
জেন অস্টেনের 'নর্দাঙ্গার অ্যাবি'
- 07 April, 2025
- লেখক: সৌভিক ঘোষাল
সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি উপন্যাসের প্রথম খসড়া ‘এলিয়নর এবং ম্যারিয়ানে’ জেন অস্টেন লেখেন ১৭৯৫ সালে। ১৭৯৬ এর অক্টোবর নাগাদ শুরু হয় ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর প্রথম খসড়া ‘ফার্স্ট ইম্প্রেশন’ লেখার কাজ, যা শেষ হয় ১৭৯৭ এর অগস্ট মাসে। এরপর ঐ বছরের নভেম্বরেই ‘এলিয়নর ও ম্যারিয়ানে’র পরিমার্জনার কাজ তিনি শুরু করেন ও এর নতুন নাম রাখেন ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’। ১৭৯৮ সালে তাঁর তৃতীয় উপন্যাস লেখার কাজ শুরু করলেন জেন অস্টেন ও এর নাম দিলেন ‘সুসান’। এই উপন্যাসটিকেই এখন আমরা চিনি ‘নর্দাঙ্গার অ্যাবি’ নামে। ১৭৯৯ এর মাঝামাঝি এটি লেখা শেষ হয়। ১৮০৩ সালে সুসান এর বেশ কিছু পরিমার্জনের পর এটিকে প্রকাশক বেঞ্জামিন ক্রসবি অ্যান্ড কোম্পানির কাছে পাঠানো হয়। ক্রসবি দশ পাউন্ড দিয়ে এর প্রকাশনা স্বত্ব কিনে নেন ও পরের বছর ১৮০৪ সালে উপন্যাসটি প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দেন। উপন্যাসটি প্রকাশিত হতে চলেছে, এই মর্মে ক্রসবি সংস্থার পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনও প্রকাশিত হয়। কিন্তু এর পরেও কোনও এক অজানা কারণে সে সময় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় নি। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত এক সংস্করণের গ্রন্থ ভূমিকায় রেবেকা ওয়েস্ট মনে করেছিলেন, প্রথমে ওপর ওপর পান্ডুলিপিটি দেখে প্রকাশক একে প্রমোদ শহর বাথ এর ওপর এক নারীর অভিজ্ঞতার মজাদার গল্প ভেবেছিলেন। পরে খুঁটিয়ে পড়ে তাঁরা বুঝতে পারেন এই আখ্যান আসলে এক ব্যঙ্গ রচনা। সমকালীন সব সেন্টিমেন্টাল আখ্যান, সেই সব আখ্যানের কল্পনাপ্রবণ নায়িকা, জনপ্রিয় সব গথিক নভেলের অতিলৌকিক জগৎ নিয়ে এখানে রয়েছে তীব্র ব্যঙ্গ বিদ্রুপ। এইবার প্রকাশক মত পরিবর্তন করলেন ও এর প্রকাশ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেন। ধরে নিলেন তাঁদের দেওয়া দশ পাউন্ড জলে গেল।
এরপর অস্টেনের বাবা হঠাৎই মারা যান ১৮০৫ সালে ও পরিবারটি আতান্তরে পরে। কয়েক বছরের অস্থির জীবন যাপনের পর অবশেষে ১৯০৯ সালে জেন অস্টেন তাঁর ও মা ও দিদির সঙ্গে চাওটনে এসে থিতু হন ভাইয়ের সংসারে। এই বছরেই অন্য এক প্রকাশনা থেকে অন্য এক লেখকের সুসান নামেই একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। এই পরিস্থিতিতে জেন অস্টেন তাঁর ‘সুসান’কে নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন। মিসেস অ্যাস্টন ডেনিশ ছদ্মনামে ১৮০৯ সালের ৫ এপ্রিল তিনি ক্রসবি প্রকাশনা সংস্থাকে একটি চিঠি লেখেন। সেখানে প্রকাশককে তিনি আর্জি জানান ছ বছর আগে কেনা পাণ্ডুলিপিটি