পান্তাভাত ও বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতি

কালবৈশাখী না হলে  বৈশাখ যেন আরও  খুনী হয়ে ওঠে। বাতাসে ভ্যাপসা গরমের দাপট টিকতে দেয় না মানুষজনকে। আগুনের হল্কা ছড়ায়, জ্বালিয়ে দেয় সবটা৷ এসময়  হাসান মামার ছুটি নেই। হাসান মামা  জমিতে চাষের কাজ করে,  যা একটু ফসল ফলায় তাই হাটে বেচে  বর্তে চলে যায়  কোনোরকমে। দীর্ঘ গ্রীষ্ম , অন্নপ্রধান দেশ বাংলা। গাঁয়ের  জলা  জমিতে সারা বছর ধানের চাষ হয়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে লাঙ্গল চষা জমিতে ফলা ধান ঘরে ওঠে। দুপুরের কড়া আগুনে রোদের  গরম থেকে বাঁচতে জল ঢালা ভাতে শরীর ভেজায় । পান্তায়  ভরে ওঠে হাসান মামার কলাইয়ের  থালা। দুপুরে কাজের ফাঁকে মাঠের একটা কোল ঘেঁষে গাছের ছায়ায় খেতে বসে হাসান মামা। জল ঢালা ভাত, কাঁচা লঙ্কা,  কাঁচা পেয়াজ, নুন আর সামান্য কাঁচা আর সরষের তেল। খিদেটা চাগার দিয়ে উঠলে  পান্তা  খিদে মেটায়, শরীর জুড়ায় ।  মাঠের কাজ শেষে ঘরে ফিরে সন্ধ্যাবেলা দাওয়ায় বসে    লাল ঝালর দেওয়া হলদে তালপাতার পাখায় হাওয়া খেতে খেতে এক নাগাড়ে গল্প  বলে যায় ওঁর ছেলেমেয়েদের পান্তা বুড়ির গল্প। 

“ বুড়ি পান্তা ভাত খেতে ভীষণ ভালোবাসে  কিন্তু প্রতিদিন এক চোর এসে তাঁর পান্তা খেয়ে যায়।” আহা, বড়ো মায়া জন্মায়  বুড়িটার জন্য৷ দরিদ্র দেশে সামান্য পান্তাভাতও চুরি হয়ে যায়।  রাজার কাছে  নালিশ  জানায় বুড়ি। ওই টুকুই যে পান্তা বুড়ির সম্বল।  বাংলার আটপৌরে সাদামাটা প্রাত্যহিক জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে পান্তা। আগের দিন  রাতে  রাঁধা ভাত মাটির হাঁড়িতে রেখে  তাতে  জল ঢালা   হয়। পরদিন সামান্য গেঁজিয়ে উঠলে স্বাদটাই পাল্টে যায় ভাতের।  পোসটা ভাতেও জল ঢালা হয় তবে তা অবশ্য টাটকা ভাতে। গরীবের পাত থেকে পান্তা এখন ঠাঁই পেয়েছে দেবতার ভোগে। জাতে ওঠা বোধহয় একেই বলে। 

হিন্দু পরিবারের রমনীরা যত্ন আত্তির করে  রেঁধে অন্নে, ভোগে   বিবিধ ব্যঞ্জন আদরে সাজিয়ে দেয় দেবতার উদ্দেশ্যে।  পান্তা কে সংস্কৃতে নাম পেয়েছে  কাঞ্জিকা। কোথাও আবার   ‘পর্য্যুষিত অন্ন’ শব্দ চোখে পরে ।  ‘সহজপাঠ’-এ পড়া “ উস্রি নদীর ঝর্ণা” দেখতে যাবার গল্পটা মনে আছে নিশ্চয়ই।  কান্ত চাকরের বোন ক্ষান্তমণি  ভোর বেলায় পান্তা ভাত খাইয়ে দিয়েছিলো, তাই বোধহয় খাবার জন্য তার তেমন আগ্রহ নেই। জল ঢালা ভাত সহজে খিদে আনে না।  এবার আসি পুজো পার্বনের কথায়। আমাদের দেশে অরন্ধনের সাথে পান্তা ভাতের সম্পর্ক আছে। ভাদ্র সংক্রান্তির দিন মনসা পুজোর পাশাপাশি উনুন পুজোও হয় কিছু অঞ্চলে। আগের দিন রাতে রাঁধা ভাত খাওয়া হয় পরের দিন। আগুন জ্বলে না পাকশালে। ঘরে ঘরে রমনীরা সুরে সুরে গান গায়, 

