না-শরীরী কাহন - নিকোলাই গোগোলের ‘ডেড সোলস' এর নাট্যরূপ - ১

ইংরেজি নাট্যানুবাদক টম কোল / বাংলা তরজমা - বিপ্লব বিশ্বাস।

[প্রাক কথা : ১৮৪২ সালে প্রথম খণ্ড আত্মপ্রকাশের পর গোগোলের এই তির্যক, হাস্যরসাত্মক উপন্যাসের (ডেড সোলস) নাট্যরূপ বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে যদিও রাশিয়ায় এই গল্প ও চরিত্র সমূহের মঞ্চরূপোযোগী উপস্থাপনের চেষ্টা শতাধিকবার হয়েছে। এ বিষয়ে সমস্যাগুলো ছিল এইরকম - অত্যন্ত সমৃদ্ধ বিস্তারিত বর্ণনা, শয়তানিবুদ্ধিতাপূর্ণ, মৌখিক বক্তব্যগুলির চলন এতটাই বাড়াবাড়ি রকমের যে তাকে অভিনয়যোগ্য করে তোলা একরূপ অসম্ভবই ছিল। তা সত্ত্বেও এই উপন্যাস হাতছানি দেয় কেননা এর চরিত্রসমূহ রুশ অভিজাত ভাঁড়েদের সারি আর এর বিছানো জমিতে গাদাগাদা হাস্যরসের খোরাক। রুশ আইনের এক মোচড়ে এক ব্যবসায়ী এখানে ওখানে ঘুরে আর অশরীরী ভূমিদাসদের ( ওদের কথায় ‘আত্মা’) কিনে নিয়ে কীভাবে তার ভাগ্য ফিরিয়ে ফেলল এবং তারপর তাদের বন্ধক রেখে সরকারের কাছ থেকে প্রচুর ঋণ নিল তারই মজাদার কাহিনি এই উপন্যাসজুড়ে। এখানে হাসির খোরাক প্রচুর, আছে মঞ্চোপযোগী শক্তিশালী উদ্ভট সব ছবি। শুধু গোগোল- সৃজিত দুনিয়ার পলায়নী, পাগলপারা যৌক্তিক বোধকে ধ্বংস না করেই এর নাট্যরূপ দেওয়া সম্ভব। এখানে একটি মজার বিষয় সংযোজন করি- মূল বইটি প্রকাশিত হওয়ার আগে কবি পুশকিনকে গোগোল পড়ে শুনিয়েছিলেন। পুশকিন তো হেসে কুটিকুটি যেহেতু এর উদ্ভট কাণ্ডকারখানা ও চরিত্রের মাঝে অট্টহাস্যের খোরাক যথেষ্ট ছিল। কিন্তু পড়া শেষ হলে পুশকিন বুঝতে পারলেন যে এইসব হাসির মধ্যে জড়িয়ে আছে গভীর যন্ত্রণা ও বেদনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেছিলেন, ‘ ভগবান! রাশিয়া কী দুঃখের দেশ!’ বিপ্লবী সাহিত্যিক চের্নিশেভস্কি বলেছিলেন, ‘ গোগোল এ উপন্যাস লিখে আমাদের নিজেদের সম্বন্ধে সচেতন করে তুললেন।’

     যাই হোক, শেষত ১৯৩২ সালে মিখাইল বুলগাকভ, কনসটানটিন স্তানিস্লাভস্কি ও তাঁর অসাধারণ নাট্যব্যক্তিত্বদের প্রতিভার সমন্বয়ে মস্কো আর্ট থিয়েটার এর নাট্যরূপ মঞ্চায়িত করে। বুলগাকভ, গোগোলের মতোই লেখক ও নাট্যব্যক্তিত্ব। তিনি স্তানিস্লাভস্কি ও তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করে এমন কাঠামো দাঁড় করান যেখান থেকে কুশীলবেরা নাটকের চরিত্রদের এমনভাবে উপস্থাপিত করবে যা রুশ শ্রোতারা দীর্ঘদিন যাবৎ দেখবে- শুনবে বলে মুখিয়ে ছিল। মঞ্চনাটকের স্বার্থে মূল উপন্যাসের বিচ্যুতিগুলোর অনেকটাই বাদ দিতে হয় ; কিন্তু এই যথাযথ রূপান্তর একটি ক্লাসিক শিল্পকর্ম হিসেবে আর্ট থিয়েটারের সংগ্রহে তার জায়গা করে নেয় - মস্কো তথা বিদেশের মাটিতে নানান পরিবর্তন ও পরিমার্জনের মাঝ দিয়ে। এই দলের এক প্রখ্যাত অভিনেতা ভি ও টপোরকভ একসময় বলেছিলেন, চিচিকভের অসম্ভব বাঁকালো চরিত্রকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে তাঁর দশ বছর লেগেছিল।

