সাম্প্রতিক বাংলা থ্রিলারের সুলুকসন্ধান

সাম্প্রতিককালে বাংলা সাহিত্য, সিনেমা, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সিরিজ – সর্বত্রই গোয়েন্দা গল্প ও থ্রিলারের জনপ্রিয়তা বেশ চোখে পড়ে। ব্যোমকেশ, ফেলুদা, কাকাবাবু প্রমুখ গোয়েন্দারা যেমন সিনেমা, ওয়েব সিরিজে পুনঃনির্মিত হচ্ছেন, তেমনি লেখা হচ্ছে নানা নতুন ক্রাইম থ্রিলার। সেসব নিয়ে চর্চার পরিসরও বাড়ছে। সংবাদপত্রের পাতায় তো বটেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমেও গোয়েন্দা গল্প ঢুকে পড়েছে। তাই নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে মূল্যবান গবেষণাপত্র।

এই সেদিন অবধিও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মূলত ক্লাসিকই পড়ানো হত, কিন্তু সম্প্রতি ভাবনাচিন্তা ও সিলেবাসেও এসেছে বদল। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থ্রিলার, গোয়েন্দা গল্প, কমিকস, কার্টুন ইত্যাদিকেও স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরে সাহিত্যের পাঠক্রমে নিয়ে এসেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক অ্যাকাডেমিক পরিসরের বাইরেও নানা কাজ হচ্ছে এইসব নিয়ে। অনেক ছোট পত্রিকা নিষ্ঠার সঙ্গে এইসব নিয়ে চর্চা করছেন। শুধু সায়েন্স ফিকশনের জগৎ নিয়েই ধারাবাহিকভাবে কাজ করছেন কল্পবিশ্ব নামের একটি পত্রিকাগোষ্ঠী। দীপন পত্রিকার তরফে বাংলা কার্টুনের নানা দিক নিয়ে প্রকাশিত একটি ব্যতিক্রমী সংখ্যা বেশ সাড়া ফেলেছিল।

আমাদের এই আলোচনা বাংলা গোয়েন্দা গল্প বা থ্রিলারের ইতিহাস নিয়ে নয়। একেবারে সাম্প্রতিক কালের, বলা ভালো গত দশ বছরের মধ্যে প্রকাশিত থ্রিলার বিষয়ক কিছু অনুসন্ধান। সে অনুসন্ধানও পার্শ্বিক। অসংখ্য লেখক এই সময়ে থ্রিলার লিখেছেন। ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রকাশন সংস্থাগুলির বাইরেও নতুন নতুন অনেক প্রকাশন সংস্থা নিয়মিত থ্রিলার প্রকাশ করে যাচ্ছেন। সেই সবের সামগ্রিক পরিচয় এই লেখায় দেবার চেষ্টা করা হয় নি। বেছে নেওয়া হয়েছে কয়েকটি বহুচর্চিত লেখা। সেগুলির মধ্যে ফুটে ওঠা প্রবণতাগুলিকে খানিকটা বিস্তারিতভাবেই বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

শুরুতেই গোয়েন্দা গল্প ও থ্রিলার – এই দুই কাছাকাছি জঁরের মধ্যেকার একটা পার্থক্য বলে রাখা যাক। গোয়েন্দা গল্প সাধারণভাবে অতীতে ঘটে যাওয়া কোনও খুন বা এ জাতীয় অপরাধের ঘটনার উৎসে পৌঁছতে চায়, খুনি বা অপরাধীকে খুঁজে বের করতে চায়, খুন বা অপরাধের মোটিফ আবিষ্কার করতে চায়। কোনাল ডয়েলের শার্লক হোমস সিরিজের গল্পকে আমরা উদাহরণ হিসেবে ভাবতে পারি। অন্যদিকে থ্রিলার জাতীয় রচনা সম্ভাব্য কোনও গণহত্যা বা বড়সড় অপরাধ, খুন ইত্যাদি আটকানোর চেষ্টা করে। এর নেপথ্যে পুরনো কোনও খুন বা অপরাধের ঘটনা থাকলেও মূল জোরটা থাকে আরো বড় কোনও অপরাধকে আটকানো বা অপরাধের সিরিয়ালকে থামানোর দিকে। সাম্প্রতিককালের অন্যতম বেস্ট সেলার রচয়িতা ড্যান ব্রাউনের রবার্ট ল্যাংডন সিরিজের ইনফার্নোর মত উপন্যাসের কথা আমরা এই প্রসঙ্গে ভাবতে পারি।

বাংলায় একসময় ডিটেকটিভ গল্পই বেশি লেখা হয়েছে। শরদিন্দুর ব্যোমকেশ বা সত্যজিতের ফেলু্দার এই ধরনের গল্প উপন্যাস জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থানে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। অন্যদিকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু সিরিজের অনেক কাহিনিই ক্রাইম থ্রিলার – সেখানে অতীত অপরাধ বা খুনের কিনারার চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায় আসন্ন অপরাধকে আটকানো।

সাম্প্রতিককালে বাংলায় ডিটেকটিভ গল্পের বদলে থ্রিলার লেখার চলই বোধহয় বেশি। ডিটেকটিভ গল্পে একজন সরকারী বা বেসরকারী গোয়েন্দা সাধারণত মুখ্য চরিত্র হিসেবে থাকেন। ক্রাইম থ্রিলারেও একজন ডিটেকটিভ মুখ্য চরিত্র হতে পারেন, কিন্তু প্রথাগত গোয়েন্দা ছাড়াও নানা বিশেষজ্ঞ সমন্বিত একটি টিম থ্রিলারে একযোগে কাজ করতে পারে। বিশেষত আধুনিক থ্রিলারে এর প্রয়োজনিয়তা বাড়ছে, কারণ নানা ধরনের প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এখন অপরাধ সংগঠনের ক্ষেত্রে অপরাধী নেটওয়ার্কগুলি ব্যবহার করছে। তাকে আটকানোর জন্যও গুপ্তচর, গোপন ল্যাঙ্গুয়েজের কোডব্রেকার, কম্পিউটার হ্যাকার, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, ডিজিটাল সার্ভিলেন্স টিম – এসবের দরকার পড়ছে। বিখ্যাত ক্রাইম থ্রিলারগুলি কত গবেষণা করে লেখা হয়, তা যারা ড্যান ব্রাউনের আখ্যানগুলি পড়েছেন সহজেই বুঝতে পারবেন।

এবার চলে আসা যাক বাংলার এই সময়ের কিছু থ্রিলার লিখিয়ে ও তাদের কয়েকটি থ্রিলার নিয়ে আলাপ আলোচনায়।

দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের ‘অঘোরে ঘুমিয়ে শিব’

বাংলার নতুন থ্রিলার লেখকদের লেখার সন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেল এই সময়ের রাজনীতির পালাবদলের ছাপ বাংলা থ্রিলারের ওপর ভালোই পড়েছে। রাজনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি সমাজ সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও হিন্দুত্বের রাজনীতির প্রভাব অনেক বেড়েছে। বাংলা সাহিত্য, বিশেষ করে পপুলার সাহিত্যের বিশ্লেষণ করতে গিয়েও এটা আমরা টের পাই। আমরা প্রথমে এমন একটি সাম্প্রতিক থ্রিলারের কথা এখানে আলোচনা করব, যার সম্পর্কে হিন্দুত্ববাদ, ইসলামোফোবিয়া ইত্যাদির অভিযোগ এসেছে। বিষয় নির্বাচন থেকে আখ্যানের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া বার্তা – এইসব সূত্র ধরে এর বিচার বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

সাম্প্রতিককালে একটি বাংলা থ্রিলার নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছে। দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের এই থ্রিলারটির নাম ‘অঘোরে ঘুমিয়ে শিব’। থ্রিলারটির বিষয়বস্তু হল তাজমহল আদতে তেজোমহালয়া নামের এক শিব মন্দির ছিল কীনা, তাই নিয়ে সৃষ্ট উত্তেজনা। বইয়ের ভূমিকায় দেবারতির একটা স্বলিখিত সাফাই আছে, যেখানে তিনি বলতে চান রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক চাপান উতোরের বাইরে একটি মনগড়া আখ্যান হিসেবেই তিনি এটি লিখেছেন। এটা লেখার ভাবনা তাঁর মাথায় এসেছে পি এন ওকের লেখা বই পড়ে। দেবারতির এই থ্রিলারে আমরা দুজন ইতিহাস গবেষকের কথা পাই। একজন অঘোরেশ ভাট আর অন্যজন ড নিজামুদ্দিন বেগ। এই দুজনে আলাদা আলাদা পথে এবং গোপনে পরস্পরের সঙ্গে সাহচর্য রেখে গবেষণা করেন ও সেই গবেষণা সূত্রে সিদ্ধান্তে আসেন যে তাজমহল আদপে সাজাহানের বানানো কোনও স্মৃতিসৌধ নয়। আটশো বছর আগে চান্দেল রাজারা এটা বানিয়েছিলেন এবং এটা ছিল এক শিবমন্দির ও প্রাসাদ। পরে এটি আসে রাজা মানসিংহের হাতে এবং তারপর তাঁর পৌত্র জয়সিংহের হাত থেকে সাজাহানের হাতে। এই অদ্ভুত তত্ত্বের জনক পি এন ওক, যিনি তাঁর হিন্দুত্ববাদী ও ইসলামোফোবিক প্রতিপাদ্যগুলির জন্য শুধু একজন বিতর্কিত ‘ইতিহাসচর্চাকারী’ নন, অবিশ্বাস্য প্রলাপকথক হিসেবেই বেশি পরিচিত হন। ওকের অনেক প্রলাপের মধ্যে তাজমহল হিন্দু মন্দির ছিল, এই দাবি ছাড়াও রয়েছে রোম শহরের নাম রামচন্দ্রের নামে বা মক্কার কাবা হিন্দু মন্দির ছিল – এই সব আশ্চর্য ‘মণিমানিক্য’। এ হেন পি এন ওকের বই পড়ে দেবারতি কেন এই আখ্যান লিখতে গেলেন এবং তাঁর আখ্যানে একে কেবল একটি বিতর্কিত মত হিসেবে রাখলেন না, আখ্যানের প্রোটাগনিস্টদের দিয়ে এটিকেই সত্য ইতিহাস, চেপে রাখা ইতিহাস বলে স্বীকৃতি দিলেন – তাই নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা স্বাভাবিক ভাবেই হয়েছে। পি এন ওকের হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডাতেই এই থ্রিলার লেখা হল কিনা, তাই নিয়ে সন্দেহও জোরালো হল এই উপন্যাস প্রকাশের পর থেকেই।

শুধু যে একটি উত্তেজনাপ্রবণ মিথ্যাকে মিথ হিসেবে বাছার জন্য দেবারতির এই থ্রিলার সমালোচনাযোগ্য তা নয়, থ্রিলারের কারুকৃতির দিক থেকেও এর দুর্বলতা অনেক। প্রথমেই যেটা বলা দরকার থ্রিলারের উপযুক্ত সাসপেন্স দেবারতি কখনোই এখানে তৈরি করতে পারেন নি। রুদ্র প্রিয়ম নামে একটি সিরিজ আছে দেবারতির। সেখানে রুদ্রাণী ও তার স্বামী প্রিয়ম নানা রহস্যের কিনারা করেন। এই সিরিজের এটি তৃতীয় আখ্যান। আখ্যান যখন শুরু হয় তখন রুদ্রাণী আগ্রার এক প্রাইভেট ব্যাঙ্কের এক ব্রাঞ্চের ম্যানেজার। আর প্রিয়ম অফিসের কাজে লন্ডনে। রুদ্রাণীর ব্রাঞ্চের এক ক্লায়েন্ট, অঘোরেশ ভাটের অ্যাকাউন্টে প্রচুর টাকা জমা পড়ে। নিয়মানুসারে তা ব্যাঙ্কের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানানোয় রুদ্রাণীকে শো কজ করা হয়। পুলিশও কিছু হুমকি পোস্টার ও অন্যান্য সূত্রে খবর পেয়ে ঘটনার তদন্ত শুরু করে। ক্রমশ জানা যায় তাজমহল নিয়ে বিতর্কিত দাবি করছে একদল লোক এবং তাজমহলে নাশকতা হতে পারে বলে পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ মনে করছে। এত টাকা অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার হওয়ার সঙ্গে এই নাশকতা প্রচেষ্টার যোগ থাকা সম্ভব।

ঘটনার এই পর্বে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রুদ্রাণীর বাবা মা সুরঞ্জন ও পূরবী কলকাতা থেকে আগ্রায় আসেন মেয়ের কাছে কদিন থাকার জন্য। তাদের চমকে দিতে লন্ডন থেকে কাউকে কিছু না জানিয়ে আগ্রায় আসে রুদ্রাণীর স্বামী প্রিয়মও।

আগ্রা শহর জুড়ে বেশ কিছু পোস্টার পড়ে যার মূল কথা হল আগ্রার হিন্দু অতীতকে ফিরিয়ে দিতে হবে। ওয়াইসি নামের একজন মুসলিম বিধায়কের ঘনিষ্ট অনুগামী গুল মহম্মদকে খুন করা হয়, সন্দেহের নিশানায় থাকে হিন্দুত্ববাদীরাই। বস্তুতপক্ষে হিন্দুত্ববাদ ও তার প্রচারের নানাকথা ও কার্যকলাপ এই উপন্যাসের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। উপন্যাসটি যেন একালের হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডার সমূহের নির্যাসের ওপর দাঁড়িয়েই নির্মাণ করতে চেয়েছেন দেবারতি।

