জেন অস্টেনের চিঠিপত্র

টেলিফোন, টেলিগ্রাফ ও ইমেল যুগের আগে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে অতি প্রাচীনকাল থেকেই চিঠির এক বিশেষ ভূমিকা ছিল। সাধারণ থেকে বহু বিখ্যাত মানুষের চিঠিতে সমকালীন জীবনযাত্রা, ব্যক্তি মানুষের সম্পর্কের রসায়ন এবং সমাজ পরিবর্তনের ধারাবাহিকতার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। তবে অষ্টাদশ শতকে 'চিঠি' মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের প্রয়োজনকে ছাপিয়ে সাহিত্যেও এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে। যদিও পঞ্চদশ ও সপ্তদশ শতকে লেখা কয়েকটি পত্র উপন্যাসের নাম পাওয়া যায়,তবুও ১৭৪০ এ রিচার্ডসনের 'পামেলা' কে ইংরেজি ভাষায় লেখা প্রথম পত্রোপন্যাস বলে চিহ্নিত করা হয়। শুধুমাত্র এই বিশেষ সাহিত্য ধারা ছাড়াও বহু গল্প উপন্যাসে চিঠির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। 'প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস ' উপন্যাসে এলিজাবেথ ডার্সির মধ্যে সম্পর্কটি সহজ হয়ে ওঠে চিঠির মাধ্যমে। এছাড়া 'পারশুয়েশন' , 'ম্যান্সফিল্ড পার্ক' 'সেন্স এন্ড সেন্সিবিলিটি' ইত্যাদি প্রায় সব উপন্যাসেই চিঠির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আসলে উপন্যাসের চরিত্রদের মতোই জেন অস্টেন নিজেও প্রচুর চিঠি লিখেছেন। তাঁর ভাইঝি ক্যারোলিন জানিয়েছেন যে পিসিকে কখনও তিনি উপন্যাস লিখতে দেখেননি, দেখেছেন ড্রয়িং রুমের ডেস্কে বসে চিঠি লিখতে। আর 

সেইসব  চিঠিতে অকপটে এমন সব কথা তিনি বলেছেন যে তাঁর দিদি ক্যাসান্ড্রা মৃত্যুর আগে জেন অস্টেনের বহু চিঠি পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। বোনের জনপ্রিয়তা রক্ষা করতে এবং হয়ত কিছু অনভিপ্রেত বিষয়কে চিরকাল গোপন রাখতেই এই সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন। যদিও জেন অস্টেনের জীবনীকার, সমালোচক এবং ভাইপো ভাইঝিরা কেউ কেউ পাঠকের হাতে পৌঁছানো বাকি চিঠিগুলির বিষয়বস্তুকে একেবারে সাধারণ, গুরুত্বহীন, ঘরোয়া কথাবার্তায় পূর্ণ বলে মনে করে ভেবেছিলেন সেগুলি পাঠকদের কোনো প্রত্যাশাই পূরণ করবে না। তবে এই ভাবনা বিতর্কিত কারণ সেই চিঠিগুলো তাঁর জন্মের আড়াইশো বছর পরও পাঠকের কাছে আদৃত হয়ে চলেছে। জেন অস্টেন তাঁর বেশিরভাগ চিঠিই লিখেছিলেন দিদি ক্যাসান্ড্রাকে ।যে সময় তাঁরা একে অপরকে ছেড়ে দূরে থাকতেন সেইসময় চিঠিতেই তাঁরা গল্প করতেন। চিঠিতে জেন অস্টেনের বক্তব্য উপস্থাপনের সরস ভঙ্গিতে কোথাও যেন খুঁজে পাওয়া যায় সেই উপন্যাস রচয়িতাকে যিনি  হয়ত এই চিঠিগুলোতেই হাত মকশো করতেন। কেননা সেই মজার ছলে করা গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য, ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে সত্যের ইঙ্গিত, চরিত্রগুলোর ক্যারিকেচার সবেতেই যেন তাঁর বিশিষ্ট লেখনীর আভাস পাওয়া যায়। এছাড়া জানা যায় তাঁর পারিবারিক নানা ঘটনা, সেগুলিতে তাঁর প্রতিক্রিয়া, সমকালীন জীবনযাত্রা এবং তাঁদের পাঠাভ্যাসের বিস্তারিত পরিচয়। কখনও কখনও তাঁর উপন্যাসের কথা এসেছে, এসেছে নিজের সৃষ্টির প্রতি সন্তান স্নেহের অনুভূতির কথা। এই চিঠিগুলো ধারাবাহিক পাঠ করলে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন কথাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