     এরপর আসে টম কোলের কথা যাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা নিউ জার্সির প্যাটারসন শহরে। হারভার্ড থেকে শ্লাভ ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক। ১৯৬০/৭০ দশকে তাঁর কাহিনিগুলি নানান পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রাশিয়ার প্রেক্ষাপটে নিবদ্ধ তাঁর প্রথম গল্প ‘আটলান্টিক’, ‘ ফার্স্ট’ পুরস্কারে ভূষিত হয়। তিনি প্রচুর চলচ্চিত্রের কাজ করেছেন। তাঁর প্রথম নাটক ‘ Medal of Honor Rag’ ১৯৭৬এ বস্টনের থিয়েটার কম্পানি দ্বারা মঞ্চায়িত হয়। এরপরেও তিনি প্রচুর মঞ্চ সফল নাটক লিখেছেন। মিলওয়াউকি রেপার্টরি থিয়েটারের শিল্পনির্দেশক জন ডিলনের সঙ্গে মানসিক সমঝোতার পর কোল উক্ত থিয়েটারের জন্য একটি রুশ নাটক তরজমায় রাজি হন, এই শর্তে যে এই তরজমা ওই থিয়েটারের তাৎকালিক বর্ধমান খ্যাতির সঙ্গে সমতা রেখে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়াবে। এরই ফলস্বরূপ তৈরি হয় এই অভিযোজিত অনুবাদ - গোগোলের ‘ ডেড সোলস’। উপন্যাসের যা কিছু বুলগাকভ বাদ দিয়েছিলেন, বারবার তা থেকে রসদ ছেনে, গোগোলিয়ো মতবাদকে উত্তরোত্তর জায়গা করে দিয়ে এই নাটক বারবার পরিমার্জিত হয়েছে যদিও কখনও কখনও তা জটিল হয়েছে। তাই এই তরজমা কিছুটা বুলগাকভের রুশ তরজমা ও কিছুটা উপন্যাসাংশের নবতর নাটকীয় রূপ। কখনও বা গোগোলের অননুকরণীয় আখ্যান থেকে খণ্ডচিত্র নিয়ে, তাঁর ব্যবহৃত কিছু ধুয়া( refrain) কাজে লাগিয়ে দেখানো হয়েছে যে মানুষের অবস্থা একই সঙ্গে মজাদার ও হৃদয়বিদারক যা চরম পর্যায়ে চলে যেতে পারে ; কিংবা অন্যত্র যেভাবে দেখানো হয়েছে সেই অবস্থা যা এতটাই বিফল যে গুরুত্ববহ হয়ে উঠতেই পারে না। ]

      নাটকের চরিত্রাবলি :

–--------------------------------

   চিচিকভ

   জোতদার - চিচিকভের মক্কেল

   পেত্রুশকা - চিচিকভের চাকর

    রাজ্য মর্টগেজ ব্যাঙ্কের সেক্রেটারি

 প্রাদেশিক কর্তাব্যক্তিগণ:

–----------------------------------

   দূরস্থ প্রদেশের গভর্নর

   গভর্নরের চাকর

   গভর্নরের স্ত্রী

   গভর্নরের মেয়ে

   ইভান আন্দ্রিয়েভিচ, পোস্টমাস্টার

   ইভান গ্রিগোরেভিচ, বিচারালয় সমূহের প্রেসিডেন্ট

   আনা গ্রিগরিয়েভনা, গ্রিগোরেভিচের স্ত্রী

   শাশা, তার চাকর

   অ্যালেকসি ইভানোভিচ, পুলিশপ্রধান

   একজন সাধারণ পুলিশ কনসটেবল

   অ্যান্টিপেটার জাখারিয়েভিচ, পাবলিক প্রসিকিউটর

   অন্যান্য শহরবাসী :

–-----------------------------

   সোফিয়া ইভানোভনা, আনার বান্ধবী

    ফাদার কিরিল

    কোপিকিন

 জোতদারগণ:

–--------------------

   মানিলভ

   লিজানকা মানিলভা, মানিলভের স্ত্রী

   সবাকেভিচ

   প্লায়ুশকিন

   মাভরা, ওই হাউজকিপার

   প্রশকা, ওই চাকর

   নজদ্রেভ

   মিঝুয়েভ, ওই শ্যালক

   করোবোচকা

   ফেটিনিয়া, ওই মহিলার চাকর।

চরিত্রবিষয়ক দুটি পাদটীকা :

–-------------------------------------------

  চিচিকভ:

 –-----------

এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র তথা পরিকল্পক চিচিকভের ভূমিকায় যথাযথ অভিনয় করা প্রকৃতই কঠিন কেননা চরিত্রটি গিরগিটিসদৃশ যে কিনা যখন যার সামনে খাড়া হবে তাদেরই অবিশ্বাস্য হাস্যরস অনুযায়ী নিজস্ব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে এবং তা অবশ্যই স্বকীয় স্বভাবটা ঠিকঠাক বজায় রেখে তা যতই শূন্যগর্ভ মনে হোক না কেন। আরও সমস্যা হল, যদি নাটকের প্রতিটি দৃশ্য একটি পূর্ণাঙ্গ ছোটো নাটক হিসেবে উপস্থাপিত করা না যায় তাহলে চিচিকভের এই যে নবতর পরিকল্পনা নিয়ে এক থেকে অন্যে স্থানান্তর তার আখ্যানগত গুণটি বিপর্যস্ত হয়। এ বিষয়ে অভিনেতা টপোরকভ তাঁর হ্যান্ডবুকে মনোরম ভঙ্গিতে লিখে গিয়েছেন।

