শাহীন আখতারের 'তালাশ' : এক অনন্ত অনুসন্ধান
- 07 June, 2021
- লেখক: শ্যামাশ্রী চৌধুরী
"যে সময়ে আমরা বেঁচে আছি , তার সঙ্গে যদি আপনার পরিচয় না থাকে, আমার গল্পগুলো পড়ুন। আপনি যদি আমার গল্পকে সহ্য না করতে পারেন , তবে বুঝবেন , এই সময়টাই অসহনীয়।" এই বিখ্যাত উক্তি যাঁর তিনি উর্দু ভাষা এবং ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে পঠিত ও বিতর্কিত লেখক সদত হসন মন্টো। গতবছর এশিয়ান লিটারেরি অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হওয়া শাহীন আখতারের'তালাশ'উপন্যাসটি সম্পর্কেও এই উক্তিটি যে কতখানি প্রাসঙ্গিক তা পাঠক সহজেই উপলব্ধি করবেন। সত্যিই 'অসহনীয়' এই সময়, নিয়ত যুদ্ধরত এই পৃথিবী। সেই ভয়াবহতা থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে বসে কেবল সংবাদপত্র, টেলিভিশন কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার কিছু ক্লিপিং দেখে তার সামান্যতম ধারণা হয়ত করতে পারি। সেই ধারণা আর বাস্তবের ফারাক মুছে দেয় "তালাশ" এর মতো মহাকাব্যিক উপন্যাস। সেখানে মেরী বা মরিয়ম লক্ষ লক্ষ নির্যাতিতা নারীর একজন যে "হামানদিস্তায় থেঁতলানো দেহ আর কোরবানির মাংসের মতো ভাগে ভাগে বেঁটে দেওয়া জীবন নিয়ে বাঁচে। তারপর এই দেহ তার আর নিজের থাকেনি। নিজের জীবন আর কোনোদিন নিজের হয়নি।"
মরিয়মের এই নিয়তি তার দেশের সঙ্গে এগিয়েছে। দেশের প্রতিটা পট পরিবর্তনে, বিপর্যয়ে এক একজন পুরুষ সঙ্গীকে সে হারিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ভাই মন্টুকে ফুলতলি গ্রামে পাঠিয়ে ঢাকা শহরের বাসায় সে একা হয়ে যায়। পুরোপুরি একা বলা যায় না কেননা তার ভেতরে বাড়ছে আরো একটি প্রাণ। আর সেই প্রাণের অংশীদার এস এম হলের আবাসিক ছাত্র নেতা আবেদ জাহাঙ্গীর সময়মতো পিছুটানকে দুমড়েমুচড়ে ফেলে দেওয়ায় মুক্তি যুদ্ধের আগেই যেন হেরে যায় দেশ বিশ্বাসের কাছে , ভরসা আর অনুক্ত প্রতিশ্রুতির কাছে।ঢাকা শহর যেদিন জ্বালিয়ে দিল শাসকদল, নির্বিচারে হত্যালীলা চলল বাইরে,ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল মরিয়ম। দু'টাকার পতাকার মতোই তুচ্ছ হয়ে যাওয়া প্রেম যা বিপ্লব ভাবনার আর এক রোমান্টিক সঙ্গী তার রক্তে ভেসে পৃথিবীতে নেমে এলো অবয়বহীন রক্তপিন্ড হয়ে। যন্ত্রনায় তলিয়ে যেতে যেতে জেগে উঠলো শৈশবের প্রথম ব্যথার অনুভূতি, মুখের মধ্যে রক্তের স্বাদের সঙ্গে উপড়ে আসা দাঁত। ক্রমে ক্রমে নারী জীবনের সূচনাকালীন রক্তক্ষরণের স্মৃতি । এক আশ্চর্য মুন্সীয়ানায় লেখক মুহূর্তে টেনে নিয়ে যান অতীতে আর তৈরি হয় এমন আলো আঁধারি ছবি । এমনই এক নৈপুণ্যে তিনি উপন্যাসের শুরুতে মরিয়মের দাঁড়ানোর ভঙ্গীতে স্পষ্ট করে তোলেন এক বিষম অনিশ্চয়তা সর্বোপরি অবস্থানশূন্যতা যা কেবল ব্যক্তিকে ছাপিয়ে বিস্তার লাভ করে নৈর্ব্যক্তিকতায়।
