বঙ্গবাণী পত্রিকা : বঙ্গসংস্কৃতির এক ভুলে যাওয়া অধ্যায়

       ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় স্নাতকোত্তর পাঠক্রম শুরু করার সদিচ্ছায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সামিল করে নিয়েছিলেন মাননীয় অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেনকে। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় দীনেশচন্দ্রকে অনুরোধ করেছিলেন —

         “এবার বাংলার এম-এ বিভাগ খুলিব, স্থির করিয়াছি। আপনি এণ্ডারসন্‌ সাহেবকে চিঠি লিখিয়া দিন, তিনি একটা খসড়া ও সিলেবাস্‌ ঠিক করিয়া পাঠান।”

এর ঠিক পরের বছরই ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয় ‘বঙ্গবাণী’ সাময়িক পত্রিকা। তাঁর দুই সুযোগ্য পুত্র রমাপ্রসাদ ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আগ্রহ-উৎসাহ-ঐকান্তিকতায় এই পত্রিকাটির জন্ম হয়। পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনায় দুই পুত্র তাঁদের পিতার পূর্ণ সমর্থন ও পরোক্ষ সহযোগিতা পেয়েছিলেন। শান্তিপদ ভট্টাচার্য লিখেছেন,

         “বস্তুত নাতিদীর্ঘ আয়ুষ্কালে ‘বঙ্গবাণী’ সাহিত্যের যে সেবা করে গেছে তা স্মরণীয়।

          পত্রিকাটির প্রকাশ ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে। শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৩৩৪

         -এর মাঘে। অর্থাৎ ছ’ বছরের জীবনে ‘বঙ্গবাণী’ তৎকালীন সকল প্রবীণ-নবীনের

        লেখার গভীর স্পর্শ পেয়েছে। বিজয়চন্দ্র মজুমদার ও দীনেশচন্দ্র সেনের যুগ্ম সম্পাদনায়

        সেদিন ‘বঙ্গবাণী’ সাহিত্যসমাজে এনে দিয়েছিল গভীর আলোড়ন, নবনব চিন্তাধারার

        অফুরন্ত প্রস্রবণ, আত্যন্তিক প্রয়াস পেয়েছিল পত্রিকার শীর্ষদেশে উল্লিখিত ‘আবার তো’রা

        মানুষ হ’ বাণীর সংহত তাৎপর্য ব্যাখ্যাতে।”

          এই ‘বঙ্গবাণী’র স্বত্বাধিকারী ও অধ্যক্ষ হিসাবে ছিলেন রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। পত্রিকাটির কার্যালয় ছিল ৭৭ নং রসা রোড। এটি প্রথমে হ্যারিসন রোডের কটন প্রেস থেকে মুদ্রিত হত। ষষ্ঠ বর্ষের দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে কটন প্রেসের পরিবর্তে লিথো অ্যাণ্ড প্রিণ্টিং ওয়ার্কস পত্রিকাটি মুদ্রণের দায়িত্ব পায়। প্রথম দিকে ‘বঙ্গবাণী’র মুদ্রক ও প্রকাশকের স্থানে জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষের নাম ছাপা হত। পরে তৃতীয় বর্ষের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা থেকে মুদ্রক ও প্রকাশক পরিবর্তিত হয়ে পৃথক ব্যক্তির নামে প্রকাশিত হয়। মুদ্রক হন সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আর প্রকাশক কিশোরীমোহন ভট্টাচার্য। পরে কিশোরীমোহনের স্থলাভিষিক্ত হন শশিভূষণ ভট্টাচার্য। পত্রিকাটির প্রতিটি সংখ্যার মূল্য ছিল সাত আনা। বার্ষিক চাঁদা ছিল চার টাকা বারো আনা।