    অনেকেই মনে করেন চিচিকভ উনিশ শতকের Banality -of- evil খেতাব পাওয়ার এক আদর্শ চরিত্র। তার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে তার ‘ মনস্তাত্ত্বিক ভাবনা হল একপ্রকার সন্তুষ্টি ও তার জ্যামিতিক প্রকাশ গোলাকার।’ একজন পাক্কা ব্যবসায়ীর মতোই তার কাজকর্ম। গোগোলিয়ো ভাষায় সে একটা খাঁটি Poshlost ( ভ্লাদিমির নবোকভ এই শব্দটা ইংরেজিভাষীদের জন্য ব্যবহার করেন, গোগোলকে নিয়ে লেখা তাঁর ক্রিটিক্যাল বায়োগ্র‍্যাফিতে। নবোকভ বিশ্বাস করতেন, এই শব্দটি ‘ডেড সোলস 'এর চরিত্রদের বিশেষত্ব অনুযায়ী সুপ্রযুক্ত) যার আভিধানিক অর্থ করা হয়েছে অশিষ্টতা বা অতি সাধারণ আচরণ ; কিন্তু চিচিকভের চরিত্রে তা নির্দিষ্ট হয়েছে ‘ আত্ম - সন্তুষ্ট নিকৃষ্টতা’ অথবা আরও ভালো ‘ নম্র উচ্চাকাঙ্ক্ষী নিকৃষ্টতা’ হিসেবে।

নজদ্রেভ:

–-----------

 নাটকের মেরুদণ্ড যদি হয় চিচিকিভ তবে সেখানে নজদ্রেভ জোগান দেয় শক্তি, ধাক্কা যা স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক কাজকামে ঘনঘন গোলমেলে জট পাকিয়ে ফেলে। জন্ম ইস্তক সে এক মিথ্যেবাদী যে নিজে যা বলে তা সবই বিশ্বাস করে। সে পুরোপুরি ক্ষণিক অনুপ্রেরণায় বাঁচে। তার প্রতিটা কাজ, প্রতিটা ধারণা, প্রতিটা ভেবে নেওয়া সুযোগ, প্রতিটা তাৎক্ষণিক অনুভব বহিরঙ্গে প্রকাশিত যা তার মুখনির্গত হয় অনিয়ন্ত্রিত শব্দঝড়ের বেগে। ‘ রুশ ভাষায় তার বক্তব্য আকস্মিক, ব্যক্তিক আবেগপূর্ণ ও অন্যান্যদের চাইতে খোলামেলা এবং ঝাঁঝালো। উক্ত অনুবাদে তার কথার ফাঁকে ফাঁকে বিশেষ কিছু উচ্চারণ রাখা হয়েছে যেমন ওই,ওই (oi oi) ও নু ( nu) যা এখানে ইহুদিকৃত বলে ধরা যায় যেহেতু আমেরিকি হাস্য- অভিনেতারা এইভাবেই এগুলোর ব্যবহার করে কিন্তু কার্যত ইহুদিদের কাছ থেকে ধার করে রুশ অভিনেতারাও এ সব ব্যবহার করে থাকে। নজদ্রেভ কিন্তু ইহুদি নয়। সে এক নিষ্কর্মা জোতদার ; কিন্তু তাকে যদি একটি ছটফটে, জীবন্ত, পাগলাটে এবং প্রাদেশিক প্রতিষ্ঠানের মাঝে একজন শাদামাটা বিদেশি বলে ধরা যায় তবে তাকে ইহুদি বলতেই হয়।

–-----------------------------------------------------------------------------------------------

নাটকের পটভূমি : ১৮৩০ সময়কালিক রাশিয়া।

–--------------------------------------------------------

                          প্রথম অঙ্ক / প্রস্তাবনা-

                       –---------------------------------

    জার প্রথম নিকোলাসের বিশাল ছবিটার সামনে খাটো অবস্থায় স্ব-গুরুত্ব - আরোপিত আমলাটি খালি মঞ্চে তার একাকী ডিনার সারছে। সে রাজ্য মর্টগেজ সংসদের সেক্রেটারি - নিচুতলার মন্ত্রীপদের সমান।

     এমনি সময়ে চিচিকভের প্রবেশ। লোকটা খুব মোটাও নয়, খুব বয়স্কও নয় আবার যুবকও নয়। সে ভদ্রসম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত বটে তবে খুব উঁচুস্তরের নয়। সিভিল সার্ভিসের পদাধিকারী, কিন্তু খুব ওপরেও নয়, আবার খুব নিচেও নয়। সংক্ষেপে, এক মাঝারি গোছের মানুষ।

     চিচিকভের হাতে এক বোতল শ্যাম্পেন আর তার পিছনে এক মক্কেলের অর্থাৎ এক জোতদারের ধ্বস্ত ছায়া যে কিনা খুব খারাপ সময়ে এসেছে।

   চিচিকভ: এই যে সেক্রেটারি সাহেব?