 তাঁর প্রিয় দাদা হেনরি একটি গভীর সত্যের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এই বলে যে জেন ' never dispatched a note or letter unworthy of publication ' এই কথার সত্যতা বিচার করতে আপাতত বিতর্ক  সরিয়ে আসুন আমরা পড়তে শুরু করি তাঁর চিঠি...

 

প্রিয় দিদি,

এই সকালে তোমার চিঠির আশায় ছিলাম, কিন্তু কোনো চিঠি এল না।তোমাকে মেরির বাচ্চাদের খবর দেওয়ার ঝামেলা আমি আর কিছুতেই নেব না। যদিও এই খবরের জন্য আমাকে ধন্যবাদ না দিয়ে তুমি সবসময় বসে পড় আর চিঠি লেখ জেমসকে। আমি নিশ্চিত আমার মতো করে তোমার চিঠির অপেক্ষায় আর দ্বিতীয় কেউ থাকে না এবং আমি মনে করি না আমি ছাড়া আর কেউ সেই চিঠি পাওয়ার এতটা যোগ্য। এতক্ষণে মনের সব রাগ রোষ হালকা করে এবার তোমাকে বলব মেরি ভালো হয়ে উঠছে আর মাও চলনসই মতো হয়েছে। প্রথমজনকে শুক্রবার দেখেছিলাম, এবং যদিও তাকে আগের মঙ্গলবার বেশ হাসিখুশি দেখেছিলাম তবুও এই তিনদিনে তার উন্নতি দেখে আমি যারপরনাই অবাক হয়েছি। তাকে বেশ ভালো দেখাচ্ছিল। মন মেজাজও ভালো ছিল এবং আমরা গডমারশাম থেকে চলে আসার সময় এলিজাবেথকে যতটা প্রাণবন্ত দেখেছিলাম মেরি তার থেকেও বেশি উৎফুল্লভাবে কথা বলছিল । আমি এক ঝলক বাচ্চাটাকে দেখেছিলাম। সে  ঘুমোচ্ছিল ; কিন্তু মিস দেবরি আমাকে বলল ওর চোখগুলো নাকি বড় , কালো আর ভারি সুন্দর। তাকে সাধারণত যেমন দেখায় তেমনি লাগছিল। পশমের সুতো দিয়ে বোনা একটা নেটের গাউন পরেছিল আর মাথায় ছিল মিসেস বার্চ  যেটাকে বলতেন  'পট হ্যাট' । মিস দেবরির একখানা সংক্ষিপ্ত এবং সারবস্তু সম্বলিত ইতিহাস ! আমার ধারণা হেনরি নিজেই তার সবকিছু ভালোভাবে মিটে যাওয়ার কথা তোমাকে জানিয়েছে । আমরা জানি না কে এইসব যুগিয়ে দিল। মিস্টার ময়েল সাগ্রহে এটা দিয়ে দিত যদি না তার অক্সফোর্ডশায়ারের সব সম্পত্তি এই একই উদ্দেশ্যে কর্ণেলের কাছে বাঁধা থাকত । যথেষ্ট আশ্চর্যের! এখন বাড়ির অবস্থা বিগড়ে রয়েছে । ন্যানি এই তিন চারদিন গা ব্যথা আর জ্বর নিয়ে তার বিছানায় । এমতাবস্থায় দুজন ঠিকে ঝি রাখতে বাধ্য হয়েছি বটে তবে তাতে করে বিশেষ সুবিধা হচ্ছে না। ন্যানি এখন আগের থেকে অনেকটাই ভালো আছে কিন্তু আমার মনে হয় আরো কিছুটা সময় লাগবে। মনে হয় তুমি আর এডওয়ার্ড শুনে খুশি হবে যে ন্যানি লিটলওয়ার্ট আমার চুল ঠিক করে দেয়। বৃহস্পতিবারের মজলিস বেশ ছোটোই ছিল বলা যায়, বড় জোর অক্সফোর্ড স্ম্যাকের মতো হবে। রুমে মাত্র সাতাশ জন লোক আর সাতটা যুগল ছিল। ওভারটন