রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প - হিতবাদী পর্ব

রবীন্দ্র ছোটগল্পের যে নান্দনিক ভুবন তার সূচনাকাল হিসেবে আমরা ধরে নিতে পারি ১৮৯১ সালকে, যখন রবীন্দ্রনাথের বয়স তিরিশ বছর। একথা ভুলে যাচ্ছি না যে এর আগেও তিনি অন্তত দুটি ছোটগল্প লিখেছেন, যা গল্পগুচ্ছ সংকলনেই রয়েছে। ১৮৮৪ তে তেইশ বছর বয়সে ঘাটের কথা আর রাজপথের কথা নামে এই দুটি গল্প ছাড়াও পরের বছর, ১৮৮৫ তে লিখেছিলেন মুকুট নামে আর একটি গল্প। সেটি যে কোনও কারণেই হোক গল্পগুচ্ছ সংকলনে আসে নি। আর কিশোরকালে ষোল বছর বয়েসে, যে বয়সে ছেলেমেয়েরা স্কুলের গণ্ডী পেরোয়, রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ভিখারিণী নামের একটি গল্প। ১৮৭৭ সালে লেখা সেই গল্পটিকেও আমরা রবীন্দ্রগল্পের পরিচিত ভুবনের বাইরের ব্যাপার বলেই মনে করছি।

প্রথম দিককার এই চারটি গল্পর বিচ্ছিন্ন পর্বটিকে এই অর্থে প্রস্তুতিপর্ব বলা যেতে পারে, যেখানে তিনি শিখেছিলেন পরে আর কীভাবে গল্প লিখবেন না। কীভাবে লিখবেন, আস্তে আস্তে সাধনা থেকে সিদ্ধিতে পৌঁছবেন, সেই পরীক্ষানিরীক্ষার দিক থেকে বিচার করলে অবশ্য একে নিরীক্ষা পর্বও বলা ঠিক হবে না। সেই পরীক্ষা নিরীক্ষার শুরু হিতবাদী পর্বে আর চূড়ান্ত সিদ্ধি সাধনা ও ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পগুলিতে।

আমরা জানি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলি এসেছিল একটা স্রোতের মতো। পত্রিকা সম্পাদকদের চাহিদা বাইরের ব্যাপার হতে পারে, আসল অনুপ্রেরণা এসেছিল ভেতর থেকেই। তা না হলে ১৮৯১ থেকে ১৮৯৫ – এই পাঁচ বছরের সময়কালে চুয়াল্লিশটি গল্প লিখে ফেলা সম্ভব হত না। এটা রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতার তুঙ্গ মুহূর্তগুলির একটি। কারণ এই সময়কালেই লেখা হয়েছে একদিকে ‘সোনার তরী’ ও অন্যদিকে ‘চিত্রা’ কাব্যগ্রন্থের অনেক স্মরণীয় কবিতা। অবশ্য পত্রিকায় লেখা দেবার বিষয়টির গুরুত্বকে নেহাৎ আপতিক ভাবা যায় না, কারণ ১৮৯৬/৯৭ তে সাধনা পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে যাবার পর রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প লেখার স্রোতটিও থেমে গেল। এরপর গদ্যে বেশ কিছুকাল আর আখ্যান লেখেন নি রবীন্দ্রনাথ। তবে তাঁর কবিতা এইবার কাহিনিকাব্যের দিকে গেল। ক্ষণিকা, কথা ও কাহিনী নতুন সময়ের ফসল। ছোটগল্প আর কবিতায় দুভাবে কাহিনি বলার পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে এবার তিনি উপনীত হলেন আর এক নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষার দিকে। এই নিরীক্ষা শুধু ফর্মগতই থাকল না, বাংলা আখ্যান সাহিত্যকেই বহির্মহল থেকে অন্দরমহল ও অন্তর্মহলের দিকে ঘুরিয়ে দিল। ‘চোখের বালি’ এক নতুন যুগের সূচনা করল। চোখের বালির পর নৌকাডুবি ও তারপর গোরার মতো মহাকাব্যিক উপন্যাস লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত হলেন আবার রাজনীতি থেকে বেরিয়েও এলেন। সমাজ রাজনীতির বিশেষ ঘূর্ণাবর্ত মনোজগতে যে আবেগের আলোড়ন তুলল, পাশাপাশি যে সব প্রশ্ন, সংশয় ও জটিলতার জন্ম ছিল তা থেকে লেখা হল একের পর এক গান, অসংখ্য মননশীল অনুসন্ধানী প্রবন্ধ নিবন্ধ। সাহিত্য ও সমাজ রাজনীতিতে তীব্র সক্রিয়তার এই পর্বটিতে – ১৯০১ থেকে ১৯১২ পর্যন্ত সময়কালে লেখা ছোটগল্পের সংখ্যা কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কম – মাত্র আটটি। সবুজপত্র পত্রিকা প্রকাশের উপলক্ষ্যটিকে ধরে ১৯১৪ সালে আবার সাত সাতটি গল্প ধারাবাহিকভাবে লিখলেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু ১৯১৪ র পরে আর সেভাবে নয়। ১৯১৭ তে লেখা হল গোটা তিনেক গল্প, তারপর আবার অনেক ব্যবধান রেখে রেখে ১৯২৫ থেকে ১৯৩৩ এর মধ্যে মাত্র পাঁচটি ছোটগল্প

