গার্সিয়া মার্কেসের আখ্যান প্রেম ও অন্যান্য দানবেরা

আটষট্টি বছরে পৌঁছেও গার্সিয়া মার্কেস কতখানি সৃজনশীল ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যাবে তাঁর প্রেম ও অন্যান্য দানব (অফ লাভ অ্যান্ড আদার ডেমনস) নামক উপন্যাসটি থেকে। গার্সিয়া মার্কেসের অন্যান্য নানা উপন্যাসের মতোই এটির কাহিনীও পাঠক জানতে শুরু করেন মাঝখান থেকে। তারপর পিছিয়ে এগিয়ে সম্পূর্ণ আখ্যানবৃত্তটি উপন্যাসকার উপস্থিত করেন। আমরা সময়ক্রম অনুযায়ীই কাহিনীধারাটা হাজির করি।

সিয়ের্ভা মারিয়া ইগ্নাসিও মারকুইসের মেয়ে। ইগ্নাসিওর বাবা প্রথম মারকুইস বিপুল সম্পত্তি রেখে যান ছেলের জন্য। ইগ্নাসিও বিপুল সম্পত্তির মালিক ঠিকই, কিন্তু সবসময়েই ফ্যাকাশে চেহারায় ধরা দেন। একদিন ঘুমানোর সময় বাদুড় তার রক্ত খেয়ে নেয় বলেই নাকি তিনি এমন ফ্যাকাশে আর দুর্বল হয়ে গেছেন। দিনের বেশিরভাগ সময়টাই তিনি একটি হ্যামকের মধ্যে বিষণ্ণভাবে শুয়ে থাকেন। চারপাশের সমস্যাকে মোকাবিলা করার বদলে বিশ্বকে ভয় পাওয়াই তার স্বভাব।

ইগ্নাসিও মার্কুইসের প্রথম প্রেম ছিল এক আধ পাগলা নারী, দুলচে অলিভিয়ার সঙ্গে। তার গান ইগ্নাসিওকে মোহিত করেছিল। কিন্তু আভিজাত্য সচেতন ইগ্নাসিওর বাবা প্রথম মার্কুইস এই প্রেম মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। ছেলেকে তিনি দুলচে অলিভিয়ার থেকে দূরে গ্রামের জমিদারিতে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন। অবশেষে বাবার সম্পত্তি পাবার শর্ত অনুসারে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে দোনাইয়া ওলাইয়াকে বিয়ে করেন ইগ্নাসিও, কিন্তু বিয়ের পরও অনেকদিন স্ত্রীর সঙ্গে কোনওরকম শারীরিক সম্পর্ক স্থাপণ করেন নি তিনি। তাদের বিছানা ছিল আলাদা। একদিন দোনাইয়া নিজেই উঠে আসেন ইগ্নাসিওর বিছানায় আর জোর করেই স্বামীর সঙ্গে মিলিত হন। এই প্রথম মিলনের আবেশ স্ত্রীর প্রতি ঘনিষ্ট প্রেমে পর্যবসিত হয় এবং তারা স্বপ্নের দিন কাটাতে শুরু করেন। কিন্তু সে সুখের দিন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অকস্মাৎ বজ্রপাতে ঝলসে মারা যান দোনাইয়া। মনে করা হয় দুলচে অলিভিয়াই বোধহয় তুকতাক করে এই বজ্র হেনেছে তার না পাওয়া প্রেমিকের স্ত্রীর ওপর।

