হেনরি ফিল্ডিংয়ের টম জোনস ও নভেলের আদিপর্ব
- 07 March, 2024
- লেখক: সৌভিক ঘোষাল
অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে ড্যানিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রুসো (১৭১৯) ও মল ফ্ল্যান্ডার্স (১৭২২) এর মতো আখ্যানগুলির মধ্যে দিয়ে ইংরাজী সাহিত্যে উপন্যাসের ধারাটি শুরু হয়েছিল বলে বেশীরভাগ সাহিত্য সমালোচকরা মনে করেন। এই ধারাকে পরবর্তীকালে যারা এগিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁদের একজন স্যামুয়েল রিচার্ডসন ও অন্যজন হেনরি ফিল্ডিং। রিচার্ডসনের পামেলা লেখা হয়েছিল ১৭৪০ সালে এবং তার নৈতিকতার দিকটি নানা মহলে অতি প্রশংসিত হয়। তবে পামেলার নৈতিকতাকেই আবার বানানো, জীবনের বাস্তবতা থেকে দূরবর্তী ইত্যাদি অভিযোগ তুলে অনেকেই এর নানা সমালোচনা ও ব্যঙ্গ বিদ্রুপও করেন। পামেলা প্রকাশের পরের বছরেই এর নৈতিক অবস্থানটিকে ব্যঙ্গ করে একদিকে সেকালের জনপ্রিয় লেখিকা এলিজা হেয়ুড লেখেন অ্যান্টি পামেলা (১৯৪১)। শামেলা নামে আর একটি ব্যাঙ্গাত্মক আখ্যান লেখেন হেনরি ফিল্ডিং। এটি অবশ্য বেনামে প্রকাশিত হয়েছিল, তবে আখ্যানকারের পরিচয় পরে উন্মোচিত হয়।
উপন্যাসের বিষয়বস্তু, চরিত্রচিত্রণ ও দৃষ্টিকোণ কেমন হবে তাই নিয়ে রিচার্ডসনের নৈতিক ধারণাটি থেকে সরে আসতে চেয়েছিলেন ফিল্ডিং। জীবনের বাস্তবতা ও শরীর মনের টান যে নৈতিকতাকে কীভাবে এলোমেলো করে দিয়ে যায় বারবার, সেটাই ফিল্ডিং দেখাতে চেয়েছেন তাঁর আখ্যানগুলিতে। বলতে চেয়েছেন অবিমিশ্র সাদা এবং কালোতে বিভাজিত করে উপন্যাসের চরিত্রপাত্রদের নির্মাণ করা ঠিক হবে না, দোষে গুণে মেশানো বৈশিষ্ট্যে নির্মাণ করলেই তাদের রক্তমাংসের মানুষ বলে মনে হবে। হেনরি ফিল্ডিং এর এই উপন্যাসভাবনার পরিচয় পাওয়া যাবে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা টম জোনস এ। ১৭৪৬ সালে ফিল্ডিং এটি লেখা শুরু করেন এবং তিন বছর পরিশ্রমের পর ১৭৪৯ সালে এই বিশাল কলেবর গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
এই উপন্যাসের ছটি খণ্ডের বিরাট আয়তনে এক মহাকাব্যিক চেহারা রয়েছে। তবে মহাকাব্যের পাশাপাশি নানা নাটকীয় বৈশিষ্ট্যও একে উজ্জ্বল করেছে। আমরা জানি হেনরি ফিল্ডিং প্রথম জীবনে নাটকই লিখতেন এবং থিয়েটার থেকেই তাঁর ভরণপোষণ হত। কিন্তু সেই সব ব্যাঙ্গাত্মক নাটক সরকারের স্বার্থের পক্ষে এতই হানিকারক হয়ে দাঁড়ায় যে ১৭৩৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এক নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন তৈরি করা হয় ও এই ধরনের ব্যাঙ্গাত্মক রচনার অভিনয়ের পথ কার্যত বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পর ফিল্ডিংকে বাধ্য হয়ে ঝুঁকে পড়তে হয় আইনের পড়াশুনো ও ওকালতিতে। তাঁর সাহিত্য জীবনটিও থিয়েটার থেকে আখ্যানের দিকে সরে আসে। তবে উপন্যাসের মধ্যেও নাটকীয়তাকে এনে তাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে তিনি কতটা দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, তার প্রমাণ রয়েছে টম জোনস উপন্যাসে।
