উপন্যাসের আদিকথা : সার্ভেন্তেসের দন কিহোতে
- 07 April, 2024
- লেখক: সৌভিক ঘোষাল
১
ড্যানিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রুশো (১৭১৯) থেকেই ইংরাজী উপন্যাসের শুরু না আরো পিছিয়ে গিয়ে বানিয়ানের পিলগ্রিমস প্রোগ্রেস (১৬৭৮) থেকে এই ইতিহাস আরম্ভ করা দরকার - সেই নিয়ে বহু আলোচনা, বিতর্ক এর মধ্যেই হয়ে গেছে। তবে ইউরোপীয় তথা বিশ্ব সাহিত্যে আধুনিক উপন্যাসের সাড়া জাগানো শুরুটা যে ১৬০৫ খ্রীষ্টাব্দে সার্ভেন্তেসের দন কিহোতের মধ্যে দিয়েই হয়, সে সম্পর্কে সন্দেহ কম।
দন কিহোতে (ইংরাজীর দৌলতে ডন কুইক্সোট বলেই যাকে কিশোরপাঠ্য সংস্করণে চিনতাম আমরা) যখন লিখছেন সার্ভেন্তেস, তখনও উপন্যাস নামের এই আধুনিক সাহিত্য প্রকরণটি বিশ্বসাহিত্যে জন্ম নেয় নি। বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসেবে দন কিহোতের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিঃসন্দেহে অপরিসীম, কিন্তু শুধু এরকম কোনও ঐতিহাসিক কারণই দন কিহোতের খ্যাতির মুখ্য ব্যাপার নয়। বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্লাসিক হয়ে ওঠা এই বইটির জনপ্রিয়তা ও বিশিষ্টতার নানা কারণ আছে। সে সব কথায় আসার আগে এই উপন্যাস লেখার সময়ে স্পেনের অবস্থাটা কেমন ছিল সে কথা একটু সেরে নেওয়া যাক।
২
১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দে ভারতে আসতে গিয়ে পথ ভুল করে কলম্বাস পৌঁছে গেলেন আমেরিকায়। তারপর থেকেই স্পেনের উপনিবেশ হয়ে দাঁড়াল এই অঞ্চল। সেখান থেকে মানুষজন আর ক্রীতদাস আসতে শুরু করল স্পেনে। শোষণের মধ্যে দিয়ে দ্রুত ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকল স্পেন।
এরই উল্টোদিকে তুর্কী মুসলিমদের সাথে তখন স্পেন নিয়মিত যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত। এই দুই বিপরীত পরিস্থিতির টানাপোড়েন চলেছে গোটা ষোড়শ শতক জুড়ে। আর এই শতকের দ্বিতীয় অর্ধে তাকে ঘনিষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন সার্ভেন্তেস। স্পেনের ঔপনিবেশিক লুন্ঠনের প্রসাদ তিনি অবশ্য পান নি, জীবিকার জন্য তাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে সব সময়েই। কিন্তু তুর্কীদের সাথে যুদ্ধের বিষময় অভিজ্ঞতা তাঁকে পেতে হয়েছিল যুদ্ধবন্দী হিসেবে। বিদেশে কারাগারে অশেষ কষ্ট ভোগ করেছেন বছরের পর বছর। অর্থের বিনিময়ে সেই বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ট্যাক্স কালেক্টর হিসেবে বাঁচতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেখানেও আসে ভাগ্য বিড়ম্বনা। আবার তাকে জেলে যেতে হয়। এই দ্বিতীয় কারাবাস পর্বেই তাঁর দন কিহোতে লেখার সূত্রপাত।
