সত্যজিতের ছোটগল্প

সত্যজিতের গল্পের ঝুলিতে আছে নানা স্বাদের গল্প। নিখুঁত ডিটেলিং, মেলোড্রামাবর্জিত, স্বতঃস্ফূর্ত তার লিখনশৈলী। পড়তে বসলে মনে হয়, চোখের সামনেই সবটুকু দেখতে পাচ্ছি। ঠিক যেন সিনেমা দেখছি। হবে না-ই বা কেন? তাঁর প্রথম পরিচয়টিই যে হল তিনি একজন বিশ্ববরেণ্য চিত্রপরিচালক। তিনি সত্যজিৎ রায়। সিনেমা বানানোই ছিল তাঁর পেশা ও নেশা। গল্পও লিখেছেন তাই সিনেমার মতো করেই। তাঁর একানব্বইটি ছোটগল্প যেন এক একটি সবাক চলচ্চিত্র। সিনেম্যাটিক ভঙ্গিতে সাহিত্যকে ভরে দিয়েছেন সেলুলয়েডে। সিনেমা বানানোর কাজ সামলে খুব কমই সময় দিতে পেরেছেন তাঁর লেখায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজের পছন্দের বিষয়গুলি বারবার হয়ে উঠেছে তাঁর গল্পের বিষয়বস্তু। তাঁর একাধিক গল্পে পাই ম্যাজিক, ছবি আঁকা, সিনেমা-র প্রসঙ্গ। অবশ্য এই স্বল্প পরিসরে তাঁর সাহিত্যকীর্তির সমস্ত আঙ্গিক তুলে ধরা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি, তবু চেষ্টা করেছি কিছু বিশেষ দিক আলোচনা করতে।
 
সত্যিজিতের ছোটগল্পে একা মানুষের ভিড়
 
সত্যজিৎ রায়ের গল্পে উপন্যাসে নারীচরিত্রের সংখ্যা বেজায় কম, এ তো আমরা সবাই জানি। ফেলুদার গল্পে থ্রি মাসকেটিয়ার্স-ই হোক বা শঙ্কু সিরিজের প্রোফেসর শঙ্কু— এঁদের বান্ধবীভাগ্যটি নেহাতই খারাপ। মূলত কিশোরদের কথা ভেবে লিখতে শুরু করা মানুষটি হয়তো আঁচ করতে পারেননি ছোটদের সঙ্গে সঙ্গে বড়রাও টানা কয়েকটি দশক ধরে গোগ্রাসে গিলবে তাঁর লেখা। বড়দের জন্য লেখা ময়ূরকন্ঠী জেলি, পিকু-তে অবশ্য সামান্য পরিসরে হলেও নারীচরিত্রর মুখ দেখা গেছে। তবে আমাদের মতো সর্বভুক পাঠকদের কাছে কি বা বড়দের গল্প, কি বা ছোটদের গল্প— আমরা সবই পড়ে ফেলি। শুধু আফশোস এই, ফেলুদার মতো অমন হ্যান্ডসাম যুবকটিকে কেন যে রায়বাবু একটি মিষ্টি প্রেমিকা দিয়ে গেলেন না! তোপসেকেও একইভাবে বঞ্চিত করে গেছেন। 
ছোটগল্পগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, চরিত্ররা হয় বউ-বাচ্চাসহ মধ্যবিত্ত গৃহস্থ নয়তো ব্যাচেলর। ব্যাচেলর পুরুষগুলির জীবনে রয়েছে একটি দু্টি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একেবারে একা নিঃসঙ্গ মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তারিণীখুড়োর কথাই ধরা যাক। ভদ্রলোক জীবনটাকে যেভাবে উপভোগ করেছেন, ভাবলে একটু হিংসেই হয়। যখন যেখানে ইচ্ছা থেকেছেন, যখন ইচ্ছা চাকরি ছেড়েছেন, গোটা ভারতবর্ষ চষে বেড়িয়েছেন— পিছুটানহীন বাঁধনশূন্য একটা জীবন! তবে শেষবয়েসে এসে কি মানুষ সঙ্গলাভের জন্য উৎসুক হয়ে পড়ে? হয়তো তাইজন্যই চৌষট্টি বছর বয়েসে বৃষ্টি হোক বাদলা হোক, খুড়ো ঠিকই হাজিরা দিয়ে যান ন্যাপলা, ভুলু, চটপটি, সুনন্দদের আড্ডায়। বাস না পেলেও অক্লেশে হেঁটে আসেন বেনেটোলা লেন থেকে বালিগঞ্জ— শুধুমাত্র এই কচিকাঁচাদের গল্প শোনানোর তাগিদে। 
 
অন্যান্য ছোটগল্পের চরিত্রদের মধ্যে বিপিন চৌধুরী (গল্পের নাম ‘বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম’), রতনবাবু (গল্পের নাম ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’), প্রোফেসর হিজিবিজবিজ (গল্পের নাম ‘প্রোফেসর হিজিবিজবিজ), বাতিকবাবু (গল্পের নাম ‘বাতিকবাবু’), হারুনদা (গল্পের নাম ‘ফটিকচাঁদ’), জগন্ময়বাবু (গল্পের নাম ‘বিষফুল’), অসমঞ্জবাবু (গল্পের নাম ‘অসমঞ্জবাবুর কুকুর), ফণীবাবু (গল্পের নাম ‘লোডশেডিং’), সহদেববাবু (গল্পের নাম ‘সহদেববাবুর পোট্রেট’), তুলসীবাবু (গল্পের নাম ‘বৃহচঞ্চু’), পুলিন রায় (গল্পের নাম ‘অতিথি’), নিশিকান্তবাবু (গল্পের নাম ‘ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট’), নিকুঞ্জ সাহা (গল্পের নাম ‘বহুরূপী’), সেজোকাকা (গল্পের নাম ‘অপদার্থ’), সাধনবাবু (গল্পের নাম ‘সাধনবাবুর সন্দেহ’), নিকুঞ্জবাবু (গল্পের নাম ‘অনুকূল’), সুখময় (গল্পের নাম ‘গণেশ মুৎসুদ্দির পোর্ট্রেট’), মৃগাঙ্কবাবু (গল্পের নাম ‘মৃগাঙ্কবাবুর ঘটনা’), নিতাইবাবু (গল্পের নাম ‘নিতাইবাবুর ময়না’), ব্রজবুড়ো (গল্পের নাম ‘ব্রজবুড়ো’), শঙ্করবাবু (গল্পের নাম ‘অভিরাম’), শশাঙ্ক (গল্পের নাম ‘ময়ূরকন্ঠী জেলি’)— এঁদের মধ্যে মিল একটাই, এঁরা প্রত্যেকে একা মানুষ। কেউ থাকেন বিশ্বস্ত চাকরের সাহচর্য্যে, কেউ বা নিঃসঙ্গতা তাড়াতে পুষেছেন পাখি, কুকুর। এমনকি রোবট চাকরও বাড়িতে এনেছেন একজন! এঁরা কেউ শখের মেকআপ আর্টিস্ট, কেউ ছবি আঁকেন, কেউ ভূপর্যটক, কেউ বিজ্ঞানী, কেউ বা দশটা-পাঁচটার চাকুরিজীবি। [সত্যজিৎ রায়ের লেখা একানব্বইটি ছোটগল্পে হয়তো এমন নিঃসঙ্গ চরিত্র আরও রয়েছে, যথাযোগ্য প্রমাণের অভাবে তাদের এ তালিকায় রাখা গেল না। এ তালিকাও যে একশো শতাংশ সঠিক, তাও বলা যায় না। হতেই পারে, এঁদের কয়েকজনের স্ত্রী পুত্র বর্তমান, অথচ গল্পে তাদের উল্লেখ নেই।]
 
অন্যের কৃতিত্ব চুরির প্রসঙ্গটি সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্পে বেশ কয়েকবার উঠে এসেছে। 
 
