আমার, আমাদের, উনিশ কুড়িদের রবীন্দ্রনাথ

রবিঠাকুর আসলে সারাজীবন ধরে তিলে তিলে একখানা ‘সব পেয়েছির দেশ’ গড়ে দিয়ে গেছেন। সে দেশে ‘নেই’ শব্দ বড়ই ব্রাত্য। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, চিঠিচাপাটি, গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ, মায় পেনের কাটাকুটিতে বানানো চমৎকার খানকতক আঁকিবুকি— ভাঁড়ারের রসদ ফুরোবার নয়। যখন যেমনটি চাই, ঠিক তেমনটিই সেখানে রয়েছে মজুত। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রবিঠাকুর। নববর্ষের সূচনাই যে হয় তাঁর ‘এসো হে বৈশাখ’ দিয়ে। অবশ্য লেখার সময় ভদ্রলোক ঘূণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেননি ১৪৩১-এর বৈশাখকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাবার স্পর্ধা আর বাঙালির থাকবে না! আকাশের মুখ কিঞ্চিৎ গোমড়া হয়েছে, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে, শীত আসবো আসবো করছে, বসন্তের দিনে কোকিল ডেকেছে— খুঁজলে তাঁর লেখা অন্তত খানবিশেক কবিতা গান পাওয়া যাবে এমন সব দিনগুলোর জন্য। ‘শিশু ভোলানাথ’—এর পাতাগুলোই প্রথম চিনিয়েছিল রবিঠাকুরকে। খানিক মায়ের উৎসাহে আর অনেকটা নিজের আগ্রহেই কবিতাগুলো মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। বাড়িতে কেউ এলে মা বেশ গর্ব করেই বলতেন, আমার শিশু ভোলানাথের সঅঅব কবিতা ঝরঝরে মুখস্থ। রবিঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করে পাড়ার ফাংশনে হাততালি আর সন্দেশের বাক্স পাওয়ার দিনগুলো বড় বেশি আদরের। ‘আমি আজ কানাই মাস্টার, পোড়ো মোর বেড়ালছানাটি’— কি যে ভালো লেগেছিল লাইনগুলো! একইসঙ্গে জীবনস্মৃতিও তখন পড়তে শুরু করেছি। জেনে অবাক হলাম, রবিঠাকুর ছেলেবেলায় নাকি বাড়ির রেলিংগুলোকে পড়াতেন। আমিও যে তখন সদ্য সদ্য আমার টেডিবিয়ার, বার্বিডলদের পড়াতে শুরু করেছি।ডাকঘরের অমল যেমন একলাটি দুপুর কাটাতো, তেমন ঠাকুরবাড়ির ছোট্ট ছেলেটারও দিন কেটেছে জানলার বাইরে বটগাছ দেখে। বাবা অফিস গেলে, মা কলেজ গেলে আমারও যে একলাটি দুপুর কেটেছে ফ্ল্যাটের বাইরে কৃষ্ণচূড়া গাছখানার দিকে তাকিয়ে। কত মিল, কত মিল! ‘বীরপুরুষ’ পড়ে অবশ্য একটু মুষড়ে পড়েছিলাম। ও যে একটা ছেলের গল্প। মেয়েরা কই শিশু ভোলানাথে? মেয়েগুলোর বুঝি সাধ হয় না বীরপুরুষ হতে? ডাকাত পিটিয়ে মায়ের চোখে যে খুদেটার হিরো হওয়ার স্বপ্ন, ও যে মেয়েরাও দেখে। ততদিনে বেশ একটু বড় হয়েছি। চিত্রাঙ্গদা পড়ে এতই ভালো লাগল, ফেসবুকের বায়ো-তে লিখে রাখলাম

‘‘নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী।

পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে

  সে নহি নহি,

  হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে

         সে নহি নহি।

  যদি পার্শ্বে রাখ মোরে

                 সংকটে সম্পদে,

  সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে

                 সহায় হতে,

            পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।”

কিশোরীবেলায় প্রথমবার প্রেমে পড়ার অনুভূতি — গীতাঞ্জলির ইংরিজি ভার্সনখানা থেকে গানের লাইন টুকে প্রেমপত্র লেখা হত। তারপর সে প্রেম ভেঙেছে, ঘরের লাইট নিভিয়ে রবিঠাকুরের বিরহের গান শুনে চোখের জলে বালিশ ভেজানোর পালা। ধীরে ধীরে বয়স বেড়েছে। জীবনে আবারও নতুন প্রেম এসেছে, তাতেও রবিঠাকুর। কলারটিউনে বেজেছে ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’।