   সেক্রেটারি : মি. চিচিকভ? না, না, আপনি নিশ্চয়ই নন। বলুন  আমার ভুল হচ্ছে।

                    সারা সকালটা তো আমার অফিসেই ছিলেন, এক্কেবারে এঁটুলির মতো।

                     রাতে আবার আমার এই খাবার টেবলে?! আপনি তো আমাকে

                     জ্বালিয়ে মারলেন মশাই?

    ( চিচিকভ শান্তভাবে শ্যাম্পেন বোতলের ছিপিতে মোচড় দেয়।) সেক্রেটারি বলেই চলে : শুনুন ভাই শুনুন। আমি জানি, আপনি আপনার কাজ করছেন। কিন্তু আমি তো আপনাকে বলেছি যে এই ব্যাপারে আপনার জন্য আমার কিচ্ছুটি করার নেই।

     চিচিকভ : সেক্রেটারি মহোদয়, আপনার প্রতি যথাযথ সম্মান জানিয়ে বলতে চাই, এ ব্যাপারে রাজ্য বন্ধকি ব্যাঙ্কের কোনও সিদ্ধান্ত না জানা পর্যন্ত আমি এখান থেকে একচুলও নড়ছি না। আমার খদ্দের কেটে পড়ছে।

সেক্রেটারি : আপনার খদ্দের আর্থিকভাবে পুরো দেউলিয়া।

চিচিকভ : ( সেক্রেটারির জন্য পাত্রে শ্যাম্পেন ঢালতে ঢালতে) আঃ, সেক্রেটারি সাহেব, আপনি তো জানেন, মানুষের দুর্বলতা সাগরের বালির মতোই অসংখ্য।

সেক্রেটারি : তা আপনি বারবার বলতে পারেন। অর্ধেক সম্পদ তাস খেলে উড়িয়েছে, বাকি অর্ধেক পান করে - এভাবেই রাজঢঙে বিশাল সম্পত্তি উড়ান- পুড়ান করেছে। আপনি আশা করছেন, এইসব বাঁচাতে ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক বন্ধকি লোন দেবে?... ( মক্কেলের দিকে আঙুল উঁচিয়ে) আর তুমি আশা করো ওই ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি হিসেবে… ( হঠাৎই হুমকির সুরে) কার সামনে খাড়িয়ে আছ, জানো?

চিচিকভ : অবশ্যই জানি স্যার আর আমি আপনাকে যথেষ্ট সম্মানও করি,আমি…

সেক্রেটারি : না। ওই যে( জারের ছবিটা দেখিয়ে), ওঁর ছবির নিচে তুমি দাঁড়িয়ে আছ। জানো, উনি কে?

চিচিকভ : নিকোলাস, স্যার… আমাদের প্রিয় সম্রাট…

সেক্রেটারি : প্রিয়?প্রিয় না ছাতা। সত্য এবং প্রতিহিংসা একটার মধ্যে ঢুকে গেছে। তা হল পবিত্র ন্যায়, করুণায় ধোয়া। তিনি যখন একান্তে আমাকে টেনে নেন, তখন আমি কী বলি? আমি এক অকিঞ্চিৎকর অধম। তখন তিনি বলেন, এমনটা করেছ কেন? আমি কি তখন বলব, হে সর্বশক্তিমান ( তিনবার, মহান স্যার), আমি রাজকোষ তছনছ করেছি, পবিত্র বিশ্বাস ভঙ্গ করেছি, শুধু এই উকিল চিচিকভের জন্য? তিনি বলবেন, ওকে এখানে নিয়ে এস। আমি জোড়হাত করে বলব, চিচিকভের কোনও ক্ষতি করবেন না, মহোদয়। তিনি বলবেন, ওর শিরা-উপশিরায় রক্তের বদলে মাখন কেন? চোখ দিয়ে কেন ওর দুধ ঝরছে? ও ক্ষতিকারক, বদমাশ, দুর্নীতিগ্রস্ত। আমি তখন তোমার হয়ে ওঁর কাছে ওকালতি করে যাব, কিন্তু প্রভু, আপনি শুনুন, চিচিকভ একটি মাঝারিগোছের নরম- সরম মানুষ। আমি কীভাবে জানব ও রাজ্যকে এমন হেয় করতে চায়? ( এরপর জারের কণ্ঠ নকল করে)... আমার চাবুক লে আও, বরফ লে আও,তোদের দুজনকেই নাঙ্গা করে বইকাল হ্রদে ডোবাব। শরীর থেকে সব চামড়া ছাড়িয়ে নেব। তারপর এইসব লেনদেন নিয়ে কথা চালাতে দেব যখন তোদের ছিন্নভিন্ন স্নায়ুতন্ত্রীগুলো আর কুঁকড়ে যাওয়া মাংসপেশী ভাঙাচোরা হাড়ের গায়ে জমে হাড় হয়ে যাবে। আর বসন্তে তোদের শরীর যখন হাড়হিম হয়ে যাবে, নেকড়ের দল তখন তোদের ছিঁড়ে খাবে। ( এবারে স্বকণ্ঠে ফিরে এসে)... এ সবই ঘটবে তখন মি. চিচিকভ। এভাবেই নিকোলাস তোমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাববেন।

  [ সেক্রেটারি খেয়েই চলে। জারের ভয়ংকর হুমকিতে সিঁটিয়ে থাকে চিচিকভ ও তার মক্কেল। এরমধ্যেও চিচিকভ নাছোড়ের মতো অনুনয় চালাতে থাকে ]

 চিচিকভ : কিন্তু সেক্রেটারি মহোদয়, এটা তো এ কারণে নয় যে আমি এক সদাশয় ব্যক্তি। সেটা তো কোনও যুক্তি হতে পারে না।

 সেক্রেটারি : তাহলে কী?