হিন্দুত্ববাদী প্রচারের একটা অংশে বলা হয়ে থাকে যে প্রাচীন হিন্দুরা গণিতশাস্ত্রে যে সব আবিষ্কার করেছিলেন, সেগুলির অনেক কিছুরই স্বীকৃতি তারা পান নি। পাই এর মান বা পিথাগোরাসের উপপাদ্য আসলে প্রাচীন হিন্দুদেরই আবিষ্কার। পিরামিড তৈরি হয়েছিল হিন্দু গণিতশাস্ত্রের সাহায্যেই। এই থ্রিলারেও এইসব দাবিকে নানা সংলাপে বর্ণনায় তোলা হয়েছে। দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে মন্দির স্থাপত্যের মধ্যে এইসব গণিতজ্ঞানের ফলিত প্রমাণ রয়েছে।

ধর্মান্তর হিন্দুত্ববাদীদের একটি বিশেষ অ্যাজেন্ডা। একদিকে বলা হয় লাভ জেহাদের কথা, যেখানে মুসলমান যুবকরা নাকী হিন্দু মেয়েদের আকৃষ্ট করে বিয়ে করে, অবশ্যই ধর্মান্তরের পরে। অন্যদিকে এখানে আগ্রার যে পুলিশ প্রধানকে দেখানো হয়েছে সেই নাহুম খান ছিলেন এক হিন্দু। কলেজের মুসলিম সহপাঠীর প্রেমে পড়ে তিনি ধর্ম, পৈতে ও কুল ত্যাগ করে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেন ও সেই সহপাঠিনীকে বিবাহের অধিকার পান। এই আখ্যানে রয়েছে একটি হিন্দু সংগঠনের মুসলিমদের টাকা দিয়ে হিন্দু করার কথাও, যে প্রকল্পের জনপ্রিয় নাম ঘরওয়াপসি। এদেশের মুসলিমরা মূলত ধর্মান্তরিত হিন্দু, তাদের আবার হিন্দু ধর্ম ও সমাজে ফিরিয়ে আনাটাকে তাই অনেক হিন্দু সংগঠন সমীচীন বলে মনে করে। আখ্যানে দেখানো হয়েছে এই কাজ যিনি করেন সেই গুরুজী আসলে দিল্লির এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ তথা সাংসদ। তাঁর নাম নাগেশ সিং, মান সিংহ ও জয় সিংহের উত্তরপুরুষ।

হিন্দুত্ববাদীদের জনপ্রিয় এক প্রচারের কথাও এখানে এসেছে সন্তান দলের প্রধান গুরুজীর বক্তৃতার সূত্রে। যে সব মুসলিমদের ধর্মান্তরকরণ করা হয়েছে তাদের নিজ সভ্যতা সংস্কৃতি সম্পর্কে গর্ব বোধ জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যেই গুরুজী ভিডিও বক্তৃতার আয়োজন করেন। সেখানে বলা হয় যে সভ্যতার সূচনা হয়েছিল এই ভারতেই, সরস্বতী নদীর ধারে। তারপর সরস্বতী নদী ক্রমশ শুকিয়ে গেলে সেই সভ্যতা ক্রমশ পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে ও পৌঁছয় আরব ও মেসোপটেমিয়ার দিকে। হিন্দুত্ববাদীদের প্রচারযন্ত্রের একটি প্রধান দিক হল আর্য আগমন তত্ত্বকে নস্যাৎ করা ও তার বিপরীত ভাষ্য রচনা করা। ইতিহাসবিকৃতির নিদর্শন এই থ্রিলারের চরিত্ররা প্রায় প্রতিটি পাতাতেই রেখে যায়। গুরুজীর ভাষণে তার কয়েকটি প্রধান নিদর্শন ধরা রয়েছে।

গুরুজী সত্তাটিকে আড়ালে রেখেই নাগেশ সিং তার রাজনৈতিক কাজকর্ম চালান বটে,কিন্তু নিজের হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডাকে আড়াল তিনি সেখানেও করেন না। বস্তুত সে কারণেই বোধহয় তিনি রাজধানীতে শাসক দলের সাংসদ হতে পেরেছেন। নিজামুদ্দিন বেগ যখন তাজমহলকে তেজোমহালয়া মন্দির বলে লেখালিখি শুরু করেন এবং এই নিয়ে বিতর্ক ওঙ্গুত্তেজনা দেখা যায়, তিনি নিজামুদ্দিনকে সমর্থন করেন। শুধু তাই নয় তার ওপর মুসলিমদের আক্রমণ রুখতে নিজের গোপন আস্তানাতেও তাকে নিয়ে যান। তবে তার উদ্যোগে আয়োজিত বহুদেশীয় শান্তি সম্মেলনকে ভেস্তে দিতে তাঁর মেয়ে উজ্জয়িনীকে অপহরণ করা হয়, তাজমহলে নাশকতার ছক যারা কষে তাদের ই একজন তাঁর সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে তাঁর সব গোপন খবর ও গতিবিধি পাচার করে দিতে থাকে।

তাজমহলে যারা নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা করে তারা হিন্দুত্ববাদী বা ইসলামিস্ট – কেউই নয়। তারা হল অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী। আগ্রায় নাগেশ সিং যে শান্তি বৈঠকের আয়োজন করেছেন ও যাতে বিবাদমান কয়েকগুচ্ছ দেশ যোগ দিতে রাজী হয়েছে, তাকে ভেস্তে দিতে না পারলে এই অবৈধ অস্ত্রব্যবসায়ীদের কাজ কারবার বন্ধ হয়ে যাবে। কেননা বিবাদমান দেশগুলির বিবাদ জনিত সংঘর্ষই অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের বিক্রিবাটার মূল জায়গা। এই সম্মেলনকে ভেস্তে দেবার জন্য আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসায়ীরা অস্ত্র জোগাড় করে স্থানীয় অস্ত্র ব্যবসায়ীদের থেকে। মূলত বিহারের মুঙ্গেরে তাদের ডেরা, তবে কলকাতা ও অন্যত্রও শাখা রয়েছে এবং তৈরি হচ্ছে।

দেবারতির এই থ্রিলার শুধু হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডার কারণেই সমালোচনাযোগ্য নয়, এর থ্রিলার অংশটির দুর্বলতাও ভয়াবহ। তাজমহলের মতো সুরক্ষা বলয়ে মোড়া সৌধকে বিস্ফোরণে গুঁড়িয়ে দেবার জন্য তারা গোপন সুড়ঙ্গের হদিশ নিয়েছে ও সেখানে বিস্ফোরক মোতায়েন করেছে – এই অংশটি এত দুর্বলভাবে উপস্থাপিত যে তা পাঠকের বিশ্বাস উৎপাদন করতে পারে না। কেন নাগেশ সিং এর ব্যক্তিগত উদ্যোগে আয়োজিত এক সম্মেলনে এত জোড়া বিবাদমান দেশ হাজির হবে, কেনই বা একটি অসরকারী সম্মেলনে তারা চুক্তি সাক্ষর করে তাদের মধ্যেকার যুদ্ধে ইতি ঘটাবে – তার কোনও বিশ্বাসযোগ্য উপস্থাপণ এই আখ্যানে দেবারতি ঘটাতে পারেন নি। অতীতের অসংখ্য প্রাসাদ ও সৌধে সুড়ঙ্গ থাকত এবং সেটা থাকাই ছিল নিরাপত্তাসূত্রে সাধারণ নিয়ম। সেই স্বাভাবিকতাকে একদিকে তাজমহলের শান্তি সম্মেলন ও অন্যদিকে তাজমহলের পূর্বতন মন্দির মিথের সঙ্গে মেলানোর যৌথ চেষ্টা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য হয় নি।

তাজমহল তেজোমহালয়া ছিল – এই বিষাক্ত ও উদ্দেশ্যমূলক বিতর্ককে ভিত্তি করে এই থ্রিলার দেবারতি না লিখলে, শুধুমাত্র থ্রিলার অংশের কারণে তা পাঠক সমালোচকের মনযোগ বা আলোচনাবৃত্তে উঠে আসত না বলেই মনে হয়।

প্রীতম বসুর পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল

দেবারতির ‘অঘোরে ঘুমায়ে শিব’ এ অতীত হিন্দুদের গাণিতিক দক্ষতার কথা এসেছে। সেই দক্ষতার প্রমাণ চেপে দেওয়ার নানা চেষ্টার কথাও এসেছে। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই সাম্প্রতিককালে বাংলার অন্যতম বিশিষ্ট একটি থ্রিলার লেখা হয়েছে। অতীত গৌরবের অতিকথন ও সেই সূত্রে হিন্দুত্ববাদের ছায়া পড়ার অভিযোগ প্রীতম বসুর থ্রিলার ‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’ সম্পর্কেও উঠেছে বটে, কিন্তু মানে ও জাতে তা অনেক আলাদা। সাম্প্রতিক কালে লেখা বাংলা থ্রিলারগুলির মধ্যে একে অন্যতম প্রধান হিসেবেই গ্রহণ করতে হবে। আমরা তাই একটু বিস্তারেই এটি নিয়ে কথা বলতে চাইবো।

আকর্ষনীয় কাহিনি বিন্যাস নিঃসন্দেহে পঞ্চাননমঙ্গল এর আবিষ্কার ঘিরে এখানে দানা বেঁধে উঠেছে, কিন্তু সেটাই এই বইয়ের প্রধানতম আকর্ষণ নয়। আমাদের হারানো অতীতের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, যা ইউরোপের চোখে জগৎ দেখার বাইরের এক নিজস্বতাকে খুলে দিতে চায়, তাকে আমরা এই আখ্যানে পেয়ে যাই। কীভাবে লেখা হত পুঁথি, কেন কাগজ ব্যবহারে আমাদের এখানে অনেক লিপিকরের দীর্ঘদিনের আপত্তি ছিল, তুলোট পাতা আর তালপাতার পুঁথির পার্থক্য কোথায়, কাহিনির অন্তর্গত উপাদান হিসেবেই প্রীতম আমাদের তা জানিয়ে দেন। তুলে আনেন বাংলা বর্ণমালার বিবর্তন সূত্রটি। এই আখ্যানের অন্যতম প্রধান দুটি চরিত্রই সারা জীবন ধরে পুরনো সাহিত্য নিয়ে দুভাবে কাজ করেন – সদানন্দ ভট্টাচার্য ও হরু ঠাকুর। প্রথমজনের যদি পারিবারিক ব্যবসা ও নেশা আগ্রহের সূত্রে জহুরীর চোখ তৈরি হয়ে থাকে তো দ্বিতীয় জনের রয়েছে পুঁথি নকলের ও পুঁথি দেখার প্রাতিষ্ঠানিক তালিম। সেইসঙ্গে স্বাভাবিক কবিত্ব যা সহজেই ধরে নিতে পারে পুরনো সাহিত্যের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গীটিকে।

সাহিত্যের অগণিত পাঠকের মধ্যেই কেউ কেউ জহুরী। তাঁরাও অন্যান্যদের মতো পড়েন সাহিত্য, কিন্তু কেবল গল্পের টান বা ছন্দের তানের আকর্ষণে নয়। তাদের নজর চলে যায় সৃজনের অন্দরমহলের দিকে। পুঁথির পাতায়, অক্ষর বিন্যাসে। প্রাচীন বা মধ্যযুগের সাহিত্যের প্রামাণিকতা নিয়ে আলাপ আলোচনায় এগুলি অত্যন্ত জরুরী হয়ে ওঠে সে আমরা জানি। আর এও জানি সাহিত্যের জহুরীদের এইসব পণ্ডিতি আলোচনা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম পেরিয়ে খুব কমই সাধারণ পাঠকের দোরগোড়ায় কড়া নাড়ে। কিন্তু কখনো কখনো একটা ব্যতিক্রম তৈরি হয়ে যায়। প্রীতম বসুর মতো প্রবাসী বাঙালি যখন ডুবুরীর মতো ভাষা সাহিত্যের সেই পণ্ডিতি গবেষণার উপাদানকে ব্যবহার করে রোমহর্ষক এক থ্রিলার তৈরি করে দিতে পারেন পাঁচমুড়ার পঞ্চাননমঙ্গলের মতো উপন্যাসে।

বস্তুতপক্ষে হরু ঠাকুরের আড়াল থেকে লেখক প্রীতম বসু নিজেই এখানে একটি পরীক্ষায় নেমেছেন। চর্যাপদের ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মাঝের সময়ের বাংলা ভাষাটি, যার কোনও প্রামাণ্য উপাদান আমাদের হাতে এসে পৌছয় নি অন্ধকার যুগের আড়াল ভেদ করে, সেই ১৪০০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ বাংলাভাষার রূপটি কেমন ছিল। গদ্য আখ্যানের পরতে পরতে মধ্যযুগের পুননির্মিত সেই ভাষায় দীর্ঘ দীর্ঘ পদ্য অংশ মিশিয়ে দেন প্রীতম, বিশেষত কাহিনির মধ্যভাগ থেকে। আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি দক্ষ আখ্যানকার প্রীতমের মধ্যেই কীভাবে মিশে আছে এক ভাষা গবেষক, ছন্দ বিশ্লেষক নিপুণ কবি।

বস্তুতপক্ষে ‘ছিরিছাঁদ’ এর লেখক প্রীতম বাংলা ও সংস্কৃত ছন্দ নিয়ে কতখানি দক্ষ তার প্রমাণ এই আখ্যানের কয়েকটি চকিত মুহূর্তেও আছে। চর্যাপদের চৌপদীর থেকে বাংলা পয়ারের আদি পর্বের নির্মাণটিই শুধু নয়, সংস্কৃত কয়েকটি ছন্দের নিপুণ বিশ্লেষণ তিনি এখানে তুলে আনেন। এখানে আছে তোটক, তূণক, ভুজঙ্গপ্রয়াত প্রভৃতি ছন্দের দৃষ্টান্ত ও আলোচনা।  প্রীতম একটি প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু উত্তর দেন নি। সংস্কৃতে অন্তমিল নেই, বাঙালি তা পেল কোথা থেকে ? হয়ত মুণ্ডা ভাষার আলোচনা ও বাংলার ওপর তার প্রভাব থেকে এই প্রশ্নের উত্তরের দিকে এগনো যায়। তবে সে অন্য প্রসঙ্গ।

পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গলের কাহিনিটি আকর্ষণীয়।

“সদানন্দ ভট্টাচার্য পাঁচমুড়ো গ্রামের সঙ্গতিহীন জমিদার। বাংলার প্রাচীন সাহিত্য, বিশেষ করে নানা ধরনের পুঁথি নিয়ে তার গভীর চর্চা আছে। মিঃ ধাড়া নামে একজন বিদেশ থেকে আসেন তাঁর কাছে। তিনি সদানন্দকে জানান যে লন্ডনে তাঁর একটা মিউজিয়াম আছে, সেখানে তিনি বাংলা সাহিত্যের পুরোনো নানা পুঁথি সংগ্রহ করে রাখেন। এই পুঁথি সংগ্রহের ব্যাপারে তিনি সদানন্দের সাহায্য চান। কালাচাঁদ নামে এক পুঁথি চোর ধাড়াকে চণ্ডীদাসের এক নকল পুঁথি বিক্রী করতে এসেছিল। সদানন্দের জহুরী চোখ ধরে ফেলে যে সেটা নকল পুঁথি। সদানন্দ যখন পুঁথির আসল নকল কীভাবে বোঝা যায় সেটা ব্যাখ্যা করে বোঝাচ্ছেন, সেইসময় খবর পাওয়া যায়, পাঁচমুড়ো গ্রামের প্রায় মজে যাওয়া পুকুর চয়নবিলের নীচে থেকে নাকি কিছু পাথর পাওয়া গেছে। পাথরগুলোতে পুরোনো কিসব অক্ষর খোদাই করে নানাকিছু লেখা আছে। সদানন্দ দ্রুত সেখানে পৌঁছলেন। পাথরের ওপর খোদাই করা লেখা পড়লেন এবং এর পর তার মধ্যে কেন্দ্র করে প্রবল উত্তেজনা তৈরি হল। তিনি অভিজ্ঞ চোখে বুঝে গেলেন এই পাথরগুলো পঞ্চাদশ শতাব্দীর বাংলা ভাষায় লেখা। পঞ্চাননমঙ্গল নামের এক অনন্য লুপ্ত রচনার অংশবিশেষ। এখানে অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মতো দেবমহিমা কীর্তন করা নেই। এর ছন্দের মধ্যে লুকানো আছে অঙ্ক। জালালুদ্দিনের সময়ের পঞ্চমুন্ডি গ্রামের ইতিহাসের ওপর ভর করে এগিয়েছে এর কাহিনি। আবার পঞ্চদশ শতক থেকে মাঝে মাঝে ফিরেছে বর্তমান কালে।

পঞ্চাননমঙ্গল এর কাহিনির অন্যতম আকর্ষণের দিক প্রাচীন ভারতের গণিত চর্চার মণিমুক্তোগুলিকে তুলে আনতে পারা। যে কৃতিত্ত্ব আমাদের বিজ্ঞানীদের পাওয়া উচিত ছিল, অনেক সময়েই তাঁরা তা পান নি। আর্যভট্ট বা ব্রহ্মগুপ্তদের আবিষ্কারগুলি আরবীয় অনুবাদের হাত ধরে পশ্চিমী জগতে পৌঁছেছে। কিন্তু সে ইতিহাসের অনেকটাই আড়ালে ঢাকা। প্রীতম বসু আমাদের সেই ইতিহাস এখানে আখ্যানের ফাঁকে ফাঁকে জানিয়ে দিতে চান। আটশো শতাব্দীর শেষভাগে ভারতীয় পণ্ডিতের হাত ধরে ভারতের সুপ্রাচীন গণিতবিদ্যা পৌঁছোয় বাগদাদের রাজসভায়, আরবিতে অনুবাদ করা হয় সেই পুঁথিগুলির। সেই সূত্রেই পরবর্তীকালে অল-খোয়ারিজমি ‘ভারতের সংখ্যা দিয়ে গণনাপদ্ধতি ব্যবহার করে “অ্যালগরিদম”এর জনক হিসাবে পশ্চিমী দুনিয়ার কাছে পরিচিত হন। (অল-খোয়ারিজম এর অপভ্রংশই আজকের অ্যালগরিদম)। আর তারপর নানা আফগানী তুর্কি আরবী শাসক, যাদের অন্যতম বক্তিয়ার খিলজি - ভারতের গর্ব নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্রমণ করেন এবং সুপরিকল্পিতভাবে তিন মাস ধরে পোড়ান হয় ভারতের মহামূল্যবান পুঁথিসমূহকে, যাতে কিনা ভারতের একান্ত নিজস্ব গণিতবিদ্যা আবিষ্কারের উজ্জ্বল ইতিহাস কালের গর্ভে চিরকালের মতো নিমজ্জিত হয়। আমরা জানতে পারি না অনেক আগেই ভারতে জানা হয়ে গিয়েছিল আলোর গতিবেগের পরিমাপ, 'পাই'-এর মান, অ্যালজেব্রা, ত্রিকোণমিতি, দশমিকের ব্যবহার, তথাকথিত ‘পিথাগোরাসের থিওরেম’ – পিথাগোরাসের জন্মের দুশো বছর আগেই।

এই গণিত চর্চার ইতিহাস যেমন আমরা জানি না, ঠিক তেমনি আজকের বাঙালি সেভাবে জানেন ই না আমাদের এই বাংলা নৌ নির্মাণ থেকে কামানের ব্যবহারে কত দক্ষ ছিল। চিনের নৌ নির্মাতারা যেমন আসতেন এই দেশে, তেমনি এদেশের যুদ্ধে প্রথম কামান ব্যবহারের গৌরব যিনি পেয়ে থাকেন সেই বাবর স্বয়ং কীভাবে তাঁর আত্মজীবনীতে বাঙালির কামান চালানোর দক্ষতার প্রশংসা করে গেছেন।

এই লেখা শুধু আমাদের অতীতের জন্য গর্বকেই জাগিয়ে তুলতে চায় না। সেই অতীত কীভাবে আরবীয় তুর্কী মুসলমান শক্তির হাতে ধ্বংস হল সেই মনস্তাপও তৈরি করে। এই জন্যেই এই লেখা নিয়ে সতর্ক হবার অবকাশ আছে। ইতিহাসের বদলার রাজনীতি, যা আমরা রাম মন্দির আন্দোলনে বাবরি ভাঙার ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রত্যক্ষ করেছি, তা যেন পপুলার ফিকশান বা কল্পকাহিনির স্বাধীনতার নামে জন্ম নিতে না পারে যেন সেটা স্বাধীন লেখকের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিচারের গুরুত্বপূর্ণ দিক। সম্ভবত লেখকও এই বিপদটি সম্বন্ধে খানিকটা সতর্ক থাকতে চেয়েছেন। তাই আমরা দেখি পঞ্চানন এর মন্দিরটি একদিনের মধ্যে অনেক সহকারী জুটিয়ে তৈরি করে দেন যে কুশলী কারিগর, তিনিও এক মুসলমান। তার পূর্বপুরুষদের মন্দির ভাঙার প্রায়শ্চিত্ত যেন তিনি এই কাজের মধ্যে দিয়ে করে যান। পারিশ্রমিক গ্রহণ করেও তা ফিরিয়ে দিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের নজির রাখেন। ইতিহাসের বিতর্ক বর্তমানে উত্তেজনা ও বিদ্বেষের রাজনীতি তৈরির কাজে যেন ব্যবহৃত না হয়, সেটা আখ্যানকাররা মনে রাখলে তা সম্প্রীতির সংস্কৃতির পক্ষে সুখকর।

বাঙালির অতীত মনন চর্চার ইতিহাস এখানে আছে, আছে বিদেশী শক্তির হাতে পর্যদুস্ত হয়ে সেই ইতিহাসকে হারিয়ে ফেলার মনস্তাপও। আর রয়েছে নিজের শিকড়ে ফেরার টান। মন্দিরের চাতালে কবিগান, ঝুমুর গান, আখড়ার সংস্কৃতি ফিরে পাওয়ার আগ্রহ। বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এমন নান্দনিক উপস্থাপণা বাংলা কথাসাহিত্যের অঙ্গনে কমই হয়েছে। তাই এটি থ্রিলার হিসেবেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকে না, পাঠকের রোমাঞ্চ চাহিদা মিটিয়েই তাকে নিজের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যের প্রতি সজাগ ও শ্রদ্ধাবনত করে দেয়। এই কাজটি শুধু থ্রিয়ার লেখকের নয়, এক মহৎ আখ্যানকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের।

প্রীতম বসুর চৌথুপীর চর্যাপদ

চৌথুপীর চর্যাপদ প্রীতম বসুর দ্বিতীয় আখ্যান, যেখানে তিনি পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল এর পরে আরেকবার বাঙালি জীবনের এক উতরোল সময়ক্ষণের পুনঃনির্মাণে প্রয়াসী হলেন। পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গলের মতো এই আখ্যানেও প্রাচীন সাহিত্যকীর্তি ও পুরাতাত্ত্বিক সামগ্রী আবিস্কারের সূত্রে একটি থ্রিলারের জন্ম দেন কথক। এখানেও পঞ্চাননমঙ্গলের মতোই দুটি ভিন্ন সময়ের আখ্যান দ্বিবেণীবদ্ধ হয়ে এগিয়ে চলে। পঞ্চাননমঙ্গলে যদি থেকে থাকে বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষাভঙ্গীতে লেখা কাব্য অংশ তো এখানে রয়েছে আরো প্রাচীন চর্যাপদের আদলের পদাবলী। পঞ্চাননমঙ্গলের প্রাচীন আখ্যানটির বাইরের আদলটিই যেমন শুধু কাব্যের আর ভেতরে রয়েছে গণিতের নানা সূত্র, তেমনি এখানেও পদাবলিগুলি জ্যোতির্বিজ্ঞান,নানা ওষধি ও ভেষজ শাস্ত্রের আকর। চৌথুপীর চর্যাপদ লেখকের পরবর্তী উপন্যাস হলেও এর সময়কাল পঞ্চাননমঙ্গলের চেয়ে অন্তত দুশো বছরের পুরনো। পঞ্চাননমঙ্গলের প্রাচীন আখ্যানটির সময়কাল পঞ্চদশ শতকের প্রথম ভাগ আর চৌথুপীর চর্যাপদের ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়া, যখন বাংলায় তুর্কি আক্রমণ সদ্য শুরু হয়েছে। বস্তুতপক্ষে তুর্কি আক্রমণে বিধ্বস্ত বাংলার ছবিটা দুটি আখ্যানেই আমরা পাই, পাই সেই বিপর্যয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ধ্বংসের হাত থেকে নিজের অতীত ইতিহাস জ্ঞান বিজ্ঞানকে রক্ষার মরীয়া চেষ্টা।

প্রীতম বসুর দুটি আখ্যানই ইতিহাসের পুনঃনির্মাণের প্রয়োজনে যথেষ্ট গবেষণার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। আবার এই গবেষণাই কোথাও কোথাও লেখককে প্রলুব্ধও করেছে আখ্যানের গতিকে থামিয়ে তথ্য পরিবেশনে। বিশেষ করে চৌথুপীর চর্যাপদের সাম্প্রতিক সময়ের আখ্যান অংশটির চরিত্র পাত্ররা জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে চরম সঙ্কটজনক কিছু মুহূর্তেও যেভাবে অতীতের তথ্য উদগীরণ করতে থাকে, তার আখ্যানগত বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রশ্ন উঠেছে এই দুটি আখ্যানেই ইসলামোফোবিয়ার উপাদান আছে কীনা তা নিয়ে। আমরা পরে এই প্রশ্নটির মুখোমুখি হব। তার আগে বলা দরকার চৌথুপীর চর্যাপদের বিশিষ্টতার জায়গাগুলি নিয়ে।

এই আখ্যানের সমকাললগ্ন যোজনগন্ধা কেন্দ্রিক আখ্যানটি মাঝে মাঝেই গতি হারিয়েছে, পট পরিবেশের ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তিও আমরা পেয়েছি মামাজীর কাছে পাত্রপাত্রীদের বন্দীদশার দীর্ঘ পর্বটিতে। এই দুর্বলতার উল্টোদিকেই রয়েছে গন্ধকালী কেন্দ্রিক প্রাচীন আখ্যানটি, যেখানে প্রীতম বৌদ্ধ পরিবেশের অসামান্য পুনঃনির্মাণ ঘটান। শুধু যে প্রাচীন অংশটির আখ্যানবিন্যাস এখানে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে তাই নয়, যুগের আবহটি ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও লেখক বিশেষ সাফল্য পেয়েছেন। আর অতি অবশ্যই বলতে হয় গন্ধকালী চরিত্রনির্মাণ প্রসঙ্গে। এক গ্রাম্য বালিকা, যার এমনকী পাঠশালায় যাবার অনুমতি পর্যন্ত মেলে নি এক সময়, সে কী করে সমকালীন জ্যোতির্বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ বিদুষী হয়ে উঠল, হয়ে উঠল ভেষজ বিষয়েও পারঙ্গম, তার নাটকীয় আখ্যান এখানে আছে। কিন্তু গন্ধকালীর বিদুষী থেরী সঞ্জীবনীতে রূপান্তরণের মধ্যে দিয়েই তার জীবনবৃত্ত শেষ হয়ে যায় নি। তিব্বতী রাজকুমার খু স্তোন এর সাহচর্যে তার চাপা থাকা নারীত্বের দিকগুলি অগ্নিস্ফুলঙ্গের মতো বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। থেরীর জীবন থেকে সে আবার সরে আসে গন্ধকালীর সাংসারিক নাম পরিচয়ে।

