চায়ের আসরে রবীন্দ্রনাথ

১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ চীন ভ্রমণে যান। তার আগেই ১৯২১ সালে সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চীন দেশের তরুণ ও যুবকদের মধ্যে তা নিয়ে বিপুল উন্মাদনা। তার আগেই ১৯১৩ সালে সাহিত্যে এশিয়া থেকে প্রথম নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। সমসাময়িক চীনে তিনি তেমন জনপ্রিয়তা পেলেন না। চীন ভ্রমণ নিয়ে তিনি উল্লেখযোগ্য কিছু রচনাও করেন নি। কিন্তু ফিরে এসে শুরু করলেন চা-চক্র। চীন ভ্রমণে তার দোভাষী হিসেবে কাজ করতেন সু-সী-মো। তার নামেই শান্তিনিকেতনে শুরু হল “সুসীম চা চক্র”। এ প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে প্রাচ্যদেশে চীনদেশ থেকেই চা-পানের ইতিহাসের সূচনা ঘটে। কথিত আছে চা গাছের পাতা কোনোভাবে এক চিনা সম্রাটের গরম পানীয় জলে পড়ে যায়। ফলে জলের রঙ আর স্বাদ বদলে যায়। সেই পাতার নির্যাস মিশ্রিত জল পান করে তিনি উদ্যম অনুভব করেন। সেই থেকে চা চাষ এবং চা পানের ব্যাপক প্রসার শুরু হয়। চীন দেশে সবাই একসাথে চা খাওয়ার জন্য ছোট ছোট ঘর বা ‘'চাগুয়ান” প্রচলিত ছিল। উত্তর চিনের বেইজিং এবং তিয়ানজিনে একে চা প্যাভিলিয়ন বা “চ্যাটিং” বলা হয়। চীন ভ্রমণ শেষে দেশে ফেরার সময় রবীন্দ্রনাথ নানা ধরনের চীনামাটির কাপ, বাটি, কেটলি, বিভিন্ন রকমের চা নিয়ে এসেছিলেন। চীন ও জাপানের চা-অনুষ্ঠানে অনুপ্রানিত হয়েই শুরু হয় সুসীম চা চক্র। শান্তিনিকেতন পত্রিকায় এ বিষয়ে  লেখা হয়েছিল, ‘পূজনীয় গুরুদেব প্রথমে এই চক্রের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন।

প্রথমত, ইহা আশ্রমের কর্মী ও অধ্যাপকগণের অবসরসময়ে একটি মিলন ক্ষেত্রের মত হইবে – যেখানে সকলে একত্র  হইয়া আলাপ-আলোচনায় পরস্পরের যোগসূত্র দৃঢ় করিতে পারিবেন।
দ্বিতীয়ত, চিন দেশের চা-পান একটি আর্টের মধ্যে গণ্য। সেখানে আমাদের দেশের মতো যেমন-তেমন ভাবে সম্পন্ন হয় না। তিনি আশা করেন, চিনের এই দৃষ্টান্ত আমাদের ব্যবহারের মধ্যে একটি সৌষ্ঠব ও সুসঙ্গতি দান করবে। ২২ শ্রাবণ, ১৩৩১ সালে, বর্তমান পাঠভবন অফিসের একতলায় বিদ্যাভবনের লম্বা হল ঘরে চা চক্রের উদবোধন উপলক্ষে ওই দিনেই রবীন্দ্রনাথ একটি গান রচনা করেন এবং দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে সমবেত কণ্ঠে সেটি গাওয়া হয়।’প্রহাসিনী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত এই গানটি পরে লিপটন কোম্পানির চায়ের বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হয়েছিল।

