বাংলা রহস্যগল্পের আনন্দমেলায়

মায়ের ভাঁড়ার থেকে চুরি করে আনা আচারের স্বাদটা যেমন বরাবরই বেশি হয়, তেমনই পড়ার বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ার মজাটাই যেন একখানা গোটা অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ এনে দিত। ভূগোলের বড় ম্যাপবইয়ের আড়ালে আনন্দমেলা, শুকতারা, টিনটিন কমিকস, মায় ফেলুদা, শঙ্কু-রা পর্যন্ত দিব্যি ফিট করে যেতেন। নীলনদের গতিপথে রিভলবার হাতে অর্জুন ছুটে চলেছে দুর্ধর্ষ অপরাধীর পিছু পিছু। ছোট্ট গোগোল টপাটপ ক্রিমিনাল ধরে ফেলছে। কাকাবাবু আর সন্তু ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দিচ্ছে বাঘা বজ্জাতগুলোকে। খুব স্বাভাবিকভাবেই ঘন্টার পর ঘন্টা মন দিয়ে অ্যাটলাসের ম্যাপবই খুঁটিয়ে পড়তে দেখে মায়ের সন্দেহ ঘনীভূত হত। মিতিনমাসি সবেমাত্তর অনেক কষ্টে একখানা জব্বর ক্লু খুঁজে পেয়েছে, এমন মোক্ষম সময়ে হঠাৎ কানে একটা  ক্লকওয়াইজ মোচড়! সাধের গল্পের বইখানা বাজেয়াপ্ত তো হলই, সঙ্গে উপরি পাওনা কানমলা আর রামবকুনি। পরপর বেশ কয়েকদিন বইখানার আর পাত্তা মিলতো না। রান্নাঘরে ফ্রিজের মাথা, ঠাকুরঘরে গোপালের সিংহাসনের তলা, আলমারির শাড়ির ভাঁজের মতো সম্ভাব্য জায়গাগুলো খুঁজে খুঁজে হয়রান। তারপর হঠাৎই একদিন চোখে পড়ল ভরদুপুরে মৌরি চিবোতে চিবোতে মা একমনে পড়ে চলেছেন মিতিনমাসি! 

এবছরের বইমেলায় আনন্দ-র স্টলে চোখে পড়ল বেশ কয়েকদশক ধরে আনন্দমেলা ম্যাগাজিনের পাতায় আসা বিভিন্ন লেখকের রহস্যগল্পগুলোকে একত্রে এনে একটা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। দেখেই স্মৃতির ঝাঁপির ঢাকনাটা খুলে গেল আর ছোটবেলাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। সূচীপত্রে চোখ বোলাতে গিয়ে সেই কবেকার চেনা লেখকদের নাম খুঁজে পেলাম। গৌরাঙ্গপ্রসাদ বসু, হীরেন চট্টোপাধ্যায়, প্রতিভা বসু, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়— জমিয়ে রাখা পুরনো আনন্দমেলার হলদেটে হয়ে আসা পাতাগুলোয় আজও জ্বলজ্বল করছে নামগুলো। একমুহূর্ত দেরি না করে বইটি যে কিনে ফেলা হয়েছে, তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাড়ি ফিরে বইটা নিয়ে বসতে অবচেতন মনেই বড় ম্যাপবইটার দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছিলাম। না পেয়ে চোখ তুলে তাকাতে মনে পড়ল, আমার ছোটবেলার সেই ম্যাপবইটা তো কবেই ছিঁড়েখুঁড়ে পাতা ঝুরঝুরে হয়ে রিটায়ার করেছে পড়ার টেবিল থেকে। বছরকুড়ি বাদে আজ আর তাকে পাবো কোথায়! অবশ্য সে থাকলেও আজ আর তাকে প্রয়োজন হত না। এতবছর বাদে গল্পের বই পড়ার জন্য পড়ার বইয়ের আড়াল খোঁজার আর দরকার নেই। ছোটবেলায় বড় বেশি করে চাইতাম এই দিনটা। কিন্তু আজ মনটা একটু যেন মুষড়েই পড়ল। ওই যে বলেছিলাম, চুরি করে আচার খেলে সে আচারের স্বাদ বহুগুণে বেড়ে যায়। এই তত্ত্বটি অবশ্য সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের। আনন্দমেলাতেই পেয়েছিলাম তাঁর লেখা একটা ভূতের গল্প, সেখানে লেখকের একটি পোষা ভূত ছিল। সেই ভূত যখন তখন লেখককে উপদেশটুপদেশ দিত, মোটিভেট করত। সেই ভূতই একদিন বলেছিল, গরমের ছুটির দুপুরবেলায় অঙ্ক কষে বোকা-রা। এ সময় হচ্ছে আচার চুরির আদর্শ সময়। আমার লুকিয়ে গল্পের বই পড়ার দিনগুলো কবেই ফুরিয়েছে। যদি মা দেখে ফেলে, এই ভয়টুকুই যেন রহস্য গল্পের থ্রিলটুকুকে শতগুণে বাড়িয়ে ফেলত।  তাছাড়া আজ যে গল্পগুলো পড়ছি একজন গবেষকের চোখ দিয়ে। না চাইতেও গল্পের ন্যারেটিভ, গঠনশৈলীর মতো টেকনিকাল দিকগুলোর দিকে মন চলে যাচ্ছে। তবে এই গল্পগুলো কেন যে আট থেকে আশি সব্বার কাছে সমান লোভনীয়, তা খানিক পরেই মালুম হল। দু’চারটে গল্পের তুমুল সমালোচনা করে মনে মনে পোস্টমর্টেম চালানোর পর একসময় ক্ষান্ত দিতে হল। তারপর আর কিচ্ছুটি মনে নেই স্রেফ পাতার পর পাতা উলটে গেছি আর গোগ্রাসে গিলেছি প্রতিটা গল্প। 

