বাংলার ব্রত : প্রান্তিক নারীকথার নিজস্ব ঐতিহ্য

ইতু পুজোর কথা দিয়ে শুরু করা যাক। এই ব্রতর কাহিনী অংশে আমরা দেখি এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ তার দুই মেয়ে উমনো, ঝুমনোকে পিঠে খাবার অপরাধে বনবাস দেয়। আতঙ্কিত দুই কন্যা বনের মধ্যে দেব কন্যাদের সাথে ইতু পুজো করে এবং বাড়ি ফিরে আসে। তাদের পুজোর ফলস্বরূপ ইতিমধ্যে ব্রাহ্মণের অবস্থা ফিরেছে, তবে ব্রাহ্মণের জানা নেই কার কোন কাজের পুণ্যে এ সৌভাগ্য এল। তাই ব্রাহ্মণ পিতা কন্যাদের দেখে পুনরায় গালি দিতে থাকে। কন্যাযুগল তখন পিতাকে জানায় তাদের পুজোর জন্যই ব্রাহ্মণের অবস্থা ফিরেছে।

এর পরবর্তী পর্যায়ে রাজার সাথে উমনোর এবং তার এক পাত্রের সাথে ঝুমনোর বিয়ে হয়।

গল্প এখানেই শেষ হতে পারতো কিন্তু রাজানুগ্রহ না পেলে কোন পূজা প্রচার লাভ করে না। তাই গল্প এগোয়। ঝুমনো  ইতু পূজা করতে থাকে, পাত্রের উন্নতি হয়। অন্যদিকে উমনো পূজা পরিত্যাগ করায় রাজার দিন দিন ক্ষতি হতে থাকে। রাজা স্ত্রীকে কেটে ফেলবার হুকুম দেন। পাত্র তাকে বোনের কাছে নিয়ে আসে। সেখানে সে পুনরায় পুজো শুরু করে। নানান নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সকলের পুনর্মিলন হয়। সকলে সমৃদ্ধ অবস্থায় ইতু পূজা করতে থাকে। ইতু পূজা এখানে পরিত্রাণের উপায় - দারিদ্র্য থেকে, আত্মীয় বিচ্ছিন্নতা থেকে, মৃত্যু থেকে।

ইতু পুজোর পুরো ব্রত কথাটি জুড়ে নারীর অবস্থান কিন্তু খুবই প্রান্তিক। কখনও তাকে পিতা দেয় বনবাস, কখনো স্বামী দেয় মৃত্যুদণ্ড - কারণ নারীকে সৌভাগ্য লক্ষী হয়ে উঠতে হবে, না হলেই শাস্তি। এখানে তার একমাত্র ভরসা অলৌকিক দৈবে।

আসা যাক জয় মঙ্গলবারের ব্রত কথায়। মঙ্গলকাব্যের দেবী এখানে একজন বৃদ্ধা ব্রাহ্মণী মাত্র যিনি তাঁর পুজো প্রচলনের স্বার্থে সন্তান বিধানের উপায় বাতলে দেন।

" মায়া করি ধরি মাতা জরাতীর বেশ, হাতি লাঠি, কাঁধে ঝুলি উড়ি পড়ে কেশ।"

মঙ্গলচন্ডীর কৃপায় সওদাগর বউ ও বেনে বউয়ের গর্ভে জয়দেব ও জয়াবতীর জন্ম হলো । কালক্রমে  তাদের সাক্ষাৎ হল । জয়দেব দেখলে জয়বতী মঙ্গলচন্ডী পূজা করছে। জয়দেব তাকে যখন জিজ্ঞাসা করল এতে কি ফল হয়, জয়াবতি উত্তর দিল -

হারালে পায়, মলে জিওয়

খাঁড়ায় কাটে না।

আগুনে জলে ফেলে

দিলে মরণ ঘটে না।

সতীন মেরে ঘর পায়।

রাজা মেরে রাজ্য পায়।

এক্ষেত্রে কামনার একটা ক্রমোন্নতি লক্ষ্য করা যায় যায়। এক ফ্যান্টাস্টিক ক্লাইম্যাক্স আসে শেষের পংক্তিতে। যে নারী তৎকালীন রাজনৈতিক ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে তার এহেন উচ্চারণ এক সুপ্ত কামনার ইতিহাসকেই প্রাঞ্জল করে তোলে। পরবর্তী কাহিনীর ঘটনাক্রম Pagan myth এর মত অলৌকিক এমনকি ভয়াবহ। জয়াবতীর সন্তানকে প্রতিবার জয়দেবের  নিত্য নতুন উপায় মারতে চাওয়া এক ভয়ংকর গার্হস্থ্য পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে। মা মঙ্গলচন্ডীর  কৃপায় প্রতিবার শেষ রক্ষা হয়। জয়দেবের বিশ্বাস পাল্টায় সে মঙ্গলচন্ডীর পূজায় ব্রত হয়। কিন্তু ব্রতকথা ছলে স্ত্রীর আরাধ্য- উপাস্যকে স্বামীর মেনে নেওয়া এক নিঃশব্দ বিপ্লবের সূচনা করে।

