প্রাচীন ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানের “আবিষ্কার”

১] অথ ক্যালকুলাস রহস্য

এটা দিয়েই শুরু করা যাক। প্রাচীন ভারতে আধুনিক ক্যালকুলাসের ভিত্তি স্থাপনের সতর্ক দাবি। আর্যভাট, ব্রহ্মগুপ্ত, দ্বিতীয় ভাস্কর হয়ে মাধবে এসে নিউটনের অন্তত দুশ বছর আগেই ক্যালকুলাসের বিকাশ নাকি প্রায় সম্পূর্ণ হতে বসেছিল। দাবি প্রকাশের স্থান: Frontline নামক ইংরেজি পাক্ষিক পত্রিকা। কাল: ২৩ জানুয়ারি ২০১৫। পাত্র: বিমান নাথ, বাঙালুরুর রামণ রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক, বিজ্ঞান লেখক, ঔপন্যাসিক।

পরিচয়টা এত বিশদভাবে দেবার কারণ আছে। একে তো পত্রিকাটাকে হিন্দুত্ববাদের প্রচারক বলা যায় না কোনো মতেই। বরং অনেক ব্যাপারে তাতে সঙ্ঘ পরিবারের দাবীদাওয়ার বিরুদ্ধেই ভালো লেখালেখি হচ্ছে। তার উপর, লেখক নিজেও খুব সাবধানে কথা বলার চেষ্টা করেছেন, যাতে গায়ে হিন্দুত্ববাদী ছাপ না লেগে যায়।

কিন্তু প্রশ্নটা আসলে ছাপ লেগে যাওয়ার বা সাবধান হওয়ার না-হওয়ার নয়। কাজের প্রশ্ন হচ্ছে—যেটা আমি আগেই দেখানোর চেষ্টা করেছি—বিচারের পদ্ধতি। এই বিচার পদ্ধতি কীভাবে স্বদেশি গবেষণা-গুদামে আবিষ্কার খুঁজতে গিয়ে মার খেয়ে যায় সেটাই দেখার।

লেখক নিশ্চয়ই জানেন, ক্যালকুলাস কাকে বলে। অথচ শুরুতে তিনি তার এমন একটা সরল সংজ্ঞা দিয়েছেন “কোনো রাশির বা সহরাশির পরিবর্তনের হার হিসাব করার” গণিত হিসাবে, যেটা একেবারেই ঠিক নয় শুধু নয়, ডাহা ভুল। ক্যালকুলাস এমন একটা গণিত, যাকে বুঝতে গেলে প্রথমে অপেক্ষক বুঝতে হবে, তার সীমা মান (limit) অর্জনের গতিপ্রকৃতি বুঝতে হবে, চলকের নির্দিষ্ট মানে অপেক্ষকের সন্ততি (continuity) রক্ষিত হচ্ছে কিনা দেখতে হবে। তারপর সেই নির্দিষ্ট মানে চলকের পরিবর্তনের সাপেক্ষে অপেক্ষকের পরিবর্তনের হার বুঝতে হবে। অধ্যাপক নাথ নিজেই দেখিয়েছেন, পঞ্চম শতাব্দের আর্যভাট (৪৭৬-৫৫০) থেকে শুরু করে ব্রহ্মগুপ্ত (৫৯৮-৬৭০) ভাস্করাচার্য (১১১৪-৮৫) হয়ে মাধব (১৩৪০-১৪২৫) পর্যন্ত কারোর কোনো গণিত পাঠে এই সবের চিহ্ন মাত্রও নেই। অথচ, তারপরও তিনি দাবি করছেন: এঁদের রচনায় “There were certainly some seeds of what is called calculus today, . . .” [Nath 2015]

আর এরকম দাবির যা পরিণাম হয়, লেখকের প্রচুর সাবধান বাণী সত্ত্বেও, ফ্রন্টলাইনের ই-ভার্সনে পাঠকদের কিছু কিছু মন্তব্যেই তা মালুম হতে থাকে! অধিকাংশ পাঠকই উচ্ছ্বাসভরে দাবি করেছেন, প্রাচীন ভারতীয় মনীষীদের এই সব অবদান কেন পাঠ্য বইতে পড়ানো হয় না। তাঁরা ধরতেই পারেননি যে লেখক এখানে একটা সম্ভাবনার কথা উত্থাপন করতে চেয়েছেন মাত্র। লেখকের কাছে যা ছিল সামান্য বীজ, বেদপ্রাণ পাঠকদের অনেকের মনে খুব সহজেই তা ক্যালকুলাসের মহীরূহ হয়ে উঠেছে।

