কল্পবিশ্বের কল্পবিজ্ঞান : সাম্প্রতিক কিছু প্রকাশনা প্রসঙ্গে

শোনা যায় গড়পড়তা বাঙালি নাকি এমনিতেই পড়াশোনা করা ছেড়ে দিয়েছে। প্রতিবার মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময় কিছু বাবা-মা-ছেলে-মেয়ে মড়াকান্না কাঁদে কেন তাদের অন্যের খাতা দেখে কিম্বা টুকলি করে পরীক্ষায় লিখতে দেওয়া হচ্ছে না। তেমন তেমন ক্ষেত্রে ঘেরাও করার ঘটনাও ঘটেছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে বাংলা গল্পের বই পড়া! হুঁহু বাবা, এমন মধুর বাংলা সিরিয়াল থাকতে বই কেন ঘাটব?

আবার, বর্তমানে চলছে তন্ত্রের ঢেউ। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা সব তন্ত্র বিশেষজ্ঞরা চমৎকার সব গল্প ফাঁদছেন, তান্ত্রিকেরা সেই সব পড়ে স্রেফ চুপ মেরে যাচ্ছেন। মনে মনে ভাবছেন, বাব্বাঃ! তন্ত্রের পেটে পেটে এতকিছু আছে! আমরা এতদিন ধরে সাধনা-টাধনা করছি। কই কিছু তো তেমন দেখলাম না! আমাদের জীবনটা তো দেখছি ষোলো আনাই বৃথা!

লুতুপুতু প্রেমের গল্প এখনও সমান জনপ্রিয়। লোকে সেইসব গল্প পড়ে পরকীয়া কিম্বা নিজকীয়া করবেন। আর রইল বাকি জ্যেঠু-কাকুরা। যারা পুরোনো লেখকের বই নতুন করে কেনে, পোস্ট দেয়, এই দেখুন, কেমন এই বইটা কিনলাম। আহা! কি গল্প! এমন গল্প পড়েও সুখ। নতুন জেনারেশানটা একেবারে উচ্ছন্নে গেছে... কিস্যু লিখতে পারো না তোমরা। স্রেফ পাতে দেওয়া যায় না।

মোদ্দা কথা, বাংলা সাহিত্য চরম সঙ্কটে দাঁড়িয়ে আছে বললে অত্যুক্তি করা হবে না।

এই ভজোকটো সময়ে মধ্যে সন্তু বাগ আর দীপ ঘোষ-রা খুললেন সাই ফাই-এর ওপর একটা আস্ত প্রকাশনা বিভাগ। ‘কল্পবিশ্ব’ নাম দিয়ে আগে একটা ওয়েব ম্যাগাজিন গজাল। কয়েক বছর ধরে বড়ো সুন্দরভাবে সেই ওয়েবজিন রমরমিয়ে চলছে। আর তারপর, বানালেন একটা গোটা প্রকাশনা বিভাগ, যে বিভাগ শুধুমাত্র কল্পবিজ্ঞান বিষয়কে কেন্দ্র করে।

বাংলা সাহিত্যে চিরকালই বিজ্ঞান ব্রাত্য। পপুলার সায়েন্সের ওপর জাঁক করে বলার মতো তেমন কোন বই নেই। পথিক গুহ বা যুধাজিৎ দাশগুপ্ত প্রবন্ধ লেখেন বটে, কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের কোন বই লিখতে ব্যর্থ। কারণ, ভেতো বাঙালী পাঠক তা চায় না। বর্তমানে বাঙালীরা অবশ্য সত্যজিৎ রায় > সন্দেশ > আনন্দ পাবলিশার্স > শিশু সাহিত্য > শঙ্কু এরকম একটা সমীকরণ হওয়ার পর চুষিকাঠি মুখে দিয়ে ‘শঙ্কু সমগ্র’ নিয়ে নাচানাচি করে চলেছে। যেন তাদের শৈশব আর কিছুতেই কাটতে চাইছে না। আর কিছু সত্যজিৎ রায়ের আরো কিছু কল্পবিজ্ঞানঘটিত ছোটগল্পের ল্যাবেঞ্চুশ নিয়ে ভারি ব্যস্ত। অথচ, শঙ্কুকে কেন্দ্র করে অনেক আগেই একটা কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক জঁরের আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠা উচিৎ ছিল। বেশ কিছু লেখকের আমবাঙালীর গেরস্থ বাঙালির ঘরের শোভা হিসাবেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠা উচিত ছিল।