শোনা যায়, সত্যজিৎ রায়ের লেখা ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ গল্পটির চিত্রনাট্য ‘এলিয়েন’ হুবহু কপি করে স্টিভেন স্পিলবার্গ বানিয়েছিলেন ‘ইটি’ ছবিটি। পরবর্তীকালে সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী বিজয়া রায় নিজেদের জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, “এই ‘ই-টি’ নিয়ে অনেক জলঘোলা হয়েছে। মানিক ‘দি এলিয়েন’ বলে যে একটা ছবি করবেন বলে ঠিক করেছিলেন, সেটা অনেক দূর এগিয়ে হলিউডের সঙ্গে কথাবার্তা বলেও শেষ পর্যন্ত যিনি মধ্যস্থতা করেছিলেন তাঁর জন্য সব বানচাল হয়ে গেল। অন্য গ্রহের প্রাণী পৃথিবীর ক্ষতি করতে আসছে না, আসছে স্পেসিমেন সংগ্রহ করতে এবং দরকার হলে উপকার করতে, কোনও ক্ষতি করতে নয়। ‘ই.টি’-তেও তা-ই আছে, কিন্তু ওখানেই মানিকের গল্পের সঙ্গে একমাত্র মিল, আর কোনও মিল নেই। গল্পটা সম্পূর্ণ আলাদা ও অতি সুন্দর, একেবারে তাক লাগিয়ে দেয়। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলাম মনে আছে। মানিকেরও দারুণ ভাল লেগেছিল।” [‘আমাদের কথা’, বিজয়া রায়]১
সত্যজিৎ রায় চাকরি করেছেন বিখ্যাত বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি. জে. কিমার অ্যান্ড কোং-এ।২ ১৯৫০ সাল নাগাদ তাঁকে অফিস থেকে লন্ডন পাঠানো হয়। বাকিটুকু রইল বিজয়া রায়ের জবানিতেই, “আমরা ৮ মে ’৫০ লন্ডনে পৌঁছই। আর ডায়েরিতে দেখছি, বাইশে জুন ওঁদের আপিসের আর্ট ডিরেক্টরের সঙ্গে ওঁর কথা-কাটাকাটি হওয়াতে খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন। ওঁদের এই লন্ডন-আপিসে ওঁর একেবারেই ভাল লাগছিল না। আর্ট ডিরেক্টর মিস্টার বুল অত্যন্ত বাজে লোক। মানিকের করা কাজ নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছিল। ধরা পড়ে গিয়েও কোনও লজ্জা নেই। মানিক আপিস থেকে ফিরেই কলকাতায় মিস্টার ব্রুমকে চিঠি লিখতে আরম্ভ করলেন। বিদেশে এই প্রথম ধাক্কা খেয়ে একটু বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন মানিক। কারণ, এটা তিনি আশা করেননি।”৩
নিজের কৃতিত্বটুকু অন্য কেউ চুরি করে নিলে যে অসম্ভব খারাপ লাগে, তা আর বলার অবকাশ রাখে না। সত্যজিতের তিনটি ছোটগল্পে এমন ঘটনা ঘটেছে— ‘ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট’, ‘গল্পবলিয়ে তারিণীখুড়ো’, ‘ময়ূরকন্ঠী জেলি’। 
 
‘ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট’ গল্পে নিশিকান্তবাবু আবিষ্কার করে ফেলেন সর্বরোগহর এক আশ্চর্য ফল। সে ফল যাতে মানুষের কাজে লাগে, তার জন্য নিজে দায়িত্ব নিয়ে খবরের কাগজে লিখে পাঠালেন। কিন্তু মানুষটি যে নেহাতই সাদাসিধা ভালোমানুষ। ফন্দিবাজ বিজনেসম্যানদের সাথে তিনি পেরে উঠবেন কেন? কোটি টাকার ব্যবসা শুরু হল সে ফলটিকে ঘিরে। ম্যাকেঞ্জি ফ্রুটের আসল আবিষ্কর্তা রয়ে গেলেন লোকচক্ষুর অগোচরেই। 
‘গল্পবলিয়ে তারিণীখুড়ো’ গল্পে এক গুজরাটি কাপড় ব্যবসায়ীর শখ হয়েছে লেখক সাজার। কিন্তু লেখক হবো বললেই তো আর হওয়া যায় না, প্লটের জোগান দেবে কে? মাইনে দিয়ে তারিণীখুড়োকে রাখলেন রোজ একটি করে অপ্রকাশিত মৌলিক গল্প শোনানোর জন্য। তারিণীখুড়ো নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি উজাড় করে দিতে লাগলেন। তারিণীখুড়োর অজান্তেই সেসব গল্প গুজরাটি ভাষায় ছাপা হতে শুরু করল সেই কাপড় ব্যবসায়ী মিঃ পারেখের নামে। কিন্তু চোরের দশদিন, গেরস্তের একদিন! তারিণীখুড়ো বুঝে ফেললেন তাঁর গল্প চুরি করে মিঃ পারেখ লেখক হিসেবে নাম কিনছেন। আমাদের তারিণীখুড়ো তো আর নিশিকান্তবাবুর মতো নিরীহ গোবেচারা ভালোমানুষটি নয়। তিনি দিলেন চোরটিকে মোক্ষম শিক্ষা। একদিন বলে বসলেন কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্প। বোকা চোর সেই গল্পই হুবহু টুকে দিল নিজের নামে। পাঠকরা ঠিক ধরে ফেলল সে গল্পের আসল রচয়িতা কে, মিঃ পারেখের লেখক সাজা আর হল না!
‘ময়ূরকন্ঠী জেলি’ গল্পে শশাঙ্ক তার সদ্যমৃত বিজ্ঞানীবন্ধু প্রদোষের ফর্মুলা চুরি করে বানিয়ে ফেলে ময়ূরকন্ঠী জেলি। বাস্তবে হয়তো এমন ঘটনা ঘটিয়ে পার পেয়ে যায় অনেকেই। কিন্তু গল্পে কর্মফল সে পেয়েছে হাতেনাতেই। জেলিটিই হয়ে ওঠে তার মৃত্যুর কারণ।
 
সুকুমার রায়ের প্রতি ট্রিবিউট
 
সত্যজিৎ রায়ের দুটি ছোটগল্প— ‘প্রোফেসর হিজিবিজবিজ’, ‘নিধিরামের ইচ্ছাপূরণ’ গল্পদুটিকে কি বাবা সুকুমার রায়ের প্রতি ট্রিবিউট বলা চলে? প্রথম গল্পটি নিঃসন্দেহে সুকুমার রায়ের পরিচয় বহন করছে। পরেরটিকে হয়তো ঠিক ‘ট্রিবিউট’ না বললেও বলা যেতে পারে গল্পটিতে পরোক্ষভাবে সুকুমার রায়ের কিছুটা প্রভাব আছে। 
‘প্রোফেসর হিজিবিজবিজ’ গল্পে একের পর এক এসেছে সুকুমার রায়ের সৃষ্ট চরিত্রদের রেফারেন্স। প্রোফেসর হিজিবিজিবিজকে দেখতে অবিকল সুকুমার রায়ের ‘হ য ব র ল’-র হিজিবিজবিজের মতো— ন্যাড়া মাথা, ছুঁচোলো কান, মিটিমিটি চাহনিতে দুষ্টুহাসির ভাব। তার চাকরটি দেখতে অবিকল ‘পালোয়ান’ কবিতার ষষ্ঠীচরণের মতো। প্রোফেসর ডাক্তারি আর বিজ্ঞানের বই ছাড়া যে দুটো বই সারাজীবনে পড়েছেন, তা হল— সুকুমার রায়ের ’আবোলতাবোল’ আর ‘হ য ব র ল’। সুকুমার রায়ের আঁকা ছবিগুলো দেখে তাঁর মন ভরত না, চাইতেন অমন কিম্ভূত জানোয়ারদের হাতের কাছে পেতে। ‘আবোলতাবোল’ পড়ে এমন ইচ্ছে অল্পবিস্তর প্রতিটি বাঙালি শিশুর হয়েছে। বকচ্ছপ, গিরগিটিয়া, হাঁসজারুরা বাস্তব দুনিয়ায় এসে পড়লে মন্দ হত না কিন্তু! প্রোফেসর হিজিবিজবিজ সারাজীবন ধরে সেই চেষ্টাই চালিয়েছেন। তিনি নিজের কানের সঙ্গে বনবেড়ালের কান জুড়ে নিজেকে দিয়েছেন সুকুমার রায়ের আঁকা হিজিবিজবিজের চেহারা। তিনি থাকেন ‘আবোলতাবোল’-এর সেই ‘বুড়ির বাড়ী’র মতো— ‘‘ঝুরঝুরে প’ড়ো ঘরে’’!৪ বাড়ির নাম ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’! প্রোফেসর এখন চান ‘ভয় পেয়ো না’ কবিতার সেই আজব প্রাণীটিকে বানাতে।
 
