মেঠাই : বাঙালি মিষ্টির নানারকম
- 07 April, 2024
- লেখক: শ্রাবন্তী ঘোষাল
বাঙালির নববর্ষ মানে পহেলা বৈশাখ। আর পহেলা বৈশাখ মানে হালখাতা, মঙ্গল শোভাযাত্রা, নতুন ক্যালেন্ডার, বৈশাখী মেলা, নতুন পঞ্জিকা যার প্রথম পাতায় কাঠ খোদাইয়ে ছাপা হালখাতার ছবি। পটলডাঙ্গার টেনিদা মানে ভজহরি মুখুজ্যে একবার পিলের রোগে ভোগা প্যালারাম কে নিয়ে এমনই হালখাতা নেমন্তন্ন খাওয়া দাওয়ায় বেরিয়েছিলেন। প্রাণে আশা ছিল বছরকার শুভ দিনে ভালোমন্দ এমনকি খাতির করে একটু বেশি মিহিদানা জুটবে। কিন্তু তার বদলে কি হয়েছিল তা পাঠক বন্ধুরা বিলকুল জানেন। পহেলা বৈশাখ মানেই প্যাচপ্যাচে গরমের সময় যখন ভুরিভোজ খেয়ে প্রাণ আইঢাই করে, থাকে না বিকেলের জলযোগে হালখাতার মিষ্টি খাওয়ার মত জায়গা। নেমন্তন্নও তো এক জায়গায় নয়। সোনার দোকান, লোহার দোকান, মুদি দোকান শাড়ির দোকান, বইয়ের দোকান এমনই কত কত দোকানে নেমন্তনের যে বহর তা তো রক্ষা করতেই হয়। অগত্যা উপায় একটাই। হালখাতার মিষ্টিতে এমন কিছুর ব্যবস্থা করা যা দীর্ঘদিন রাখা যায় অর্থাৎ কিনা রসের মিষ্টি পদ। দুধের মিষ্টি এই তালিকা থেকে প্রায় বাদ দেয়া যায়, কারণ সেসব মিষ্টিতে ছানা গরমে কেটে যাওয়া সম্ভাবনা থাকে। কদিন রেখে খেতে ভরসা দানাদার, দরবেশ, লবঙ্গলতিকা এসব ভাজা মিষ্টি যাতে দুধ-ছানার ভাগ কম বা প্রায় নেই বললেই চলে।
বাংলায় প্রচলিত মিষ্টির মধ্যে মুখ্য দল দুইটি - মন্ডা ও মেঠাই। মন্ডা বলতে মূলত বোঝানো হয় দুধ কেটে ছানা দিয়ে তৈরি মিষ্টি অথবা ক্ষীরের মিষ্টি আর মেঠাই হলো ডাল, গম, যবের গুঁড়ো দিয়ে তৈরী চিনি, গুড় বা মধুর দ্রবণে রসসিক্ত মিষ্টি। এই দুই দলের মধ্যে কোন্দল তেমন না থাকলেও দ্বিতীয় দল তুলনামূলক প্রাচীন এবং পরিব্যাপ্ত। “শব্দের মৃগয়া: বাঙালীর মিষ্টান্ন” প্রবন্ধে সুকুমার সেন লিখছেন যে মেঠাই শব্দটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয় - প্রথমত মিষ্টান্ন আর দ্বিতীয়টি বিশেষ একটি মিষ্টান্ন যার নামান্তর মোতিচুর, রূপান্তর দরবেশ। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিদ্যাসাগরের বর্ণনায় ছানাজাত ও অ-ছানাজাত মিষ্টির উল্লেখ পাওয়া যায়।
“লুচি কচুরি মতিচুর শোভিতম
জিলিপি সন্দেশ গজা বিরাজিতম “
মোতিচুর আর দরবেশ দিয়েই কাহিনী শুরু করা যাক।
বুন্দি…বুন্দিয়া:
“গান বাজনা মতিচুর
তিন নিয়ে বিষ্ণুপুর”
মল্লরাজাদের বাসভূমি বিষ্ণুপুরের প্রাচীন খ্যাতির বাহক তার ধ্রুপদী সংগীত ও বাদ্য এবং মতিচুর মিষ্টি। মুক্তা বা মোতির আকারের দানা থেকে বানানো এই লাড্ডু পিয়াল ফলের বীজ গুঁড়ো করে তা থেকে তৈরী হত। পরবর্তী সময়ে পিয়াল বীজের অভাবে তার পরিবর্তে বেসন ভালো করে ফেটিয়ে ফুটো করা হাতা দিয়ে গরম তেলে ভেজে তৈরী হয় বুন্দি বা বোঁদে। সংস্কৃত বিন্দু (যার অর্থ ফোঁটা) থেকে হিন্দীতে বৃন্দ হয়ে রসে ভাজা বেসনবিন্দু চিনির সিরায় ভিজে তৈরী হয় বোঁদে। একাধিক রঙের এই বোঁদে অল্প ক্ষীর আর বাদাম,কিশমিশ সহযোগে হাতে পাকিয়ে তৈরী হয় দরবেশ। দরবেশের আলখাল্লার মতো বিচিত্র রঙের সন্নিবেশের কারণে তার এমন নাম। ছোট আকারের যে বোঁদে তার নাম মিহিদানা। উত্তম ফলারের অবশ্য উপকরণ এই মিহিদানা।
১২৬১ সালে রচিত রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকে লিখছেন,
"ঘিয়ে ভাজা তপ্ত লুচি দু চারি আদার কুচি
কচুরি তাহাতে খান দুই।
ছকা আর শাক ভাজা মতিচুর বঁদে খাজা