স্কচম্যান যথেষ্ট দয়া দেখিয়ে আমাকে কিছু টাকার হাত থেকে মুক্তি দিয়ে ছটা সেমিজ ও চার জোড়া মোজা দিয়েছে। সেমিজের কাপড় খুব একটা মিহি নয় যেমনটা আমি পছন্দ করি কিন্তু যেহেতু আমি এটার জন্য যতটা খরচ করতে চেয়েছিলাম ততটা করেছি তাই অভিযোগ করার কোনো কারণ নেই। প্রতি গজে আমার খরচ হয়েছে তিন শিলিং ছয় পেন্স। যাইহোক শেষবারের কাপড়ের তুলনায় এটা বরং মিহি এবং অতটা খসখসেও নয়।আমরা 'Fitz- Albini' উপন্যাসটা পেয়েছি। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে বাবা এটা কিনে এনেছেন। এটা আমাকে খুব একটা স্বস্তি দেয় না যখন ভাবি এগারটনের একমাত্র একটা লেখাই কিনলাম যেটার জন্য তার পরিবারবর্গ লজ্জিত। জানি তুমি সহজেই বিশ্বাস করবে এসব দ্বিধাদ্বন্দ্ব এই বইটা পড়ার সময় আমার মাথায় আসেনি। আমরা কেউই এখনও এর প্রথম পর্ব শেষ করে উঠতে পারিনি। বাবা হতাশ হয়েছেন, আমি নয়, কেননা আমি এর থেকে ভালো কিছু আশা করিনি। আর কোনো বই এমনভাবে লেখকের ভেতরের প্রমাণ বহন করেনি। প্রতিটি অনুভূতিই এগারটনের। খুব ছোটো একটা গল্প আছে এবং সেটা খুবই উদ্ভট ও বিচ্ছিন্নভাবে বলা হয়েছে। অনেক চরিত্র এনেছেন, কোনোরকমে তাদের আঁকা হয়েছে। আমরা এখনও পর্যন্ত কাউকে চিনে উঠতে পারিনি ডক্টর, মিসেস হে এবং মিস্টার অক্সেনডেনকে ছাড়া। তার প্রতিও সুবিচার করা হয়নি। এডওয়ার্ডকে অবশ্যই বলো বাবা সিওয়ার্ডকে পঁচিশ সিলিং দিয়েছে শেষবারের ভেড়াগুলোর জন্য আর এই খবরের বিনিময়ে বাবা এডওয়ার্ডের কিছু শুয়োর পেতে চান। আমরা বসওয়েলের 'ট্যুর টু দ্য হেব্রিডস' পেয়েছি এবং তাঁর 'লাইফ অফ জনসন' পাব এবং যেহেতু বার্ডনের হাতে তখনও কিছু টাকা থাকবে সেটা দিয়ে ক্যুপারের বই কেনা হবে। এটা জানতে পারলে  মিস্টার ক্ল্যার্ক খুশি হবেন। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল অন্যান্য লেখার ফাঁকে আমি মিসেস বার্চকে চিঠি লিখেছি তাই আশা করা যায় পৃথিবীর অন্য অংশের সব লোকের খবর শীঘ্রই পাওয়া যাবে। মিসেস ই লেইকেও চিঠি লিখেছি এবং মিসেস হিথকোট এতটাই বদমেজাজি যে আমাকে আবার প্রশ্নভরা চিঠি পাঠিয়েছে। সুতরাং সব মিলিয়ে আমি চিঠি লিখতে লিখতে সেইরকমই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তাই মা বা মেরির সম্পর্কে নতুন কিছু বলার না থাকলে আমি আর বেশ কিছুদিন চিঠি লিখব না। সম্ভবত একটু বিরতি কলমের প্রতি আমার শ্রদ্ধা পুনরুদ্ধার করতে পারে। ছোটো এডওয়ার্ডকে জিজ্ঞাসা করো বব ব্রাউন এই ঠান্ডায় একটা মস্ত কোট পরে কিনা।