ফলে সৃজনস্রোতের ধারাবাহিকতার দিক থেকে, শিল্পসার্থকতার দিক থেকে ১৮৯১ থেকে ১৮৯৫ - এই পাঁচ বছর, যাকে হিতবাদী – সাধনা পর্ব বলেই সাধারণভাবে অভিহিত করা হয়, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প লেখার স্বর্ণযুগ, এটা মেনে নিতে কোনও অসুবিধে নেই। আমাদের এই লেখার বিষয় রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প লেখার সূচনা পর্বটি।

বাংলা ১২৯৮ সনে হিতবাদী পত্রিকায় একের পর এক ছটি (মতান্তরে সাতটি) গল্প লেখেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর কোনও এক কারণে হিতবাদীতে গল্প লেখা থামিয়ে শুরু করবেন সাধনা পত্রিকায় লেখা। হিতবাদী পত্রিকা ছিল একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। এর সম্পাদক ছিলেন কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য আর সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনার দায়িত্ব ছিল রবীন্দ্রনাথের ওপর। রবীন্দ্রনাথ বন্ধু শ্রীশ চন্দ্র মজুমদারকে লেখা একটি চিঠিতে জানিয়েছিলেন যে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ঠাকুর পরিবারের অনেকেই এই পত্রিকার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরই পত্রিকার নামকরণ করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র, রমেশচন্দ্র দত্তের মতো সেকালের শ্রেষ্ঠ লেখকেরা এই পত্রিকায় লিখবেন বলে সম্মতি দিয়েছিলেন।

হিতবাদী পত্রিকার পরপর ছটি সংখ্যায় ছয় সপ্তাহে রবীন্দ্রনাথের ছটি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। ১২৯৮ বঙ্গাব্দের ১৭ জ্যৈষ্ঠ (৩০ মে, ১৮৯১) বেরোয় দেনাপাওনা গল্পটি। ২৪ জ্যৈষ্ঠ বেরোয় পোস্টমাস্টার, ৩১ জ্যৈষ্ঠ গিন্নী, ৭ আষাঢ় রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা, ১৪ আষাঢ় ব্যবধান, ২১ আষাঢ় (৪ জুলাই, ১৮৯১) তারাপ্রসন্নের কীর্তি। রবীন্দ্রজীবন গবেষক প্রশান্তকুমার পালের মতে খাতা গল্পটিও হিতবাদী পত্রিকাতেই বেরিয়েছিল। (রবিজীবনী, ৩ খণ্ড, পৃ – ৫০)।