“হায় হায় হায় দিন চলি যায়।

চা-স্পৃহ চঞ্চল  চাতকদল চল’  চল’ চল’  হে।।      

টগ'বগ'-উচ্ছল   কাথলিতল-জল   কল'কল'হে।

এল     চীনগগন হতে   পূর্বপবনস্রোতে   শ্যামলরসধরপুঞ্জ॥

শ্রাবণবাসরে   রস ঝর'ঝর' ঝরে,   ভুঞ্জ হে ভুঞ্জ   দলবল হে।

এস'     পুঁথিপরিচারক   তদ্ধিতকারক   তারক তুমি কাণ্ডারী।

এস'     গণিতধুরন্ধর   কাব্যপুরন্দর   ভূবিবরণভাণ্ডারী।

এস'     বিশ্বভারনত   শুষ্করুটিনপথ-   মরুপরিচারণক্লান্ত।

এস'     হিসাবপত্তরত্রস্ত   তহবিল-মিল-ভুল-গ্রস্ত   লোচনপ্রান্ত-   ছল'ছল' হে।

এস'     গীতিবীথিচর   তম্বুরকরধর   তানতালতলমগ্ন।

এস'     চিত্রী চট'পট'   ফেলি তুলিকপট   রেখাবর্ণবিলগ্ন।

এস'     কন্‌স্‌টিট্যুশন-   নিয়মবিভূষণ   তর্কে অপরিশ্রান্ত।

এস'     কমিটিপলাতক   বিধানঘাতক   এস' দিগভ্রান্ত   টল'মল' হে॥

“রবীন্দ্রসঙ্গীত : কাব্য ও সুর” বইটিতে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বীরেন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন,

 “...... নূতন ঘর উঠলে দিনেন্দ্র স্মরণে এবং দিনান্ত মিলনে নাম হল ‘দিনান্তিকা’। এই আসর উপলক্ষে রচিত হয় ‘হায় হায় হায়   দিন চলি যায়, চা-স্পৃহ চঞ্চল চাতকদল চল চল হে’। এই গানের মধ্যে তদানীন্তন আশ্রম কর্মীদের প্রচ্ছন্ন চিত্র রচনা করা হয়েছে --- যাঁরা জানেন তাঁরা ঠিক ধরতে পারেন।” শাস্ত্রজ্ঞ, শিল্পী,গণিতবিদ, হিসাবপটু, নিয়মরক্ষক, সঙ্গীতজ্ঞ সবাইকে এক আসরে বসাতে চায়ে রবীন্দ্রনাথের অসীম ভরসা ছিল। এই সভার “চক্রবর্তী” পদে আসীন ছিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দীর্ঘদেহী, ভোজনরসিক, আড্ডাপ্রেমী দিনু ঠাকুরের সাথে অধ্যাপকদের আড্ডায় একদিন “চক্রেশ্বর” রবীন্দ্রনাথ চাতক কবিতা পাঠ করেন।

