স্বদেশ বিদেশে রেলভ্রমণে রবীন্দ্রনাথ

১৯০৭ এর ৭ অঘ্রাণ, কলেরায় আক্রান্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথকে ছেড়ে চলে গেলো তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ। তখন তার বয়েস মাত্র ১১ বছর ১১ মাস। রবীন্দ্রনাথের মতো শোক-তাপ-মৃত্যুঞ্জয় পারেননি, শমীর সৎকার করতে। শুধু পাশের ঘরে নিশ্চল ধ্যানস্থ রইলেন। সৎকারের দায়িত্ব ভাগ করে মুঙ্গের থেকে শান্তিনিকেতনের উদ্দেশে রওনা দিলেন রেলপথে।  

এর প্রায় ২৫ বছর পর, ১৯৩২-এর ২২ শ্রাবণ, রবীন্দ্রনাথের দৌহিত্র নিতীন্দ্রনাথের অকালপ্রয়াণে সন্তান-শোকাতুর কন্যা মীরাদেবীকে রবীন্দ্রনাথ এক সান্ত্বনাপত্রে লিখছেন —    

     “…শমী যে রাত্রে চলে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। মন বললে কম পড়েনি — সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারি মধ্যে! সমস্তর জন্যে আমার কাজও বাকি রইল। যতদিন আছি সেই কাজের ধারা চলতে থাকবে। সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোনোখানে কোনো সূত্র যেন ছিন্ন হয়ে না যায় — যা ঘটেছে তাকে যেন সহজভাবে স্বীকার করি…।”

      শোককে আত্মস্থ করে স্থির-শান্ত থাকার এই ব্রহ্মদর্শন তিনি পেয়েছিলেন পিতা দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে। জগদীশচন্দ্রের স্ত্রী অবলা বসু যাকে বিনম্রতায় বলেছেন “ইহাকেই প্রকৃত ঋষিভাব বলা যায়।” এই ‘ঋষিভাব’ অর্জন তো মহর্ষির কাছ থেকেই। আর মহর্ষিকে, পিতা দেবেন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথ প্রথম নিবিড় করে পেয়েছিলেন পরিবারের চৌহদ্দির বাইরে, তাঁর ভ্রমণ-সঙ্গী হয়ে। তার আগে পর্যন্ত, রবীন্দ্রনাথের বয়ানে বলতে গেলে — “বাল্যকালে তিনি আমার কাছে অপরিচিত ছিলেন বলিলেই হয়।” (‘জীবনস্মৃতি’)।

হিমালয় গিরিপথে চলেছিনু যবে বাল্যকালে

     ঠিক যে-বয়েসে শমীন্দ্রনাথ চলে গেছিল, মুঙ্গের থেকে পিতা রবীন্দ্রনাথ আদরের শমীকে ফিরিয়ে আনতে পারেননি,  ঠিক সেই বয়েসেই পুত্র রবীন্দ্রনাথ মহর্ষির সঙ্গে প্রথম রেলভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বয়েস তখন ১১ বছর ৯ মাস। সেদিনটা ছিল ১৮৭৩-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার। রবীন্দ্রনাথের পৈতের ঠিক ৮ দিন পর। উপনয়নের কারণে ন্যাড়া মাথাটি নিয়ে ইশকুলে যেতে হবে ভেবে রবীন্দ্রনাথ যখন ভয়ানক চিন্তিত, ঠিক সেই সময় তেতলার ঘরে ডেকে দেবেন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে হিমালয় যেতে চান কিনা। “চাই”— এই কথাটি আকাশ ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়েছিল কিশোর রবির। সপিতা রবীন্দ্রনাথের এই পর্বের ভ্রমণের বয়েস ছিল তিন মাস ও কয়েকদিন।

  

পিতা রবীন্দ্রনাথ ও পুত্র রবির জীবনের দুটি ছোটো অথচ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ করা এই কারণে, রবীন্দ্রনাথের জীবনে ভ্রমণ, সৃষ্টি ও জীবনের গতি কীভাবে মিশে গেছে তা বোঝাতে গেলে যে-কথা উল্লেখ করতেই হয়, তা হলো — রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য ভ্রমণ কখনো ছিল প্রয়োজনের তাগিতে, কখনো ছিল মানসমুক্তির জন্য। তবে কবি নিজেই তাঁর যে ভ্রামণিক জীবনের কথা লিখেছেন, তার থেকে এটুকু স্পষ্ট, সেইসব ভ্রমণের উদ্দেশ্য বক্তৃতা, সংবর্ধনা, সমাদর আমন্ত্রণ হলেও, কবির মন কিন্তু জাগরুক থেকেছে সৃষ্টিশীলতায়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি। আবার কোনো কোনো সময়, এক একটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তাঁর লেখার রসদ হয়েছে। ভ্রমণ তাই রবীন্দ্রনাথের লেখার পুষ্টি এবং মুক্তি দুই-ই। এই প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথের আশি বছরের আয়ুষ্কালের মধ্যে দীর্ঘ আটষট্টি বছর ধরে তাঁর স্থলপথে —  স্থলযান, বিশেষ করে রেল ভ্রমণের উপর আলোকপাতের চেষ্টা।

    রবীন্দ্রনাথের রেলে চাপার মাত্র বছর কুড়ি আগে ভারতে রেল চলাচল শুরু হয়। তাই রেলভ্রমণ তখন দেশিয় মানুষের কাছে যেমন ছিল কৌতূহলোদ্দীপক, তেমনই ভয় মেশানো রোমাঞ্চকর। রেলে চড়ার আগেই সদ্য ট্রেনে চাপার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ভাগ্নে সত্যপ্রসাদও কিশোর রবিকে সাবধান করে বলেছিল, বিশেষ দক্ষতা না থাকলে রেলগাড়িতে চড়া ভয়ানক সংকটের। পা ফস্কে গেলে আর রক্ষে নেই। তারপর গাড়ি চলতে আরম্ভ করলে শরীরের সব শক্তি নিয়ে খুব জোর করে বসতে হবে, নাহলে এমন ভয়ংকর ধাক্কা দেয় যে মানুষ কে কোথায় ছিটকে পড়ে তার ঠিকানা পাওয়া যায় না। সত্যপ্রসাদের এই সাবধান বাণী মাথায় রেখে কিছুটা ভয়ে ভয়েই রবির প্রথম ট্রেনে চাপা।