লক্ষ্যণীয়, গল্পে কিন্তু কোথাও একবারের জন্যও সুকুমার রায়ের নামটি উল্লেখ করতে হয়নি। সত্যজিৎ রায় নিশ্চিত ছিলেন তাঁর বাবার সৃষ্ট চরিত্রগুলো এতই জনপ্রিয়, সৃষ্টিকর্তার নাম না বললেও পাঠক ঠিকই চিনে নেবে। 
এবার আসা যাক, ‘নিধিরামের ইচ্ছাপূরণ’ গল্পটির প্রসঙ্গে। গল্পের শুরু হচ্ছে এইভাবে— “কোনও মানুষই তার নিজের অবস্থা সম্পর্কে ষোলো আনা সন্তুষ্ট বোধ করে না। কোনও-না কোনও ব্যাপারে একটা খুঁতখুঁতেমির ভাব প্রায় সবার মধ্যেই থাকে। রাম ভাবে তার শরীরে আরও মাংস হল না কেন— হাড়গুলো বড্ড বেশি বেরিয়ে থাকে; শ্যাম ভাবে— আমার কেন গলায় সুর নেই, পাশের বাড়ির ছোকরা তো দিব্যি হারমোনিয়াম বাজিয়ে গলা সাধে; যদু বলে— আহা, যদি খেলোয়াড় হতে পারতাম!— গাভাসকার ব্যাটা কত রেকর্ড করে কী নামটাই করে নিল! মধু বলে— যদি বোম্বাইয়ের ফিল্মের হিরো হতে পারতাম!— যশ আর অর্থ দুইয়েরই কোনও অভাব হত না।” মজার ছলে এই সাংঘাতিক সত্যিটাই লিখে গেছেন সুকুমার রায় তাঁর ‘খিচুড়ি’ কবিতায়— “জিরাফের সাধ নাই মাঠে ঘাটে ঘুরিতে,/ফড়িঙের ঢং ধরি সেও চায় উড়িতে।”৫ সত্যজিতের গল্পে নিধিরামের ইচ্ছেটি অবশ্য পূরণ হয়েছে। এক বাবাজির আশীর্বাদে নিধিরাম পেয়েছে তার কাঙ্ক্ষিত মনোতোষের জীবন, বন্ধু মনোতোষ পেয়েছে নিধিরামের জীবন।
সত্যজিতের ছোটগল্পে মনোজগতের বিভিন্ন রূপ
 
‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র বঙ্কুবাবু নিরীহ ভালোমানুষ। তাঁকে কেউ রাগতে দেখেনি, উঁচুগলায় কথা বলতে শোনেনি। তাঁর কোনও বন্ধু নেই। গ্রামের উকিল শ্রীপতি মজুমদারের আড্ডায় বঙ্কুবাবুকে রোজ ধরে নিয়ে আসা হয়, কারণ এমন একজন লোক তো চাই, যাকে নিয়ে নির্বিচারে মশকরা করা যায়। বঙ্কুবাবু তাঁদের রগড়ের রসদ! একদিন ভিনগ্রহ থেকে একটি প্রাণী এল। অ্যাং। অ্যাং শেখালো বঙ্কুবাবুকে, ‘নীরবে অপমান সহ্য করা শুধু মানুষ কেন, কোনও প্রাণীরই শোভা পায় না।’ বঙ্কুবাবুর মনোজগতে ঘটে যায় আশ্চর্য এক পরিবর্তন। এই নতুন বঙ্কুবিহারী হয়ে উঠলেন আত্মবিশ্বাসে ভরপুর একটি মানুষ। শ্রীপতি মজুমদারের আড্ডার প্রতিটি সদস্যকে গুণে গুণে সবকটি অপমান সুদে-আসলে ফেরত দিয়েছেন। 
‘সদানন্দের খুদে জগৎ’ গল্পে সদানন্দের সূক্ষ্ম অনুভূতিপ্রবণতা তার বয়েসী আর পাঁচটা বাচ্চার থেকে তাকে একটু আলাদা করে দেয়। সদানন্দ পিঁপড়ে ভালোবাসে, তাদের লক্ষ্য করে। পিঁপড়েরাই ওর একমাত্র বন্ধু। তাদের নিয়েই সে বানিয়ে ফেলেছে তার নিজস্ব একটা আলাদা জগৎ। 
 
‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’ গল্পে রতনবাবু একদিন দেখা পান তাঁর অল্টার ইগো-র। রতনবাবুর মতো সেও একা, নিঃসঙ্গ একটি মানুষ। রতনবাবু কিন্তু খুশি হন না তাকে খুঁজে পেয়ে। তাঁর মতোই হুবহু আরও একটি মানুষ কেন থাকবে পৃথিবীতে, এ প্রশ্ন তাঁকে বিব্রত করে তুলেছে। নিজের অল্টার ইগো-কে তাই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছেন তিনি। পরিণামে তাঁরও একইভাবে মৃত্যু ঘটেছে। কারণ নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যে প্রকারান্তরে মৃত্যু-ই। 
‘খগম’ গল্পটিতে ধূর্জটিবাবু মনে করেন সাধু-সন্ন্যাসী মানেই বুজরুকি আর ভণ্ডামির ডিপো। বিনা কারণেই মেরে ফেলেন ইমলিবাবার পোষা সাপটিকে। ইমলিবাবার শাপে তিনি মানুষ থেকে সাপে পরিণত হয়েছেন। ‘খগম’ গল্পটির মূল উৎস মহাভারত হলেও বর্ণনায় হয়তো বেশ কিছু পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাব রয়েছে। যেমন, ধূর্জটিবাবুর বরফের মতো ঠান্ডা হাত ধরামাত্র গল্পকথকের প্রতিক্রিয়াটি কীটসের ‘ল্যামিয়া’ কবিতার কথা মনে করায়। ল্যামিয়াও সাপ হয়ে গিয়েছিল— “Lycius then press’d her hand, with devout touch, Twas'icy, and the cold ran through his veins!” সাপ রূপান্তরিত হতে শুরু করেছেন ধূর্জটিবাবু, লুকিয়ে পড়ছেন খাটের তলায় অন্ধকারে— কাফকার ‘The Metamorphosis’-এ গ্রেগর যখন পোকায় রূপান্তরিত হয়েছে, তখন সে— “hardly aware of what he was doing other than a slight feeling of shame, he hurried under the couch.”৬
 
‘বারীন ভৌমিকের ব্যারাম’ গল্পে এসেছে ক্লেপটোম্যানিয়া রোগটির প্রসঙ্গ।
‘মৃগাঙ্কবাবুর ঘটনা’ গল্পের বিষয়বস্তু হার্ডিঞ্জ ইন্ডিয়া কোম্পানির কেরানি মৃগাঙ্কবাবুর ট্র্যাজিক পরিণতি। ভদ্রলোককে দেখতে অনেকটা বাঁদরের মতো। লক্ষ লক্ষ বছর আগে মানুষ ছিল এক শ্রেণীর চতুষ্পদ বাঁদর— এই সামান্য খবরটুকু তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। সুস্থ মানুষটির ঘটে মস্তিষ্কবিকৃতি, মৃগাঙ্কবাবু নিজেকে বাঁদর ভাবতে শুরু করেন। গল্পের মধ্যে হাস্যরস থাকলেও মৃগাঙ্কবাবুর পরিণতিটি বড়ই করুণ— “চিড়িয়াখানার একজন কর্মচারী গতকাল ভোরে শিম্পাঞ্জির খাঁচার সামনে মাটিতে একটি বাঁদর শ্রেণী জীবকে পড়ে থাকতে দেখে।... প্রাণীটি বেঁচে আছে— এবং বাঁদরের মতোই হুপ্ হাপ্ কিচির মিচির শব্দ করছে। সবচেয়ে আশ্চর্য এই যে বাঁদরটির বাঁ হাতের অনামিকায় একটি আংটি পরানো— তাতে নীলের উপর সাদা দিয়ে মিনে করে লেখা ইংরিজি অক্ষর ‘এম’।”
‘ব্রজবুড়ো’ গল্পে ব্রজকিশোর ব্যানার্জি ভুগছেন অদ্ভুত এক মনের অসুখে। শরীরে তিনি বৃদ্ধ, মন কিন্তু আটকা পড়ে আছে তাঁর বালকবয়েসে। ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে ভাব করতে চান অথচ বাচ্চারা তাঁকে দেখে ভয়ে পালিয়ে যায়। ফলস্বরূপ তিনি একেবারে একা হয়ে পড়েছেন। 
‘পিকুর ডায়রি’ গল্পে ছোট্ট পিকু বোঝে না পারিবারিক অশান্তির কারণ, তবু তার অবচেতন মনে স্পষ্ট হয়েছে এক ভাঙনের ছবি। পিকুর অসহায়তা, নিঃসঙ্গতার একমাত্র সাক্ষী তার ডায়রি— “আর কেউ নেই খালি আমি আর দাদু আর একটা খালি মাছি আছে খালি খালি আসছে জালাতোন ভারি বদমাইস মাছিটা আর বাস এইবার পাতা শেস, খাতা শেস, বাস শেস।”
 