অদ্রীশ বর্ধন, রণেন ঘোষ, দিলীপ রায়চৌধুরীরা চেষ্টা করেছিলেন। ‘আশ্চর্য’ কিম্বা ‘ফ্যান্টাস্টিক’ ভেতো বাঙালীর পোষালো না। বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু তবুও, ব্যাটনটা রইল এবং বর্তমানে সেটা উঠে এল কল্পবিশ্বের হাতে। আর এখান থেকেই তাদের যাত্রা শুরু। সার্থক যাত্রা শুরু বলতে হবে।

আমি এই প্রকাশনা বিভাগের বেশ কিছু বই পড়লাম। বলতে বাধ্য হচ্ছি, তাদের এই মরণপণ প্রচেষ্টা আমাকে বিস্মিতই করেছে। ভালোও লেগেছে। আমি সর্বান্তঃকরণে তাদের সফলতা প্রার্থনা করি। তারা একটার পর একটা যে-সমস্ত বই বার করে চলেছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। কটা বই বিক্রী হচ্ছে, তার ধার না ধরে, ভালো বই বের করার দিকে যতদিন তারা ঝুঁকে থাকবেন ততই মঙ্গল, ততই তারা এগোবে। ভাবীকাল তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। যেদিন পপুলার লেখার দিকে মন দেবেন, বাঙালী সায়েন্স প্রীতি আবার পচা কেষ্টপুর খালের মধ্যে গিয়ে সেঁধুবে।

পাশাপাশি, কল্পবিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতিও নজর দিচ্ছে সমানভাবে। পাঠকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছাড়াও, বেশ কিছু আলোচনাচক্র, অনলাইন এবং অফলাইন বৈঠক আয়োজন করে এবং সেখানে বেশ ভাবগম্ভীর আলোচনাও হয়।

তাদের কাজের প্রতি লক্ষ্য রাখলে, দেখা যায়, তারা মূলত তিন ধরনের বই বের করছে। এক, ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’ ধরে নিয়ে স্বর্ণযুগের লেখকদের লেখা আর অনুবাদকে পুণরায় প্রকাশ করছে; দুই, প্রায় নতুন বিদেশি লেখকদের অনুবাদ করছে; আর তিন, বর্তমান লেখকদের সুযোগ দিচ্ছেন। এই তিনের ত্রহ্যস্পর্শের সাথে তাদের প্রকাশনা বিভাগে প্রাণ এনে দিয়েছে অনলাইন কেনাকাটার সুযোগ। আর ই-বুকের চমৎকার বন্দোবস্থ। শেষোক্ত দুটো বর্তমান সময়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধিমান পদক্ষেপ।

তাদের কাজের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ, এখনও পর্যন্ত, আমার মতে, এডগার এলান পো রচনা সংগ্রহের বক্স সেট। মোট বাহাত্তরটা গল্প অনুবাদ করেছিলেন অদ্রীশ বর্ধন। সেই অনুবাদের দুই খন্ডের মনমাতানো বক্স সেট, যা রীতিমতো আন্তর্জাতিক মানের। আমি মাঝে মাঝেই সেটটার দিকে তাকাই, হাত বোলাই পরম যত্নে। এমনভাবে কোন বই আগে এসেছে কি? জানি না। কি তার বাইন্ডিং, কি তার পেজ কোয়ালিটি, বইয়ের মাঝে মাঝে ছবি ও সেই সঙ্গে পাদটীকা।

এছাড়াও আরোও যে সমস্ত বই তারা বের করেছে, সেগুলোর কিছু কিছু পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। সেগুলো নিয়ে কিছু বলার লোভ সামলাতে পারছি না। মানে ছোট্ট ছোট্ট রিভিউ আর কি। প্রতিটা বইয়ের কোয়ালিটি একই রকমের উচ্চমানের। কিন্তু বইয়ের ভেতরে কি আছে, আমার মনে হয়, পাঠকদের কাছে সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এতএব, এক এক করে সেগুলো বলি -

রে ব্র্যাডবেরী। কি সুন্দরভাবে তাঁর তিনটে বই বের করল কল্পবিশ্ব! ‘ফারেনহাইট ৪৫১’, ‘মঙ্গল গ্রহের ডায়রী’ আর ‘চিত্রবিচিত্র মানুষ’। বক্সসেট একটা বানালে আরও চমৎকার হত যদিও। কিন্তু কিছু না বেরোনোর থেকে বেরোনো ভালো। বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বে যে সমস্ত লেখকেরা এই জঁরের কাহিনী লিখে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তাদের লেখা আরও বেশি করে আসা উচিৎ।

ফারেনহাইট ৪৫১ - মূল গল্প নিয়ে আলোচনার কোন মানে হয় না। যদি অল্প কথায় বোঝাতে হয়, তাহলে গল্পটা এই, একটা শহর তথা রাষ্ট্রে বই পড়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যারা বই পড়ে, হয় তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, অথবা তারা দেশান্তরী হয়। ফায়ারম্যান, যারা এক সময়ে আগুন নেভানোর কাজ করত, তারা এখন বই জ্বালানোর কাজ করে। এমনই এক ফায়ারম্যান গাই মন্টাগকে কেন্দ্র করে এই কাহিনী এগিয়ে চলে।

বই পোড়ানো অর্থটা প্রতীকী, এটা সহজেই বোঝা যায়। আসলেই আমরা পড়তে চাই না। পড়ার অর্থই হল চিন্তার ক্ষেত্রটাকে প্রশস্ত করা। কেন চিন্তা করব? চিন্তা আমাকে সুখ দেয় না। স্বচ্ছন্দ দেয় না। সে আমাকে রাতদিন অস্বাছ্যন্দে রাখে। আমার প্রতিদিনকে চ্যালেঞ্জ করে --- “শান্তি মন্টাগ, শান্তি। দ্বিধা, প্রশ্ন এই সবকিছু ভুলিয়ে দাও। ... সোজা কথায় লোকজনের মাথাগুলো অদাহ্য তথ্য দিয়ে বোঝাই করে দাও। একেবারে ঠেসে ঠেসে সাধারণ জ্ঞান ভরে দাও। আর এভাবে মাথাগুলোকে ভরিয়ে দিতে পারলেই দেখবে লোকজন খানিক আইঢাই করবে বটে কিন্তু নিজেরা কেমন জানে সেই নিয়ে খুশি থাকবে। ... ভাববে ভীষণ চিন্তাশীল তারা। ... আর, ওর বদলে তাদের খানিক পিছলে জ্ঞান দিয়ে দেখ। পিছলে জ্ঞান, মানে এই ধরো দর্শন, সমাজতত্ত্ব এইসব আরকি। সেখানে প্রশ্ন থাকে। ... লোকজনের সব স্ফুর্তি গায়েব হয়ে যাবে।”

রে ব্র্যাডবেরি আমাদের জন্যে রেখে গেলেন ফারেনহাইট ৪৫১। দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য আমাদের জন্যে উপহার দিলেন আন্তর্জাতিক মানের মাতৃভাষায় অনুবাদ।