সমকাললগ্ন আখ্যানটির কেন্দ্রীয় চরিত্র যোজনগন্ধা পুরাতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ, ‘সিদ্ধমাতৃকা : সিক্রেট কোডস অব ট্যানট্রিকস’ নামের পুরাতত্ত্ব বিষয়ক বিখ্যাত এক বইয়ের লেখিকা। তাঁর বাবা ডক্টর বুধাদিত্য চ্যাটার্জিও ছিলেন পুরাতত্ত্বের পণ্ডিত ও আবিষ্কারক। পুরাতাত্ত্বিক আবিস্কারের নেশাতেই একসময় তাঁর প্রাণ যায়। যেখানে তিনি মারা গিয়েছিলেন সেই চৌথুপী আরেকবার উঠে আসে খবরে। একটি মূর্তি উদ্ধার ও খুনের সূত্রে। যোজনগন্ধা ক্যান্সার আক্রান্ত, তার অপারেশনের দিন নির্ধারিত হয়ে আছে। তবু এই বিশেষ জায়গাটির আকর্ষণে সে দুদিনের জন্য প্লেনে করে পাড়ি দেয় উত্তরবঙ্গের উদ্দেশ্যে। ঘটনাচক্রে এই দুদিন বেড়ে যায় দু সপ্তাহে। যোজনগন্ধা ও অন্যান্যরা মামাজী নামের এক ব্ল্যাকমেলারের হাতে বন্দী হয়। এই ঘটনাবহুল সফরকালেই হঠাৎ পাওয়া গন্ধকালীর লেখা এক চর্যাপদের পুঁথি হাতে আসে যোজনগন্ধার। সে এর পাঠে নিবিষ্ট হয়। ঘটনার নানা আবর্তে তার সহপাঠক হিসেবে আসেন তিব্বতী এক লামা, লবসাঙ চ্যোগিয়্যাল, যিনি ভেষজ বিদ্যায় ও সিদ্ধম লিপি তথা বৌদ্ধ শাস্ত্রে পারঙ্গম। উভয়ে মিলে গন্ধকালীর ‘হাজার বছরের পুরানো বাংলা ভাষায় লেখা বৌদ্ধ গান ও দোহা’গুলি আজকের ভাষায় পড়ে ফেলেন। বস্তুত গন্ধকালী কাহিনিটিই এই উপন্যাসের মূল মর্মবস্তু।

গন্ধকালী ছিলেন উত্তর বাংলার এক গ্রাম্য ধীবরের কন্যা। বাল্যে তাকে ডাকাতেরা অপহরণ করেছিল, তাই সংসারের স্বাভাবিক প্রবাহ থেকে সমাজ তাকে দূরে রেখেছিল। সেই সময়কালটা ছিল বাংলায় তুর্কি আক্রমণের প্রথম পর্ব। ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাহিনী তখন একের পর এক মন্দির, বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করছে, সেখানকার পুঁথিপত্র জ্বালিয়ে দিচ্ছে। নির্মমভাবে হত্যা করছে সেখানকার মানুষকে, তাদের ওপর জোরজুলুম করে চাপিয়ে দিচ্ছে নিজেদের ধর্ম। এই সময়েই গন্ধকালী নদীর বুক থেকে উদ্ধার করেন বৌদ্ধ আচার্য শ্রীধর পণ্ডিতকে। জ্যোতিষ শাস্ত্রের দিকপাল পণ্ডিত আচার্য শ্রীধর ছিলেন নালন্দা, বিক্রমশীল মহাবিহারের প্রাক্তন অধ্যাপক, শিলাদিত্য সঙ্ঘারামের অধ্যক্ষ।  শিলাদিত্য সঙ্ঘারাম তুর্কি আক্রমণে ধ্বংসের সময় সেখান থেকে কোনওক্রমে প্রাণ নিয়ে তিনি পালিয়ে আসেন। মৃতপ্রায় শ্রীধর আচার্যকে সুস্থ করে তোলেন গন্ধকালী ও তার বাবা চন্দর মাঝি। সেখানেই ছেলেদের পড়ানোর কাজে যুক্ত হন শ্রীধর। এমন পণ্ডিতকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে গ্রামবাসীরাও খুশি হয়। কিন্তু বিবাদ বাঁধে গন্ধকালী বিদ্যাশিক্ষায় যুক্ত হলে। মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে শ্রীধর পণ্ডিতের শাস্ত্রের নিদান ভিত্তিক যুক্তিমালাও সমাজের কিছু মুরুব্বীকে আশ্বস্ত করে নি। লোপামুদ্রা, বিশ্ববারা, সিকতা, নিভাবরি, ঘোষা, মৈত্রেয়ী, গার্গি প্রমুখ প্রায় কুড়িজন বিদুষী মহিলার রচিত স্তোত্র যে ঋকবেদে আছে – এই তথ্যকেও তারা আমল দিতে প্রস্তুত হয় নি। পরিবেশ পরিস্থিতির জটিলতা শেষপর্যন্ত গন্ধকালীকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করে। কিন্তু তার মধ্যেই শ্রীধর পণ্ডিতের শিক্ষা এবং নিজের ধীশক্তির সমন্বয় তাকে একজন পারঙ্গম জ্যোতির্বিদ করে তুলেছে অতি অল্প বয়সেই। ঘটনার বিচিত্র আবর্ত পেরিয়ে শেষমেষ গন্ধকালী নানা বাধা অতিক্রম করে এসে হাজির হয় চৌথুপী বিহারে, যা ছোট হলেও জ্ঞানচর্চার এক প্রশংসনীয় কেন্দ্র ছিল। বিশেষ করে এর জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগটি ছিল ফলিত ও তাত্ত্বিক চর্চার এক উন্নত প্রতিষ্ঠান। সে যুগের দুই শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ শান্তভদ্র ও তিব্বতী আচার্য তোন পা ছিলেন এর দুই স্তম্ভ। আর শীর্ষে ছিলেন সদ্য তরুণী গন্ধকালী, যিনি ততদিনে রূপান্তরিত হয়েছেন থেরী সঞ্জীবনীতে।

অতীতের এই মূল কাহিনীটির সঙ্গে এসে মিশেছে একটি ছোট তিব্বতী উপকাহিনীও। যেখানে আমরা দেখি তিব্বতের রাজা কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত। তিব্বতে এর চিকিৎসা নেই, কিন্তু ভারতে আছে। কুষ্ঠের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিয়েছে রাজপুত্র খু স্তোনেরও। হাজার হাজার তিব্বতবাসীও এতে আক্রান্ত। নিজের, পরিবারের ও দেশের রোগ মুক্তির উপায় খুঁজতে বিঘ্নসঙ্কুল পথ পেরিয়ে খু স্তোন হাজির হন ভারতে। পথে তার সমস্ত সঙ্গীরাই মারা যান শত্রু আক্রমণে। ভারতে আসার পথে খবর পান তার কাকা তার বাবাকে বন্দী করে নিজেই সিংহাসন দখল করেছেন। ভারতে এসে খু স্তোন শেষমেষ এসে পৌঁছন চৌথুপী বিহারে, সেখানেই তার সাথে সাক্ষাৎ হয় থেরী সঞ্জীবনীর।

চৌথুপীও তখন মহাবিপদের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত। যে কোনও মুহূর্তে তুর্কীরা এসে ধ্বংস করতে পারে বিহার ও তার পুঁথিশালা যেখানে রয়েছে পদ্মসম্ভব, দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, প্রজ্ঞাকরমিতি, পণ্ডিত নারো পা, স্থবির বোধিভদ্র, শ্রীজ্ঞান মিত্রের মতো পন্ডিতদের লেখা বহু মহামূল্যবান পুঁথি। আশেপাশের ধ্বংস হয়ে যাওয়া বিহারগুলি থেকেও - যার অন্যতম বিক্রমশীল মহাবিহার - বেশ কয়েক হাজার পুঁথি তখন গোপনে এসে পৌঁছেছে চৌথুপীতে। বাংলা তথা ভারতের জ্ঞানসাধনার সেই অমূল্য সম্পদগুলিকেও তুর্কী ধ্বংসলীলার হাত থেকে বাঁচানো নিয়ে সবাই চিন্তিত। বেশ কিছু পুঁথি চৌথুপীর তিব্বতী পণ্ডিত তোন পার সহায়তায় তিব্বতে পাঠানো হয়েছে। বাকী আরো কয়েক হাজার পুঁথিকে এক রুদ্ধশ্বাস নাটকীয় যাত্রার মধ্যে দিয়ে শত্রুর শ্যেন দৃষ্টি ও মাথার ওপর উদ্যত মৃত্যুর করাল ছায়া অতিক্রম করে শেষপর্যন্ত তিব্বতে নিয়ে যান খু স্তোন ও থেরী সঞ্জীবনী। অবশ্য এই যাত্রায় থেরী সঞ্জীবনীর চীবর ছেড়ে আত্মপ্রকাশ করেছেন পূর্ণ যৌবনা নারী গন্ধকালী। যুবরাজ খু স্তোনের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হবার প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে এই দুর্গম নাটকীয় অভিযাত্রার সময়। তিব্বতে গিয়ে কাকার হাত থেকে সিংহাসন মুক্ত করেছেন স্তোন পা, পিতার মৃত্যুর পর রাজা হয়েছেন। আর রণ কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার মিশেলে পরাজিত করেছেন আক্রমণকারী পরাক্রান্ত তুর্কি বাহিনীকে।

যেহেতু এই উপন্যাসে তুর্কী আক্রমণের ভয়াবহতা, তাদের বিধর্মীদের আক্রমণ, মঠ মন্দির ধ্বংস ও পুঁথি পোড়ানো ও হত্যালীলার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে,রয়েছে সে সম্পর্কে এই স্বাভাবিক বীতরাগের আবহও – তাই কেউ কেউ এই আখ্যান প্রসঙ্গে তুলেছেন ইসলামোফোবিয়ার অভিযোগ। বিশেষ করে এমন এক সময়ে এই আখ্যানটি পাঠকের সামনে হাজির হয়েছে যখন ইসলামোফোবিয়া দেশ দুনিয়া জুড়ে যথেষ্ট ব্যাপ্ত ও চর্চিত একটা বিষয়।

এই প্রসঙ্গে এটাই বলার যে এই সময়ের ইতিহাসকে আজকের সমাজ রাজনীতিতে টেনে যদি একটি ধর্মর মানুষজনকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করার চেষ্টা করা হয় সমাজ বাস্তবতার দৈনন্দিনতায়, ইতিহাসের প্রতিশোধ নেবার ভাষ্যটি উদগ্র হয়ে ওঠে, যেমনটা কখনো কখনো হচ্ছে, তাহলে নিশ্চয় তাকে ইসলামোফোবিক বলে আখ্যাত করা সঙ্গত। কিন্তু প্রীতম বসু তুর্কী আক্রমণের সময়ের বাস্তবতার কোনও প্রতিস্পর্ধাকে সমকালে হাজির করার বয়ান হাজির করেন না, তার ইঙ্গিৎ মাত্রও দেন না।

অবশ্য অতীত গৌরব ও জ্ঞান বিজ্ঞানের অর্জনের কথাগুলি বলতে গিয়ে প্রীতম অতিরেক করেছেন, এই অভিযোগ অনেকদূর পর্যন্ত তথ্য সমর্থিত। মহাভারতের কাল গ্রহ নক্ষত্রের গ্রহণের বিস্তারিত বিবরণ সূত্রে মেপে ফেলার অধ্যায়টিই হোক বা সে যুগে আলোর গতির পরিমাপ জানা থাকার প্রসঙ্গই হোক – প্রীতম কল্পনাকে বাস্তব তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি দূরে কোথাও কোথাও নিয়ে গিয়েছেন। এটি আখ্যানমাত্র,ইতিহাস নয়,তাই আখ্যানকারের এমত কিছু স্বাধীনতা থেকেও যায় একথা যারা বলতে চান - তাদের বলা যেতে পারে এইসব অতিরেক বিপুল গবেষণার ভিত্তিতে আখ্যান নির্মাণের যে বিশিষ্ট অর্জন,তার দিকেই কিছু প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দেয়।

কিছু অতিরেক সত্ত্বেও গন্ধকালী আখ্যান নির্মাণ যে উচ্চতায় এখানে পৌঁছল, সমকালীন যোজনগন্ধা আখ্যানটি তার বিপরীতে কেন এত নিষ্প্রাণ ও স্থবির হয়ে রইলো তা পাঠককে ভাবাবেই। এখানে ঘটনা পরম্পরার অতি নাটকীয়তাই শুধু যে বিশ্বাসের বাস্তবতাকে আঘাত করে তাই নয়, সঙ্কট মুহূর্তে চরিত্র পাত্রদের আচার আচরণ ও দীর্ঘ দীর্ঘ বচনগুলিও অবিশ্বাস্য মনে হয়। বিশেষত আখ্যান কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পর যখন ব্ল্যাকমেলার মামাজীর অধীনে যোজনগন্ধা ও হাবিলদারের দীর্ঘ বন্দিদশা শুরু হয়, তখন থেকে আখ্যানও তার গতি হারিয়ে একই জায়গায় প্রায়শ পুনরাবৃত্ত ফলত ক্লান্তিকর হতে থাকে। যোজনগন্ধার আচার আচরণ সংগতিপূর্ণ হচ্ছে না এটা অনুভব করেই কি লেখক একদম শেষে ক্যান্সারের পাশাপাশি ডিসোসিয়েটিভ আইডেনটিটি ডিসঅর্ডার নামক তার এক মানসিক রোগের কথা পাঠককে জানিয়ে দেন ?