“ জয় জয় মা মনসা জয় বিষহরী গো

বন্দনা করি তোমার মা মনসার চরণে।” 

সুরের সারল্য ছড়িয়ে পরে বাতাসে। জলা জঙ্গলে ভরা বাংলায়  সাপের উৎপাত আর ভয়ে অনার্য দেবী মনসার পায়ে মাথা কুটতে বাধ্য হয়েছে মানুষ। মনসার   আর সরস্বতী উভয়ের  সাথেই   জলের সম্পর্ক আছে।  সাথে থাকে হাঁস।  সরস্বতীর পুজো হয় সূর্যের উত্তরায়নে শ্রী পঞ্চমী তিথিতে আর মনসা দেবী পুজা পান সূর্যের দক্ষিণায়নে নাগ পঞ্চমীতে।  দুই  পুজা  হয়তো জলের বন্দনা। প্রাচীন গ্রন্থ থেকে জানা যায়, দেবী মনসা নাকি জলের অন্বেষণে পশ্চিম থেকে পূবে আসেন। ভক্তরা  প্রার্থনা জানান  , তাপের অবসর( উনান জ্বলে না) হোক,  শীতল থাক এ পৃথিবী, মনুষ্য দেহ।  মনসা পুজোর দিন জল ঢালা পান্তা ভাত খেয়ে অরন্ধনে মেতে ওঠেন বাঙালি।অভিজাত গৃহস্থের ঘরেও পান্তাকে ব্রাত্য মানা হয় না। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসা ভাসানে মনসা দেবীর ব্রত পালনে পান্তা দিয়ে দেবী পুজোর কথা আছে, 

“ পান্তা ওদন দিয়া পুজিবেক তোমা

 আশ্বিনে অনন্ত পূজা চিত্তে নাহি সীমা।”

 যুগ যুগ ধরে পান্তা ভাতের উল্লেখ পাওয়া যায় সাহিত্যে।  মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে বিজয় গুপ্তের লেখা “পদ্মা পুরাণ” এ পাওয়া যায়,

“আনিয়া মানের পাত বাড়ি দিলো পান্তাভাত” 

আবার “চন্ডীমঙ্গল” কাব্যে ব্যাধ পত্নী নিদয়ার গর্ভবস্থায় নিদয়া পান্তা খাওয়ার কথা বলে, 

“ পাঁচ মাসে নিদয়ার না রোচে ওদন, 

 ছয় মাসে কাঁজী করঞ্জায় মন।” 

মুকুন্দ চক্রবর্তীর অম্বিকা মঙ্গল এর ‘বণিক’  খন্ডে লহনা খুল্লনাকে বলে, 

“ হরিদ্রা রঞ্জিত কাঁজি     উদর ভরিয়া ভুঞ্জি

   বন-শাকে বড়ই পীরিতি।”