পরপর একটা স্রোতের মতো লেখা হলেও গল্পগুলি মেজাজে ও মানে একরকমের নয়। ধরা যাক একেবারে প্রথম দুটি গল্পের কথা। সকলের সুপরিচিত দেনাপাওনা ও পোস্টমাস্টার। দুটি গল্পই পরপর দু সপ্তাহে হিতবাদী পত্রিকায় বেরিয়েছিল ১২৯৮ বঙ্গাব্দে (১৮৯১ সালে) র জ্যৈষ্ঠ মাসের দুটি সংখ্যায়। দুটি গল্পেই আছে ট্রাজেডির রস। কিন্তু গল্পদুটি একেবারে আলাদা ধরনের।

দেনাপাওনা গল্পে রয়েছে একটি বলার মতো কাহিনি অংশ৷ নিরুপমার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের কথা নিয়ে গল্পটি গড়ে উঠেছে। তবে ছোটগল্পের ধর্ম মেনে জোর পড়েছে কেবল একটি পর্বতে, একটি পর্বের একটি বিশেষ দিকে। পাঁচ ছেলের জন্মের পর এই মেয়ের জন্ম বলে সে বড় বেশি আদরের ছিল বাবা মায়ের। একটি ভালো বিয়ে দেবার জন্য পিতা রামসুন্দর শুধু যথাসাধ্য করেছিলেন তাই নয়, সাধ্যকে অনেকদূর অতিক্রম করেই গিয়েছিলেন। এক রায়বাহাদুরের সম্ভ্রান্ত পরিবারে মেয়েটিকে সঁপে দিলেন তিনি। এজন্য দশ হাজার টাকা বরপণ আর অনেক দানসামগ্রী দেবার বোঝা এসে পড়ল তার ওপর। কিছু টাকা জোগাড় করলেন, যদিও একজন প্রতিশ্রুতিভঙ্গ করায় বরপণের অধিকাংশটাই বাকি থেকে গেল। বিয়ে প্রায় ভেঙে যেতে বসল। সত্যিই যদি সেদিন বিয়েটা ভেঙেই যেত, তবে হয়ত লগ্নভ্রষ্টা হবার অসম্মান নিয়েও নিরুপমা বেঁচে যেত৷ কিন্তু বিবাহ সভায় পাত্র স্বয়ং তার আধুনিক মনোভাব দেখাল, বাবার বিরুদ্ধাচরণ করে জানিয়ে দিল পণের কথা সে বোঝে না, বিয়ে করতে এসেছে বিয়ে করেই ফিরবে। খানিকটা নিরানন্দভাবেই অত:পর বিবাহ অনুষ্ঠান সমাপ্ত হল।

বিয়ের পর পাত্র, যার নাম গল্পকার আমাদের জানান নি, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এর চাকরি নিয়ে চলে গেলেন প্রবাসে৷ নিরুপমা শ্বশুরবাড়িতে রইলেন শরশয্যায়। পণের টাকা না পাওয়ার জ্বালায় শ্বশুর শাশুড়ির নানাবিধ অত্যাচার ও কটুবাক্য অনবরত আছড়ে পড়ত তার ওপর। নিরূপনার বাবা রামসুন্দরও মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসে অনেক অপমান অসম্মানের বলি হতেন। মেয়ের বাপের বাড়ি যাবার ছাড়পত্র কিছুতেই মিলত না।

অবশেষে নিজের বসতবাড়ি বিক্রি করে বাকি পণের টাকা জোগাড় করে রামসুন্দর সমস্যার সমাধান করবেন ভেবেছিলেন। ছেলেরা তা জানতে পেরে নিজেদের অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাবাকে বাধা দিক। নিরুপমাও জানিয়ে দিল টাকা যদি দেওয়া হয়, সেটাই হবে অপমান। তার স্বামী যে এই টাকা চান না তাও সে বলল।

নিরুপমার ওপর শ্বশুরবাড়ির আক্রমণ আর নিরুপমার নিজের প্রতি অযত্ন - দুই ক্রমাগত বেড়ে চলল, যার ফল তার কঠিন ব্যধি। যেদিন তার অন্তিম শ্বাস উঠল, সেইদিনই প্রথম ও শেষবারের জন্য একবার ডাক্তার ডাকা হয়েছিল। নিরুপমার মৃত্যুর পর মহাসমারোহে তার অন্তেষ্টিক্রিয়া হল, প্রতিমা বিসর্জনের সমারোহের সঙ্গেই যা কেবল তুলনীয়। অন্যদিকে এসে পৌঁছল তার প্রবাসী স্বামীর চিঠি। সে এইবার ওখানে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। স্ত্রী নিরুপমাকে এইবার নিজের কাছে নিয়ে যেতে চায়। মায়ের জবাবী চিঠিতেই সে কেবল জানল তার স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ ও পরিবারকর্তৃক দ্বিতীয় বিবাহের আয়োজনের কথা।