     প্রথম গন্তব্য বোলপুর। “গাড়ি ছুটিয়া চলিল; তরুশ্রেণীর সবুজ-নীল পাড়-দেওয়া বিস্তীর্ণ মাঠ এবং ছায়াচ্ছন্ন গ্রামগুলি রেলগাড়ির দুই ধারে দুই ছবির ঝরনার মতো বেগে ছুটিতে লাগিল যেন মরীচিকার বন্যা বহিয়া চলিয়াছে।” (‘জীবনস্মৃতি’)। সন্ধ্যার সময় তাঁরা বোলপুরে পৌঁছলেন। শহরের ছেলের সেই প্রথম প্রকৃতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয়। এই সময় বোলপুরে বালক রবির কবিত্ব অনুভবও বেশি করে জেগে ওঠে — লেখেন কবিতা ও ‘পৃথ্বীরাজের পরাজয়’ নামে বীররসাত্মক একটি কাব্য। কিন্তু বালক-কৈশোরের মাঝামাঝিতে লেখা এই কাব্যের কোনো হদিশ নেই। 

    এরপর মহর্ষি, রবিকে নিয়ে বোলপুর ছাড়লেন। সেখান থেকে সাহেবগঞ্জ, দানাপুর, এলাহাবাদ, কানপুর হয়ে তাঁরা পৌঁছলেন অমৃতসরে। সেখানে প্রায় প্রতিদিন সকালবেলায় রবীন্দ্রনাথ বাবার সঙ্গে সরোবরের মাঝে শিখদের মন্দিরে (স্বর্ণমন্দিরে) যেতেন। শিখ-উপাসকদের মাঝে বসে দেবেন্দ্রনাথও তাঁদের সঙ্গে ভজনায় যোগ দিতেন। অমৃতসরে মাসখানেক থাকার পর চৈত্র মাসের শেষে তাঁদের ডালহৌসি যাত্রা।

    রবীন্দ্রনাথের প্রথম রেলভ্রমণে অমৃতসর যাওয়ার পথে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা তাঁর মনে চিরকালের আঁকা হয়ে গেছিল। রবীন্দ্রনাথ যেহেতু তখন অনূর্ধ্ব ১২, দেবেন্দ্রনাথ নিয়ম অনুযায়ী হাফ টিকিট কেটেছিলেন ছেলের জন্যে। রবীন্দ্রনাথ ছোটো থেকেই দীর্ঘদেহী, সুন্দর পরিণত স্বাস্থ্যের অধিকারী, তার উপরে ন্যাড়া মাথা ঢাকতে মাথায় জমকালো উঁচু টুপিতে আরো বড়ো দেখাচ্ছে। টিকিট পরীক্ষক এবং স্টেশনমাস্টারের বিশ্বাসই হয়নি বালক রবির তখনও ১২ হয়নি। তারা দেবেন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথের জন্য ফুল টিকিট কাটতে বলে। তাঁকে অবিশ্বাস করায় মহর্ষি অত্যন্ত অসম্মানিত ও অপমানিত বোধ করেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বাক্স থেকে একটা গোটা নোট বের করে দিলেন। টিকিট পরীক্ষক রসিদ কেটে বাকি টাকা ফেরত দিলে মহর্ষি কামরার জানলা দিয়ে সে টাকা প্ল্যাটফর্মে ছুঁড়ে দিলেন। বালক রবির মনে পিতার বলিষ্ঠ চরিত্রের এই যে চিত্র আঁকা হয়ে গেছিল, তা আজীবন অমলিন ছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘অপরিচিতা’ গল্পে ট্রেনের কামরার যাত্রী ও রেলকর্মাচারীর বিরোধের মধ্যে হয়তো সেই বালকবেলায় প্রত্যক্ষ করা ঘটনা কোনোভাবে ছাপ ফেলে থাকতে পারে।

পান্থ তুমি পান্থজনের সখা

                 “তুমি বিনা কে প্রভু সংকট নিবারে

                       কে সহায় ভব অন্ধকারে…”

 বারো পূর্ণ হয়েছে কি দিনকতক দেরি — কিশোর রবি এক মনে বেহাগের সুরে গাইছে ব্রহ্মসংগীত। সামনে আরামকেদারায় নিস্তব্ধ বসে মহর্ষি, মাথা নিচু। কোলের উপর তাঁর দুই হাত জড়ো করা। বারান্দা ভেসে যাচ্ছে চাঁদের আলোয়। ডালহৌসি পাহাড়ের কোলে বক্রোটার ডাকবাংলোয় প্রায় দিন এইভাবে ব্রহ্মসংগীতের মধ্যে দিয়ে সন্ধ্যা নামত। কখনো কখনো ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গেলে রবি দেখত সামনের কাচঘেরা বারান্দায় মোমবাতি হাতে উপাসনায় চলেছেন তার পিতা। বাড়ির ভৃত্যদের শাসনে জর্জরিত রবি প্রথম দীর্ঘযাত্রায় গিয়ে বাবার কাছ থেকে পেয়েছিল এক অপার স্বাধীনতা। কিন্তু এই স্বাধীনতাই ছিল কিশোর রবিকে সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর। বিশ্বপথিক, বিশ্বপরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন ধরে মানসভ্রমণের সঙ্গে বাস্তবেও ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই প্রথম ভ্রমণই “স্মৃতির পটে জীবনের ছবি” এঁকে গেছে।

      জীবণ্নস্মৃতি থেকে জানা যাচ্ছে, এই ভ্রমণে দেবেন্দ্রনাথ কনিষ্ঠ পুত্র রবিকে যেমন স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, তেমনই রেখেছিলেন শৃঙ্খলে। তবে এই শৃঙ্খলা বালক রবির কাছে কখনোই শৃঙ্খল হয়ে ওঠেনি। অর্থের মূল্য বোঝানোর জন্য দেবেন্দ্রনাথ পুত্রকে কিছু টাকা রাখতে দিতেন, মাঝেমধ্যে ক্যাশবাক্সও এবং পরে তার হিসেব নিতেন। সময়নিষ্ঠ করবার   ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে জানা যাচ্ছে, এই ভ্রমণে দেবেন্দ্রনাথ কনিষ্ঠ পুত্রটিকে যেমন স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, তেমনই  জন্যই হোক বা দায়িত্বে দীক্ষিত করবার জন্য, তাঁর সোনার দামি হাতঘড়িতে দম দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন পুত্রকে। ভগবদগীতার চিহ্নিত করা শ্লোকগুলো অনুবাদ করতে দিতেন। সংস্কৃত, বাংলার জ্ঞান পরীক্ষা করতে নানারকম উপায় অবলম্বন করেছিলেন। বাড়ি থেকে আসা চিঠি পড়িয়ে চিঠি লেখা শেখাতেন। পর্বতের স্বচ্ছ আকাশে তারা সুস্পষ্ট হলে দেবেন্দ্রনাথ পুত্রটিকে গ্রহতারকা চিনিয়ে জ্যোতিষ্ক নিয়ে আলোচনা করতেন। সূর্যোদয়কালে উপনিষদের দ্বারা উপাসনা করাতেন।