ফলারের জোগাড় বড়ই।।”
মোতিচুর ভাজার বুন্দির দানা গোলের পরিবর্তে লম্বাটে করে হাতার উপর ফেললে খাঁজকাটা দড়ির আকৃতির যে দানা পাওয়া যায় তার নাম সিড়ি। এই সিড়ি রসে ডুবিয়ে হাতে পাকিয়ে তৈরী হয় সিরি নাড়ু।বেসন শক্ত করে চেপে টানা হাত চালাতে হয় বলে একে টানা নাড়ুও বলা হয়।
রাজা-গজা-খাজা
বাংলার বিভিন্ন মেঠাইয়ের উদ্ভবের ইতিহাসে রাজাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, খামখেয়ালিপনা এক অসীম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বেলিয়াতোড়ের সুবিখ্যাত ম্যাচা সন্দেশ, ক্ষীরপাইয়ের বাবরসা, দক্ষিণ ভারতের মৈসুর পাক দিলখুশ তেমনই গল্প বলে। মজার বিষয় তিনটি কাহিনীতেই উপাদান বেসন, আটা/ময়দা, চিনি আর ঘি। কথিত আছে সপ্তদশ শতকে মল্লভূমের রাঢ় অঞ্চলে একবার দুধের যোগানের টান পড়ে কিন্তু মল্লরাজদের খাদ্য তালিকায় মিষ্টি বাদ দেয়া যায় না। সম্ভবত ১৬২৫ থেকে ১৬৩৫ এর মধ্যবর্তী সময়ে, ম্যাচার জন্ম হয় কোন এক মিষ্টির দোকানের ময়রার হাতে। প্রথমে বেসন জল দিয়ে মেখে মণ্ড করে গিয়ে ঝুরো আকারে ভাজা হয়। তারপর তা ঢেঁকিতে কুটে মিহি করা হয়। এরপরে তা চিনির রসে পাক করা হয় এবং এর সাথে এলাচের দানা, লবঙ্গ ইত্যাদি যোগ করা হয় । ক্ষীরপাইয়ের বাবরশার সাথে যদিও মুঘল সম্রাট বাবরের কোন সম্বন্ধ নেই। বর্গির আক্রমণে যখন গ্রামবাসীর দেশ ছেড়ে পালাচ্ছিল, সেখানকার লালকুঠির কুঠিয়াল এডওয়ার্ড বাবর্শ স্থানীয় সাহসী মানুষদের নেতৃত্ব দিয়ে বর্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতবশত স্থানীয় একটি মিষ্টির নাম রাখা হল বাবরশা। ঘি ময়দা বেসন চিনি দিয়ে খামির তৈরি করে তা পাতলা করে ঘি তে ভেজে সম্পূর্ণ ভাজা অংশটি রসে ডোবানো হয়। আকৃতিতে বিশাল এই মিষ্টি রাজস্থানের ঘিওরের কাছাকাছি হলেও খেতে সুস্বাদু ও মুচমুচে।
১৯ শতকে মহীশূরের রাজসভায় রাজা কৃষ্ণরাজ ওয়াদিয়ারের রাজত্বকালে রাজপাচক কাকাসুর মদপ্পা ঘি, বেসন আর চিনি মিশিয়ে যে মিষ্টি তৈরি করেন তা বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মহীশূরের নাম অবলম্বনে রাজা তার নাম দেন মাইসোর পাক।
বাংলার অপর দুই বিখ্যাত মিষ্টি খাজা ও গজার উপকরণ বেসন নয় ময়দা। ময়দায় ময়ান দিয়ে তা কেটে ভালো করে ঘিতে ভেজে কড়া রসে ডুবিয়ে গজা প্রস্তুত হয়। বিজন বিহারী ভট্টাচার্য লিখছেন যে ফারসি গজক থেকে গজা শব্দটি এসেছে। তিল ও চিনি দিয়ে তৈরি এক রকম কাঠির মতো আকৃতি বিশিষ্ট মিষ্টি খাবারের নাম গজক। কাঠি গজা চ্যাপটা গজা জিভে গজা এসব এর রূপভেদ। সুকুমার সেন এই গজার প্রকারভেদ প্রসঙ্গে লিখছেন লুচিতে ক্ষীরের পুর দিয়ে সাজা পানের মতো মোড়ক করে তা লবঙ্গ দিয়ে বিঁধে ঘিয়ে ভেজে রসে ডুবিয়ে নিলে যে খাদ্যটি হয় তার নাম এমপ্রেস গজা। বলাবাহুল্য যে বড়লাট লর্ড ক্যানিং এর পত্নীকে impress করার জন্য প্রস্তুত এই গজার বর্তমান নাম লবঙ্গলতিকা। ময়দা লুচির মত বেলে তাতে ক্ষীরের অথবা নারকেলের ছাঁচের পুর দিয়ে অর্ধচন্দ্রাকার আকৃতিতে ঘিতে ভেজে রসে ফেলে তার নাম হয় পেরাকি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বিভিন্ন আকৃতির ও নামের খাজা গজা প্রচলিত ছিল। এলোমেলো বিসদৃশ আকৃতির যে এলোঝেলো গজা রবীন্দ্রনাথ তার নাম দিয়েছিলেন পরিবন্ধ।