এখানেই শেষ হয়েছে ১৭৯৮ সালের ২৫ শে নভেম্বর স্টেভেনটন থেকে দিদি ক্যাসান্ড্রাকে লেখা জেন অস্টেনের চিঠি। ক্যাসান্ড্রা তখন রয়েছেন ভাই এডওয়ার্ডের কাছে গডমারশামে। এই প্রসঙ্গে বলা যায় ক্যাসান্ড্রা এবং জেন দুজনেই আজীবন অবিবাহিত থেকে দাদা ও ভাইদের অসুস্থ স্ত্রী ও সন্তানদের দেখাশোনা করেছেন।তাই পিসিদের সঙ্গে ভাইপো ভাইঝিদের সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। এখানে মেরির সন্তানদের প্রসঙ্গ এসেছে। ১৭ ই নভেম্বর জন্ম হয়েছে বড়দা জেমস ও মেরির ছেলে জেমস এডওয়ার্ডের । বড় বড় চোখের যে ঘুমন্ত শিশুর উল্লেখ রয়েছে চিঠিতে সেই পরবর্তী কালে হয়েছিলেন জেন অস্টেনের প্রথম জীবনীকার। মেরি জেমসের দ্বিতীয় স্ত্রী।প্রথম স্ত্রী অ্যানে ম্যথিউর মৃত্যুর পর ১৭৯৭ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। জেমসের প্রথম স্ত্রীর কন্যা আনা অস্টেন। তাঁর কথায় পরে আসছি আপাতত এই চিঠিটির বিষয়ে মনোযোগী হই। এখানে ঘরোয়া কথাবার্তা ও কিছু ঘটনার বর্ণনার মধ্যে জেন অস্টেনের হাস্যরস সৃষ্টির আভাস স্পষ্টতই প্রতীয়মান। মিস দেবরির বর্ণনায়, মোজা ও সেমিজ কেনার প্রসঙ্গগুলি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। দাদা হেনরি সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে। হেনরি আর ক্যাসান্ড্রা পিঠোপিঠি ভাইবোন। জেনের থেকে হেনরি চার বছরের বড়। তবে দাদা ভাইদের মধ্যে এই হেনরির সঙ্গেই জেনের সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো ছিল। হেনরির সাহায্যেই 'সুজান ' উপন্যাসের পান্ডুলিপি প্রকাশককে বিক্রি করেন জেন। ১৮১১ সালে লন্ডনে এই দাদার কাছে থেকে 'সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি' র প্রুফ সংশোধন করেন ও প্রকাশ করেন । ম্যান্সফিল্ড পার্ক লিখতে শুরু করেন এবং 'ফার্স্ট ইমপ্রেশন' কে পরিণত করেন ' প্রাইড অ্যান্ড প্রজুডিস' এ। ১৮১৭ তে জেন অস্টেনের মৃত্যুর পর ১৮১৮ তে 'নর্থঅ্যাঙ্গার অ্যাবে' ও 'পারশুয়েশন' প্রকাশিত হয় হেনরির 'বায়োগ্রাফিক্যাল নোটিশ' সহ। এই উপন্যাস দুটিতেই প্রথম লেখক হিসেবে জেন অস্টেনের নাম সর্বসমক্ষে আসে। হেনরি ১৭৯৩ সালে অক্সফোর্ড মিলিশিয়াতে যোগ দেন লেফটেন্যান্ট হিসেবে। চিঠিতে যে বিষয়টির ইঙ্গিত রয়েছে সেটা হেনরির প্রমোশনের। তখন তিনি হয়েছেন একজন ক্যাপ্টেন,পেমাস্টার ও অ্যাডজুট্যান্ট। 