এই কাঁজি হল খানিকটা আমানির বা পান্তা ভাতের সাথে মিশে থাকা জলের  মতো। পান্তার জলটুকুও ছাড় দেয় না  বাঙালি।  ‘আমানি’ শব্দটির উদ্ভব হয়েছে ‘আমপানি’ বা ‘অম্লপানীয়’  প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকে। বৈশাখের প্রথম দিন হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কৃষকেরা ‘আমানি’ খেয়ে মাঠে  চাষের কাজে যান। চৈত্র-সংক্রান্তির দিন সন্ধ্যায় গৃহিনী এক হাঁড়ি জলে  কিছুটা আতপ চাল বা ‘আম চাল’ সারারাত ভিজতে দেন। হাঁড়ি ঢাকা দিয়ে তার উপর বসান  একটি কচি আমের ডাল । বৈশাখের পয়লা ভোরে সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির বধূরা সকলকে ভেজা চাল খেতে দেন আর আম্রপল্লব দিয়ে সকলের গায়ে জল ছিটিয়ে দেন। এ যেন হিন্দুদের ‘শান্তির জল। তাদের বিশ্বাস,  এই রীতি পালনের মাধ্যমে নতুন বছর সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধিতে ভরে উঠবে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও শ্রীহট্টে এক সময় এই অনুষ্ঠান ঘরে ঘরে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে পালিত হত।  বাংলার নতুন বছর  পান্তা উৎসব ঢাকায় এখনও খুব  জনপ্রিয়। এপার বাংলাতেও গৃহস্থ বাড়িতে ‘আম্বজলের পাতিল’ রাখার সাবেক রীতি ছিল। প্রতিদিন তাতে পুরনো চালের ঝরঝরে অল্প ভাত আর জল রাখা হয় । পাঁচ-সাত দিন পরে তা থেকে বেশ টকটক গন্ধ বেরলে জলটুকু ছেঁকে নেওয়া হত। সকালে খালি পেটে সেই জল পান করা ছিল অম্বলের রোগীর জন্য  উপকারী। শরীর ঠান্ডা করা ছাড়াও তার ছিল আরও অনেক গুণ। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের “ মনসা মঙ্গল” কাব্যে চাঁদ সওদাগরের স্ত্রী  গর্ভবতী সনকা বলে, 

“ পান্তা আমানি পাইলে এখনি 

সুখেতে আহার করি।” 

 অভাবের সংসারে ফুল্লরাকে পাথরের বাটী পর্যন্ত বাঁধা দিতে হয়। দুঃখে বারোমাস্যায় করুন  কাহিনী শুনিয়ে ফুল্লরা দেবী চন্ডীকে বলে, 

“ দুঃখ কর অবধান দুঃখ কর অবধান

আমানি খাবার গর্তে দেখো বিদ্যমান।” 

কালকেতুর ভোজন বর্ণনা প্রসঙ্গে এসেছে আমানির কথা। 

“ মোচরিয়া গোঁফ দুটি বান্ধিলেন ঘাড়ে

এক শ্বাসে তিন হাঁড়ি আমানি উজারে।” 

ক্ষুধার জ্বালা এতই তীব্র,  পান্তা ভাতের জলটুকুও এক নিঃশ্বাসে গিলে ফেলে সমাজের হত দরিদ্র মানুষ। 

রূপরামের “ধর্মমঙ্গল” কাব্যেও আছে  আমানির কথা। 

“ আমানি মাগিবে আর কত পান্তা ভাত

আর কত সদাই বুনিবে তালপাত।” 

বাসি ভাত দিয়ে পান্তা তৈরির কথা  “চণ্ডীমঙ্গল” কাব্যে পাই, 

“ বাসি অন্ন আনে রামা দিআ তরাতরি

জল সমে ঢালে অন্ন পাতে শীঘ্র করি।” 