যে রাতে মরিয়মের গর্ভস্থ ভ্রূণের ভবিষ্যত নির্ধারিত হল সেই রাতেই জন্ম হল 'মুক্তি'র। এই মুক্তিই যুদ্ধ শেষ হওয়ার বহু বছর পর তার সাক্ষাৎকার নিতে আসে, খুঁড়তে থাকে অতীত।
ধ্বংসলীলা আর গণহত্যার রাতে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা যখন বেতারে টাটকা খবরে আহ্লাদিত তখন হঠাৎই ধৃতরাষ্ট্র কথা বলে ওঠেন সঞ্জয়ের সঙ্গে। জীবন, ইতিহাস , মহাকাব্য মুখোমুখি দাঁড়ায়.... ধ্বংসের। মৃতদেহ ভেসে যায় নদীর জলে। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা হাজার হাজার তরুণ ও নিরপরাধ মানুষের রক্ত, মাংস, মজ্জা মাটিতে মিশে ধুলো হয়ে যায় রাতারাতি। ধুলো জমে যায় স্মৃতির পাতায়। সেই ধুলো মুছে জেগে ওঠে দুঃসহ অতীত ও অপমানিত বর্তমান। যুদ্ধের আঠাশ বছর পর মরিয়মের সাক্ষাৎকার নেয় মুক্তি।
'তালাশ' এর জন্ম প্রসঙ্গে লেখক জানান যে ৭১ এর ওরাল হিস্ট্রি প্রজেক্টে কাজ করতে গিয়ে বীরাঙ্গনাদের সংস্পর্শে আসা। তাঁদের সাক্ষাৎকারগুলি ছিল চোখ খুলে দেওয়ার মতো।তাঁরা শুধু যুদ্ধের নয় মাসের নির্যাতনের কাহিনী বলতেন না। তার পরের কষ্টের কথা বেশি করে বলতেন। কখনও কখনও তা যুদ্ধের ভয়াল অভিজ্ঞতাকেও ঢেকে দিত।
কি হল তবে মরিয়মের সেই রাতের পর ? দশবছরের জেল খাটা খুনের আসামী রমিজ শেখের সঙ্গে শহর ছেড়ে পাড়ি দেয় জীবন যেদিকে নিয়ে যাবে সেই পথে। এভাবেই একদল লোকের সঙ্গে আশ্রয় নেয় 'স্বর্গধাম' নামে সদ্য মালিকহীন হয়ে পড়া হিন্দু বাড়িতে । সেখানে ভারি মুশকিল হল তুলসী তলা আর শীতলা ঠাকুরকে নিয়ে। অবশেষে তুলসী তলা উপড়ে ফেলে এবং ঝুনো নারকেলসহ শীতলাকে জঙ্গলে ফেলে এসে স্বস্তি পায় একদল 'ধর্মভীরু' কিংবা 'ধর্মবিদ্বেষী' দিশেহারা মানুষ। কিন্তু 'আপনা মাংসে হরিণা বৈরী' । স্বর্গধামেও এক কুৎসিত রাজনীতি ঘিরে ধরে মরিয়মকে। পনের বছরের জীবনে প্রথম অনাত্মীয় পুরুষ জসিমুল হক সিনেমা হলে তার হাত ধরে। তার জেরে শহরের বাসায় ভাইয়ের অভিভাবকত্বে তার নির্বাসন হয়। অথচ পরিস্থিতি তাকে টেনে নিয়ে ফেলে নির্যাতন ও দুর্নামের অতল গহ্বরে। মিলিটারিদের হাতে ধরা পড়ে সে।
প্রসঙ্গত মনে পড়ে এলি উইজেলের 'রাত্রি' উপন্যাসটির কথা। কয়েকপাতা পড়ার পরই যে বই বন্ধ করতে হয়। হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের অসম্ভব যন্ত্রণার বিবরণ পড়তে গেলে যে মনোবল দরকার কিংবা সেই বিশ্বাসের জোর যে পৃথিবীর কোনো আঁধারই অনন্ত নয়, তবেই পার হওয়া যাবে সেই দুঃসহ দিনলিপি। বারাকে থাকা মহিলাদের গায়ে কোনো কাপড় থাকত