এখনকার দিনে প্রায় বিলুপ্ত অগ্রহায়ণ মাসের কুলুই মঙ্গলবার এর কথা এবং সংকট মঙ্গলবার এর ব্রতকথাতেও দুরূহ সামাজিক এবং গার্হস্থ্য সমস্যার নিবিড় ছায়া ঘনিয়ে আসে। প্রথমটিতে দেখা যায় ব্রাহ্মণের ঘরের এক অবিবাহিত মেয়ের গর্ভাবস্থা। ফলশ্রুতি হিসেবে তার বাবা-মা তাকে বনবাস দেন। পুনরায় মা মঙ্গলচন্ডী উদ্ধারকর্ত্রী হন এক বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীর ছদ্মবেশে। মেয়েটির যমজ ছেলে হয় - আকুলী সুকূলী। তারা অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন। যা বলে তাই সত্য হয়। মা মঙ্গলচন্ডীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক উপাস্য-উপাসকের নয়-- নিতান্ত আটপৌরে, দিদিমা নাতির। শেষে এক সওদাগর তাদের ক্ষমাপ্রার্থী হলে, মা মঙ্গলচন্ডী নিজের পুজো প্রচারের সুযোগ পান। মেয়েটি শুধুমাত্র মায়ের কৃপায় তার গৃহে ফিরে যায় তাই নয় শেষ পর্যন্ত রাজার ছেলের সাথে তার পুনর্বার বিবাহ হয়। তার সমস্ত স্খলনের আর চিহ্ন থাকে না। এই অসম্ভব wish fulfillment ব্রতকথার পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে। নারী জীবনের নিদারুণ, দুর্বিষহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ হয়ে দাঁড়ায় মঙ্গলচন্ডীর উপাসনা। তাই মন্ত্রের মধ্যেও এক সব পেয়েছির সম্ভাবনা ঝলমল করতে থাকে।

সোনার মঙ্গল চন্ডী

রুপোর বালা

কেন মা মঙ্গলচন্ডী এলবেলা?

হাসতে, খেলতে,

পাটের শাড়ি পরতে

সোনার দোলায় দুলতে,  শাখা শাড়ি পরতে

তেল, হলুদ মাখতে, আঘাটায় ঘাট করতে ,

অপকে পথ করতে

অরাজকে রাজ্য দিতে,

হা-পুতির পুত দিতে আইবুড়োর বিয়ে দিতে নির্ধনের ধন দিতে ,

চোরের বন্ধন ঘুচতে কানার চক্ষু দিতে,

অন্ধের  নড়ি দিতে

তাই এত বেলা।

সংকট মঙ্গলবার এর ব্রতকথাতে দেখা যায় ১২ বছর আগে সওদাগর গেছেন বাণিজ্যে। তার  শোকাকুলা  স্ত্রী আরো একজন সধবার সাথে মঙ্গলচন্ডীর ব্রত শুরু করলেন। দুই নারীর নৈকট্য একটা সম্ভাবনার সূচনা করছিল মাত্র, কিন্তু সওদাগর বাড়ি ফেরায় স্ত্রী ব্রত শেষ না করেই উঠে যান। সওদাগর বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে চিনতে পারেন না, দাসির হাতেই ধন দৌলত দিয়ে  তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেন। ধরা হয় এই ব্যাভিচার ব্রত শেষ না করারই পরিণতি। পুনর্বার স্ত্রী ব্রত করেন এবং ঈশ্বরীর কৃপায় সওদাগর  তাকে তার মর্যাদা ফিরিয়ে দেন। দুটি ঘটনাতেই দুটো বাস্তব আশঙ্কা ঈশ্বরীর আরাধনার ভিত রচনা করে।

"হাতের কঙ্কন বেচে কিনলুম দাসী

সে হলো রাজমহিষী

আমি হল দাসীর দাসী।"