আসলে যাঁরা এইভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে প্রাচীন ভারতে খুঁজতে থাকেন, তাঁদের সমস্যা হল, সহজ সত্যও তাঁদের নজর এড়িয়ে যায়। অধ্যাপক নাথ (এবং চন্দ্রকান্ত রাজু—এঁর কথা আমরা একটু পরেই জানব—দুজনেই) মনে করেন, কোণের সাইন অনুপাত বোঝাতে গিয়ে আর্যভাট যেখানে ‘জ্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, নবম শতাব্দে আরব গণিতজ্ঞ ইব্‌ন মুসা আল-খোয়ারিজমি (৭৮০-৮৫০) তাকে আরবিতে অনুবাদ করতে গিয়ে “ভুল করে লেখেন জিব” হিসাবে। সেটাই পরে অনৈক লাতিন অনুবাদক পাঠ করেন আরবি ‘জেব’ বা পকেট অর্থে, এবং লাতিনে লেখেন ‘সাইনুস’ ইত্যাদি। তার থেকেই সাইন অনুপাতের ধারণা এবং পরিভাষা এসে যায়। নিজেদের রচনা নিজেরা ভালো করে পড়লে এবং লক্ষ করলে এই দুই গবেষকই বুঝতে পারতেন, শব্দ চয়নে ভুল করেছিলেন একমাত্র আর্যভাট। বাকি আর কেউই কোথাও কোনো ভুল করেননি। আর্যভাটের অঙ্কে দেখানো হয়েছিল, কোনো বৃত্তের ব্যাসার্ধ এক একক ধরলে কোনো অর্ধ-জ্যা তার কেন্দ্রে যে কোণ উৎপন্ন করে তার সাইন অনুপাতের মান হচ্ছে সেই অর্ধ-জ্যা-এর দৈর্ঘ্যের সমান। অথচ, তিনি সেই অর্ধ-জ্যাকেও ‘জ্যা’ নামেই চিহ্নিত করেছিলেন। আল-খোয়ারিজমি খুব সম্ভবত ভুলটা লক্ষ করেছিলেন। তাই আর্যভাটের এই অসাধারণ আবিষ্কার ও তাঁর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতেই বোধ হয় তিনি সাইনের অনুপাতকে ‘জ্যা’ না বলে কাছাকাছি অন্য একটা সংস্কৃত শব্দ ‘জিব’ দিয়ে বুঝিয়েছিলেন।

আরও দেখবার জিনিস হচ্ছে, শ্রীরাজু কিন্তু আর্যভাটের সাইন অনুপাতের সারণিতে ক্যালকুলাসের ছায়া বা বীজ দেখেননি। তিনি আবার দেখেছেন ত্রিকোনমিতির বীজ। আর্যভাট যে সারণিটি তৈরি করেছিলেন ০ থেকে ৯০ ডিগ্রি কোণ পর্যন্ত ৩/ডিগ্রি অন্তর ২৪ টি মানের জন্য, তা যে কীভাবে ত্রিকোণমিতির উৎস বা বীজ হতে পারে—তাও এই সব জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরাই বলতে পারেন। কেন না, এঁরা কেউ বোধ হয় জানেন না, বা জানবার চেষ্টাও করেন না, যে প্রাচীন ভারতে জ্যামিতির তেমন কিছু মৌলিক চিন্তার বিকাশ হয়নি। যা কিছু হয়েছে তা মূলত পরিমিতিবিদ্যার চর্চা। [সেন ১৯৯৪, ২য়, ৫০] জ্যামিতির বিকাশ ছাড়া ত্রিকোণমিতির বিকাশ কীভাবে সম্ভব হল, তাও এনারাই ব্যাখ্যা করতে পারেন।

আমার একটা ব্যাখ্যা অবশ্য আছে। আরও দু পা এগিয়ে সেই কথা বলব। 

 

[২] গ্রিস থেকে নয়?

‘ফ্রন্টলাইন’-এর মতো নামকরা কাগজ যদি এতটা এগিয়ে যেতে পারে, অন্য পত্রিকাগুলিই বা কেন পিছিয়ে থাকবে? দেখা যাচ্ছে, কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবি সমর সেন প্রতিষ্ঠিত ও আমৃত্যু সম্পাদিত বিখ্যাত প্রগতিশীল ইংরেজি পত্রিকা ‘ফ্রন্টিয়ার’-ও দু-একটা “ভারতেই হয়েছিল” মার্কা প্রবন্ধ ছাপাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

এক্ষেত্রে লেখক পূর্বোল্লেখিত গণিতবিদ চন্দ্র কান্ত রাজু। তাঁর প্রতিপাদ্য অবশ্য বিশেষ কোনো একটা বা দুটো আবিষ্কার নয়। তিনি কলম চালিয়েছেন সম্পূর্ণ এক ভিন্ন উদ্দেশ্যে। এযাবতকাল বিজ্ঞানের ইতিহাসে যা কিছু প্রাচীন গ্রিসের অবদান বলে পরিচিত, তিনি এক বিশাল ফুঁ দিয়ে তা উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। তাঁর প্রবন্ধের শিরোনামই হচ্ছে—“গ্রিস থেকে নয়”। [Raju 2015] তিনি দাবি করেছেন, বিজ্ঞানে প্রাচীন গ্রিকদের অবদান বলে যা কিছু পরিচিত তার কোনোটার পেছনেই কিছুমাত্র সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। সমস্তটাই ইউরোপীয়দের, না, স্রেফ ইউরোপীয় নয়, ইউরোপের খ্রিস্টানদের, অপপ্রচার। তারা বিশ্বের অন্যান্য জাতিকে অত্যন্ত হেয় চোখে দেখে, ভারত বা আরবের থেকে যা যা পাওয়া গেছে বিজ্ঞান, গণিত বা জ্যোতিষশাস্ত্রে, তারা মনে করে, সেই সবই তাদের থেকেই পুবের দিকে চলে গিয়েছিল; পরে আবার ফিরে এসেছে। তিনি নাকি ইউক্লিদের অস্তিত্বের সপক্ষে কঠিন প্রমাণ দাখিলের জন্য দু লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করে রেখেছেন; কিন্তু আজ অবধি কেউ এগিয়ে আসেনি প্রমাণ দিয়ে সেই পুরস্কারটি দাবি করতে।

প্রমাণ নেই, অথচ শুধু তো ইউরোপীয়রাই নয়, বিশ্বের সমস্ত লোকই কেন কথাটা বিশ্বাস করে নিয়েছে?