শুরুতেই আছে গৌরাঙ্গপ্রসাদ বসু-র ‘গোয়েন্দার নাম গোগো’।  ক্লাস এইটের গোগো মনে মনে ভীষণভাবে চাইছে এমন একখানা দুর্দান্ত রহস্যময় কেস এসে পড়ুক, ঝটপট সলভ করে সে তার ছোটকা-কে টেক্কা দিয়ে দেবে! রহস্য এসেও পড়ল। শহরের একজন বড় হিরের ব্যবসাদার মিস্টার বিলমোরিয়ার বাড়িতে একজন খদ্দের একটি হিরে দেখাতে এনেছিলেন। আরও ভালো করে পরখ করার জন্য বিলমোরিয়া হিরেটি সে রাতের জন্য নিজের আলমারিতেই রাখেন। পরদিন সকালেই ফেরত দিতে হবে। এদিকে সকাল সকালই সে হিরে গায়েব। বাড়িতে আছে তাঁর স্ত্রী, বেয়ারা, খানসামা, ড্রাইভার এবং তিন তিনটি ভাইপো যাদের টাকার প্রয়োজন বড্ড বেশি। অকুস্থলে গিয়ে গোগো স্রেফ একটা পোড়া দেশলাই কাঠির ক্লু পেয়ে আপরাধীকে শনাক্ত করে ফেলল। গল্পের মধ্যে লুপহোল যথেষ্ট, অনেকটাই কাকতালীয়। তবে সেই ১৯৭৫ সালের নিরিখে এমন ঝরঝরে ভাষায় লেখা কিশোর গোয়েন্দা-কাহিনী অবশ্যই সুখপাঠ্য। 