কলকাতার বনেদী শ্রেষ্ঠী পরিবারের সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন পালন তার প্রাক-যৌবনে শুরু হয়। ব্রাক্ষ্মসমাজের পুরোধা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অনাড়ম্বর জীবন যাপনে বিশ্বাসী ছিলেন। শৈশবে মাতৃহীন তার চতুর্দশতম সন্তান রবির জীবনের অনেকটাই দাদা-বৌদি, দিদিদের তত্ত্বাবধানে কেটেছে। ২৫শে বৈশাখে রবির জন্মদিন পালন নিয়ে কোনো স্মৃতিচিত্র পাওয়া যায় না। তাঁর মেজদাদা প্রথম ভারতীয় আইসিএস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুবাদে তার স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর ইউরোপের সভ্যতার সাথে পরিচয় ঘটে। তিনিই প্রথম তার সন্তান বিবি আর সুরেনের জন্মদিন পালনের মাধ্যমে ঠাকুরবাড়িতে জন্মদিন পালনের  সূচনা করেন। ১৮৮৭ সালের ৭ই মে, শনিবার রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নি সরলা (স্বর্ণকুমারী দেবী ও জানকীনাথ ঘোষালের কন্যা) ভোরবেলা তার দাদা জ্যোৎস্নানাথকে সঙ্গে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর “বির্জি তলাও” এর বাড়িতে যেখানে রবীন্দ্রনাথ তখন থাকতেন। বাড়ির বকুল ফুল দিয়ে  নিজের হাতে গাঁথলেন মালা আর পথে কিনলেন  কয়েক ছড়া বেল ফুলের মালা আর তার সাথে উপহারের ঝুলিতে ছিল একজোড়া ধুতি-চাদর এবং একটি কবিতার বই “The Poems of Heine”। নিঃশব্দে ৪৯ নং পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে ঢুকে রবীন্দ্রনাথের ঘরে পৌঁছে ঘুমন্ত রবীন্দ্রনাথকে জাগিয়ে ফুল মালা ধুতি চাদর - এই নৈবেদ্য তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করলেন। জ্যোৎস্নানাথ রবিমামাকে প্রণাম করে কবিতার বইটি উপহার দিলেন। বাড়িতে সাড়া পরে গেল। একে একে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও বেরিয়ে এসে রবীন্দ্রনাথকে জন্মদিনের আশীর্বাদ, শুভেচ্ছা, প্রণাম জানালেন। এই ঘটনার ঠিক ৫০ বছর পরে ১৯৩৭ সাল থেকে  শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালনের এক নতুন ধারার সূত্রপাত হলো। কবির বয়স, শারীরিক অসুস্থতা ছাড়াও বীরভূমের প্রখর দাবদাহ, জল সংকট ইত্যাদি সমস্যার জন্য ২৫শে বৈশাখের পরিবর্তে পয়লা বৈশাখে নববর্ষের অনুষ্ঠানের পরেই কবির জন্মদিন উদযাপন শুরু হলো। ১৯৩৯ সালের এমনি এক পয়লা বৈশাখের বিকেল বেলায় দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মরণে ‘“দিনান্তিকা” চা চক্রের উদবোধন করেন রবীন্দ্রনাথ। দিনান্তিকা বাড়িটি একটি অষ্টকোণাকার দোতলা বাড়ি যা দিনের শেষে সমবেত চা পানের (বা চা-চক্র যাকে কবি বলেছিলেন ‘চাক্র’) ক্ষেত্র।দিনান্তিকার নকশাকার ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভাইপো দিনু ঠাকুরের স্ত্রী কমলাদেবী।অষ্টকোণাকার বৌদ্ধ স্তুপের আদলে নির্মিত, বাইরের দিকে ঘোরানো সিঁড়ি বিশিষ্ট বাড়িটির দেয়ালে ও ছাদে শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু অনুপম  ফ্রেস্কো এঁকেছিলেন।

শান্তিনিকেতনের ইতিহাসে এবং রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনে চা-পান, চায়ের আসর, চায়ের আডডা এসব বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ।

রবীন্দ্রানুরাগী অমল হোমের লেখায় এমনি এক দিনের চায়ের আড্ডার কথা লেখা আছে। তিনি লিখছেন, “দীনেন্দ্রনাথের বেণুকুঞ্জে গানে গল্পে আড্ডা জমিয়েছি কালীদাস নাগ আর আমি। বৈকালিক চা-পর্ব সবে শেষ হয়েছে, দিক-দিগন্ত ধুলোয় ঢেকে ছুটে এল ঝড়। আমরা দেখছি দাঁড়িয়ে বারান্দায়। হঠাৎ দিনদা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ওই দ্যাখো রবিকা আসছেন!’ দেখি সেই ঝড়ের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ছুটে আসছেন। তাঁর বেশবাস, তাঁর শ্মশ্রুকেশ উড়ছে। জোব্বাটাকে চেপে ধরেছেন বাঁ হাতে আর ডান হাতে চেপে ধরেছেন চোখের চশমাটা। আর একটু এগিয়ে আসতেই শুনতে পেলাম গলা ছেড়ে তিনি গাইছেন। মেঘমন্দ্রের সঙ্গে তাঁর কণ্ঠ উঠছে গর্জে– ‘যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি।’ বারান্দাতে উঠেই বললেন, ‘দিনু এই নে।’ ঘরে এসে বসে পড়লেন দীনেন্দ্রনাথের ফরাসে। তারপর নামল বৃষ্টি মুষলধারে। আর নামল অজস্রধারায় কবির ও দীনেন্দ্রনাথের গান। সেদিন খুলে গিয়েছিল কবির কণ্ঠ।”

রানী চন্দ লিখেছেন ‘গুরুদেব’ ‘চীনে চা’ খেতে ভালোবাসতেন। তবে তাঁর চায়ে দুধ ও চিনির আধিক্য থাকত, যা চিনা ও জাপানি চায়ের রীতির থেকে একেবারেই আলাদা। তাঁর পানীয় ছিল গরম জলে চিনিসমেত দুধ যার মধ্যে দু’একটি শুকনো বেল বা জুঁইয়ের সুগন্ধি চায়ের পাতা।তাঁর নিজস্ব ভৃত্য বনমালীকে চা বানানোর ভার তিনি দিয়েছিলেন। আধ গ্লাস গরমজলে কয়েকটি চা-পাতা ভিজিয়ে রাখা হত। কিছু সময়ের অপেক্ষার পর চায়ের লিকারের সমপরিমাণ দুধ ও চিনি মিশিয়ে তাঁর চা প্রস্তুত করা হত।”চা-কর” বনমালীর কাজ ছিল সকাল ৭টায় প্রাতরাশের পর ন'টা অব্দি তিনি যখন টানা লিখতেন,তখন দফায় দফায় চায়ের যোগান দেয়া।শুধু কবিকেই নয় শান্তিনিকেতনে আগত কবির বিশেষ বন্ধুদের পরম যত্নে চায়ের সরঞ্জাম সহ চা পরিবেশন করা হত।বনফুল লিখেছেন,তার প্রাতরাশে  ফুলকো লুচি, আলুর ছেঁচকি, গরম শিঙাড়া, কচুরি, সন্দেশ,কেক, বিস্কুট, আপেল, কলার সঙ্গে চায়ের সরঞ্জাম সাজানো ছিল।সেবারেই রবীন্দ্রনাথ বনফুলকে বিকেলে দেখা করতে বললেন। রবীন্দ্রনাথ বনফুলকে বলছেন, ‘যাই হোক, বিকেলে কিন্তু চা খাবে। তোমার লেখা পড়ে মনে হয় তুমি ঝাল খেতে ভালোবাস। বিকেলে বড় বড় কাবলে মটরের ঘুগনি করলে কেমন হয়? ঘুগনির মাঝখানে একটা লাল লঙ্কা গোঁজা থাকবে। কী বল?’ খাদ্যরসিক ও রন্ধনপটু বনফুল ‘বেশ তো’ বলে সায় দিয়েছিলেন।দীনু ঠাকুরের বাড়িতে এমনি আরেক  চায়ের নিমন্ত্রণের কথা   লীলা মজুমদার লিখেছেন।সুগন্ধী দার্জিলিঙ চা সেই আসরে পরিবেশন করা হয়েছিল এবং ‘’গুরুদেব’’ তা উপভোগ করেছিলেন।উজ্জ্বল সােনালি রঙের দেশী চায়ের তিনি প্রশংসা করতেন।চিন দেশ থেকে আনা শুকনাে বেল, যুঁই-এর চা তাঁর খুব পছন্দ ছিল। গরম জল পড়লেই শুকনাে ফুলের পাপড়িগুলাে খুলে যেত। একবার তাঁর কাছে চিন দেশ থেকে এল গ্রিন টি। সেই চায়ের পাতার ওপর গরম জল ঢাললে চায়ের রঙ হত ফিকে হলুদ। সেই চা খুব পছন্দ হয়েছিল।

শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, ঠাকুরবাড়িতে চায়ের ইতিহাস অতি প্রাচীন।