বিশালায়তন এই উপন্যাসের গঠনে যে সুডৌল নির্মিতি রয়েছে, তা সেকাল ও একালের পাঠককে সমভাবে আকৃষ্ট করে। ছয়খণ্ডের এই উপন্যাসের রয়েছে তিনটি পর্ব। প্রথম দুটি খণ্ড গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে রচিত। তার পরের দুটি খণ্ডের প্রেক্ষাপটে রয়েছে পথ ও পথপাশের সরাইখানা। শেষ দুটি খণ্ডের অকুস্থল রাজধানী শহর লন্ডন। যেভাবে এই উপন্যাসের প্লট একটি আকর্ষণীয় প্রেম কাহিনী, তার জটিলতার নানা দিক এবং শেষমেষ বহু নাটকীয় ঘটনা ও সংঘাতের পর্ব পেরিয়ে এক মধুরেণ সমাপয়েৎ এর দিকে এগিয়েছে, তার প্রশংসা সেকাল একালের সমালোচকরা বারবার করেছেন।
সুঠাম শরীর ও প্রচুর সম্পদের মালিক মধ্যবয়স্ক মিস্টার অলওয়ার্দির কথা দিয়ে শুরু হয় হেনরি ফিল্ডিং এর সাড়া জাগানো উপন্যাস টম জোনস। মিস্টার অলওয়ার্দি থাকেন সমারসেট অঞ্চলে তাঁর খামার বাড়িতে। যখন এই উপন্যাসের আখ্যান শুরু হচ্ছে তার পাঁচবছর আগে মারা গিয়েছেন তার স্ত্রী। তার আগে নিতান্ত শিশুকালে গত হয় তাদের তিন সন্তানই। একাকী হয়ে পড়া সংসারে অলওয়ার্দির সঙ্গী তাঁর তখনো অবধি অবিবাহিত বোন মিস ব্রিজেস। আর আছে ভৃত্য খানসামারা, যাদের অন্যতম মিসেস উইলকিন্স। মিস্টার অলওয়ার্দী বইপিপাসু, সংস্কৃতিবান মানুষ। বই পড়ে আর প্রকৃতির সান্নিধ্যে তাঁর দিন কাটে। একদিন বাড়ি ফিরে মিস্টার অলওয়ার্দি দেখেন তাঁর ঘরে বিছানার ওপর এক সদ্য জন্মানো শিশু। বিস্ময়ে অবাক হয়ে তিনি ডেকে পাঠান খানসামা মিসেস উইলকিন্সকে, কিন্তু শিশুটি সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। মিস্টার অলওয়ার্দি সামাজিক প্রশ্নের ভয়কে উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেন তিনিই শিশুটির লালন পালন করবেন। তাঁর বোন মিস ব্রিজেস দাদার এই সিদ্ধান্তে সম্মত হয়। খানসামা মিসেস উইলকিন্স ইতোমধ্যে জনৈকা জেনি জোনসকে শিশুটির গর্ভদাত্রী সন্দেহে নিয়ে আসে মিস্টার অলওয়ার্দির কাছে এবং জেনি শিশুটির মাতৃত্বের কথা স্বীকার করে। তবে সে শিশুটির বাবার নাম পরিচয় জানাতে অসম্মত হয়। মিস্টার অলওয়ার্দি জেনিকে শাস্তি না দিয়ে বেশ খানিক টাকা পয়সা দেন ও সে কাজ ছেড়ে দূরে চলে যায় বসবাস করতে। শিশুটি মিস্টার অলওয়ার্দির কাছেই থাকবে বলে সিদ্ধান্ত হয়, তার নাম রাখা হয় অলওয়ার্দির নামের সূত্র ধরে থমাস জোনস, সংক্ষেপে টম জোনস।
এইসময়ে সমারসেট অঞ্চলে আসেন ক্যাপ্টেন ব্লিফিল। তিনিও মিস্টার অলওয়ার্দির মতো গ্রন্থপিপাসু মানুষ বলে দুজনের দুজনকে পছন্দ হয়ে যায়। তাঁরা পরস্পরের বন্ধু হয়ে ওঠেন। তবে বন্ধুত্ব দ্রুতই আত্মীয়তার সম্পর্কে পৌঁছয় যখন বন্ধুর বোন মিস ব্রিজেসকে ভালোবেসে ফেলেন ক্যাপ্টেন ব্লিফিল। মিস ব্রিজেসও সে ভালোবাসার ডাকে ইতিবাচক সম্মতি জানালে মিস্টার অলওয়ার্দির সানন্দ সম্মতিতে ক্যাপ্টেন ব্লিফিল আর ব্রিজেস বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের যে পুত্র সন্তানের জন্ম হয় সে মাস্টার ব্লিফিল নামে উপন্যাসে উল্লিখিত। অলওয়ার্দির ইচ্ছে ছিল টম আর মাস্টার ব্লিফিল তার বাড়িতে একসঙ্গে বড় হয়ে উথুক। অলওয়ার্দির