সার্ভেন্তেস অল্প বয়স থেকেই খ্যাতিমান লেখক হতে চেয়েছিলেন। একসময় নাটক লিখে জনপ্রিয়তাও পেয়েছিলেন। কিন্তু তারপর প্রতিদ্বন্দ্বী নাট্যকারদের ছায়ায় হারিয়ে যান কিছুটা। বেশ কিছু কবিতাও লিখেছিলেন। কিন্তু শিল্পীর অমরত্ব তিনি পেয়েছেন শেষজীবনে লেখা দন কিহোতের মধ্যে দিয়েই। ১৬০৫ এ এই বইয়ের প্রথম খণ্ড বেরিয়েছিল। আর ১৬১৫ তে বেরোয় এই বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড। তাঁর মৃত্যুর ঠিক একবছর আগে। মনে করা হয় ১৬১৬ সালে একই দিনে চলে গিয়েছিলেন বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুই নক্ষত্র – শেক্সপীয়র ও সার্ভেন্তেস।
৩
দন কিহোতে কেন অনন্য নানাজনে নানাভাবে তাঁর উত্তর দিয়েছেন। সমালোচক বা সাহিত্যের অধ্যাপকরা এই বই নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করে গেছেন স্বাভাবিকভাবেই, কিন্তু তাঁর এই লেখা সৃজন জগতের মানুষজনকেও বারবার কলম ধরতে বাধ্য করেছে। বিশিষ্ট ঔপন্যাসিকদের অনেকেই দন কিহোতেকে আধুনিক আখ্যানের জনক বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন, সার্ভেন্তেসকে লেখকদের লেখক বলে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
সার্ভেন্তেস বিদগ্ধ পাঠক মহলে যেমন জনপ্রিয়, তেমনি আম জনতারও প্রিয় লেখক। দন কিহোতের কাহিনীর সংক্ষিপ্ত কিশোর পাঠ্য সংস্করণগুলি দেশ ভাষা নিরপেক্ষভাবে গত চারশো বছর ধরে কোটি কোটি শিশু কিশোরের মনোরঞ্জন করে আসছে। তারা সেখানে গল্পের আশ্চর্য জগৎকে খুঁজে পেয়ে আকৃষ্ট হয়েছে। আবার সেই কিশোর পাঠকই পরবর্তীকালে মূল উপন্যাসের মধ্যে জগৎ ও জীবনের কিছু মৌলিক দিককে আবিস্কার করেছে পরম মুগ্ধতায়।
দন কিহোতে উপন্যাসের পাঠকেরা জানেন এই উপন্যাসের টেক্সট এর মধ্যে আরো নানা টেক্সট প্রায়শই ঢুকে পড়ে। দন কিহোতে চরিত্রটিই তো নাইটদের বীরত্বপূর্ণ নানা কল্প কাহিনীর এক নতুন জীবন্ত সংস্করণ হয়ে উঠতে চায়। অজস্র শিভালরিক রোমান্স দন কিহোতে পড়েছেন। কিন্তু অন্য সকলে সেই কাহিনীর জগৎ থেকে যখন শুধু গল্পরসটুকু খুঁজে নেন, দন কিহোতে হয়ে ওঠেন সেই টেক্সটগুলির নায়কদের অদ্ভুত প্রতিরূপ। কল্পনার আশ্চর্য রঙ মিশিয়ে এই হয়ে ওঠা নাইটটি চারপাশের বাস্তব জগতের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বারবার উপহাস্যস্পদ, বিড়ম্বিত, লাঞ্ছিত হতে থাকেন, তবু দ্বিতীয় খণ্ডের অন্তিম অধ্যায়ে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত নিজের বানিয়ে তোলা জগৎ থেকে একবিন্দু সরতে রাজী হন না। উইন্ড মিলকে দৈত্য ভেবে এগিয়ে গিয়ে নাস্তানাবুদ হওয়া থেকে শুরু করে সরাইখানাকে দুর্গ ভাবা বা একপাল মেষশাবককে শত্রুসৈন্য ভেবে ফেলা – দন কিহোতের নিজস্ব কল্পনার জগৎ বাস্তব দুনিয়ার সঙ্গে বারবার সংঘাতে আসে। তার বিশ্বস্ত অনুচর সাঙ্কো পাঞ্জা বারবার তাকে বোঝাতে যায় ভুলের কথা, তিনি নিজে বারবার মারাত্মকভাবে প্রহৃত ও আহত হন – তবু কল্পভুবনকে কিছুতেই কল্পজগৎ বলে বিশ্বাস করেন না।
উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের প্রথম পরিচ্ছেদে দন কিহোতের জীবন ও ভাবনাকে পাঠকের সামনে কীভাবে তুলে ধরেছেন সার্ভেন্তেস দেখা যাক – “আমাদের এই ভদ্রলোকটির সারা বছর প্রায় কিছুই করার থাকত না। তিনি ভ্রাম্যমাণ নাইটদের সম্পর্কে লেখা উপাখ্যান অত্যন্ত মনযোগ সহকারে পড়ে সময় কাটাতেন। পড়ে তিনি এত মজা পেতেন যে শেষমেষ পাড়াগেঁয়ে ফুর্তিফার্তা একরকম ছেড়েই দিলেন, এমনকি নিজের ভূসম্পত্তির তদারকি পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, এ জাতীয় বিনোদনে আত্মহারা হয়ে এ ধরনের বই কেনার জন্য তিনি একর একর আবাদি জমি বেচে দেন”।
সার্ভেন্তেস আমাদের জানান যে তাঁর আখ্যানের এই চরিত্রটি এসব রোমানস পড়তে এমনই ব্যস্ত যে, রাতে পড়া শুরু করলে ভোর হয়ে যেত, আর দিনে শুরু করলে রাত আসত ঘনিয়ে। পড়তেন বেশি, ঘুমোতেন সামান্যই। ফলে বুদ্ধিশুদ্ধি গুলিয়ে গেল, যুক্তির খেই ফেললেন হারিয়ে। বইয়ের পাতার এলোমেলো ধারনার দুনিয়াটা দখল করল তাঁর কল্পনাকে। মায়াবী আকর্ষণ, বিবাদ, যুদ্ধ, দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান, অস্ত্রক্ষত, অভিযোগ, প্রেম, উৎপীড়ন, দেদার আজগুবি আর অসম্ভবে ঠাসা ছিল তাঁর মগজ। এত বেশি মাত্রায় যে, তাঁর পড়া সমস্ত অবাস্তব আর উদ্ভট কাহিনীই তাঁর নির্ভরযোগ্য ইতিহাসের মতো প্রামাণিক বলে মনে হত।
দন কিহোতে ক্রমশই তাঁর বোধবুদ্ধি খুইয়ে ফেলেন। তাঁর মাথায় ভর করে উভট সব কল্পনা, যা বলতে গেলে ছিল পাগলামিরই নামান্তর। তিনি ভাবলেন নিজের মর্যাদা বৃদ্ধি আর জনগণের সেবা – এই দুই কাজের জন্যই সবচেয়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে ভ্রাম্যমাণ নাইটে রূপান্তরিত হওয়া। মাথা থেকে পা পর্যন্ত নানা অস্ত্রশস্ত্র আর বর্মে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধের ঘোড়ায় চড়ে অভিযানের খোঁজে সারা দুনিয়া চষে বেড়ানোর স্বপ্ন তাঁর মাথায় ঘুরতে শুরু করে।