আনন্দ বাগচী-র ‘জটাধরের জট’ ১৯৮৩-র গল্প। গুচ্ছ গুচ্ছ গোয়েন্দা-কাহিনী পড়ে জটা নিজেকে গোয়েন্দা ভাবতে শুরু করেছে। রেস্তোরাঁর টেবিলে সে একজন দাড়িওলা আর একজন ঢ্যাঙা ট্যারাচোখের লোকের কথোপকথন আড়ি পেতে শুনেছে। ‘যে রকম দেখে এসেছি, আজ রাতেই মার্ডারটা কমপ্লিট হয়ে যাবে। তারপর তো সব ছকমাফিক, টাইম নেবে না।’— এতদূর শুনেই জটা বুঝে ফেলেছে আজ রাতেই ঘটতে চলেছে ভয়ংকর একখানা খুন। রহস্য সমাধানের উত্তেজনা, বিপদের ঝুঁকি নিয়ে গভীর রাতে স্টিলের হান্টার হাতে জটা আর তার বন্ধু খুঁজে খুঁজে হাজির হল অকুস্থলে। বন্ধ ঘরে নিশ্চয়ই বন্দি হয়ে আছে হতভাগ্য মানুষটি, যাকে আজ ইহলীলা সংবরণ করতে হবে। তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ল জটা-রা। ভেতরে থাকা ভালোমানুষ গোছের লোকটি তখন কিছু লিখছিলেন প্রদীপের আলোয়। জটাদের দেখে ডাকাত ভেবে তিনলাফে তিনি খোলা দরজা দিয়ে ধাঁ। জটা এগিয়ে গিয়ে দেখল ভদ্রলোক আধা-অন্ধকারে লিখছিলেন উপন্যাস ‘খুনের পরে খুন’ এবং তিনি আর কেউ নন, জনপ্রিয় লেখক ভীমভবানী সেন!

সৈয়দ মুজতবা সিরাজের কর্নেল সিরিজ আজও সমান জনপ্রিয়। এই সংকলনে সিরিজের একটা গল্প রয়েছে, ‘কালো কুকুর’। কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে মাছ ধরতে গিয়ে জয়ন্ত পড়েছিল এক পাগল ট্যাক্সিডার্মিস্টের খপ্পরে। মনে পড়ল, ছোটবেলায় প্রথম ট্যাক্সিডার্মি-র কথা এই গল্পটা পড়েই জেনেছিলাম। তখন তো কথায় কথায় ফোন বের করে গুগল চেক করার সুবিধেটুকু ছিল না। পড়ার বইয়ের বাইরে যাবতীয় জেনারেল নলেজ আমার গল্পের বই আর ম্যাগাজিন পড়েই বাড়ত। সযত্নে সেসব ইনফো ডায়েরিতে নোট করে রাখতাম আর সুযোগমতো বন্ধুদের আড্ডায় সে বিদ্যে জাহির করে তাক লাগিয়ে দিতাম। গল্পে ট্যাক্সিডার্মিস্ট জনার্দন বকশি জয়ন্তর ছাল ছাড়িয়ে তাকে স্টাফ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। 

কিশোর রহস্য-কাহিনী সংকলনে গোগোল অনুপস্থিত থাকবে, তা হয় নাকি? সমরেশ বসু-র গোগোল সিরিজের একটা ছোটগল্প ঠিকই মজুত এখানে। তবে গোগোলের আরও অনেক ভালো গল্প ছিল। ‘জ্বরের ঘোরে শোনা’ গল্পটায় গোগোল বেচারি জ্বরে কাবু হয়ে ঘরবন্দি। ওপরের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা বেড়াতে গেছে। মওকা বুঝে ডাকাতদল ঢুকেছে সর্বস্ব চেঁচেপুছে নিয়ে যেতে। ওপর থেকে অনবরত খুটখাট আওয়াজ পেয়েই গোগোলের সন্দেহ, তারপর সে পুলিশকে জানায়। পুলিশের তৎপরতায় ডাকাতদল ধরা পড়ে। 

এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের গল্প ‘নাম-না-জানা-বন্ধু’ শোনায় শ্রীলঙ্কার ইতিহাস। গল্পের হিরো অবশ্য চারশো ক্যারেটের একপিস নীলা, ব্লু বেল অফ এশিয়া। তবে গল্পখানা রহস্যকাহিনীর চেয়ে ভ্রমণকাহিনী হিসেবে বেশি উপাদেয়। সিদ্ধার্থ ঘোষের ‘একটি জলবৎ রহস্য’ গল্পে অপরাধী লিফটের দরজার ফাঁকে আইসকিউব ঢুকিয়ে খাঁটি অ্যালিবাই তৈরির চেষ্টা করেছে। 