বোন ব্রিজেস এ প্রস্তাবে সম্মত হলেও তাঁর স্বামী তথা মাস্টার ব্লিফিলের বাবা ক্যাপ্টেন ব্লিফিল এটা খুশিমনে মানতে পারলেন না। তিনি বাইবেল ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চাইলেন জন্মের নাম ঠিকানাহীন শিশুরা শাস্তিযোগ্য। মিস্টার অলওয়ার্দি পালটা বললেন এই ধরনের শিশুদের বাবা মায়েরা যে দোষই করে থাকুক না কেন, শিশুরা নিরপরাধ ও নিষ্পাপ। ঈশ্বর কখনো নিষ্পাপদের শাস্তিবিধান করেন না।
এইসময়ে একটি গুজব বেশ পাকিয়ে ওঠে। জেনি যে স্কুল শিক্ষকের বাড়ির খানসামা ছিল সেই মিস্টার পাত্রিজের সঙ্গে নাকী জেনির সম্পর্ক ছিল। সন্তানহীনা মিসেস পাত্রিজ ক্রমশই স্বামীর এই অবৈধ সম্পর্কের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেন আর ধরে নেন টম জোনস হল তার স্বামী মিস্টার পাত্রিজ ও তাদের একদা খানসামা জেনির অবৈধ সম্পর্কের সন্তান। এই সন্দেহের বশে তিনি তাঁর স্বামীকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন ও তাদের কলহ বিবাদের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মিস্টার অলওয়ার্দির কাছে সবাই এর বিতর্কের মীমাংসা করে দেবার আর্জি নিয়ে আসে। সব পক্ষকেই অলওয়ার্দি ডেকে পাঠান। জেনিকে ডাকতে যায় অলওয়ার্দির খানসামা মিসেস উইলকিন্স কিন্তু জানা যায় জেনি তার আবাস ছেড়ে কদিন আগেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। মিস্টার পাত্রিজ জেনির সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্কের কথা পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করেন কিন্তু মিসেস পাত্রিজ বলেন তিনি তার স্বামী ও জেনিকে একত্রে বিছানায় দেখেছেন। এই মিথ্যা অভিযোগে মিস্টার পাত্রিজের স্কুলের চাকরীটি চলে যায় এবং এর কিছুদিন পরে মিসেস পাত্রিজ অকস্মাৎ প্রয়াত হন। গ্রামবাসীরা মিস্টার পাত্রিজের প্রতি এই দুঃসময়ে সহানুভূতি দেখালেও তিনি গ্রাম ছেড়ে চলে যান।
ক্যাপ্টেন ব্লিফিল স্বপ্ন দেখা শুরু করেন মিস্টার অলওয়ার্দি মারা গেলে তিনি তাঁর বিপুল সম্পত্তি হাতে পাবেন এবং এলাকাটা, বাগান ও বাড়ি সমেত মনের মতো করে সাজাবেন। স্থাপত্যবিদ্যা সম্পর্কিত নানা বইপত্রও তিনি এজন্য পড়তে শুরু করেছিলেন। কিন্তু ভাগ্য অন্যদিকে বইলো এবং এক দুর্ঘটনায় হঠাৎই ক্যাপ্টেন ব্লিফিলের মৃত্যু হল।
উপন্যাস কথক হেনরি ফিল্ডিং পাঠকের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই কথা বলেন। এর আগে ন্যারেটিভ টেকনিক সম্পর্কে পাঠককে উদ্দেশ্য করে তিনি এই উপন্যাসের এক জায়গায় লিখেছিলেন, “Reader, this is not a newspaper, consisting of just the same number of words whether there be any news in it or not. In these pages you will find only the important events, so do not be surprised if sometimes time seems to stand still, and sometimes to fly.”
এবার তিনি জানান “The reader will not be surprised if we pass quickly over twelve years when nothing interesting happened. We shall now meet our hero, Tom, at about fourteen years of age.”