অতিরেকগুলি বাদ দিয়েও প্রীতম যেভাবে বাংলা তথা ভারতের জ্ঞান বিজ্ঞান জগতের বিশিষ্ট অর্জনগুলিকে একের পর এক তুলে আনেন, তার ধারাবাহিক চর্চার কথা বলেন – তা আমাদের জাতিগত গৌরবকে পুনঃনির্মাণের এক জরুরী চেষ্টা। আমাদের গণিতশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার ব্যুৎপত্তিই হোক বা ভেষজ চিকিৎসাশাস্ত্রের বিষ্ময়কর বিকাশই হোক, অনেক পরিশ্রমসাধ্য গবেষণার মধ্যে দিয়ে প্রীতম তার স্বাদু পরিবেশন করেছেন এখানে। অনেক প্রচলিত ধারণাকে উলটে পালটে দিয়েছেন। অনেক নতুন তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়ে আমাদের অতীতের প্রতি বিষ্ময়মুগ্ধ ভালোবাসার বোধ জাগিয়ে তুলেছেন, যা চৌথপীর চর্যাপদের অন্যতম অবদান।

ভারতীয় ভেষজের আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে এবং তার সন্ধানে বে আইনি কারবারের চেষ্টা আমরা সংবাদপত্রের পাতায় মাঝেমাঝেই দেখতে পাই। প্রীতম আমাদের জানিয়েছেন কিড়াজড়ি নামে লোকমুখে জনপ্রিয় এক ঘাসের কথা, যার রয়েছে যৌবন প্রদীপ্ত করার অনবদ্য শক্তি। জানিয়েছেন ডাকিনী ব্রহ্মকালির বইয়ের সূত্রে এ সম্পর্কে আমাদের দীর্ঘকালীন চেনাজানার কথা। ডাকিনী শব্দের বর্তমান লোক প্রচলিত অর্থের সাথে প্রকৃত অর্থের পার্থক্যটি ধরিয়ে দিয়ে প্রীতম জানিয়েছেন বিদ্যার সঙ্গে শব্দটির সংযোগের কথা, ডাক ও খনার বচন কথাটির মধ্যে যা ধরা আছে। গন্ধকালীর শিক্ষাসূত্রে এখানে এসেছে ভারতের জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার মহান ঐতিহ্যের কথা। আর্যভটের আর্যভটীয়, ব্রহ্মগুপ্তের ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত ছাড়াও এসেছে পরাশর সিদ্ধান্ত, অত্রি সিদ্ধান্ত, গর্গ সিদ্ধান্ত, সূর্য সিদ্ধান্ত, মরীচি সিদ্ধান্ত, অঙ্গিরস সিদ্ধান্ত ইত্যাদি জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বইগুলির কথা। এসেছে ফলিত জ্যোতিবির্জ্ঞান চর্চায় সেকালের মানমন্দিরে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রের প্রসঙ্গ, যার মধ্যে ছিল জলঘড়ি, শঙ্কু, ফলক যন্ত্র, কপাল যন্ত্র, দোলন যন্ত্র ইত্যাদি।

বিষ এবং ওষধি সম্পর্কে ভারতীয় ভেষজবিদ ও চিকিৎসকদের বিপুল জ্ঞানভাণ্ডারের কিছু কিছু নিদর্শন গন্ধকালীর বইয়ের সূত্রে এখানে হাজির করেছেন আখ্যানকার। সেই হারিয়ে যাওয়া জ্ঞান পুনরুদ্ধারে বিশ্বের তাবড় তাবড় ওষুধ কোম্পানির আগ্রহ ও কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের কথাও জানিয়েছেন। চাণক্য বর্ণিত মারাত্মক বিষ বা ক্ষুদাহরণকারী ওষুধের কথা এখানে এসেছে। লামা লবসাঙ চ্যোগিয়্যাল জানিয়েছে মৌর্যযুগের সেনাদের একপ্রকার ক্ষুধাদমনকারী ওষুধ দেওয়া হত, যা খেয়ে পনেরোদিন বা এক মাস সেনারা খাদ্যাভাবেও যুদ্ধ করতে পারত। নারীদের ঋতুবন্ধ করার ওষুধও সেকালে জানা ছিল বলে লামার মুখ থেকে শুনি আমরা, শুনি চাণক্য বর্ণিত সেযুগের একধরনের কেমিক্যাল ওয়েপেনের কথা।

আমাদের অতীতের জ্ঞানবিজ্ঞানের দিকে নজর ফেরানো, নিজের ইতিহাস ঐতিহ্য শিকড়কে শ্রদ্ধা করতে ভালোবাসতে শেখা প্রীতম বসুর প্রথম উপন্যাস পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গলের অন্যতম লক্ষ্য ছিল, সেই লক্ষ্য চৌথুপীর চর্যাপদেও বর্তমান। এই ধারায় বাংলায় সাম্প্রতিক কালে আরো উল্লেখযোগ্য লেখালেখি শুরু হয়েছে, তা পাঠকদের কাছে বিপুল সমাদরও পাচ্ছে, এটা নিঃসন্দেহে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের একটি ইতিবাচক দিক।

কাশ্মীর সমস্যা ও অভীক দত্তের ব্লু ফ্লাওয়ার

সাম্প্রতিক থ্রিলার রচয়িতাদের মধ্যে যাদের জনপ্রিয়তার কথা শোনা যায় অভীক দত্ত তাদের একজন। অভীক দত্তের যে বইটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে তা হল তিন খণ্ডে প্রকাশিত ‘ব্লু ফ্লাওয়ার’ নামের একটি থ্রিলার। মূলত কাশ্মীরের সন্ত্রাসবাদ, তার পেছনে পাকিস্থান ও মধ্যপ্রাচ্যের উশকানি ও অস্ত্র সাহায্য এবং তার মোকাবিলায় ভারত রাষ্ট্র, তার সেনাবাহিনী, ইনটেলিজেন্সের কার্যকলাপ নিয়ে এর পর্বগুলি লেখা হয়েছে।

ব্লু ফ্লাওয়ার থ্রিলারের প্রথম খণ্ডটি শুরু হয়েছিল বীরেন বলে কলকাতার একটি সাধারণ চাকরীপ্রার্থী যুবককে সন্ত্রাসবাদীরা কীভাবে নিজেদের কাজে লাগাতে চাইলো, সেই বৃত্তান্ত দিয়ে। জঙ্গীদের কথামতো কাজ না করলে তার বাড়ির সবাইকে খতম করে দেওয়া হবে, এই হুমকির সামনে বীরেন প্রাথমিকভাবে নিমরাজী হল। যদিও চরম মুহূর্তে সে জঙ্গীদের সঙ্গে না থেকে ভারত রাষ্ট্রের সন্ত্রাস দমন অভিযানকেই সাহায্য করল। প্রথম খণ্ডে বিশেষ উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে মিনি নামের এক কিশোরী মেয়ে। তার সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সূত্রেই জানা যায় তার জেঠু জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য আসলে বিরাট এক সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্কের অন্যতম হোতা। মিনি তার জেঠুর ঘরে আরবী ভাষায় লেখা এক লিফলেট পেয়েছিল। গোপনে তার ছবি তুলে সে সেটা পাঠায় তার সহপাঠী বন্ধু মেহজাবিনকে। মেহজাবিন পড়ে জানায় এই লিফলেটে কাশ্মীরের আজাদী, সন্ত্রাস ইত্যাদির কথা লেখা আছে। এই লিফলেট তার জেঠুর কাছে কেন, সেটা নিয়ে মিনির মনে ধন্ধ তৈরি হয়। পরে জেঠু যখন কয়েকদিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে বেপাত্তা সে দরজা ভেঙে বাড়ির লোকেদের নিয়ে জেঠুর ঘরে ঢোকে। জানা যায় এই জেঠুর এক স্ত্রী আছেন, যার নাম ইয়াসমিন। সেখানেই অবিবাহিত বলে জানা জ্যোতির্ময়ের রয়েছে পুরদস্তুর এক সংসার। সেখান থেকেই চলে তার জেহাদী নেটওয়ার্কের অনেক কাজ। তার ছেলে সুমনও এই কাজে যুক্ত। পরে জানা যায় জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যের জীবনবৃত্তান্ত। তিনি শুধু ইয়াসমিনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তাই নয়, ইয়াসমিনের জন্য নিজের ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেন। নতুন নাম নেন হাসান মাকসুদ। ক্রমশ কাশ্মীরের আজাদির লড়াই ও সন্ত্রাসবাদী নানা কাজকর্মের অন্যতম পাণ্ডা হয়ে ওঠেন। জ্যোতির্ময় অবশ্য মিনির চতুরতায় ধরা পড়ে যান ভারতীয় গোয়েন্দাবিভাগের হাতে। সে মোবাইল লোকেশন সহ সব কিছু জানিয়ে দিয়েছিল গোয়েন্দা দপ্তরকে।

এই জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যই বীরেনকে দিল্লি হয়ে কাশ্মীর যাবার কথা জানান। বীরেন অবশ্য নিজ পরিচয়ে যায় না, টিকিট কাটা হয় সায়ক বড়ালের নামে। সেই নামেই তৈরি হয় নকল সব আইডেনটিটি কার্ড। সব ব্যবস্থা জ্যোতির্ময়দের সংগঠনই করে। পূর্ব পরিকল্পনামতো শ্রীনগর এয়ারপোর্টে বীরেনকে রিসিভ করে নিজের সঙ্গী করে জনৈক মীর্জা শেখ। শ্রীনগর থেকে বীরেন যায় অনন্তনাগে। কেবল একটা মুখবন্ধ করা খাম নিয়ে ফিরে আসার জন্য কেন তাকে এত দূর পাঠানো হল, তা তার কাছে রহস্যই থেকে যায়। তখনো অবধি সে জানে না কাদের নির্দেশে তাকে কাজ করতে হচ্ছে – তারা টেরোরিস্ট না সি বি আই, ভারত রাষ্ট্রের লোক না কাশ্মীরকে আজাদ করতে চাওয়া জঙ্গী সন্ত্রাসবাদী। আর এও জানে না এসব অদ্ভুত হুকুম তামিলের জন্য সাতে পাঁচে না থাকা তাকেই কেন হঠাৎ করে বেছে নেওয়া হল। তবে কাশ্মীরে ঘোরাঘুরির সময়ে বেশ কিছু দেওয়াল লিখন তার চোখে পড়ে। সেখানে কোথাও লেখা – “গো টু হেল ইন্ডিয়া”, কোথাও লেখা “উই নিড ইন্ডিপেন্ডেন্স”, কোথাও লেখা “পাকিস্থান জিন্দাবাদ”। কাশ্মীরীদের একাংশের ভাবনাচিন্তার ধরন তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। মীর্জা শেখও তাকে ভারত বিরোধী নানা টুকরো মন্তব্য ও শ্লেষ ছুঁড়ে দেয় মাঝে মাঝে। তা থেকে তার ধারণা হতে থাকে সে এখন কাদের নিয়ন্ত্রণে।

কাহিনির অন্য প্রান্ত ছুঁয়ে থাকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং ইনটেলিজেন্স এর লোকেদের। এই ইনটেলিজেন্স বা গোয়েন্দা বিভাগের মাথায় আছেন তুষার রঙ্গনাথন। তাঁর প্রধান সহকারীদের মধ্যে আছেন আশরফ খান, মাথুর প্রমুখরা।

জ্যোতির্ময় দত্ত যে সময় গ্রেপ্তার হচ্ছেন সেই সময়েই টিভির খবরে জানা যায় মুম্বাই কলকাতা ফ্লাইট হাইজ্যাক করেছে জঙ্গীরা। সেই ফ্লাইটে রয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন পাকিস্থানী সমাজকর্মী ও লেখিকা আফসানা সাইদ। মেয়েদের অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠন তাকে যতই টার্গেট বানায়, ততই বাড়ে তার খ্যাতি ও আন্তর্জাতিক প্রচার। পরিশেষে জানা যায় তার এই পরিচয়টি আসলে এক বিরাট ভেক, এর আড়াল থেকে তিনি আসলে সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্ককে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেন এবং নিজেও তার একজন হোতা। আফসানা সাইদের পাশাপাশি সেই হাইজ্যাকড ফ্লাইটে রয়েছে ও হাইজ্যাকের ঘটনাবলী নিয়ন্ত্রণ করছে জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য ওরফে হাসান মাকসুদের ছেলে সুমনও। প্রথম খণ্ডের শেষে প্লেন বদলের সময় ইন্ডিয়ান ইনটেলিজেন্স এর নির্দেশে আর্মির শার্প শ্যুটাররা আফসানা সাইদ, মীর্জা, সুমন – সবাইকেই হত্যা করে। সিঁড়ি থেকে ঝাঁপ দিয়ে বীরেন নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়। পরে ভারতীয় ইনটেলিজেন্স তাকে নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করবে, সে অবশ্য দ্বিতীয় খণ্ডের ব্যাপার।

ব্লু ফ্লাওয়ারের দ্বিতীয় খণ্ডের অনেকটা অংশ জুড়ে আছে জ্যোতির্ময় ওরফে মকসুদ হাসানকে ধরিয়ে দেওয়ার শাস্তিস্বরূপ মিনির অপহরণ, ধর্মান্তরকরণ ও এক মুসলিম ছেলের সঙ্গে তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, মিনির প্রতিবাদ প্রতিরোধের জন্য নানাবিধ অত্যাচার ও ধর্ষণ। বাংলাদেশের এক গ্রামে মিনির ওপর চলা এই অত্যাচার পর্বে তাকে বিয়ে করতে চাওয়া নাজিব, তার মা মনোয়ারা বেগম, নাজিবের বন্ধু মোতালেবদের উক্তি প্রত্যুক্তিতে ধরা পড়েছে ধর্মবিশ্বাসের নামে নারী দমনের কেমন সব নৃশংস ধারণাতে বিশ্বাস করে তারা। তাদের মধ্যে মনুষ্যত্বের আর কিছুই বাকী নেই, ধর্মের নামে একরাশ মানবতাবিরোধী চিন্তা ও কাজের মধ্যেই থাকে তারা। নিজেদের জঙ্গলের শের মনে করে রাষ্ট্র, আইন কানুনকে তারা কোনওরকম পাত্তাই দিতে চায় না। ভারতীয় ইনটেলিজেন্স অবশ্য তাদের ঘেরাটোপ ভেদ করে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয় তাদের এলাকায়, তারপর তাদের গ্রেপ্তার করে আর উদ্ধার করে মিনিকে।