না। পাছে নির্যাতিত হয়ে তারা গলায় দড়ি দেয়। মরিয়ম যে কক্ষে ছিল তার সিলিং এ হুক ছিল কিন্তু মরিয়মের কাছে ওড়না ছিল না জেনে মুক্তি স্বস্তি পায়। কেননা শারীরিক লাঞ্ছনা রুখতে কিংবা লাঞ্ছিত হয়ে নারী আত্মহত্যা করবে এমনটাই শুনতে, দেখতে ও ভাবতে ভালোবাসে জহরব্রতের গৌরবের ইতিহাস এবং নারীদেহের সঙ্গে সতীত্ব, শুদ্ধতা আর পবিত্রতার মতো শব্দের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কের বহুযুগলালিত সংস্কার। অথচ প্রতি মুহূর্ত নরকে যাপন করেও তারা বাঁচতে চেয়েছিল। হয়ত জীবনের স্বাভাবিক ছন্দের মধ্যে দাঁড়িয়ে ক্ষণিক আঘাত, ব্যর্থতা ,হতাশা কিংবা অবসাদে মানুষ মৃত্যুর কথা ভাবে আর মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আঁকড়ে ধরে জীবনকে। ছিয়াত্তর দিন মহাসাগরে ছোট্ট ভেলায় নিয়ত মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করতে করতেও স্টিভেন কালাহান বলেছিলেন ," মরার চাইতে বাঁচার চেষ্টা করা সোজা।" জীবন না মৃত্যু কোনটি বেশি সহজ তা চরম সংকট বুঝিয়ে দেয় পদে পদে তবে একথা ঠিক যে স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে তার পূর্বাভাস পেলে তাদের সিদ্ধান্ত বদলে যেত কিনা কে বলতে পারে ! অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে অসংখ্য নাবালিকা। বারাকের মেয়েরাই তাদের কবর দিয়েছে। মৃত সন্তান প্রসব করেছে অগুনতি অসহায় মা। সেসব কথা লিখতে গেলে কলমের মুখ থেকেও বুঝি রক্ত ঝরে। এ তো অর্ধেক মাত্র। আরো বৃহত্তর অপমান, লাঞ্ছনা আর নির্যাতনের শানিত তরবারিতে ছিন্নভিন্ন হয়েছে লক্ষ লক্ষ নির্যাতিতা নারীর ভবিষ্যত জীবন। অত্যাচারী ভিনদেশী শাসকের অনুগত সেনারাই কেবল নয় , স্বাধীন দেশবাসীও ঠাঁই দেয়নি তাদের সুস্থ জীবনে। বরং ঠেলে দিয়েছে আরো আরো যন্ত্রণার কানাগলিতে।
এই যন্ত্রণাই তাড়িত করেছিল শাহীন আখতারকে। তাই ২০২০ সালে এশিয়ান লিটারেরি অ্যাওয়ার্ড দাতারা বলেন,
"We believe that it is one of the best feminist and antiwar documentary novels by an Asian writer of our times. It is an evidential document of suffering and courage of our times."
শাহীন এই উপন্যাস লিখতে গিয়ে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করলেও কখনও পাঠককে সেই যন্ত্রনার অংশীদার করতে চাননি কিন্তু লেখার মধ্যে স্রষ্টার নিজস্ব অনুভব যদি প্রকৃতই চিত্রিত হয় তবে অজান্তেই পাঠক তাতে আক্রান্ত হতে বাধ্য। রচনাশৈলীতে প্রথাগত বাংলা উপন্যাসের ফর্ম ভেঙে এক নতুন আঙ্গিকে বাস্তব আর কল্পনার মিশেল। লেখক কেবল তৃতীয় পুরুষের বক্তা না হয়ে ঘটনার বিশ্লেষণে সরাসরি কথা বলে ওঠেন পাঠকের সঙ্গে...