লেখকের সাফ উত্তর—দাসত্বের মনোভাব। আমরাও নাকি মনে করি, ইউরোপীয়রা সব ব্যাপারেই আমাদের থেকে বিদ্যাবুদ্ধিতে এগিয়ে। তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের যা কিছু বিকাশ ঘটেছে সব ওরাই করেছে।

কলেজ পাড়ার ছেলে ছোকরাদের ভাষায় একটা কথাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে—“পারি না!”

বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। আপাতত কয়েকটা ছোটখাটো জিনিস ভেবে দেখার পরামর্শ দেবার বাইরে আর কিছুই করা যাবে না। তাছাড়া, সত্যি কথা বলতে গেলে, আমার হাতেও তো তেমন কোনো প্রমাণ-টমাণ নেই যে সত্যিই ইউক্লিদ বলে প্রাচীন গ্রিসে কেউ একজন ছিলেন যিনি জ্যামিতির ওই প্রসিদ্ধ বইটা লিখেছিলেন। সুতরাং আমার পক্ষেও এখন সেই প্রশ্নে লড়তে যাওয়া কোনোভাবেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

কিন্তু তাঁর এ থিসিসে তিনটি সংশয় আছে আমার।

[এক] বরাহমিহির (৫০৫-৮৭) ষষ্ঠ শতাব্দের একজন খুবই পরিচিত নাম। ভারতের জ্যোতিষশাস্ত্র সঙ্কলন ও উপস্থাপনায় তাঁর নাম ভারতে তো বটেই, সারা পৃথিবীতেই বিজ্ঞানের ইতিহাস লেখক ও পাঠকদের কাছে কম-বেশি সুপরিচিত। তাঁর একটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম হচ্ছে “পঞ্চসিদ্ধান্তিকা”। তাতে তিনি তাঁর সমকালে প্রচলিত পাঁচটি জ্যোতিষীয় শাস্ত্রগ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছিলেন: সূর্যসিদ্ধান্ত, বশিষ্টসিদ্ধান্ত, পৈতামহসিদ্ধান্ত, রোমকসিদ্ধান্ত ও পৌলিশসিদ্ধান্ত। শেষের দুটি গ্রন্থের নাম শুনেই বোঝা যায়, সেগুলি পশ্চিমি দেশ থেকে আগত। বরাহমিহির পাঁচটি গ্রন্থের বিষয়বস্তুর উপর বিস্তারিত আলোচনা করার পর সেই বিদেশাগত গ্রন্থদুটিরই প্রশংসা করেছেন। আর তাদের তুলনায় দেশি গ্রন্থগুলিকে বলেছেন “দুর্বিভ্রষ্ট” (turned astray)। এর একটা যুতসই ব্যাখ্যা যে চাই আমাদের! ভারত থেকে যে জ্যোতির্বিদ্যা নবম শতাব্দের পরে আরব অনুবাদকদের হাত ঘুরে গেল পশ্চিমে, সেই বিদ্যাকে ষষ্ঠ শতাব্দে একজন ভারতীয় শাস্ত্রকার শুধু যে হাতে পেয়ে গেলেন তাই নয়, বললেন, ভারতের ফসলের চেয়েও ভালো। তিনি তা পেলেনই বা কোন সূত্রে, আর তা বেশি ভালোই বা হল কীভাবে?

[দুই] আরব পণ্ডিতরা তিন চার শতাব্দ ধরে যে সব গ্রন্থ অনুবাদ নয়, “রচনা” করলেন, তাতে তাঁরা জ্ঞানবিজ্ঞানের অনেক নতুন কথা বললেন। অথচ, সেইগুলো যখন ইউরোপের খ্রিস্টান পাদ্রিরা আবার গ্রিক লাতিনে অনুবাদ করে (শ্রীরাজুর ভাষ্য অনুযায়ী) নিজেদের নামে কুক্ষিগত করে ফেলল, সারা মুসলিম দুনিয়া থেকে কেউ বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করলেন না? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? যে জ্যামিতির জ্ঞান আরবরা সংগ্রহ করলেন, যে জ্যোতির্বিদ্যা তাঁরাই সংগ্রহ বা সৃষ্টি করে আনলেন, সেইগুলোর কোনোটা ইউক্লিদ, কোনোটা তলেমির নামে চালান হয়ে গেল, আর তাঁরা সবাই বসে বসে চুপচাপ দেখলেন?

[তিন] আরবি বা তুর্কি থেকে শুধু তো বিজ্ঞানের গ্রন্থগুলোই নয়, দর্শন সাহিত্য রাজনীতি ইত্যাদি আরও অনেক বিষয়ের উপরে গ্রিকদের রচিত গ্রন্থ উদ্ধার করা হয়েছে বলে ইতিহাসে বলা হয়ে থাকে। ইলিয়াদ ওদিসি-র মতো হোমারের প্রাচীন মহাকাব্য, সোফোক্লেসের অয়দিপাউস নাট্যগাথা, ভার্জিলের (লাতিন) কাব্য ইনিদ, ইত্যাদিও তো সেই সব সূত্রেই পাওয়া গেছে। তাদের স্রষ্টারা সব আরবে পারস্যে বসে লিখলেন; অথচ সেই সবের কাহিনি, চরিত্র, পাত্রপাত্রী, স্থানকাল বিবরণ, পাহাড় নদী আকাশ, ইত্যাদি সমস্ত কিছুই চলে গেল সুদূর গ্রিসে, কিংবা ক্রিটে অথবা আলেক্সান্দ্রিয়ায়—এরই বা ব্যাখ্যা কী? মূর্তিপূজা বিরোধী ইসলাম ধর্মের উপাসকরা বসে বসে গ্রিক দেবদেবী নিয়ে কাহিনি ফাঁদলেন যাতে পরে তা নিজেদের কাঁধ থেকে নামিয়ে গ্রিকদের কাঁধে ঝেড়ে ফেলা যায়—একটু বেশি কষ্টকল্পনা হয়ে গেল না কি? আর, এইগুলি যদি জালি না হয়ে খাঁটি হয়ে থাকে, তাহলে এরাই তো সেই প্রমাণ যা আপনি খুঁজছেন মশাই!