       প্রথম পর্যায়ে বিজয়চন্দ্র মজুমদার ও দীনেশচন্দ্র সেন ছিলেন ‘বঙ্গবাণী’র যুগ্ম সম্পাদক। কিন্তু প্রথম দু’ বছর যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করলেও তৃতীয় বর্ষ থেকে দীনেশচন্দ্র শারীরিক অসুস্থতার জন্য সম্পাদনার দায়িত্ব ত্যাগ করেন। পরবর্তী চার বছর একক ভাবে সম্পাদকের দায়িত্ব বহন করেছেন বিজয়চন্দ্র মজুমদার। দীনেশচন্দ্র সম্পাদক না থাকলেও নিয়মিত ‘বঙ্গবাণী’তে লিখেছেন। ‘বঙ্গবাণী’ যে ছ’ বছর প্রকাশিত হয়েছিল সেই ছ’ বছরই তিনি লিখেছেন। প্রথম বছর তাঁর দশটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। পঞ্চম বছরে প্রথম সংখ্যায় ছাপা হয় তাঁর লেখা ‘পুত্রস্নেহ’ নামক গল্পটি। শেষ বছরে অবশ্য একবারই তিনি লিখেছিলেন। দীনেশচন্দ্রের বেশিরভাগ রচনাই প্রবন্ধ জাতীয়। স্মরণ সংখ্যায় আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্মৃতিকথাও লিখেছিলেন।

       ‘বঙ্গবাণী’র অন্যতম সম্পাদক বিজয়চন্দ্র মজুমদার নিজেই ছিলেন কবি। পত্রিকার প্রয়োজনে তাঁকেই সব থেকে বেশি লিখতে হয়েছে এবং সেগুলির বেশির ভাগই ছিল কবিতা। তিনি কবিতানুরাগী ছিলেন বলে সমকালীন স্বনামখ্যাত অনেক কবিই ‘বঙ্গবাণী’তে কবিতা লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি লিখেছেন করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, কামিনী রায়, বন্দে আলী মিঞা, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, গোলাম মোস্তাফা প্রমুখ কবি। নজরুলের বিখ্যাত ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ কবিতাটি ‘বঙ্গবাণী’তে প্রথম ছাপা হয়। জীবনানন্দ ‘দাশগুপ্ত’ পদবীতে তাঁর সাহিত্য রচনার প্রাথমিক পর্বে যে আটটি কবিতা রচনা করেছিলেন তা এই ‘বঙ্গবাণী’তেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’-এর অন্যতম তিনটি কবিতা ‘বিবেকানন্দ’, ‘দেশবন্ধুর প্রয়াণে’, ‘হিন্দু-মুসলমান’ এই পত্রিকায় প্রকাশ-সৌভাগ্য লাভ করেছিল।

       রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি গান, কবিতা ও অভিভাষণ ‘বঙ্গবাণী’তে ছাপা হয়েছিল। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে লেখা কবির পত্রাবলী ধারাবাহিক ভাবে (ফাল্গুন ১৩৩৩ – আষাঢ় ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত) বেরিয়েছিল। তাঁর ‘পরীর পরিচয়’ গল্পটি ‘বঙ্গবাণী’তে  প্রকাশ পেয়েছিল। তাঁর এই একটি মাত্র গল্পই এই পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ সংখ্যায় কবির ‘সাহিত্য ধর্ম’ প্রবন্ধটি ‘বিচিত্রা’য় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। আধুনিক সাহিত্য বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব এই প্রবন্ধে প্রকাশ পেয়েছিল। অনেক লেখকই তখন কবির মতের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছিলেন। এই বিরোধীদের প্রধান ছিলেন নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। নরেশচন্দ্র ‘বিচিত্রা’র পরবর্তী সংখ্যায় (ভাদ্র ১৩৩৪) এবং শরৎচন্দ্র ‘বঙ্গবাণী’তে (আশ্বিন ১৩৩৪) — উভয়েই রবীন্দ্র অভিমতের বিরোধিতা করে প্রবন্ধ লেখেন। এছাড়া ‘বঙ্গবাণী’তে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী, দিলীপকুমার রায়, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রফুল্লকুমার সরকার, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস, প্রিয়নাথ কর, বিনয়কুমার সরকার, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, বিমানবিহারী মজুমদার, ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত, মহম্মদ শহীদুল্লাহ, হরিহর শেঠ ও রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখের গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ‘বঙ্গবাণী’ প্রকাশ করেছিল। প্রবন্ধগুলিতে বিষয়-বৈচিত্র্যও ছিল। সাহিত্য-শিল্প-সংগীত-সমাজ-শিক্ষা — সব বিষয়ই ধরা আছে প্রবন্ধগুলিতে।