    এই ভ্রমণ তাই রবীন্দ্রনাথের জীবনে শুধু প্রথম ট্রেনে চাপা নয়, শুধু ভ্রমণ বা ঘোরাঘুরি নয়, এমনকি শুধু মহর্ষি পিতার সঙ্গলাভও নয় — এই ভ্রমণ ছিল জীবনশিক্ষার; এই ভ্রমণ ছিল, ভ্রমণকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তারও শিক্ষা। রবীন্দ্রনাথের জীবনশিক্ষাও এই ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে বিচিত্রপথে ভ্রমণ করেছে।  

    পিতার সঙ্গে ভ্রমণকালে রবীন্দ্রনাথের বারো বছর পূর্ণ হয়েছে। তাঁর দেহ-মন দুই-ই পরিপুষ্ট আগের থেকে। গেছিলেন হাফ টিকিটে, ফিরলেন পূর্ণ টিকিটে। সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের অনুচর কিশোরী চ্যাটার্জী। যাবার পথের অপ্রীতিকর ঘটনা, ফেরবার পথে “রেলের পথেই আমার ভাগ্যে আদর শুরু হইল।… পথে যেখানে যত সাহেব মেম গাড়িতে উঠিত আমাকে নাড়াচাড়া না করিয়া ছাড়িত না।” (‘জীবনস্মৃতি’)। এই ভ্রমণ রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক জীবনেও অনেক পরিবর্তন এনেছে। যেমন, অন্তঃপুরের বাধা ঘুচে যায়, মায়ের ঘরের সভায় একটা বড়ো আসন দখল করে কিশোর রবি। সব থেকে উল্লেখযোগ্য, তখন বাড়ির যিনি কনিষ্ঠ বধূ ছিলেন, তার কাছ থেকে তিনি প্রচুর স্নেহ ও আদর পেলেন। অর্থাৎ বালক রবি যা পায়নি, কৈশোরে পৌঁছে সমবয়সী বৌঠানের কাছে একটা আলাদা মনোযোগ পেলেন। সেই হয়তো সখ্যের শুরু।

      ১৮৭৮-র মে (১২৮৫-র ২ জ্যৈষ্ঠ), মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্র আমেদাবাদ যাত্রা করলেন — পশ্চিম ভারত যাত্রা। উদ্দেশ্য ভাইকে ইংরেজি ভাষা ও বিলেতি আদব-কায়দা শেখানো। তবে এই রেলভ্রমণের কোনো বর্ণনা নেই। কিন্তু এই ভ্রমণের একটা ‘ইমপ্যাক্ট’ তাঁর ‘করুণা’ উপন্যাসে নানাদিক থেকে পড়েছে। ‘করুণা’ উপন্যাসটি ১২৮৪ আশ্বিন থেকে ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব পত্রিকা ‘ভারতী’তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। এই উপন্যাসে ট্রেন, প্যাটফর্মে অনেক ছোটো-বড়ো ঘটনার উল্লেখ আছে। আমেদাবাদ ও বোম্বাইয়ে (বর্তমান মুম্বাই) ছয় মাস মতো কাটান রবীন্দ্রনাথ।

এবার আমায় ডাকলে দূরে

  সাগর পারের গোপন পুরে

      রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিলেতযাত্রা করেন ১৮৭৮-এর ২০ সেপ্টেম্বর (১২৮৫-র ৫ আশ্বিন)। ‘পুনা’ জাহাজে। সঙ্গে মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, পুত্র সুরেন্দ্রনাথ এবং কন্যা ইন্দিরা তখন লণ্ডনেই। সুয়েজ থেকে সারারাত রেলভ্রমণের পর রবীন্দ্রনাথ আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছান। প্রথম বিলেত যাত্রার নানা অভিজ্ঞতাসঞ্জাত বিবরণ প্রকাশিত হয় ‘ভারতী’তে। “সুয়েজে আমরা রেলোয় উঠলাম। এ রেলগাড়ির অনেক প্রকার রোগ আছে। প্রথমতঃ শোবার কোনো বন্দোবস্ত নেই, … দ্বিতীয়তঃ এমন গজগামিনী রেলগাড়ি সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায় না। সমস্ত রাত্রিই গাড়ি চলেছে;…। (‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’)।

     কয়েকদিন পর ইটালির ব্রিন্দিশি থেকে বিকেল তিনটের সময় কবি ট্রেনে উঠলেন। আঙুর খেতের ভিতর দিয়ে ট্রেনের যাত্রাপথ। পরের দিন সকালে প্যারিস পৌঁছলেন। এই যাত্রাপথ ছিল প্রায় ষোলো-সতেরো ঘন্টার। বিন্দ্রিশি থেকে প্যারিস যাবার পথে আলপস পর্বতমালার বিখ্যাত Mont Cenis–এর টানেল অতিক্রম করতে হয়েছিল, সময় লেগেছিল পাক্কা আধ ঘন্টা। এই টানেল কীভবে তৈরি হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ সেটা জেনে নিয়েছিলেন, এবং পরে সেটা বঙ্গভারতীর পাঠকদের জন্য লিখেওছিলেন। লিখেছিলেন রেলভ্রমণের নানা কথন — “ইটালি থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত সমস্ত রাস্তা  — নির্ঝর নদী পর্বত গ্রাম হ্রদ দেখতে দেখতে আমরা পথের কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম।”

       ১২৮৮-র অগ্রহায়ণ সংখ্যার ‘ভারতী’তে ‘রেলগাড়ি’ শিরোনামের একটি রম্য নিবন্ধ পাওয়া যায়, যেখানে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, একবার লণ্ডন যাবার সময় একটুর জন্য ট্রেন মিস করেছিলেন। কিন্তু আধ ঘন্টার মধ্যেই পরবর্তী ট্রেন পেয়ে যান কবি। কারণ শহর হিসেবে ছোটো হলেও রেলগাড়ির সংখ্যা ছিল প্রচুর। গোটা শহর জুড়ে রেলের লাইনের জাল বিস্তার। এই ভ্রমণের মধ্যেই এক বিধবা রমণীর আপ্যায়নে লণ্ডন থেকে কিছু দূরের এক শহরে যেতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লণ্ডন থেকে যাত্রা করে আবার লণ্ডনেই ফিরে আসেন। আসলে সেই ট্রেন ছিল “এ গাড়ি খেয়াগাড়ি, পারাপার করে।”  রবীন্দ্রনাথ এই বিদেশ ভ্রমণ করে ফিরলেন, সঙ্গে আনলেন বিদেশীয় সঙ্গীত-রীতি।

