কুমার সাহানি ও ভারতীয় সিনেমার নবতরঙ্গের একটি অধ্যায়

সাম্প্রতিক ভারতীয় চলচ্চিত্রে কুমার সাহানি এমন একজন চলচ্চিত্রকার যিনি 'এপিক সিনেমা'র অন্যতম স্রষ্টা। সাহানি তার চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেন ১৯৭০-এর দশকে। মণি কাউল, আদুর গোপালকৃষ্ণাণ, জি. অরবিন্দন এবং সৈয়দ মির্জার সঙ্গে তার নাম উচ্চারিত হয় নিউ ইন্ডিয়ান সিনেমার অন্যতম স্রষ্টা হিসাবে। কুমার সাহানি তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র “মায়া দর্পণ' নির্মাণ করেছেন ১৯৭২ সালে যা নিউ ইন্ডিয়ান সিনেমার একটি পথ প্রদর্শক।
কুমার সাহানির জন্ম ১৯৪০ সালের ৭ ডিসেম্বর অধুনা পাকিস্তানের লারকানা অঞ্চলে। দেশভাগের সময় তার পরিবার লারকানা থেকে বম্বে চলে আসে। বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের পাঠ শেষ করে FTII-এ চিত্রনাট্য বিভাগের ছাত্র হিসাবে যোগ দেন। সেখানে তিনি খত্বিক ঘটকের কাছে চলচ্চিত্রের পাঠ নিয়েছিলেন। FTII-এর পর্ব শেষ করে প্যারিসে কিছুদিন চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়াশুনা করার সুযোগ পান। বন্ধু মণি কাউলের সঙ্গে তিনিও প্রখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্রকার রবের ব্রেস'র পড়ানোর ভক্ত হয়ে পড়েন।
কুমার সাহানির জগৎ প্রাথমিকভাবে নির্মিত হয় তিনজন প্রথ্যাত চিন্তকের প্রভাবে। একজন অবশ্যই খত্বিক ঘটক, যার হাত ধরে তিনি এপিক সিনেমার ধারণায় পৌঁছেছেন। দ্বিতীয়জন ব্রেস, যিনি সাহানিকে শিখিয়েছেন কীভাবে আখ্যানের বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে বিষয়ীর স্থানিক সম্পর্ক নির্মাণ করতে হয়। তৃতীয় মানুষটি ইতিহাসবিদ, গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক ডি.ডি.কোসাম্বি, যাঁর প্রভাবে কুমার সাহানির ইতিহাসবোধ ও মার্কসীয় বীক্ষা তৈরি হয়েছিল। সাহানির ছবিতে ভারতীয় সমাজের একটা রূপ পাওয়া যায় যেখানে সামস্ততান্ত্রিক অবশেষ এবং পুঁজিবাদের সহাবস্থানে গড়ে ওঠা দেশীয় সমাজচিত্রটি ধরা পড়ে।
কুমার সাহানির প্রথম ছবি ‘মায়া দর্পণ' দেখলে তার কাজে ঘটক, ব্রেস ও কোসাস্বির প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। এ ছবি তারণ নামে একটি মফস্বলী উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণীর গল্প। ছবিটা তৈরি হয়েছে হিন্দি কথা সাহিত্যিক নির্মল ভার্মার একটি গল্পকে ভিত্তি করে। ভার্মার গল্পে আধা-সামস্ততান্ত্রিক সমাজের একটি পরিবারে তারণ নামের যুবতীটির একাকিত্বকে গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হয়েছে। সাহানির ছবিতেও ভার্মার গল্পের এই বিশেষ দিকটিকে ধরা হয়েছে। যেখানে ভারতীয় সমাজে আধুনিক ব্যক্তি এবং আধা-সামস্ততান্ত্রিক সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধের সংঘাতে নির্মিত হচ্ছে বিষয়ী ও তার জগৎ।