মঙ্গল গ্রহের ডায়েরি - যশোধরা রায়চৌধুরী আপাদমস্তক কবি। কবি অর্থে, যার অন্তরে এক দৃষ্টি জন্মেছে। কোন লেখক যখন কবি হন, তা যেন ঈশ্বরের মহাপ্রসাদের মতো। কিম্বা সরস্বতীর অপাঙ্গ দৃষ্টিপাতের মতো। যশোধরা রায়চৌধুরী এই অনুবাদের কাজ নিজের চেতনসত্ত্বাকে নিংড়ে দিয়ে করেছেন। "মার্শিয়ান ক্রনিকলস সায়েন্স ফিকশান বা কল্পবিজ্ঞান গোত্রের বই। এবং এর জনরাঁ 'ফিক্স আপ' নভেল।" লিখছেন অনুবাদিকা বইয়ের মুখপ্রবন্ধে। অর্থাৎ, এই উপন্যাস যেন বিভিন্ন সময়ে একই বিষয়বস্তুর ওপর লেখা ছোটগল্পগুলোকে একটা সুতোয় গেঁথে নিয়ে উপন্যাসের মালা বানানোর খেলা। যন্ত্রসভ্যতার ওপর রে ব্র্যাডবেরির যে একটা তিক্ততা বোধ ছিল, সেটা বোঝা যায় এই উপন্যাসের শেষে যন্ত্রসভ্যতার ভয়ঙ্কর পতনের সংকেতের মধ্যে দিয়ে।

ব্র্যাডবেরি কবি। তার কিছু কিছু গল্পের মধ্যে এই কবিত্ব চরম পর্যায়ে পৌছেছে। যশোধরা রায়চৌধুরীও কবি। যোগ্য সঙ্গত করেছেন।

ব্র্যাডবেরি জৈবিক সভ্যতাকে কিভাবে দেখতেন? অনেকটা আলবেয়ার কামু’র মতো কি? তার ‘মিথ অফ সিসিফাস’-এর এক পর্যায়ের প্রশ্নই কি ব্র্যাডবেরির ‘তৃতীয় অভিযান’-এ নেই - “আমরা যখন পৃথিবীতে ছিলাম, সেখানেও তো কেউ বলেনি আমাদের, কেন সেখানে ছিলাম আমরা। মানে, আমি ওই পৃথিবীটার কথা বলছি আর কি, বুঝেছ তো? যেখান থেকে তোমাদের আগমন! কেউ কি সত্যিই জানে, যে তার আগে আরও একটা পৃথিবী ছিল কি না আমাদের?” অর্থাৎ, আমাদের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য কি? কেন আছি আমরা? আমাদের অস্তিত্বের সার্থকতা কোথায়? আদৌ ‘সার্থকতা’ ব্যাপারটার কোন মানে আছে কি?

রে ব্র্যাডবেরি কি এর উত্তর পেয়েছিলেন? দিয়েছিলেন কি তার অন্য কোন লেখায়??

চিত্রবিচিত্র মানুষ - আমার মনে হয়, ঠিক এই লাইনটার মর্মার্থের ফল্গুধারা এই গল্প সংকলনের পরতে পরতে বয়ে গেছে। যেমন ‘ক্যালাইডোস্কোপ’, যেমন ‘কোনও বিশেষ রাত বা সকাল নয়’। পরের গল্পটার একটা জায়গায় তো সরাসরি প্রশ্ন --- “এ জীবনে কেউ কেন কিছু করে, কেউ কি বলতে পারে?” কিম্বা “বোকা আমরা সবাই... সর্বদাই। তবে ওই যা, এক-একদিন এক-এক ধরনের বোকা। আমরা ভাবি, আজ আর আমি বোকা নই। যা শিক্ষা নেওয়ার নিয়েছি। গতকাল বোকা ছিলাম বটে, তবে আজ নই। তারপর আগামীকাল বুঝব, হ্যাঁ, আজকেও বোকা ছিলাম। আমার মনে হয়, আমরা যে নিখুঁত নই সেটা ধরে নিয়ে বাঁচাটাই এই দুনিয়ায় আমাদের মানসিক উন্নতি করার, টিকে থাকার একমাত্র উপায়।” এই গল্পে রে ব্র্যাডবেরি কি নিজের চিন্তাভাবনাকেই কাঁটাছেঁড়া করার চেষ্টা করেছিলেন?