দন কিহোতে হাতের কাছে পাওয়া জিনিসপত্র নিয়েই কাজ শুরু করে দেন। দীর্ঘকাল ঘরের কোণে পড়ে থেকে থেকে তাঁর প্রপিতামহের বর্ম, শিরস্ত্রাণ ইত্যাদিতে মরচে পড়ে গিয়েছিল। সেইসব তিনি যতটা পারলেন সাফ সুতরো করলেন। শিরস্ত্রাণের ভাঙা জায়গায় লাগিয়ে নিলেন কার্ডবোর্ড। তরবারি আঘাত তা কতটা সইতে পারবে, নিজেই তা পরীক্ষা করলেন। এক কোপে যথারীতি কার্ডবোর্ড উড়ে গেল, তারপর তিনি সেখানে কার্ডবোর্ডের সঙ্গে লাগালেন লোহার পাতলা পাত, তবে আর পরীক্ষা করে দেখলেন না এ কতটা মজবুত হল।
নাইটের উপযুক্ত ভালো ঘোড়া তাঁর ছিল না। দন কিহোতেকে বাধ্য হয়ে বেছে নিতে হল বুড়ো বেতো আর হাড় জিরজিরে এক ঘোড়াকেই। তবে প্রভুর পেশা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার নাম পালটে নতুন খেতাব দেওয়ার প্রয়োজন পড়ল। অনেক মাথা ঘামিয়ে শেষমেষ যে নামটি মনে ধরল, সেই রোজিনানতে নামেই এরপর থেকে তিনি তাঁর বহুকালের পুরনো ঘোড়াটিকে ডাকতে আরম্ভ করলেন। তবে ঘোড়ার নতুন নাম বেছেই কাজ ফুরোল না। নতুন পেশার উপযোগী নিজেরও এক নতুন নামকরণ দরকার হয়ে পড়ল। দন কিহোতে দ্য লা মাংকার মতো একটা গালভারি নাম স্থির করলেন নিজের জন্য।
এরপরে দরকার পড়ল এক কল্পিত প্রেমিকার। প্রেমিকা ছাড়া নাইট হওয়া ঠিক মানায় না। প্রেমিকা না থাকলে তিনি যে দৈত্যদের পরাভূত করবেন, তারা কার পায়ে গিয়ে পড়বে ? অতএব অনেক খুঁজে পেতে বাড়ির কাছের এক পল্লীবালিকাকে মনের মানুষ হিসেবে দন কিহোতে নির্ধারণ করলেন। কিন্তু তার আলদোনজা নামটিকে নাইটের প্রেয়সী সুলভ করে তোলার দরকার পড়ল। পরিবর্তিত নাম দাঁড়াল দালসিনিয়া দেল তোবোসো। এরপর ঘোড়ার পিঠে চড়ে দন কিহোতে চললেন তাঁর বিচিত্র সব অভিযানে। পরে একজন অনুচর না থাকলে নাইটকে মানায় না বলে সাঙ্কো পাঞ্জাকে তাঁর অভিযানে যুক্ত করে নিলেন সম্পদের নানা লোভ দেখিয়ে। দন কিহোতের এপিসোডিক গঠনে এরপর নানা মজার ঘটনাক্রম আমরা একের পর এক প্রত্যক্ষ করতে থাকি।
তবে দন কিহোতে চরিত্র সৃজনের আশ্চর্য রসায়ন এখানেই যে এতকিছুর পরেও ্তিনি আমাদের চোখে ক্লাউন হয়ে ওঠেন না, ভিলেন তো নয় ই; বরং খুব আশ্চর্য ধরনের এক নায়কই থেকে যান। তাঁর আশ্চর্য কাণ্ডকারখানা দেখে পাঠক মজা পান আবার তাঁকে নিয়ে কৌতূহলীও হয়ে ওঠেন। কৌতূহলের চেয়েও বড় কথা দন কিহোতের জন্য আমাদের এক ধরনের বেদনাবোধ ও ভালোবাসা মিশে থাকে। এই ভালোবাসা কি এই কারণে, যে দন কিহোতে এক উচ্চ আদর্শ তৈরি করে নিয়েছিলেন তার ভ্রাম্যমাণ নাইট জীবনে, যেখানে তিনি সব অন্যায় অবিচারের প্রতিরোধে ছুটে যান ? নাকি আমরা যে কল্পজগতে কখনো বেশিক্ষণ বিচরণের সাহসই দেখাতে পারি না, এক আশ্চর্য জগতের বাসিন্দা হয়ে সেখানেই তাঁর থেকে যাবার অবিশ্বাস্য এক দৃঢ়তার জন্য ?