নিরুপমার ট্রাজেডি নি:সন্দেহে আমাদের ব্যথিত করে। পণপ্রথার মতো ব্যাধির প্রতিকার চেয়ে আমরা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠি। প্রশ্ন করি কেন রামসুন্দরের মতো পিতারা কন্যার ভালো বিয়ে বলতে এমন অদ্ভুত যূপকাষ্ঠে মেয়েকে ঠেলে দেন ও সার্বিক অন্ধকারে নিজেদেরও ডোবান। ডেপুটি মেজিস্ট্রেটের মতো চাকরি করে যে ছেলে, যে নিজে বরপণ নেবার পক্ষপাতী নয়, সে কেন নিজের বাবা মায়ের প্রকৃতি জেনেও স্ত্রীকে সেখানে নির্যাতিত হতে দেয় মাসের পর মাস, কোনও খোঁজ খবর নেয় না স্ত্রী বা তার পরিবারের থেকে, এসব অনেক প্রশ্ন আমাদের মনে উঠতে থাকে। নিরুপমার ট্রাজেডি এই অর্থেই আমাদের ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করে।

এরই পাশাপাশি যদি দেখি পোস্টমাস্টার গল্পটিকে, তাহলে দেখব তার ট্রাজেডির ধরনটি একেবারেই আলাদা। এখানে সামাজিক সমস্যা বা পারিবারিক অত্যাচারের কিছুই নেই, ভালোবাসা থেকেই এই ট্রাজেডির জন্ম। অনামা এক পোস্টমাস্টার কলকাতা থেকে এসেছিলেন এক অজ পাড়াগাঁয়ে চাকরি নিয়ে। সেই গ্রামে তিনি যখন আত্মীয় পরিজনবন্ধুবিহীন অবস্থায় কথা বলার কাউকেই পান না, তখন বারো তেরো বছরের বাবা মা হারা যে অনাথ মেয়েটি তার গৃহকাজ করে দিত, সেই রতনই হয়ে ওঠে তার একমাত্র সঙ্গী। রতনকে  সামনে রেখেই পোস্টমাস্টার বলে যেতেন নানা পূর্বপ্রসঙ্গ ও চিন্তাভাবনা। রতনকে লেখাপড়া শেখানোর আয়োজনও তিনি করেছিলেন। রতনও অপেক্ষা করে থাকত পোস্টমাস্টার মশাই এর ডাকের জন্য। তার অসুস্থতার সময়ে ডাক্তার ডাকা, ওষুধ খাওয়ানো ও সেবা শুশ্রুষার সমুদয় দায়িত্ব সে তুলে নিয়েছিল নিজের কাঁধে।

দীর্ঘ রোগভোগের পর পোস্টমাস্টার মশাই বুঝলেন এই পাড়াগাঁয়ে তার থাকা আর চলবে না। বদলির আবেদন করলেন। তা মঞ্জুর না হওয়ায় চাকরী ছেড়েই ঘরে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন। রতন জানতে পারল পোস্টমাস্টারমশাই আর কোনওদিনই ফিরবেন না। সে কাতর কন্ঠে আকুতি জানালো পোস্টমাস্টার মশাই তাকেও সঙ্গে নিয়ে চলুন তার বাড়িতে৷ মৃদু হাস্যে এই অসম্ভব প্রস্তাবকে উড়িয়ে দিয়ে একাকীই ফেরার পথ ধরলেন তিনি। ফেরার আগে মাইনের প্রায় সবটা টাকা আর নতুন পোস্টমাস্টারকে তাকে সংসার কাজে পুনবর্হাল করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি রতনের ভবিষ্যৎ সুগম করতে চাইলেন। সে সব ঐহিক স্বাচ্ছন্দ্যকথা রতনের বেদনাকে কিছুমাত্র সান্ত্বনা দিতে পারল না। সে সুখী ছিল পোস্টমাস্টারের সঙ্গে। সেই সঙ্গসুখের বিনিময় খাওয়া পরা জোটার পার্থিব কিছু ব্যবস্থা দিয়ে হয় কী! গ্রাম ছাড়ার মুহূর্তে ঘরে ফেরার আনন্দই পোস্টমাস্টারকে ঘিরে রেখেছিল। রতনের উচ্ছ্বসিত কান্নার আবেগ তখন ততটা দাগ কাটেনি তার মনে। ফেরার পথে রতনের স্মৃতি ও ছায়া ক্রমশ দীর্ঘায়িত হতে লাগল তার মনে। ফিরে যাবার ইচ্ছেও হল৷ কিন্তু ফেরা হল না।