যদি না ছাপারই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তাহলে সেটা তাঁকে জানিয়ে দিতে। তিনি অন্য এক প্রকাশনা সংস্থায় তাহলে সেটি পাঠাবেন। উপন্যাস প্রকাশে ছ বছর ধরে সাড়া শব্দ না করলেও এই চিঠি পাবার তিনদিনের মধ্যেই প্রকাশনা সংস্থার পক্ষে রিচার্ড ক্রসবি তাঁকে এক কড়া প্রত্যুত্তর পাঠান। ১৮০৯ এর ৮ এপ্রিল লেখা সেই চিঠিতে রিচার্ড ক্রসবি বলেন যে তাঁরা দ্রুতই উপন্যাসটি ছেপে ফেলবেন এমন কোনও প্রতিশ্রুতি তাঁদের তরফে দেওয়া হয় নি। এই পাণ্ডুলিপিটি তাঁরা দশ পাউন্ড দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন। সেটা ফেরত দিলে তবেই তাঁরা পাণ্ডুলিপিটি ফেরৎ দিতে পারেন। কিন্তু দশ পাউন্ড ফেরৎ না দিয়ে অন্য প্রকাশকের থেকে বইটি বের করলে তাঁরা আইনী ব্যবস্থা নেবেন। জেন অস্টেনের পক্ষে তখন দশ পাউন্ড ফেরৎ দেবার সঙ্গতি ছিল না।১ তাই বিষয়টি আবার তখনকার মতো ধামাচাপা পড়ে যায়। ১৮১১ থেকে ১৮১৫ সালের মধ্যে জেন অস্টেনের চারটি উপন্যাস – সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি, প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস, ম্যানসফিল্ড পার্ক ও এমা - প্রকাশিত হয় এবং সেগুলি ব্যাপক সাড়া ফেলে। অস্টেন এই সূত্রে যথেষ্ট খ্যাতি ও অর্থর অধিকারী হন। এইবার তিনি দাদার মাধ্যমে দশ পাউন্ড দিয়ে সুসান এর পাণ্ডুলিপি ও স্বত্ব ক্রসবি প্রকাশনা সংস্থা থেকে ফেরৎ নিয়ে নেন। বলাই বাহুল্য প্রকাশক ক্রসবির কর্তাব্যক্তিরা কেউই জানতেন না যে পাণ্ডুলিপি তাঁরা না ছেপে ফেরৎ দিয়ে দিচ্ছেন সেটি ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ সহ বাই এ লেডি নামে ছাপা বইগুলির লেখিকার লেখা।
পাণ্ডুলিপিটি ফেরৎ পাবার পর জেন অস্টেন নায়িকার নামটি সুসান থেকে বদলে করলেন ক্যাথারিন মোরল্যান্ড। সেইসঙ্গে একটি ভূমিকা যোগ করলেন, যাতে বললেন এটি ১৮০৩ সালে প্রকাশের কথা ছিল, কিন্তু নানা কারণে দেরি হল। উপন্যাসের ঘটনাপট প্রায় দেড় দশক আগের, সেটা পাঠককে মনে রাখতে বললেন সেই ভূমিকায়। উপন্যাসের নায়িকার নাম পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ রদবদল তিনি করেছিলেন কিনা, সেটা জানা যায় না, কিন্তু এই প্রাককথন থেকে মনে হয় প্রকাশের আগে আদিপর্বের অন্য দুটি উপন্যাস – ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’ ও ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ যে ব্যাপক রদবদলের মধ্যে দিয়ে নতুন রূপ পেয়েছিল, এক্ষেত্রে তা ঘটেনি। প্রাককথন লেখা হয়ে যাবার পরও কোনও কারণে এটাকে অস্টেন কোনও প্রকাশকের কাছে পাঠান নি। ১৮১৬ সালে তাঁর দাদা হেনরি অস্টেন হঠাৎই প্রবল আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েন ও পারিবারিক ভারসাম্য এতে প্রবলভাবে বিঘ্নিত হয়। এটাই সম্ভবত অস্টেনকে