এই গল্প সংকলনটিও হয়তো ‘ফিক্স-আপ’ নভেলের দিকে যেতে পারত। কিন্তু ‘ভাগ্যচক্র’ নামক ছোটগল্প থেকে সেই যে চিত্রবিচিত্র মানুষটি ভ্যানিশ হয়ে গেলেন, তাকে হঠাৎ করে ‘চিত্রবিচিত্র মানুষ’ নামক শেষ গল্পে ফিরিয়ে আনতেই মনে পড়ে গেল, ও আচ্ছা! এটা তো এই মানুষটার গায়ের থেকে বেরিয়ে আসা গল্পগুলো! তবে এই গল্পটার মধ্যে সায়েন্স ফিকশানের মাঝেও যে এভাবে ম্যাজিক রিয়েলিটি সুচারুভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, না পড়লে এই অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতাম। আর রে ব্র্যাডবেরি একবার, মাত্র একবারই দেখলাম ঈশ্বরকে কিভাবে দেখতেন, আমাদের জানাচ্ছেন। ‘সেই মানুষটা’ গল্পে বোঝা যায়, ঈশ্বরকে কত আপন করে অনুভব করেছেন তিনি। তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন নিজের মতো করে। কিন্তু, মাত্র ঐ একবারই।

অনুবাদ অসাধারণ। একদম অনুভবি অনুবাদ। রে ব্র্যাডবেরির তিনটে অনুবাদই বিশ্বমানের। এমন অনুবাদ পড়লে, যারা বলে, মূল ভাষায় লেখার মাধুর্য ইত্যাদি ইত্যাদি, তাদেরকে বলতে ইচ্ছা করে ‘গোলি মারো মূলভাষা’, আ মরি বাংলা ভাষাতেই আমি হাসতে-কাঁদতে চাই।

তিনটে বইয়ের অনুবাদ, পেজ কোয়ালিটি আর সাইজ --- অসাধারন। রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে যেমন সঙ্গে নেওয়া যায়, তেমনি বইয়ের ঝকঝকে ভাব সামান্য যত্নেই অনেকদিন থাকবে।

দ্য গ্রেট গড প্যান এবং দ্য হোয়াইট পিপল - ভয় পাওয়ানো, আর ভয় ধরিয়ে দেওয়ার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। জুজুবুড়ি টাইপ গল্পে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করানো হল ভয় পাওয়ানো। এখানে চট করে কোন শিশু বা শিশুতুল্য মানুষকে কিছুক্ষণের জন্যে বিশ্বাস করানো যায় এক অসম্ভব অস্তিত্বের সম্পর্কে, টেকে না বেশিদিন; আর অন্যদিকে, এক অপার্থিব অস্তিত্বকে বিশ্বাস করানো, একেবারে মূলে গিয়ে বিশ্বাস ধরিয়ে দেওয়া --- ভয় পাওয়ানো। এটার প্রভাব অমোঘ। অনেক ক্ষেত্রে ‘কাল্ট’ ব্যাপারটার সৃষ্টি হয়। ‘বাণ মারা’ এমনই এক বাংলা ভয় দেখানো ছেলেমানুষি। বিশ্বাস করতে মন চায় না, অথচ এড়িয়ে যেতে গেলেও বুক ধুকপুক করে। যে কারনে তান্ত্রিকদের এত রমরমা।

আর্থার ম্যাকেন ভয় ধরাতে পারেন। কারণ, তার লেখার কনটেন্টের মধ্যে প্রথমেই যে অপার্থিব জগতের সন্ধান দেন, তা আমাদের মরজগতের সমান্তরালে অবস্থান করে। এবং পাঠকদের এই দুই জগতের ঠিক মাঝামাঝি ফেলে রাখেন।