প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর ইগ্নাসিও বিবাগী জীবন কাটানো শুরু করেন। অল্প কিছু সম্পত্তি রেখে বিশাল জমি ও অন্য নানা কিছু বিলিয়ে দেন খ্রিস্টিয় মঠে। এই সময়েই তার জীবনে আসেন দ্বিতীয় স্ত্রী তথা সিয়ের্ভা মারিয়ার মা বার্নার্দা ক্যাব্রেরা। বার্নার্দা ছিলেন বণিক পরিবারের এক মহিলা। তিনি তার বাবার পরিকল্পনা মতোই বিপত্নীক ইগ্নাসিওকে আকৃষ্ট করার খেলায় নামেন। তাকে যৌনতায় টেনে নেন ও গর্ভবতী হন। বিয়ে করতে বাধ্য করেন ইগ্নাসিও। দাস কেনাবেচা এবং ময়দার ব্যবসা করে তিনি প্রচুর অর্থ রোজগার করেন। অবশ্য এই অর্থ তিনি ধরে রাখতে পারেন নি। হিংস্র যৌনতার দিকে তার ছিল প্রবল আসক্তি। বার্নাদা সুঠাম ক্রীতদাস জুডাস ইসকারিওতের প্রেমে পড়েন। প্রচুর পয়সার বিনিময়ে তাকে কিনে নেন ও তারপর তার সঙ্গে উদ্দাম যৌনতায় সারাদিন মেতে থাকেন। হঠাৎ জুডাস মারা গেলে তিনি অন্যান্য ক্রীতদাসদের সঙ্গে ব্যাভিচারী যৌনতা শুরু করেন। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে ক্রীতদাসরা তার ভয়ে পালাতে থাকে। বার্নার্দা হতাশ একাকিত্বে ভুগতে থাকেন। শুধু স্বামীই নয়, শিশুকন্যা মারিয়াকেও তিনি তীব্রভাবে অপছন্দ করতেন। মেয়ের বেড়ে ওঠার দিকে বিন্দুমাত্র নজর তার ছিল না। কোকো ও মধু খেয়েই বার্নার্দার দিন কাটত।

মায়ের স্নেহছায়া বঞ্চিত মারিয়া কালো দাসদের উঠোনে লালিত পালিত হতে থাকে। আফ্রিকান দাসদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী ইয়োরুবান দেবতাদের পুজো করতে শেখে। শেখে আফ্রিকান গান আর বেশ কয়েকটি আফ্রিকান ভাষা। প্রধান ক্রীতদাসী দোমিঙ্গা যতদিন বেঁচে ছিল, তার কর্তৃত্বে সংসারে শৃঙ্খলা ছিল। কিন্তু সে মারা যাবার পরে নৈরাজ্যে ভরে উঠল গোটা সংসার। এই সময়েই একদিন দাসীর সঙ্গে বাজারে গিয়ে এক কুকুরের কামড় খেল সিয়ের্ভা মারিয়া। এখান থেকেই কাহিনী এক নাটকীয় মোড় নিল।

ক্রমে জানা গেল যে সেই কুকুরটি জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। কুকুরটি যাদের কামড়েছিল, তাদের মধ্যেও সেই রোগলক্ষণ প্রকাশ পেতে দেখা গেল, যে রোগের কোনও ওষুধ নেই, মৃত্যুই একমাত্র ভবিতব্য। সিয়ের্ভা মারিয়ার দেহে যদিও কোনও রোগলক্ষণ প্রকাশ পায় নি এবং ছোট্ট ক্ষতস্থানটিও শুকিয়ে গিয়েছিল, তবুও অনেক পরেও জলাতঙ্কের প্রাণঘাতী লক্ষণ প্রকাশিত হতে পারে ভেবে তার বাবা ইগ্নাসিও মারকুইস চিন্তিত হলেন। এই দুশ্চিন্তাকে ঘিরেই মেয়ের প্রতি এবং সংসারের প্রতি ফিরে তাকালেন তিনি। মারিয়ার মা বার্নার্দার উদাসীনতার বিপ্রতীপে একাই মেয়ের বাবা ও মা হয়ে উঠতে চাইলেন। মেয়ের সম্ভাব্য মারণ রোগের প্রতিকার চিন্তা সূত্রে একদিন তার পরিচয় হল শহরের সবচেয়ে প্রতিভাবান কিন্তু বিতর্কিত ডাক্তার আব্রেনুনসিওর সঙ্গে। আব্রেনুনসিও যে কোনও রোগীর মৃত্যু সম্পর্কে যেমন অভ্রান্ত ভবিষ্যৎবাণী করতে পারতেন, তেমনি পারতেন ক্ষেত্রবিশেষে মৃত্যুর মুখে পতিত মানুষকে আবার জীবনে ফিরিয়ে আনতে। যদিও একে অষ্টাদশ শতকের খ্রিস্টিয় সমাজের কর্তাব্যক্তিরা বিজ্ঞান নয়, অশুভ কালোজাদু বলেই ভাবত।