Fitz-Albini হল 'Arthur Fitz - Albini , a Novel '। লেখক স্যামুয়েল এগারটন ব্রিজেস।১৭৯৮ সালে দুখন্ডে প্রকাশিত হয় এই উপন্যাস। এখানে বসওয়েলের  লেখা স্যামুয়েল জনসনের জীবনী ও ক্যুপারের বই কেনার কথা রয়েছে। বাবা জর্জ অস্টেন নিজেও প্রচুর বই পড়তেন এবং ছেলেমেয়েদেরও নানা বই পড়ায় উৎসাহ দিতেন। চিঠিতেই উল্লেখ রয়েছে কতগুলো বই কেনার কথা। হেনরি 'বায়োগ্রাফিক্যাল নোটিস ' এ লিখেছেন জেন অস্টেন জনসনের গদ্য এবং ক্যুপারের কবিতা পড়তে ভালোবাসতেন। বার্ডেন সেই সময়ের  উইনচেস্টারে দুজন বই বিক্রেতার একজন। তাঁর কাছ থেকে যে প্রায়শই বই নেওয়া হত তা বোঝা যায়।

জর্জ অস্টেনের ফার্মে পশুপালন করা হত এবং এডওয়ার্ডেরও ফার্ম ছিল।সেই প্রসঙ্গে একটু মজা করার সুযোগ হাতছাড়া করেননি অস্টেন। চিঠির শুরুতে দিদির প্রতি অভিমানের সুর থাকলেও গল্পের আদলে এগোতে থাকা চিঠির পরের অংশটিতে তার চিহ্ন ছিল না।শেষে আবার চিঠি লিখে লিখে ক্লান্ত হয়ে তিনি সাময়িক বিরতি নেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। যদিও নিজের কথা রাখতে না পেরে একসপ্তাহ পরেই ডিসেম্বরের ২ তারিখে আবার দিদিকে চিঠি লেখেন জেন। এই প্রসঙ্গে লেডি বারট্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে 'ম্যান্সফিল্ড পার্ক' এ কথক যা বললেন তা উদ্ধৃত করা যায়..." Every body at all addicted to letter writing, without having much to say, which will include a large proportion of the female world at least, must feel with Lady Bertram...in having such a capital piece of Mansfield news... " অস্টেন নিজেও সম্ভবত চিঠি লেখার নেশায় আসক্ত ছিলেন। তাই তেমন কিছু বলার না থাকলেও দিদিকে দীর্ঘ চিঠি লিখতেন। তাছাড়া আরও একটা মজার বিষয় হল সেই সময় ব্যাক্তিগত চিঠিগুলোর প্রাপককে দাম দিয়ে চিঠিটা নিতে হত এবং দাম নির্ধারিত হত কতটা দূর চিঠিটা যাচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে।তাই দীর্ঘ চিঠি পেলে প্রাপক তার  অর্থ ব্যয়টা কিছুটা উসুল হয়েছে ভাবত। অস্টেনের বেশিরভাগ চিঠিই একপাতার হত কেননা দুপাতার দাম হত দ্বিগুণ।আর সেই একটা পাতার একটুকু জায়গাও নষ্ট করতেন না অস্টেন। ১৮০১ সালে দিদিকে লেখা অন্য একটি চিঠিতে জেন লিখছেন," আমি খুশি হয়েছি যে ওয়াইল্ডম্যানসরা বল নাচের আয়োজন করেছে এবং আশা করি তুমি সেখানে গিয়ে কিছু চুমু ছড়িয়ে আমার তোমার দুজনের উপকারে লাগার মতো ফ্র্যাঙ্ক কিনে আনবে" । আপাত হাসির আড়ালে দুটি গভীর সত্যের ইঙ্গিত দিয়েছেন জেন। প্রথমত ১৭৮৪ থেকে ১৮১২ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া চিঠিপত্র পাঠানোর খরচ তাঁদের দুই বোনের এই চিঠিপত্র বিনিময়ে অসুবিধার সৃষ্টি করত। দ্বিতীয়ত এক বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেনীর 'ফ্র্যাঙ্ক' এর অপব্যবহার। সেই সময় পার্লামেন্টের সদস্যরা চিঠিপত্র বিনামূল্যে পাঠাতে ও গ্রহন করতে পারতেন। চিঠির কোনায় তাঁদের স্বাক্ষর বা বিশেষ কোনো চিহ্ন ব্যবহার করে এগুলোকে অন্যান্য চিঠির থেকে আলাদা করা হত। পার্লামেন্টের সদস্যদের বদান্যতায় তাঁদের বিশেষ ঘনিষ্ঠরাও এই 'ফ্র্যাঙ্ক' ব্যবহার করতেন যার ফলে ডাক বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। পরবর্তীতে ১৮৪০ এ এই 'ফ্র্যাঙ্ক ' এর প্রচলন বন্ধ করা হয়।