চিনের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য এবং সস্তায় চা উৎপাদনের জন্য ওয়ারেন হেস্টিং ১৭৭৪ সালে ভুটানে চীন থেকে চা গাছ এনে ওয়ারেন হেস্টিংস চা চাষের চেষ্টা করেন।পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের চা রপ্তানির প্রয়োজনে আসামের চা বাগানে চা-উৎপাদন  সফল হলো । ১৮৩৪ সালে বড়রাট লর্ড বেন্টিং ভারতীয়দের  চায়ের ব্যবসার অনুমোদন দিলেন  এবং রবীন্দ্রনাথের পিতামহ উদ্যোগপতি  প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর চা ব্যবসায়  বিনিয়োগের মাধ্যমে  শিল্পের প্রযুক্তিগত এই ব্যবসাকে স্বাগত জানালেন।

প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ১৮৩৯ সালে গড়ে উঠল “দ্য বেঙ্গল টি অ্যাসোসিয়েশন এবং পরে ১৮৮১ সালে কলকাতায় স্থাপিত হয় “ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন “।১৯২০ সাল নাগাদ ভারতের পাকাপাকিভাবে চায়ের সফল ও ব্যাপক   ব্যবসা শুরু হয়। চা পানে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার নানাভাবে বিজ্ঞাপনে তাদের প্রলুব্ধ করতে থাকেন।এমনকি বিনা পয়সায় তখন যোগাযোগের অন্যতম  মাধ্যম জলপথের লঞ্চঘাট এবং ফেরিঘাটে বিনামূল্যে চা খাওয়ানো হতো খাওয়ানো হতো। চায়ের প্রতি ভারতীয়দের এক বড় অংশের প্রবল বিরাম এবং সন্দেহ ছিল।মহাত্মা গান্ধী বিরোধিতা করে বলেছিলেন যে চীনে পানীয় জল পরিশ্রুত করার জন্য হয়তো এসব পাতা ব্যবহার করা হয়। ভারতে এর কোনো প্রয়োজন নেই।উষ্ণ পানীয়ের দরকার হলে গরম জলে দুধ চিনি গুলে খেলেই তো হয়!  বাঙালি বিজ্ঞানী  আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় চায়ের উপর বিরক্ত ছিলেন। অজীর্ণ ও অম্ল রোগের মূল এই  পানীয়টিকে তিনি বিষপানের সমান মনে করতেন। মজার বিষয় এই যে

সস্ত্রীক মহাত্মা গান্ধী যখন শান্তিনিকেতনে আসেন তখন কালোর দোকানের চা খাইয়ে রবীন্দ্রনাথ আতিথেয়তা রক্ষা করেছিলেন।

কালিপদ দলুই ওরফে কালো ১৯১৮ সালে আশ্রমের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে একটি চায়ের দোকান খোলেন। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন মজলিশে ‘’লিকার চা’’ এই দোকান থেকে যেত।উনুন,মাটির জালা,কাঠের বেঞ্চি,কেটলি-মগ-কাচের গেলাসের এই কালোর দোকানে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর,নন্দলাল বসু,রামকিঙ্কর বেইজ  নিয়মিত চায়ের খদ্দের ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ তার দীর্ঘ জীবনে দৈ,ঘি,মিষ্টি, কালি,হেলথ ড্রিংক ইত্যাদির পাশাপাশি লিপটন কোম্পানির জন্য চায়ের বিজ্ঞাপনের কপি লিখে দিয়েছিলেন

“চা-স্পৃহ চঞ্চল

চাতকদল চল

কাতলি-জল তল, কলকল হে”

এই বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতেই দেশজুড়ে সবাই জানল  রবীন্দ্রনাথ একজন বিশিষ্ট চা-প্রেমী। এরপর এলিট থেকে লোয়ার মিডল ক্লাস, সবশ্রেণির মানুষের তৃষ্ণা লিপ্টন চায়ে মিটতে শুরু করল।  বস্তুত, কবিগুরুর লেখায় দেশবাসী চা-পানে আস্থা পেল।