       রবীন্দ্রবিরোধী প্রবন্ধটি ছাড়াও শরৎচন্দ্র ‘বঙ্গবাণী’তে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। যেমন, সাহিত্য ও নীতি, আধুনিক সাহিত্যের কৈফিয়ৎ। আশ্বিন ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে লেখা সাহিত্যের রীতি ও নীতি প্রবন্ধটিই ছিল রবীন্দ্র বক্তব্যের বিরোধিতা করে লেখা। তবে প্রথম দিকে শরৎচন্দ্র ‘বঙ্গবাণী’তে লিখতে আগ্রহী ছিলেন না। একটি চিঠিতে জানা যায় তাঁর মনের কথা :

            “ও আশু মুখুজ্জের ছেলেদের কাগজ, সাহিত্য সৃষ্টি করা ওদের উদ্দেশ্য না,

             প্রবাসী ও মডার্ণ রিভিয়্যুর পালটা গাইবার জন্য ওদের কাগজ বাহির করা —

        ওতে আমি লিখব না।”

তাই ‘বঙ্গবাণী’র প্রথম সাতটি সংখ্যায় পাঠক শরৎচন্দ্রকে পায়নি। ১৩২৯ বঙ্গব্দের আশ্বিন সংখ্যায়  শরৎচন্দ্রের প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়। এটি হল কালজয়ী গল্প ‘মহেশ’। ‘মহেশ’ই ‘বঙ্গবাণী’তে প্রকাশিত শরৎচন্দ্রের প্রথম রচনা। এই গল্পটি ছাড়াও আরও দুটি অত্যন্ত পরিচিত গল্প ‘অভাগীর স্বর্গ’ এবং ‘সতী’ এই পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।

       শরৎচন্দ্রের সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘পথের দাবী’ ‘বঙ্গবাণী’তে ধারাবাহিক ভাবে (১৩২৯ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যা থেকে ১৩৩৩ বঙ্গব্দের বৈশাখ সংখ্যা পর্যন্ত) প্রকাশিত হয়েছিল। তবে উপন্যাসটি যে একটানা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল তা নয়, মাঝে মধ্যেই কিস্তি বিরতি ঘটেছিল। ফলে ‘বঙ্গবাণী’র কোনো কোনো সংখ্যা ‘পথের দাবী’ ছাড়াই প্রকাশিত হয়েছিল। আবার লেখা জমা দিতে বিলম্ব হওয়ায় ‘বঙ্গবাণী’ও অনেক সময় নির্দিষ্ট সময়ে প্রকাশ পায়নি। আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই উপন্যাসটির জন্য পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা ও প্রচার বেড়ে গিয়েছিল। তবে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সক্রিয়তা উপন্যাস সমাপ্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

       জনপ্রিয় এই উপন্যাসটি ছাড়া বিভিন্ন লেখকের আরও দশটি উপন্যাস ‘বঙ্গবাণী’তে প্রকাশিত হয়েছিল। চপলাবালা বসু, নিরুপমাদেবী, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, বনবিহারী মুখোপাধ্যায়, সরোজবাসিনী গুপ্ত ও সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন একটি করে উপন্যাস। অনুরূপাদেবী লিখেছে ‘সতী’ ও ‘হারানো খাতা’ নামে দুটি উপন্যাস।