সত্যজিতের ছোটগল্পে ভূতেরা
 
সব মিলিয়ে তাঁর চব্বিশটি ছোটগল্পে দেখা দিয়েছে ভূতেরা— ‘অনাথবাবুর ভয়’, ‘দুই ম্যাজিশিয়ান’, ‘বাদুড় বিভীষিকা’, ‘নীল আতঙ্ক’, ‘ফ্রিৎস’, ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’, ‘মি. শাসমলের শেষরাত্রি’, ‘ভুতো’, ‘ফার্স্ট ক্লাস কামরা’, ‘কনওয়ে কাসলের প্রেতাত্মা’, ‘তারিণীখুড়ো ও বেতাল’, ‘গগন চৌধুরীর স্টুডিও’, ‘লখনৌর ডুয়েল’, ‘ধুমলগড়ের হান্টিং লজ’, ‘লাখপতি’, ‘খেলোয়াড় তারিণীখুড়ো’, ‘আমি ভূত’, ‘রামধনের বাঁশি’, ‘মহারাজা তারিণীখুড়ো’, ‘কাগতাড়ুয়া’, ‘নরিস সাহেবের বাংলো’, ‘কুটুম-কাটাম’, ‘টেলিফোন’, ‘অভিরাম’। এদের মধ্যে অবশ্য ‘ফার্স্ট ক্লাস কামরা’ ও ‘লাখপতি’ গল্পে ভূত আর সশরীরে এসে উঠতে পারেননি, গা ছমছমে ভূতের গল্পদুটি শেষমেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধুর প্র্যাকটিকাল জোক বলে প্রমাণিত হয়েছে। তবু ভৌতিক রসখানি তো পুরোমাত্রায় বজায় আছে, তাই ও দুটিকেও ভূতের গল্পের তালিকায় ফেলা গেল। তাছাড়া, ‘দুই ম্যাজিশিয়ান’, ‘নীল আতঙ্ক’, ‘মি. শাসমলের শেষরাত্রি’, ‘গগন চৌধুরীর স্টুডিও’, ‘অভিরাম’— গল্পের ভূতেরা সরাসরি না দেখা দিয়ে একটু ঘুরপথে এসেছেন, তাঁরা প্রত্যেকে স্বপ্নে হানা দিয়েছেন। মজার কথা হল, এই চব্বিশটি গল্পের ভূতেরা কিন্তু মোটেই দুষ্টু ভূত নয়, ভূতুড়ে বদখেয়াল চাপে না একটিরও মাথায়। কেউ কেউ এসেছে জ্যান্ত অবস্থায় তাদের সাথে হওয়া অন্যায়গুলোর প্রতিশোধ নিতে, কেউ বা ফিরে আসে পোষ্য বেড়ালের টানে অথবা বাকি ফেলে রাখা কাজগুলো সম্পূর্ণ করার তাগিদে। সত্যজিতের গল্পের ভূতেরা কোথাও কোথাও মানুষের চেয়েও বেশি মানবিক হয়ে উঠেছে। কোনও ভূত ভারী নিঃসঙ্গ, কোনও ভূত ভোগে হীনমন্যতায়। প্রভু ভৃত্যের মনোরম কেমিস্ট্রিও দেখা গেছে। 
 
‘অনাথবাবুর ভয়’ গল্পে রঘুনাথপুর যাওয়ার ট্রেনে গল্পকথকের আলাপ হল অনাথবন্ধু মিত্র-র সঙ্গে। তিনি ভূত বিশেষজ্ঞ। পঁচিশ বছর ধরে রিসার্চ করে ভূত, প্রেত, পিশাচ, ডাকিনী, যোগিনী, ভ্যাম্পায়ার, ওয়্যারউলফ, ভুডুইজম ইত্যাদি যা কিছু আছে সব তিনি জেনে ফেলেছেন বলে মনে করেন। ভারতবর্ষের অন্তত তিনশো ভূতের বাড়িতে রাত কাটানো এই ভূত বিশারদটি মনস্থ করলেন রঘুনাথপুরের ভূতুড়ে হালদারবাড়িতে রাত্রিবাস করে ভূতের সাথে মোলাকাত করবেন। বাড়িতে ভূত যে আছেই, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। কারণ তিনি গন্ধ পেয়েছেন— ‘মাদ্রাজি ধূপ, মাছের তেল আর মড়াপোড়ার গন্ধ মেশানো একটা গন্ধ’। এ গন্ধ তাঁর চেনা গন্ধ। বিকেল নাগাদ হালদারবাড়ির উত্তর-পশ্চিমের ঘরে ঢুকে পড়লেন অনাথবাবু। তারপর কী হল? পরদিন সকালে উৎসুক গল্পকথককে তাঁর রাত্রিবাসের চমৎকার ভূতুড়ে অভিজ্ঞতাখানি উপহার দিয়ে বললেন, “আমার আর ভূতের পিছনে ধাওয়া করতে হবে না সীতেশবাবু। কোনওদিনও না। সে শখ মিটে গেছে।” গল্পকথক দিনের আলোয় এসে ঢুকলেন সেই উত্তর পশ্চিমের ঘরে— “বুট জুতো পরা ও কে পড়ে আছে মেঝেতে?’’ গল্পকথক জ্ঞান হারালেন। জ্ঞান ফিরতে ভবতোষবাবু জানালেন, অনাথবাবু আর অনাথবাবু নেই, তাঁর নামের ডগায় চন্দ্রবিন্দু বসে গেছে, “হলধরের যা হয়েছিল, এঁরও ঠিক তাই। মরে একেবারে কাঠ, আর চোখ ঠিক সেইভাবে চাওয়া, সেই দৃষ্টি, সেই কড়িকাঠের দিকে।” গল্পকথক অবশ্য জানেন, অনাথবাবু মরে কাঠ হননি— তিনি একটি ভূত হয়েছেন! ‘‘কালও সকালে গেলে দেখতে পাব তাঁকে— গায়ে কালো কোট, পায়ে বুট জুতো— হালদারবাড়ির পূব দিকের জঙ্গল থেকে নিমের দাঁতন হাতে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসছেন।”
 
‘দুই ম্যাজিশিয়ান’ গল্পে সুরপতি মণ্ডল একজন নামকরা উঠতি ম্যাজিশিয়ান। ট্রেনের কামরায় হঠাৎ দেখা ত্রিপুরাবাবুর সঙ্গে। ত্রিপুরাচরণ মল্লিক, সুরপতির গুরু। এক বিয়েবাড়িতে আংটি-আধুলির ম্যাজিক দেখে সুরপতি শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ত্রিপুরাবাবুর। বিয়েবাড়িতে পঞ্চাশটাকার বিনিময়ে ত্রিপুরাবাবু ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াতেন। নামযশ, অর্থ-র দিকে তাকাননি। সুরপতির মনে হয়েছিল এই গুণী মানুষটি অকালেই হারিয়ে যাবেন শুধুমাত্র অ্যাম্বিশানের অভাবে। সুরপতি হারিয়ে যেতে চায়নি তার গুরুর মতো। ইতালীয় জাদুকর শেফাল্লো দি গ্রেট-এর জাঁকজমক দেখে তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ত্রিপুরাবাবুর খাঁটি ম্যাজিককে সে অবজ্ঞা করে না, কিন্তু স্টেজে সে ম্যাজিক চালাতে গেলে যে একটু চটক ও চাকচিক্যর প্রয়োজন— একথা সে স্বীকার না করে পারে না। ত্রিপুরাবাবু মারা গেছেন বহুবছর আগে বাস চাপা পড়ে। ত্রিপুরাবাবু এখন এসেছেন এক অদ্ভুত দাবী নিয়ে। যে নামযশকে তিনি বেঁচে থাকতে এড়িয়ে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পরপারে বসে তাঁর ইচ্ছে হয়েছে অনেক লোকের সামনে তাঁর সেরা খেলাগুলো দেখানোর। লক্ষ্ণৌতে সুরপতি ম্যাজিক দেখানোর আমন্ত্রণ পেয়েছে। ত্রিপুরাবাবুর সাধ, সে শো-তে সুরপতির বদলে তার গুরু ম্যাজিক দেখাবেন। পরিবর্তে সুরপতিকে তিনি শিখিয়ে দেবেন আংটি আধুলির ম্যাজিক। ত্রিপুরাবাবুর প্রস্তাব না মানলে সুরপতিকে তিনি অকেজো করে দেবেন, সে আর ম্যাজিক দেখাতেই পারবে না। একপ্রকার বাধ্য হয়েই সুরপতি মেনে নেয় ত্রিপুরাবাবুর দাবি। ত্রিপুরবাবু শিখিয়ে দেন সেই আংটি-আধুলির ম্যাজিক— ‘একটা রুপোর আধুলি গড়িয়ে গড়িয়ে তিন হাত দূরে রাখা একটি সোনার আংটির কাছে গেল, তারপর আংটিটাকে সঙ্গে নিয়ে আবার গড়গড়িয়ে ত্রিপুরাবাবুর কাছেই ফিরে এল।’ এরপর সুরপতির ঘুমটি ভাঙে! ব্যাপারখানা যে নিছক স্বপ্ন নয়, তা পরিষ্কার হয়ে যায় একটু পরেই। সুরপতি শিখে ফেলেছে সেই আংটি আধুলির ম্যাজিক, যে ম্যাজিক ত্রিপুরাচরণ বেঁচে থাকতে শেখাতে চাননি সুরপতিকে। গল্পের শেষে সুরপতি লক্ষ্ণৌতে তার ম্যাজিক শো-য়ে সমবেত দর্শকের সামনে তার স্বর্গত গুরু ত্রিপুরাচরণ মল্লিকের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছে। ত্রিপুরাচরণ হয়তো এটুকুই চেয়েছিলেন। এই সামান্য স্বীকৃতিটুকু পাওয়াই হয়তো ছিল তাঁর একান্ত বাসনা। 
 
