বাংলায় বৌদ্ধধর্ম : একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা

ভারত ভূখণ্ডের ইতিহাসের পাতা উল্টানো গেলে যে সংস্কৃতির ও দর্শনের কথা অনিবার্য ভাবে উঠে আসে, তা হলো বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও দর্শনের কথা, আর এই দর্শন চর্চার প্রধান কেন্দ্রভূমি হল বঙ্গদেশ, অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ । সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতা নিয়ে তৈরী হয় যে কলকাতা শহর, ব্রিটিশ উপনিবেশ কালে, বঙ্গদেশের সংস্কৃতির বা এ ভূখণ্ডের মানুষের শিক্ষিত হয়ে ওঠার সূচনা তখন থেকে নয়; চন্ডীদাসের বা চৈতন্যের জন্মলগ্ন বা চন্ডীদাসের কাব্য রচনা থেকেও নয়; তার উদ্ভব তারও হাজার বছর পূর্বে, খ্রিষ্ট জন্মেরও পূর্বে।

‘বাংলা ভাষার’ উদ্ভব ও বঙ্গদেশের সংস্কৃতির উদ্ভব একই সময়ে নয়। ভাষা নিজের নিয়মে পরিবর্তিত হয় I গৌড়ীয় প্রাকৃত থেকে ভাষা, অপভ্রংশ এবং তার থেকে বাংলা হয়ে ওঠে I এ দেশের ভাষা সময়ের ধারার সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছিল এবং হবে I বঙ্গদেশের, এ ভূখণ্ডে মানুষের জীবন, তার ভাবনা প্রবাহ, তার দর্শন ভাবনা, বাংলা ভাষার জন্ম সময়ের বহু পূর্বেই সূচনা হয়েছিল। বাংলা ভাষার জন্ম এ দেশের মানুষ কে চিন্তা ও তার প্রকাশের এক নতুন অস্ত্র দিয়েছে। এদেশের প্রাচীন অংশগুলি ছিল বঙ্গ, পুন্ড্র, রাঢ়, গৌড়, সমতট প্রভৃতি। এদের সমযোগে আজ বঙ্গ বলেই উল্লেখ করব। প্রাচীন বঙ্গ ছিল কৌম প্রধান। ছোট ছোট প্রাচীন কৌম ভিত্তিক সমাজ এবং অঞ্চলভেদে ছিল তার ভিন্ন ধর্মীয় আচার। ড. নীহাররঞ্জন রায় বাঙালির ইতিহাস - এ তা খুব স্পট করে উল্লেখ করেছেন।

 

বঙ্গদেশের প্রাচীন দর্শন চর্চার সময়কাল

 

ইসলাম ধর্মের আগমন ঘটে ১২শ শতকে। তার পূর্বে জৈন, আজীবিক, বৌদ্ধ এবং ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ প্রধানত বসবাস করেছে এ দেশে। বৈদিক ধর্ম এদেশে সেই কালে প্রবেশ লাভ করেনি, জাতি বিভক্ত, ব্রাহ্মণ্যধর্মেরই আগমন ঘটেছিল এদেশে এবং তার আগমন ঘটে মূলত গুপ্ত রাজাদের আমলে। কিন্তু আজীবিক, বা জৈন বা বৌদ্ধ ধর্মের আগমন ঘটে তার বহু পূর্বে। ড. নীহার রঞ্জন রায় লিখছেন,

" জৈন, আজীবিক ও বৌদ্ধ ধর্মের পূর্বাভিযানকে আশ্রয় করিয়াই প্রাচীন বাঙলায় আর্য - ধর্মকর্মের প্রাথমিক সূচনা ও বিস্তার। "

এ ক্ষেত্রে নীহাররঞ্জন রায় কেন বৌদ্ধ ধর্মকে "আর্য ধর্ম" বলে উল্লেখ করেছেন তা সম্পর্কে প্রশ্ন জাগে, কারণ গৌতম বুদ্ধ আর্যছিলেন না, এবং মূলত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতিবাদী ধর্ম হিসাবেই বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান। ফলে যে ধর্মের উত্থান আর্য ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার বিরুদ্ধে, লিচ্ছবি উপজাতির এক রাজকুমারের মধ্য দিয়ে তাকে আর্য ধর্ম বলতে অবশ্যই আপত্তি রয়েছে। যাই হোক, তাঁর ও অন্যান্য ঐতিহাসিকদের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট, যে হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আগমনের আগেই বৌদ্ধ ধর্মের আগমন ও বিস্তার ব্যাপক রূপ ধারণ করে। এবং এই আগমন ঘটে সম্রাট অশোকের শাসন কালের পূর্বেই I কারণ হয়তো বুদ্ধ গয়া বা বিহার এর বাংলা দেশের সঙ্গে নৈকট্য।