বেশ কিছু বছর পরে ভাইঝি আনা অস্টেন ও ফ্যানি নাইটকে লেখা জেনের চিঠিগুলিতে একটি স্বতন্ত্র স্বর উঠে আসে। বড়দা জেমসের বড় মেয়ে আনা তার পিসির মতোই লেখক হতে চেয়েছিলেন। অস্টেন চিঠিতে তাঁকে নানা উপদেশ দেন লেখার বিষয়ে...

 

 প্রিয় আনা,

'তোমার তিনটে বই দেখে ভারি খুশি হয়েছি, কিন্তু আমার ভালো রকম কিছু সমালোচনা করার আছে। অতটা বেশি হয়ত তোমার ভালো লাগবে না। মিসেস এফ এর ভাড়াটে হিসেবে থিতু হওয়াটা এবং নেবার সংলগ্ন স্যার টি এইচের মতো একজনের কাছে অন্য কোনো প্ররোচনা ছাড়া যাওয়াটা আমরা মেনে নিতে পারছি না। ওর কাছাকাছি মেয়েটিকে আকৃষ্ট করার মতো আরো কোনো বন্ধু থাকার কথা। একজন মহিলা, সদ্য বেড়ে ওঠা দুটো মেয়ে যার সঙ্গে রয়েছে,এমন একটা এলাকায় যেখানে সে একজন লোক ছাড়া কাউকে চেনে না এবং লোকটির চরিত্রও খুব একটা ভালো না তেমন একটা লোকের পাল্লায় পড়া মিসেস এফ এর মতো একজন বিচক্ষণ মানুষের পক্ষে বেমানান। মনে রেখো সে বিচক্ষণ। তাকে দিয়ে অসঙ্গতিপূর্ণ কাজ করিও না।-- ওকে একটা বন্ধু দাও এবং সেই বন্ধুকে প্রাইওরিতে দেখা করার নিমন্ত্রণ করুক এবং সেখানে সে যেমন ডিনার করে করুক।তাতে আমাদের আপত্তি নেই....

তুমি একটা মিষ্টি জায়গা বর্ণনা করো কিন্তু প্রায়শই তা এতটা পুঙ্খানুপুঙ্খ হয় যে সবাই এটা পছন্দ করবে না...'

এভাবেই চলতে থাকে লেখার মান উন্নত করার পরামর্শ এবং তার সঙ্গে থাকে আরো লেখার উৎসাহ। এই সংক্ষিপ্ত অংশটি যে চিঠি থেকে নেওয়া হয়েছে সেটি১৮১৪ সালের ২৮ শে সেপ্টেম্বর চাওটন থেকে লেখা। তাঁর আরেক প্রিয় ভাইঝি ফ্যানি নাইট যাঁকে তিনি বলতেন 'the delight of my Life ' তাঁকে মৃত্যুর কয়েকমাস আগে ১৮১৭ সালের ১৩ই মার্চ চাওটন থেকে লেখা একটা চিঠিতে মেয়েদের সামাজিক অবস্থান, প্রেম ও বিবাহ নিয়ে অসাধারণ কিছু মন্তব্য করছেন ...