বস্তুতপক্ষে এই উপন্যাসের নামের মধ্যে প্রেম ও দানবত্বের যে বৈপরীত্য আছে, তেমনি আছে যুক্তিবাদ ও কুসংস্কারের ভয়াবহ বৈপরীত্য। এই বৈপরীত্যের একদিকে যদি দাঁড়িয়ে থাকেন বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ ও জ্ঞানতৃষ্ণার প্রেমে স্নাত ডাক্তার আব্রেনুনসিও এবং তরুণ যাজক কায়তানো দেলাউরা, তাহলে অন্যদিকে আছেন বিশপ ও খ্রিস্টিয় মঠের অন্যান্য কর্তাব্যক্তি সহ প্রচলিত ধর্মমতের অন্ধ বিশ্বাসীরা।

সিয়ের্ভা মারিয়ার মধ্যে যেহেতু জলাতঙ্কের রোগলক্ষণ প্রকাশিত হয় নি, তাই সতর্ক দৃষ্টিতে তাকে বাড়ির আদরে রাখার পক্ষেই জোরালো মত দিয়েছিলেন ডাক্তার আব্রেনুনসিও। কিন্তু সেরে আসা পায়ের ক্ষতকে দোলাচলতায় ভোগা ইগ্নাসিও মারকুইস ছেড়ে দিলেন তুকতাককারী ও হাতুড়েদের হাতে। তাদের চিকিৎসার নামে চালানো অদ্ভুত নানা অত্যাচারেই অন্য রোগলক্ষণ দেখা দিল মারিয়ার। আর এই ভিন্ন রোগলক্ষণকে জলাতঙ্ক তথা অশুভ দানব শক্তির প্রকাশ ধরে নিয়ে বিশপ ইগ্নাসিও মারকুইসকে জোর করলেন মেয়েকে এক কনভেন্টে ধর্মবিচারের প্রকোষ্টে ছেড়ে দিতে। দুর্বল মনের মারকুইস সে নির্দেশ অমান্য করতে পারলেন না। মন না মানলেও মেয়েকে রেখে আসলেন খ্রিস্টিয় মঠের বিশেষ বন্দীশালায়। যে সদ্য কিশোরী ছোটবেলা থেকে বাবা মায়ের স্নেহ পায় নি, তার জন্য মায়ের না হলেও বাবার স্নেহ যখন জুটতে শুরু করেছিল, তখনই তা হারিয়ে গেল। হারিয়ে গেল ছোটবেলা থেকে পাওয়া ক্রীতদাসীদের অভ্যস্ত সঙ্গও। খ্রিস্টিয় মঠের বিরূপ পরিবেশে যখন সে দিশেহারা ও আতঙ্কিত, তখন তার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই রাগ, ক্ষোভ ও অসহিষ্ণুতা উন্মার্গগামীর বাহ্য আবরণে প্রকাশ পেল। একেই তাকে দানবীয় গ্রাসের শিকার বলে আরো জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন বিশপ ও কনভেন্টের কত্রীরা।