খাজা গজার সাথে ছন্দবদ্ধ হলেও নামেই তার গঠণগত ফারাক ধরা পড়ে। চ্যাপ্টা,খাঁজ কাটা এই মিষ্টি পরতে পরতে তৈরী হয়। ঘি দিয়ে মাখা ময়দা খুব ভালো করে ভাঁজ করে লুচির মত বেলে ঘিতে ভেজে তা কেটে নিয়ে চিনির রসে ডুবিয়ে তুলে তার নাম হয় খাজ। লম্বা নৌকা আকৃতির যে খাজা ভেজেই রসে ডুবিয়ে নেয়া হয় তার নাম বাংলা খাজা। বাঁকুড়া জেলার ইন্দাসে ধবধবে সাদা রঙের একটি বিশেষ খাজা প্রস্তুত হয়। পুরীর জগন্নাথ দেবের প্রসাদের বহুল প্রচলিত খাজার চেয়ে দর্শন ও স্বাদে তা আলাদা। সাদা গোলাপের পাপড়ির মত পরতে পরতে রাখা এই খাজা দীর্ঘদিন ভালো থাকে।
জিলিপির প্যাঁচ
জিলিপি নিয়ে অনেক মজার কাহিনী প্রচলিত আছে। কৌশিক মজুমদার “নোলা” বইটিতে জিলিপির উদ্ভবের আখ্যান প্রসঙ্গে বলেছেন মুহাম্মদ বিন হাসান আল বোগদাদির লিখিত ১৩শ শতাব্দীর রান্নার বইতে জিলিপি সর্বাধিক পুরনো প্রণালী বর্ণনা পাওয়া যায়। যদিও মিশরের ইহুদিরা এর আগেই খাবারটি আবিষ্কার করেছিলেন বলে অনুমান করা যায। ইরানে জলেবিয়া নামে প্রচলিত এই কুন্ডলী আকৃতির মিষ্টিটি ঈদে ফকির মিশকিনদের মধ্যে বিতরণ করা হত। মধ্যযুগে পারসী ভাষাভাষী তুর্কিদের সাথে জালেবিয়া পশ্চিম ভারতের জলপথে ভারতে এল। প্যাঁচে-প্যাঁচে রস আর হাল্কা মুচমুচে স্বাদের জন্য দেশব্যাপী খাস ও আমজনতার মধ্যে বিপুল জনপ্রিয় জিলিপির নাম অঞ্চলভেদে আলাদা। ইরানের জালাবিয়া, নেপালে জেলি, উর্দু আর হিন্দিতে জালেবি এবং অবশেষে বাংলায় জিলাপি বা জিলিপি। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর জিলাপির রসে এমনই মজেছিলেন যে নিজের সাথে তার নাম জুড়ে জিলাবির নাম দিয়েছিলেন “জাহাঙ্গীরা”। খ্রিষ্টপূর্ব ষোড়শ শতকে সংস্কৃতে রচিত “গুণ্যগুণবোধিনী” তে জিলাপির উপাদানের সাথে বর্তমান সময়ের জিলিপির উপাদানের মিল আছে। ১৪৫০ সালে জৈন সাধু জিনসুরের লেখা “প্রিয়ঙ্কর রূপরেখা” তে জিলিপির উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৭শ শতকের রাণি দীপাবাইয়ের সভাকবি রঘুনাথের “ভোজনকুতুহল” এ জিলিপির উল্লেখ আছে। জিলিপি বাঙালি জীবনে ধর্ম সমন্বয়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রথের মেলা,মাজারের উরস, রমজান মাসের ইফতারি ছাড়াও রোববারের কচুরীর পর জিলিপির ঠোঙা বাঙালি জীবনের অন্যতম ধ্রুবক। পুরীর জগন্নাথ দুধ ছিন্ন করে প্রস্তুত ছানার খাবার গ্রহণ করতেন না, তাই খাজা-গজায় তিনি মিষ্টিমুখ করেন। বাংলায় এসে ছানার মিষ্টি বাদে একমাত্র সর্বজনপ্রিয় দুধ ছাড়া মিষ্টি জিলিপিতেই তার সেবা চলে। বাঙালি সাধু শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব জিলিপির পরম রসিক ছিলেন। তাঁর জন্মস্থান কামারপুকুরের চিনু কাঁসারির সাদা জিলিপি ও বোঁদে তার অত্যন্ত প্রিয় ছিল।কথামৃতে জিলিপি বিষয়ে তিনি বলছেন, “...লাটসাহেবের গাড়ির চাকা। জিলিপি গোল চক্রের মত ঘোরানো আছে, ওপরে কিছু বোঝবার নেই কিন্তু মিষ্টি রসে ডুবে ভরপুর রয়েছে।” তেমনই রসে বশে তিনি ডুবে থাকতে চেয়েছেন আজীবন। তাঁর পার্ষদ স্বামী তুরীয়ানন্দ একবার কাশীতে জিলিপি ভাজা দেখে এক শিষ্যকে বলেছিলেন, “সুরেন,ওই জিলিপি আমাদের আদর্শ। জ্ঞানরূপ ঘিতে ভেজে, ভক্তিরূপ চিনির রসে নিজেদের ডোবাতে হবে। জিলিপিতে কামড় দিলে বাইরে মচমচ করে কিন্তু ভিতরটা রসে ভরা”।