পান্তার ভেদাভেদ হয় না, তাই অনার্য দেবী মনসা যেমন পান্তায় পূজিত হন, তেমন শক্তিরূপেন সংস্থিতা দেবী দুর্গাকে ঘরের মেয়ে মেনে   সাধ করে পান্তা ভোগ সাজানো হয়।  বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে কচুর শাক আর পান্তা খাইয়ে বিদায় জানানো হয়  উমাকে।  রুনু দিদার কাছে এ প্রসঙ্গে  একটা গল্প শুনেছিলাম,  নবমী নিশির অবসানে দর্পণে প্রতিমা নিরঞ্জনের পর বাড়ীর মেয়েরা হাতে নীল অপরাজিতা ডাল পরে ভোগের পান্তা ভাত খায়। পান চিবোনো লাল দাঁতের ফাঁকে হাসি রেখে রুনু দিদা বলে, উমা কৈলাশে ফিরে শিব বাবাজী যখন প্রশ্ন করে, পৃথিবী থেকে তিনি কী খেয়ে যাত্রা শুরু করেছেন ? পার্বতী বেজার মুখে বলেন, সামান্য পান্তা ভাত আর কচু শাক। এ যেন  স্বামী সোহাগিনী উমার শিবের  মনে আক্ষেপ না আনার প্রয়াস। তবে মা দুর্গা তো ঘরের মেয়ে, এতটা পথ পাড়ি দিয়ে যাবেন  সূদুর কৈলাশ তাই সহজপাচ্য পান্তা খাইয়ে শরীর শীতল রাখার জন্য এই আয়োজন হতে পারে। একবার এক পত্রিকায় পড়েছিলাম, দশমীর দিন যমশেরপুরের বাগচীদের বাড়ীতে একচালা কনক দুর্গা পুজোয়  পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ মাছ বেড়ে দেন বাড়ীর এয়োরা     আর বালুরঘাটের পাল বাড়ীতে নবমী, দশমীতে পান্তার সাথে থাকে বোয়াল আর রাইখোর মাছ। 

পান্তা ভাতের সাথে জড়িয়ে আছেন দেবী শীতলা।  চৈত্র মাসের কৃষ্ণ পক্ষের সপ্তমীতে শরীর শীতল রাখার জন্য শীতল পান্তা খাওয়া হয় হইহই করে। তাই এই তিথির নাম শীতল ষষ্ঠী।   

পান্তা ভাত আর্য অনার্য নির্বিশেষে সকল বাড়ীর রান্না ঘরে জায়গা করে নিয়েছে। বাংলার ছেলেভুলানো ছড়াতে এসেছে পান্তার কথা। 

“পান্তা খেয়ে শান্ত হয়ে

কাপড় দিয়ে গায়

গরু চরাতে পাচন হাতে

রাখাল ছেলে যায়।” 

কেবল এই বাংলা নয়, ওপার বাংলাতেও  নানান লোকাচার, পালা-পার্বণ,  ধর্মীয় রীতিনীতির সাথে মিশে আছে  ।   আম্মা বলতো, এক মুঠো চাল বেশী নিস যদি ঘরে অতিথি আসেন। সত্যিই তো, অতিথি তো বলে কয়ে আসে না। তাই বেশী করে ভাত রাঁধা হতো গৃহস্থের ঘরে। আর  ভাত বেশী হলেও চিন্তা কী? বাসী ভাতে জল ঢেলে সহজেই তার জীবন কাল বৃদ্ধি করা যায়। আগের দিনে তার ফ্রিজ কোথায়? এই ছিলো  ভাত সংরক্ষণের একটি পদ্ধতি। 

বৈষ্ণবরা  জৈষ্ঠ্য মাসে রাধাকৃষ্ণ কে   পান্তা ভোগ দেন,  যার নাম ‘কাঞ্জী’।   কালো পাথরের বাটীতে কাঞ্জী সাজিয়ে সাথে দই,চিনি,কলমি,শাক ভাজা এবং দুই একরকমের নিরামিষ তরকারি দেওয়া হয়। চন্ডী মঙ্গল কাব্যে মুকুন্দ চক্রবর্তী লিখেছেন,    ব্যাধ পত্নী নিদয়ার গর্ভবস্থায় নিদয়া কাঞ্জী ( কাঁজী) বা পান্তা খাওয়ার কথা বলে, 

“ পাঁচ মাসে নিদয়ার না রোচে ওদন, 

 ছয় মাসে কাঁজী করঞ্জায় মন।” 

 