বিশপ সিয়ের্ভা মারিয়ার দেখাশোনার জন্য নিযুক্ত করলেন কায়তানো দেলাউরাকে। মধ্য তিরিশের এই যুবক যাজকবৃত্তে প্রবেশ করলেও ছিলেন বহুপাঠী, স্বাধীন চিন্তাশক্তি সম্পন্ন ও যুক্তিবাদী। তিনি খুব সহজেই বুঝে ফেললেন সিয়ের্ভা মারিয়া জলাতঙ্কেও ভুগছে না, কোনও পিশাচও তাকে ভর করে নি। ডাইনি তাড়ানোর যে চিকিৎসা মঠে তার ওপর চলছে তা শুধু অপ্রয়োজনীয়ই নয়, ক্ষতিকরও। এও কায়তানো দেলাউরা বুঝলেন ও বিশপকে বোঝাতে চাইলেন যে যাকে পিশাচাক্রান্ত বলে মনে করা হচ্ছে আফ্রিকি ভাষায় গান ও কথা বলার জন্য, সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা বিষয়। আফ্রিকি ক্রীতদাস ক্রীতদাসীদের মধ্যে বেড়ে ওঠায় এরকমই হবার কথা। এও তিনি বুঝলেন ডাইনী শিকার পদ্ধতি নয়, মারিয়ার দরকার স্নেহ ও প্রেম। বিশপ অবশ্য তার বিশ্বাসের জগৎ থেকে সরতে রাজী ছিলেন না, তা এই তরুণ যাজকটিকে তিনি যতই স্নেহ করুন না কেন।

এই সময়েই কায়তানো দেলাউরা সিয়ের্ভা মারিয়ার প্রেমে পড়লেন। প্রচলিত খ্রিস্টিয় পন্থায় নিজেই নিজেকে এজন্য শাস্তি দিতে চাইলেন প্রথমে। বিশপের কাছে স্বীকারোক্তিও করলেন। তাকে মারিয়ার কাছ থেকে দূরেও সরিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু ততদিনে খ্রিস্টিয় যাজকের সত্তা ভেঙে প্রেমিক সত্তা তাকে এমন আচ্ছাদিত করেছে যে মারিয়ার থেকে দূরে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হল না। রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে নানা আগল টপকে মারিয়ার সঙ্গে দেখা করতে কায়তানো। মারিয়ার কাছে খুলে দিলেন নিজের হৃদয়। মারিয়া এই প্রেমকে শুধু স্বীকৃতিই দিল না, একান্ত আবেশে নিজেকে বেঁধে ফেলল কায়তানোর সঙ্গে। কৌমার্য না খোয়ালেও চুম্বনে আশ্লেষে ভরে রইলো তাদের প্রতিদিনের রাত জাগা ভালোবাসা। একদিন অবশ্য ধরা পড়ে গেল কায়তানো দেলাউরার এই গোপন অভিসার। তাকে বাধার প্রাচীরে সরিয়ে দেওয়া হল মারিয়ার থেকে। যে মারিয়া হাস্যে লাস্যে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিল প্রেমিকের বিরহে আবার ফিরে গেল তার উন্মার্গগামী আচরণে। অভিমানে নিজেকে জীবন থেকেই সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তই নিল সে।