যে আদিম জনজাতি একদিন প্রাকৃতিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তার সন্তোষ বিধানের জন্য নানান আচার-উপচারের আয়োজন করত - তেমনই নিজের পরিবেশের উপর নিয়ন্ত্রণহীন নারী আচার-উপচারের নিমগ্নতায় আচ্ছন্ন হয়, তৈরি করে নেয় তার নিজস্ব, একান্ত ধর্মাচরণ -  ব্রতকথা। সাহিত্য ইতিহাসের এক প্রান্তে পড়ে থাকে পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশে নারীর একান্ত ঘেরাটোপ - The women enclave - যা  যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নারীর আশ্রয় হয়ে থেকেছে।

এই ব্রতগুলির মধ্যে বেশ কিছু প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে ঠিকই কিন্তু এখনো কিছু ব্রত বিশেষত গ্রামবাংলায় বহুল প্রচলিত।

গত শতাব্দীর প্রথম ভাগে ভাদুলিব্রত, পুন্যি পুকুর এবং দশপুত্তল ব্রতের জনপ্রিয়তা চোখে পড়ার মতো ছিল। অনেকেরই ঠাকুমা দিদিমার কাছে এই ব্রতের অভিজ্ঞতা পাওয়া যেতে পারে।  শেষের দুটি কুমারী ব্রত হওয়ার কারণে পিতৃকুলের সৌভাগ্য এবং ভবিষ্যৎ সৌভাগ্যময় জীবনের কামনায় আশান্বিত।

"পুন্যি পুকুর পুষ্প মালা

কে পুজারে দুপুর বেলা? আমি সতী লীলাবতী

সাত ভায়ের বোন ভাগ্যবতী।

অথবা

" এ পূজলে কি হয়? নির্ধনীর  ধন হয়।

সাবিত্রী সমান হয় ।

স্বামী আদরিনী হয়।

পুত্র দিয়ে স্বামীর কোলে। মরণ যেন হয় গঙ্গা জলে।।

এটা বেশ আকর্ষণীয় বিষয় এই ব্রতগুলি অনেক সময় দলবদ্ধভাবে পালিত হলেও তার উদ্দেশ্য কিন্তু নারীদের  সামূহিক উত্তরণ নয়, বরং গভীর ভাবে ব্যক্তিগত। সিমন দ্য ব্যোভেয়ার এর একটা কথা এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে - "They live dispersed among the males, attached through residence, housework, economic conditions and social standing to certain men--- fathers or husbands - more firmly than they are to other woman."

দশ পুত্তল ব্রতের কথায় আসা যাক এইবার। এর কথাগুলি এরকম -

১. এবার মরে মানুষ হবো রামের মতো পতি পাব।

২. এবার মোরে মানুষ হব সীতার মতো সতী হব।

৩. এবার মরে মানুষ হবো লক্ষণের মতো দেবর পাব।

৪. এবার মরে মানুষ হবো দশরথের মতো শ্বশুর পাবো।

৫. এবার মরে মানুষ হবো কৌশল্যার মতো শাশুড়ি পাব।

৬. এবার মরে মানুষ হব কুন্তীর মতো পুত্রবতী হব।

৭. এবার মোরে মানুষ হবো দ্রৌপদীর মতো রাধুনী হব।......

এখানে দুই মহাকাব্যের প্রখ্যাত নায়ক নায়িকার সম জীবন যে শুধু কামনা করা হচ্ছে তা নয়, প্রতি পংক্তি উচ্চারিত হচ্ছে মনুষ্যজন্মের কামনায়। যেন যে জন্ম চলছে তা  মনুষ্যেতর। অস্তিত্বের কোন গভীর সংকট থেকে এই উচ্চারণ তা সহজেই অনুমেয়।

বাংলার ব্রত কথাতে উল্লেখিত দেবদেবীরা পুরানের দেবদেবীদের মত মানুষের পারলৌকিক পরমার্থ বিধান করেন না। তাদের আচার-আচরণও শাস্ত্রসম্মত নয় - একেবারে লৌকিক, সহজিয়া। যে বিষয়গুলি নারী অভিজ্ঞতায় প্রোজ্জ্বল এবং গুরুত্বপূর্ণ, যেমন - চাষবাস, স্বামীর বাণিজ্য, প্রজনন, প্রকৃতি বন্দনা, ঋতু বন্দনা, স্বামীর বহুপত্নীত্ব, সাংসারিক সমৃদ্ধি - সেগুলিই এই ব্রতগুলির বৃত্ত রচনা করে।

নারীর সামাজিক অবস্থান সম্পূর্ণভাবে পুরুষ স্বীকৃতির ওপর নির্ভরশীল এই আক্ষেপে তা পরিস্ফুট। এই প্রসঙ্গে De Beauvoir একটি কথা প্রাসঙ্গিক মনে হয়, "it is not the inferiority of women that has caused their historical insignificance: it is rather there historical insignificance that has doomed  them to inferiority."