তার দুটি বিখ্যাত নভেলা ‘দ্য গ্রেট গড প্যান’ এবং ‘দ্য হোয়াইট পিপল’ যখন আমি পড়ছিলাম তখন ছিল মধ্যরাত্রি। সারা দুনিয়া নিস্তব্ধ। শীতের রাতে দুরাগত ট্রেনের হুইসলও তখন খুব কাছের মনে হয়। সেখানে মনে মনে পরলেও মনে হয় যেন জোরে জোরে পড়ছি। এমনকি যা পড়ছি সেই চরিত্রগুলোও কেমন যেন বাস্তব হয়ে ওঠে।

 

শ্রেষ্ঠ বারোটি রচনা : এইচ পি লাভক্র্যাফট - এইচ পি লাভক্র্যাফটকে, কল্পবিশ্ব ‘ভয়াল রসের সম্রাট’ অভিধায় ভূষিত করেছে, খুব একটা ভুল বলে নি, যদিও, আমার মতে, তিনি বীভৎস রস সৃষ্টি করেছেন। কেন ভয়াল নয়? কারণ, লাভক্র্যাফটের অপার্থিব চরিত্রগুলো ‘ভীষণ’ বা ‘ভয়ানক নয়’, ‘অত্যন্ত কদর্য’ বা ‘ঘৃণা-উৎপাদক’ ।

এবং এটাই লাভক্র্যাফটের লক্ষ্য ছিল বলে মনে হয়। জ্ঞানত, কিম্বা অজান্তে।

“The oldest and strongest emotion of mankind is fear, and the oldest and strongest kind of fear of the unknown.”, বলছেন লাভক্র্যাফট। লাভক্র্যাফটের জীবন পর্যালোচনা করলে হয়তো দেখা যাবে, শিশুকালের সঙ্গে এর নিবিড় যোগ আছে। খানিকটা আভাস বিশ্বদীপ দে-র লেখায় পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তা লাভক্র্যাফটের ব্যাপারে কৌতুহল জাগায়, তাকে আরেকটু গভীরে জানতে গেলে তার জীবন আর মানসিক অবস্থার কথা ঘাটতে হবে আরও।

আমার মনে হয়, এই ফারাকটার কারণেই বাঙালী জনমানস লাভক্র্যাফটকে বর্জন করেছে। তার লেখা নিয়ে আলোচনা তো দূর, পড়তেও খুব একটা আগ্রহী নয়। বাঙালী ‘ভয়’ পছন্দ করে, ‘বীভৎসতা’ পছন্দ করে কি? এছাড়াও ভয়কে খুঁজতে গিয়ে স্বপ্নকে নিয়ে, সুররিয়ালকে নিয়ে নাড়াঘাটা করতে গিয়েও সেই বিষয়গুলোকে পাঠকমানসে বিশ্বস্ত করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন।

এই প্রথম, কোন বইয়ের সটীক সংস্করণ এত ভাল লাগল। লাভক্র্যাফটের সাথে আলাপ করতে গেলে, নিঃসন্দেহে এই বইটা যথাযথ। এমন বই-ই আমি আশা করেছিলাম রে ব্র্যাডবেরির ক্ষেত্রেও। এক্ষেত্রে সন্তু বাগ এবং দীপ ঘোষ দুজনেই সমান প্রশংসার দাবীদার। অনুবাদ নিয়ে কিছু বলার নেই। সুমিত বর্ধন থেকে শুরু করে সৌমেন চ্যাটার্জি প্রত্যেকেই দুরন্ত অনুবাদ করেছেন। কল্পবিশ্বের অনুবাদক যারা, তারা সত্যিই অতুলনীয়। আমি কোন অনুবাদকেই মোটামুটি বলতে পারছি না। প্রত্যেকটা সমান প্রশংসার দাবিদার। আর এর প্রচ্ছদটাও চমৎকার।