ড. নীহাররঞ্জন রায় 'বাঙালির ইতিহাস' এ লিখছেন,

" বোধিসত্ত্বাবধান কল্পলতা গ্রন্থের অনাথপিন্ডকসূতা সুমাগধার কাহিনীতে জানা যায় যে, বুদ্ধদেব স্বয়ং একবার ধর্মপ্রচারোদ্দেশে পুন্ড্রবর্ধনে আসিয়া ছয় মাস বাস করিয়া গিয়েছিলেন। চীনা পরিব্রাজক য়ুয়ান- চোয়াঙ ও বলিতেছেন, বুদ্ধদেব পুন্ড্রবর্ধন, সমতট, ও কর্ণসুবর্ণে আসিয়া ধর্ম প্রচার করিয়া ছিলেন কিন্তু এতগুলো উল্লেখ সত্ত্বেও বুদ্ধদেবের বাঙলাদেশে আসা ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া মনে হয়না, দীক্ষাদান সম্পর্কে পলি বিনয়পিটক - গ্রন্থে আর্যাবর্তের পূর্বতম সীমা টানা হইয়াছে কজঙ্গল; সংস্কৃত বিনয় গ্রন্থে এই সীমা বিস্তৃত হইয়াছে পুন্ড্রবর্ধন পর্যন্ত । এই দুইটি সাক্ষ্য হইতে মনে হয়, বুদ্ধদেব স্বয়ং বাঙলাদেশে আসুন বা না আসুন, মৌর্য সম্রাট অশোকের আগেই বৌদ্ধধর্ম প্রাচীন বাঙলায় কোনও কোনও স্থানে বিস্তার লাভ করিয়াছিল। অন্তত খৃস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে বৌদ্ধধর্ম যে সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছিল মহাস্থান-শিলাখন্ড লিপিতে তো তাহার পাথুরে প্রমাণও বিদ্যমান।''

এবং এই বঙ্গদেশ ক্রমে হয়ে ওঠে বৌদ্ধ দর্শন ও তার আলোচনার প্রধান পীঠস্থান।

পুষ্প নিয়োগী তাঁর " Buddhism in Ancient Bengal" এ বলেছেন,

" It produced numerous scholars, respected and admired in Buddhist world. Here, where founded many monasteries, which developed as active centre of learning, visited by scholars not only from other parts of India but also from outside."

বঙ্গদেশে ব্রাহ্মণ্য আর্য ধর্মের বিস্তার ঘটে বহু পরে। প্রাক- গুপ্ত পর্বে আর্য - বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রসারের নির্ভরযোগ্য প্রণাম প্রায় কিছুই পাওয়া যা না । অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার ভিত্তি এই বঙ্গদেশে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের ভিতের উপরেই স্থাপিত হয়। গুপ্ত রাজারা হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও বুদ্ধধর্মের প্রসার আটকাতে পারেননি। হিন্দু ধর্মের প্রসারের পাশাপাশিই বৌদ্ধ ধর্ম কে তাদে স্বীকার করতে হয়েছিল। এবং দেশের রাজা 'হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী' হওয়া সত্ত্বেও উত্তর ভারতের বিষ্ণুর বা তার অবতারদের যে প্রভাব প্রতিপত্তি তা এই বঙ্গদেশে কোনোদিনই বিস্তার লাভ করেনি । তার একটি কারণ এখানকার ' কৌমমূলক' দেব দেবীর সুগভীর প্রভাব এবং দ্বিতীয় কারণ গভীর বৌদ্ধ দর্শনের চর্চার পীঠস্থান হিসেবে বঙ্গদেশের প্রতিষ্ঠা I

 

বৌদ্ধ বিহারগুলি

 