ডক্টর বীণাপাণি চন্দ তার প্রবন্ধ "ভারতীয় জ্ঞান পরম্পরায় বাংলার ব্রত" তে বলছেন - জলা জঙ্গলময় বাংলাদেশে বাপ, ভাই, স্বামী, শ্বশুর বাণিজ্য যাত্রায় গেলে ভাদ্রের জলে প্লাবনেও তাদের সুখ, সমৃদ্ধি সফল বাণিজ্য, গৃহে প্রত্যাগমন কামনা করে করা হতো ভাদুলীব্রত –

নদী নদী কোথা যাও

সোয়ামি শ্বশুরের বার্তা দাও।

নদীর জল ,বৃষ্টির জল যে জল হও

আমার বাপ, ভায়ের সম্বাদ কও ।

এর মধ্যে খানিক নাট্যরূপ, খানিক গীতিরূপ, খানিক শিল্পকলা মিশে এক সমান্তরাল  কাল্পনিক পৃথিবী রচনা করে, যে পৃথিবীর কাল্পনিক নিয়ন্ত্রণ থাকে নারীদেরই হাতে। ব্রত শুধু ধর্মাচরণ থাকে না, alternative metareal life এর চেহারা নেয়।

সেঁজুতি ব্রত , গোকুল ব্রত এমন বেশ কিছু ব্রত রয়েছে যেখানে ব্রতের মন্ত্র ঐহিক তো বটেই কোন কোন সময় হিংসাশ্রয়ী।

" অশ্বত্থ তলায় বাস করি/ সতীন কেটে আলতা পরি/ সাত সতীনের সাতকৌটো/ তার মাঝে আমার এক অবভরের কৌটা/

 অবভরের কৌটা নাড়িচাড়ি/ সাত সতীন কে পুড়িয়ে মারি।"

উপাসনার  মুহূর্তে এমন অসংস্কৃত, কদর্য প্রকাশ কি শুধুই তদানীন্তন নারী মনের হীনতার  পরিচয়? নাকি সমাজের স্বীকৃত পুরুষের বহুগামীত্ব নারীদের আত্মধ্বংসী যৌনহিংসার রূপ দিয়েছে। অন্যের মৃত্যু কামনায় তার এই প্রার্থনা সত্যি তাকে মনুষ্যেতর করে তোলে-- এক উৎপাদনক্ষম  যৌনএকক মাত্র। সৌভাগ্য চতুর্থীর ব্রতেরকথাতে দেখা যায় রাজ পরিবারেও এই ঈর্ষা সমানভাবে বর্তমান এবং রানীদের নিজেদের অবস্থানকে যাচাই করতে হয় আদৃত এবং পরিত্যক্তের মাপকাঠিতে।  রাজ পরিবারে থাকার অধিকার পায় কখনো বড় রানী কখনো ছোট রানী।

অপরদিকে শ্রেণি সাম্যের বন্ধুত্ব দেখা যায় মৌনী অমাবস্যার ব্রত কথায়। কারণ এখানে দুই নারী যৌন প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। গয়লানী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় বামনী কে। মৌনি অমাবস্যার ব্রত পালন করে তারা অক্ষয় স্বর্গ লাভ করে।

 

বাঙালি সাহিত্য মগ্ন জাতি। সাহিত্য তার যাপিত জীবনের অঙ্গ। তবে যাপিত জীবনও যে মূল সাহিত্য ধারার কৌলিন্য না পেয়েও এক আপাত-নির্বাক গোষ্ঠীর সুস্পষ্ট সাহিত্যিক দলিল হয়ে থাকে, তার প্রকৃষ্ট নমুনা বাংলার ব্রতকথা - ভারতীয় লোক সাহিত্যের অসামান্য বৈচিত্র্যে বাংলার একান্ত নিজস্ব সংযোজন। উনিশ শতকের স্বর্ণকুমারী দেবী থেকে শুরু করে হালের তসলিমা নাসরিন - বাংলার মহিলা সাহিত্যিকরা যে লিঙ্গ ও শ্রেণি সাম্যের দাবি নিয়ে নারী মননের আলেখ্য তুলে ধরেন তার পিছনে অনেকটাই  উত্তর ঔপনিবেশিক পাশ্চাত্য চেতনার ভূমিকা রয়েছে। অথচ বাংলার লোক সাহিত্য তার আখ্যানমূলক কথন ভঙ্গিমায় কখনো  উপকথা, কখনো রূপকথা এবং কখনো ব্রতকথার মধ্য দিয়ে এক সমান্তরাল ধারা বয়ে নিয়ে চলছে যেখানে সমসাময়িক পিতৃতান্ত্রিকতার মধ্যেই এক প্রাচীন জনজাতির নারীকথনের ইতিহাস রচিত হয়েছে। সে ইতিহাস প্রাক – ঔপনিবেশিক, নির্ভেজাল লোকায়ত।