দেড়শ বছরের পুরনো পাথরচাপুড়ির মেলায় সিউড়ির তাঁতি পাড়ার দে পরিবার ১০৫ বছর ধরে জিলিপি তৈরি করে আসছে। পীর দাতাবাবার নামে উৎসর্গীকৃত এই মেলায় প্রথম ভাজা জিলিপি দাতাবাবার নামে তার মাজারে উৎসর্গ করে বিক্রি বাটা শুরু হয়। বহু প্রাচীন এই মেলা নটকোনা দ্রব্য ও মনোহারী দ্রব্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। সময়ের সাথে তা বিলীন হয়ে গেলেও শুধুমাত্র জিলিপির টানে এখনো মানুষ আসে এই দোকানে। পরম্পরা মেনে তারা গুণমানে কোন সমঝোতা করেনি। ঢেঁকিতে বিউলির ডাল এবং আতপ চাল গুঁড়ো করে জিলিপির মন্ড প্রস্তুত করা হয়। আদিতে যে জিলিপি ছিল ময়দার তৈরি কালক্রমে বাংলায় এসে তা ডাল বাটা বা ডাল গুঁড়ো করে তৈরি করা ঘন মিশ্রণ থেকে তৈরি হতে শুরু করল। এভাবেই জিলিপি থেকে উঠে এলো অমৃতি বা আমিত্বির গল্প। বাংলায় প্রবাদ অনুসারে কারো মনের গহীন প্যাচ কে বোঝানোর জন্য জিলিপির আড়াই প্যাচের তুলনা দেয়া হয়। অমৃতিতে এসে সেই প্যাচ আরো গভীরতর হল। ময়দার বদলে বিউলির ডাল এবং তার সাথে চাল গুড়োর ঘন প্রলেপে তৈরি হওয়া অমৃতি জিলিপির থেকে আরও বেশি খাঁজপ্রবণ এবং স্বাদে আরেকটু বেশি রসালো। চৈতন্যচরিতামৃতে অমৃতির উল্লেখ আছে।জিলিপির তুলনায় একটু শক্ত অমৃতির উপাদানে সুজি ব্যবহৃত হয়। জিলিপির তুলনায় বেশি দিন তা সংরক্ষণও করা যায়।
জিলিপিই কিন্তু জিলিপির তুলনা। একাত্তরের শহীদ জননী বেগম জাহানারা ইমাম তার বড় ছেলের রুমিকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন কোন খোঁজ খবর না পেয়ে আকুল হয়ে পড়েন। আত্মীয় বন্ধুদের পরিচিত এক পীর বাবার সাথে দেখা করতে যাওয়ার মুহূর্তে সবার মধ্যে বিতরণের জন্য এক চাঙারি জিলিপি নিতে ভোলেন না। পালাপার্বন বা উৎসবে তৈরি করা বিশেষ জিলাপি বাদ দিলেও ঢাকা শহরে এখনো অন্তত পাঁচ রকমের জিলিপি পাওয়া যায়। ঢাকার চকবাজারের শাহী জিলাপি আকৃতিতে বিশাল। কিন্তু তার জনপ্রিয়তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য মাষকলাইয়ের ডাল, ঘি, ডালদা বেসন এবং ময়দা দিয়ে তৈরি মোটা প্যাঁচের রসালো স্বাদ। এছাড়া মুচকুচে খাস্তা ছোট আকৃতির ঘি এবং কেশরে ভাজা রেশমি জিলাপি ও বোম্বাই জিলিপির পাশাপাশি সাম্প্রতিককালে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে পেস্তার রঙে অর্থাৎ সবুজ রঙের পেস্তা জিলিপি এবং খেজুর গুড়ের রসে ভেজানো গুড়ের জিলিপি। বড় আকৃতির জিলিপির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাঁকুড়ার কেঞ্জাকুড়ার জিলাপি। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে রাঢ়বঙ্গের ভাদু পূজার শেষ দিনে জিলিপির মেলা এ অঞ্চলের স্থানীয় সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন । প্রায় প্রতিযোগিতার স্তরে এক একজন বিক্রেতা তিন থেকে চার কেজি ওজনের জিলিপি তৈরি করেন। বিরি কলাই ডালের বেসন, চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি চিনির রসে ডোবানো এই জিলিপির খামির যত পুরনো হবে তত নাকি এর স্বাদ বাড়ে। মেদিনীপুরে বিখ্যাত মুগের ডালের জিলিপির প্যাঁচ সংখ্যা নেহাতই কম। মুগের ডাল দিয়ে তৈরি করা এই জিলিপি তৈরি করার জন্য মুগের ডাল শিলনোড়ায় বেটে তা মালসায় ভরে ঢাকনা দিয়ে খোলা আকাশের নিচে সারারাত রেখে দেয়া হয়। সকালে ফুলে ওঠা সেই মণ্ডকে ভালো করে ফেটিয়ে প্রস্তুত করা হয় খামির। এই খামির থেকে ঘি এর পরিবর্তে তেলে জিলিপি ভেজে তা কেশর মেশানো চিনির শিরা রসে ডোবানো হয়। হালকা সোনালী রঙের এই জিলিপির স্বাদ বাড়াতে এই জিলিপির খামিরে জিরে বা মৌরির গুঁড়ো বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। হলুদ রঙের মোটা পাপড়ির এই জিলিপি দেখতে অনেকটা ছানার জিলিপির মত। ময়মনসিংহে চালের গুঁড়োর সাথে তেঁতুলের টক মিশিয়ে চিনির রসে ডোবানো টক জিলিপি বেশ জনপ্রিয়। কলকাতায় বালিগঞ্জে পুলিনবিহারী সেনের বাড়িতে জিলিপি ক্লাব নামে সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই ক্লাবের নিয়মিত সভ্যদের মধ্যে ছিলেন শচীন সেন,নীহার রায়, প্রতুল গুপ্ত রাধামোহন ভট্টাচার্য, জিতেন সেন প্রমুখ যারা প্রতি রবিবার সেখানে হাজিরা দিতেন। বারাণসীতে পাণিফলের আটা থেকে জিলিপি তৈরী হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে মানকচুর জিলিপি তৈরীর ফরমায়েশ করেছিলেন। ’’প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে সুনীতিবাবুর সুকিয়াস রো'র বাড়িতে গেলেই গরম গরম হিংয়ের কচুরি ও জিলিপি সহযোগে জলযোগ সম্পন্ন হতো” - বিজনবিহারী ভট্টাচার্য লিখেছেন।
লে হালুয়া
বাঙালির ঘরে বহুল প্রচলিত যে হালুয়া তার তার উৎস আরবি ও ফার্সি ভাষভাষী দেশে।হালুয়া মুসলিম সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ অঙ্গ। অটোম্যান সাম্রাজ্যের যুগে সুলতানি হেঁসেলের ইতিহাসে প্রথম হেলভা বা মিষ্টান্ন তৈরির আলাদা পাকশালার সন্ধান পাওয়া যায় যার পোশাকি নাম ছিল হেলভাআনে। হেলবাহি বা হালওয়াই (মিষ্টি তৈরির কারিগর) শব্দটি আরব বণিকদের সূত্রে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল। কলকাতার চিৎপুরে এখনো তাদের অষ্টম প্রজন্মের সন্ধান পাওয়া যায়। চির পরিচিত সুজির হালুয়া বাদ দিলেও কলকাতা চিৎপুরের এই অঞ্চলে ঈদ শবে বরাতের পালা পর্বন বাদ দিলেও প্রত্যেকদিন প্রায় ৭ থেকে ৮ রকম হালুয়া পাওয়া যায়। বিভিন্ন ফলের নির্যাস কে হালকা এসেন্স দিয়ে প্রায় স্বচ্ছ ব্লকের আকারে অল্প মিষ্টি দিয়ে তৈরি করা হালুয়া নতুন প্রজন্মের কাছেও বেশ জনপ্রিয়। করাচি হালুয়া, বম্বে হালুয়া, মাসকট হালুয়া একেকটি অঞ্চলের বিশিষ্টতার পরিচয় বহন করে। যেমন মাসকট শব্দটির উৎস মাসকথ সিংহলি ভাষায় যার অর্থ নারকেলের দুধ। ইউনানী ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর জরিবুটি ও ঔষধি গুণসম্পন্ন দ্রব্যকে হালুয়ার আকারে খাওয়ার নিদান দেয়া হয়। যেমন-রামপুরের আদার হালুয়া এক এক বৃদ্ধ সুলতানের শীতকালে গলা ব্যথা কমানোর জন্য তৈরি করা হয়েছিল। চবনপ্রাস ও সেই অর্থে এক প্রকার হালুয়া। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আত্মজীবনীতে অমৃতসরের গুরুদোয়ারার কড়াভোগ বা মোহনভোগের কথা বলেছেন। উত্তর ভারতে যারা হালুয়া তৈরী করেন তাদের বলা হয় হালুইকর। ঢাকায় শবে বরাতের হরেক রকম রুটির সাথে হালুয়া অত্যন্ত জনপ্রিয়। সুজির হালুয়া, ছোলার ডালের হালুয়া, বেসনের হালুয়া, মুগ ডালের হালুয়া নানা প্রকারে তার অবস্থান। এই জমাট বাঁধা হালুয়া চৌকো টুকরো করে কেটে নিএল তা হয় বরফি। কলকাতার হাজি আলাউদ্দিন সুইটসের সবচেয়ে বিখ্যাত বত্তিশা হালুয়ায় প্রায় ৩২ রকম উপাদান দেয়া হয়। স্বাদে ও দামে বেশ ভারী এই মিষ্টি শুধুমাত্র শীতকালে তৈরি করা হয়। আমলক, অর্জুব, অশ্বগন্ধা ও নাগকেশর, গোলমরিচ, পিপুল, পুনর্নবা, গোক্ষুর, শঙ্খপুষ্পী এর কয়েকটি উপাদান। বোহরি সম্প্রদায় ভুক্ত মুসলিমদের খাদ্যরীতিতে মিষ্টির স্থান সবার আগে। তারা খাবারের শুরুতে খেজুরের হালুয়া, খুবানি কা মিঠাই, আনজির মিঠাই খান। ভারতের পশ্চিম উপকূল নিয়ে যখন পারসিরা এ দেশে আসেন তাদের সূত্রে ডিমের হালুয়ার প্রচলন শুরু হয়।