 জাপানে চা-অনুষ্ঠানের নিষ্ঠা ও সৌন্দর্য দেখে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন। জাপান ভ্রমণের সময় ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ এক ধনী ব্যক্তির বাড়িতে চা-পান অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পান। চা-পান অনুষ্ঠান জাপানের একটি বিশেষ রীতি, যেটিকে জাপানীরা প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সানন্দে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। চায়ের ঘরে প্রবেশের পূর্বে অতিথিদের সেখানে একটি বারান্দাতে বসানো হয়। চায়ের ঘর সাধারণত শৈল্পিক স্পর্শে সমৃদ্ধ। একটি সাধারণ মানের অট্টালিকার চেয়েও চা-ঘর তৈরীর খরচ বেশি। এ ব্যাপারে পরিচ্ছন্নতাই সবার আগে  বিবেচ্য। সেই চায়ের অনুষ্ঠান রবীন্দ্রনাথকে এতই মোহিত করেছিল যে তিনি তাঁর বিস্তৃত বিবরণ লিখেছেন ২২ জৈষ্ঠের লেখায়, তার পরে গৃহস্বামী এসে বললেন, চা তৈরি এবং পরিবেশনের ভার বিশেষ কারণে তিনি তাঁর মেয়ের উপরে দিয়েছেন। মেয়ে এসে নমস্কার করে চা তৈরিতে প্রবৃত্ত হলেন। তার প্রবেশ থেকে আরম্ভ করে চা তৈরির প্রত্যেক অঙ্গ যেন কবিতার ছন্দের মত । ধোয়া মোছা, আগুনজ্বালা, চা-দানির ঢাকনা খোলা, গরম জলের পাত্র নামানো, পেয়ালায় চা ঢালা, অতিথির সম্মুখে এগিয়ে দেওয়া, সমস্ত এমন সংযম এবং সৌন্দর্য মণ্ডিত যে, সে না দেখলে বোঝা যায় না।’

একবার জাপান থেকে শান্তিনিকেতনে আগত অতিথি দম্পতি শুরুদেবকে শ্রদ্ধা জানাতে জাপানি প্রথায় ‘টি সেরিমনি’র আয়োজন করেছিলেন। সেদিন অতিথি ভদ্রমহিলা উত্তরায়ণের লাল বারান্দাতে  নিজে হাতে জাপানি প্রথায় চা তৈরি করে সকলকে পরিবেশন করেছিলেন। শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে কবির কোণার্ক বাড়ির এই লাল বারান্দাটি ছিল চায়ের আসরের জন্য বিখ্যাত। বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য প্রায়ই এখানে চায়ের টেবিলের বন্দোবস্ত করা হত। জওহরলাল নেহেরু সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে এসে এই বাড়িটিতেই থেকেছিলেন।তখন  লাল বারান্দাতেই বসত চায়ের আসর।

ইংল্যান্ডের ইতিহাসে গোলাপের যুদ্ধের কাহিনী যেমন কুসুমাস্তীর্ণ নয়, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে বচ্চনের চায়ের মজলিস যেমন কোনো মনোরম আড্ডার কাহিনী শোনায় না মধ্য বয়সে তেমনি রবীন্দ্রনাথের জীবনে চা পরিণত বয়সের এক রহস্যময় চায়ের মজলিসের কথা জানা যায়। সে মজলিশের উদ্যোক্তা আশা করেছিলেন যে আমন্ত্রিত অতিথিদের গানে গল্পে আড্ডায়  কিছু সম্পর্কের ইতিবাচক রূপায়ণ  হবে। কিন্তু বাস্তবে হল তার বিপরীত।