পরের গল্প ‘বাদুড় বিভীষিকা’য় বিলিতি ভ্যাম্পায়ারের আগমন ঘটেছে। গল্পকথক একজন গবেষক, বাংলার প্রাচীন পোড়া ইটের মন্দিরগুলোই তাঁর গবেষণার বিষয়। সে সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের কাজে তিনি এসেছেন সিউড়ি। কথক ভদ্রলোকটির বাদুড় একেবারেই ধাতে সয় না। সিউড়ির যে বাড়িতে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, সেখানে দেখা যায় একটি বাদুড় আগে থেকেই অতিথির অধিকার ফলিয়ে ঝুলে আছেন কড়িকাঠ থেকে। গল্পকথক পড়েছেন মহা অস্বস্তিতে। বাড়ির কেয়ারটেকারকে ডেকে এনে মহা হুলুস্থূল জুড়লেন। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বাইরের আলো কমতে বাদুড়বাবাজি উড়ে ঘর থেকে চলে গেলেন। স্বস্তি পেলেন কথক। রোদ পড়তে তিনি গিয়ে পৌঁছলেন এক গোরস্থানে, দেখা হল জগদীশ পার্সিভ্যাল মুখার্জির সঙ্গে। লোকটি যেন বুঝে ফেলেছেন কথকের কাছে বাদুড়প্রসঙ্গ ভারী অতৃপ্তিকর, তাই জেনেবুঝেই বারবার বাদুড়ের কথা তুলে বিব্রত করতে চান কথককে। সে রাতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল তিনটি— স্বপ্নে কথক দেখলেন জগদীশবাবু জ্বলজ্বলে সবুজ চোখ ও ধারালো সরু দাঁত বাগিয়ে হাসছেন এবং একলাফে গরাদ ভেদ করে ঢুকে পড়লেন ঘরের ভেতর। সকালে উঠে কথক শুনলেন, বাড়ির কেয়ারটেকারের বাছুরটি মরেছে, তার গলায় ছোবলের দাগ! কথকের মনে হল, ভ্যাম্পায়ার ব্যাটও যে গলা থেকেই রক্ত শুষে খায়! তৃতীয় ঘটনাটি সবচেয়ে ইনটারেস্টিং, দেখা গেল আগের দিনের বাদুড়টি আবার ফিরে এসেছে, কড়িকাঠ থেকে সে ঝুলে আছে। বিকেলে ফের দেখা হল জগদীশবাবুর সঙ্গে। তিনি জানালেন, তিনি নাকি রাতে জাগেন, দিনে ঘুমোন। সে রাতে জানলার গরাদ গলে বাদুড়বাবাজি ফেরত এলে গল্পকথক তাঁর শক্ত বাঁধানো খাতাটি বাগিয়ে ধরে কষিয়ে একখান চাঁটি মারেন। বাদুড় ধাক্কা খেয়ে ঘরের বাইরে মাঠে গিয়ে পড়ল, পরক্ষণেই শোনা গেল কারোর ঘাসের ওপর দিয়ে দৌড়ে পালানোর খচমচ শব্দ! পরদিন সকালে দেখা গেল, জগদীশবাবুকে ধরাধরি করে আনা হচ্ছে, কপালময় চাপ চাপ রক্ত। জানা গেল, ভদ্রলোক বদ্ধ পাগল, সন্ধেবেলা এ গাছে সে গাছে উঠে মাথা নিচু করে ঝুলে থাকেন— বাদুড়ের মতো!
 
‘নীল আতঙ্ক’ গল্পে বীরভূমের এক দুঁদে নীলকর সাহেবের প্রেতাত্মা ফিরে এসেছে তার মৃত্যুশতবার্ষিকীতে। বছর উনত্রিশের অনিরুদ্ধ নামে ছেলেটির গন্তব্যস্থান ছিল দুমকা, বন্ধু প্রমোদের বাড়ি। মাঝপথে অনিরুদ্ধর গাড়ির টায়ারটি দেহ রাখল। মুষলধারে বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। স্থানীয় লোকের কাছে জানা গেল, অনিরুদ্ধ ভুলপথে এসে পড়েছে। অনিরুদ্ধর দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য বলা মুশকিল, সামনেই ছিল এক পুরনো নীলকুঠি। রাতে মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু তার জুটল। চৌকিদারের হাতের সেঁকা মোটা রুটি, আর তার বউয়ের রান্না উরুৎ কা ডাল-ও জুটে গেল। আর পাঠকের জুটল খাসা একখানা সাহেব ভূতের গপ্পো! অনিরুদ্ধর হঠাৎ ঘুম ভাঙে, সে দেখে সে আর ‘অনিরুদ্ধ’ নেই, সে হয়ে গিয়েছে ১৮৬৮-র নীলকর সাহেব। সাহেবটির তিনকূলে আর কেউ বেঁচে নেই, এক তার প্রিয় পোষ্য রেক্স ছাড়া। বাংলাদেশের ম্যালেরিয়া তার আপনজনদের কেড়ে নিয়েছে। ম্যালেরিয়ার ভয়ে তার বাকি সঙ্গীরাও পালিয়েছে। টাকার মোহে থেকে গেছে শুধু এই সাহেবটি। সাতাশে এপ্রিলের রাতে সে ডায়েরিতে ব্যক্ত করতে বসেছে তার শেষ স্বীকারোক্তি। কিছু কুকীর্তির কারণে ইংল্যান্ডে ফেরার পথ তার বন্ধ। স্থানীয় নেটিভরা এই অত্যাচারী সাহেবটিকে একেবারেই পছন্দ করে না। সে মারা গেলে চোখের জল ফেলার জন্য থাকবে হয়তো শুধুই বেয়ারা মীরজান। পোষ্য রেক্স-কে নিয়েই তার যত ভাবনা। সাহেব মরলে যে তার প্রিয় গ্রে হাউন্ডটিকে গ্রামের লোক ঢিল মেরে, লাঠির বাড়ি মেরে শেষ করবে। পিস্তল হাতে এগিয়ে যায় সাহেব, নিজের হাতে কুকুরটিকে হত্যা করে। ঘরে ফিরে এসে পিস্তলের ঘোড়া টেনে দেয় সাহেব নিজের রগ লক্ষ্য করে। পরদিন সকালে অনিরুদ্ধর ঘুম ভাঙে, ঘড়িতে তারিখ দেখে বোঝে, আগের রাতটিই ছিল নীলকর সাহেবটির মৃত্যুশতবার্ষিকী!
 