পথভ্রষ্ট হই নাই তাহারি অটল বলে

   এরপরে পাঁচ বছরের মধ্যে দু’বার রবীন্দ্রনাথ পাহাড়ি ট্রেনে দার্জিলিং গেছেন। একবার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে ১৮৮২ র অক্টোবর (১২৮৯ কার্তিক), দুর্গাপুজোর সময়। প্রথমবারের এই দার্জিলিং ভ্রমণের তেমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। কবি নিজেও কিছু লিখে যাননি। সম্ভবত ভ্রমণসঙ্গীদের সঙ্গটাই তাঁর কাছে বেশি আকর্ষণের ছিল বলে লেখার উপাদান বা ইচ্ছে সেভাবে প্রবল হয়নি। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে চলাচল শুরু হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই এই তিনজনের হিমালয় যাত্রা।

    ১৮৮৫-তে (১২৯২সাল), গরমের ছুটিতে রবীন্দ্রনাথ, ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ এবং ভাইঝি ইন্দিরার আবদারে হাজারিবাগের উদ্দেশে ট্রেনে যাত্রা করেছেন, সঙ্গী আরও একজন ‘মোটাসোটা, গোলগাল, সাদাসিধে মানুষ।’ তখন অবশ্য সরাসরি ট্রেনে হাজারিবাগ যাওয়া যেত না। প্রথমে যেতে হত মধুপুর, তারপর ট্রেন বদল করে গিরিডি পর্যন্ত। সেখান থেকে গাড়িতে হাজারিবাগ। কবি তাঁর ছোটো সঙ্গীদের নিয়ে রাতের ট্রেনে হাওড়া থেকে মধুপুর এসে ভোর চারটের সময় গিরিডির ট্রেন ধরেছিলেন।

     রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, হাজারিবাগ ভ্রমণ থেকে ফিরেই রবীন্দ্রনাথকে সম্ভবত দেওঘরে তাঁর ছোটোবেলার শিক্ষক রাজনারায়ণ বসুর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার জন্য আবার হাওড়ায় ট্রেনে চাপতে হয়। আবার দুই-একদিনের মধ্যেই দেওঘর থেকে রাতের ট্রেনে কলকাতায় ফিরছেন। এই রাতের ট্রেনেই রবীন্দ্রনাথ স্বপ্ন দেখেন, কোনো এক মন্দিরের সিঁড়ির উপর বলির রক্তচিহ্ন দেখে একটি বালিকা তার বাবাকে ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করছে, এত রক্ত কেন! এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, রবীন্দ্রনাথের এই রাতের রেল ভ্রমণের থেকেই ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের জন্ম, যে উপন্যাসকে পরে কবি ‘বিসর্জন’ নাম দিয়ে নাট্যরূপ দেন। এর অনেক পরে লেখা ‘অপরিচিতা’ গল্পে একটি চরিত্রকে দেখা যায়, ট্রেনের কামরায় ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতে।

    যৌবনের শুরুতে রবীন্দ্রনাথের একবার ট্রেনের বদলে গোরুর গাড়িতে করে জিটি রোড ধরে পেশোয়ার যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। তাঁর এই অদ্ভুত বাসনা যথারীতি কারও সমর্থন পায়নি। দেবেন্দ্রনাথ কিন্তু কোনো আপত্তি করেননি। এবং এই বাধা না পাওয়াটাই রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় মানসিক প্রস্তুতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

ট্রেনই কবির প্রধান ভ্রমণবাহক ছিল।

আসা যাওয়ার পথ চলেছে

     ১৮৮৭-র শরৎকাল। রবীন্দ্রনাথ পরিবারের নানান বয়সী সদস্যের দলবল নিয়ে যাচ্ছেন দার্জিলিং। এই ভ্রমণে  কবিই একমাত্র পুরুষ। কবির এবারের ভ্রমণসঙ্গী সকলেই মেয়ে; যেমন স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, বড়দিদি সৌদামিনী দেবী, ন’দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী, তাঁর দুই মেয়ে হিরণ্ময়ী ও সরলা। তারা যথাক্রমে উনিশ ও পনেরো বছরের। এক পরিচারিকা এবং রবীন্দ্রনাথের প্রথম সন্তান বেলা, তখন সে মাত্র এক বছরের। তখন পদ্মার উপর ব্রিজ না থাকায় দার্জিলিং যাওয়া  বেশ ঝামেলারই ছিল। দার্জিলিং যেতে গেলে দামুকদিয়া নামে একটি স্টেশানে নেমে স্টিমারে পদ্মা পেরোতে হত। সেখান থেকে মিটার গেজের ছোটো লাইন শিলিগুড়ি, তারপর সেখান থেকে আরো ছোটো রেলগাড়ি। মিটার গেজের গাড়িতে লেডিজ কম্পার্টমেন্টে উঠেছিলেন পরিবারের মেয়েরা আর কবি নিজে অন্য জেনারেল কামরায়। রাত ট্রেনের কামরাতেই কেটেছিল। পরদিন শিলিগুড়িতে নেমে ট্রেনবদল। শিলিগুড়ি থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে ঘুরতে ঘুরতে ন্যারোগেজ লাইন ধরে চলেছে টয়ট্রেন। গন্তব্য দার্জিলিং।

    দার্জিলিংয়ে থাকার জন্য তাঁরা দুশো তেতাল্লিশ টাকা দিয়ে Castleton House ভাড়া নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখেছেন, বেশ সহজেই দার্জিলিং পোঁছেছেন। কিন্তু তাঁর ন’দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী ভারতী পত্রিকায় ছোটো ভাইয়ের মজার আনাড়ি কীর্তিকলাপ লিখতে গিয়ে এক জায়গায় লিখেছেন, আগের স্টেশান ‘ঘুম’-কে ভুল করে দার্জিলিং ভেবে মালপত্তর নিয়ে সদলবলে নেমে পড়তে গেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ আবার চিঠিতে মজা করে লিখছেন, ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন, তবু কোমর কেন টনটন করে রে!’ এর থেকে বোঝা যায়, শীতের মুখে শীতপোষাক, আরও তল্পিতল্পা, এক কথায় যাকে ‘লাগেজ’ বলে, পুরুষ হিসেবে তাঁকেই টানাটানি করতে হয়েছিল। এই দার্জিলিংবাস ছিল একমাসের। কার্তিকের শেষ দিকে তাঁরা ফিরে আসেন। এই সময়ই কবি ‘মায়ার খেলা’র গান রচনা শুরু করেন।