বাংলার পাশেই ওড়িশা।  পান্তা ভাত এখানে নাম পেয়েছে পাখাল। নীল মাধব সেবায় লাগে পাখাল। দশম শতক থেকেই জগন্নাথ মন্দিরে পাখাল ভোগের শুরু। আজও   প্রতিবছর ২০ শে মার্চ ওড়িশ্যায় ধুমধাম করে পালিত হয় ‘পাখাল দিবস’। পান্তার জন্য এমন ভালোবাসা সত্যিই বিরল। পালি ভাষাতে পান্তাকে বলা হয়  ‘পাখালিবা’। সংস্কৃতে  ‘প্রক্ষালনা’  অর্থাৎ  যাকে ধৌত করা হয়েছে বা ধোয়া হয়েছে।    ষোড়শ শতকে  কবি অর্জুনদাস তাঁর “কল্পলতা”  গ্রন্থে পাখালের কথা বলেছেন। তবে  সে কী একরকমের পাখাল? ‘দহি পাখাল’, ‘চুক্কা পাখাল’, ‘জিরা পাখাল’, ‘ঘি পাখাল’, ‘গরম পাখাল’, ‘সাজা পাখাল’, ‘বাসী পাখাল’,  সুবাস পাখাল এমন কত নামের বাহার।  ‘সাজা পাখালে’  টাটকা  ভাত রেঁধে জল ঢালা হয় , সাথে আদা কুচি, কাঁচা আমের টুকরো, কাঁচা লঙ্কা বাটা।  আর টাটকা ভাত  সারারাত মাটির হাঁড়িতে ভিজিয়ে রেখে  পরদিন সামান্য টকে গিয়ে ‘বাসি পাখাল’  তৈরি হয়। পরিবেশনের আগে এক চিমটি নুনই এরজন্য যথেষ্ট।  ‘বাসি পাখালে’  দই মেশালেই   হয়ে যায় ‘দধি পাখাল’ ।  গরম সরষের তেলে  কারিপাতা,  সরষের দানা, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে পাখালে ঢেলে দিলেই তৈরি ‘ চুক্কা পাখাল’ ।  মিঠা পাখালের সাথে থাকে আখ, জিরা গুঁড়ো, দই, আদা। সুবাস পাখাল তো গন্ধরাজ পান্তা। জুঁই, মোগরা, চাঁপা, আদার গন্ধে সুবাসিত। সুখুয়া পোড়া বা শুকনো মাছ ভাজা,  পালং ভাজা বড়ি চূড়া বা ডালের বড়া কিংবা আলু ভাজার সাথে খাওয়া হয়।  কথায় আছে যাহা বাহান্ন তাহাই তিপান্ন ঠিক যেমন বাংলায় যাহা আমানি  ওড়িশায় তাহাই  তরানি।

ওড়িশার বিখ্যাত  কবি কালি চরণ গানে পাই, 

“ আশা জীবন ধন মো পাখলা কনসা।”

আসলে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের কাছে পান্তা সহজলভ্য,  এই কারণেই হয়তো ঈশ্বরকে নিবেদনের মধ্যে দিয়ে বোঝানো হয়, দেবতা সকলের জন্য, তিনি ধনী নির্ধন ভেদাভেদ করেন না, অল্পেই তুষ্ট তিনি। 