এই উপন্যাসের কেন্দ্রে আছে বারো বছরের এক সদ্য কিশোরী সিয়েরভা মারিয়া। তাকে প্রত্যক্ষে অপ্রতক্ষে ঘিরে আছে উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্ররা। কায়তানো দেলাউরা, ইগনাসিও মারকিউস, বের্নার্দা, জুডাস ইসকারিওতে, দুলচে অলিভিয়া, ডাক্তার আব্রেনুনসিও, বিশপ, জোসেফা মিরান্দা, মাতিনা লাব্রোদে, সাগুন্তা, ফাদার টমাস আকুইনো। চরিত্রদের সম্পর্কে কথা বলার সময় আমাদের মনে রাখতে হবে এর দেশকালের বিশেষত্বটি। গার্সিয়া মার্কেসের সাংবাদিক জীবনের শুরুর দিকের এক দিনে এই উপন্যাসের বীজটি প্রোথিত হয়েছিল। উপন্যাসের প্রাক কথনে গার্সিয়া মার্কেস নিজেই সেটা জানিয়েছেন। দিনটা ছিল ১৯৪৯ সালের ২৬ অক্টোবর। কাগজের সম্পাদক ক্লেমেন্তে মানুয়েল সাবালা টেলিফোনে জানতে পারেন সান্তা ক্লারার পুরনো কনভেন্টের মাটির তলার সমাধিকক্ষগুলো খালি করা হবে। গার্সিয়া মার্কেসকে ক্লেমেন্তে সেখানে একবার যেতে বলেন, কোনও খবর আছে কীনা তা অনুসন্ধানের জন্য। একশো বছর আগে ক্লারিসান নানদের একটি কনভেন্টকে হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। এইবার সেই হাসপাতাল তথা কনভেন্টটি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। সেখানে গড়ে উঠবে একটি পাঁচতারা হোটেল। সেজন্যই সমাধিকক্ষ খালি করার আয়োজন। এই সময়েই মারকিউস দন ইগনাসিওর পাশের সমাধিটি খালি করার সময় কুড়ুলের আঘাতে হঠাৎ বেরিয়ে এল চুলের একটি স্রোত। অবিশ্বাস্য রকম লম্বা সেই চুলের উৎস খোঁজ করে পৌঁছনো গেল এক বালিকার মাথার খুলিতে। সেই সমাধিতে তার নাম লেখা ছিল – সিয়েরভা মারিয়া। দেখা গেল চুলের দৈর্ঘ্য বাইশ মিটার এগারো সেন্টিমিটার। মৃত্যুর পরে মানুষের চুল মাসে এক সেন্টিমিটার বাড়লে এই সমাধির বয়েস দাঁড়ায় দুশো বছর। এই দৃশ্যটির সঙ্গে গার্সিয়া মার্কেস মিশিয়ে নেন ছেলেবেলায় দিদিমার কাছে শোনা এক কাহিনী। সেই কাহিনীতে বারো বছরের একটি মেয়ে কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল, যার ছিল অতি দীর্ঘ চুল। চোখে দেখা সমাধি থেকে বেরনো কেশরাশি আর কানে শোনা ছেলেবেলার গল্পের স্মৃতি মিশে একটি আখ্যানের পরিকল্পনা দানা বাঁধে গার্সিয়া মার্কেসের মনে। তবে সেই পরিকল্পনা তিনি মনেই রেখে দিয়েছিলেন। অবশেষে ঘটনাটির প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পর উনিশশো চুরানব্বইতে এসে সেই পরিকল্পনা উপন্যাসে রূপ পেল। উপন্যাসটির ঘটনাস্থল কলম্বিয়ার ক্যারিবিয়ান শহর আর্তাহেনা আর সময়কাল অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন আধুনিক জ্ঞানচর্চা ও যুক্তিবাদ ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে সমাজের ওপর, ভলতেয়ার অনেকের কাছে হয়ে উঠছেন মহানায়ক, তখন এই যুক্তিবাদীদের বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন সান্তা ক্লারা কনভেন্টটির পরিচালিকা হোসেফা মিরান্দা। এই আখ্যানে এক নেতিবাচক চরিত্র হিসেবেই তাঁকে দেখেন পাঠক। তার জন্যই সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় সিয়ের্ভা মারিয়াকে। নান হলেও তার মধ্যে সহানুভূতি ও স্নেহশীলতার কোনও প্রকাশ আমরা দেখি নি। তার তুলনায় বিশপ বরং অনেক বেশি দোদুল্যমান ও সহানুভূতি সম্পন্ন। তিয়াত্তর বছরের এই বৃদ্ধ অ্যাজমা রোগীটি নিজের দায়িত্ব প্রতিনিয়ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। সিয়ের্ভা মারিয়ার দেখভালের জন্য তিনি যাদের পাঠান সেই কায়েতানো যেমন সংবেদনশীল ও সহানুভূতিশীল। আর একজন – ফাদার টমাসও ছিলেন তাই। তিনি আফ্রিকার ভাষা সংস্কৃতি সঙ্গীত জানতেন বলে মারিয়ার সঙ্গে তার বিনিময় সহজ হয়েছিল। অকস্মাৎ তারও আশ্চর্যজনক মৃত্যু হলে মারিয়াকে সহানুভূতি দিয়ে বিশ্লেষণ করার আর কেউ মঠে থাকলেন না। এরপর বাধ্য হয়েই তিনি কড়া হাতে মারিয়ার প্রেত মোচনের কাজটা করতে এগোলেন। তাঁকে একটি অপসৃয়মাণ সময় ও মানসিকতার প্রতিনিধি হিসেবেই হাজির করেন গার্সিয়া মার্কেজ। কায়েতানোর মত নতুন চিন্তার পাদ্রীকে তিনি যথেষ্ট ভালোবেসেও শেষপর্যন্ত খ্রিস্টিয় মঠ ও যাজকবৃত্তির প্রচলিত নিগড়টি আঁকড়ে থাকতে চান। তাঁর হাঁপানি একদিকে যেমন এক শারীরিক অসুখ, তেমনি অন্যদিকে প্রতীকীও বটে। ব্যবস্থার জীর্ণ কাঠামোয় যার হাঁপ ধরেছে, কিন্তু এর নিরাময়ের স্থায়ী সমাধান তার কাছে নেই। একে নিয়েই তাঁকে চলতে হবে।