রতন আর পোস্টমাস্টার এর মধ্যবর্তী সম্পর্কের প্রকৃতিতে একটা ধূসরতা আছে, যা অন্যান্য অনেক রবীন্দ্র গল্পেও দেখা যায়। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক তপোব্রত ঘোষ লিখেছেন, "রতনের বয়স বারো তেরো। আলো আঁধারিতে দাঁড়িয়ে আছে বলেই পোস্টমাস্টার সম্বন্ধে নিজের হৃদয়ানুভূতিকে সে নিজেই স্পষ্ট বুঝতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ নারীপুরুষের মধ্যে অনেক সময় এমন একটি মিশ্র সম্পর্ক তৈরি করেন, যাকে বিশেষ কোনও সংজ্ঞায় সুপরিস্ফুট করা যায় না; যেমন 'মেঘ ও রৌদ্র' গল্পে শশিভূষণ-গিরিবালা সম্পর্ক; পোস্টমাস্টার আর রতনের সম্পর্কও অনেকটা অনুরূপ।" [রবীন্দ্র ছোটগল্পের শিল্পরূপ - পৃ ৫৫]

কয়েক মাসের জন্য কাছাকাছি এসে আবার চিরকালের জন্য আলাদা হয়ে গেল দুটি মানবপ্রাণ। সমাজ সময় এরপর এগিয়ে যাবে নিজের গতিতে, কিন্তু তাদের আর কোনওদিন কোনোভাবেই দেখা হবে না। পোস্টমাস্টার গল্পের এই ট্রাজেডি দেনাপাওনা গল্পের চেয়ে প্রকৃতিতে একেবারে আলাদা৷ নিরুপমার পরিণতি অনেক অনেক বেশি মর্মান্তিক, কিন্তু সে আঘাত মূলত সমাজ সংসারের অনিয়ম অনাচারের আঘাত। পণপ্রথাকে নিষিদ্ধ শাস্তিযোগ্য করে ভবিষ্যৎ নিরুপমাদের ট্রাজেডির প্রতিরোধ সম্ভব। পোস্টমাস্টার গল্পে রতনের ওপর যে আঘাত নেমে, তার সঙ্গে জড়িত হৃদয়ের কারবার। বাইরের সমাজ সংস্কারের নিয়ম কানুন বদলে তার সমাধান সম্ভবপর নয়৷ দেনাপাওনা গল্পটি আমাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ও ক্রোধান্বিত করে সামাজিক সংস্কারের জন্য উদ্যোগী হতে বলে আর পোস্টমাস্টার গল্পটি জীবনের সমাধান অযোগ্য বিরাট ও ব্যাপক ক্ষত ও ক্ষতির সামনে দাঁড় করিয়ে বিমূঢ় করে দেয়। বস্তুতপক্ষে হিতবাদীতে লেখা গল্পগুলির মধ্যেই শুধু নয়, রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ গল্পগুলির অন্যতম এই পোস্টমাস্টার গল্পটি। সন্দেহ নেই এই গল্পটির মাধ্যমেই রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্পের শিল্পোৎকর্ষর চরম বিন্দুটিকে প্রথমবারের জন্য স্পর্শ করেছিলেন।