আসামের নরম মাটিতে ধানের চাষ ‘পৈতা ভাত’ কে স্বাগত জানায়। বাংলার “পান্তা ” এদেশে ‘পৈতা ভাত’।    ঝলসানো গরম থেকে স্বস্তি  পেতে জল ঢালা পৈতা আর পিটিকা আলু তুলে নিয়েছে এদেশের মানুষ।  বিরাট যাপি মাথায় আসামের কৃষক রোদে পুড়ে জলে ভিজে ফসল ফলায়।  অসমের নববর্ষ বা বোহাগ বিহু উৎসবে উল্লাসে মেতে ওঠে আসামবাসী৷  “বোহাগ বিহু” র সময়  পান্তা ভাত ও হাত পাখা অপরিহার্য। দই বা সরষের তেলের সাথে খাওয়া হয় পৈতা ভাত । সরিষার তেল, লবণ, সেদ্ধ আলু,  পোড়া   টমেটো আর কাঁচা লঙ্কা থাকলে তো কেয়া বাত। তবে দিবা রাশ   হলে  এর সাথে নানান ব্যঞ্জন  যোগ হয় যেমন ‘পুরা মাছ’ বা পোড়া  মাছ,   মুরগীর মাংস এমন কতকি। আসামের কিছু পরিবার পৈতা ভাতের সাথে তিল বাটা  বা খরোলি খায়।  আরও রাজকীয় করতে আলু ভাজা,  ডিম, বেগুন পোড়া খাওয়া যায়।  সন্ধেবেলা ভাত রাঁধার পর  বাঁশের পাত্রে ঢেলে, আলু আর ছোটো ছোটো পেঁয়াজ ভাতের মধ্যে রেখে বাঁশের ঝাঝরি দিয়ে ঢেকে, মাটির উনুন নিভিয়ে গরম ছাইয়ের মধ্যে দিয়ে রেখে দেয়  সারারাত। উষ্ণতা পরম মমতায় ঘিরে রাখবে তাকে। ভাত হবে ঝাঁঝালো  আর নরম। পরদিন খাবার সময় টের পাওয়া যায় আলু আর পেঁয়াজের মিষ্টতা৷ 

দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের ‘সাধ্বী অন্নম’ বা “সাল্লা অন্নম”  খানিকটা পান্তার মতো। রান্না করা ভাতে গরম দুধ আর বাটার মিল্ক মিশিয়ে সারারাত রেখে পরদিন কাঁচা পেঁয়াজ,  কাঁচা লঙ্কার খায় অন্ধ্রের মানুষ। তামিলনাড়ুতে “ পাঝায়া সুরু”, ‘পাঝাম কাঞ্জি’,   বিহারে ‘গিল ভাত’ বা সাদা খিচুড়ি, ছত্তিশগড়ে ‘বোরে ভাত’ বা ‘বোরে বাসি’ আর ঝাড়খণ্ডে  গ্রামবাসীদের কাছে স্রেফ ‘পানিভাত’। 

ফ্রে সেবাস্টিয়ান ম্যানরিক সায়েব বঙ্গ দর্শন করে লিখেছিলেন, বাংলাদেশে গরিব লোক পান্তা খায় নুন লঙ্কা পেঁয়াজ আর শাক দিয়ে। 

বাঙালির  কাছে যেমন ‘আমানি’ প্রিয় পানীয়, দক্ষিণ ভারতে এক সময় সামাজিক শ্রেণী নির্বিশেষে ঠিক তেমনই জনপ্রিয় ছিল নীরাগরম।   এর সঙ্গে যদিও উষ্ণ পানীয়ের কোন সম্পর্ক নেই। বরং এর অর্থ একেবারেই বিপরীত। ‘নীর’ অর্থাৎ জল আর ‘আগরম’ অর্থাৎ খাদ্য। জাউ বা জলে ভেজানো ভাত নীরাগরম।  এর একটা ভালো নামও আছে, ‘ নিশিনীর’ । নুন, লঙ্কা, লেবু আর ছাঁচি পেঁয়াজ দিয়ে   চমৎকার এক  প্রাতরাশ।  

 মুঘল আমলে সামাজিক কিংবা  সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য আর  আয়োজিত অনুষ্ঠানের দর্শকরা জল ঢালা ভাত খেতো তৃপ্তি ভরে।

 