 চিচিকভ : আমার মক্কেল একজন সম্পদশালী ব্যক্তি। ওর অধীনে অনেক কৃষক প্রজা আছে।

 সেক্রেটারি : ওর ওই প্রজাদেরকে তুমি জামানত হিসেবে রাখতে চাও?

 চিচিকভ : ঠিক তাই।

 সেক্রেটারি : কত? মাথাপিছু?

 চিচিকভ : দুশো রুবল। প্রত্যেক মৃত আত্মার জন্য।

 সেক্রেটারি : ( জোর হেসে) প্রতি আত্মার জন্য দুশো রুবল?

 চিচিকভ : হ্যাঁ স্যার, রাজ্য বন্ধকি ব্যাঙ্কে…

 সেক্রেটারি : রাজ্য বন্ধকি ব্যাঙ্ক মাতাল আর জুয়াড়িদের কর্জ দিতে তৈরি হয়নি, মশাই?

  চিচিকভ : আরে মশাই, অ্যাতো কঠোর হচ্ছেন কেন? ওর সম্পত্তির যা হবার তা হবে। আপনারা তো পাওনা পেয়েই যাবেন। খারাপ ফসল, ফসলের রোগবাগ, দেখভালের লোকের চুরিচামারি… এ সব তো যে কোনও জোতদারের ক্ষেত্রেই হতে পারে। পারে না?

 সেক্রেটারি : যাই হোক, মি. চিচিকভ, আমার শেষ কথা হল, এটা হবে না। আপনার আর কিছু বলার আছে কি?

 চিচিকভ : আছে। ( পকেট থেকে একতোড়া টাকা বের করে) আপনি যদি কিছু মনে না করেন স্যার ( এই বলে সেক্রেটারির দিকে টাকার বান্ডিলটা ঠেলে দেয়)...

 সেক্রেটারি : ও, ঠিকাছে। এমন জটিল প্রশ্নের অবশ্য সব সময় আর একটি দিকও থাকে ( টাকাটা তুলে নেন) আমরা মানুষের রক্ষক, আমরা কি ওই পুরনো দিনের কঠিন ইহুদি ফারিসিদের মতো হতে পারি? আমরা রাজ্য বন্ধকি ব্যাঙ্কের সদস্যরা তো আপনার এই মক্কেলের মতো উদ্যোগী কৃষক - জোতদারদেরই সাহায্য করার জন্যই আছি, মি. চিচিকভ। ( টাকাটা গুনে নেয়)... আঃ, তবে আপনি তো জানেন, সংসদে আমি একা নই। অন্যরাও আছেন।

 চিচিকভ : সব জানি। তাদেরও ঠান্ডা হতে দেওয়া হবে না, সেক্রেটারি সাহেব। ঈশ্বর না করুন, আমিও তো সরকারের সেবা করেছি। আমি জানি।

 সেক্রেটারি : ঠিকাছে, তাহলে আসুন, কাগজপত্রগুলো দেখে-টেখে নিই।

 চিচিকভ : ( কাগজপত্র তুলে ধরে) দাঁড়ান, এগুলি এক জায়গায় পিন করে দিই। আর একটা কথা, আমি আপনার জন্য একটি বন্ধকি তালিকা তৈরি করেছি ; কিন্তু এর মধ্যে অর্ধেক চাষিই, কী বলে, মৃত। সে কারণে পরে এদের কিন্তু ধরে পাওয়া যাবে না। ঠিকাছে?

 সেক্রেটারি : আপনি একটা পুরো জোতদারির প্রতিনিধিত্ব করছেন। অথচ পুরোটাই তো গড়বড়ে মনে হচ্ছে। অর্ধেক চাষিই মৃত আর তাই নিয়ে দরাদরি?! 

 চিচিকভ : দয়া করে শুনুন, সেক্রেটারি মশাই।

 সেক্রেটারি : ঠিকাছে, সেভাবেই দেখা যাক। আচ্ছা, গত সরকারি আদমশুমারির রিপোর্ট অনুসারে এই মড়া-ধড়া যাদের নিয়ে আপনি চিন্তা করছেন, তাদের নাম কি মৃত হিসেবে নথিভুক্ত ছিল নাকি জীবিত হিসেবে?

 চিচিকভ : অবশ্যই তারা এখনও জীবিত হিসেবেই নথিভুক্ত আছে ; কিন্তু পরবর্তী শুমারি এলে কী হবে তা…

 সেক্রেটারি : আর একটা শব্দও নয়। আপনি এই চাষিদের চেনেন। একজন মরে তো আর একজন বেঁচে ওঠে। শেষ পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে। যতক্ষণ সেনসাস রিপোর্টে ওদের নাম জীবিত হিসেবে নথিভুক্ত আর তাদের নামে করও দেওয়া হতে থাকবে - আমার হিসেবে তারা জীবিতই। আপনার মক্কেল এদের সবার নামে ট্যাক্স দেয় কি? প্রতিটি নামের ক্ষেত্রে? 