সিদ্ধির চরমসীমা স্পর্শ করার পর আবার সাধারণে নেমে আসার সাহিত্যিক উদাহরণ কম নেই। বঙ্কিমচন্দ্র কপালকুণ্ডলায় শিল্পসার্থকতার অসামান্য শিখর স্পর্শ করার পরেই মৃণালিনীর মতো এক আপাত সাধারণ উপন্যাসের জন্ম দিয়েছিলেন। চোখের বালির শিল্পসার্থকতার পর নৌকাডুবিতে রবীন্দ্রনাথের ঔপন্যাসিক প্রতিভার পশ্চাৎ অপসারণ ঘটেছিল। ১২৯৮ বঙ্গাব্দের ২৪ জ্যৈষ্ঠ হিতবাদীতে বেরিয়েছিল পোস্টমাস্টার। এর সাতদিন পর ৩১ জ্যৈষ্ঠ বেরোয় গিন্নি গল্পটি। এক মাস্টারমশাইয়ের ছাত্রদের ওপর নানাবিধ অত্যাচারের কথা এই গল্পের মূল বিষয়বস্তু। অসংখ্য ছাত্রের ওপর অজস্র নির্যাতনের মধ্যে আশু বলে এক বালকের ওপর একটি বিশেষ নির্যাতনের ঘটনা, তাকে সর্বসমক্ষে গিন্নি নাম দিয়ে সকলের কাছে উপহাস্যস্পদ করে তোলা নিয়ে এই গল্পটির আখ্যানভাগ তৈরি করেছেন রবীন্দ্রনাথ। অত্যাচারী শিক্ষক শিবনাথ পণ্ডিতের ওপর খানিক রাগ, আর নিজ ছাত্রজীবনের কিছু সমগোত্রীয় স্মৃতির রোমন্থন ছাড়া এই গল্প থেকে পাঠক বিশেষ কিছু পাবেন না। রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ ছোটগল্পই শিল্পগুণে অসামান্য। কয়েকটি অকিঞ্চিৎকর গল্পের তালিকা করতে হলে তার মধ্যে 'গিন্নি' গল্পটিকে ফেলা যেতে পারে।

রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা গল্পের বিষয়বস্তুটি সাধারণ কিন্তু তার প্রকাশভঙ্গীতে চমৎকারিত্ব আছে। রামকানাই এর দাদা মারা যাবার সময় যে উইল করলেন, তা রামকানাই নিজ হাতে লেখেন ও মৃত্যুপথযাত্রী দাদা গুরুচরণ তাতে কাঁপা হাতে কোনোরকমে সই করেন। এই উইলে দাদা সকল সম্পত্তি নিজের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীকে দিয়ে গেলেন। রামকানাইয়ের যদিও আশা ছিল অপুত্রক দাদা রামকানাইয়ের পুত্র নবদ্বীপকেই দিয়ে যাবেন। নবদ্বীপ ও তার মা রামকানাইয়ের ওপরেই অনেক দোষ চাপালেন, মূল অভিযোগ দাদা মৃত্যুকালে যাই বলুন রামকানাই অন্যরকম লিখে নবদ্বীপের ভাগে সম্পত্তি আসার ব্যবস্থা করে দিতেই পারতেন। মৃত্যুপথযাত্রী গুরুচরণ রামকানাই যা লিখতেন তাতেই সই করে দিতেন। স্ত্রী পুত্রের গঞ্জনা সহ্য করেও রামকানাই উইল দিয়ে এলেন গুরুচরণের স্ত্রী বরদাসুন্দরীকে।

এরপর নবদ্বীপ বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে সম্পত্তি হাতানোর পরিকল্পনা করল। রামকানাইকে কাশীতে পাঠিয়ে উইল জাল করা হল। কাশী থেকে ফিরে এসে উইল জাল মামলায় আদালতের সমন পেয়ে সাক্ষ্য দিতে গেলেন রামকানাই। ততদিনে তিনি উইল জালের কথা জেনেছেন ও পরিতাপে আহার নিদ্রা প্রায় ত্যাগ করেছেন। নবদ্বীপ অনেককে হাত করে মামলা জেতার অবস্থায় পৌঁছে গেছিল, কিন্তু রামকানাই আদালতে সত্যি স্বীকার করে বয়ান দেওয়ায় সম্পত্তি হাতছাড়া হল। শুধু তাই নয় উইল জাল করার অপরাধে সপার্ষদ নবদ্বীপের কারাদণ্ড হয়ে গেল।