দোদুল্যমানতা রয়েছে ইগ্নাসিও মারকুইসের মধ্যে। সারাজীবন নানা আঘাতে তিনি জর্জরিত হয়েছেন। নিজেকে জীবনের চলমানতা থেকেও সরিয়ে নিয়েছেন অনেকটা। তার ফ্যাকাসে রক্তশূন্যতা শুধু শারীরিক বিষয় নয়, মনেরও ব্যাপার। তবে অন্তত দুবার তিনি তার সমস্ত অবসাদ আর শৈথিল্যকে সরিয়ে প্রাণ সতেজতায় ফিরেছিলেন। একবার অবশ্যই প্রথম বিয়ের দীর্ঘদিন পরে হওয়া প্রথম যৌনতার আবেশজাত প্রেমের প্রতিক্রিয়ায়। বজ্রপাতে স্ত্রীর মৃত্যুর অকস্মাৎ ধাক্কায় যা থেমে যায়। দ্বিতীয়বার মেয়ের জলাতঙ্কর সম্ভাবনায় দায়িত্বশীল পিতা হিসেবে তাকে সাংসারিক বাস্তবতা ও কর্তৃত্বে লগ্ন হতে দেখা যায়। এই পর্বে ডাক্তার আব্রেনুনসিওর সঙ্গে আলাপ তাঁকে সুযোগ দিয়েছিল ধর্মীয় বিশ্বাসের অসাড়তার বীজটিকে মহীরূহ করে তোলার। কিন্তু সেটা যে তিনি পারলেন না, বরং হাতুড়ে বিদ্যা ও পরিশেষে খ্রিস্টিয় প্রতিষ্ঠানের নির্দেশের কাছে আত্মসমর্পণ করে মেয়েকে কার্যত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলেন – সেটা তার চরিত্রের ভেতরের দুর্বলতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাবের দিকটিকেই স্পষ্ট করে তোলে। এই উপন্যাসের সবচেয়ে দোলাচলচিত্ত কিন্তু সবচেয়ে জীবন্ত চরিত্র হিসেবে তাঁকে তৈরি করেছে গার্সিয়া মার্কেজের জাদুকরী কলম।