কুমার সাহানির ছবিতে আখ্যানের কালিক গতি একটু ধীর। এই ধীর গতির সঙ্গে আর একটা প্রচেষ্টা থাকে যা হল পাশ্চাত্য পরিপ্রেক্ষিতবাদী চিত্রকলা ও হলিউডি অবিচ্ছেদী সম্পাদনারীতি থেকে ছবিকে মুক্ত রাখা। কুমার সাহানির ছবি উপন্যাস রীতির অনুসারী নয়। বরং তার ছবি বিশ্লেষণাত্মক-- যে ধরনের বিশ্লেষণ রীতি আমরা মহাকাব্যের রচনা পদ্ধতিতে লক্ষ্য করি। 'এপিক সিনেমা'র যে ধারা খত্বিক ঘটকে শুরু হয়েছিল তার বিশেষ অগ্রগতি আমরা কুমার সাহানির ছবিতে দেখতে পাই। ১৯৮৯ সালে নির্মিত 'খয়াল গাথা' একটি গুরুত্বপূর্ণ কাহিনিচিত্র যা সাহানির 'এপিক সিনেমা'র ধারণাটিকে সবচেয়ে ভালভাবে প্রকাশ করেছে। এ ছবিতে খেয়ালের উৎপত্তি, বিবর্তন এবং আধুনিকীকরণ ঐতিহাসিকভাবে আখ্যায়িত করেন সাহানি। আসলে ‘এপিক সিনেমা'র ধারণা যেভাবে খত্বিক ঘটক থেকে কুমার সাহানিতে বিকশিত হয়েছে তার মধ্যে ভারতীয় মার্গসংগীত বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতে যে নির্দিষ্ট জমাট গঠনপ্রণালী অনুসৃত হয়, ভারতীয় মার্গ সংগীতে তা করা হয় না। ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতে রাগের একটি মূর্ত প্রাথমিক কাঠামো থাকলেও ক্রমে তা বিস্তারলাভ করতে করতে বিমূর্ত রূপ ধারণ করে। একটি প্রথাগত ধারণা রয়েছে যে চলচ্চিত্র যেহেতু রূপকলা, তাই পাশ্চাত্য সংগীতের জমাট গঠনপ্রণালীর সংগীতের বিমূর্ততার সঙ্গে সেরকম সম্পর্ক স্থাপন চলচ্চিত্রে সম্ভব নয়। 'এপিক সিনেমা' এখানে আঙ্গিকগত ও আখ্যানগত এক বিকল্প ধারণার কথা বলে। সাহানি 'এপিক সিনেমা'র এই ধারণাটিকে ধারণাটিকে অত্যন্ত সফলভাবে রূপায়িত করেছেন ‘খায়াল গাথা’ ছবিতে।
কুমার সাহানি বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ছোট ছবি এবং তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। কিন্তু তার পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্রের সংখ্যা সীমিত। 'মায়া দর্পণ' এবং “খয়াল গাথা' ছাড়া 'তরঙ্গ' (১৯৮৪), 'কসবা' (১৯৯১) এবং রবীন্দ্রনাথের উপ্যন্যাস অবলম্বনে ‘চার অধ্যায়' (১৯৯৭) তার বড় কাজ। সাহানি তার গুরু কোসাম্বির মতোই ভারতীয় আধুনিক সমাজের এক মার্কসবাদী বিশ্লেষণ উপস্থিত করেছেন যার কেন্দ্রে রয়েছে সামস্ততান্ত্রিক অবশেষ এবং পুঁজিবাদের এক অদ্ভুত সহাবস্থান। কুমার সাহানির ছবিতে বিষয়ী ও বিষয়ীর পারিপার্শ্বিক জগতে্র মধ্যে এমন এক সম্পর্ক নির্মিত হয় যা চরিত্র ও স্থানের দ্বান্দ্বিকতা দ্বারা নির্ধারিত বস্তজগৎ ও বিষয়ী জগতের মধ্যে অপ্রথাগত একটানাপোড়েন দেখতে পাওয়া যায়। ভারতীয় আধুনিক সমাজের জটিল গঠনটি সাহানির ছবিতে প্রকাশিত হয়। সমাজের পুরুষতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক, নৈতিকতার পরিবেষ্টনী, রক্ষণশীলতা এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা -- ভারতীয় সমাজের এই বিশেষ চরিত্রের আধুনিকতার জটিল রূপটি কুমার সাহানি তাঁর ছবিতে ধরার চেষ্টা করেছেন, যেখানে পুঁজির পলিটিক্যাল ইকোনমি কেবল নয়, নৈতিকতা এবং পারিবারিক, কাঠামোর পলিটিক্যাল ইকোনমিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।