আবেগে উত্তেজনায় শ্রীযুত রাজু কী বলতে কী বলবেন ভেবে না পেয়ে কিছু কিছু ব্যাপারে এত উল্টোপাল্টা বলে ফেলেছেন যে সেই সব পড়ে হাসব না কাঁদব ঠিক করতে পারছি না।

দুটো উদাহরণ দিই।

ক্যালেন্ডার প্রসঙ্গে তিনি দাবি করেছেন, গ্রিক বিজ্ঞান তেমন উন্নত ছিল না এবং তাদের পাটিগণিতের জ্ঞান খুবই নিম্ন মানের ছিল বলেই নাকি ইউরোপে ক্যালেন্ডারের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তারা বছরের দৈর্ঘ্যকে অনেকটা ত্রুটিপূর্ণভাবে (৩৬৫/ দিন) হিসাব করেছিল। ভারতে নাকি সেই সময়ে এর চেয়ে অনেক বেশি নিখুঁত হিসাব জানা হয়ে গিয়েছিল।

দেশপ্রেম আর কাকে বলে?

একে তো যে সময়ের কথা তিনি বলছেন তখন গ্রিক বিদ্বানদের খ্রিস্টীয় ইউরোপ থেকে প্রায় ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া হয়েছিল। ইতিহাসে এই সব ঘটনা এত সুবিদিত যে এর পুনরুক্তি করতে যথেষ্ট দ্বিধা হয়। গ্রিকদের গণিত বা জ্যোতিষ আবার ইউরোপে ঢোকে (প্রধানত আরবি পণ্ডিতদের অনুবাদের মাধ্যমে) বিভিন্ন ধর্মযুদ্ধের সমকাল বা পর থেকে। একাদশ দ্বাদশ শতাব্দ থেকে।

আর ভারতের ক্যালেন্ডার?

সেদিন তো দূরের কথা, আজ অবধিও তা ঠিকঠাক করে তৈরি করা যায়নি। তৃতীয় চতুর্থ শতকে ভারতে বছরের হিসাব করা হত ৩৫৪ (চান্দ্র) বা ৩৬৫ (সৌর) দিনে। কখনও কখনও তা গড় হিসাবে ৩৬০ দিনেও ধরা হত। সেই কারণেই কয়েক বছর পর পর আবার এক বছরে তের মাস ধরতে হত, তার মধ্যে একটা মাসকে (দুটো অমাবস্যা ঢুকিয়ে) চিহ্নিত করা হত মলমাস (অর্থাৎ, অশুভ মাস) বলে। ভারতীয় ক্যালেন্ডারে এখনও প্রতিটি মাসের দিন সংখ্যাস্থায়ীভাবে স্থিরীকৃত করা যায়নি। কেন না, প্রত্যেক বছর বিভিন্ন তিথির সঙ্গে রাশি মিলিয়ে এবং নির্দিষ্ট তিথিতে বিভিন্ন বিশিষ্ট পূজাপার্বণ ফেলে ফেলে কোন মাসে কত দিন ধরা হবে তা ঠিক করতে হয়। তার উপর সারা দেশে আজ পর্যন্ত একই ক্যালেন্ডার চালু করা যায়নি। এক এক অঞ্চলের এক এক রকম দিনপঞ্জিকা। এই সব তথ্য অধ্যাপক রাজু জানেন না তা হতে পারে না; তিনি তাঁর থিসিসের পক্ষে স্রেফ অসুবিধা বিধায় তা অক্লেশে অগ্রাহ্য করে গেছেন! মেঘনাদ সাহাও এক সময় এই ভারতীয় ক্যালেন্ডার নিয়ে অনেক আক্ষেপোক্তি করে গেছেন। [Saha 1952]

দ্বিতীয়ত, আবার সেই ত্রিকোনমিতির কথায় ফিরে যাই।

ভারতীয়দের কোনো ভুল হয় না। আর্যভাটেরও ‘অর্ধ-জ্যা’ বোঝাতে গিয়ে ‘জ্যা’ শব্দ ব্যবহারে ভুল হয়নি। কিন্তু যে আরবি পণ্ডিত (আল-খোয়ারিজমি) ‘অর্ধ-জ্যা’ বোঝানোর জন্য ‘জ্যা’ শব্দের পরিবর্তে ‘জিব’ শব্দটা ব্যবহার করলেন, ভুল হল তাঁর। তার থেকে পর পর ভুল হতে হতে লাতিনে গিয়ে ‘অর্ধ-জ্যা’ ‘সাইনুস’ এবং অবশেষে ইংরেজিতে ‘সাইন’ হয়ে বসল। সত্যিই সত্য মিথ্যা ধরার অসাধারণ ক্ষমতা, মানতেই হবে! কিন্তু আমার এখানে প্রতিপাদ্য নিছক সেটা নয়। শ্রীরাজু সেই ঠিক ভুলের চক্করে পড়ে দাবি করে বসলেন, বাংলায় বা ভারতীয় ভাষায় ত্রিকোণমিতির নাম নাকি বৃত্তমিতি হওয়া উচিত ছিল; কেন না, “the chord relates to the circle, the triangle is incidental, and it was in the chapters on the circle that this was studied in Indian texts. Since it concerns circular functions, one should call it circlemetry, not trigonometry; but people don’t do so since the West trusted straight lines and had serious problems with curved ones, and everybody blindly apes that practice on the belief that the West is superior.” [Raju 2015]