বের্নার্দা চরিত্রটিও শেষপর্যন্ত হতাশার অন্ধকারে মারকুইসের মতোই হারিয়ে যায় এই উপন্যাসে। কিন্তু এই চরিত্রটির গঠন বা ভিত্তি তার স্বামীর চেয়ে একেবারেই আলাদা ধরনের। নিশ্চেষ্টতা যদি ইগ্নাসিওর চরিত্রমূল হয়ে থেকে, তবে তার বিপ্রতীপে বের্নার্দার জীবনতৃষ্ণাই তাকে বাল্যাবধি সক্রিয় রেখেছিল। বাবার সঙ্গে শলা পরামর্শ করে মারকিউসকে যৌনতায় প্রলুব্ধ করে অতঃপর তার স্ত্রী হয়ে ওঠাই হোক বা আইন বহির্ভূত ব্যবসায় সাফল্য পেয়ে বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠাই হোক – নিজের লক্ষ্য পূরণে সে নীতি নৈতিকতাকে কখনো আমল দিতে চায় নি। অসম্ভব যৌন ক্ষুধাকে লাগাম পরানোর কোনও ইচ্ছাই তার ছিল না। একের পর এক পুরুষকে সে প্রয়োজনে জোর করে বা টাকা দিয়েও তার শয্যাসঙ্গী করেছে। নিজের গর্ভজাত সন্তানের প্রতি তার মধ্যে যে ধরনের বীতরাগ দেখা গিয়েছে, তাও বিরল ব্যতিক্রমী। সে যেন তেন প্রকারে নিজেকে সুখী দেখতে ও রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু তার হিসেব শেষ পর্যন্ত মেলে নি। একাকী এক বনের মধ্যে চরম নিঃসঙ্গতায় সে তার শেষজীবন কাটিয়েছে এবং তার মৃতদেহটি পর্যন্ত মাংসাশী পাখিদের খাদ্যে পরিণত হয়েছে।

নিঃসন্দেহে কায়তানো দেলাউরা আর ডাক্তার আব্রেনুনসিও এই উপন্যাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চরিত্র। তারা দুজনেই বহু ভাষাবিদ ও বহুপাঠী। তারা তাদের স্বল্প কিন্তু ব্যঞ্জনাময় সাক্ষাৎকারগুলিতে নানা বইপত্র নিয়ে কথা বলে। পুরনো চিন্তার বিপরীতে নতুন চিন্তা ও যুক্তি বোধে দীপ্ত ছিল যে অষ্টাদশ শতাব্দীর নতুন মানুষেরা – এঁরা তাদেরই প্রতিনিধি। তাদের কথাবার্তায় অন্যান্যদের পাশাপাশি শুনি ফরাসী দার্শনিক সে কালের অন্যতম প্রগতিশীল চিন্তানায়ক ভলতেয়ারের কথা। আব্রেনুনসিও শুধু এক দক্ষতাসম্পন্ন চিকিৎসকই নন, এক বহুপাঠী চিন্তকও। তাঁর চিকিৎসাশাস্ত্রের গুরুও অভিনব চিন্তা ও চিকিৎসাপদ্ধতির জন্য আলোড়ন তুলেছিলেন, আব্রেনুনসিওকে নিয়েও সমাজে প্রবল আলোড়ন। রক্ষণশীল দুনিয়া ও যাজক সমাজ তাকে অপাংক্তেয় করতে চায়, কিন্তু প্রবল দৃঢ়তা সম্পন্ন তার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বধ্যপরিকর। নিজে বশীভূত হওয়া দূরে থাক, তিনিই বরং সচেষ্ট হন যাজকবৃত্তের মধ্যেও ঢুকে পড়ে সম্ভাব্যদের যুক্তিবাদের আলোয় নিয়ে আসতে। কায়তানো দেলাউরাকে তিনি আগাগোড়া তাঁর দিকে আনার চেষ্টা করে গেছেন। তিনি শুধুই একজন ব্যক্তি যুক্তিবাদী ছিলেন না, ছিলেন যুক্তিবাদী আন্দোলনের বিকাশমান ধারাটির এক সংগঠক ও সেনাপতি। তাঁর বাড়ির বিরাট গ্রন্থাগারে অজস্র নিষিদ্ধ যুক্তিবাদী বইকে তিনি রাখতে ভয় পান না। উপযুক্ত পাত্রদের সঙ্গে সে সব বইয়ের পরিচয় করিয়ে দিয়ে সেগুলির প্রচার প্রসার করতেও উদ্যোগী হন।