    এরপরে বছর না ঘুরতেই রবীন্দ্রনাথ বেনারসের কাছে গাজিপুর গেছেন স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে। ইস্ট ইণ্ডিয়ান রেলপথের দিলদারনগরে বেলা দেড়টার সময় নামেন। তারপর তাড়িঘাটের ট্রেনে ওঠেন। তবে গাজিপুরে কবি টানা থাকেননি, মাঝে বার দুই কলকাতা যান। একবার গিয়ে সুরেন্দ্রনাথ ও ইন্দিরা দেবীকে, আরেকবার ন’দিদিকে নিয়ে আসেন। গাজিপুর যেতে গেলে তখন দুটি ট্রেন বদল করতে হত। এই যাত্রার বর্ণনা পাওয়া যায় স্বর্ণকুমারী দেবীর একটি লেখা থেকে। সেখান থেকে তাঁরা কাশীও বেড়াতে যান। গাজিপুরবাসের সময় কবি আটাশটি কবিতা লেখেন। ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসে গাজিপুর ও কাশীর যে বর্ণনা আছে, তা কবির এই ভ্রমণেরই অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। গাজিপুর থেকে বর্ষার শেষদিকে কবি সপরিবারে কলকাতায় ফেরেন।

    ১৮৮৯-এর ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকে রবীন্দ্রনাথ দু’ বছর তিন মাসের কন্যা মাধুরীলতাকে নিয়ে মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের কাছে সোলাপুর যাত্রা করেছেন। সঙ্গে একজন আয়া। স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ঠিক দু’ মাস দিন কয়েক আগে জন্ম দিয়েছেন তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান রথীন্দ্রনাথের। তিনি কলকাতায়। প্রায় চার মাস পর কবি সকন্যা কলকাতায় ফিরছেন, সঙ্গে সেই আয়াটি। কবির এই ভ্রমণ ছিল সম্ভবত দুটি শিশুর মা, স্ত্রীকে কিছুদিনের বিশ্রাম দেওয়ার জন্য। এই সোলাপুরে থাকাকালীনই ‘রাজা ও রানী’ নাটকের প্রথম খসড়া শুরু, যদিও তখন নামকরণ কিছুই হয়নি। এই সময় তিনি কয়েকটি ছোটো কবিতা গান এবং একটি বিবাহের ফরমায়েসি গান লেখেন।

    ১৮৯০-এর মার্চে (১২৯৬ এর চৈত্র) বা তার কিছু আগে কবি কলকাতা ফিরছেন শান্তিনিকেতন থেকে। ট্রেন থেকে  বসন্তের রূপ দেখে কবির মনে হয়, এই প্রকৃতির রূপ বদলে যাবে গ্রীষ্মে। তখনই আচমকা এর পাশাপাশি তাঁর মনে হয়, কোনো সুন্দরী নারী যদি মনে করে ক্ষণিকের পাওয়া তার বাইরের রূপ-যৌবন দিয়ে প্রেমিককে মুগ্ধ করেছে, তখন সে তার ওই রূপকে ধিক্কারই দেবে। এই ভাবনা থেকেই বসন্তের পরেই এক বর্ষায় জন্ম নেয়’ চিত্রাঙ্গদা’। 

পথ দিয়ে কে যায় গো চলে

    ১৮৯০-এর ৭ সেপ্টেম্বর (১২৯৭, ২৩ ভাদ্র), কবি দ্বিতীয়বারের জন্য ইউরোপের মাটিতে পা দিলেন। সেখান থেকে সকাল সাড়ে এগারোটায় রেলে প্যারিস যাত্রা করলেন। ৮ সেপ্টেম্বর রাত্রে ট্রেন বদল করে ভোর তিনটেতে প্যারিসে নামলেন। রবীন্দ্রনাথের বর্ণনা থেকেই জানা যাচ্ছে, ট্রেনে ডাইনিংকারে খাবার ব্যবস্থা এবং শোওয়ার ও স্নানের জন্যও সুবন্দোবস্ত ছিল। রবীন্দ্রনাথ যে ট্রেনে প্যারিসে যাওয়ার জন্য উঠেছিলেন, সেই ট্রেন একেবারে প্যারিস যায় না, একটু পাশ দিয়ে যায়। তাই প্যারিসের কাছাকাছি স্টেশানে ট্রেনের ব্যবস্থার জন্য টেলিগ্রাফ করা হয়েছিল। প্যারিসে যাওয়ার সময় রেলের লোকেরা গভীর রাত্রে ২ টোর সময় ট্রেন বদলের জন্য কবিকে জাগিয়ে দিয়েছিল। তাঁরা ছিলেন তিনজন ভারতীয় যাত্রী — মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ, বন্ধু লোকেন পালিত ও কবি নিজে। তাঁদের জন্য এই স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা। এই ট্রেনটিতে ছিল মাত্র একটি ইঞ্জিন, একটি ফার্স্ট ক্লাস কামরা ও একটি ব্রেকভ্যান। এই পথ ছিল অল্প সময়ের। রাত তিনটেতে প্যারিসে ট্রেন পৌঁছেছিল। এরপরে দুই ভাইয়ের গন্তব্য অনুযায়ী ট্রেন নিয়ে বিভ্রাট হয়। তাঁরা যে ট্রেনে উঠেছিলেন, সেই ট্রেন তাঁদের গন্তব্যে যেত না। সত্যেন্দ্রনাথ ও কবি তিন চারটে স্টেশান ফিরে গিয়ে আবার ট্রেন বদল করেন।