৪
দন কিহোতের উপ আখ্যানগুলির আকর্ষণও কম কিছু নয়। যেমন কার্দেনিও – লুসিন্দা – ফের্নান্দো – দরোতেয়ার প্রেম বিশ্বাসঘাতকতা ও বিরহের আখ্যানটি। বা তার পরেই আনসেলমো – কামিলা – লোতারিওর কাহিনীটি। প্রথম কাহিনীর চরিত্রগুলির মুখোমুখি হয়েছিল সাঙ্কো পাঞ্জা সহ অন্যরা কিন্তু দ্বিতীয়টি পাদ্রীর পড়ে শোনানো এক আখ্যান – “কৌতূহলী বেয়াদবের উপন্যাস”। প্রথম খণ্ডের একেবারে শেষের দিকে ৫১ নং অধ্যায়ে মেষপালক এউহেনিওর বলা গল্পে এউহেনিও, আনসেলমো – লেয়ান্দ্রা – ভিসেন্তে দে লা রোসার কথা শুনি আমরা।
৫
টেক্সট উইথ ইন এ টেক্সট বা পাঠের মধ্যে পাঠ দন কিহোতে উপন্যাসের একটা বড় ব্যাপার। বস্তুতপক্ষে বিভিন্ন শিভালরি সংক্রান্ত নাইটদের আখ্যানই দন কিহোতের মনোজগৎ টি গড়ে তুলেছিল এবং শুধু মনোজগতেই আর তা সীমাবদ্ধ থাকে নি, তাকেই এক বাস্তব দুনিয়া ভেবে অভিযানে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি।
বস্তুতপক্ষে দন কিহোতের মূল কাহিনীটির মধ্যে বিভিন্ন টেক্সট বারবার উল্লিখিত হয়। দন কিহোতে তার প্রথম অভিযানে আহত হয়ে বাড়ি ফেরার পরেই আমরা দেখি তার নিজস্ব গ্রন্থাগার ছানবিন করছেন এলাকার পাদ্রী। (৬ নং অধ্যায়)। তার উৎসাহী সঙ্গী দন কিহোতের আত্মীয় ও ভৃত্যরাও। তারা সবাই মনে করে এই গ্রন্থগুলিই সব সর্বনাশের জন্য দায়ী এবং আগুনে পুড়িয়ে দেওয়াই এগুলির একমাত্র সদগতি করতে পারে। অসংখ্য বইকে কোতল করা হয় এবং নামমাত্র কয়েকটি অগ্নিশিখা থেকে রক্ষা পায়। এর পরেও পাদ্রীকে আরেকবার গ্রন্থ ভষ্ম কর্মসূচী বিষয়ে উৎসাহী দেখা যায়, কিন্তু সেবার সরাইখানার মালিক তার বইগুলিকে পুড়িয়ে ফেলার এই অভিপ্রায়কে মোটেই সমর্থন দেন না। সরাইখানার মালিকও শিভালরি রোম্যান্সগুলি পড়তে ভালোবাসেন, তবে দন কিহোতের সাথে তার পার্থক্য হল তিনি এগুলিকে চিত্তরঞ্জনের উপাদান হিসেবেই দেখেন, জীবনের বাস্তবতার সাথে তাকে মিলিয়ে ফেলেন না। পাঠ (টেক্সট) ও বাস্তব জীবনের অন্তর্বতী টেনশন দন কিহোতে আখ্যানের অন্যতম প্রধান দিক।
উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের একেবারে শেষদিকে ৪৭ ও ৪৮ নং পরিচ্ছেদে যাজক ও পাদ্রী দন কিহোতের অসুস্থতা প্রসঙ্গে শিভালরিক রোমান্সগুলি নিয়ে কথা শুরু করেন এবং এই সমস্ত বইয়ের নানা বৈশিষ্ট্য তাদের আলোচনায় উঠে আসে। ৪৯ নং অধ্যায়ে যাজক দন কিহোতেকে কোন ধরনের বই পড়া উচিত আর কোন ধরনের বই পরিত্যাজ্য সে বিষয়ে উদাহরণ সহ আলোচনা করেন। কল্পিত রোমান্সের পরিবর্তে ইতিহাস বিখ্যাত বীরদের সম্পর্কে পড়ার উপদেশ দেন যাজক।
দুই খণ্ডের বিপুল আয়োজন যে পাঠের জগৎকে ঘিরে, দ্বিতীয় খণ্ডের শেষে সেই পাঠের জগৎটিকে নিজেই ভেঙে দেন দন কিহোতে। উইল করে জানিয়ে যান শেষ ইচ্ছে। তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী এইসব পড়তে পারবে না। অলীক থেকে বাস্তবের দিকে, রোমান্স থেকে আধুনিক নভেলের দিকে শুরু হয় আখ্যানের যাত্রা। সার্ভেন্তেসের দন কিহোতের হাত ধরে।