      মক্কেল টাল খেতে থাকলে চিচিকভ তাকে খাড়া করে দাঁড় করায়।

 চিচিকভ : ও, হ্যাঁ, হ্যাঁ।

 সেক্রেটারি : তাহলে ঠিক আছে, মি. চিচিকভ। আমি আইনের পথ ধরেই হাঁটব। এটাই আমার জানার মূল বিষয় ( এই বলে চিচিকভের হাত থেকে বন্ধকি তালিকাগুলো নিতে থাকে)।

 চিচিকভ : ( হঠাৎ মুখের রং পালটে যায়। কপালে বাড়ি মারে) আঃ… ( এরপর ধরে থাকা মক্কেলকে ছেড়ে দিলে সে পড়ে যায়)।

 সেক্রেটারি : কী হল?

 চিচিকভ : ও কিছু না ( মক্কেলকে আবার দাঁড় করায়)।

 সেক্রেটারি : ও ঠিকাছে। এই বন্ধক দিয়েই আমাদের কাগজপত্রের কাজকাম শুরু করা যাক।

       এরপর সেক্রেটারি ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠে চিচিকভ হতভম্ব মক্কেলকে আবার ফেলে দিতে যায়।

 চিচিকভ : পেত্রুশকা, পেত্রুশকা, পেত্রুশকা (তাকে  খুঁজে পেতে চিচিকভ ছুটে ছুটে গোলাকারে ঘুরতে থাকে) ; জানি সে এখানে আছে। আমি ওর গন্ধ পাচ্ছি। পে- ত্রু-শ- কা…।

      শেষ অবধি ওরই মতো পরিত্যক্ত, পুরনো কম্বল বা কোটের স্তূপ থেকে পেত্রুশকা বেরিয়ে আসে। মদমত্ত সে খামচে খামচে গোঙাতে গোঙাতে আসছে। সে চিচিকভের চাকর তথা ড্রাইভার।

 পেত্রুশকা : প্রভু?...

 চিচিকভ : নচ্ছার, নোংরা, মাতাল, নোংরার ডাঁই!

 পেত্রুশকা : হ্যাঁ স্যার, ঠিক বলেছেন স্যার ( এই বলে হাতের ছড়িটা দোলায়)।

 চিচিকভ : তুই এখানে এলি কী করে?

 পেত্রুশকা : তাইতো, কীভাবে এলাম!

 চিচিকভ : আমিও তো সেটাই জানতে চাইছি। তোকে তো অনেকক্ষণ খুঁজছি?

 পেত্রুশকা : জানি না, কীভাবে আমাকে বের করলেন! আমি নিজেই জানতাম না যে আমি এখানে!

 চিচিকভ : তোর গন্ধ পেয়েছিলাম শয়তান। তুই কি খানিক ভালো হয়ে থাকতে পারিস না?

 পেত্রুশকা : সবই তাঁর ইচ্ছা, প্রভু ( নোংরা কোটটা মেলে ধরে ভিতরের গন্ধ শোঁকে) তাঁর কাজকারবারই অদ্ভুত! 

 চিচিকভ : হ্যাঁ, ঠিক তাই। ঠিক তাই। পেত্রুশকা, তাড়াতাড়ি কর। আমার কপাল খুলতে চলেছে। আমি পথের সন্ধান পেয়েছি। শেষ পর্যন্ত পেয়েছি। ( সেক্রেটারির টেবিলটি দেখিয়ে) সেক্রেটারি সাহেব আমাকে পথ দেখিয়েছেন। মরা আত্মাদের দিয়েই আমি আমার ভাগ্য ফেরাব।

 পেত্রুশকা : ( তেজ ফিরে পেয়ে ছড়ি দুলিয়ে হাঁক পাড়ে) উড়ে চল ছোকরার দল। তেজ চল। ট…প…র…র…।

      বাজনা বেজে ওঠে। আলো পালটায়।

                                      প্রথম অঙ্ক : প্রস্তাবনা -

                                    –-----------------------------------

    রাস্তা। পেত্রুশকা গাড়ি চালাচ্ছে। রুশ গ্রাম- প্রকৃতির মাঝ দিয়ে, নীরবতা ভেঙে। গাড়িতে বসে চিচিকভ। 