     রবীন্দ্রনাথের জীবন শুধুই সাহিত্যসৃষ্টি কিংবা সামাজিক কর্তব্যপালন নয়, তাঁর জীবন ছিল সমস্যাবহুলও। স্ত্রী মৃণালিণী দেবীর মৃত্যু হয়েছে। কবির দ্বিতীয়া কন্যা রেণুকার যক্ষ্মার লক্ষণ, অত্যন্ত অসুস্থ। যক্ষ্মার তখনও কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ বের হয়নি। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ১৯০৩-এর মে মাসে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে তিনি হাজারিবাগ, মধুপুর গিরিডি হয়ে অত্যন্ত কষ্ট করে আলমোড়ায় পৌঁছন। এই সুদীর্ঘ ভ্রমণের কষ্টভোগ সুধাংশুবিকাশ রায়কে লেখা এক পত্র থেকে জানা যায়। যেমন, মধুপুর স্টেশানে পৌঁছলে স্টেশানমাস্টার কথা দিয়েছিলেন, বোম্বাই মেলের সঙ্গে তাঁদের গাড়ি জুতে দিতে পারেন। কিন্তু পরে টেলিগ্রাফ করে জানানো হয় যে এত অল্প সময়ের মধ্যে সেটা সম্ভব নয়। এইরকম আরো নানারকম পথকষ্ট। আলমোড়া থেকে চারমাস পর আবার অসুস্থ রেণুকাকে নিয়ে কবি কলকাতায় ফিরে আসেন। আবারো ট্রেন সংক্রান্ত দুর্ভোগ পোয়াতে হয় কবিকে। আলমোড়া থেকে স্ট্রেচারে করে পাহাড়ি রাস্তা অতিক্রম করে সকন্যা রবীন্দ্রনাথ যখন কাঠগোদামে পৌঁছান, তখন নির্ধারিত ট্রেন আগেই স্টেশান ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।

     পরের দিনে ট্রেনে উঠে কবি কোনো একটা বড়ো স্টেশানে রেণুকার জন্য দুধ কিনতে নেমেছিলেন। হঠাৎ মনে পড়ে মানিব্যাগ ফেলে এসেছেন কামরাতেই। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এলেন; কিন্তু দেখেন মানিব্যাগ নেই। রবীন্দ্রনাথ কিছুক্ষণের জন্য বিচলিত হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি যে রবীন্দ্রনাথ! নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিলেন যে, যে পার্সটি নিয়েছে, সে চুরি করেনি, কবি নিজেই তাকে দান করেছেন।

     ক্ষয়রোগে মাধুরীলতার মৃত্যুর দিন কয়েক আগে লেখা রবীন্দ্রনাথ ‘ফাঁকি’ কবিতায় অসুস্থ বিনু, তার চলে যাওয়া, ট্রেনের অনুষঙ্গ জুড়ে যেন তাঁর দুই কন্যাই রয়েছে। হয়তো বা রেণুকা বেশি করে। “বিলাসপুরে ইস্টেশনে বদল হবে গাড়ি;” — কবিতায় কাঠগোদাম হয়েছে বিলাসপুর। আবার “যাত্রীঘরে বিছানাটা দিলেম পেতে” —  ট্রেন মিস করায় অসুস্থ রেণুকাকে নিয়ে কবির স্টেশানে অপেক্ষা, বেদনাঘন মুহূর্তগুলো জীবন্ত হয়েছে এই কবিতায়।

     ১৯১৯-এ কবি দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ করেন। তার আগে দীর্ঘদিন শান্তিনিকেতনের কাজে আবদ্ধ ছিলেন। দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ ছিল একঘেয়েমি থেকে মুক্তিও। এই ভ্রমণ ছিল দু’ মাসের ওপর। তারপর যান কাশী। এরকম বেরিয়ে পড়া কবির অব্যাহত থাকতই — যেমন শিলং, গৌহাটি। গৌহাটিতে তিনদিন থেকে কবি আসাম-বেঙ্গল রেলপথে লামডিং ঘুরে সিলেট যাত্রা করেন। গৌহাটি থেকে ট্রেন ছাড়লে ট্রেন যে স্টেশানেই থামে, সেখানেই কবির দর্শনপ্রার্থীর ভিড়। সিলেট স্টেশানে ট্রেন পৌঁছলে দেখা গেল বিরাট জনতা। সিলেট থেকে যাওয়ার পথে আখাউড়া স্টেশান পড়ত। সেখান থেকে কবি ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা যান।

    ১৩২৭-এর ২৯ মার্চ কবি বোম্বাই যান। বোম্বাই স্টেশানেও দর্শনার্থীদের সেই উপচে পরা ভিড়। একদিন সেখানে থেকে রাত্রের ট্রেনে কবি আমেদাবাদ যান। আমেদাবাদে দিন চারেক থেকে রবীন্দ্রনাথ ভাবনগর যাত্রা করেন। তখন সেখানকার প্রধানমন্ত্রী প্রভাশঙ্কর পট্টানীর ব্যবস্থায় কবির জন্য স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়। এরপর কবি বরোদা থেকে সুরাট, তারপর বোম্বাই হয়ে আবার কলকাতায় ফেরেন।    

আমি সুদূরের পিয়াসী

রবীন্দ্রনাথ চলেছেন বিলেত। সঙ্গে ছেলে রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী ও ত্রিপুরার সোমেন্দ্রচন্দ্র দেববর্মা। আর সম্ভবত সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা মঞ্জু, যে বিলাতে থেকে পড়াশুনো করবার উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন। ১৯২০-র ১৪ মে — তাঁর ৫৯তম জন্মদিনের কয়েকদিন পর — কলকাতা থেকে যাত্রার আগে হাওড়া স্টেশানে কবিকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বোম্বাই যাবার পথে ট্রেন নাগপুরে দাঁড়ালে কবি সেখান থেকে কবি অজিত চক্রবর্তীকে সেখানকার গরমের কথা লিখতে গিয়ে মজা করে লিখছেন যে, এখনো তিনঘণ্টা রবিতাপ সহ্য করতে হবে। কবির এই পর্বের ভ্রমণের বর্ণনা পাওয়া যায় সোমেন্দ্রচন্দ্রের স্মৃতিচারণায়। কবি ডোভার থেকে ট্রেনে লণ্ডনে আসেন।

    রথীন্দ্রনাথের দেওয়া ‘পিতৃস্মৃতি’র এক বর্ণনা থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের অ্যাটাচিটি ছিল পুত্র রথীন্দ্রনাথের হাতে। আর সেই অ্যাটাচিতে ছিল ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদের পাণ্ডুলিপি। গন্তব্য স্টেশানে নামার সময় তাড়াহুড়োতে তিনি অ্যাটাচিটি নামাতে ভুলে যান। পরের দিন অ্যাটাচির খোঁজ পড়তে বোঝা যায়, পাণ্ডুলিপি সমেত অ্যাটাচিটি টিউবে ফেলে আসা হয়েছে। রথীন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে চলে যান লস্ট প্রপার্টি অফিসে। সেখানে যাওয়া মাত্র ওই অনন্য সম্পদ ফেরত পান। ভাবতে অবাক লাগে, যে-বই নোবেল পাবে, সেই বই পাণ্ডুলিপি অবস্থায় হারিয়ে গেছিল।