দেশপ্রেমের উচ্চতাপ দ্রবণে একজন গণিতজ্ঞ মানুষের বুদ্ধি কতখানি গলে গেলে এটা বলা সম্ভব? আনুষঙ্গিক অঙ্ক জানা যে কোনো লোকই জানেন, সাইন অনুপাত মানেই হল একটা সমকোণী ত্রিভুজের দুটোর যে কোনো একটা সূক্ষ্মকোণের সাপেক্ষে লম্ব আর অতিভুজের অনুপাত। অর্থাৎ, এতে ত্রিভুজ এবং সরল রেখাই প্রধান বিবেচ্য। আর্যভাট যে বৃত্তের মধ্যে জ্যা এঁকে এটা অনুশীলন করেছিলেন সেটাই ছিল বরং ঘটনাচক্র। আর্যভাটকেও অবশ্যই বৃত্তের মধ্যে ত্রিভুজ এঁকে নিতে হয়েছিল। ত্রিভুজ না জেনে বা না বুঝে যে এগুলো বোঝা যায় না—আজকাল স্কুলের ছাত্ররাও এটা জানে। রাজু জানেন না—এটা একটা খবরই বটে! আর, সাইন অনুপাত থেকে যখন সাইন অপেক্ষকের কথা ভাবতে বসব, তখন সে আর ত্রিকোণমিতিও নয়, জ্যামিতিও নয়; তখন সে আসলে বীজগণিতের সঙ্গে ত্রিকোণমিতির এক সংযুক্ত অঙ্ক।[1]

না, মোদীর রাজত্বে দেখছি অনেকেরই মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিচ্ছে!

অথবা, হয়ত এটাই বিপুল প্রতিভার একটা নিশ্চিত লক্ষণ!!

তাছাড়া, ভদ্রলোকের এই অভিযোগটাও সত্য নয় যে বিজ্ঞানের ইতিহাস যাঁরা লিখছেন, ভারতীয় কিংবা বিদেশি, যাই হোন না কেন, তাঁরা সকলেই প্রাচীন ও মধ্যযুগের বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিকাশের যাবতীয় কৃতিত্ব খ্রিস্টানদের এবং ইউরোপকে দিয়ে দিচ্ছেন। সমরেন্দ্র নাথ সেন তাঁর বইতে অন্তত ডজন খানেক ইতিহাস লেখকের নাম ও উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যাঁরা সেকালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বহু ব্যাপারেই ইউরোপের ব্যর্থতার কথা এবং তার পাশাপাশি ভারত বা প্রাচ্যের অন্যান্য দেশের কৃতিত্বের কথা বেশ জোরের সাথে তুলে ধরেছেন। এমনকি মধ্য যুগে আরব পণ্ডিতদের কৃতিত্বের কাহিনিগুলিও আমরা ইউরোপ ও আমেরিকার লেখকদের থেকেই জেনেছি।

তাহলে প্রশ্ন হল: এত বাজে কথা এনারা কেন বলছেন? এবার সেই ব্যাপারে আমার ধারণা রাখতে চাই।

তথ্যের চাইতেও এখানে বড় হয়ে উঠেছে আদর্শগত বিশ্বাস। উত্তর আধুনিক দর্শনের অন্তর্গত উত্তর-উপনিবেশ (post-colonial) মতাদর্শ এই আজগুবি দাবিপত্রের পশ্চাদ নির্মাতা বলে আমার সন্দেহ।

ব্যাখ্যা করেই বলি।

গত কয়েক দশক ধরে প্রথমে ইউরোপ ও আমেরিকায়, তদনন্তর ভারতের মাটিতেও রেনেশাঁস উত্তর আধুনিক সভ্যতার কিছু অর্জনের বিরুদ্ধে একটা গর্জন শুরু হয়েছে। রেনেশাঁস ফেনেশাস বলে আসলে কিছু হয়নি। মধ্য যুগের শেষে আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতি কোনো কাজের কথা নয়। ইউরোপীয় বণিকদের তরফে সারা বিশ্বে উপনিবেশ ও আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে নিজেদের সম্পর্কে এক অতিকথা বানিয়ে তা অনুন্নত তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলিতে ফিরি করা হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান যুক্তিবাদ—সবই এদের নির্মাণ। আমাদের মতো পশ্চাদপদ উপনিবেশের লোকেরা সাদা চাওড়ার বিদ্বান ব্যক্তিদের এই সব জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং নিজেদের মূর্খ সাব্যস্ত করেছে। এখন আমাদের দেশজ শিক্ষা সংস্কৃতি বিজ্ঞান প্রযুক্তির কথা সাতকাহন করে বলতে হবে। “হতে পারি ক্ষীণ মোরা নহি কভু দীন” সেটা জানাতে হবে।

জানানোর উপায়?