কায়তানো দেলাউরা এক মেধাবী পাঠক। যাজক পরিমণ্ডলে থাকলেও তাঁর যুক্তিবাদী মন ও সুকুমারবৃত্তি সদা জাগ্রত। বস্তুতপক্ষে তাঁর বিপুল পাঠাসক্তি যা এমনকী নিষিদ্ধ বই অন্বেষণে পরাঙ্মুখ হয় না আর তার মধ্যে জেগে ওঠা প্রেমের অনুভূতি – একই সজীব সত্তার দুই আলাদা প্রকাশ। সজীব সংবেদনশীলতার যে যন্ত্রণা আবহমান কাল ধরে ব্যতিক্রমী ছক ভাঙা মন ও মননের সঙ্গী হয়েছে, কায়তানোও তার ব্যতিক্রমী নন। পাঠক আব্রেনুনসিওকে যতটা শ্রদ্ধা করে, কায়তানোকে ততটাই ভালোবাসে। মারিয়ার সঙ্গে তার যে প্রেম শেষপর্যন্ত পরিণতি পেল না, তাই এক ট্রাজিক চরিত্র হিসেবে তাঁকে পাঠক মনে উজ্জ্বল করে রাখে।

সিয়ের্ভা মারিয়া এই উপন্যাসের নায়িকা। বারো বছরের এই মেয়েটিকে বালিকা বা সদ্য কিশোরী বলা যায়। তার বড় হয়ে ওঠার পর্বটি বাবা মার থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কেটেছে দাসদাসীদের মধ্যে। কিন্তু বাইরে থেকে পাঠক একে যতই বঞ্চনা হিসেবে দেখুক সে একেই অভ্যাস থেকে আসক্তির পর্যায়ে নিয়ে গেছে। শিখে নিয়েছে আফ্রিকি দাসদের ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি আর ভাষা। সাদা চামড়ার নানদের কনভেন্ট বা বিশপ তাদের ঔপনিবেশিক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের চোখ দিয়ে এই মেয়েটির গড়নকে তাই বুঝতে পারেন না। মেয়েটির সাদা চামড়ার তলায় লুকিয়ে থাকা আফ্রিকি সত্তা তাদের কাছে দানস সদৃশ। সিয়ের্ভা মারিয়ার মধ্যে দিয়ে গার্সিয়া মার্কেস উপনিবেশকারী আর উপনিবেশিত (কলোনাইজার ও কলোনাইজড) গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব সংঘাতের কিছু মৌলিক দিক তুলে আনেন, যা ছিল লাতিন আমেরিকান সংস্কৃতির এক মৌল দিক। সিয়ের্ভা মারিয়ার অসম বয়সী প্রেম তখনই কায়তানোকে স্বীকৃতি দিল, যখন সে দেখল কনভেন্টের সেই পরিবেশে তার মত কায়তানোও হয়ে পড়েছেন এক বহিরাগত, এক আউট সাইডার। এই বহিরাগতর হাত ধরেই সে কনভেন্টের ঘেরাটোপ থেকে পালাতে চেয়েছিল। যেভাবে একদিন সে পালিয়েছিল ঠাকুমার ঐতিহ্যশালী ঘরের ঐশ্বর্যময় পালঙ্ক থেকে দাসীদের চেনা পরিসরে। এই দুই পলায়ন প্রচেষ্টাই শেষমেষ ব্যর্থ হয়ে যায় আর সিয়ের্ভা মারিয়াও জীবনে বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

গার্সিয়া মার্কেসের ‘প্রেম ও অন্যান্য দানব’ উপন্যাসটি একইসঙ্গে এক প্রেমের কাহিনী, তাকে দানবীয় পরিবেশে হত্যার আখ্যান আবার তা সামাজিক সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের এক বহুস্তরিক চিত্র – যা দেশকালের ব্যাপ্ত প্রেক্ষাপটটিকে ধারণ করে থাকে আশ্চর্য শৈল্পিক দক্ষতায়।