এই পাণ্ডুলিপি তখনকার মতো তাকে তুলে রাখতে বাধ্য করেছিল। তারপর অস্টেন নিজেও মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেই রোগশয্যা থেকে তিনি আর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন নি। ১৮১৭ সালে জুলাই মাসে তিনি যখন মারা যান, তখনও ক্যাথারিন মোরল্যান্ডকে কেন্দ্র করে লেখা এই উপন্যাসটি অপ্রকাশিত থেকে যায়। জেন অস্টেনের মৃত্যুর পর তাঁর প্রিয় দাদা ও দিদি – হেনরি অস্টেন ও ক্যাসান্দ্রা অস্টেন বোনের দুটি অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি প্রকাশে উদ্যোগী হন। ১৮১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘পারসুয়েশান’ এর পাশাপাশি ক্যাথারিন মোরল্যান্ড কেন্দ্রিক উপন্যাসটিও প্রকাশিত হয় এবং এর নাম দেওয়া হয় ‘নর্দাঙ্গার অ্যাবি’।
নর্দাঙ্গার অ্যাবি উপন্যাসের কেন্দ্রে আছে পনেরো বছর বয়সী কিশোরী নায়িকা ক্যাথারিন মোরল্যান্ড। ফুলার্টন গ্রামে তার পরিবারের বাস। বাবা মিস্টার মোরল্যান্ড স্থানীয় চার্চের যাজক। পরিবারে দশটি ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁদের বিরাট সংসার। মেয়েবেলাতে পুতুল অপেক্ষা সে ক্রিকেট খেলাতেই বেশি উৎসাহী ছিল। বছর পনেরো বয়সে তার ধরন ধারন কিছু বদলালো, সবার চোখে সে হয়ে উঠল সুন্দরী। তাকে আকর্ষণ করতে শুরু করল নানা ধরনের রহস্য রোমাঞ্চ ও রোমান্স। মোরল্যান্ডদের প্রতিবেশী মিস্টার অ্যান্ড মিসেস অ্যালেন ঠিক করলেন মাস দেড়েকের জন্য প্রমোদ শহর তথা বাণিজ্যকেন্দ্র বাথ এ যাবেন। নিঃসন্তান দম্পত্তি মোরল্যান্ড পরিবারের বড় মেয়ে ক্যাথারিনকেও সঙ্গে নিতে চাইলেন। মোরল্যান্ড কর্তা গিন্নির সানন্দ সম্মতি মেলার পর তাঁরা বাথ এ এসে আস্তানা নিলেন। ক্যাথরিন তখন সতেরো বছরের হয়েছে। গ্রাম ছেড়ে প্রথমবারের জন্য বাইরে পা দিল সে। নায়িকার সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাসের ঘটনাপট একেবারে শুরুতেই ফুলার্টন গ্রাম থেকে দীর্ঘদিনের জন্য সরে এল বাথ শহরে। পরে টিনলে পরিবারের আবাস নর্দাঙ্গার অ্যাবি হয়ে একেবারে শেষে তা আবার ফিরবে ফুলার্টন গ্রামে।
বাথ এক জমজমাট নগরী। আমোদ প্রমোদের নানা উপকরণ আর হরেক রকমের দোকানপাটের জন্য এর খ্যাতি আছে। এর জৌলুসের টানে দেশের নানা প্রান্তের মানুষ এখানে ছুটি কাটাতে আসেন। অ্যালেন দম্পতি ও ক্যাথারিন মোরল্যান্ডের সঙ্গে এই বাথেই পরিচয় হল থর্পে পরিবার ও টিনলে পরিবারের। থর্পে পরিবারের যে দুটি মানুষ এই উপন্যাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তারা হল জন থর্পে ও তার বোন ইসাবেলা থর্পে। নায়িকা ক্যাথারিন মোরল্যান্ড ছাড়াও এই উপন্যাসে বিশেষ ভূমিকা আছে তার ভাই জেমস মোরল্যান্ডের। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য জন থর্পে ও জেমস মোরল্যান্ড দুজনেই অক্সফোর্ডে সহপাঠী ও আগে থেকেই তাঁদের বন্ধুত্ব আছে। ইসাবেলা থর্পে আর ক্যাথারিন মোরল্যান্ড বাথ শহরেই পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হয় ও অল্পদিনের মধ্যেই পরস্পরের প্রাণের বন্ধু হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির নানা কথা তাঁরা পরস্পরকে বলে। আর তাঁদের আলোচনা জুড়ে থাকে মিসেস র্যাডক্লিফের লেখা ‘দ্য মিস্ট্রিজ অব উদলফো’র মতো নানা গথিক রোমান্সের শিহরণ জাগানো কাহিনী। অতিলৌকিক নানা ফ্যান্টাসি ক্যাথারিন মোরল্যান্ডের জীবনদৃষ্টিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। নর্দাঙ্গার অ্যাবিতে বসবাসকালে এজন্য ক্যাথারিনকে বেশ কিছু সমস্যাতেও পড়তে হয়।
ইসাবেলা থর্পে ছাড়া বাথ শহরে আর যে মানুষটি ক্যাথারিনের মন জয় করে সে হল টিনলে পরিবারের মেজ ছেলে হেনরি টিনলে। হেনরি টিনলের বোন এলিয়নর টিনলেও ক্যাথারিনের ঘনিষ্ট বন্ধু হয়ে ওঠে। টিনলে পরিবারের আরো দুজন মানুষ – হেনরি ও এলিয়নরের দাদা ক্যাপ্টেন ফ্রেডরিক টিনলে ও তাঁদের বাবা জেনারেল টিনলে এই উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে উপস্থিত।
ইসাবেলা থর্পে ক্যাথারিনের দাদা জেমস মোরল্যান্ডের প্রেমে পড়ে ও তারা পরস্পরকে বাগদান করে। কয়েক বছর পর বিয়ে হবে, এমন কথাও দুই পরিবারের মধ্যে হয়ে যায়। ক্যাথারিন ও জেমসের বাবা মিস্টার টিনলে প্রতিশ্রুতি দেন জেমস বিবাহ উপযুক্ত সময়ে পৌঁছলে তার হাতে বার্ষিক ৪০০ পাউন্ডের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।২
অন্যদিকে ইসাবেলার দাদা জন থর্পে ক্যাথরিনের প্রতি অনুরক্ত হয় এবং বারবার তাকে সম্পর্কে জড়িয়ে নিতে নানা কলাকৌশল অবলম্বন করতে থাকে। ইসাবেলাও দাদার হয়ে বন্ধু ক্যাথারিনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। তবে এইসব ছলাকলা ক্যাথারিনকে প্রবল বিরক্ত করে, কারণ সে ইতোমধ্যেই হেনরি টিনলেকে তার মন সমর্পণ করেছে। জন জোর করে মিথ্যা বলে একদিন ক্যাথারিনকে গাড়িতে তুলে তাকে শহরের বাইরে নিয়ে যায় ও এর ফলে হেনরি ও এলিয়নর টিনলের সঙ্গে ক্যাথরিনের প্রস্তাবিত পথভ্রমণ ভেস্তে যায়। ক্যাথারিন এর পর থেকে সচেতন হয়ে সবলে জন এর সমস্ত ছলাকলাকে ভেস্তে দিতে থাকে। অন্যদিকে এই বাথেই শুরু হয় টিনলে পরিবারের বড় ছেলে ক্যাপ্টেন ফ্রেডরিক টিনলের সঙ্গে ইসাবেলার গোপন সম্পর্ক। ক্যাথারিন এই সম্পর্কের বিষয়টি আঁচ করতে শুরু করে ও নিজের ভাইয়ের কথা ভেবে ক্ষুব্ধ হয়। সে বোঝে ইসাবেলা তার ভাই জেমসকে প্রতারণা করছে। হেনরি টিনলেকে এই বিষয়টি ক্যাথারিন জানালে হেনরি বলে তার ভাই আর যাই হোক ইসাবেলাকে কখোনোই বিয়ে করবে না এবং সে নিজের বাহিনীর কাজে অবিলম্বেই বাথ ছেড়ে চলে যাবে। পরবর্তীকালে নর্দাঙ্গার অ্যাবিতে বাসকালে ভাই জেমসের এক চিঠি থেকে ক্যাথারিন জানতে পারে ইসাবেলা