এই খণ্ডেই রয়েছে ভারতীয় ইনটেলিজেন্স এর অন্যতম রত্ন সায়ক বড়ালের নানাবিধ কার্যাবলীর কথা, যে পাকিস্থানের ভেতরে থেকে ভারতীয় ইনটেলিজেন্সের হয়ে গোপন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। একসময়ে সে ধরা পড়েছিল, ভাবা হয়েছিল পাকিস্থানিরা তাকে মেরে দিয়েছে। কিন্তু দেখা যায় সে মারাত্মক আহত হলেও জীবিত। ক্রমশ সুস্থ হয়ে সে আবার কাজে ফেরে এবং জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে খবর সংগ্রহ জারি রাখে।

পাকিস্থানের ভেতরের সেনা, আই এস আই এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন – লস্কর, তালিবান সম্পর্কিত কথাবার্তা ছাড়াও পাক অধিকৃত কাশ্মীর কীভাবে ভারতীয় কাশ্মীরে অস্থিরতা ও জঙ্গী কার্যকলাপ তথা কাশ্মীরের আজাদীর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে, তাতে ভারতীয় কাশ্মীরের ভেতরে কী প্রভাব পড়ছে, তার এক ছবি এই খণ্ডে বেশ বিস্তারেই রাখার চেষ্টা করেছেন অভীক। আবার পাকিস্থানী রাজনীতির ভেতরের যে ছবি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রায়শই বে আব্রু হয়ে যায়, যেভাবে নির্বাচিত সরকারের বদলে বারেবারেই সেখানে হানা দেয় সেনা শাসন – তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই অভীকের ব্লু ফ্লাওয়ারের আখ্যান এগিয়েছে। সেনা ও আই এস আই এর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব, সেনানায়ক নিয়াজির নিজের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে নেওয়া ও রাষ্ট্রপতি হবার পর পরই তাকে মারার জন্য জঙ্গীহানার চেষ্টা দেখি আমরা। নিয়াজি কোনওক্রমে প্রাণে বেঁচে যান, আর তারপরই এই ষড়যন্ত্রে জড়িত সন্দেহে সরিয়ে দেওয়া হয় আই এস আই প্রধান সরফরাজকে।

ব্লু ফ্লাওয়ারের দ্বিতীয় খণ্ডের শেষে জেল থেকে গোয়েন্দা দফতরের বিশ্বস্ত কর্মী রেহানকে গোপনে সেলের ভেতর লুকিয়ে রাখা তার বন্দুক বের করে খুন করে ইসমাইল। তারপর জেল থেকে পালায়। তৃতীয় খণ্ডের অনেকটা অংশ জুড়ে তার অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে সেনা হামলার পরিকল্পনা ও সেই সূত্রে নানা কার্যকলাপের কথা রয়েছে। সে হামলার পরে নিজেকে বাঁচাতে পর্যন্ত চায় না, ইসলামের নামে কয়েকশো বা হাজার “কাফের”কে হত্যা করে বেহস্তে যাওয়াই তার একমাত্র লক্ষ্য। তার এই কাজে সে নানা ব্যক্তি ও সংগঠনের সহায়তা পায়। কাশ্মীরের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাদরীকে তার সহযোগী ও পরামর্শদাতা হিসেবে দেখিয়েছেন আখ্যানকার অভীক। এছাড়াও নানা নেটওয়ার্ক তাকে এই জেহাদী জঙ্গী কার্যকলাপে সাহায্য করে। শেষের দিকে তাকে আপাতত জঙ্গী হামলার এই পরিকল্পনা স্থগিত করতে বলা হয়, কিন্তু সে রাজী হয় না। একাই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যতজনকে পারে হত্যা করে ইসলামের সেবা করতে চায় সে।

তৃতীয় খণ্ডে এসে বীরেন এক আশ্চর্য সত্যের মুখোমুখি হয়। কেন জঙ্গীরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে দলে নিতে চেয়েছিল সে আগে বুঝতেই পারে নি। অবশেষে সে জানতে পারে তার বাবা ছিল রাজাকার। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ে পাকিস্থানি আর্মির হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের খুন জখমের কাজে সে লিপ্ত ছিল। পরে কলকাতায় চলে এসে আস্তানা নেয়, বিয়ে করে, সন্তানদের নিয়ে সাধারণ জীবনযাপন করতে থাকে। পাকিস্থানের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় ছিল তার। তাদের পক্ষ থেকে তাকে অপেক্ষা করতে বলা হয় সঠিক সময়ের জন্য। শেষমেষ তার ছেলে বীরেনকেই তাদের কাজের জন্য ‘কুরবানি’ দেয়। এই ইতিহাস জানার পর বীরেন সবটা ইন্ডিয়ান ইনটেলিজেন্স এ তার টপ বসকে জানানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ঘটনাচক্রে তার সে সুযোগ আসে নি। মাঝে একবার দোলাচলতায় পড়লেও সে চরম মুহূর্তে নিজের কাজ করে, ঘৃণ্য সন্ত্রাসী ইসমাইলকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে অমৃতসর স্বর্ণমন্দির এলাকায় সন্ত্রাসী হামলার ছককে ব্যর্থ করে দেয়।

এই ধরনের রচনাকে সিরিয়াস উপন্যাস না বলে জনপ্রিয় থ্রিলার গোত্রে ফেলা হয় কেন? যদিও সাহিত্যের রূপভেদ নিয়ে সাধারণ পাঠকের খুব বেশি মাথাব্যথা থাকে না, কিন্তু সমালোচকের দায় থাকে পপুলার লিটারেচর আলোচনার সময় তা নিয়ে কিছু কথা বলার। সেই দায়দায়িত্ব মেনে দু কথা বলা যাক।

কাশ্মীর নিয়ে সিরিয়াস উপন্যাস লিখতে চাইলে সেখানে অবশ্যই আসা দরকার কাশ্মীর সমস্যার এক ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ। কাশ্মীরের সমস্যাটি প্রকৃতপক্ষে কী - বিভিন্ন চরিত্রপাত্রর সূত্রেই হোক বা সর্বগ ও সর্বজ্ঞ অথরের ভাষ্যেই হোক – উপন্যাসে তাকে হাজির করার দরকার হত। নিশ্চয় সেই সমস্যাকে ঔপন্যাসিক যেভাবে তুলে ধরতেন তা নিয়ে সবাই একমত হতেন না, নানা বিতর্ক থাকত এবং সেই বিতর্কে নানাজনে নানাভাবে অংশ নিতের। কিন্তু দেশকালের বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে সমস্যাটিকে স্থাপণ করতে পারলে কাশ্মীর সমস্যা সংক্রান্ত সঙ্কটটির নভেলাইজেশন সম্ভব হত। এখানে অভীক থ্রিলার লেখার আগ্রহে সে পথ একেবারেই মাড়াতে চান নি। এখানে উপন্যাস যে সমস্যাবিন্দুতে শুরু হয়, তিন খণ্ড পেরিয়ে সেই একটি সমস্যাবিন্দুতেই দাঁড়িয়ে থাকে। একদিকে কাশ্মীরের আজাদীর লড়াই আর অন্যদিকে ভারতের অখণ্ডতার জন্য যুদ্ধ – এই একরৈখিকতার চারপাশে ঘটনার জাল বুনে তৈরি হয়েছে এই থ্রিলার।

অনেক চরিত্র এখানে আসে আর মিলিয়ে যায়। কয়েকটি চরিত্র তিন খণ্ড জুড়েই থাকে। যেমন জেহাদী হাসান মাকসুদ, গোয়েন্দা প্রধান তুষার রঙ্গনাথন, তার সহকারী খান ও মাথুর, সায়ক বড়াল – কিন্তু এই চরিত্রগুলির উপন্যাসসুলভ কোনও বিবর্তন নেই। থ্রিলারের ধারা অনুযায়ী শুরু থেকে শেষ তারা একইরকমভাবে ভাবে, কাজ করে। এমনকী সবচেয়ে বড় কয়েকটি বাঁক বদলের পরও বীরেনের মধ্যে মৌলিক কোনও পরিবর্তন আমরা লক্ষ করি না।

সাধারণ মানুষের নানা জনপ্রিয় বিশ্বাসকে এখানে খুব সহজ সরল নাটকীয়ভাবে উপস্থাপণ করা হয়েছে। আম হিন্দু মধ্যবিত্ত বাঙালি কাশ্মীর সমস্যা, জেহাদ, সন্ত্রাসবাদ, পাকিস্থানের আই এস আই ইত্যাদিকে যেভাবে দেখে এখানে তার উপস্থাপণ রয়েছে। মুসলমান মাত্রেই জেহাদী - এই চড়া দাগের হিন্দুত্বের ন্যারাটিভকে এড়িয়ে যাবার একটা প্রয়াস অভীকের লেখায় রয়েছে, সন্ত্রাসবাদী মুসলিমদের পাশাপাশি দেশপ্রেমিক মুসলিমদেরও সেখানে বিস্তারিতভাবে দেখানো হয়েছে। তারা ইনটেলিজেন্স সার্ভিসে মন্ত্রগুপ্তি নিয়ে কাজ করে চলেছে ভারত রাষ্ট্র ও তার অখণ্ডতার জন্য এবং সেজন্য তাদের নিজেদের এবং পরিবারের প্রাণ পর্যন্ত চলে যাচ্ছে জঙ্গী হামলায়। কাশ্মীরের মানুষের একাংশের ভারতের ওপর ক্ষোভ ও আজাদীর লড়াইয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থনের কারণ যে ভারতের সেনার সেখানকার মানুষের ওপর নানা অন্যায় আচরণ, সেকথাও বেশ কয়েক জায়গায় বলা হয়েছে। তবে কাশ্মীরের আজাদীর লড়াই যে প্রধানত ইসলামিক দুনিয়া ও বিশেষভাবে পাকিস্থানের মদতপুষ্ট, টাকা ও অস্ত্রশস্ত্রের জোগান বা নেটওয়ার্কগত সাহায্য অথবা মগজধোলাই এর মাধ্যমে তারাই যে বাইরে থেকে কাশ্মীরের মানুষকে ক্রমাগত উশকে চলেছে – এটাই আখ্যানকার মূলত বোঝাতে চান। এখানে অভীক দত্ত কাশ্মীরের ইতিহাস, সেই ইতিহাসের নানা জটিলতা, পালাবদল – এসব প্রসঙ্গকে আনতে চান নি। ফলে কবে থেকে কাশ্মীর মানেই একদিকে ভারতের সেনা আর অন্যদিকে জঙ্গী সন্ত্রাসবাদ – তার কোনও হদিশ পাঠক পাবেন না। আবহমানের প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আখ্যান একটি সমস্যা বিন্দুতে শুরু হয়, সেখানেই শেষ হয়।

আধুনিককালে অপরাধ সংগঠন ও তাকে আটকানোর চেষ্টা উভয়ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, সেই কথা মাথায় রেখে আধুনিক থ্রিলারও এগুলিকে ব্যবহার করে যথেষ্ট পরিমাণে। থ্রিলারের ক্রাফটম্যানশিপের দিক থেকে বলা যায় সেদিকেও অভীক বেশি দূর যাবার চেষ্টা করেন নি। কম্পিউটার খুলে পাসওয়ার্ড মেলানোর মামুলি দু একটি দৃশ্য এখানে এসেছে, তাও পাসওয়ার্ড মেলানো হয়েছে কখনো অনুমান, কখনো ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতিতে। একটি বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে প্রথাগত নজরদারিকে ফাঁকি দেওয়া যায়, এমন বোমার উল্লেখ আছে, কিন্তু তা তৈরির কলাকৌশল, তার ধরণ ধারণ বা তাকে খুঁজে বের করার নতুন পথ সন্ধান – এসব এখানে আসে নি।

সমস্যার কোনও গভীর কারণ অনুসন্ধানে পাঠককে ব্যস্ত না করে থ্রিলার পাঠকের চাহিদামতো রুদ্ধশ্বাস নানা ঘটনা পরম্পরা তিন পর্ব জুড়ে অভীক একের পর এক হাজির করে যেতে থাকেন। নানা গোপন ও আধা গোপন মিটিং, ইন্টারোগেশন, অপহরণ, চেজ সিকোয়েন্স, দুঃসাহসিক গোয়েন্দা অভিযান, প্লেন হাইজ্যাকিং, শার্প শ্যুটার দিয়ে হত্যা, আত্মঘাতী জেহাদী হামলার ছক, জেলের মধ্যে সেলে রিভলভার লুকিয়ে রাখা ও তা দিয়ে ঘটানো হত্যাকাণ্ড, নয়া নিযুক্ত রাষ্ট্রপতির ওপর প্রাণঘাতী বোমা বিস্ফোরণের চেষ্টা, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্ক, দেশপ্রেম ও আজাদীর লড়াই, মন্ত্রীদের উদ্বিগ্ন ফোন, নিরাপত্তারক্ষীদের সদা ব্যস্ততা ও সতর্কতা – জনপ্রিয় হয়ে ওঠার মাল মশলা সরবরাহে অভীক কার্পণ্য করেন নি। দ্বিতীয় পর্বের একাংশে খানিক স্লথতা ছাড়া কাহিনির গতি ও আকর্ষণকে তিনি সতেজ রাখতে পেরেছেন।