‘বোঝাপড়া’ কবিতাটা একসময় স্কুলের সিলেবাসে ছিল— ‘মনেরে আজ কহো যে, ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে।’ স্কুলে অবশ্য অতখানি গভীর ফিলোজফি বুঝে ওঠার মতো পাকামাথা ছিল না। কবিতাটা বোঝানোর জন্য ম্যাম বলেছিলেন, ‘এই ধরো মনীষার চমৎকার শাকা লাকা বুম বুম পেনসিলখানা অস্মিতা ভুল করে ভেঙে ফেলেছে। এখন মনীষাও যদি রিভেঞ্জ নিতে অস্মিতার লাইট জ্বলা জলের বোতলটা আছাড় মেরে ভেঙে দেয়, তাহলে কি ওর পেনসিলটা জোড়া লেগে যাবে? যাবে না তো। উল্টে অস্মিতাও রাগ করে মনীষার আরেকটা কিছু ভেঙে দেবে। ভাঙাভাঙির খেলা চলতেই থাকবে। চোখের বদলে চোখ নেওয়ার আইন চালু হলে যে গোটা দুনিয়া অন্ধ হয়ে যাবে। অস্মিতা যদি ভুল করে ভেঙে থাকে, মনীষা অবশ্যই দুঃখ পাবে। কিন্তু তাকে রিঅ্যালিটিটা অ্যাকসেপ্ট করতেই হবে। তার উচিত অস্মিতাকে ক্ষমা করে দেওয়া।’ এই প্রাথমিক শিক্ষাগুলোর উৎসই আমার রবিঠাকুর।

শিশু ভোলানাথে প্রায় সব শিশুই ছেলে বলে বড় অভিমান হত। তা পুষিয়ে গেল যখন ‘পলাতকা’, ‘পুনশ্চ’—র কবিতাগুলো পড়তে শুরু করলাম। ‘পলাতকা’ কাব্যগ্রন্থ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন মেয়ে মাধবীলতা মারা যাবার পর। ‘মুক্তি’ কবিতাখানা বড় বেশি ভালো লেগেছিল। ‘মুক্তি’র মেয়েটি নিছকই এক ঘরের বউ। সে এখন এক মারণরোগে আক্রান্ত। বয়েস তার মোটে বাইশ। এই বাইশ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে বারবার ডাক এসেছে নিরানন্দ গৃহকোণের নাগপাশ ছিন্ন করে বেরিয়ে পড়ার। কিন্তু সে যে অন্তঃপুরিকা। সে যে ‘লক্ষ্মী সতী ভালোমানুষ অতি’। ন’বছর বয়েসে বিয়ে হয়ে সে শ্বশুরবাড়ি এসেছে। তারপর ‘বাইশ বছর রয়েছি সেই এক চাকাতেই বাঁধা’। তার সেই অন্তঃপুরের অন্ধকার কারাগারে, রান্নাঘরের ধূমাচ্ছন্ন বন্দীশালায় বাইরের পৃথিবীটার ডাক বারবার প্রতিহত হয়ে ফিরে গিয়েছে। আজ যখন মৃত্যু আসন্ন, তখনই তার ফুরসত হয়েছে বিশ্বপ্রকৃতির সাথে মুখোমুখি বসার। সে বলেছে — ‘আমি নারী, আমি মহীয়সী, আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎস্নাবীণায় নিদ্রাবিহীন শশী। আমি নইলে মিথ্যা হত সন্ধ্যাতারা-ওঠা, মিথ্যা হত কাননে ফুল-ফোটা।’ পড়ার সময়ে বারবার ভেবেছি, এই রিয়েলাইজেশনটুকু আরও আগে হলে মেয়েটিকে এতটা রিক্তহাতে হয়তো চলে যেতে হত না। ‘রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধা’-র বাইরেও যে কিছু থাকতে পারে, সেই বোধটুকুই তার ছিল না। বাইশ বছরে যে একটি দিনও নিজের কথা ভাবার সময় পায়নি, নিজের দিকে তাকাবার অবকাশ পায়নি, জীবনের শেষবেলায় তাই মৃত্যুই তার কাছে পরম কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠেছে —

         ‘দাও খুলে দাও দ্বার —

ব্যর্থ বাইশ বছর হতে পার করে দাও কালের পারাবার।’