ও জেমস গভীর গোপন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। ততদিনে আবার ইসাবেলার সঙ্গে ছলাকলাপর্ব শেষ করে ক্যাপ্টেন ফ্রেডরিক টিনলে তাকে জানিয়ে দিয়েছে ইসাবেলাকে সে কোনওমতেই বিয়ে করার কথা ভাবছে না। ইসাবেলা এতে সম্বিৎ ফিরে পায়, বুঝতে পারে এই সম্পর্কের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। সে তখন আবার ক্যাথারিনকে চিঠি লিখে জানায় জেমস তার সম্পর্কে ভুল ভাবছে ও সে জেমসের সঙ্গেই প্রণয় সম্পর্কে বাঁধা থাকতে চায়। ক্যাথারিন এর কাছে ইসাবেলার লাস্যময়ী শিকারী স্বভাব ততদিনে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এক সময়ে যে সত্যিই তার প্রাণসখী হয়ে উঠেছিল, তার চরিত্রের অন্ধকার দিক চিনতে পেরে তার থেকে সরে আসতে ক্যাথারিনের কষ্টই হয়। কিন্তু নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে সে ততদিনে আবেগকে পাশে সরিয়ে রেখে যুক্তিবুদ্ধিকে সর্বাগ্রে রাখার প্রয়োজনিয়তা বুঝেছে। সে কারণেই সে আর ইসাবেলার হয়ে দাদা জেমসকে সম্পর্কে ফেরৎ আসা বিষয়ক কোনও অনুরোধ করার রাস্তায় হাঁটে নি। ইসাবেলার সঙ্গে সম্পর্ককেও ক্যাথারিন অতীত বলে ধরে নেয়।
বাথ এ অ্যালেন দম্পতির ছয় সপ্তাহের প্রমোদবাস শেষ হলে তাঁরা একে আরো কিছুটা বাড়িয়ে দেন। তাঁরা ফুলার্টনের গ্রামে ফেরার আগেই টিনলে পরিবারের কর্তা জেনারেল টিনলে ক্যাথারিনকে তাঁদের নর্দাঙ্গার অ্যাবিতে আমন্ত্রণ জানান। অ্যালেন দম্পতির সম্মতি নিয়ে ক্যাথারিন খুশি মনে সেখানে যাত্রা করে। এই খুশির পেছনে একদিকে ছিল মনের মানুষ হেনরি টিনলের সঙ্গ উপভোগের সুযোগ, অন্যদিকে ছিল গথিক রোমান্সের কনিষ্ঠ ভক্ত পাঠিকা হিসেবে উপন্যাসকল্পনার রাজ্যে প্রবেশের বাসনা। নর্দাঙ্গার অ্যাবিতে শুরু হয় এই উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব।
মিসেস টিনলে যখন মারা গিয়েছিলেন তখন এলিয়নর টিনলে সেখানে ছিল না। মিসেস টিনলের ঘরটিও তাঁর মৃত্যুর পর থেকে বন্ধই রাখা হয়। অতিথিরা কেউ সেখানে যেতে চাইলে জেনারেল টিনলে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। ক্যাথারিনকে সেই ঘরে যেতে তিনি নিষেধ করে দেন। এইসমস্ত থেকে ক্যাথারিন ধারণা করতে শুরু করে যে মিসেস টিনলের মৃত্যু হয়ত স্বাভাবিকভাবে হয় নি, এর পেছনে কোনও রহস্য আছে। হেনরি টিনলের কাছে সে এমন ইঙ্গিৎও দিয়ে ফেলে যে জেনারেল টিনলেই হয়ত তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর কারণ আর সেটাকে তিনি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। হেনরি টিনলে এই সমস্ত অলীক কল্পনায় প্রবল ক্ষুব্ধ হয় এবং ক্যাথারিনকে বলে সে গথিক রোমান্স পড়ে পড়ে নিজের স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি বিসর্জন দিয়েছে এবং এইসমস্ত অলীক কল্পকাহিনীর কুপ্রভাবেই এসব স্বকপোলকল্পিত ভাবনায় ডুবে থাকছে। ঘটনাচক্রে কর্মোপলক্ষে বাইরে থাকা জেনারেল টিনলে এইসময়েই ‘নর্দাঙ্গার অ্যাবি’তে প্রত্যাবর্তন করেন। ফেরার পরেই তিনি এলিয়নরকে নির্দেশ দেন অবিলম্বে ক্যাথারিন মোরল্যান্ডকে তার বাড়িতে ফিরিয়ে দিতে। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও এলিয়নরকে বাবার এই নির্দেশ মানতে হয়। ক্যাথারিন ভাবতে থাকে হেনরি টিনলেকে তাঁর মার মৃত্যু সংক্রান্ত যে সব আশঙ্কার কথা সে বলেছিল, সেই সব শুনেই কূপিত হয়ে জেনারেল টিনলে তাঁকে বাড়ি থেকে দূর করে দিলেন। পরে অবশ্য জানা যায় সত্যি ঘটনাটি ছিল অন্য। জেনারেল টিনলেকে জন থর্পে মিথ্যা কাহিনী ফেঁদে জানিয়েছিল ক্যাথারিন মোরল্যান্ডের অনেক সম্পত্তি আর নিঃসন্তান অ্যালেন দম্পতির বিরাট সম্পত্তিও সেই পেতে চলেছে। বস্তুতপক্ষে এই দুটোই ছিল চরম মিথ্যা। আসল সত্যি জানার পর জেনারেল টিনলে বুঝতে পারেন হেনরি টিনলে ক্যাথারিনকে বিয়ে করলে কিছুই পাবে না। আশাভঙ্গ থেকেই তাঁর ক্ষোভ ও এক কিশোরী মেয়েকে চরম নিন্দনীয় বিতাড়ণ। বাবার এই আচরণ অবশ্য হেনরি টিনলে মেনে নেয় নি। সে এসে দাঁড়িয়েছে ফুলার্টন গ্রামে ক্যাথারিন মোরল্যান্ডের কাছে এবং তাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। এলিয়নর টিনলে যাকে ভালোবাসত সে বংশের দ্বিতীয় পুত্রসন্তান ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নয় বলে সেই বিয়েতেও এতদিন জেনারেল টিনলের সম্মতি ছিল না। কিন্তু একটি বাঁধ ভেঙে যাবার পরে তিনি এবার অর্গল খুলে দিতে বাধ্য হন ও এলিয়নরকেও অনুমতি দেন তাঁর মনের মানুষ বেছে নেবার। সম্পত্তির উত্তরাধিকার সমস্যা ও বিত্তের ফারাকের নানা বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে জেন অস্টেনের উপন্যাসের নায়ক নায়িকারা শেষ পর্যন্ত নিজেদের মনের মানুষকে যেভাবে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে সমর্থ হয়, তার ধারাবাহিকতা ‘নর্দাঙ্গার অ্যাবি’ উপন্যাসেও দেখা যায়।
এই উপন্যাসের নায়ক হেনরি টিনলে জেন অস্টেনের উপন্যাস ধারায় এক অন্য রকমের চরিত্র। সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটির নায়ক এডওয়ার্ড ফেরারের মতো কোনও অতীত ঘটনা তার জড়তার কারণ হয় নি। প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস এর নায়ক ডার্সির মতো অহংকারের গরিমা সংক্রান্ত ভ্রান্তির সংশোধনও তাঁকে করতে হয় নি। সে আদ্যন্ত শ্রেণির ঊর্ধ্বে ভালোবাসাকে, বিত্তের ওপরে চিত্তকে স্থান দিয়েছে। এজন্য প্রয়োজনে বাবার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতেও তার আটকায় নি। সে সমস্ত মন প্রাণ দিয়েই তাঁর কিশোরী বান্ধবীটিকে ভালোবেসেছে, তার দিকে ঘটে যাওয়া অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি বিচ্যুতির