বাংলার ব্রতকথা তার কাহিনী বিন্যাস এবং ভাষাবিন্যাসে একদম স্বকীয় এক ঘরানার জন্ম দিয়েছে। মৌখিক সাহিত্য হিসেবে সৃষ্ট বলেই  হয়তো এই ব্রত কথাগুলি প্রথমেই ভাষার পিতৃতান্ত্রিক অনুশাসনকে  অবহেলায় পেরিয়ে যায়। তাই সমকালীন নারীদের দৈনিক যাপনের অসংস্কৃত , প্রাকৃত ভাষাই উপাসনার মন্ত্র হয়ে ওঠে। তার আর বিধিবদ্ধ শুদ্ধিকরণের প্রয়োজন হয় না।

শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাংলার ব্রত’ গ্রন্থে ব্রতের সংজ্ঞা হিসেবে বলেছেন - "কিছু কামনা করে যে অনুষ্ঠান সমাজে চলে তাকেই বলি ব্রত।" তিনি ব্রতকে দুটি ভাগে ভাগও করেছেন শাস্ত্রীয় ব্রত এবং মেয়েলি ব্রত। আবার মেয়েলি ব্রতেরও দুটি ভাগ রয়েছে কুমারী ব্রত ও নারী ব্রত। অবনীন্দ্রনাথের ভাষায় "খাঁটি মেয়েলী ব্রতগুলিতে তার ছড়ায় এবং আলপনায় একটা জাতির মনের, তাদের চিন্তার, তাদের চেষ্টার ছাপ পাই।" এই ব্রতগুলোতেই প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে এক নিগুঢ় সাহিত্য - প্রান্তিক, বহু ক্ষেত্রেই অনুচ্চারিত।

Simone De Beauvoir তাঁর The Second Sex এ বলছেন "...in truth that Golden Age of women is only a myth. To say that women was the other (sic)  is to say that there did not exist between sexes a reciprocal relation: Earth, Mother, Goddess - she was no fellow creature in man's eyes, it was beyond the human realm that her power was affirmed, and she was out there outside of that realm."

পিতৃতান্ত্রিকতার অনুকেন্দ্রে অনুপ্রবেশের অধিকারহীন এই নারীদের একান্ত নিজস্ব women enclave তৈরি হয় ব্রতের মাধ্যমে- যার উদযাপন, উচ্চারণ, শিল্প ভাবনা কামনা, বাসনা, উপাসনা সবই তাদের একান্ত নিজস্ব।

 ১০

সুতার নুটি যেমন গড়িয়ে চলে, ব্রত কথার কথকথাও  শেষ হবার নয়। তুষালি ব্রত, বারো মাসে অমাবস্যার  ব্রত, মার্কন্ডেয় পুরান নির্ভর বিপত্তারিণী ব্রত, শিবরাত্রি ব্রত কথা, মনসার ব্রত, জিতাষ্টমীর ব্রতকথা তাদের কাহিনী বিন্যাসে চরিত্রবিন্যাসে, ভাষার ব্যবহারে অনেক পরিণত। তবে আরাধ্য  ঈশ্বর ঈশ্বরীরা এখানে তাদের আচার ব্যবহারে  আত্মীয় পরিজনের মতোই। Pagan দেব-দেবীদের নিজস্ব আদলে তারা রুষ্ট হলে বিপদ আনছেন আবার তুষ্ট হলে সমৃদ্ধি বিধান করছেন। রাঢ়বঙ্গে মাসাধিক কাল ধরে চলা টুসু বা ভাদু উৎসব, রাজবংশী সম্প্রদায়ের নিজস্ব ব্রত তার নিজস্ব সাহিত্য-ইতিহাস নিয়ে অবস্থান করছে।

 

আকর

1. মেয়েদের ব্রতকথা আশুতোষ মজুমদার প্রণীত (দেব সাহিত্য কুটির প্রাইভেট লিমিটেড)

2. ভারতীয় জ্ঞান পরম্পরায় বাংলার ব্রত: ডঃ বীণাপানি চন্দ  GAP , BHASHA  VOL IV , ISSUE III, July - Sep 2023

3. The Second Sex - Simone De Beauvoir (1989) Translated and  Ed. by H M. Pashley, New York ,Vintage Books.