"মেরীর দুর্ভাগ্যের কারণ হয়তো নারীর প্রজনন অঙ্গটি, যা বংশরক্ষার সূচিমুখ--তার পবিত্রতা, যা শুধু একজন পুরুষের ব্যবহারের জন্য এবং বৈধভাবে। সেটি অরক্ষণীয় হয়ে পড়ে যুদ্ধের বছর... বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করে গর্ভপাত ঘটানোর পরও নারীদেহের পবিত্রতা পুনরুদ্ধার হয়নি।"
শাহীনের উপন্যাসটির প্রকাশ কাল ২০০৪। তার প্রায় দশবছর পর অর্থাৎ ২০১৪ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি 'চিলড্রেন অফ্ ওয়র'। যেখানে রাষ্ট্রের ক্ষমতা আর নারীদেহের প্রজননের রাজনৈতিক ব্যবহার স্তম্ভিত করেছিল দর্শককে।
১৯৭১ সালের ২৫শে অক্টোবর সোমবার,টাইম ম্যাগাজিনের চাঞ্চল্যকর খবর ছিল ঢাকার মোরাং সামরিক ক্যান্টনমেন্টে ৫৬৩ জন মেয়ের প্রত্যেকেই গর্ভবতী। তাদের গর্ভপাতের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হয় ২৫ শে মার্চ থেকে...
মরিয়ম জানতে চায় ,"এখনও আমাদের নেতা নেত্রীরা স্টেজের উপর উঠে চিল্লাফাল্লা করেন--দু'লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হইছে। সেই দু'লক্ষ মা বোন কই? পাকিস্তানে গেছে না হয় ত্রিশ-চল্লিশজন, বাকিরা কোথায়? তারা কেমন আছে?"
এই প্রশ্নের সামনে তারা খসে। লক্ষ লক্ষ মেয়ে যাদের বেশিরভাগই নাবালিকা তারা কোথায় গেল? কি হল তাদের ? সমাজ কী জীবন এগিয়ে দিল তাদের সামনে? এই উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই
এগিয়ে চলে পাঠক আর সীমাহীন হতাশা গ্রাস করে তাকে। মেয়েদের পুনর্বাসন কেন্দ্র খুলে স্বনির্ভর করার চেষ্টা চলল, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করা হল যদিও সেগুলো প্রহসনেরই নামান্তর। দু'পক্ষই অতীত সঙ্গে নিয়ে ভবিষ্যত গড়তে গিয়ে সব ভেঙে ফেলে। 'বীরাঙ্গনা'দের সঙ্গে কেউ কেউ সম্পর্ক তৈরি করেছে কিছু আর্থিক সুবিধার লোভে। কেউ জানতে চায়নি তারা কি চায়। পরিবার ঢাকতে চেয়েছে লজ্জা, গোছাতে চেয়েছে আখের ,সমাজ সযত্নে তফাৎ রেখেছে এবং প্রয়োজনে কাদা ছুঁড়ে আগল দিয়েছে তার ভবিষ্যৎ শুদ্ধতার ঘরে, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে তাদের ভবিষ্যৎ। পিতৃপরিচয়হীন সদ্যজাত শিশুগুলিকে জন্মের পর বিদেশে দত্তক দিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের না জানিয়ে। কাউকে কাউকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে। নির্যাতিতারা হয়ে দাঁড়িয়েছিল পরিবার, সমাজ আর রাষ্ট্রের 'বোঝা'। বারাকে বন্দী অনুরাধা বলেছিল,
-"তুমি ভাবছ স্বাধীন দেশের মানুষ মালা দিয়া আমাদের বরণ করবে? না মেরী, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা কদাচ ঘটেনি। যুদ্ধশেষে পুরুষেরা বীরের খেতাব পায় আর মেয়েদের বলা হয় কলঙ্কিনী। আমাদের ধরে ধরে তখন বেশ্যা বানাবে--তুমি দেখো ।"
এ ভয়ঙ্কর সত্য চিরকালীন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আবারও গড়ে ওঠে দুঃসহ স্মৃতি বুকে চেপে। মেয়েরা কিছুতেই ফিরতে পারেনা সুস্থির জীবনের ছন্দে। তাদের নতুন নামকরণ হয় 'comfort women'। দীর্ঘ দু'বছর ধরে চলা অতিমারীর গ্রাসে অসংখ্য প্রাণ। এও এক অন্য যুদ্ধ, বিষম অবরোধ ! তফাৎ এই যে এই যুদ্ধ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নতুন নতুন 'comfort women' তৈরি হওয়াকে সাময়িক বিলম্বিত করেছে।