  বাংলার  মাঠে- ঘাটে আগে একটা কথা শোনা যেতো   “সুখুয়াপান্তাভাতে টাটকা বেগুন পোড়া”।   পূর্ববঙ্গে পান্তার সাথে নানান ধরণের ভর্তা খাওয়া হয়। শুটকি মাছের ঝুরো, ইলিশ মাছ ভাজা কুমড়ো  ফুলের বড়া, কাঁচা লঙ্কা,  পেঁয়াজ,  বলে শেষ করা যাবে না।  এমনকি পান্তা – ভর্তা ও বিশেষ জনপ্রিয়।  বাহুল্য বাড়ার সাথে বৈচিত্র্য বাড়ছে কিন্তু  দরিদ্র মানুষ এতো সমারোহ করবে কী করে?  পান্তার সাথে সামান্য শাক ভাজা, শুকনো লঙ্কা পোড়া, নুন,সরষের তেল,কাঁচা লঙ্কা  দিয়েই পেট ভরিয়ে নেয়।  পশ্চিমবঙ্গে  পান্তার সাথে নানান ধরনের ডালের বড়া, কাসুন্দি,  লেবু, কাঁচা লঙ্কা, আলুর চোখা,  মাছ ভাজা খাওয়া হয়। । বীরভূম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার মানুষ মাছের টক, পোস্তবাটা,  কুড়তি কলাই বাটা দিয়ে পান্তা খেতে ভালোবাসে। বাঙালীর আবেগের সাথে জড়িয়ে থাকা এই পান্তা ভাতের জন্য  জনৈক এক কবি  লিখেছেন,
” সিদ্ধ ভাতকে পান্তা বানাই
চুবিয়ে রাখি জলে,
এটাই আজ মূল রেসিপি
তারেই পান্তা বলে।”
ইতিহাসও পান্তার গুনকীর্তন থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেনি। ১৭৫৬ সালে সিরাজদৌল্লা কলকাতা আক্রমন করলে  বহু ইংরেজ বন্দী হয় ।  একমাত্র  ওলন্দাজ কুঠির প্রধান ভিনেট ওয়ারেন হেস্টিংস কে ছেড়ে দেওয়ার জন্য সিরাজদৌল্লা কে অনুরোধ করলেন। মুক্তি পেয়ে হেস্টিংস সোজা চলে আসলেন কাশিমবাজারে। ওয়ারেন হেস্টিংস গোপনে নবাবের তথ্য পাচার করছে জেনে সিরাজ আবার হেস্টিংস কে বন্দী করতে চাইলেন। এবার হেস্টিংস কান্তবাবুর দোকানে গিয়ে লুকিয়ে পড়লেন।  কৃষ্ণ কান্ত নন্দীও কম যান কিসে? সাহেব আপ্যায়ন হাতছাড়া করার মানুষ তিনি নন। ওয়ারেন হেস্টিংস কে তাঁর দোকানে লুকিয়ে রেখে থালায় সাজিয়ে দিলেন পান্তা ভাত আর চিংড়ি মাছ।  ব্যাস, সেসময়ের পর শুরু হলো ছড়া কাটা, 

“ মুস্কিলে পড়িয়া কান্ত করে হায় হায়,  

হেস্টিংসে কি খেতে দিয়া প্রাণ রাখা যায়? 

ঘরে ছিলো পান্তা ভাত আর চিংড়ি মাছ 

কাঁচা লঙ্কা, বড়ি পোড়া কাছে কলাগাছ 

সূড়যোদয় হলো আজ পশ্চিম গগনে

হেস্টিংস ডিনার খান কান্তের ভবনে।” 

রোদ ঝলসানো গরমে গ্রাম থেকে শহুরে জীবনে পান্তা ভাতকে দূরে সরিয়ে ফেলার কোনো উপায় নেই। পুষ্টিগুণে ভরপুর এই  পান্তা ভাত উৎসব থেকে ঐতিহ্যে সকলকে ঘিরে রেখেছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় প্রচুর ধান উৎপাদন হওয়ায় পান্তা ভাত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তাদের কাছে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় দেখা গেছে ১০০ গ্রাম পান্তা ভাতে ভরপুর আয়রন,পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ক্যালশিয়াম মজুত থাকে, এছাড়া শরীরে জলের ভারসাম্য বজায় রাখে এই পান্তা। তাই বৈজ্ঞানিক বা ভোজন রসিকরা পান্তাকে পাত থেকে বাদ দিতে পারেন না।