ভারত ভূখণ্ডের এই পূর্ব অঞ্চল চিরকালই যুক্তিবাদী দর্শন ও বিদ্যার অংশী থেকেছে। ফাহিয়ান পঞ্চম শতকের দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে ভারত ভূখণ্ডে আসেন এবং ৪০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪১১ খিস্টাব্দ এই ছয় বছর এ ভূখন্ডে অবস্থান করেন। এখানে তিনি বৌদ্ধ দর্শন গভীর ভাবে অধ্যায়ন বা পাঠ করেন। এই ছয় বছরের মধ্যেই তিনি বঙ্গদেশে আসেন। বঙ্গদেশে তিনি তাম্র--লিপ্তি তে এসেছিলেন এবং সেখানে তিনি দু 'বছর থাকেন। এখানে তিনি ২২টি বৌদ্ধ মঠের সন্ধান পান। তারানাথ তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, যে দ্বিতীয় শতকেই নালন্দা বৌদ্ধদের দর্শন আলোচনার অন্যতম স্থানে পরিণত হয়। দ্বিতীয় শতকে বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন নালন্দায় শিক্ষা লাভ করেন এবং তাঁর মূলমধ্যমকারীকা, শূন্যতাসপ্ততি প্রভৃতি একাধিক বৌদ্ধ দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন, যা বৌদ্ধ দর্শনের ‘মধ্যপন্থা’ ও ‘শূন্যতাবাদের’ মতো গুরুত্বপূর্ণ মতবাদের সূচনা করে। বঙ্গদেশের কথা বলতে গিয়ে নালন্দার কথা বলার মূল কারণ হল, দ্বিতীয় শতকে নালন্দার প্রসার একই ভাবে বঙ্গদেশের নানা অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করে এবং বঙ্গদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বৌদ্ধ মঠ ও ক্রমে সুবৃহৎ মহাবিহার গড়ে ওঠে।

বঙ্গদেশে বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন চর্চার কেন্দ্র যে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল তা ফা -হিয়ান, হিউ-এন স্যাং ও অন্যান্য চৈনিক পরিব্রাজকদের লেখা থেকে স্পষ্ট ভাবে জানা যায়। যদিও গুপ্তকালের পূর্বে অন্যান্য প্রমানের অভাব বোধ থেকে যায়। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে হিউ যেন স্যাং ভারতবর্ষে আসেন। তিনি নালন্দায় প্রধান উপাচার্যর শীলভাদ্রের ( ৫২৯ - ৬৪৫) দেখা পেয়েছিলেন। শীলভদ্র ছিলেন বঙ্গদেশের সমতটের বাসিন্দা। হিউ এন স্যাং এর শিক্ষক ছিলেন শীলভদ্র। শীলভদ্র প্রধানতঃ যোগাচার্যের শিক্ষক ছিলেন। শীলভদ্র সম্পর্কে একটি দারুন ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। ৩০ বছর বয়সে দক্ষিণ ভারতের এক ব্রাহ্মণ পন্ডিত কে তর্কে পরাস্ত করে সে অঞ্চলে একটি বিহার প্রতিষ্ঠা করেন শীলভদ্র, যা পরবর্তীতে সেই দেশের রাজার অর্থে প্রতিপালিত হত। হিউয়েন স্যাং লিখেছেন, শীলভদ্র তখন নালন্দার একমাত্র আচার্য ছিলেন, যিনি সমস্ত গুরুপূর্ণ পুঁথি পাঠ করেছিলেন।

হিউয়েন স্যাং বঙ্গদেশের পুন্ড্রবর্ধন-এ আসেন। এখানে তিনি ২০টি বিহারের সন্ধান পান যেখানে প্রায় ৩০০০ বৌদ্ধ শ্রমণ পাঠরত ছিল। তিনি পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহারও দর্শন করেছিলেন। হিউ- এন - স্যাং রাজমহলের কাছে কঞ্জলে ৭টি বৌদ্ধ ধর্মের মঠ দেখে ছিলেন I কর্ণসুবর্ণের কাছে ১০টি বৌদ্ধ মঠ দেখে ছিলেন I