 চিচিকভ : গভর্নর হাউজ চল। ওখানেই যেতে হবে।

 পেত্রুশকা : হাপ, হাপ, উড়ে চল ছোকরার দল। উড়ে চল।

 চিচিকভ : এরপরেও কি আমার সম্পর্কে লোকে বলবে, আমি সন্তানদের জন্য কিছু রেখে যাইনি? বলবে, আমি এক অদূরদর্শী বাবা? বলবে, আমি শুধু ওদের জন্য ছেঁড়া কম্বল আর উপবাস ছেড়ে গেছি? ঈশ্বর না করুন! ( ধর্মীয় ঢঙে ক্রশ টেনে) অবশ্য আমার কোনও ছেলেপুলে নেই। এটা ঠিক। কিন্তু ঈশ্বরের দয়ায় একদিন যে উত্তরসূরি হবে না, কে বলবে! এবং তাদের জন্যই লাখ লাখ টাকা আমি রেখে যাব। শুধু তাদের জন্যই আমি যে কোনও পরীক্ষার মাঝ দিয়ে যেতে রাজি। শুধুই ওদের জন্য, পেত্রুশকা!... ওই ছোটো ছোটো দুষ্টুমিষ্টিদের জন্য। আমার সামনে পথ এখন পরিষ্কার। রাস্তার মাইল-ফলকের মতোই তা আমার চোখের সামনে স্পষ্ট পড়ে আছে। ট্যাক্স! আমাকে যা দিতে হবে তা শুধু ট্যাক্স। এবং তার জন্য ওরা আমাকে হাত খুলে আশীর্বাদ জানাবে। ( হতবাক হয়ে) ও! জমি! জমি ছাড়া তুমি চাষিদের কিনতে পারো না। বোকাপাঁঠা কোথাকার! আমি কী করব, পেত্রুশকা? আঃ, স্থানান্তর! হ্যাঁ, ওদের আমি খেরশন জেলায় বদলি করে দিতে পারি। ওখানেও জমি-টমি দেওয়া হচ্ছে। যদিও ওটা অনুর্বর মরু অঞ্চল। তাতে কী? আমার চাষিরা তো সব মরে যাবে। ঈশ্বর ওদের আত্মার শান্তি দিন।( ধর্মীয় ঢঙে আবার ক্রশ টেনে) ঈশ্বর, এটা কোন প্রদেশ? রাস্তাগুলো সব জঘন্য। গভর্নরের বাড়ি এলাম কি পেত্রুশকা?  এই পেত্রুশকা, ঘুমাচ্ছিস নাকি?

 পেত্রুশকা : ( অস্পষ্টভাবে কিছু বলে) 

 চিচিকভ : ব্যাঙছাতা কোথাকার। ব্যাটা, পচা ওলকপি একটা।

 পেত্রুশকা : হ্যাঁ প্রভু। চল বেটা, উড়ে চল। গভর্নরের বাড়ি। চল…

                                            প্রথম অঙ্ক : প্রথম দৃশ্য

                                         –----------------------------------

   সুন্দর সব সুচিকাজের ঘেরাটোপে একটা ট্যাম্বুরের পাশে বসে এক নতুন সুচিকাজে ব্যস্ত গভর্নর। তিনি একটি ড্রেসিং গাউন পরে আছেন, অর্ডার অফ সেন্ট অ্যান গলায় ঝুলছে। হাতে কাজ করতে করতে তিনি একটি জনপ্রিয় লাজুক লাজুক সুর ভাঁজছেন, বিষয়টা ওই নকল প্রেম, অনেকটা ছেনালির মতো লাগছে। তখনই চাকর প্রবেশ করে :

 চাকর : কোন এক প্যাভেল ইভানোভিচ চিচিকভ কলেজিয়েট কাউনসিলর - টিলর হবে, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

 গভর্নর : চি- চি - ক - ভ? আমার ফ্রক কোটটি দাও।

      চাকর গভর্নরকে লম্বা ফ্রক কোটটি গায়ে ঢোকাতে সাহায্য করে। ওর গলাতেও অন্য একটা গানের দূর। বিষয় সম্ভবত এরকম - কোনও বুড়ো এক যুবতীর প্রেমে পড়ে বড্ড বোকামি করে ফেলেছে যেন।

 গভর্নর : ওকে নিয়ে এস।

       চাকর বেরিয়ে যায়। চিচিকভ ঢোকে।

 চিচিকভ : মান্যবর, ( গভীর স্তাবকতাসুলভ মাথা নুইয়ে) আপনার এই সুন্দর শহরে প্রবেশ করামাত্র আমি এটি মহান কর্তব্য বলে অনুভব করলাম যে এই শহরের নামি নাগরিকদের ও প্রভুদের আমার সম্মান জানিয়ে যাই। সর্বোপরি আপনাকে আমার শ্রদ্ধা মিশ্রিত বিনীত সম্মান জ্ঞাপন করি। গ্রহণ করুন ইয়োর এক্সসেলেন্সি৷

 গভর্নর : ও, ঠিকাছে, ঠিকাছে। আপনি আসাতে খুবই খুশি হলাম। আপনি বসুন।

        চিচিকভ বসে পড়ে।

গভর্নর : চাকর বলছিল, আপনি নাকি পদাধিকারে কলেজিয়েট কাউন্সিলর?  কোথায় কাজ করেছেন? 

 চিচিকভ : স্যার, আমি যে পদে প্রথম এই পবিত্র রাশিয়ার সেবা করেছি তা হল ট্রেজারি দপ্তরে। পরে অন্যান্য জায়গায়। যেমন, নির্মাণ - কমিশন।

 গভর্নর : কীসের নির্মাণ?