মিহিদানার মত দানাদার এই হালুয়া ঘি, ডিম, এলাচ, ভ্যানিলা এসেন্স,গোলাপজল দিয়ে তৈরি। হালুয়ার আরেক বিশেষ সংস্করণ আফলাতুন। আরবিতে গ্রীক দার্শনিক প্লেটোকে আফলাতুন নামে ডাকা হয় যার ভাবার্থ দাঁড়ায়” যিনি নিজেকে অপার বুদ্ধিমান মনে করেন”। ছোটো চৌকো আকারে বাটার পেপারে জড়ানো এই মিষ্টি কলকাতায় শুধুমাত্র হাতে গোনা দুয়েকটি দোকানে পাওয়া যায়। সুজি, ডিম, খোয়াক্ষীর, চিনি দিয়ে তৈরী আফলাতুনের জন্য বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিখ্যাত। আফলাতুনের মতো শোন হালুয়াও একটু বিচিত্র। ঢিমে আঁচে ময়দা, দুধ, চিনি আর কর্নফ্লাওয়ার একসঙ্গে জাল দিয়ে কাজু পেস্তা বাদাম এলাচের সাথে বিপুল পরিমাণ ঘি মিশিয়ে তা তৈরি করা হয়। নিরেট এবং শক্ত প্রায় সব হালুয়ার চেয়ে ব্যতিক্রমী হওয়াতেই এর বিপুল খ্যাতি। এরই তুতো ভাই বা বোন শোনপাপড়ি যা চিনির পাককে রবার ব্যান্ডের মতো ছড়িয়ে ঘি মাখা বেসন তার গায়ে লাগিয়ে পরতে, পরতে তৈরি হয়। যত দামি আর নাজুক তার উপকরণ তত হালকা আর মুচমুচে তার স্বাদ। কলকাতায় আগত পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের হাত ধরে ঢাকাই শোন পাপড়ি কলকাতায় আসে।
“মাসিমা মালপোয়া খামু”
বাংলা ছায়াছবির ইতিহাসে নানা কারণে বিখ্যাত “সাড়ে চুয়াত্তর” ছবির প্রবাদপ্রতিম শিল্পী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংলাপে মাসিমার কাছে মালপোয়া খাবার আবদার ছবির এক মজার ক্লাইম্যাক্স তৈরি করে। ঢাকার পোলা ভানু মালপোয়ার গন্ধ শুঁকে দোতলায় নায়িকার ঘরে হাজির হন।বলা বাহুল্য ঢাকার মালপোয়া আর কলকাতার মালপোয়া স্বাদে গন্ধে আলাদা। মালপোয়ার মাল অংশটি ফারসী আর সংস্কৃত পুপ থেকে এসেছে পোয়া। বৃন্দাবন ভক্ত বৈষ্ণবদের হায় ধরে তার বাংলায় প্রবেশ।মালপোয়া তৈরীর মূল উপকরণ তিনটি সুজি ময়দা আর চিনি। দুধের সাথে নির্দিষ্ট অনুপাতে মেশানো সুজি ময়দার সাথে সুগন্ধের জন্য যোগ করা হয় মৌরি। এই মিশ্রণ তেলে ভেজে চিনির রসে ডুবিয়ে তৈরি হয় মালপোয়া।
ঢাকা বিক্রমপুরে প্রচলিত মালপোয়ায় দুধ-সুজি-ময়দার মিশ্রণে চিনি মিশিয়ে অল্প আছে সাদা মালপোয়া ভেজে তোলা হয়।ঢাকা বা কলকাতার বাইরে উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যে মালপোয়ার প্রচলন আছে তার স্বাদ এবং পরিবেশনে কিছুটা আলাদ। ঘিয়ে ভাজা আর রসে ডোবানো মালপোয়া সেখানে দুধ দিয়ে বানানো ঘন ক্ষীর সহযোগে পরিবেশন করা হয়। বাঙালি হিন্দুর উৎসবে পার্বণে বিশেষত জন্মাষ্টমীতে মালপোয়ার উপস্থিতি অনিবার্য। এছাড়া শীতে পিঠে পুলির সময় ময়দার পরিবর্তে নতুন চালের গুঁড়ো আর সুজি দিয়ে তেলে ভাজা এই মালপোয়া তেল পিঠে নামেও পরিচিত।প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যে মূলত ঋকবেদে অপুপ নামে একটি মিষ্টির উল্লেখ পাওয়া যায়। যবের আটা থেকে মন্ড তৈরি করে তা ঘিয়ে ভেজে অথবা জলে সেদ্ধ করে চ্যাপ্টা আকৃতির যে বস্তুটি পাওয়া যায় তা মধু দিয়ে ভিজিয়ে খাবার প্রচলন ছিল। বর্ণনার দিক থেকে তা বর্তমান সময়ের মালপোয়ার প্রায় কাছাকাছি।মোটামুটি ২য় শতাব্দী থেকেই এ দেশে বার্লির পরিবর্তে গমের আটার প্রজনন শুরু হলো।মন্ড পাকিয়ে গমের আঁটা বা ময়দা কে ঘিয়ে ভেজে আখের রসের ঘন দ্রবণে ডুবিয়ে মালপোয়ার নতুন এক উন্নততর রূপ দেখা গেল। ভারতবর্ষের খাদ্য বিষয়ক অভিধান এর প্রণেতা কেটি আচয়া তেমনই মনে করেন। বাংলায় ভক্তিবাদী আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ শ্রী চৈতন্যের হাত ধরে জগন্নাথ ক্ষেত্র বা উড়িষ্যা থেকে মালপোয়া বাংলায় বহুল জনপ্রিয় হয়। শ্রী জগন্নাথ দেবের ৫২ ভোগের অন্যতম মিষ্টি এই মালপোয়া বাংলার বিভিন্ন বৈষ্ণব তীর্থে নিতাই গৌড়ের ভোগরাগে স্থান পায়। খড়দহের শ্যামসুন্দর জিউর মন্দিরের প্রসাদী মালপোয়ার স্বাদ উড়িষ্যার অনুগামী।