চীনা পরিব্রাজক, ( I-Tsing) ইয়েজিং ( ৬৩৫-৭১৩) চীন থেকে ভারতে এসেছিলেন এবং এখানে এসে বৌদ্ধ সাহিত্য ও দর্শন চর্চায় নিমগ্ন হয়ে ছিলেন। তিনি সপ্তম শতাব্দী তে তাম্রলিপ্তি (বর্তমান তমলুক ) তে আসেন এবং সেখানে ৫-৬টি বৌদ্ধ বিহার লক্ষ্য করেন তার মধ্যে, একটি মহা বিহারের সন্ধান পান তিনি। যার নাম হলো বরাহা মহা বিহার। প্রাচীনকাল থেকেই তাম্রলিপ্তি ছিল বৌদ্ধদের অন্যতম অঞ্চল। তিনি বঙ্গদেশের সমতটে বৌদ্ধ ধর্মের বিরাট ব্যাপ্তি লক্ষ করেছিলেনI রক্তমৃত্তিকাও ছিল বৌদ্ধ দর্শন চর্চার কেন্দ্র। তাঁর স্মৃতি কথায় দেখি , দক্ষিণ দিক থেকে বঙ্গদেশে প্রবেশ করেন তিনি এবং সমতটের রাজা, যিনি ছিলেন বৌদ্ধ উপাসক তাঁর দেখা পান। ইনি প্রত্যহ মহাপ্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের শ্লোক পাঠ করতেন। এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করার কারণ হল, এই বিষয়টি স্পষ্ট করে তোলা যে যদিও বুদ্ধের মূর্তি পূজার চল ঘটেছিল, কারণ অবলোকিতেশ্বের এর মূর্তি পূজার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু বৌদ্ধ দর্শনের চর্চা বা পাঠও গভীর ভাবে বর্তমান ছিল। এর আরো অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। সোমপুর বিহার, জগদ্দল মহাবিহার, দেবীকোটা বিহার , হলুদ বিহার , ত্রিকূট বিহার , বজ্রাসন বিহার, শালবন বিহার -এবং আরো অনেক বিহারের সন্ধান পাওয়া গেছে। পরবর্তীতে পাল রাজত্বকালে বঙ্গদেশে যে মহাবিহার বা মহাবিদ্যালয়গুলোর নির্মাণ ও উত্থান ঘটে, সেটিও তারই পরিচয় বহন করে। পাল রাজত্বের পূর্বেও বঙ্গদেশের ছোট ছোট রাজ্যগুলি, গভীর ভাবে বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন চর্চা করেছে।

পাল রাজারা বঙ্গদেশ রাজা হিসেবে আসন গ্রহণ করেন অষ্টম শতকে। গোপালের রাজ্যাভিষেকের কথা আমরা সকলেই জানি। তিনি কোনো যুদ্ধ জয় করে রাজা হননি। জনগণ তাকে রাজা হিসেবে নির্বাচন করেছিল। এবং তার পরবর্তীকালে পাল রাজারা বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন, যা ছিল বঙ্গদেশে তখন অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী ধর্ম ,তার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। মনে রাখা দরকার তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ধর্ম বাংলার অন্যতম ধর্ম হয়ে ওঠেনি। কারণ তার পূবেই বৌদ্ধ ধর্মের বিরাট ব্যাপ্তি ঘটেছিল I গোপাল একজন ছোট সামন্ত ছিলেন। গোপাল ছিলেন বৌদ্ধ। ফলে বোঝা যায় সাধারণের জনগণের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম স্বাভাবিক ছিল।

৮ম থেকে প্রায় ১২ শতক পর্যন্ত তাঁরা শাসন করেছেন এবং তাঁদের সময়কালে গড়ে ওঠে অনেকগুলো মহাবিহার যা ছিল আসলে তৎকালীন মহাবিদ্যালয়। পালরাজাদের আমলে গড়ে উঠেছিল ওদন্তপুরী মহাবিহার, সোমপুরী মহাবিহার, বিক্রমশীলা মহাবিহার (বিহারের ভাগলপুরের কাছে) এর মতো বিরাট সব মহাবিহার। নালন্দা অবশ্যই তখন সমগ্র ভারত ভূখণ্ডে ও দক্ষিণ এশিয়ায় বিরাট প্রতিপত্তি বিস্তার করেছে।