ঘটনার অভিঘাতে আহত হয়ে ও সকলের তর্জনে যন্ত্রণা পেয়ে প্রাণত্যাগ করলেন ভগ্নমনোরথ রামকানাই। তাঁর সততা সবার কাছেই নির্বুদ্ধিতা বলে সাব্যস্ত হল। সংসার বুদ্ধি কীভাবে ন্যায় নীতির ঊর্ধ্বে স্থান পায়, গল্পের নামকরণে তার ছাপ রাখলেন রবীন্দ্রনাঘ।

এই গল্পের মূল আকর্ষণ হল রচনার মধ্যে মিশে থাকা স্যাটায়ার। সেই স্যাটায়ার সৃষ্টির জন্য যে তির্যক বাকরীতি ও ভাষা ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রনাথ, তা শব্দশিল্পী হিসেবে তাঁর অসামান্যতা প্রকাশ করে। পরিহাসবোধ সঞ্চারে তিনি কতটা পারঙ্গম ছিলেন, এই গল্পে তারও অনেক প্রমাণ আছে।

পরবর্তী ব্যবধান গল্পটি বেশ সাদামাটা একটি গল্প। বনমালী ও হিমাংশু মামাতো পিসতুতো ভাই। বনমালী বয়সে অনেকটা বড়, সে হিমাংশুকে কোলেপিঠে করে অনেক আদরে বড় করেছে। নিজে বনমালী খুব বেশি পড়াশুনো করে নি, কিন্তু পড়ুয়া স্বভাবের হিমাংশুকে সে খুব শ্রদ্ধা করে। ছোট ভাইয়ের সব কথাই গুরুত্ব দিয়ে শোনে। বনমালীর জীবনে কেন্দ্রীয় অবস্থানটি ভাই হিমাংশুর। একদা দুই পরিবারের মধ্যে অকিঞ্চিৎকর একটি ছোট নালার অধিকার কার তাই নিয়ে বিবাদ বাধল। মামলায় বনমালীদের জিৎ হতেই তার কাছে আসা বন্ধ করে দিল হিমাংশু। একদিন দুদিন করে বেশ কিছুদিন হিমাংশুর প্রত্যাশায় বসে থেকে বনমালী অবশেষে বুঝল চূড়ান্ত ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে। দুই ভাইয়ের মিলনের আর কোনও পথ নেই।

তারাপ্রসন্নর কীর্তি গল্পটি আদ্যন্ত মজাদার কিন্তু তার পরিণতি বেদনাদায়ক। গল্পের তারাপ্রসন্ন সংসার অনভিজ্ঞ এক লেখক। তার লেখার উচ্চমান সম্পর্কে স্ত্রী দাক্ষায়ণীর অগাধ বিশ্বাস। সেই লেখা তিনি কিছুই বোঝেন না বলে তার উচ্চগুণ সম্পর্কে আরো বেশি নি:সংশয় হন। তিনিই তাঁর গয়না বন্ধক রেখে সেই টাকা দিয়ে তারাপ্রসন্নকে কলকাতায় গিয়ে বই ছাপানোর প্রস্তাব দেন। সেই মোতাবেক তারাপ্রসন্ন কলকাতায় আসেন ও বেদান্তপ্রভাকর নামে বই প্রকাশ করেন। নানা কাগজে বইটি নিয়ে আলোচনা হয়, গ্রন্থাগারগুলি সেটি চেয়ে চিঠি লেখে। কিন্তু বই বিক্রি হয় না। দাক্ষায়ণী ভেবেছিলেন চার মেয়ের বিবাহের টাকা স্বামী বই বিক্রি করেই জোগাড় করে ফেলতে পারবেন। বাস্তবে হয় তার উলটো। বই বিক্রি করে টাকা তো আসেই না, উল্টে ক্ষতি হয়। এমত অবস্থায় দাক্ষায়ণী পঞ্চম কন্যা সপ্তমটির জন্ম দেন ও বলে যান এর নাম যেন স্বামীর বইয়ের নামে বেদান্তপ্রভাকর রাখা হয়। স্বামীকে নানা সতর্কতামূলক নির্দেশ দিয়ে দাক্ষায়ণী প্রয়াত হন। যে গল্প কৌতুক আর পরিহাসে এগোচ্ছিল, শেষে দাক্ষায়নীর মৃত্যুতে তা চকিতে বদলে যায় ও পাঠকমনে এনে দেয় ধাক্কার অভিঘাত।