       ঠাকুর পরিবার থেকে শুরু করে সেকালের যশস্বী প্রায় সকল সাহিত্যিকই ‘বঙ্গবাণী’র জন্য কলম ধরেছেন। তবে তাঁদের মধ্যে কেউ ছিলেন নিয়মিত, কেউ বা অনিয়মিত। যেমন, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ও প্রভাবতী দেবী সরস্বতী — দু’জনেই  সেই সময়কার অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। কিন্তু তাঁরা এই পত্রিকায় কেউই একটির বেশি গল্প লেখেননি। ‘বঙ্গবাণী’তে যাঁরা গল্প লিখেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিপিনচন্দ্র পাল, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায়, অনুরূপা দেবী, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, বনফুল, সজনীকান্ত দাস, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, মণীশ ঘটক, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রবোধকুমার সান্যাল, মানিক ভট্টাচার্য প্রমুখ।

       ১৯২১-১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অবনীন্দ্রনাথ রাণী বাগেশ্বরী অধ্যাপক পদে ছিলেন।  সেই সময়ে তিনি উনত্রিশটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আগ্রহে অবনীন্দ্রনাথের সাতাশটি বক্তৃতা ‘বঙ্গবাণী’তে ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। আশুতোষের আগ্রহেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথও সাহিত্য বিষয়ক তিনটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এই তিনটি বক্তৃতা ‘বঙ্গবাণী’র জন্য কবি পরে নতুন করে লিখে দিয়েছিলেন। ‘বঙ্গবাণী’র দুটি বিশেষ স্মরণ সংখ্যাও প্রকাশিত হয়েছিল — একটি  আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে, অন্যটি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্মরণে। ইন্দিরা দেবী, চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়, যোগীন্দ্রনাথ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, অশ্বিনীকুমার দত্ত — এঁরা ছাড়াও আরও অনেক বিশিষ্ট জনের প্রয়াণ সংবাদ ‘বঙ্গবাণী’তে মুদ্রিত হয়েছিল।

       ‘বঙ্গবাণী’র কতগুলি নিয়মিত বিভাগ ছিল। যেমন, গ্রন্থ-সমালোচনা, প্রতিধ্বনি, সাহিত্য বীথি, সমালোচনা চিত্র, সংগীত শিক্ষার আসর, বঙ্গবাণীর নৈবেদ্য, আইন-আদালত প্রভৃতি। এই সব ক’টি বিভাগই যেমন পত্রিকা প্রকাশের সূচনা লগ্ন থেকে ছিল না, পরে সংযোজিত হয়েছিল, তেমনই আবার কোনো কোনো বিভাগের বিলুপ্তিও ঘটেছিল। সংগীত শিক্ষার আসর বিভাগে সুপরিচিত অনেক নাটকের গানগুলির স্বরলিপি ছাপা হত। ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যায় দ্বিজেন্দ্রলালের ‘মেবার পতন’ নাটকের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ গানটির স্বরলিপি ছাপা হয়। গানের এই বিশেষ কথাটি ‘বঙ্গবাণী’র প্রথম পৃষ্ঠাতে নিয়মিত ছাপা হত।

       ‘বঙ্গবাণী’র গ্রন্থ-সমালোচনা বিভাগটি নামহীন সমালোচকদের যুক্তিনিষ্ঠ ও বিশ্লেষণী ব্যাখ্যার দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছিল। তবে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও দীনেশচন্দ্র সেনের মতো ব্যক্তিত্ব স্বনামেই গ্রন্থ সমালোচনা করেছিলেন। ভাবগম্ভীর প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা, শিশু-সাহিত্য, এমনকী, রূপোপজীবিনী, রোগ ও আরোগ্য, সংক্ষিপ্ত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা প্রণালীরও সমালোচনা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘চিরকুমার সভা’, নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ ও ‘দোলনচাঁপা’, রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত ‘বার্ষিক শিশুসাথী’, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘অতসী’, সুকুমার রায়ের ‘হ-য-ব-র-ল’, কামিনী রায়ের ‘ঠাকুরমার চিঠি’, জগদানন্দ রায়ের ‘বাংলার পাখি’, প্রভাবতী দেবীর ‘মুক্তির আহ্বান’, প্রমথ চৌধুরীর ‘বীরবলের হালখাতা’ ও মোহিতলাল মজুমদারের ‘বিস্মরণী’ — সে সময়ে প্রকাশিত এই রকম সুপরিচিত বহু গ্রন্থের সমালোচনা ‘বঙ্গবাণী’তে প্রকাশিত হয়েছিল।