    ‘গীতাঞ্জলি’র কম করে ছটি গান কবি কোনো না কোনো রেলপথেই রচনা করেছিলেন।

যেমন — ‘আছে আমার হৃদয় আছে ভরে’ — ই. আই. আর. রেলপথে লেখা । ১৩১৭ র ২১ আষাঢ়।

‘গর্ব করে নিই নে ও নাম’ — ই. বি. এস. আর রেলপথ। ১৩১৭ র ২২ আষাঢ়।

‘সংসারেতে আর-যাহারা আমায় ভালোবাসে’ — ই. আই. আর. রেলপথ। ১৩১৭ র ২৫ শ্রাবণ।

‘প্রেমের দূতকে পাঠাবে নাথ কবে’ — ই. আই. আর. রেলপথ ১৩১৭ ২৫ শ্রাবণ

‘গান গাওয়ালে আমায় তুমি’ — ই. আই. আর. রেলপথ। ১৩১৭ র ২৫ শ্রাবণ।

‘মনে করি এইখানে শেষ’ — ই. আই. আর. রেলপথ, ১৩১৭ র ২৫ শ্রাবণ।

     ইংল্যাণ্ডে ভিড়ে ঠাসা কামরায় রবীন্দ্রনাথকে রেভারেণ্ড অ্যাণ্ডরুজ যেভাবে দেখেছিলেন, ১৯১৩-র অক্টোবরে তাঁর ‘Rabindranath’s Return’, The Modern Review’তে লিখছেন — “I noticed that all through the long train journey Rabindranath sat, with his eyes closed, wrapt in meditation”. তাঁর এই ভ্রমণ ছিল এক বছর চার মাসের। ১৯১৩ র ২৯ অক্টোবর কবি সকাল আটটায় হাওড়া পৌঁছলে বিরাট এক সংবর্ধনা পেলেন। সেদিনই দুপুরের ট্রেনে তিনি শান্তিনিকেতন ফিরে গেলেন।

পথিক পরান্‌, চল্‌, চল্সে পথে তুই

রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতত্ত্বের একটি বিশেষ আধার তাঁর ভ্রমণপিপাসু মন। এই ভ্রমণ নিয়েও কখনো কখনো তাঁর মধ্যে টানাপোড়েন চলেছে। রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্রাবলী (বালিয়া, মঙ্গলবার। ৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৩)-তে লিখছেন — “ঘরের কোণও আমাকে টানে, ঘরের বাহিরও আমাকে আহবান করে।” কখনো শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি তাঁর পিছু টেনে ধরেছে, কখনো বিশ্বভারতীর কর্মভার, কখনো সমস্যাবহুল পারিবারিক পরিস্থিতি; অন্যদিকে বিশ্বকে জানার হাতছানি, মানসভ্রমণ, কখনো সংবর্ধনা-বক্তৃতার আহবান। রবীন্দ্রনাথের কাছে ঘরে বাইরের এই যে সামঞ্জস্য রক্ষা, এই-ই তো তাঁকে নব নব সৃষ্টির পথকে আলোকিত করেছিল।

    শরতের আশ্রমের সৌন্দর্য একদিকে, আরেকদিকে শিলং পাহাড়ের হাতছানি। কিছুদিন আশ্রমের বন্ধন মুক্তি ঘটিয়ে কবি শিলং যাওয়ার জন্য বোলপুর থেকে হাওড়া যাওয়ার ট্রেন ধরলেন বিকেলে। আরেকবার এইরকম এক শরতেই গেছেন মাদ্রাজ। ১৯১৪-তে পুজোর সময় কবি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কাছে গয়ায় গেছেন। গয়া থেকে দুটো স্টেশান দূরে বেলা স্টেশান থেকে বৌদ্ধ আমলের গিরিগুহা দেখতে গেছেন। গয়া থেকে বেলা যাওয়ার পথে চলন্ত ট্রেনে বসে কবি লিখলেন ‘গীতালি’র সেই গীত — “পথে পথেই বাসা বাঁধি, মনে ভাবি পথ ফুরালো।” ‘বেলা’ স্টেশানে কবিকে নামিয়ে ট্রেন চলে গেল। স্টেশান চত্বর ফাঁকা। ওয়েটিংরুমে বসে তিনি লিখলেন — “পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে।” ফেরার পথে ট্রেনে বসেই লিখলেন — “পথের সাথী, নমি বারম্বার।”

        ১৯১৮-র ১২ অক্টোবর পুজোর ছুটিতে রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে মাদ্রাজ যাত্রা করেন। শিল্পী সুরেন্দ্রনাথ কর ও বিশ্বভারতীর সংগীতের অধ্যাপক ভীমরাও শাস্ত্রী ছিলেন কবির সহযাত্রী। কিন্তু মাঝপথে ট্রেনের ইঞ্জিন বিগড়ে গেলে মাদ্রাজ সফর বাতিল করে কবি পিঠাপুরমের রাজার আতিথ্য গ্রহণ করেন। দিন কয়েক সেখানে থেকে ফিরে আসেন ২০ অক্টোবর। ১৯১৯-এ শান্তিনিকেতনে পুজোর ছুটি হলে সপ্তাহ দুয়েক সেখানে কাটিয়ে কলকাতা হয়ে রবীন্দ্রনাথ অসম যাত্রা করেন। সান্তাহার স্টেশানে এসে কবি শিলং মেলে ওঠেন। শিলং কবির খুব ভালো লেগেছিল। এরপর তিনি শিলং ছেড়ে গৌহাটি আসেন। ৩ নভেম্বর রাত্রে গৌহাটি রেল স্টেশান থেকে ট্রেনে চাপেন তিনি। গন্তব্য শ্রীহট্ট। এই পথে বদরপুরে কবিকে ট্রেন বদল করতে হয়। বদরপুর থেকে সুরমা মেল করিমগঞ্জে পৌঁছেছিল অল্প সময়ের মধ্যেই। রেলকর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সেদিন শুধুমাত্র কবিকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য সুরমা মেলকে করিমগঞ্জ স্টেশানে পঁচিশ মিনিট মতো দাঁড় করানো হয়েছিল, যেখানে ওই ট্রেন দাঁড়াত মাত্র মিনিট তিনেক। রাত দশটা নাগাদ কুলাউড়া জংশনে ট্রেন পৌঁছল, কবি শ্রীহট্টগামী ট্রেনে উঠলেন বটে; কিন্তু তখন রাত্রের দিকে কোনো ট্রেন যাতায়াত করত না বলে তাঁকে ট্রেনের ফার্স্টক্লাস কামরায় রাত্রিযাপন করতে হয়। কুলাউড়া থেকে শ্রীহট্ট, প্রত্যেক স্টেশানে অজস্র মানুষ ফুলের তোড়া নিয়ে কবিকে সংবর্ধনা দেন। ১৯১৯-এর ৫ নভেম্বর সকাল সাড়ে নটায় শ্রীহট্ট রেলস্টেশানে রবীন্দ্রনাথের ট্রেন পৌঁছলে দেখা গেল লোকে লোকারণ্য। চারিদিকে হর্ষধ্বনি। স্টেশান চত্বরেই প্রচুর বাজি পোড়ানো হলো।