‘ফ্রিৎস’ গল্পে একত্রিশবছর পর জয়ন্ত এসেছে তার ছেলেবেলায় ছুটি কাটিয়ে যাওয়া বুন্দি শহরের সার্কিট হাউসে। তার মনে পড়ে, ছেলেবেলায় সে সঙ্গে এনেছিল একটা পুতুল। সুইজারল্যান্ডের কোনও এক গ্রাম থেকে কেনা পুতুল— দশবারো ইঞ্চি লম্বা, সুইসদেশীয় পোশাক পরা, দেখতে নাকি হুবহু এক খুদে জ্যান্ত মানুষ। নাম তার ফ্রিৎস। পুতুলটা ছিল ছোট্ট জয়ন্তর ভীষণ প্রিয়। জয়ন্ত তার সাথে কথা বলত, খেলত। বুন্দিতে আসার পর পুতুলখানা গিয়ে পড়ে কুকুরদের খপ্পরে। দাঁতে কামড়ে পুতুলটা ক্ষতবিক্ষত করে দেয় তারা। জয়ন্তর মনে হয়, তার ফ্রিৎস আর বেঁচে নেই। সে সার্কিট হাউসেরই এক দেবদারু গাছের নীচে পুতুলটাকে কবর দেয়। একত্রিশবছর পর জয়ন্ত ফিরেছে সার্কিট হাউসে, রাতে বিছানায় শুয়ে সে শুনতে পাচ্ছে তার ছেলেবেলার পুতুল হেঁটে বেড়াচ্ছে তার চারপাশে। লেপের সাদা ওয়াড়ে ফ্রিৎসের পায়ের ছাপও দেখা যায়। সঙ্গী কথক তার মনের অবস্থা বুঝে পরামর্শ দেন ফ্রিৎসের কবর খুঁড়ে দেখতে— ‘‘ফ্রিৎসের বেল্টের বকলস বা কোটের পেতলের বোতাম— এসব জিনিসগুলো টিকে থাকা কিছুই আশ্চর্য নয়। জয়ন্তকে যদি দেখানো যায় যে তার সাধের পুতুলের শুধু ওই জিনিসগুলোই অবশিষ্ট আছে, আর সব মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, তা হলে হয়তো তার মন থেকে উদ্ভট ধারণা দূর হবে। এ না করলে প্রতিরাত্রেই সে আজগুবি স্বপ্ন দেখবে, আর সকালে উঠে বলবে ফ্রিৎস আমার বুকের ওপর হাঁটাহাঁটি করছিল। এইভাবে ক্রমে তার মাথাটা বিগড়ে যাওয়া অসম্ভব না।” ফ্রিৎসের কবর খোঁড়া হল, দেখা গেল ‘গর্তের মধ্যে ধুলোমাখা অবস্থায় চিত হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে একটি দশ-বারো ইঞ্চি ধবধবে সাদা নিখুঁত নরকঙ্কাল!’
 
‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’ গল্পে গল্পকথকের হস্তগত হয় একটি পুরনো ডায়রি, যার লেখক জন মিডলটন ব্রাউন। ব্যাঙ্গালোরবাসী এই সাহেবের ডায়েরি থেকে গল্পকথক জানতে পারেন এক আশ্চর্য তথ্য। ‘সাইমন’ নামে ব্রাউনসাহেবের কাছের কেউ একজন মারা যাওয়ার পরেও ব্রাউনসাহেবকে নিয়মিত দেখা দিয়েছে। এই ঘটনাটি চাক্ষুষ দেখার উৎসাহই গল্পকথককে টেনে নিয়ে যায় ব্যাঙ্গালোরের ফ্রেজার টাউনে অবস্থিত এভারগ্রিন লজটিতে। ব্রাউনসাহেব ডায়রির শেষপাতায় লিখেছিলেন, ‘যে আমাকে ভালবাসে, তার মৃত্যুর পরেও যে তার সে ভালবাসা অটুট থাকে, এই জ্ঞান লাভ করে আমি পরম শান্তি পেয়েছি।’ এভারগ্রিন লজে দেখা পাওয়া যায় তাঁর সাইমনের— একটি কালো বিড়াল! ‘কোনও এক অশরীরী বৃদ্ধের খিলখিলে হাসির ফাঁকে ফাঁকে বারবার উচ্চারিত হচ্ছে— “সাইমন সাইমন সাইমন সাইমন”— আর তার সঙ্গে ছেলেমানুষি খুশি হওয়া হাততালি।’
 
‘মিঃ শাসমলের শেষ রাত্রি’ গল্পে মিঃ শাসমল তাঁর বিজনেস পার্টনারকে খুন করে উত্তর বিহারের এক ফরেস্ট বাংলোয় গা-ঢাকা দিয়েছেন। রাতে তাঁর ঘরে আসতে থাকে একের পর এক অতিথি! মাসছয়েক আগে প্রতিবেশীর হুলোটিকে পেপারওয়েট ছুঁড়ে মেরে খুন করেছিলেন, তিয়াত্তর সালে একটি হাড় জিরজিরে নেড়িকে গাড়িচাপা দিয়েছিলেন, ছেলেবেলায় এয়ার গান দিয়ে পাখি মেরেছিলেন, মামাবাড়িতে থানইঁট ছুঁড়ে সাপ মেরেছিলেন— তাদের সব্বাই সে রাতে হাজির হয়েছে তাঁর ফরেস্ট বাংলোয়। সারাজীবনে যত মশা, পিঁপড়ে মেরেছেন, এসে পড়েছে তাদের ভূতেরাও। সবশেষে শুনতে পেলেন সদ্যমৃত বিজনেস পার্টনারের পায়ের শব্দ। একটি ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে প্রায়শ্চিত্ত করলেন মিঃ শাসমল। পরে অবশ্য দেখা গেছে, তাঁর বিজনেস পার্টনার অধীরবাবু দিব্যি বেঁচেবর্তে আছেন এবং তিনিই পুলিশসমেত উপস্থিত হয়েছেন সেই ফরেস্ট বাংলোয়। অন্ধকারে মিঃ শাসমলের চালানো গুলিটি আসলে অধীরবাবুর বদলে লেগেছিল সোফার গায়ে! 
 
‘ভূতো’ গল্পে নবীন শিখতে চায় ভেনট্রিলোকুইজম কিন্তু অক্রূর চৌধুরী শিষ্য নেবেন না। নাছোড়বান্দা নবীনকে তিনি একরকম বাড়ি থেকে বারই করে দিয়েছেন। রেগেমেগে নবীন কলেজ স্ট্রিট থেকে বই কিনে একাই শিখে ফেলল খেলাটি। এই পর্যন্ত তবু ঠিক ছিল। কিন্তু নবীন যে প্রবল প্রতিহিংসাপরায়ণ। সে বানিয়ে ফেলল একটা পুতুল, যাকে দেখতে অবিকল অক্রূর চৌধুরীর মতো। পুতুলের নাম সে দিল ভূতো। রাতারাতি নবীন জনপ্রিয় হয়ে উঠল। কিন্তু অক্রূর চৌধুরীর রোজগার প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে। স্টেজে উঠলেই লোকে হাসে, ‘ভূতো’ বলে টিটকিরি দেয়। একদিন অক্রূর চৌধুরী এলেন নবীনের কাছে। তাঁকে হাতের পুতুল বানিয়ে ফেলা যে তিনি বরদাস্ত করছেন না, তা স্পষ্টভাষায় জানিয়ে গেলেন। এরপর থেকেই ভূতো পুতুলটি গেল বদলে। মাথায় পাকাচুল গজালো, অক্রূর চৌধুরীর মতো কপালে তিল এল, ধীরে ধীরে সে পুতুল নবীনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। পুতুল ঘোষণা করল, এসব হচ্ছে নবীনের কর্মফল! পুতুল শ্বাস নিতে শুরু করে, ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে অশরীরী চিৎকার— ‘ভূতো নয়! আমি অক্রূর চৌধুরী!’ এরপর একইসাথে পুতুলটি অকেজো হয়ে যায় এবং অক্রূর চৌধুরী মারা যান হৃদরোগে। নবীন সিদ্ধান্ত নেয় আর পুতুল নয়, সে এবার অন্য ম্যাজিক ধরবে!
 