শিউরে উঠে ভেবেছি, জীবনে আর যাই করি না কেন, এমন বিচ্ছিরিভাবে পোষ মানবো না কখনও যেখানে আপোষ করে চলাটাই হয়ে ওঠে শেষ কথা। পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের ভালোমন্দ নিজেই বুঝে নিতে পারার ক্ষমতা অর্জন করতেই হবে। জীবনটা যে বড় সুন্দর। সুন্দর করে বাঁচাটা যে একটা আর্ট, রবিঠাকুর সে শিক্ষা বারেবারে দিয়েছেন। ‘তেমন করে হাত বাড়ালে সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি’, শুধু হাতটা বাড়াতে জানতে হবে। বেঁচে থাকার সময়টুকুতে অনেকেই জীবনের প্রতি তেমন করে শ্রদ্ধা দেখিয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু যে মুহূর্তে মৃত্যু কাছে এসে দাঁড়ায়, ‘মুক্তি’র মেয়েটির মতো মনে হয় জীবন কত মধুর। আসলে ভালোবাসা জিনিসটা বরাবরই গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি। তুমি নিজেকে ভালোবাসলে তবেই তোমার জীবনটা ঠিকপথে চলবে, এই সোজাকথাটা তো রবিঠাকুরই শিখিয়েছেন।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, রিসার্চে কেটে গেল প্রায় বছরদশেক। ক্যাম্পাসে ঢুকলেই চোখে পড়ে রবিঠাকুরের স্ট্যাচুখানা। বাগানের ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকোনো মাইকে বাজে রবিঠাকুরের গান। সমস্ত মার্কশিটের ওপর দিকের কোণায় জ্বলজ্বল করে রবিঠাকুরের মুখখানা। জোড়াসাঁকো ক্যাম্পাসে গেলে তাঁর বাড়িখানায় একবারটি ঢুঁ মেরে আসা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কোন ঘরে কোথায় কী আছে সব মুখস্থ। রিসার্চে আসার আগে একখানা জম্মোকঠিন সর্বভারতীয় পরীক্ষা দিতে হয়। সে পরীক্ষার সিলেবাসে রবীন্দ্রসাহিত্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ টপিক। ওই অংশের বেশকিছু সালতারিখ ঠোঁটস্থ কণ্ঠস্থ রাখা বাঞ্ছনীয়। এখনও মনে আছে, পরীক্ষার কিছুদিন আগে কয়েকজন বন্ধুকে পাকড়াও করে নিয়ে গিয়েছিলাম জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। মুখে বলেছিলাম, ‘ওপরের একটা ঘরের সামনে ইম্পরট্যান্ট সাল-তারিখ লেখা বড় একটা বোর্ড আছে, ওইটা একবার দেখে নিলেই সব মনে থাকবে।’ আদতে কারণ ছিল অন্য। ছোট্টটি থেকে যাপনের অংশ হিসেবে যাঁকে বেছে নিয়েছি, এতবড় পরীক্ষা দিতে যাবার আগে তাঁর আশীর্বাদ তো নিতে হবে!

রবিঠাকুরই শিখিয়েছেন, যতদিন না একবারটি কেউ একলা একলা ঘুরতে বেরোচ্ছে, মানুষ হবার শিক্ষাটি ততদিন পর্যন্ত তার অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এমফিলের রিসার্চ তখন মাঝপথে। একের পর এক সেমিনার, পেপার প্রেজেন্টেশনের ঝামেলা চলছে। তার মধ্যেই একদিন বেরিয়ে পড়েছিলাম সোলো ট্রিপে। যাবার আগের দিন পর্যন্ত সে কি ভয়, কি ভয়! ফ্লাইট স্টেটাস ডাবল চেক ট্রিপল চেক করছি। হোটেলগুলোয় কল করে কনফার্ম করছি। শেষমেশ মন শান্ত করতে সঞ্চয়িতা খুলে বসলাম। এলোমেলো পাতা উল্টোতে উল্টোতে একসময় সামনে এল ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’। সত্যি তো,

“কী আছে হোথায়— চলেছি কিসের অন্বেষণে?” রবিঠাকুরের জীবনদেবতা তাঁকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল নিরুদ্দেশের পথে— ক্রমাগত জানা থেকে অজানায়, জ্ঞাত থেকে অজ্ঞাতের পানে। সে যাত্রার কি কোনও শেষ ছিল? রবিঠাকুরই তো বলেছেন, ‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে’। দূরে পশ্চিমে সূয্যি ডুবে গেলে সেখানেই কি আর তার যাত্রা ফুরোয়? যা এক দেশের পশ্চিম, তা-ই তো অন্য আর এক দেশের পূবদিক। কঠিন কঠিন কথাগুলো এর চেয়ে সোজা করে বোধহয় আর কেউ বলেননি। সাহস করে একলাটি যখন রাজ্যের বাইরে পা রেখেছি, বারেবারে মনে হয়েছে এ যেন ‘অনেককালের যাত্রা আমার অনেক দূরের পথে’। সেসব নতুন জায়গার নতুন গন্ধ, হাওয়ার নতুন স্বাদ, নতুন মানুষ সবটুকু আমার মনকুঠুরীতে ভরে নিয়েছিলাম। আজও যখন হঠাৎ হঠাৎ জীবনে এক একখানা বড়সড় চ্যালেঞ্জ ভূতপ্রেতের মতো এসে হাজির হয়, মনকে বোঝাতে পারি একলাটি অত্তোদূরে ঘুরে আসতে পেরেছিলাম, আমি সব পারবো। আর বুকে আছেন রবিঠাকুর, করবি আমার কী?