       এরপরে  রবীন্দ্রনাথ আবার শিলংয়ের ট্রেনে চাপেন ২৬ এপ্রিল, ১৯২৩। এই ভ্রমণের সময়সীমা ছিল দেড় মাসের মতো। কবি তৃতীয়বার শিলং যান ১৯২৭-এর মে মাসে। এর আগে নির্মলকুমারীরর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, কোপেনহেগেন ছেড়ে হামবুর্গ পৌঁছেছেন কবি, নির্মলকুমারী প্রমুখ। এই গোটা ট্রেনকেই জাহাজে তুলে বলটিক সমুদ্র পার করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সেই রাত্রে রেলের কামরায় কিন্তু জাহাজের ডেকে ‘সে কোন পাগল যায়’ গানটি রচনা করেন। ১৯৩০-এর ২ মার্চ ট্রেনে তিনি মাদ্রাজ যান। বোলপুর থেকে হাওড়া রবীন্দ্রনাথের যাতায়াত ছিলই। ১৯৩৭-এর মে মাসে হাওড়া থেকে আলমোড়া যান ট্রেনে।

কোথা বাইরে দূরে

পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে!

১৯৪১-এর ২৫ জুলাই (৯ শ্রাবণ ১৩৪৮)। অসুস্থ কবিকে অস্ত্রোপচারের জন্য কলকাতায় নিয়ে আসা হবে স্থির হয়েছে। তখনকার ই.আই. রেলওয়ের অধিকর্তা এন. সি. ঘোষ কবির জন্য বিশেষ একটি সেলুনকারের ব্যব্যস্থা করে দিয়েছিলেন। এই সেলুনকারটিতে ছিল চারটে ঘর — একটি শোওয়ার ঘর, একটি ড্রয়িংরুম, একটি খাবার ঘর ও একটি কিচেন। এছাড়া দুটো স্নানের ও ভৃত্যদের ঘর। সেলুনকারের প্রত্যেকটি ঘরে দুটো করে ফ্যান লাগানো। সেলুনকারটিকে আগের দিনই বোলপুর স্টেশানে নিয়ে আসা হয়েছিল। সকালে ট্রেন ছাড়ল, ট্রেনের কামরায় ছিলেন কন্যা মীরা দেবী, নাতনি নন্দিতা এবং নির্মলকুমারী। প্রায় সত্তর বছরের শান্তিনিকেতনের সঙ্গে যে যোগ, সেই স্থান ত্যাগের মুহূর্তে কবির মনে নিশ্চয়ই অফুরন্ত স্মৃতি এসে জড়ো হয়েছিল। বোলপুর থেকে হাওড়া আসতে পৌনে সাত ঘন্টার মতো সময় লেগেছিল। ২ টো বেজে ৪০ এ ট্রেন হাওড়ায় পৌঁছল। সেলুনকার থেকে স্ট্রেচারে করে কবিকে নামানো হলো।

      যে-পথে বাবার সঙ্গে কবির প্রথম রেললভ্রমণ শুরু, সেই পথেই তাঁর অন্তিম রেলযাত্রা। হাওড়া স্টেশান থেকে মোটরগাড়িতে তাঁর পৈত্রিক বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল কবিকে। এই জোড়াসাঁকো থেকে কবি আর কোনোদিনই সজ্ঞানে বেরোলেন না। রাখীপূর্ণিমার শেষে ৭ আগস্ট, ১৯৪১ (২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ সাল) বেলা ১২টা দশে কবির অমৃতলোকযাত্রা।

    রবীন্দ্রনাথ ছিলেন যথার্থ বিশ্বপথিক। পথের সঙ্গে ছিল তাঁর বন্ধনহীন গ্রন্থি। এই বিশ্বপরিব্রাজক প্রয়োজনের তাগিদে অনেক সময় ভ্রমণ করলেও, যে কোনো ভ্রমণেই ছিল কবি-মনের অভিসার। প্রত্যেকটি স্থলযানের নানারকম অভিজ্ঞতা তাঁর সাহিত্য-সম্ভারে  নানাভাবে ছায়া ফেলে গেছে। শেষ পাঁচ বছরে রেলগাড়ি তাঁর কাব্য কবিতায় এক বিধুর অনুভূতি নিয়ে শিল্পরূপ ধারণ করেছে। আবার চলন্ত ট্রেনে লেখালিখি করতে গিয়ে হাতের লেখা মনের মতো না হলে তাঁর মন খারাপ হত। বিভিন্ন যানে চেপে তিনি যেমন বিশ্বপ্রকৃতির রং-রূপ-শোভা, নিত্যনতুন মানুষ-পারিপার্শ্বিকতা, কর্মকোলাহলের স্পর্শ নিতেন, তেমনই এসবের মাঝে নিজের মনের জানলা খুলে কখনো লেখার পরিকল্পনা, কখনো উপন্যাসের খসড়া তৈরি, কখনো কাব্য, গদ্য, কখনো গান রচনা-সুর তাঁর দেওয়া চলতই। গতিই ছিল রবীন্দ্রনাথের আজীবনের সঙ্গী। তিনি মনে করতেন, রেলগাড়ির মতো আমাদের প্রত্যেকের জীবন ছুটে চলেছে, কিন্তু তার মধ্যে থেকে যেটুকু পাই, সে ক্ষণকালীন নয়, সে চিরকালীন। রবীন্দ্রনাথও আমাদের কাছে ক্ষণকালীন নন, আমাদের চিরকালীন চলার পথের সাথি  —“ওগো পথের সাথি, নমি বারম্বার