গৌর প্রেম নিষ্ঠা চিনির রসবড়া
বাংলার ঘরোয়া মিষ্টি ও ময়রার তৈরি মিষ্টির ইতিহাসে শ্রী চৈতন্যদেবের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ষোড়শ বা সপ্তদশ শতকে বৈষ্ণবরা দীর্ঘ পথযাত্রা করে পুরী,বৃন্দাবন মথুরা,প্রভৃত স্থানের তীর্থ করতে যেতেন। উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মিষ্টি তাদের সূত্রে বাংলায় পৌঁছায়। যেমন উত্তর ভারতের শুকনো মালপোয়া বাংলায় এসে রসে ডুবেছে। চৈতন্যদেব পুরীতে থাকাকালীন তার শিষ্যরা বাংলা থেকে যেসব মিষ্টি বা মিষ্টান্ন বয়ে নিয়ে যেতেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিভিন্ন প্রকার বড়া,চিনি ও গুড়ের পাকে তৈরি বিভিন্ন প্রকার নাড়ু , অষ্টকৌড়ির খাজা প্রভৃতি। বাংলার মিষ্টিতেডালের গুঁড়ো প্রচলিত ছিল না মূলত বৃন্দাবন মথুরা আগ্রা দিল্লি থেকে তার আগমন।
ভেজানো মুগ,ছোলা মটর, বিউলির ডাল বেটে তেলে ভেজে তৈরী করা বড়া ভিন্ন ভিন্ন গাঢ়ত্বের চিনির রসে ডুবিয়ে তৈরী হয় নানা মিষ্টি। যেমন-পাতলা রসে ডোবানো ডালবড়ার নাম রসবড়া, আর কড়া ভাজা বড়া ঘন রসে ডুবলে তার নাম রসকড়া। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে শান্তিপুরের অদ্বৈত আচার্যের বাড়িতে মহাপ্রভুর ভোজের বর্ণনায় পাওয়া যায়,
“মুগ বড়া , মাষ বড়া , কলাবড়া মিষ্ট
ক্ষীরপুলী , নারিকেল – পুলী আর যত পিষ্ট”
শ্রীচৈতন্যদেব নিজে মিষ্টান্ন পছন্দ করতেন। পানিহাটি থেকে প্রতিবছর যে রাঘবের ঝালি পুরীতে রথের সময় যেত তাতে থাকত মুগ নাড়ু, গঙাজল নাড়ু, শুনটির নাড়ু (আদার শুকনো টুকরোকে শুন্টি বলা হয়) খইয়ের মোয়া, শালিকা ধানের খৈয়ের নাড়ু, চিড়ার নাড়ু, বাদামের নাড়ু, ক্ষীরের নাড়ু, ধানিয়া মুহুরী ধানের নাড়ু, আতপচালের মুড়ির মোয়া ইত্যাদি নানা মিষ্টি যা বাংলার একান্ত ঘরোয়া আয়োজন।চৈতন্য পরবর্তী যুগে নদীয়া, হুগলী জেলায় মিষ্টান্নশিল্পের ব্যাপক প্রসারে শ্রীচৈতন্যের প্রভাব অনস্বীকার্য।
মিষ্টান্নম ইতরে জনা
শ্রী দ্বারকানাথ বিদ্যারত্ন তার কবিতা কুসুমাঞ্জলি বইয়ের প্রথম খন্ডে লিখেছিলেন বিয়ের অনুষ্ঠানে সাধারণ জনতা মিষ্টিতেই খুশি। মিষ্টান্ন বা মিষ্টি ইতর অর্থাৎ অপরজনের মধ্যে বিতরণের জন্য পালাপার্বনে প্রস্তুত করা হতো। ক্রমশ এই ইতর শব্দটির ব্যঞ্জনা পাল্টে গেল । আমি বা আমার বৈশিষ্ট্য ব্যতীত বাকি সকলেই খারাপ এই যুক্তি-দর্শনের ভিত্তিতে ইতর শব্দের অর্থ দাঁড়ালো হীন প্রবৃত্তি সম্পন্ন মানুষ যারা মূলত সমাজে নিচের তলায় বাস করে। মিষ্টি তৈরীর মূল উপাদান চিনি বা গুড়ের উৎপাদন ব্যবস্থা একসময় রাজা বা অভিজাতক শ্রেণীর করতল গত হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের পক্ষে টাকা দিয়ে মিষ্টি খাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। অবস্থাপন্ন মানুষের বাড়িতেই পালা পর্বনের ভিয়েন বসত এবং ময়রারা সেই মিষ্টি বানাতেন। ময়রাদের মিষ্টি ফেরি করার কথা মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গলে জানা যায়।