 চিচিকভ : নির্মাণ মানে, হে মহানুভব, যেমন ধরুন, মস্কোয় রক্ষাকর্তা খ্রিষ্টের ক্যাথিড্রাল। আবার ধরুন, প্রিভি কাউনসিলেও কাজ করেছি, হে মহানুভব। তারপর কাসটমসে অর্থাৎ শুল্ক দপ্তরেও।

 গভর্নর : শুল্ক দপ্তরে?  সেখানে তো আপনাকে কোনও উচ্চ পদাসীন দেখেছি বলে মনে হয় না!

 চিচিকভ : সে সব অনেক আগেকার কথা স্যার। এই দুঃখের উপত্যকায় অতি কষ্টে পথ করে এগিয়ে যাওয়া আমি এক অকিঞ্চিৎকর কীট মাত্র। আমার একমাত্র গুণ, ধৈর্য, অসীম ধৈর্য। ধৈর্য আর নম্রতা। আর এই কষ্টের পথে এ সবের বিনিময়ে দেশসেবা করতে গিয়ে শত্রুদের কাছ থেকে কী পেলাম? ( ঘনিষ্ঠ হয়ে) আমি কি একে ষড়যন্ত্র বলব? আমার জীবনের বিরুদ্ধে এক জবর অভিসন্ধি? কলম বা রং কিছুই সম্ভবত এর ছবি আঁকতে পারবে না। আমার জীবনটা, হে মহানুভব, একটা ভঙ্গুর তিন- মাস্তুলের ছোট্ট নৌকার মতো যা ঢেউয়ের আঘাতে খালি এদিক-ওদিক করে।

 গভর্নর : একটা ভঙ্গুর…

 চিচিকভ : ছোট্ট তিন মাস্তুলের নৌকা,হে মহানুভব।

 গভর্নর : এভাবেই বাড়ি খেতে খেতে কি আপনি এখানে এসে পড়েছেন?

 চিচিকভ : রাশিয়াময় ঘুরে বেড়ানোই আমার কাজ, স্যার ; যদি এভাবেই দেশের কোনও এক কোণে কোনও এক গোধূলি এট্টু শান্তিতে কাটাতে পারি আর এভাবেই সুযোগ ঘটে যায়, এ মাটির কোনও বর্ণময় বাঁক আর তার মানুষজনের সঙ্গে পরিচিত হবার।

 গভর্নর : বর্ণময়!

 চিচিকভ : হ্যাঁ, মহানুভব। এটিই আমার গভীর নিরীক্ষার ফল ; এক গভীরতর বিজ্ঞান ; একটি বই যা শ্বাস নেয় ও বাঁচে।

 গভর্নর : ওঃ, ঠিক কথা, ঠিক কথা, দারুণ সত্যি।

 চিচিকভ : যেমন স্যার, এই এলাকা, এই প্রদেশ যা আপনার মতো এক মহানুভবের অধীনস্থ। সেখানে প্রবেশ করা মানেই তো স্বর্গরাজ্যে ঢুকে পড়া।

 গভর্নর : আরে না, না, মি. চিচিকভ… মাই গুডনেস… তা কেন?

 চিচিকভ : আপনার এই রাস্তাঘাট যেন মখমলে মোড়া। একেবারে পাক্কা।

 গভর্নর : ( লজ্জার ঢঙে নকল হাসি হেসে) ওহো…ধুর…।

 চিচিকভ : যে সরকার জ্ঞানীগুণীদের ওপর দেশ পরিচালনার ভার দেয়, সে সরকারের সর্বোচ্চ সম্মান প্রাপ্য।

 গভর্নর : আরে ব্বাবা… এ সব কী বলছেন!... আপনার নামটি আর একবার বলুন তো?

 চিচিকভ : চিচিকভ। প্যাভেল ইভানোভিচ চিচিকভ, হে মহানুভব।

 গভর্নর : সুপ্রিয় প্যাভেল ইভানোভিচ, আজ সন্ধেয় আমরা একটি অতি ক্ষুদ্র পার্টির ব্যবস্থা করেছি। আপনি কি সেখানে উপস্থিত থাকবেন? 

 চিচিকভ : হে মহানুভব, আপনার বিশেষ সম্মানার্থে অবশ্যই তা ভেবে দেখা যেতে পারে ( উঠে দাঁড়িয়ে নত হয়ে)। আচ্ছা, এখন তবে আসি। বাঃ, ( সুচিকাজটি দেখে নকল প্রশংসায় দাঁড়িয়ে পড়ে)  এই লোভনীয় কাজটি কার হাতের?

 গভর্নর : ( বিনয়ের সঙ্গে) ও কিছু না। ওটা একটা ছোট্ট পার্সের জন্য। আমারই হাতে বোনা।

 চিচিকভ : না,না। এ দারুণ সুন্দর! ( কৃতজ্ঞতায় আবার নত হয়) কিন্তু এখন আমাকে যে… অবশ্য যদি আপনার অনুমতি হয় ( উঠে পড়ে আবার নত হয় ও বেরিয়ে যায়)।

 গভর্নর : ( দৌড়ে বউকে ডাকতে যায়) কইগো… জানো, শেষ পর্যন্ত এ শহরে অন্তত একজনকে পাওয়া গেছে যার সম্পর্কে কিছু বলা যায়। একজন উচ্চমানের দার্শনিক। দারুণ গুণী মানুষ, বুঝলে?