জাপানের নবজাগরণের পথিকৃৎ ওকাকুরা কাকুজো যিনি “The book of Tea” লিখে সারা বিশ্বে চা-পানের ইতিহাস নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন। তার এই ভারতে আগমনের দুটি উদ্দেশ্য ছিল।  প্রথম উদ্দেশ্য ছিল ভারতের বৌদ্ধ তীর্থসমূহ ঘুরে দেখা এবং আমেরিকার বিশ্বধর্ম সম্মেলনে থেকে প্রত্যাগত জনপ্রিয় তরুণ সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের সাক্ষাৎ লাভ। এদেশে এসে কয়েকজন তরুণ দেশব্রতী  এবং স্বামী বিবেকানন্দের আইরিশ শিষ্যা ভগিনী  নিবেদিতার সাথে তার পরিচয় হয়। রবীন্দ্রনাথ তার বিজ্ঞানী বন্ধু আরেক বন্ধু জগদীশ চন্দ্র বসুর সূত্রে নিবেদিতার সাথে পরিচিত ছিলেন। এবারে নিবেদিতার সূত্রে ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচিত হলেন। নিবেদিতা এদেশে বরাবরই সমসাময়িক মনীষার সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। স্বামী বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ পরস্পর পূর্ব পরিচিত হলেও মতাদর্শ এবং তার প্রয়োগ জনিত পার্থক্যের কারণে  তাদের মধ্যে কোন সাকার যোগাযোগের সেতু ছিল না। যুবক নরেন্দ্রনাথ ব্রাক্ষ্মসমাজে নিয়মিত যাতায়াত করতেন এবং সেইসূত্রে রবীন্দ্রনাথের লেখা গানে তিনি পারদর্শী হয়েছিলেন। বৈষ্ণবচরণ বসাক ও তাঁর সংকলিত “সংগীতকল্পতরু” গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের গান স্থান পেয়েছিল। বলরাম বসুর বাগবাজারের বাড়িতে তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণকে তিনি যুবক রবীন্দ্রনাথের লেখা গান “তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা” গেয়ে শুনিয়েছিলেন।  নিবেদিতা বিশ্বাস করতেন ব্রাহ্মসমাজের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ও সেতু-বন্ধন ছাড়া রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্দেশ্য অসম্পূর্ণ থাকবে। রবীন্দ্রনাথ সে সময় আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক।

স্বামী বিবেকানন্দের ইচ্ছায় ও নিবেদিতার আগ্রহে

ভারতের বিশ্বনন্দিত সমসাময়িক দুই প্রবাদপুরুষ বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের মানসিক ব্যবধান কমিয়ে আনতে বিবেকানন্দ-শিষ্যা ভারতপ্রেমিক ভগিনী নিবেদিতা প্রয়াসী হয়েছিলেন। যদিও নিজ নিজ মতবাদ ও জীবনবোধে অনড় এই দুই প্রতিভার মনোভাব পরস্পরের প্রতি ছিল যথেষ্ট শীতল।

১৮৯৯ সালের ২৮শে জানুয়ারি নিবেদিতা স্বামীজির আগ্রহে বাগবাজারে ১৬ বোসপাড়া লেনে তাঁর স্কুলবাড়ির খোলা উঠোনে ব্রাহ্ম বন্ধুদের জন্য এক ঘরোয়া চা-চক্রের আয়োজন করেছিলেন। স্বামীজি সেখানে আসবেন এবং কথা বলবেন এটা আগেই ঠিক করা ছিল। সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্র বসু, সস্ত্রীক ড. প্রসন্নকুমার রায়, মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়, সরলা ঘোষাল, তাঁর মা স্বর্ণকুমারীদেবী এবং রবীন্দ্রনাথ যোগ দিয়েছিলেন চা-পানের আসরে। ডা. মহেন্দ্রলাল সরকারকে সঙ্গে নিয়ে যোগ দিলেন স্বামীজি। ঘরোয়া আলাপচারিতার পরিবেশে নিবেদিতা মুখোমুখি আনতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দকে। সেখানে রবীন্দ্রনাথের গাওয়া তিনটি গানের মৃদু সুরের আবহ সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে ১৮৯৯ সালের ৩০ জানুয়ারি নিবেদিতা লেখেন, ‘It was quite a brilliant little gathering, for Mr. Tagore sang 3 of his own compositions in a lovely tenor — and Swami was lovely.” I cannot forget the lovely poem ‘Come O’ Peace’ (এসো শান্তি) – But there were some clouds.’ সেখানে রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়েছিল কি না এ সম্বন্ধে ইতিহাস নিশ্চুপ। কী সেই মেঘাবৃত সত্য? তা চিরকালের মতো অধরাই রয়ে গেল।