'অবিবাহিত মেয়েদের দরিদ্র হয়ে পড়ার ভয়ঙ্কর প্রবণতা থাকে - এটা বিয়ের সপক্ষে খুব শক্তপোক্ত একটা যুক্তি, কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে এই যুক্তি মাথায় রাখার প্রয়োজন নেই। মিষ্টি সোনা, তুমি নত হতে চাও না। খুব ভালো। আমি বলব, আগেও যা বলেছি, তাড়াহুড়ো কোরো না। ভরসা রাখো। শেষ পর্যন্ত সঠিক মানুষ আসবে। আগামী দু তিন বছরের মধ্যে এমন একজন আসবে ইতিপূর্বে তেমন কাউকে দেখনি । তার ভালোবাসার উষ্ণতা সবাইকে ছাপিয়ে যাবে এবং সে তোমার সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে থাকবে যে তোমার মনে হবে এমনভাবে আগে কাউকে ভালোবাসনি। আর তারপর তাড়াতাড়ি মা হতে গিয়ে চেহারা,মন মেজাজ , শরীর স্বাস্থ্য সব নষ্ট করে ফেলবে না...

আনার বিশ্রী রকম ঠান্ডা লেগেছে। তাকে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।আমরা তো অন্যরকম ভয় পেয়েছিলাম...'

চিঠিতে নিজের শারীরিক সুস্থতার খবর দিচ্ছেন। অন্য একটি প্রসঙ্গে দাম্পত্য অশান্তি ও বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে বেড়ে ওঠা সন্তানের ভালো হওয়ার সম্ভাবনায় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। প্রিয়তম ফ্যানিকে বিদায় জানিয়ে শেষ হয়েছে এই চিঠি।

জেন অস্টেন প্রেমহীন বিবাহকে কখনও মেনে নিতে পারেননি। অল্প বয়সে টম লেফ্রয়কে ভালো লেগেছিল হয়ত। কয়েকটা বল নাচের আসরে তাঁদের দেখা গিয়েছিল একসঙ্গে। টম লেফ্রয় তখনও প্রতিষ্ঠিত হননি। যদিও পরবর্তীতে তিনি একজন রাজনীতিবিদ ও বিচারক হিসেবে যথেষ্ট অর্থশালী হয়ে উঠেছিলেন কিন্তু সম্পর্কটা আর এগোয়নি। জর্জ অস্টেনের অবসরের পর বাথ শহরে এসে  পশ্চিমের দেশগুলোতে ঘোরার সময় একজনের সঙ্গে অল্প সময়ে জেন একটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন বলে জানা যায়। তবে কিছুদিন পর সেই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। পরবর্তীকালে একটি বিবাহ প্রস্তাব এলে প্রথমে সেটি গ্রহণ করলেও পরেরদিন প্রত্যাখ্যান করেন। প্রেমহীন বিবাহ তাঁর কাছে অর্থহীন ছিল। তাছাড়া বিবাহ , সংসার ও সন্তান প্রতিপালন তাঁর লেখক জীবনের ইতি ঘটাবে এমন একটা ভয়ও হয়ত ছিল। ভাইঝি আনার অল্প বয়সে বিবাহ তিনি মেনে নিতে পারেননি এবং তার বারংবার সন্তান ধারণের খবরও তাঁকে কষ্ট দিত। তবে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস 'প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস ' এর নায়ক ডার্সির মধ্যে কেউ কেউ টম লেফ্রয়ের ছায়া দেখেন। টম পরিণত বয়সে সম্পর্কটিকে 'boyish love' বলে খানিক হালকা করে দিলেও অস্বীকার তো করতে পারেননি...হতে পারে সে ক্ষণিক মোহ , তবু ক্ষণ তো মিথ্যে নয়। আর নয় বলেই এতগুলো উপন্যাসে নারী পুরুষ সম্পর্কের রসায়ন এমন অতুলনীয় হয়ে উঠেছে স্রষ্টার কলমে।