পেছনের কারণটি অনুধাবন করে সমস্যাটিকে বোঝার চেষ্টা করেছে। নর্দাঙ্গার অ্যাবিতে বাস পর্বে ক্যাথারিনের তাঁর মৃত্যু জনিত বিষয়টিকে ঘিরে অলীক জল্পনা ও তাঁর বাবাকে মিথ্যা দোষারোপের জন্য সে রাগ প্রকাশ করেছে ঠিকই, কিন্তু সেই রাগ মনের মধ্যে পুষে রাখে নি। গথিক রোমান্সের অতিলৌকিক কল্পনাপ্রবণ জগতে ডুবে থাকার সমস্যাটি ক্যাথারিনের কাছে মেলে ধরে তার সংশোধনের সুযোগ করে দিয়েছে। এমন অবিমিশ্র ইতিবাচক নায়ক চরিত্র জেন অস্টেনের উপন্যাসে আর পাওয়া যাবে না।
নায়িকা কিশোরী ক্যাথারিন মোরল্যান্ড এই উপন্যাসে তাঁর বয়ঃসন্ধির পর্বই শুধু পেরোচ্ছে না, গ্রামজীবন থেকে বেরিয়ে প্রথমবারের জন্য বৃহৎ জগৎ ও জীবনকে চিনছে, তার দ্বন্দ্ব সংঘাতে আন্দোলিত হচ্ছে। রোমান্স কাহিনীর নায়িকা ও গথিক উপন্যাসের পাঠিকাদের মতো করেই এই উপন্যাসে তাঁর যাত্রা শুরু, কিন্তু অভিজ্ঞতার প্রখর তাপে এই দুই মায়াবী জগতের ভাববাষ্প ক্রমশ তাঁর মন থেকে উবে গেছে। সে অনেক ভুল করেছে ও ভুল ভেবেছে, কিন্তু তার মন কখনোই পঙ্কিল আবর্তে নেমে যায় নি। হেনরি টিনলের প্রতি তাঁর প্রেমে সে ঐকান্তিক। বন্ধু ইসাবেলার ভাই জনের প্রেমের ছলচাতুরিপূর্ণ নানা প্রলোভনকে সে দৃঢ়তার সঙ্গে এড়িয়ে গেছে। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে স্যামুয়েল রিচার্ডসনের ‘পামেলা’র মতো উপন্যাসে যে নৈতিক নায়িকাকে দেখা যায়, তার ছায়া ক্যাথারিন মোরল্যান্ডের মধ্যে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। অবশ্য জেন অস্টেন রিচার্ডসনের উত্তরাধিকারী নন। তিনি আদর্শ নৈতিক চরিত্রদের সামনে রেখে উপন্যাস নির্মাণ করে পাঠককে বার্তা দিতে চান না। তাই ক্যাথারিন মোরল্যান্ডের পাশেই আমরা পাই তার বন্ধু ইসাবেলাকে। ‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ এর মারিয়া চরিত্রের সঙ্গে এই ইসাবেলার অনেক মিল। প্রেমের ক্ষেত্রে তাঁরা অক্লেশে নৈতিকতার সীমাকে ভেঙ্গে ফেলে, শরীরী প্রেমের টানে জড়িয়ে পড়ে গোপন পরকীয়ায়। ইসাবেলা তাঁর বন্ধু ক্যাথারিন মোরল্যান্ডের প্রতিও কতখানি প্রকৃত বন্ধুসুলভ আচরণ করেছে, তা ভেবে দেখার দরকার। ইসাবেলাকে ভালোবাসলেও ভাই জনের দিকে তাকিয়ে সে এই বন্ধুকে প্রায়ই বিপথে চালিত করার চেষ্টা করেছে, নানাভাবে তাকে ভুল বুঝিয়ে সমস্যাতেও ফেলেছে। অবশ্য সে নিজেও শেষপর্যন্ত পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে প্রতারিতই হয়েছে ও চেষ্টা করেছে অতীত সম্পর্কে প্রত্যাবর্তনে। ওঠাপড়া সত্ত্বেও ক্যাথারিনের সঙ্গে তার সম্পর্কসূত্রটি শেষ অবধি ছিন্ন হয়ে যায় নি।