দাবি, আরও দাবি। ভুল বা মিথ্যা হলেও।

একজন বললেই অন্যরা পাঁচ জনে তা বিশ্বাস করবে। তার পর তা ছড়িয়ে পড়বে। এর মধ্যে যে ছদ্ম-উপনিবেশ বিরোধী একটা সুর আরোপ করা হয়ে থেকে, তার অসচেতন মানুষজনদের কাছে একটা আবেদন থাকে। পশ্চিমি লোকদের আমাদের চাইতে শ্রেয়তর ভাবার দাস সুলভ মনোভাব কাটাতে হবে; আসলে যে আমরা ওদের থেকে সমস্ত ব্যাপারেই এক কালে এগিয়ে ছিলাম তা ওরা ভুলিয়ে দিতে চাইলেও আমরা ভুলব না, ভোলাতেও দেব না—এরকম সংলাপ ঝাড়তে থাকলে তার আবেদন অনেকের কাছেই খুব দ্রুত পৌঁছে যাবে। এই ভাবে। . . .

তবে তাঁরা না চাইলেও এই সব ভুয়ো দাবি পেশ করে এই সব বিদ্বান ব্যক্তিরা বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের যে কতটা সুবিধা করে দিচ্ছেন, বোধ হয় ভাবতেও পারছেন না।

এই বোধিকে ছদ্ম-উপনিবেশ বিরোধী বলছি কেন?

কারণ আছে। যাঁরা সত্যিই উপনিবেশ বিরোধী মতাবহ তৈরি করেছেন, ঔপনিবেশিক শাসন শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলন করেছেন, তাঁরা অনেকেই ইউরোপের সাহিত্য সংস্কৃতি দর্শন বিজ্ঞানের ভালো জিনিসগুলোকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। শেক্সপিয়র বা নিউটনকে নিতে গিয়ে তাদের অ্যাটলি বা চার্চিলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে অসুবিধা হয়নি। বা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে তাঁদের শেক্সপিয়র বা নিউটনকে ছোট করার প্রয়োজন পড়েনি। বরং তাঁরা ইউরোপের আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান থেকে রসদ কুড়িয়ে নিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছেন এবং আরও বেশি লড়াই করার শক্তি সামর্থ্য সংগ্রহ করেছেন।

পক্ষান্তরে ভারতীয় ঐতিহ্য, ভারতীয় সংস্কৃতি, দেশজ বিদ্যা, দেশজ জ্ঞান ইত্যাদির উপর জোর দেবার নাম করে অন্য এক দল শুধু যে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান মূল্যবোধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তাই নয়, তারা প্রকৃত উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনকে সর্বশক্তি দিয়ে রুখবার চেষ্টা চালিয়েছে। এই ব্যাপারে আরএসএস প্রমুখর মুখ্য ভূমিকার কথা সকলেই জানেন। আজকের উপনিবেশোত্তর তাত্ত্বিকরা জেনে বা না জেনে, বুঝে বা না বুঝে, এই সর্বনেশে দেশজ প্রতিক্রিয়ার হাতেই নিজেদের জ্ঞানগম্যি সঁপে দিচ্ছেন। তাঁদের হাতে পড়ে শুভঙ্করের আর্যা নিউটনের বিজ্ঞানের উপর জায়গা পেয়ে যাচ্ছে। চণ্ডীমণ্ডপের পাঠশালার তুলনায় বিদ্যাসাগরি স্কুল খেলো হয়ে পড়ছে। এর ফলেই, সম্ভবত, সঙ্ঘ পরিবারের রামমোহন বিদ্যাসাগর বিরোধিতা আর উপনিবেশোত্তর বিচারে রামমোহন বিদ্যাসাগরের অবমূল্যায়ন একেবারে যেন খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে! এটা কোনো আকস্মিকতা নয়, ভ্রান্ত বিচারের অনিবার্য পরিণাম। মূল যে দর্শন তাঁদের এই জায়গায় এনে ফেলেছে, সেই উত্তর-আধুনিকতার মতাদর্শের সম্পর্কে তাঁরা সচেতন না হলে এই পরিণতি তাদের পেছন ছাড়বে না। 

পাশাপাশি রাজুর লেখাটা পড়ে মনের মধ্যে অন্য একটা সন্দেহও দেখা দিচ্ছে। ঘটনা যেভাবেই ঘটে থাকুক না কেন, বিজ্ঞানের ইতিহাসে মানুষের প্রাচীন কালের জ্ঞানচর্চার কথা বলতে গেলে গ্রিকদের কার্যকলাপ একটা বিরাট জায়গা নিয়ে বসে থাকে। সেই ইতিহাস বার্নালই লিখুন আর সেনই লিখে থাকুন। ভারতের কথাও আসে, তবে অতটা জায়গা দাবি করতে পারে না। এখন যদি শ্রীরাজুর কথা সত্য হয় বা মেনে নেওয়া হয়, তাহলে এক ধাক্কায় গ্রিসকে হঠিয়ে দিয়ে ইতিহাসের অনেকটা জায়গা ফাঁকা করে ফেলা যাবে। সেখানে কি আর . . .? সঙ্ঘ পরিবার যে চেষ্টা করে যাচ্ছে, আর একদিক থেকে তার জন্য অনেকটা খোলা জমি বের করে ফেলা যাবে। আধুনিক কালে জমির প্রোমোটাররা বিভিন্ন বস্তি এলাকায় আগুন জ্বালিয়ে যেমনটা করে থাকে আর কি।

সেক্ষেত্রে শুধু প্রশ্ন একটাই: কাজটা ভালো হবে কি? 

 

[৩] মার্ক্সবাদী, তুমিও?