       ‘বঙ্গবাণী’র বিশেষত্ব এইখানেই যে, তার সমকালীন সাময়িক পত্রিকাগুলিকে কেন্দ্র করে তখন এক একটি লেখক গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছিল।  যেমন, ‘ভারতী’ ছিল একান্ত ভাবেই ঠাকুরবাড়ির। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে যে ‘যমুনা’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল তা ছিল শরৎচন্দ্র কেন্দ্রিক। শরৎচন্দ্রের বেশির ভাগ রচনাই ‘যমুনা’তে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি কিছুকাল এই পত্রিকার সম্পাদনাও করেছিলেন। দ্বিতীয় দশকে প্রকাশিত হয়েছিল ‘ভারতবর্ষ’, ‘নারায়ণ’ ও ‘সবুজপত্র’। চিত্তরঞ্জন দাশের ‘নারায়ণ’ সরাসরি রবীন্দ্র-বিরোধী না হলেও খ্যাতির শীর্ষে থাকা কবিকে সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে একটি বিপরীতমুখী সাহিত্যধারা তৈরি করেছিল। সেই দিক থেকে ‘বঙ্গবাণী’ ছিল একেবারেই ব্যতিক্রমী।

       প্রকাশের প্রথম থেকেই ‘বঙ্গবাণী’ যতদূর সম্ভব এই গোষ্ঠী কেন্দ্রিকতা থেকে দূরে সরে গিয়ে লেখক নির্বাচনে স্বকীয়তা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে চেষ্টা করেছিল। তাই রবীন্দ্রনাথের রচনা প্রকাশের পাশাপাশি চিত্তরঞ্জন দাশের লেখাও যেমন প্রকাশিত হয়েছিল, তেমনই প্রকাশিত হয়েছিল বিপিনচন্দ্র পালের রচনাও। তিনি ‘বঙ্গবাণী’তে গল্প ছাড়াও ধারাবাহিক ভাবে একাধিক প্রবন্ধ ও ‘মার্কিনে চারি মাস’ নামে ভ্রমণকথা লিখেছিলেন। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁর দুটি অপ্রকাশিত গান ১৩৩২ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ ও ভাদ্র সংখ্যায় মর্যাদার সঙ্গে মুদ্রিত হয় এই পত্রিকায়। গোষ্ঠী কেন্দ্রিকতার ঊর্ধ্বে যাওয়ার সদ্বিচ্ছা প্রথম থেকেই ছিল বলে দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যায় লেখা সম্ভব হয়েছিল —

              “আমাদের প্রতিজ্ঞা ছিল এই পত্রিকাকে কোনও দল বিশেষের বা সম্প্রদায় বিশেষের

              মুখপাত্র করিব না। সকল শ্রেণির চিন্তাশীল সুলেখকদিগকে স্বাধীনভাবে তাঁহাদের বিভিন্ন

              মতবাদ প্রকাশ করিতে অনুরোধ করিব।”

ধারাবাহিক এই নিরপেক্ষতা থাকার জন্য ওই সময়ে পাঠক সমাজে ‘বঙ্গবাণী’ বিশেষ সমাদর পেয়েছিল।

       আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘বঙ্গবাণী’র সরাসরি নিবিড় যোগ না থাকলেও তাঁর আন্তরিকতা, শিক্ষানুরাগ, কল্যাণকামী প্রেরণা, দীনেশচন্দ্র সেনের মতো পণ্ডিতের সহযোগিতা, সম্পাদক বিজয়চন্দ্র মজুমদারের নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা এবং রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হার্দিক প্রচেষ্টা — পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে অনুকূল হয়ে উঠেছিল। পাঠকের প্রত্যাশাও কিছু কম ছিল না। ‘বঙ্গবাণী’ তা পূরণ করতে পেরেছিল। বস্তুত মাত্র ক’ বছরের আয়ুষ্কালে এই পত্রিকা যে বিশুদ্ধ সাহিত্যধারা তৈরি করেছিল তা তুলনারহিত।