‘ফার্স্ট ক্লাস কামরা’ গল্পে দেখা গেছে রঞ্জনবাবুর উগ্র সাহেবপ্রীতির বহর। একদিন এক ফার্স্ট ক্লাস কামরায় তিনি দর্শন পেলেন মেজর ড্যাভেনপোর্টের ভূতের। সারারাত ভূতটি তাঁকে বেজায় নাকাল করেছিল। এ ঘটনার পর থেকেই তাঁর সাহেবপ্রীতিটি খানিক কমে। বছরদশেক বাদে তিনি জানতে পারেন, সে ভূতটি আর কেউ নয়, তাঁরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু পুলকেশবাবু! সাহেব সেজে ভয় দেখিয়ে রঞ্জনবাবুর সাহেবপ্রীতির ভূতটিকে তাড়িয়েছিল।
 
‘কনওয়ে কাসলের প্রেতাত্মা’ গল্পে তারিণীখুড়ো হাজারটাকার বাজি ফেলে উকিল ঘনশ্যাম আপটে-কে ভূত দেখাতে বদ্ধপরিকর। তরুণ সাংবাদিক আনওয়র কুরেশি হাড়ে হাড়ে চেনে আপটে-কে। আপটে বেজায় কিপটে! আত্মম্ভরি লোকটিকে জব্দ করতে অগত্যা কনওয়ে কাসলে তাকে মেকি ভূতের ব্যবস্থা করতে হয়। তারিনীখুড়ো বাজি জিতলে কুরেশি তার কাছে আসল কথাটি ফাঁস করে। তারিণীখুড়োর গল্প কিন্তু এখানেই শেষ নয়। কনওয়ে কাসলের দোতলায় সত্যিকারের ভূতের অস্তিত্ব মেলে। অশরীরী পাংখাবরদার আজও অক্লান্ত হাতে সেখানে টেনে চলেছে শতচ্ছিন্ন একটা বিশাল পাখা!
 
‘তারিণীখুড়ো ও বেতাল’ গল্পে টিপটিপে এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় মোমবাতির আলোয় আসর সাজিয়ে বসেছেন তারিণীখুড়ো। হায়দ্রাবাদের আর্টিস্ট ধনরাজ মার্তণ্ডর পৌরাণিক ছবির মডেল হতে হয়েছিল তাঁকে। আটটা ছবি শেষ হওয়ার পর আচমকা এক দুষ্কৃতি তাঁকে জখম করে, ফলে তারিণীখুড়োর বদলে অন্য মডেল নিতে হয় ধনরাজ মার্তণ্ডকে। ছবির বিষয় হয় রাজা বিক্রমাদিত্যর কাঁধে বেতাল। ছবির প্রয়োজনে তারিণীখুড়ো খুঁজে আনেন একটি কঙ্কাল। সে কঙ্কালেরও একটু ইতিহাস আছে। কঙ্কালটি ম্যাজিশিয়ান ভোজরাজের ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল। এ কঙ্কাল কোনও এক সিদ্ধপুরুষের, পৃথিবীতে কঙ্কালের কাজ ফুরোলে নদীর জলে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ ছিল। কঙ্কালের কাজ সম্ভবত বাকি ছিল, তাই ভোজরাজ সেটিকে মুসির জলে ফেললেও তা ডুবে যায়নি। কঙ্কাল যখন চাপানো হল নতুন মডেলের পিঠে, কঙ্কাল জড়িয়ে ধরল তাকে। ভয়ে নতুন মডেল কবুল করল, ধনরাজের মডেল হওয়ার লোভে তারিণীখুড়োকে সে-ই জখম করেছে। দোষীর উপযুক্ত শাস্তি হল, তারিণীখুড়োকেই মডেল করলেন ধনরাজ এবং কাজের শেষে কঙ্কালটিকে মুসি নদীর জলে ফেলতেই সেটি নিমেষে গেল তলিয়ে!
 
‘গগন চৌধুরীর স্টুডিও’ গল্পে রোজ রাতে উলটোদিকের বাড়িটি থেকে সুধীনের ঘরে ঢোকে জোরালো আলো। প্রতিবেশীর কাছে সে শুনেছে ওবাড়ির মালিক গগন চৌধুরী এককালে ছবি আঁকতেন। এরপর সুধীন স্বপ্নে মুখোমুখি হয় গগন চৌধুরীর। গগন চৌধুরী মৃত মানুষদের পরপার থেকে ডেকে এনে তাদের পোর্ট্রেট আঁকেন। ভয়ংকর স্বপ্নের শেষে সুধীনের ঘুম ভাঙলে সে শোনে, গগনবাবু বহুদিন ধরে অসুখে ভুগছিলেন বলে ঘরে বাতি জ্বলতো, কাল রাতেই তিনি মারা গেছেন!
‘লখনৌর ডুয়েল’ গল্পে তারিণীখুড়ো নিলামে কেনেন একজোড়া ডুয়েলিং পিস্তল। সে পিস্তলজোড়া দেখতে বাড়িতে আসে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সাহেব। সে শোনায় এক অভূতপূর্ব কাহিনী। এই পিস্তলজোড়া দিয়েই নাকি দেড়শোবছর আগে ডুয়েল লড়েছিল দু’জন সাহেব। তারা দুজনেই পেতে চেয়েছিল অ্যানাবেলা হাডসন নামে এক রূপসী তরুণীকে। প্রতিবছর ষোলোই অক্টোবর সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি নাকি আজও ঘটে চলেছে। ঘটনাটি চাক্ষুষ দেখতে তারিণীখুড়ো গিয়ে উপস্থিত হলেন দিলখুশার সামনের সেই মাঠে। অ্যানাবেলা কিন্তু তার পাণিপ্রার্থী দুই সাহেবের একজনকেও পছন্দ করেনি। সে বেছে নিয়েছিল অন্য একজনকে। দুই সাহেবের একজন মরে ডুয়েলিং পিস্তলের গুলিতে, অপরজনকে মারে স্বয়ং অ্যানাবেলা। তার পছন্দের মানুষটি ছিল তারিণীখুড়োর বাড়িতে পিস্তল দেখতে আসা সেই আগন্তুক। কুয়াশায় মিলিয়ে যাওয়ার আগে তারিণীখুড়োকে নিজের পরিচয় দিয়ে যায় সে আগন্তক। 
‘ধুমলগড়ের হান্টিং লজ’ গল্পে তারিণীখুড়োর উপস্থিতিতে উদয় হয় ধুমলগড়ের বড় রাজকুমার আদিত্যনারায়ণের প্রেতাত্মা। সম্পত্তির লোভে ছোটকুমার প্রতাপনারায়ণ তাকে সুপরিকল্পিতভাবে খুন করেছিল। আদিত্যনারায়ণের প্রেতাত্মা ফিরে আসে তার হত্যার প্রতিশোধ নিতে। 
 
‘লাখপতি’ গল্পে ত্রিদিববাবু টাকার পেছনে দৌড়তে দৌড়তে মানবিক বোধগুলি খোয়াতে বসেছেন। ছেলেবেলার বন্ধু প্রশান্তবাবু তাঁর এই পরিবর্তনে মোটেই খুশি নন। ফন্দি আঁটেন এক প্র্যাকটিকাল জোকের। ত্রিদিববাবুকে দেখানো হল তাঁর ছেলেবেলার প্রতিবিম্ব— যেন ছেলেবেলার সেই ত্রিদিব ওরফে মন্টু ছেলেবেলাতেই মারা গেছে, তার ভূত আজকের লাখপতি ত্রিদিববাবুকে মোটেই বরদাস্ত করতে পারছে না। বলাই বাহুল্য, প্রশান্তবাবুর ফন্দিটি কিন্তু কাজে দিয়েছিল!
’খেলোয়াড় তারিণীখুড়ো’ গল্পে বিখ্যাত ক্রিকেটার রণজির প্রেতাত্মা তারিণীখুড়োর হয়ে ক্রিকেট খেলেছে। 
 
‘আমি ভূত’ গল্পে দেখা পাই এক ভারী মিষ্টি ভূতের। স্টোভ ফেটে মরে যাওয়াতে তার মুখের অবস্থা হয়েছে ভয়াবহ। সে জানে তার মুখ দেখলে জ্যান্ত মানুষরা বড্ড ভয় পাবে। তাই সে আড়ালে আবডালেই থাকে। তবু ভুলবশত একদিন দেখা দিয়ে ফেলায় বাড়িটির ‘ভূতুড়ে বাড়ি’ হিসেবে নাম রটে যায়, ফলে আর কেউ ও বাড়িতে পা রাখে না। ভূতেদেরও যে একা লাগে, তাদেরও যে সঙ্গ পেতে ইচ্ছে করতে পারে। ভূতটির মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়েছে। একদিন এক অতিসাহসী লেখক থাকতে এলেন সেখানে। তাঁর স্টোভটিও বার্স্ট করল এবং লেখকমশাই অক্কা পেলেন। পূর্বতন ভূতটির সঙ্গীর অভাব মিটল। 
 