মরিয়ম ছাড়া যে চরিত্রটি মনে দাগ কেটে যায় সে অনুরাধা। বারাকে কাগজ কলম পেলে অ্যান ফ্রাঙ্কের মতো সে লিখত বন্দী জীবনের কথা। অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে নরকের দেওয়ালে কান পেতে বৃষ্টির শব্দ শোনে। দেওয়ালের ঘ্রাণ নেয়। শিউলির গন্ধের হ্যালুসিনেশন হয়...শরতের আগমনে মা দুর্গার আসার সময় হয়ে আসে। যদিও আসল মহামায়ার আদল তখন ইন্দিরা গান্ধীর মুখে। মৃত্যুর গাঢ় অন্ধকারে অনুরাধা জীবন হয়ে টিকে থাকে। অথচ স্বাধীন দেশ তাদের সামনে ভিক্ষা ও অন্ধকার গলির দরজা খুলে দেয়। নিজের জন্মস্থানে টাকা দিয়েও কবরের জায়গার সংস্থান হয়না। যুদ্ধবিধ্বস্ত যে দেশের ছবি আমরা দেখি তার ভেতরেও একটা অন্য পরাজয়ের গল্প আছে। যে গল্পে মরিয়মের বড় পিসির মৃত্যুর পর তার বিয়ের সময় সঙ্গে যাওয়া এক ট্রাঙ্ক ভর্তি বই ফিরে আসে যেটা একবারও খোলা হয়নি। সেই গল্পেরই আরেক অংশে মরিয়মের বাবা কফিলউদ্দিন আহমেদ একমাত্র ছেলে মন্টুকে যুদ্ধে হারিয়ে বিষয় সম্পত্তি মূল্যহীন মনে করেন এবং জীবিত তিন মেয়ের ভবিষ্যতের কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে অর্থ সম্পদ যথেচ্ছভাবে নষ্ট করতে থাকেন। পুত্রের মৃত্যুতে অর্থহীন হয়ে যাওয়া জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে আরো একটি পুত্র সন্তানের কামনায় রাতের অন্ধকারে স্ত্রীর ঘরে যেতে গিয়ে মনে পড়ে স্ত্রী ততদিনে সে ক্ষমতা হারিয়েছেন। মরিয়মের জীবনে আসা আবেদ জাহাঙ্গীর, মমতাজ, আবেদ সামির, দেবাশীষ দত্ত সকলের ভূমিকায় সেই একই গল্পের নানা শাখা প্রশাখা যেখানে স্পষ্ট হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র নামক সভ্য সমাজের তিনটি কাঠামোয় নারীর অবস্থান। সেই একই অন্ধত্বই অন্য আঙ্গিকে ধর্মের বেশে আসে যখন দেবাশীষ দত্তকে মিথ্যে পরিচয়ে বিয়েতে বসতে বাধ্য হতে হয়। গোটা উপন্যাস জুড়েই যে যন্ত্রণায় পাঠক আক্রান্ত হয় তা পরিণত হয় নিষ্ফল ক্রোধে, হতাশা ছুঁয়ে ভয়ে কেননা যুদ্ধ আজও থামেনি। কখনও যে থামবে সে ভরসাও আশ্বস্ত করে না । সীমান্ত অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর অবস্থান, সামরিক শাসনের আবশ্যিকতায় আমরা নিশ্চিন্তে থাকি আর হাজারও অবদমন সত্ত্বেও 'মনোরমা'রা উঠে এসে সুললিত সভ্যতাকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়। পৃথিবীতে যতদিন যুদ্ধ থাকবে , আগ্রাসনের ভাবনায় সর্বদা উত্তপ্ত রক্তস্রোত প্রবাহিত হবে শিরা ও ধমনীতে ততদিন মরিয়মরা ধর্ষিত হতে থাকবে রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে, লাঞ্ছিত হতে থাকবে দেশ। বাইরের ছদ্ম উপশম কখনও স্পর্শ করতে পারবে না ব্যথার মর্মস্থল..