এবার যাঁর কথা বলব, তিনি আরও উপর দিয়ে যাচ্ছেন। অরুণাভ মিশ্র। তাঁর রচনাটি বেরিয়েছে সিপিআই (এম) দলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির তাত্ত্বিক মুখপত্র “মার্ক্সবাদী পথ”-এ (২০১৫)। তিনি লিখেছেন বিজেপি লবির উল্টোপাল্টা দাবিগুলির বিরুদ্ধেই। সঙ্ঘ পরিবারের দাবিগুলি নিয়ে তিনি যা লিখেছেন তার অনেক কিছুই আমি এই অবধি যে ধরনের আলোচনা করেছি, তার সাথে কমবেশি মিলে যায়। তবুও দুঃখের কথা হল, প্রাচীন ভারতের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ব্যাপারে বিজেপি-লবির দাবিগুলির সমালোচনা করেও তিনি নিজে আবার এক গুচ্ছে একই জাতীয় অন্য “কৃতিত্ব”-এর উল্লেখ করে বসে আছেন। এবং যথারীতি, তিনিও সেই সব “কৃতিত্ব”-গুলির সমর্থনে কিছুই সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে পারেননি শুধু নয়, দিতে যে হবে সেই ব্যাপারেও বোধ হয় সচেতন নন। এর দ্বারা তিনি নিশ্চয়ই বোঝাতে চেয়েছেন, আধুনিক বিজ্ঞানের সবই “ব্যাদে-ছিল” দাবিদার সমিতির সদস্য সংখ্যা কত বিপুল! একটা মার্ক্সবাদী দলেও তাদের লোকজন ঢুকে বসে আছে!!

চলুন, এবার তাঁর লেখার সাথেও মোলাকাত করি। [মিশ্র ২০১৫]

প্রথমেই বলে রাখি, অরুণাভ মিশ্রর প্রবন্ধটি কিন্তু যথেষ্ট ভালো এবং তথ্য সমৃদ্ধ। প্রাচীন ভারতের হরপ্পা যুগ থেকে শুরু করে বৈদিক, বেদোত্তর ও বৌদ্ধ-জৈন পর্যায় ধরে ধরে তিনি যেভাবে তাঁর লেখনীকে সাজিয়েছেন তা ভারতের মাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের ইতিহাসকে এক সংক্ষিপ্ত ক্যানভাসে অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে। এই কাজটির জন্য তাঁর অবশ্যই আমাদের সকলের কাছে খুব উচ্চমূল্যের প্রশংসা এবং ধন্যবাদ প্রাপ্য। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবারের মুখপাত্রদের অলীক দাবিগুলিকে খণ্ডন করার পাশাপাশি তিনি নিজে যে সমস্ত আজগুবি কিছু কৃতিত্ব আবিষ্কার করে বসেছেন, তাতেই এক বালতি দুধে পাঁচ চামচ চোনা পড়ে গেল।

উদাহরণ দিই।

ভারতীয় কণাদ খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দ নাগাদ পদার্থের গঠনকারী মৌলিক কণার কথা বলেছিলেন এবং তা গ্রিক দার্শনিক দেমোক্রিতাসের বেশ কিছুকাল আগেই—এই তথ্যটি সম্পর্কে আজ আর কারোর মনেই কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কণাকে পরমাণু বলে তাকে আধুনিক ধারণার সাথে মিলিয়ে দেবার যে অপচেষ্টা আমাদের দেশে অনেকেই করে থাকেন, অরুণাভ মিশ্র তেমনটা করতে যাবেন কেন? বৈশেষিক দর্শনে পদার্থের অনেকগুলো গুণের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে দ্রব্যগুণ এবং শক্তিগুণও রয়েছে। এগুলোকে ভর ও শক্তির আধুনিক ধারণার সাথে মিলিয়ে দিয়ে তারপর ভর ও শক্তির সংরক্ষণ সূত্রও খুঁজে পেতে মিশ্রবাবুর কিছু মাত্র অসুবিধা হয়নি। আর এরকম চিন্তার রাস্তায় একবার পা বাড়ালে যা হয়, ইনিও সেই পথে ক্রমাগতই এগিয়ে (আসলে পিছিয়ে) গেছেন। তাঁর হাতে পড়ে বরাহমিহির সেই ষষ্ঠ শতকেই পরমাণুর ব্যাস মেপে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন: ১০—৬ সেন্টিমিটার। তারপর খুব গর্বের সাথে বলেছেন, “আধুনিক হিসাবের তুলনায় এটা মাত্র একশ ভাগ বেশি।” সত্য হলে, আহা, সূক্ষ্মতা বৈকি!

সত্যি সাহস বটে অরুণাভ মিশ্রর। বরাহমিহির শুধু পরমাণুর ব্যাস মাপলেন তাই নয়, মিটার স্কেলে মাপলেন। পৃথিবীতে চালু হওয়ার ঢের আগে, প্রায় দেড় হাজার বছর আগেই তিনি এই সুপ্রাচীন সুপবিত্র ভারতের মাটিতে একে পেড়ে ফেলেছেন! আমরা যখন মাত্র চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগেও বেশিরভাগ মাপামাপি হাত দিয়ে করতে দেখতাম, বড় জোর ইঞ্চি ফুট গজের কারবারও দেখা যেত, ওনার দূরদৃষ্টি সেই তুলনায় প্রখর বলতেই হবে। আরও ভাবুন, সেই প্রাচীন কালেই বরাহমিহির এক সেন্টিমিটারের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ মাপতে পেরেছিলেন! কীভাবে মাপতেন তিনি? যে কোনো মাপনের জন্য তো সাধন লাগে। এগুলো বলার দরকার নেই?