‘রামধনের বাঁশি’ গল্পে রামধনের থাকার ঘরটি দখল করেছেন খগেশবাবু। রামধন বেঁচে থাকতে খগেশবাবু একবার তার চুলের মুঠি ধরে আছাড় মেরেছিলেন। রামধনের কিন্তু প্রতিশোধ নেওয়ার কোনও মতলব নেই। তার শখের বাঁশিটি রয়ে গেছে খগেশবাবুর দখল করে বসা ঘরখানায়। সেইটি উদ্ধার করতে রামধন ঢুকেছে ঘরে। আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও সে বাঁশি আর খুঁজে পায় না। এমন সময় খগেশবাবু এসে হাজির। রামধন ভয়েই কাঠ। কিন্তু তাকে দেখে খগেশবাবু খেলেন ভিরমি, সটান পড়লেন মেঝের ওপর। রামধন তো ভূত! দশবছর আগেই সে অক্কা পেয়েছে। আসলে সকলের কাছে ধমক খেয়ে মানুষ হওয়া রামধনের মধ্যে তৈরি হওয়া হীনমন্যতাবোধটি চারিয়ে গেছে রামধনের ভূতের মধ্যেও! 
‘মহারাজা তারিণীখুড়ো’ গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি অভিশপ্ত পান্না। পান্নাটি কেনার পর থেকেই মন্দোরের রাজা শত্রুঘ্ন সিংয়ের মাথাটি যায় খারাপ হয়ে, শেষমেশ তিনি আত্মহত্যা করেন। তাঁর ছেলে গুলাব সিংও একইভাবে পাগল হয়ে গেছেন। অথচ স্টেটের অবস্থা সুবিধের নয়। এক মার্কিন ধনকুবেরকে রাজকীয় সংগ্রহশালা থেকে কিছু জিনিস বেচলে খানিক সুরাহা হতে পারে। খরিদ্দার আসছেন অথচ রাজার মাথার ঠিক নেই। এমতাবস্থায় রাজবাড়ির দেওয়ান বিজ্ঞাপন দিয়ে ধরে আনলেন রাজার মতো দেখতে আরেকজন মানুষ। মানুষটি আর কেউ নয়, আমাদের চেনা তারিণীখুড়ো! খুড়োকে তালিম দিয়ে সাজানো হল রাজা। একরাতে দেখা দিলেন শত্রুঘ্ন সিংয়ের প্রেতাত্মা। প্রেতাত্মার কথামতো অভিশপ্ত পান্নাটি বেচে দেওয়া হল সেই মার্কিন ধনকুবেরকে। অশুভ পান্না বিদেয় হতেই আসল রাজা গুলাব সিং সুস্থ হয়ে উঠলেন। 
 
‘কাগতাড়ুয়া’ গল্পে পুরনো চাকর অভিরামের প্রেতাত্মা তার মনিবকে স্বপ্নে দেখা দিয়েছে। ঘড়ি চুরির মিথ্যে দোষ চাপিয়ে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে তার মনিবকে জানিয়ে দেয়, নতুন চাকর ভাল করে ঝাড়ু দেয় না বলে দেখা যায়নি ঘড়িটা আসলে আলমারির তলাতেই আছে। 
 
‘নরিস সাহেবের বাংলো’ গল্পে আবারও বাঙালির উৎকট সাহেবপ্রীতির পরিচয় পাই। নরেশ হালদার চেয়েছিল সাহেব হতে। জন্মসূত্রে পাওয়া ফরসা গায়ের রঙ, লালচে চুল, নীল চোখ। মিশনারি স্কুলে সে শিখেছিল সঠিক অ্যাকসেন্টে ইংরেজি ভাষা। এভাবেই নরেশ হালদার থেকে নরিসসাহেবের জন্ম। তবু সে ধরা পড়ে যায় একদিন। সকলের সামনে নেটিভ বলে লাথি মেরে তাকে বার করে দেওয়া হয় ইউরোপীয়ান ক্লাব থেকে। অপমানে, দুঃখে নরেশ আত্মহত্যা করে। বহুবছর পর তারিণীখুড়োর প্ল্যানচেটে এসে ভূতটি বাংলায় কথা বলে। নরেশ হালদার বোঝে সাহেব সেজে সে কী ভুল করেছিল!
 
‘কুটুম-কাটাম’ গল্পে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমানো গাছের ডালের পুতুলের প্রসঙ্গ এসেছে। দিলীপ কুড়িয়ে পেয়েছে চতুষ্পদ জানোয়ারের মতো দেখতে একটা গাছের ডালের অংশ। সেটা রাত হলেই ছটফট করে। দিলীপ জানতো না ওই জিনিসটির যমজ ডাল আরও একটি আছে। সেটিকে খুঁজে এনে পাশাপাশি রাখতেই ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানা থেমে যায়। 
 
‘টেলিফোন’ গল্পে বাবা গণপতি সোম, ছেলে শ্রীপতি সোম মারা গেছে রোড অ্যাকসিডেন্টে। ইহজীবনে বাকি রেখে যাওয়া এক গুরূত্বপূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে চেয়েছে এই দুই বাবা-ছেলের ভূত। ছেলে শ্রীপতি সোম কুসঙ্গে পড়ে জুয়ার নেশায় সর্বস্ব হারিয়ে প্রচুর ধারদেনা করে বসে। বন্ধু অরূপ নিজের বাড়ি থেকে একটা দামী আংটি চুরি করে শ্রীপতিকে দেয় দেনা মেটানোর জন্য। আংটিটা শ্রীপতির এত ভালো লেগে যায়, সে কিছুতেই ওটা হাতছাড়া করতে পারে না। বাবা গণপতি সোম ছেলের অবস্থা জানতে পেরে দেনাশোধের ব্যবস্থা করেন। শ্রীপতির ভূত এখন বন্ধুর আংটি বন্ধুকে ফিরিয়ে দিতে চায়। বাবা গণপতির ভূত টেলিফোনে অরূপের বাবা বীরেশবাবুর সঙ্গে কথা বলতে থাকে, শ্রীপতির ভূত সে ফাঁকে আংটি রেখে আসে পাশের ঘরে। 
 
‘অভিরাম’ গল্পে চাকর অভিরামের ঝুলিতে আছে রাশি রাশি গল্প। কিন্তু মনিব শঙ্করবাবুর ভূতে ভারী ভয়, তাই ভূতের গল্প অভিরামের আর বলা হয়ে ওঠে না। অভিরাম একদিন মারা গেল। অভিরামের ভূত মায়া কাটাতে পারেনি পুরনো মনিবের। সে ফিরে এসেছে মনিবের বাড়ি। মনিবটিরও যে অভিরাম ছাড়া চলে না। অভিরাম না থাকলে কে শোনাবে তাঁকে নিত্যনতুন গল্প? অভিরামের বদলি গোমড়ামুখো চাকরটিকে তাঁর মোটেই পোষাচ্ছে না! শোওয়ার ঘরের বাইরে হঠাৎ পান অভিরামের গলার শব্দ। অভিরাম জানে তার মনিবটি ভারী ভূতকাতুরে। সে সাবধান করে দেয়, মনিব যেন দরজা না খোলে, কারণ দরজা খুললে অভিরামকে দেখা যাবে না। অভিরাম যে ভূত! এদিকে অভিরাম ভূত হয়েছে জেনে শঙ্করবাবুরও আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেছে। আর তাঁর ভয়ডর নেই। এইবার তিনি বাকি মরণটুকু ভূতের গল্প শুনে কাটাতে চান। 
 
আকরগ্রন্থ :
গল্প ১০১, সত্যজিৎ রায়, প্রথম সংস্করণ মে ২০০১, দ্বাদশ মুদ্রণ মার্চ ২০১৭, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা
 
সহায়ক গ্রন্থ :
১) ‘আমাদের কথা’, বিজয়া রায়, প্রথম সংস্করণ মে ২০০৮, নবম মুদ্রণ এপ্রিল ২০১৭, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৪৪৩
২) ‘আমাদের কথা’, বিজয়া রায়, প্রথম সংস্করণ মে ২০০৮, নবম মুদ্রণ এপ্রিল ২০১৭, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৭২
৩) ‘আমাদের কথা’, বিজয়া রায়, প্রথম সংস্করণ মে ২০০৮, নবম মুদ্রণ এপ্রিল ২০১৭, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১০৮
৪) ‘সুকুমার সমগ্র’, সুকুমার রায়, দে’জ, দ্বাদশ সংস্করণ, সেপ্টেম্বর ২০১৮, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৮
৫) ‘সুকুমার সমগ্র’, সুকুমার রায়, দে’জ, দ্বাদশ সংস্করণ, সেপ্টেম্বর ২০১৮, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৪
৬) 'Metamorphosis', Franz Kafka, Translated by David Wyllie, Fingerprint classics, Reprint 2020, ISBN : 9788172345136