সায়ন্তনী পুততুণ্ডের ‘চুপি চুপি আসছে’

ক্রাইম থ্রিলারের অন্যতম কাজ পাঠককে সারাক্ষণ টেনে রাখা। তাতে যেমন ঘটনার গতি থাকবে, সাসপেন্স থাকবে, তেমনি থাকবে নানা নাটকীয় মোচড়। এইসমস্ত গুণই রয়েছে সায়ন্তনী পুততুণ্ডের  লেখা ‘চুপি চুপি আসছে’ নামের থ্রিলারটিতে। এটি এক সিরিয়াল কিলারের আখ্যান। থ্রিলারের শুরুতে আমরা জানতে পারি বত্রিশ বছর আগে এই সিরিয়াল কিলিংগুলো হয়েছিল। পরপর পাঁচটি লাশ ফেলে যাওয়া হয় বিভিন্ন পুলিশ স্টেশনের সামনে। কলকাতা শহর জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। পুলিশের তাবড় গোয়েন্দারা এর অনুসন্ধানে নিযুক্ত হয়ে যান। কিন্তু অনেক অনুসন্ধানের পরও সিরিয়াল কিলারকে ধরা যায় নি। বরং তদন্তকারী অফিসাররাই কয়েকজন খুন হয়ে যান। খুনের কোনও কিনারা করতে না পেরে শেষমেষ গোয়েন্দা দপ্তর তদন্ত প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। আখ্যান শুরু হচ্ছে সিরিয়াল কিলিং এর প্রথম অধ্যায়টির বত্রিশ বছর পর এই কেসটির রি ওপেনিং দিয়ে। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের তরুণ বলিষ্ঠ সুঠাম অফিসার অধিরাজ ব্যানার্জী। তাঁর প্রধান সহকারী অর্ণব সরকার। এছাড়া এই তদন্ত প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় পর্বে অধিরাজের টিমে যুক্ত হন ফরেনসিক বিভাগের ডাক্তার চ্যাটার্জী, তাঁর সহকারী যুবতী মিস আহেলি মুখার্জী এবং পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের নতুন রিক্রুটমেন্ট মহিলা অফিসার মিস দত্ত। গোয়েন্দা বিভাগের অন্যতম কর্তা শিশির সেন গোটা তদন্ত প্রক্রিয়ার দায়িত্ব তরুণ অধিরাজের হাতে তুলে দিয়ে বেশ খানিকটা আশঙ্কাতেই দিন কাটান। কারণ তিনি জানেন এই সিরিয়াল কিলার কতটা ভয়ংকর। বত্রিশ বছর আগে যখন সিরিয়াল কিলিং ও তার তদন্ত চলছিল তখন তিনিই ছিলেন তদন্তকারী অফিসার রথীন দাশগুপ্তের প্রধান সহকারী তথা প্রিয়পাত্র। তদন্তে কিছু অগ্রগতি ঘটাতে পারলেও শেষপর্যন্ত খোদ রথীন দাশগুপ্তর লাশই পাওয়া যাবে লালবাজারের সামনে। নতুন করে বত্রিশ বছর পরে তদন্ত শুরু হতে না হতেই অধিরাজের তিন সহযোগী খুন হয়ে যান। খুনি অধিরাজের পাশে গোপনে ঘুরে গিয়ে তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যায়। অধিরাজ তার নিরপত্তারক্ষীদের খুনে বিহ্বল হয়ে নিজের নিরাপত্তা তুলে নিতে বলে, তবে অর্ণব ও দুই তরুণী অফিসার তাঁকে ছায়ার মতো সব সময়েই ঘিরে রাখেন।

সায়ন্তনীর এই থ্রিলারের একটি বড় গুণ যদি হয় আগাগোড়া সাসপেন্সকে জাগিয়ে রাখতে পারা তবে আরেকটি গুণ অবশ্যই এক বিশেষ মনস্তত্ত্বকে এই সিরিয়াল কিলিং এর সঙ্গে আশ্চর্য দক্ষতায় মিশিয়ে দেওয়ার দক্ষতা। আমরা সিরিয়াল কিলারের স্বগতোক্তিগুলি থেকে তার পরিচয় জানতে না পারলেও জীবনকথার অনেকটাই জেনে যাই। জানতে পারি যে একেবারে ছেলেবেলা থেকেই মনে মনে নারীত্বের কিছু বৈশিষ্ট্য তাকে ঘিরে ছিল। সে মেয়েদের মতো চুড়িদার দুল ইত্যাদি পড়ত গোপনে। তার শৈশব জর্জরিত হয়েছিল জেঠুর ভয়ংকর যৌন অত্যাচারে। মা বাবাকে সে কথা জানিয়েও সুরাহা কিছু হয় নি, বরং আর্মি অফিসার বাবা তাঁকে বাড়ি থেকেই তাড়িয়ে দেন। আর এক আর্মি অফিসারের বাড়িতে সে পালিত হয়। স্কুল কলেজে পড়ার সময় থেকে সে বুঝতে পারে তার যৌন পছন্দটি অন্যরকম। মেয়েদের নয়, সে আকৃষ্ট হয় পুরুষদের জন্য। এই আকর্ষণ প্রকাশ করে ফেলায় বেশ কয়েকবার তাঁকে লাঞ্ছিতও হতে হয়। সমকামী প্রেমকে সমাজ যে শুধু অস্বীকারই করে তা নয়, কীভাবে একজন সমকামীকে লাঞ্ছিত হতে হয় এই বিকল্প যৌন পছন্দের জন্য – তার স্বরূপ বেশ আন্তরিকভাবেই এই থ্রিলারের নানা জায়গায় সায়ন্তনী স্পষ্ট করেছেন। এই লাঞ্ছনা অপমান ও প্রতিশোধ স্পৃহাই শেষপর্যন্ত তাকে বলে ঘুরে দাঁড়াতে, প্রতিবাদ করতে এবং বদলা নিতে। একজন প্রেমিকের পাশাপাশি সে হয়ে ওঠে একজন নৃশংস সিরিয়াল কিলার।

এই সিরিয়াল কিলারের বাইরের কর্কশ পাশবিক জিঘাংসার পাশাপাশিই এক অদ্ভুত শিশু মনস্তত্ত্বের আশ্চর্য মিশেলের কথা আমরা জানতে পারি। টম অ্যান্ড জেরির কার্টুন দেখা বা জনসনের বেবি ক্রিম ব্যবহার করার মতো বৈপরীত্যকে সিরিয়াল কিলারের খুনি মানসিকতার সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে দিতে পেরেছেন সায়ন্তনী – আর এটা নিঃসন্দেহে এই থ্রিলারের বহুকৌণিকতা বাড়িয়েছে।

সিরিয়াল কিলারের প্রকৃত পরিচয়টি কী আর কীভাবে অধিরাজ ও তার দল সেই পরিচয়ের রহস্যভেদে শেষপর্যন্ত সক্ষম হল – সে বৃত্তান্ত পাঠকালের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্যই ছেড়ে রাখা যাক। আপাতত শুধু এটুকুই বলা যাক প্রযুক্তির সংক্ষিপ্ত কিন্তু নাটকীয় ব্যবহার, কাহিনির অবিশ্বাস্য সব মোচড় আর তার মধ্যেও বাস্তবতাকে বজায় রাখা, শুরু থেকে শেষ অবধি একটানা রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা ধরে রাখা আর বিশেষ ধরনের মানব মনস্তত্ত্বের সঙ্গে অপরাধকে মেলানর মতো বৈশিষ্ট্যগুলি এই ক্রাইম থ্রিলারকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। আর একটি দিক হল অপরাধীকে আঁকার ক্ষেত্রে সাদা কালোর দ্বিত্বকে অসামান্য মুন্সিয়ানায় এখানে ভেঙেছেন সায়ন্তনী। সিরিয়াল কিলার একই সঙ্গে হিরো ও ভিলেন, একই অঙ্গে ডাক্তার জেকিল ও মিস্টার হাইডের মতো। আমরা সিরিয়াল কিলারের জিঘাংসা ও পাশবিকতায় শিউরে উঠি, আবার তার অপাপবিদ্ধ শৈশবে রক্তাক্ত হওয়া ও কৈশোর, যৌবনে বিশেষ যৌন পছন্দের জন্য লাঞ্ছিত হবার ঘটনায় বিমর্ষ হই। সিরিয়াল কিলার সামাজিক সঙ্কটের শিকার হয়ে, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা নিয়ে সাদা কালোর বাইরে একটা গোটা মানুষ হিসেবে উঠে আসছে – থ্রিলারে এটি খুব সুলভ নয়। সেদিক থেকেও সায়ন্তনী পুততুণ্ডর ‘চুপি চুপি আসছে’ বেশ খানিকটা বিশেষত্ব দাবি করতে পারে।

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেন নি’

‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেন নি’ এবং তারই সিকোয়েল ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো আসেন নি’ – সাম্প্রতিককালে বাংলায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা একটি থ্রিলার সিরিজ। এখনো অবধি এর দু খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডের সমাপ্তি থেকে মনে হয় লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের পরিকল্পনা রয়েছে এর আরো অন্তত একটি খণ্ড লেখার। এখনো অবধি প্রকাশিত দুটি খণ্ডই স্বয়ংসম্পূর্ণ – অর্থাৎ একটি নিরপেক্ষভাবেও অপরটি পড়লে পাঠকের অসুবিধে হবে না। আবার খণ্ডদুটি পরস্পর সংযুক্তও।

প্রথম খণ্ডের যাবতীয় ঘটনাই ঘটে বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যার নাম সুন্দরপুর। সেখানেই তদন্তের কাজে যায় ডিবি বা বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশের অফিসার নুরে ছফা। বেশ কিছু মানুষ রহস্যজনকভাবে হারিয়ে গেছে এই সুন্দরপুরে এসে, তাদের আর কোনও খোঁজখবর পাওয়া যায় নি। পুলিশ তদন্ত করেও কিছু বের করতে পারে নি। হয়ত এই রহস্য অমীমাংসিতই থেকে যেত যদি না বাংলাদেশের চূড়ান্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবের বোনপো হাসিব আহমেদ এই নিরুদ্দেশের তালিকায় থাকতেন। ক্যান্সার আক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী মাতৃসমা দিদির শেষ ইচ্ছে তার ছেলের পরিণতিটুকু জানা। এই কারণেই প্রধানমন্ত্রীর সচিব খানিকটা ব্যক্তিগত উদ্যোগেই করিৎকর্মা গোয়েন্দা অফিসার নুরে ছফাকে নিয়োগ করেন এই রহস্যের কিনারা করতে।

নুরে ছফা সুন্দরপুরে এসেছে এই তদন্তের কাজে এরকম একটা অবস্থায় এই থ্রিলার শুরু হয়। প্রথমদিকে নুরে ছফা কে, কেন তার আগমন সে সব পাঠক জানতে পারেন না। নুরে ছফা গোপনেই তার তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যায়। এই কাজে সে পুলিশ প্রশাসনকে এড়িয়ে আতর আলী নামের স্থানীয় এক যুবককে কাজে লাগায়। পুলিশ এমনকি তার পরিচয়টুকুও জানে না দীর্ঘদিন। সুন্দরপুর এমনিতে এক শান্ত স্বাভাবিক গ্রাম। এটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত হয়ে ওঠে এখানে স্থাপিত এক রেস্তোরার জন্য। ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেন নি’ নামের এই রেস্তোরাটির খাবার এতই বিখ্যাত হয়ে ওঠে যে শুধু এখানে খাবার জন্যই দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে আসেন। রেস্তোরাটির মালিক মুসকান জুবেরি। তার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। দেখলে তার বয়েস ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বলেই মনে হয়। আতর আলী নুরে ছফাকে সাংবাদিক হিসেবেই জানত। সে মুসকান জুবেরি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যের জন্য নুরে ছফাকে বিবাহ ইচ্ছুক পাত্র পরিচয়ে নিয়ে যায় স্থানীয় শিক্ষক রমাকান্ত কামারের কাছে। রমাকান্ত কামারের থেকে নুরে ছফা জানতে পারে এখানকার জমিদার বংশের শেষ প্রভাবশালী জমিদার অলোকনাথ বসুর কন্যা অঞ্জলি বসুর সঙ্গে সাঈদ জুবেরির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আলাপ, প্রেম ও বিবাহ হয়েছিল। সেই বিবাহজাত সন্তান রাশেদ জুবেরিকে নিয়ে সবাই ভাষা আন্দোলনের পরে সুন্দরপুরের জমিদার বাড়িতে থাকা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় অলোকনাথ, অঞ্জলি, সাঈদ জুবেরি সবাইকে রাজাকার বাহিনী একদিন হানা দিয়ে হত্যা করে। রাশেদ জুবেরি সেইসময় রমাকান্ত কামারের বাড়িতে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান ও পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর রাশেদ জুবেরি মাঝে মাঝে সুন্দরপুরে ফিরলেও থাকতেন না। তার অধিকাংশ সম্পত্তিই তখন বেহাৎ হয়ে গেছে, চলে গেছে স্থানীয় এম পির কব্জায়। ২০১০ সাল নাগাদ ঢাকার ওরিয়েন্ট হাসপাতালে ক্যান্সার আক্রান্ত রাশেদ জুবেরি মারা যান। তার কয়েকমাস পরে তার স্ত্রীর পরিচয় নিয়ে সুন্দরপুরে আসেন মুশকান জুবেরি। তিনি জমিদারবাড়িতে থাকতে শুরু করেন। এই রেস্তোরা চালু করেন।