ক্যাপ্টেন ফ্রেডরিক টিনলে একেবারেই নারীলোপুল এক শিকারী চরিত্র। ভাইবোনেদের কাছেও এটা অস্পষ্ট ছিল না যে তাদের দাদা ইসাবেলাকে কোনও মতেই বিয়ে করবে না। ‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ এর হেনরি ক্রফোর্ড এর মতো নর্দাঙ্গার অ্যাবির ফ্রেডরিক টিনলেও ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়াতে ভালোবাসে। নারী শরীরকে ব্যবহার করে সম্পর্ক থেকে সরে আসায় তারা অভ্যস্ত।
যে মাত্রায় ফ্রেডরিক টিনলে এক নেতিবাচক চরিত্র, সেই মাত্রায় না হলেও জন থর্পকে এক বিরক্তিকর যুবক হিসেবে পাঠক দেখেন। সে ক্যাথারিন মোরল্যান্ডকে ভালোবেসেছে, কিন্তু সম্মান করতে চায় নি। তার ইচ্ছে অনিচ্ছেকে বিন্দুমাত্র আমলও দিতে চায় নি। হেনরি টিনলের প্রতি ক্যাথারিন তার ভালোবাসাকে কখোনো গোপন রাখে নি। কিন্তু সেই সম্পর্কে পূর্ণমাত্রায় ওয়াকিবহাল থেকেও যেন তেন প্রকারেণ ক্যাথারিনকে পাবার উদগ্র বাসনাকে সে আটকাতে পারে নি। নানা ছল চাতুরি ও মিথ্যার আশ্রয় অবিরত নিয়ে গেছে। ক্যাথারিন হেনরি টিনলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে সে যেভাবে জেনারেল টিনলেকে ক্যাথারিনের পারিবারিক অবস্থা সম্পর্কে দুবার দুই বিপ্রতীপ রকম মিথ্যা বলেছে, তাতে ক্যাথারিনকে সম্পূর্ণ অকারণে জেনারেল টিনলের রোষাগ্নিতে পড়তে হয়েছে।
জেনারেল টিনলেও যেভাবে এক অপরিচিত যুবকের মিথ্যা কথায় বিভ্রান্ত হন এবং সেই জাত ক্রোধে এক কিশোরীর প্রতি নির্মম আচরণ করেন, তা তাঁকে চরিত্র হিসেবেই অনেকটা নিচু করে দেয়। আমরা যখন জানতে পারি ক্যাথারিনের প্রতি তাঁর সমস্ত সৌহার্দপূর্ণ আচরণের পেছনে ছিল ক্যাথারিনের সম্পত্তি জনিত ভ্রান্ত তথ্য আর ক্যাথারিন বিত্তশালী নয় জানার পরেই যখন তাঁর মনোভাব সম্পূর্ণ বদলে গেল – তখনই এই অর্থলোলুপ মানুষটির চরিত্র আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিজের মেয়েকেও একই কারণে তিনি মেয়ের ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে আটকান, কারণ সেই ছেলেটি পরিবারের দ্বিতীয় পুরুষ বলে সম্পত্তির উত্তরাধিকার পাবে না। সামন্ততান্ত্রিক মন মানসিকতা ও অর্থলোভের যাঁতাকলে বন্দী এক নেতিবাচক চরিত্র হিসেবেই জেনারেল টিনলেকে পাঠক দেখবেন।
দন কিহোতে যেভাবে শিভালরিক রোমান্সের পরম্পরাটিকে ব্যঙ্গ করে ও সেখান থেকে তার নায়ককে বাস্তবতা নামিয়ে আনে, এখানে লেখিকা প্রায় তেমনই কাজ করেন। সেকালে অত্যন্ত জনপ্রিয় গথিক উপন্যাসের ধারা ও সেন্সিবিলিটিতে ভরা রোমান্সের ধারাকে জেন অস্টেন ‘নর্দাঙ্গার অ্যাবি’তে তীব্র বিদ্রুপ করেছেন। জেন অস্টেনের উপন্যাসে যে সাধারণ হিউমার থাকে এই উপন্যাসের তার স্যাটায়ারধর্মী বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার থেকে বেশ খানিকটা আলাদা।
---
টীকা -
১। এখনকার ভারতীয় মুদ্রার মূল্যমানে যা অন্তত পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা হবে বলে অনুমান করা যায়।
২। বর্তমান মূল্যমানে ভারতীয় মুদ্রায় কম করেও বার্ষিক আঠারো লক্ষ টাকা হবে বলে অনুমান করা যায়।