“মোদক প্রধান রানা
করে চিনি কারখানা
খন্ড নাড়ু করে নির্মাণ
পসরা করিয়া শিরে
নগরে নগরে ফিরে… “
এই ময়রাগণ মিষ্টি তৈরি করলেও বছরের অন্যান্য সময় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ফেরি করে বিক্রি করতেন। পথের পাঁচালীর চিনিবাস ময়রা পুজোর আগে বিক্রি করতে আসে। অপু দুর্গা তাকে দেখে প্রলুদ্ধ হলেও আর্থিক সাচ্ছল্যের অভাবে মিষ্টি কিনতে পারে না। চিনিবাসের সাথে ঘুরে সেজ ঠাকরুনের বাড়িতে মিষ্টি কেনা দেখাতেই তাদের আনন্দ। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের প্রচলিত ডাকের কথা ”হুগাত নাই ত্যানা, মিডা ছাড়ি ভাত খায় না”র অর্থ দাঁড়ায় যার পরনের কাপড় জোটে না,মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছে তাদের কাছে বিলাসীতা।
পলাশীর যুদ্ধের পর বাঙলা জুড়ে শারদীয় দুর্গোৎসবের যে ব্যাপক শুরু হল, তার সাথে বাংলার মিষ্টিশিল্প বিশেষভাবে সম্পর্কিত। শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব সহ সে সময় কলকাতায় যেসব বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তিত্ব বাড়িতে দুর্গাপূজা প্রচলিত হয় সেখানে দুর্গাপুজোর দেবী ভোগের অন্যতম উপাদান ছিল মিষ্টি। অব্রাহ্মণ হওয়ার কারণে দেবীর ভোগে তারা অন্ন নিবেদন করতেন না। নুন ছাড়া লুচি এবং তার সাথে বিভিন্ন রকম শুকনো মিষ্টির প্রচলন ছিল যেমন পদ্মগজা, জিবে গজা, মোতিচুর, বোঁদের লাড্ডু ইত্যাদি। সে সময় লোকমুখ কথিত ছিল, ” মা দুর্গা ভোজন করেন কুমারটুলির অভয়চরণ মিত্রের বাড়িতে। অভয়চরণের মৃত্যুর ৫৬ বছর পর রসরাজ অমৃতলাল বসুর আত্মস্মৃতি থেকে জানা যায় যে,অভয়চরণ মিত্রের বাড়ির মিষ্টান্ন, এক একখানা জিলিপি যেন গরুর গাড়ির ভাকা,গজা নয় যেন এক একখানা বারকোশ,মোতিচুর এক একটি বড় কামানের গোলা…।
জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র সরস্বতীপূজা বিষয়ক শ্লোক রচনা করতে গিয়ে লুচি-কচুরি-মিষ্টি শোভিতা দেবীকে বর্ণনা করেছিলেন। আর ১৯৩২ সালে প্রকাশিত ‘সুরসাকী’ কাব্যগ্রন্থে কাজী নজরুল ইসলামের একটি গানে হরিনামের রুচির কারণ হিসেবে ফিরে আসে সেই লুচি আর মিষ্টির কথা। শতক জুড়ে মোহনীয় মেঠাই চক্রের কাহিনীতে সাময়িক ছেদ টানা যাক। রাধুঁনী-হালুইকর-ময়রা-ভিয়েন দের আসর বাঙালি জীবনে অটুট থাক।
“আমার হরিনামে রুচি কারণ পরিনামে লুচি
আমি ভোজনের লাগি করি ভজন।
আমি মালপোর লাগি তল্পি বাঁধিয়া
এ কল্প-লোকে এসেছি মন॥
‘রাধাবল্লভি’-লোভে পূজি রাধা-বল্লভে,
রস-গোল্লার লাগি আসি রাস-মোচ্ছবে!
আমার গোল্লায় গেছে মন রস-গোল্লায় গেছে মন!
ও তো রসগোল্লা কভু নয়
যেন ন্যাড়া-মাথা বাবাজি থালাতে হয়েন উদয়!
গজা দেখে প্রেম যে গজায় হৃদিতলে রে,
পানতোয়া দেখে প্রাণ নাচে হরি বলে রে!
ওই গোলগাল মোয়া মায়াময় এই সংসার দেয় ভুলিয়ে,
আর ক্ষীরের খোয়াতে খোয়াইতে কুল মন ওঠে চুলবুলিয়ে!
মন বলে হরি হরি হাত বলে হরো হে
অরসিকে তেড়ে আসে বলে ওহে ধরো হে!
সংসারেতে ভক্ত শুধু রাঁধুনি ও ময়রাই–
সেই দুই ভাই আজি এসেছে রে!
যারা ময়দা পেয়ে মালপো বিলোয়
সে দুই ভাই আজি এসেছে রে!
আমি চিনি মেখে গায়ে যোগী হব দাদা যাব ময়রার দেশে
রস- কড়ার কড়াই-এ ডুবিয়া মরিব গলে সন্দেশ ঠেসে।
ভোজন-ভজহরির শোনো এই তথ্য
গো-ময় সংসারে ভোজনই সত্য॥”