দেবপালের আমলে (নবম শতক) সুমাত্রা, জাভা ও মালয় দ্বীপপুঞ্জের শৈলেন্দ্র রাজবংশের উপর বাংলা দেশ গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। দেবপালের আমলে জাভার ( বর্তমান ইন্দোনেশিয়া) শীলেন্দ্র রাজবংশের(অষ্টম/নবম শতক) এক রাজা ছিলেন গৌড়ের বৌদ্ধাচার্য কুমারঘোষের শিষ্য।পাল রাজাদের আমলেই তিব্বতের সঙ্গে বঙ্গদেশের ও বিহারের যোগাযোগের স্থাপনা হয়, মহাযান গভীর প্রভাব বিস্তার করে তিব্বতে। এই তিব্বতই পরবর্তী বিপদকালে বহু গুরুত্বপূর্ণ পুঁথি সংরক্ষন করে রেখেছিল। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (৯৮২- ১০৫৪) তিব্বতে গিয়ে মহাযানের বহু গুরুত্বপূর্ণ পুঁথি রচনা করেছিলেন।একটি বিষয় উল্লেখ করা অবশ্যই কর্তব্য, যেকোনো রাজা বা ব্যক্তি বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করে ছিলেন তারা অন্য ধর্মের প্রতিও সমান সহানুভূতিশীল বা ধৈর্যশীল ছিলেন। নিজের ধর্ম বা দর্শনের পৃষ্ঠপোষকতা তাদের অপর ধর্ম কে আক্রমণ করতে বাধ্য করেনি। এই হাজার বছরের ইতিহাসের ধারায় বহু বৌদ্ধ দার্শনিক -এর জন্ম হয়েছিল এই বঙ্গদেশে।

 

বৌদ্ধ বিহারগুলি পঠন ব্যবস্থা 

 

বিহার বা মহা বিহারের ধারণা প্রথম স্থাপনা করেন সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ। তার পূর্বে এদেশে প্রকৃতির মাঝেই ঋষিরা সাধনা করতেন। সঠিক ভাবে বছরের বারো মাস সাধনা ও শিক্ষা লাভ ও চর্চার জন্য সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ তার শিষ্যদের জন্য সঙ্ঘারাম প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে যে সকল বিহার সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। নালন্দা,ওদন্তপুরী, বিক্রমশীলা ও অন্যান্য মহাবিহারের শিক্ষা ব্যবস্থাছিল অতি উচ্চমানের। ভারত ভূখণ্ডের নানা অংশ থেকে, চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা লাভ করতে আসত।এক্ষেত্রে একটি বিষয় উল্লেখ করা খুবই প্রয়োজন, এই মহাবিহারগুলির শিক্ষার্থীরা সকলেই বৌদ্ধ শ্রমণ বা ভিক্ষু ছিল না। সাধারণ বিদ্যার্থীরা সম্পূর্ণ ভাবে ধর্ম ও বৌদ্ধ দর্শন চর্চা না করলেও অন্যান্য বিষয় নিয়ে পড়ার অধিকারী ছিল। পঠন কালে সকলের থাকার ব্যবস্থা করত এই মহাবিহারগুলি। বৌদ্শ্রমণ, সাধারণ ছাত্রকূল, অন্য ধর্মের শিক্ষার্থীবৃন্দ, এবং বিদেশের শিক্ষার্থী এই চার ধরণের শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল । মহাযান ও হীনযান বৌদ্ধ ধর্মের দুই শাখারই দর্শনের চর্চা হতো এখানে। সাহিত্য,বেদ,হেতুবি-দ্যা (logic), শব্দবিদ্যা (grammar and philology),চিকিৎসাবিদ্যা, অথর্বেদ, সাংখ্য দর্শন (system of philosophy), সাধারণ বিজ্ঞান, যোগশাস্ত্র, তন্ত্র, অধিবিজ্ঞান বা ( meta physics) পড়ানো হতো। হীনযান ও মহাযান বিভক্ত হয়ে পড়লেও তাদের মধ্যে শত্রুতা বা বৈরিতা ছিল না। একই মহাবিহারে তারা শিক্ষা লাভ করেছে দীর্ঘ বছর, কারণ গৌতম বুদ্ধের বলা মূল পথ বোধি লাভ, থেকে তারা সরে যায়নি । তবে মহাযান শাখায় দর্শন চর্চা ব্যাপ্তি লাভ করেছিল I

 

" The diversity to be found within Buddhism and the important role of a teacher in mediating a received tradition and adapting it to the needs, the personal transformation, of the pupil. This diversity prevents or strongly hinders generalization about Buddhism as a whole. Nevertheless, it is the diversity which Mahayana Buddhists have glorified in, seen not as a scandal but as something to be proud of, indicating a richness and multifaceted ability to aid the spiritual quest of all sentient..."