অদ্রীশ বর্ধনের ‘মিশরীয় জাহাজের রহস্য’ গল্পে চোরাচালানকারীদের আশ্চর্য বুদ্ধিকে টেক্কা দিয়েছে গোয়েন্দা ইন্দ্রনাথ। স্মাগলার মানিকচাঁদের নির্দেশমতো হতদরিদ্র শিল্পী বিশুবাবু চারহাজার ছশো বছরের পুরনো মিশরীয় জাহাজের রেপ্লিকা বানাতেন। ফুটতিনেক লম্বা, সাদা জাহাজ। দাঁড়, কেবিনঘর মিলিয়ে অবিকল আসল জাহাজের এক মিনি সংস্করণ। নিপুণ কায়দায় জাহাজের ভেতরে বানিয়ে দিতেন চোরা সুড়ঙ্গ, ঠিক যেমনটা ছিল আসল মিশরীয় জাহাজে। কিন্তু তিনি ঘূণাক্ষরেও টের পাননি তাঁর এই অদ্ভুত সুন্দর সৃষ্টিগুলি কি সাংঘাতিক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। মানিকচাঁদের হুকুমমতো কেবিনঘরের জানলায় বসানো হত রংবেরঙের কাচ। সে কাচ ওড়িশার খনি থেকে বেআইনিভাবে তোলা ব্লু ডায়মন্ড! শুধু এই নয়, জাহাজের চোরা সুড়ঙ্গে কোটি টাকার ড্রাগসও ভরে চালান দিত মানিকচাঁদেরা। 

ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘অম্বর রহস্য’ গল্পে খুনের পর খুন, যমজ বোনের রহস্য, অপরাধীর পেছনে ধাওয়া— কি নেই! 

আশাপূর্ণা দেবীর ‘মাত্র একখানা থান ইট’ গল্পে ছাদ থেকে অসাবধানতাবশত একখানা ইট ফেলে দেয় বঙ্কু আর সেটা গিয়ে পড়ে তার প্রতিবেশী জেঠুর টাকে। জেঠু অক্কা পেয়েছেন নিশ্চিত ধরে নিয়েই বঙ্কু ফেরার হয়। অল্পদিনেই তার সাথে রাস্তার পাগল ভিখারির আর কোনও তফাত থাকে না। সর্বক্ষণ সে ভয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। গল্পের শেষে অবশ্য জানা যায়, জেঠু থানইটের আঘাত হজম করে দিব্যি বেঁচেবর্তে আছেন এবং আদরের বিবাগী বঙ্কুকে ফিরে পাওয়ার জন্য মানত করছেন, এদিক সেদিক পুজো দিচ্ছেন। ঘটনাচক্রে দুজনের মোলাকাতও হয়, বঙ্কুও জেঠুর সঙ্গে ঘরে ফেরে। 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কঠিন শাস্তি’ গল্পে দেখা পাই আদ্যন্ত খারাপ একটা মানুষের। রাস্তাঘাটে ছোট ছেলেপুলেদের গায়ে অকারণে হাত তোলে। লোক ঠকানো, খুন তার কাছে জলভাত। কিন্তু অমন লোকেরও দুর্বলতা রয়েছে, তার ফুটফুটে দুই সন্তান। গল্পের হিরো টিটো আর পাপান-কে একদিন লোকটা অভ্যেসবশত রাস্তার মাঝে বিনা কারণেই তুমুল অপমান করেছিল। শাস্তি দিতে ছেলেদুটি তাকে ফলো করতে শুরু করে। এক এক করে তার কুকীর্তিগুলোর খবর জানার সঙ্গে তার দুর্বলতার দিকটিও তারা জেনে ফেলে। চাইলেই টিটো আর পাপান তাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু দুষ্টু লোকটা যে একজন বাবা আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, বাবা হিসেবে সে যে একেবারে দশে দশ! সুতরাং, শাস্তি হিসেবে অন্যপথ ধরতে হল। তাকে ডেকে এনে সরাসরি বলা হল, অন্যায়ের রাস্তা এই মুহূর্তে ছেড়ে না দিলে তার ছেলেদুটিকে সবকিছু বলে দেওয়া হবে। আর অবাক কাণ্ড, অমন ধুরন্ধর লোকটি পেল সাংঘাতিক ভয়। ঝরঝরিয়ে কেঁদে সে প্রমিস করল আর কক্ষণও সে কোনও অন্যায় করবে না। 