তার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে যান লেখক নির্মোহভাবে, " যুদ্ধ বিক্ষুব্ধ সাগরের মতো। তা ধ্বংস করে, আপনজনের মৃত্যু ঘটায় আর সয়-সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তা অন্ধ--বড়লোক--ছোটলোক মানে না, নারীদের উলঙ্গ আর বেইজ্জত করে। যুদ্ধ শেষে পরিষ্কার -পরিচ্ছন্ন ফর্সা চেহারার শহুরে , ভিনদেশি মানুষেরা খাদ্য -খাবার আর ক্যামেরা নিয়ে আসে। নিজেরা সঙ্গে আনা বোতল খুলে পানি খায়, সেই পানিতে কাউকে ভাগ বসাতে দেয় না। তারপর খাওয়ার জিনিস বিতরণ করে ছবি তুলে যেখান থেকে এসেছিল সেখানে ফিরে যায়।"
উপন্যাসটি শেষ হয় এক অদ্ভুত আলোআঁধারিতে। স্বপ্ন ও বাস্তবতা মিলে মিশে নিয়ে যায় এক রহস্যময় গন্তব্যে। নৌকা যাত্রার মেটাফর। ধ্বংসের পরে সৃজন... নতুন জীবনের সন্ধানে যাত্রা। উপন্যাস শেষ হয় কিন্তু চলতে থাকে সেই নতুন পৃথিবীর খোঁজ। স্বস্তি পায় না মন কেননা নিত্য নতুন যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েই যায়। তাই মুক্তি যুদ্ধের পটভূমিতে লেখা এই উপন্যাস প্রাসঙ্গিকতা হারায় না কেবল এক বিশেষ সময়ের সত্য উন্মোচনে। পুরস্কারদাতারা 'তালাশ'কে সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচের 'দ্য আনওম্যানলি ফেইস অব দ্য ওয়র', রুথ ক্লাগারের 'স্টিল অ্যালাইভ' বা মার্থা হিলারের 'আ ওম্যান ইন বার্লিন' এমন কয়েকটি যুদ্ধ বিরোধী উপন্যাসের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
উপন্যাসটি পড়তে পড়তে মনে হতে পারে কিছু কিছু জায়গা অগোছালো একটু খাপছাড়া ।কখনও সরাসরি বাস্তব চরিত্রেরা মিশছে হঠাৎ করেই। কোনটা উপন্যাসের কল্পনা আর জীবনের সত্যি তা আর আলাদা করা যায় না। তবে মর্মন্তুদ বেদনা ও অপমানের এমন জ্বলন্ত ইতিহাসকে পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা যায় না। তা হলে মূল সুরটি এত তীব্র, তীক্ষ্ম হয়ে আঘাত করত না চেতনার মর্মমূলে।
পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় 'তালাশ' অনূদিত হোক পাঠক হিসেবে এমন একটি সার্থক উপন্যাস পড়ে এই ইচ্ছেই পোষণ করি। ২০১১ সালে দিল্লি থেকে প্রকাশিত হয় ইংরেজি অনুবাদ। সম্প্রতি কোরিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
'তালাশ' শাহীন আখতারের দ্বিতীয় উপন্যাস। প্রথমটির নাম 'পালাবার পথ নেই'। তাঁর লেখক জীবনের দুই দশক অতিক্রান্ত হলেও তিনি লিখেছেন বেশ কিছু ছোটগল্প ও পাঁচটি উপন্যাস । তবে সবকটি উপন্যাসই যুগোত্তীর্ণ। উপন্যাস গুলির ভিত্তি ইতিহাস। লেখার ফর্ম নিয়ে নিয়ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন তিনি আর 'তালাশ' এর মতো রচনা দিয়ে ছুঁয়ে যান পৃথিবীর সব প্রান্তের অত্যাচারিত নির্যাতিতর ক্রন্দন ,ক্ষত। লেখনী অক্ষয় হোক তাঁর। জীবন ভাষ্যে এমনই সচল, সক্রিয় থাকুক তাঁর সৃজন ভাবনা।
আবারও মনে পড়ছে 'রাত্রি' উপন্যাসের শেষ পাতা..." এমন সময় আসতেই পারে যখন কোনো অন্যায়কে প্রতিরোধ করার সামর্থ্য হল না আমাদের, কিন্তু এমন সময় যেন কখনও না আসে যখন প্রতিবাদ করতেই ব্যর্থ হলাম আমরা..."
আমাদের প্রতিবাদ জারি থাক। আমরা স্বপ্ন দেখতে শিখি আগ্রাসন মুক্ত পৃথিবীর...