এই জি ওয়েলস কল্পগল্প সমগ্র - ‘সায়েন্টিফিক রোমান্স’ আসলেই জিনিসটা কি, আমি শিখেছিলাম জুলে ভের্নের কাছ থেকে। তার ‘এরাউন্ড দ্য ইয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেজ’ কিম্বা ‘মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’ --- সবকিছুতেই এমন অদ্ভুত এক মানবিকতার ছাপ ছিল, যার অনুভব আমি এখনও চোখ বন্ধ করলেই অনুভব করতে পারি।

অনেকদিন পর, এইচ জি ওয়েলসের মধ্যে আবার সেই অনুভূতিটা পেলাম। এমনকি, ওনার লেখা ছোটগল্পগুলো পড়তে পড়তে এও বুঝতে পারছিলাম, ওয়েলস, কীভাবে বাংলা সাহিত্য জগতে, বিশেষত কল্পবিজ্ঞান জগতে প্রভাব ফেলেছেন গভীরভাবে, অবচেতনে।

তো, এই হল এইচ জি ওয়েলস। যিনি নিজেও লেখেন, অন্যদেরকেও লিখতে অনুপ্রাণিত করেন, শুধু তাই নয়, তার লেখার ছাপ থেকে সরে থাকার কোন উপায় থাকে না, কারণ, এই লেখক পাঠক, এমনকি লেখকের অবচেতন মনেও গভীর ছাপ ফেলে যান, ঠাহর করে ওঠা যায় না। একজন লেখক কতটা সার্থকভাবে মনের মধ্যে স্থান করে নিলে এমনটা সম্ভব ভাবলে অবাক হতে হয়।

বাঙালীর মজা হল, এমন একজন লেখককে স্টাডি না করে স্রেফ এবং স্রেফ গিলে ফেলার অসম্ভব ক্ষমতা রাখা। কোন প্রকাশক, বা কোন লেখক নিজের মতো করে উদ্যোগ নিলেন না পুরো ওয়েলসের সার্থক অনুবাদ করার। বিক্ষিপ্ত কিছু লেখা, বিশেষত যেগুলো লিখলে বাজার কাটবে, বিক্রী হবে বেশি সেগুলোর দিকেই নজর দেওয়া হল। ফলে পুরো ওয়েলস পড়তে হলে মূল ইংরাজী ছাড়া গতি নেই। অদ্রীশ বর্ধনের নিজস্ব উদ্যোগে যেকয়টা অনুবাদ হল, সেগুলোই আবার পুনরায় মুদ্রিত করা ছাড়া আরোও এগোনোর কোন উদ্যোগ এখনও নেই। বাংলা কল্পবিজ্ঞানের যা দশা তাতে করে ওয়েলসই আবার ফিরতে পারলে ভালো। না হলে তরুণ প্রজন্মের হাতে বিজ্ঞানের নবতম কল্পকাহিনী লেখার উদাহরণ এখনও হাতে গোনা।

স্বর্ণযুগের লেখকদের কাজও সামনে আনার প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন কল্পবিশ্বের কান্ডারীরা। তার দু-একটা উদাহরণ দেওয়া যাক

মিলক গ্রহে মানুষ - ‘মিলক গ্রহে মানুষ’ উপন্যাসটা পড়ার ইচ্ছে জেগেছিল মূলত দুটো কারণে --- এক, এর অদ্ভুত প্রচ্ছদ, এবং দুই, অদ্রীশ বর্ধনের মৌলিক লেখা।

এরকম একটা প্রচ্ছদের ওপরে আকর্ষণের কারণ আমি প্রথমে বুঝতে পারি নি। অনেকদিন ধরেই বইটা চোখের সামনে ঘোরাফেরা করছিল, এমনিই ফেলে রেখেছিলাম, কিন্তু তবুও, টানছিল আমাকে নিতাই ঘোষের আঁকা ওই অদ্ভুত প্রচ্ছদটা। কিছু একটা চেনা, তবুও যেন চিনতে পারছিলাম না।