যে জঁরই হোক, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে বাদ রেখে কোনও সংকলন হতে পারে নাকি! তাঁর বিখ্যাত ‘ফটিকের কেরামতি’ গল্পটা বহু জায়গায় পড়েছি। কিন্তু এর জন্মভূমি যে আনন্দমেলার পাতা, সেইটি জানা ছিল না। ১৯৯৩-তে গল্পটি ছাপা হয় আনন্দমেলায়। গ্রামের এক এলেবেলে চোর ফটিক। সে না পারে করতে ঠিকমতো চুরি, না জানে কোনও ভদ্রগোছের কাজ। একদিন গভীর রাতে একজন আগন্তুক তাকে দিয়ে গেল একটা গুলিভরা পিস্তল ও পাঁচশো টাকা। গ্রামের একজন মান্যগণ্য মানুষ বঙ্কুবাবু। তাঁর মেয়ের বিয়ের রাতে লোকজনের ভিড়ে, বাজি-পটকার আওয়াজে চুপিসারে তাঁকে খুন করতে হবে। কাজ ঠিকমতো উতরে গেলেই আরও পাঁচশো টাকা জুটবে। আর না পারলে ফটিককেই তার পৈতৃক প্রাণটা নমো নমো করে ত্যাগ করতে হবে। ফটিক বেচারা পড়ল অথই জলে। ভয়ে, দুশ্চিন্তায় সে আধমরা। সিঁধকাঠিটাই সে ঠিকমতো চালাতে শেখেনি, তার হাতে কিনা পিস্তল! প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সে নেমে পড়ল গোয়েন্দাগিরিতে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ সবই পারে। পাকা গোয়েন্দার মতোই ফটিক চোর খুঁজে বার করল কে আছে এই শয়তানি ফন্দির পেছনে। তারপর নিজে তো বাঁচলই, সঙ্গে বঙ্কুবাবুর ক্ষতি করতে চাওয়া তারই জামাই বাবাজীবনের মুখোশখানা দিল খুলে। 

সমরেশ মজুমদারের অর্জুনের সঙ্গে পরিচয় আনন্দমেলার পাতা ধরেই। প্রত্যেক পুজোবার্ষিকীতে অর্জুনের বড় একটা উপন্যাস থাকতই। তবে কয়েকদশক আগে অর্জুনের কিছু ছোটগল্পও যে আনন্দমেলায় বেরিয়েছিল, তা বোঝা গেল সংকলনের সূচীপত্র দেখে। ‘লাখ টাকার পাথর’, ‘অর্জুন হতভম্ব’, ‘আমি অর্জুন’— মোট তিনটি ছোটগল্প আছে এই সিরিজের। ‘লাখ টাকার পাথর’ গল্পে সদ্যবিধবা স্ত্রী আঁচ করতে পেরেছিলেন তাঁর স্বামীর দামী পাথরখানার মালিকানা নিয়ে বিসদৃশরকম বিবাদ ঘটতে চলেছে তাঁর তিন গুণধর পুত্রের মধ্যে। তাই সবার অলক্ষ্যে স্বামীর মৃতদেহ থেকে পাথরখানা খুলে নিয়ে ঢুকিয়ে দেন তাঁর মুখের ভেতরে। আঙুল চালিয়ে ঠেলে দেন আরও ভেতরে। গলার নলিতে গিয়ে আটকে যায় সে পাথর। চেয়েছিলেন, মৃতদেহের সঙ্গে যেন পাথরটাও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কিশোর মনের তুলনায় এ গল্পটা যথেষ্ট ডার্ক। ‘অর্জুন হতভম্ব’ গল্পে অর্জুনকে শিখণ্ডীর মতো ব্যবহার করেছে একজন পাতিচোর। একটা প্রাচীন মূর্তিচুরি করে সন্দেহের তীর ঘুরিয়ে দিয়েছে সম্পূর্ণ অন্যদিকে। অর্জুন যতক্ষণে ব্যাপারখানা বুঝে উঠতে পেরেছে, ততক্ষণে পাখি উড়ে গেছে। অর্জুনকে আর কোনও গল্পে এমন বোকা বনতে দেখা গেছে বলে তো মনে পড়ে না। ‘আমি অর্জুন’ গল্পে একজন ফোটোগ্রাফার দৈবক্রমে তুলে ফেলেন একটি মার্ডারের কিছু দৃশ্য। তারপর যথারীতি তার পেছনে লাগে গুণ্ডার দল। এ গল্প একখানা জমজমাট থ্রিলার উপন্যাস হবার জন্য যথোপযুক্ত ছিল। ছোটগল্পে কেমন যেন মন ভরল না। 

