মুরাকামির দৌড় আর দৌড়ের স্মৃতিকথা

‘প্রাচীন কালের লোকেরা প্রকৃতিকে এবং সংসারকে যেরকম ভাবে দেখত আমরা ঠিক সে ভাবে দেখি নে। বিজ্ঞান এসে সমস্ত জগৎসংসারের মধ্যে এমন একটা দ্রাবক পদার্থ ঢেলে দিয়েছে যাতে করে সবটা ছিঁড়ে গিয়ে তার ক্ষীর এবং নীর, ছানা এবং মাখন স্বতন্ত্র হয়ে গেছে।’ - সাহিত্য, লোকেন্দ্রনাথ পালিতকে লিখিত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মানুষ যতই আধুনিক হয়েছে, হাতের নাগালে চলে এসেছে স্বাচ্ছন্দ্যের সমস্ত উপকরণ, সমাজবিচ্ছিন্নতাও বৃদ্ধি পেয়েছে তত, একাকিত্ব গ্রাস করেছে ক্রমশ, শুধুমাত্র ঘরের কোণে নয়, আধুনিক মানুষ আজ ভিড়ের মাঝেও নিঃসঙ্গ। মননশীল মানুষের অন্বেষণ কিন্তু শেষ হয়ে যায় নি, সে আজও খুঁজে চলেছে কিছু না কিছু, এই খোঁজার চেষ্টাই জীবনের চালিকাশক্তি, মুরাকামির লেখাতেও এই খোঁজই প্রধান মোটিফ। হারুকি মুরাকামি প্রতিটি লেখায় বিষন্নতা জড়িয়ে থাকে শীতের কুয়াশার মতো। আধুনিক মানুষের একাকিত্ব তাঁর উপন্যাসগুলির অন্যতম উপাদান। আলোচ্য ক্ষীণতনু স্মৃতিকথা What I talk about when I talk about running  তার ব্যতিক্রম নয়। Philip Gabrielএর ইংরেজি অনুবাদে বইটি বৃহত্তর পাঠকসমাজের করায়ত্ত হয় ২০০৮ সালে।

আশির দশকে শারীরিক সক্ষমতা বজায় রাখতে দৌড় শুরু করেন মুরাকামি, অংশ নেন নানা প্রতিযোগিতায়। ২০০৫-এ New York City Marathon-এ অংশগ্রহণের জন্য যে প্রস্তুতি শুরু করেন মুরাকামি, সেই সময়ের অভিজ্ঞতাই লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি দার্শনিকতার মোড়কে। দৌড় কিভাবে তাঁর লেখাকেও প্রভাবিত করেছে সে কথাও অকপটে বলেছেন তিনি। নিছক একটি দৌড় প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে বৃহত্তর জীবন দর্শনের কথাই ধীরে ধীরে প্রতীয়মান হয় যত অগ্রসর হই এ লেখায়। ভীষণ সহজভাবে যদি বলি, একটি মানুষ যখন দৌড়োতে থাকে - সে রেসের দৌড় হোক বা জীবনের ইঁদুর-দৌড় - সে সেখানে সম্পূর্ণ একা। তখন সে কথা বলে শুধু নিজের সাথে, আর সে কথোপকথনে উদ্ভাসিত হয় স্ব-অস্তিত্ব, নিজের মধ্যে অন্তর্লীন সেই জীবনবোধের কথাই সহজভাবে মুরাকামি তুলে ধরেন এই বইটিতে। এই সীমিত জীবনের উপকরণগুলির মধ্যে কোনগুলিকে প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ, সে সম্পর্কে তাঁর সরাসরি মন্তব্য: ‘... you really need to  prioritize in life, figuring out in what order you should divide up your time and energy. If you don’t get that sort of system set by a certain age, you’ll lack focus and your life will be out of balance.’

ঘৃণা-ক্রোধ-জিঘাংসা-বিরহ-বিষাদ-হতাশার বিপ্রতীপে কী সরল এই জীবনবোধ যেখানে উচ্চারিত হয়, ‘There are plenty of things in this world that are way beyond me, plenty of opponents I can never beat.’ তাই সব সময় সব কিছুকে অতিক্রম করার প্রতিযোগিতা থেকে তাঁর জীবনপ্রণালী শতযোজন দূরে। কত সহজ উদাহরণ দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দেন  ‘শুধু যাওয়া-আসা শুধু স্রোতে-ভাসা’ এই জীবনকে কীভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে, চার্ল্স নদীর তীর বরাবর জগিং করারা সময় তাঁকে দৌড়ে অতিক্রম করে যায় হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা, পরাজয়ের গ্লানি বোধ হয় না তাঁর, বরং তাদের দেখে তিনি বুঝতে পারেন যন্ত্রণার যে অতল গভীরতা তিনি উপলব্ধি করেছেন, সে গভীরতা অল্পবয়সী এই তরুণীদের নেই, থাকার কথাও নয়, ‘..not to brag, but these girls probably don’t know as much as I do about pain.’ অর্থাৎ গতির নিরিখে তারা এগিয়ে থাকলেও অভিজ্ঞতার মাপকাঠিতে তাঁর কাছাকাছি আসা তাদের পক্ষে সম্ভবপর নয়, তবু সেই বোধ অহংভাবেরও জন্ম দেয় না তাঁর মনে, কারণ এটাই বহমান জীবনের ধর্ম, এমনটাই তো হওয়া উচিৎ। এর পাশাপাশি বোধিসত্ত্ব-মার্গের বিবিধ উপদেশগুলির থেকে একটি উদাহরণ দিলে হয়তো বোঝা যেতে পারে মুরাকামির সৃষ্টির মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের নানাবিধ বক্তব্যের কী সাবলীল বিচরণ:

মনুষ্য জীবন হচ্ছে দুঃখের সংসার(দুঃখ); সব বস্তুর মধ্যে পার্থক্য আছে বলে মনে হলেও, সেই পার্থক্যের ওপারে যে সাম্য রয়েছে তা আমাদের ভুললে চলবে না(শূন্যতা); এই সংসারে এমন কিছুই নেই যার অবস্থা চিরকাল অপরিবর্তিত থাকবে। সবকিছুই পরিবর্তনশীল(অনিত্য); এই সংসারে একা টিকে থাকতে পারবে, এমন বস্তু কিছুই নেই। তাই তুচ্ছ অহং ভাবকে আঁকড়ে থাকলে চলবে না(অনাত্মন)।  

 তাই মুরাকামিও ভাবেন, ‘One generation takes over from the next. This is how things are handed over in this world, so I don’t feel so bad if they pass me. These girls have their own pace, their own sense of time. And I have my own pace, my own sense of time. The two are completely different, but that’s the way it should be.’

ঠিক যেমন মুরাকামির এই রচনা চিন্তাশীল পাঠকের কাছে উন্মুক্ত করে দিতে পারে চিন্তার নতুন জগৎ, তাঁর  নিজের কাছেও যে সব লেখকরা ভাবোন্মেষ ঘটিয়েছেন নানা সময়ে, তাঁদের উল্লেখ পাই এ লেখায়। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই যে দর্শন নিহিত থাকে, মুরাকামি তাঁর সমস্ত লেখায় সেই সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন পাঠককে, ‘Somerset Maugham once wrote that in each shave lies a philosophy. I couldn’t agree more. No matter how mundane some action might appear, keep at it long enough and it becomes a contemplative, even meditative act.’

কাফকা যে তাঁর প্রিয় লেখকদের মধ্যে অন্যতম, তা তিনি বহুবার বলেছেন, কাফকার আবছায়া পথে পা রেখেছেন তিনিও, তাই যখন পড়ি, ‘The most important thing we ever learn at school is the fact that the most important things can’t be learned at school.’, মনে পড়ে যায় কাফকার সেই উক্তি: ‘I can prove at any time that my education tried to make another person out of me than the one I became.’

আলব্যর কামু বলতেন তিনি নৈতিকতা ও কর্তব্যের শিক্ষা পেয়েছিলেন ফুটবল খেলা থেকে, সার্ত্রে বক্সিং লড়তেন, হেমিংওয়ের শিকারপ্রীতি, বুলফাইটিং বা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার অভিজ্ঞতা কিভাবে তাঁর সাহিত্যে অমর হয়ে আছে, তাও আমরা জানি, মুরাকামিও তাঁর জীবনদর্শনকে চিরায়ত করে গেলেন এ লেখায়: ‘The end of the race is just a temporary marker without much significance. It’s the same with our lives. Just because there’s an end doesn’t mean existence has meaning. An end point is simply set up as a temporary marker, or perhaps as an indirect metaphor for the fleeting nature of existence.’

মুরাকামির ‘শেষের কবিতা’টি এই রকম – ‘Finally I dedicate this book to all the runners I’ve encountered on the road – those I’ve passed and those who’ve passed me. Without all of you, I never would have kept on running.’ সত্যি তো! আমাদের জীবনও তো তাদের নিয়েই গড়ে উঠেছে যাদের সাথে চলতে চলতে হঠাৎ দেখা হয়েছে, তাদের কাউকে পিছনে ফেলে আমি এগিয়ে গেছি চলার নেশায়, কেউ বা আমায় ফেলে গেছে জীবনপথের বাঁকে কোনো অছিলায়, তাদের ছাড়া এ জীবন পূর্ণ হত কী? 

মাৎসুও বাশো তাঁর ‘দূর প্রদেশের সংকীর্ণ পথ’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘সংসারী মানুষের চোখে পড়ে না/ঘরের কানাচে ফুটে থাকা/তুচ্ছ কুরি ফুলগুলি’ (অনু. গৌরী আইয়ুব)। আমাদেরও হয়তো চোখেই পড়ত না যাপিত জীবনের মাঝে সুপ্ত থাকা সমান্তরাল ‘অন্য’ জগতের ইঙ্গিত, যদি না দস্তয়েভস্কি, কাফকা,  কুন্দেরা বা মুরাকামি কলম ধরতেন!