নুরে ছফা ক্রমশই নানা সূত্র থেকে খোঁজখবর নিয়ে দ্রুত জেনে যায় মুশকান জুবেরি ক্ষমতার অলিন্দে প্রভাব বিস্তার করেছেন নিজের রূপ গুণ আর ব্যক্তিত্ত্ব দিয়ে। স্থানীয় এম পি, পুলিশ প্রশাসনের বরকর্তারা তার কোনও অনুরোধ তামিল করতে পেলে বর্তে যেতেন, বিনিময়ে চাইতেন শুধু তার খানিক সান্নিধ্য। বেহাত হওয়া সম্পত্তির অনেকটাও তিনি উদ্ধার করতে পেরেছেন এই প্রভাব খাটিয়েই।

মুশকান জুবেরিই যেহেতু গোয়েন্দা নুরে ছফার প্রাইম সাসপেক্ট, কিন্তু অনুমান ছাড়া কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ তার কাছে নেই, তাই তার প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় মুশকান জুবেরি সম্পর্কে যত বেশি খবর সংগ্রহ করা। সাকরেদ আতর আলী প্রথমে ও তারপর নুরে ছফা নিজেও একবার মুশকান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য গোপনে রাতের অন্ধকারে জমিদার বাড়িতে ঢোকে। কিন্তু তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে মুশকান আরো রহস্যাবৃত হয়ে ওঠে তাদের কাছে। আতর তাকে প্রায় রহস্যময়ী ডাইনীই ভেবে বসে। এস পির সঙ্গে সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে মুশকান জুবেরি সন্দেহভাজন হয়ে ওঠা নুরে ছফাকে গ্রেপ্তারও করিয়ে দেয় স্থানীয় ওসিকে দিয়ে। থানায় যখন নুরে ছফাকে জিজ্ঞাসাবাদ এমনকী মারধোরও করা হচ্ছে সেই সময়েই নুরে ছফা তার প্রকৃত পরিচয় দেয় পুলিশকে এবং ওপরতলা থেকে পুলিশের ওপর দ্রুত এই বিষয়ে যাবতীয় নির্দেশও চলে আসে। নুরে ছফা জমিদারবাড়িতে গিয়ে মুশকান জুবেরিকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে এমন আবহে তাকে অবাক করে মুসকান জুবেরি নিজেই অজানা এক নম্বর থেকে ফোন করে নুরে ছফাকে কথা বলার জন্য জমিদার বাড়িতে যেতে বলে। নুরে ছফা পুলিশ ছাড়া জমিদার বাড়ির দরজায় দুই পাহারাদার রেখে একাই জিজ্ঞাসাবাদ করতে ঢোকে এবং তারপর নাটকীয় সব ঘটনাবলী ক্রম উন্মোচিত হতে থাকে। নুরে ছফার প্রাথমিক ধারণা ছিল মুসকান জুবেরি - বিয়ের আগে যিনি ছিলেন ওরিয়েন্ট হাসপাতালের একজন ডাক্তার এবং যার পদবী ছিল সোহেলি – মানব অঙ্গ গোপনে সংগ্রহ ও পাচারের কাজে যুক্ত। মুশকান জুবেরি তাকে নিজের জীবনের কাহিনি শোনায়, খানিক সত্যি মিথ্যে মিশিয়ে, গোপন অনেক রহস্য লুকিয়ে রেখে। নুরে ছফার বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য সে তাকে পুরনো অ্যালবামও দেখায়। জানায় যে দশ বছর বয়সেই সে বাবা মার সঙ্গে আমেরিকায় চলে গিয়েছিল। স্কুলের পাঠ শেষ করে সে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। সেই সময়ে বন্ধুদের সঙ্গে একটি ভ্রমণে যায় সে, মাঝপথে বিমান ভেঙে পড়ে এক গভীর নির্জন জায়গায়। অধিকাংশ যাত্রী দুর্ঘটনার পরেই মারা যায়। অনেকে ক্রমশ আহত হয়ে আর না খেয়ে মরতে শুরু করে। বাকিরা প্রথমে অনেকদিন না খেয়ে ছিল। তারপর খিদের জ্বালায় মৃত সহযাত্রীদের মাংস খেতে থাকে। অনেকদিন পর কয়েকজনকে উদ্ধার করা হয়, কিন্তু তাদের দেহে মনে তখন নরমাংস ভোজনের গ্লানি। মুশকান সোহেলির এই কাহিনি শ্বেতাঙ্গ সমাজ খুব অস্বাভাবিকভাবে না নিলেও প্রতিবেশী বাঙালি সমাজ ঠিকভাবে নিতে পারে নি। তাকে আমেরিকা ছাড়তে হয়। লন্ডনে থাকে সে দীর্ঘদিন ও তারপর ঢাকায় চলে আসে ও ওরিয়েন্ট হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতে থাকে। আমেরিকা থেকে সেখানে আসা ডাক্তার মুশকান সোহেলির এই কথা অন্যদের বলে, ফলে সেখানে তার কাজ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে যায়। সেখান থেকে লুকিয়ে সে চলে আসে সুন্দরপুরে ও নিজের এই অতীতকে গোপন রেখে রেস্তোরা খুলে স্বামীর ভিটেতে থেকে জীবন অতিবাহিত করতে থাকে। এই কাহিনি শুনতে শুনতেই নুরে ছফা দেখে তার সারা শরীর ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে। অ্যালবামের আটকে যাওয়া পাতাগুলো সে থুথু দিয়ে যখন উল্টেছিল, তখনই সেখানে রাখা এক বিশেষ মাদকের প্রভাবে ঘটে এই ঘটনা। তার বিকল হয়ে পড়ার সুযোগ নিয়ে জমিদারবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে সেখান থেকে ছদ্মবেশে পালিয়ে যায় মুশকান জুবেরি। কোনওক্রমে নুরে ছফাকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ কিন্তু মুসকান জুবেরিকে ধরতে ব্যর্থ হয়। এখানেই শেষ হয় প্রথম খণ্ডের কাহিনি।

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের উল্লিখিত থ্রিলারের এখনো অবধি প্রকাশিত দুই খণ্ডের রচনারীতির মধ্যে স্বাভাবিক কারণেই কিছু পার্থক্য আছে। প্রথম খণ্ডে রহস্য নির্মাণে যে সময় ব্যয়িত হয়েছে, সিকোয়েলের পরবর্তী খণ্ডে স্বাভাবিকভাবেই তার আর প্রয়োজন পড়ে নি। প্রথম খণ্ডের সেই রহস্যনির্মাণ পর্যায়টিতেও নাজিম উদ্দিন যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পাঠক নুরে ছফার প্রকৃত পরিচয় পর্যন্ত জানত না। অনেক পরে জানা যায় যে সে বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশের এক শীর্ষ স্থানীয় অফিসার। সুন্দরপুরে সে কেন এসেছে আর কীসের তদন্ত সে করছে, সেটাও ধীরে ধীরে পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। রেস্তোরার খাবারের অদ্ভুত স্বাদ যা দূর দূরান্তের লোককে এখানে টেনে আনে তার মধ্যেই রহস্য লুকিয়ে আছে না এখানে খেতে আসা কারোর কারোর নিখোঁজ হয়ে যাওয়াই মূল রহস্য তা জানতে পাঠককে অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হয়। এই অপেক্ষাপর্বে থ্রিলারের উত্তেজনার বদলে সাধারণ কিছু কৌতূহল নিয়েই পাঠক গ্রামীণ চরিত্রগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছে। সংবাদ সরবরাহকারী আতর আলী, কবরের মাটি খোঁড়ার কাজ করা ফালু, রবীন্দ্রনাথের নামচিহ্নিত হোটেলের সামনের দোকানের রহমান মিয়ার মতো মানুষগুলি গোয়েন্দা নুরে ছফা বা প্রধান সাসপেক্ট মুশকান জুবেরির পাশাপাশি যথেষ্ট গুরুত্ব নিয়ে এখানে হাজির থাকে। প্রথম খণ্ডে গ্রামের প্রবীণ মাস্টারমশাই রমাকান্ত কামার অতীত ইতিহাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করেন নুরে ছফাকে, তবে দ্বিতীয় খণ্ডেই তার বিস্তারিত উপস্থিতি ও গুরুত্ব আমরা পাই।

দ্বিতীয় খণ্ডের গঠন ও রচনারীতি প্রথম খণ্ড থেকে অনেকটাই আলাদা। এখানে রহস্যের মাঝখান থেকে কাহিনি শুরু হয়। কে সাসপেক্ট, কী তার অপরাধ আর কে গোয়েন্দা এসব পাঠক প্রথম খণ্ডেই জেনে যাওয়ায় এখানে প্রথম থেকেই প্রচলিত থ্রিলারের আদলে গোয়েন্দাকে সাসপেক্টের পেছনে অবিরত ধাওয়া করতে দেখি আমরা। অনেকগুলি চেজ সিকোয়েন্স দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে। অবশ্য নুরে ছফা বা অন্য রহস্যভেদীরা যে সরাসরি মুশকান জুবেরিকে ধাওয়া করেছে তা নয়। কারণ সে প্রথম খণ্ডের শেষে নুরে ছফা ও পুলিশকে বোকা বানিয়ে বেপাত্তা হয়ে যাবার পর কোথায় কীভাবে রয়েছে, সেটাই সবার অজানা। বিভিন্ন সূত্র অনুসন্ধান করে মুশকান জুবেরির সাম্প্রতিক অবস্থান বের করাটাই ছিল মূল চ্যালেঞ্জ।

দ্বিতীয় খণ্ডের কাহিনি এই কারণে আরো জটিল, উত্তেজনাপ্রবণ ও নাটকীয়। এখানে মুশকানকে ধরার জন্য গোয়েন্দা নুরে ছফার নতুন তৎপরতা অনেক সরাসরি। সুন্দরপুরের গণ্ডী ছেড়ে কাহিনি এখানে ঢাকা, কলকাতার নানা অঞ্চলে যেমন বিচরণ করেছে, তেমনি কখনো কখনো আবার ফিরে গেছে সুন্দরপুরেও। অনেক বেশি চরিত্রর দেখা পাওয়া গেছে দ্বিতীয় খণ্ডে। প্রথম খণ্ডে মূলত গ্রামীণ সাধারণ কিছু মানুষ জনকেই নুরে ছফা আর মুশকান জুবেরির চারপাশে আমরা দেখেছিলাম। দ্বিতীয় খণ্ডে দেশের নামকরা রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, চিকিৎসকরা তো বটেই, কলকাতা পুলিশের বড় বড় অফিসাররা পর্যন্ত চরিত্রপাত্র হিসেবে সরাসরি হাজির হয়েছেন। নুরে ছফার পাশাপাশি রহস্য সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব আশেক মাহমুদ সরাসরি ভূমিকা নিতে থাকেন এবং তার আস্থাভাজন সহকারী আসলামকে এই কাজে নুরে ছফার সমান্তরালে গোপনে নিয়োগ করে দেন ও তাকে দরকারে আইন কানুনের বাইরে যেভাবে হোক রহস্য সমাধানের চেষ্টা করতে বলেন। অপহরণ, ধর্ষণ ও খুনের হুমকি বেশ কয়েকটি দৃশ্যে দেখা যায়।

উপন্যাসের এই দ্বিতীয় খণ্ডে আমরা জানতে পারি প্রথম যৌবনে মুশকান সোহেলি বাধ্য হয়েই জীবন বাঁচানোর তাগিদে নরমাংস খেয়েছিল বটে, কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে সে বুঝে যায় মানুষের শরীরের বিশেষ অংশ ভক্ষণ তাকে চিরযৌওবনা করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে গোপনে মানুষ শিকার ও তারপর তার গোপন অংশ ভক্ষণ সে চালিয়েই যায়। পরবর্তীকালে এই চক্রে সামিল হয় আরো দুজন। তার পরম বন্ধু ডাক্তার আসকার ও তার মেয়ে সুস্মিতা।

মুশকান জুবেরির পাশাপাশি নুরে ছফার আর এক সাসপেক্ট হিসেবে উঠে আসে সুস্মিতা সমাদ্দার। একটা দীর্ঘ পর্বে নুরে ছফা ভেবেছিল মুশকান জুবেরি আর সুস্মিতা সমাদ্দার একই ব্যক্তি। প্লাস্টিক সার্জারী করিয়ে মুশকান জুবেরি সুস্মিতা সমাদ্দারে রূপান্তরিত হয়ে সবার চোখের সামনে থেকেই সবাইকে ধুলো দিচ্ছে। কিন্তু ঘটনার গতি শেষমেষ এই অনুমানকে মিথ্যে প্রমাণ করে। তবে নুরে ছফা যে তার গোয়েন্দাগিরির দক্ষতার প্রমাণ রেখে অনেক গোপন তথ্য জানতে সক্ষম হয়েছে তা মুশকান জুবেরি ও সুস্মিতা দুজনেই বুঝে যায় এবং ঘোর বিপদ থেকে কোনওক্রমে পালাতে সক্ষম হলেও তাদের নতুন অজ্ঞাতবাস কতদিনের জন্য নিরাপদ তাই নিয়ে ধন্দে থাকে। যদি মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এই থ্রিলারের তৃতীয় খণ্ড লেখেন তাহলে সেখানে কাহিনি এই জায়গা থেকে শুরু বলে পাঠক এরকম অনুমান করতে পারেন। থ্রিলারে সাধারণভাবে গোয়েন্দা সাসপেক্টের চতুরতাকে অতিক্রম তাকে বাগে আনতে সক্ষম হন, রহস্যেরও নিরসন করেন। প্রথম দুই খণ্ডে নুরে ছফার অনেক সাফল্য সত্ত্বেও মুশকান জুবেরি শেষপর্যন্ত তাকে বোকা বানিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছে। তৃতীয় খণ্ড লেখা হলে সেখানে ডিটেকটিভ আর সাসপেক্ট এর অন্তিম অবস্থান কীরকম হবে তা নিয়েও পাঠকের কৌতূহল থাকবে।