- Mahayana Buddhism, The Doctrinal Foundations. Paul Williams.

 

মূলমধ্যমকারীকা সূত্র , প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র, সৎধর্মপুণ্ডরীকা সূত্রের মতো আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ দর্শনের সূত্রের উদ্ভব ও চর্চা ঘটেছিল নালন্দা , ওদন্তপুরী , তক্ষশীলা , রক্তমৃত্তিকা , পাহাড়পুরের প্রভৃতি মহা বিহারগুলোয়। মহাযানী বৌদ্ধরা দর্শন চর্চার ঠিক কোন ধাপে পৌঁছেছিল তা এই সূত্রগুলি আলোচনা করলে বোঝা যায়। ভাবনার জগতে এক বিরাট বিপ্লবের সূচনা ঘটেছিল I

 

বৌদ্ধ দর্শন : আংশিক রেখাপাত

নাগার্জুন বুদ্ধ ১৫০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেনI মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম বুদ্ধ ছিলেন নাগার্জুন যিনি বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন কে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়ে ছিলেন। মূলমাধ্যমকারীকা গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। শূন্যবাদ এর মূল প্রবক্তা।কোনোকিছুই নিরপেক্ষ ভাবে এ সংসারে নেই। নিরপেক্ষ ভাবে সব কিছুই শূন্য। শূন্য বাদে সমস্ত কিছু কে নাকচ করছেন না তিনি, তার বক্তব্য স্বাধীন ভাবে বা নিরপেক্ষ ভাবে কোনো বস্তুর অবস্থান এই পৃথিবীতে নেই। প্রত্যেক বস্তুই অন্য কোনো বস্তুর সাপেক্ষে রয়েছে।সমস্ত কিছুই অন্য কিছুর ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ কোনো কারণ ছাড়া কোনো ফল বা বস্তু এ সংসারে বর্তমান নয়,এমনকি বুদ্ধ বা নির্বাণ নিরপেক্ষ ভাবে শূন্য। বুদ্ধ, নির্বাণ ও চতুরার্য সত্যকে পরীক্ষা করেছিলেন নাগার্জুনIযে ভাবে,নিরপেক্ষ ভাবে, সব কিছুর অস্তিত্ব বা অবস্থানকে স্বীকার করা হয়, নাগার্জুন তাকে পরীক্ষা করেন ও প্রমাণ করেন তা বস্তুত শূন্য। মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম অস্তিত্বের এমন সব প্রশ্ন করে যা ভাবনা ও দর্শন জগতে বিরাট পরিবর্তন বা বিপ্লব নিয়ে আসে। এমনি আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র রচিত হয় , এবং সকল সূত্র ও ভাবনা বঙ্গদেশে গভীর ভাবে প্রভাব বিস্তার করেI যদিও মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম একমাত্র বৌদ্ধ ধর্ম বা দর্শন চর্চা করেনি। হীন যান শাখাও তার দর্শন চর্চা চিরকালই বজায় রেখেছিল। বৌদ্ধ ধর্মে,মূর্তিপূজার, প্রধানত বুদ্ধ কে এবং দেবী তারা ও অবলোকিতেশ্বর পূজার প্রচলন হয়েছিল ক্রমশ, কিন্তু দর্শন চর্চা থেকে বৌদ্ধ দার্শনিকরা কখনোই সরে যান নি। সৎধর্মপুণ্ডরীকা সূত্র তে এসে মহাযান ধর্ম স্পষ্ট ঘোষণা করেছে যে প্রত্যেকেই বুদ্ধ এবং প্রত্যেকেরই বোধি লাভের সম্ভাবনা বর্তমান। চিত্তই সে পথ নির্দেশ করবে। ফলে ঈশ্বর লাভের পথ নয়, মানুষ হিসেবে তার চূড়ান্ত পূর্ণতা লাভই প্রত্যেক বোধিসত্বের পথ। অবশ্য তার জন্য তার কর্মের পরিবর্তনের প্রয়োজন। ফলে এই মহা বিহারগুলি মানুষের বোধিলাভের পথেরই সন্ধান করেছে। ঈশ্বর কে জীবন নিবেদনে বিশ্বাস করেনি।