অবশেষে একটানে বইটা শেষ করলাম। কিশোর উপন্যাস। পড়তে পড়তে একটা কনসেপ্টে এসে আসল ব্যাপারটা খোলসা হল। তা হল, মগজ ধোলাই টাইপের মেশিন, যার নাম এখানে ‘মগজ’। ‘হীরক রাজার দেশে’ ১৯৮০ সালে নির্মিত, আর ‘মিলক গ্রহে মানুষ’ লেখা হয়েছে ১৯৬৩ সালে। আমি জোর করে অবশ্যই মিল টানতে চাইছি না। কিন্তু ছবি, সিনেমা আর উপন্যাসটাকে যদি এক সরলারেখায় টানার চেষ্টা করা যায়, তাহলে হয়তো রেখার খুব কাছাকাছিই তিনটে থাকবে।

অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদের একটা নিজস্ব শৈলী আছে। সেই শৈলীতে একটা টানটান ভাব থাকে, সেটা কীভাবে উনি পারতেন আমার কাছে বিস্ময়। তার এই মৌলিক লেখাটিতেও পেলাম। আমার মনে হয় এটাই ওনার ‘সিগনেচার’। আমার খুব ভাল লাগল, কল্পবিশ্ব ওনার লেখা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে এবং ইতিমধ্যে অনেকগুলো প্রকাশও করে ফেলেছে। তাদের সাধুবাদ জানাই।

আদিম আতঙ্ক -

আদিম আতঙ্ক Dean Koontz এর Phantoms অবলম্বনে লিখেছিলেন অদ্রীশ বর্ধন। অনুবাদ লেখার গুণে অনুসৃষ্টি হয়ে উঠেছে বলেই মনে করি। এও মনে করি অদ্রীশ বর্ধনের দুর্ভাগ্য তিনি বাংলায় জন্মেছেন। অদ্রীশ বর্ধনের দুর্ভাগ্য, তার ‘আদিম আতঙ্ক’র উপযুক্ত প্রচার ও প্রসার হয় নি। অদ্রীশ বর্ধনের দুর্ভাগ্য, বাংলার কোনও পরিচালকের চোখে এটা পড়ে নি। না হলে এতদিনে, তার এই কাজটা, অন্তত একটা স্থায়ী দাগ রেখে যেতে পারত। আর কল্পবিশ্ব প্রকাশ করার আগে, বাঙালীরা এমন একটা কাজকে স্রেফ ভুলে মেরে দিয়েছেন একটাই কারণে, এটা একটা কল্পবিজ্ঞান থ্রিলার। দুর্ভাগ্য, অদ্রীশ বর্ধনের মতন কল্পবিজ্ঞানের লেখকেরা ব্রাত্য, এখনও।

আমি পুরোনো সংস্করণের কথা বলতে পারি না, কিন্তু নতুন সংস্করণের প্রচ্ছদটাই এত হাড় হিম করা, যে দেখলেই গা শিরিশির করে ওঠে। প্রচ্ছদকারীকে অভিনন্দন।


ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে আরও কিছু বই সংগ্রহ করা এবং পড়ে ফেলা। শুনেছি লাভক্র্যাফট সমগ্র বের হবে। বের হবে রে ব্র্যাডবেরি-র সমস্ত লেখার বঙ্গানুবাদ, এক এক করে। আরও অনেক কাজ বাকি তাদের। অনেক নিত্য নতুন কাজ চলছে বর্তমান বিশ্বে। সেগুলোকে যদি না আনতে পারা যায় তাহলে আর কি সাধুবাদ? যেদিন একদম আনকোরা নতুন বইয়ের অনুবাদ আসবে, আর আসবে পাল্লা দিয়ে বর্তমানের নব বাঙালী লেখকদের আরপ্প আরও লেখা, ততদিনে তাদের এই প্রকাশ পূর্ণতা পাবে না। অনেক পথ চলাও বাকি।

আমি সেই পথের দিকে তাকিয়ে থাকি। নবনির্মানের পথ ধরে হাটতে হাটতে হারিয়ে যাই বিজ্ঞানের কল্পবিশ্বে... ।