আর সর্বোপরি, ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে দেখলে, বরাহমিহির কেনই বা এত সূক্ষ্ম পরিমাপ করতে যাবেন? সেকালে এর কী এমন দরকার ছিল? দাবিটা আমার ধারণায় নেহাতই বালখিল্যোচিত। একজন বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী চিন্তাশীল মানুষের পক্ষে এরকম দাবি করা শোভা পায় না।

সারা পৃথিবীতেই কেউ মাত্র তিনশ বছর আগেও মৌলিক পদার্থ কাকে বলে জানত না। অথচ এই ভদ্রলোকের গবেষণায় ভারতের বাচস্পতি মিশ্র ৮০০ খ্রিস্টাব্দেই সমস্ত পদার্থকে মৌলিক যৌগিক ও মিশ্র পদার্থ হিসাবে বিভাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়। তিনি নাকি অণু পরমাণু বিভেদের কথাও জানতেন এবং যৌগ পদার্থের অণুগুলিতে পরমাণুর ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিগত বিন্যাসের কথাও বলে গেছেন বলে জানা গেল।

আবার যৌগ পদার্থের শ্রেণি নির্ণয় বাচস্পতির আমলে হয়েছে বলে জানালেও তার প্রায় বারো শ বছর আগেই কণাদও নাকি এক-ভৌতিক, ভিন্ন-ভৌতিক এবং মহাভৌতিক নাম দিয়ে আসলে যথাক্রমে homo-atomic, hetero-atomic এবং polyhetero-atomic যৌগগুলিকে বুঝিয়েছেন বলে তাঁর “মনে করার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে”। লেখক জৈনদের পুঁথিতে “দুই বিপরীত ধর্মের পরমাণুর মিলনে যৌগ গঠনের কথা” পড়ে বুঝেছেন, ধনাত্মক ও ঋণাত্মক তড়িত বিশিষ্ট দু রকম মৌলের সমন্বয়ে যৌগ গঠনের যে তত্ত্ব লিনাস পাউলিং দিতে পেরেছেন মাত্র ১৯৩২ সালে, ভারতে তা প্রথম শতাব্দের মধ্যেই জানা হয়ে গিয়েছিল।

এত দূর এগোনোর পর তাহলে সেই কণাদও আবার মাটি, জল, বাতাস, আগুন আর আকাশ-কেই মৌলিক পদার্থ বলে যাবেন কেন? কণাদ তাঁর যুগে (মোটামুটি ষষ্ঠ-পঞ্চম খ্রিস্টপূর্ব শতকে) পরমাণু তত্ত্ব দিয়ে যা বলেছেন, তাই তাঁকে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করে রাখার পক্ষে যথেষ্ট। মিথ্যা কৃতিত্ব দেবার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

ও, হ্যাঁ। আরও খবর আছে। দৈর্ঘ্য যদি প্রাচীন ভারতে অত সূক্ষ্মতায় মাপা সম্ভব হয়ে থাকে, তবে সময়ই বা বাদ যাবে কেন? অরুণাভবাবু সেই দিকেও আমাদের নজর আকর্ষণ করেছেন। বেদাঙ্গ জ্যোতিষের কালে ভারতীয়রা বছর মাপত ৩৬৬ দিনে; রাশিচক্রের খবর তারা রাখত না; তা সত্ত্বেও “প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদরা ‘ত্রুটি’ পরিমাণ (১/৩৩৭৫০ সেকেন্ড) সময়ের হিসাব করতে জানতেন।” এর পর কি আমরা আর বলতে পারব, বামপন্থীরা বিজেপি-র থেকে পিছিয়ে আছে প্রাচীন ভারতের বিশাল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্পদকে চেনানোর ব্যাপারে? উঁহু!

শুধু ধন্দ থেকে গেল মনে মনে, এত সূক্ষ্ম সময়ের হিসাব তাদের কোন কম্মে লাগত?

আমি মনে করি, বিজ্ঞানের ইতিহাস সম্পর্কে আমি প্রথম পর্বে যে সমস্ত মৌল উপলব্ধিগুলির কথা বলেছি, সেগুলো শধু বিজেপি-পন্থীরা নয়, আমাদের শিবিরভুক্ত বামপন্থী বা যুক্তিবাদীরাও অনেক ক্ষেত্রেই বোঝেন না বা বুঝলেও মনে রাখেন না। তাঁরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কেবলমাত্র উপর-উপর তথ্য নিয়ে পড়ে থাকেন এবং বিভিন্ন পক্ষের প্রদত্ত সেই সব তথ্যের সত্য মিথ্যা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। গোড়ার কথাগুলো মাথায় না রাখার জন্যই অরুণাভবাবুরও এই রকম অসম্ভব “আবিষ্কার” পুনরাবিষ্কার করতে কোনো দ্বিধা হয়নি।

এটা খুবই দুঃখজনক।

 

 


[1] কিছুদিন পরে রাজু আবার নাথের বিরুদ্ধে তথ্য চুরির অভিযোগ এনে বসেছেন। তাঁর ২০০৭ সালের একটা বই [Cultural Foundations of Mathematics: the Nature of Mathematical Proof and the Transmission of Calculus from India to Europe in the 16th c. (Pearson Longman, 2007)] থেকে নাকি এই সব খবর ঋণ স্বীকার ছাড়াই অধ্যাপক নাথ নিজের বক্তব্য হিসাবে ছাপিয়ে দিয়েছেন। ফ্রন্টলাইন পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে জানানো সত্ত্বেও নাকি তাঁরা ভুল স্বীকার করেননি। [Raju 2015a] আহা হা! উপনিবেশ বিরোধীদের যেমন আবিষ্কার তেমনি চুরি!!