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘কিস্তিমাত’ গল্পে গোয়েন্দা নয়, স্বয়ং মিলিটারি এসে হাজির হয়েছে। সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে বিপত্তির সূত্রপাত। কিডন্যাপ, গুমখুনের আশংকা আর সঙ্গে মধুরেণ সমাপয়েৎ হিসেবে চিলতে একটু রোমান্সের আভাস। 

বিমল করের ম্যাজিশিয়ান গোয়েন্দা কিকিরা-ও এসেছেন। ‘কৃষ্ণধাম কথা’ গল্পে একজন বৃদ্ধ খানিকটা অভিমান ও অনেকটা অসৎ ছেলেকে শিক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায়ে নিজেই নিজের সুইসাইড সাজান ও লুকিয়ে অন্যত্র বসে থাকেন। 

রূপক সাহা-র ‘মহারাজের হিরের আংটি’ গল্পে স্রেফ ঈর্ষাবশত একজন লুকিয়ে ফেলে একটি হিরের আংটি। এখানে অবশ্য গোয়েন্দার চোখ নয়, কাজে লেগেছে ভিসিআর যন্ত্রটি। 

আবুল বাশারের ‘আজব গোয়েন্দার দেশে’ গল্পটি নিয়ে যায় সেই প্রাচীন সময়ের প্রেক্ষাপটে, যখন বাটি চেলে অপরাধী ধরা হত। গল্পটি পড়লে বোঝা যায়, গ্রামেগঞ্জে জনপ্রিয় এই কায়দাটি যাঁরা জানতেন, তাঁদের ছিল আসলে সত্যান্বেষীর চোখ, আর গ্রাম্য মানুষজনের বিশ্বাস ও সম্ভ্রম আদায় করতে দেখাতেন বাটিচালার ম্যাজিক। 

সংকলনে মিতিনমাসির অভাবটা বড় বেশি স্পষ্ট। তবে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের একটি অন্য গল্প ঠিকই রয়েছে— ‘চারুহাসিনীর দেওয়াল-সিন্দুক’। ছেলে-বউমা-নাতি-নাতনী সব্বাই থাকা সত্ত্বেও বৃদ্ধা  চারুহাসিনীকে একলাটি চলে যেতে হয়। মারা যাওয়ার আগে সব সম্পত্তি তিনি অনাথআশ্রমের নামে দান করে যান। স্বার্থপর সন্তানদের একটু জব্দ করার উদ্দেশ্যে দেওয়াল-সিন্দুকে দিয়ে যান কম্বিনেশন লক আর ক্লু দিয়ে যান চিঠিতে। 

পেশাদারী জীবনে একটুআধটু স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা  থাকা ভালো। কিন্তু যখন সে রেষারেষি ব্যক্তিগত জীবন বিষিয়ে তোলে, তখন যে তা বড়ই ভয়ংকর। ঋতা বসু-র ‘দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ’ গল্পে রয়েছে তিনজন বন্ধুর কথা। তিনজনের একজন টিভি স্টার, অপরজন ফিল্ম স্টার। দুজনেই জানে মনে মনে যে তারা একে অপরের শত্রু, অথচ মুখে মিষ্টি হাসিটুকু বজায় রেখে বন্ধুত্বের অভিনয় করে চলেছে বছরের পর বছর। একদিন সুযোগ বুঝে টিভি স্টার বন্ধুটি গাপ করল ফিল্মস্টার বন্ধুটির পয়া একটি দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ। চোর কে জানা আছে অথচ কোনওমতেই লোককে জানানো চলবে না। স্রেফ চোরের ওপর বাটপাড়ি করে চোরাই মাল ঘরে ফিরিয়ে আনতে হবে। এই কঠিন চ্যালেঞ্জটাই নেয় তৃতীয় বন্ধুটি। অজস্র রহস্যের গোলকধাঁধা পেরিয়ে শেষমেশ শঙ্খটি সে ফিরিয়ে দিতে পারে তার যথার্থ মালিককে। 