হিতবাদী পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সেখানে ধারাবাহিকভাবে পরপর ছয় সপ্তাহে ছটি গল্প লেখেন। গোটা সাহিত্য বিভাগটি নিয়েও নানা পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তারপরই কোনও এক কারণে হিতবাদী থেকে তিনি দূরে সরে আসেন। রবিজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাসকে উদ্ধৃত করে জানাচ্ছেন, "রবীন্দ্রনাথ এই প্রসঙ্গে আমাদের বলিয়াছেন যে, এই কয়েকটি গল্প ভির হইবার পর সম্পাদক কৃষ্ণকমল তাঁহাকে বলেন, গল্পগুলি সাধারণের পক্ষে গুরুপাক হইতেছে, আরও লঘু রকমের রচনা আবশ্যক। এই কথায় রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত হইয়া হিতবাদীতে লেখা ছাড়িয়া দেন।" [রবিজীবনী - প্রশান্তকুমার পাল, তৃতীয় খণ্ড, পৃ - ১৮৩] কৃষ্ণকমল কোন ধরনের পাঠকরুচির কথা মাথায় রেখে রবীন্দ্রনাথকে ভিন্ন স্বাদের গল্প লেখার প্রস্তাব দিয়ে থাকতে পারেন, সেই সম্পর্কিত অনুমানে আমাদের সাহয্য করতে পারে ১২৯৮ সালে নবভারত পত্রিকায় প্রকাশিত একটি মন্তব্য। "গল্পগুলিতে একটু প্লট না থাকিলে, তাহা প্রায় মনোহর হয় না। তারপর কী হইল, জানিবার ইচ্ছা যে গল্পে উদ্দীপিত না করে, সেই গল্পই অধিকাংশস্থলে প্রায় পঠিত হয় না।" [(হিতবাদী, নব্যভারত, আষাঢ়, ১২৯৮, পৃ ১৩৯) - এই আকরটি আমরা পেয়েছি রবীন্দ্র ছোটগল্পের শিল্পরূপ - তপোব্রত ঘোষ - বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায়।]

হিতবাদী থেকে শুরু করেন সাধনা পত্রিকা নিয়ে কাজ। ততদিনে ছোটগল্পর শৈলিটি তাঁর মনকে অধিকার করে নিয়েছে৷ হিতবাদীর পর আবার তিনি গল্প লেখা শুরু করলেন সাধনা পত্রিকায়। প্রথমেই এল অসামান্য একটি গল্প - খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন। তারপর একে একে সম্পত্তি সমর্পণ, দালিয়া, কঙ্কাল ইত্যাদি। সাধনা পত্রিকায় বছর পাঁচেকের পর্বটিতে প্রকাশিত গোটা চল্লিশেক গল্পের মধ্যে বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রনাথ তথা বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত সৃষ্টি। এই তালিকায় আমরা রাখতে পারি - খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, কঙ্কাল, একরাত্রি, জীবিত ও মৃত, কাবুলিওয়ালা, মধ্যবর্তিনী, শাস্তি, সমাপ্তি, মেঘ ও রৌদ্র, ক্ষুদিত পাষাণ ইত্যাদি সুপরিচিত গল্পকে। হিতবাদীতে যার সূচনা, তাই ফুলে ফলে পূর্ণ বিকশিত হয় সাধনা পত্রিকার পাতায়। সে সম্পর্কে আমরা পরে বিস্তারিত আলোচনা করব।