অনির্বাণ বসু-র ‘দেবতার হাত’ গল্পটা পড়তে বসে বারবার মনে হচ্ছিল যেন কোনও ফ্যান ফিকশন পড়ছি। আসলে এ গল্পের গোয়েন্দা আকিদার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার বড় বেশি মিল। ফেলুদা-তোপসে জুটির মতো এখানেও রয়েছে আকিদা-বোড়ে জুটি। ফেলুদা হল তোপসের কাজিন। আর বোড়ে-র বাবা হল আকিদার মামা।  তপেশরঞ্জনকে কাটছাঁট করে ফেলুদা ‘তোপসে’ বানিয়েছিল। বোড়ে-র নাম আসলে জুনো। আকিদা সর্বক্ষণ ফেলুদার কায়দায় জুনোকে ডমিনেট করার চেষ্টা করে। ফেলুদা যেমন গাড়িপাগল, আকিদাও তেমনই একই নেশায় মজে আছে। তার আদবকায়দা, সকালে উঠে শরীরচর্চা সবেতেই যেন ফেলুদারই ছায়া। বাঙালি সাহেববাড়ির অন্দরমহল, মিশরীয় দেবতার রেফারেন্স, খুচরো জেনারেল নলেজ দেওয়ার টেকনিক, ভাষাশৈলী— সত্যজিৎ রায়ের ছোঁয়া গল্পের পরতে পরতে। 

সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মধুরা নিরুদ্দেশ’ আনন্দমেলার কিশোর-কিশোরীদের জন্য বড় বেশি প্রয়োজনীয় গল্প। স্কুলের মেয়েদের কিডন্যাপ করে বিদেশে পাচার করার গ্যাং তুলে নিয়ে যায় ক্লাস নাইনের মধুরা-কে। উপস্থিত বুদ্ধির জোরে মধুরা নিজেকে বাঁচায় ও সেইসঙ্গে আরও তিনটি মেয়েও বেঁচে যায়। 

সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প ‘আর একটু হলে’—তে পুলিশ চিত্তদারোগা মোটেই পছন্দ করেন না গোয়েন্দা তারাচরণ-কে। পুলিশের কাজ পুলিশ করবে, মাঝখান থেকে ক্রেডিট নিয়ে যাবে গেঁয়ো গোয়েন্দা তারাচরণ? কভি নেহি। অথচ তারাচরণের রয়েছে দিব্যি গোয়েন্দাসুলভ ইনস্টিংক্ট। ছদ্মবেশী চিত্তদারোগাকেও সে নিমেষে চিনে ফেলার ক্ষমতা রাখে। একদিন এই গেঁয়ো গোয়েন্দাই দারোগাবাবুর প্রাণটা বাঁচায়। গল্পের শেষে মনে মনে হলেও চিত্তদারোগা তাকে ‘গোয়েন্দা’ বলে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন। 

বইয়ের শেষ পাতায় পৌঁছনোর পর বুঝলাম, আমার বাজেয়াপ্ত আনন্দমেলাদের কেন প্রতিবারই আমি মায়ের ড্রয়ার থেকেই খুঁজে পেতাম। এতগুলো বছর পরেও আনন্দমেলার আকর্ষণ আমার কাছে বিন্দুমাত্র কমেনি। আমার মা’ও যে আনন্দমেলার ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এও যেন এক রহস্যের উন্মোচন। সেই ১৯৭৫ সালে আনন্দমেলার প্রথম আত্মপ্রকাশ। অজস্র রহস্য গল্প লেখা হয়েছে, হচ্ছে। এই সংকলনে ১৯৭৫ থেকে ২০১১-র মধ্যে লেখা পঁয়ত্রিশজন নামজাদা লেখকের গল্প একত্রে আনা হয়েছে। কাজটা মোটেই সহজ নয়। তবে আরও যে অসাধারণ গল্পগুলো বাদ থেকে গেছে, আশা করা যায় সম্পাদক পৌলমী সেনগুপ্ত পরের সংকলনে তাদের রাখার কথা ভাবছেন। 

তথ্যসূত্র -

আনন্দমেলা রহস্য গল্পসংকলন, সম্পাদনা পৌলমী সেনগুপ্ত