চোদ্দ বছরের টমের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব মিস্টার জর্জ সিগ্রিমের সঙ্গে, যার পেশা বাগান জমি দেখাশুনো করা। তারা একসঙ্গে সময় কাটায়, পাখি শিকারে যায়। একদিন তারা তাদের পড়শির জমিতে পাখি শিকার করতে করতে ঢুকে পড়লে তিনি মিস্টার অলওয়ার্দির কাছে এই নিয়ে অভিযোগ জানান। টম তার দোষ স্বীকার করে, কিন্তু তার সঙ্গে যে জর্জ সিগ্রিমও ছিল সেটা চেপে যায়। অপরাধ স্বীকারের সাহস দেখে টমের ওপর খুশি হয়ে মিস্টার অলওয়ার্দি তাকে একটি সুন্দর ঘোড়া উপহার দেন। টমের সঙ্গে মাস্টার ব্লিফিলের সম্পর্ক কিন্তু যথেষ্ট তিক্ত হয়ে ওঠে। ব্লিফিল একদিন টমকে বেজন্মার বাচ্চা বলে গালাগাল দেয়। টম রাগ সামলাতে পারে না। ঘুষি মেরে ব্লিফিলের নাক ফাটিয়ে দেয়। ব্লিফিল তার জেঠামশাই মিস্টার অলওয়ার্দির কাছে গিয়ে টমের বিরুদ্ধে নালিশ জানায়। টম বলে তার জন্ম নিয়ে কটু মন্তব্য করায় সে রাগ সামলাতে না পেরেছে ব্লিফিলকে মেরেছে। ব্লিফিল কিন্তু নিজের গালি দেবার দোষটা স্বীকার করে না। উলটে টমকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে চায় আর টেনে আনে পাখি মারার ঘটনাটা। বলে টমের সঙ্গে সেবার জর্জও ছিল, কিন্তু টম মিথ্যা করে বলেছিল যে সে একাই পাখি মারতে পড়শির এলাকায় ঢুকে পড়েছিল। টম স্বীকার করে জর্জকে বাঁচানোর জন্য সে সেবার মিথ্যা বলেছিল। সেই ঘটনার পর মিস্টার অলওয়ার্দি তাকে যে ঘোড়াটা উপহার দিয়েছিলেন সেটাও টম ফিরিয়ে দিতে চায়। মিস্টার অলওয়ার্দি টমকে ক্ষমা করে দেন আর টম ও মাস্টার ব্লিফিল দুজনকেই বলেন এরপর থেকে বন্ধু হয়ে থাকতে। জর্জ সিগ্রিমকে তিনি অবশ্য শাস্তি দেন আগের পাখি শিকারের ঘটনাটার জন্য। কাজ হারিয়ে পরিবার নিয়ে সে বিশেষ অর্থকষ্টে পড়ে।।
টম আর মাস্টার ব্লিফিলের পড়াশুনোর ভার ছিল মিস্টার থকুম ও মিস্টার স্কোয়ার নামের দুই শিক্ষকের ওপর। তারা অলওয়ার্দির বাড়িতেই থাকতেন এবং প্রায় পরিবারের লোক হয়ে গিয়েছিলেন। মিস্টার থকুম ধর্ম ও নৈতিকতা বিষয়ে পণ্ডিত ছিলেন আর মিস্টার স্কোয়ারের পাণ্ডিত্য ছিল দর্শন সম্পর্কে। মিস্টার স্কোয়ার ধর্মবোধের চেয়ে যুক্তিবুদ্ধিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। মিস্টার থকুম আর মিস্টার স্কোয়ার দুজনেই বিধবা ব্রিজেস ব্লিফিলকে পছন্দ করতেন ও তাকে বিবাহের ইচ্ছা পোষণ করতেন। এই নিয়ে তাদের দুজনের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও তিক্ততাও ছিল। ব্রিজেস তনয় মাস্টার ব্লিফিলের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়ে তারা মিসেস ব্লিফিলকে খুশি করতে চাইতেন আর এই পক্ষপাতের জায়গা থেকে টমের ওপর নেমে আসত নানা নির্যাতন। মিসেস ব্লিফিলও তাদের পছন্দ করতেন। মিস্টার থকুমের কথাবার্তা আর মিস্টার স্কোয়ারের দেহসৌষ্ঠব তাকে আকৃষ্ট করেছিল।
এরপর কাহিনী এসে দাঁড়ায় যেখানে সেখানে টমের বয়স আঠারো বছর। টমের মধ্যে সহানুভূতি কর্তব্যপরায়ণতা ইত্যাদি বোধ ক্রমশ প্রবল হয়েছে। সে ভুলতে পারে না তার সঙ্গী হয়ে পাখি শিকারে যাবার জন্যই জর্জ সিগ্রিমকে কাজ হারিয়ে আতান্তরে পড়তে হয়েছে। তাদের দিন কাটছে প্রবল দারিদ্রে। টম তার উপহার পাওয়া ঘোড়াটি বিক্রি করে সেই টাকা জর্জকে পরিবার প্রতিপালনের জন্য দিয়ে দেয়। মিস্টার অলওয়ার্দির উপহার দেওয়া বাইব্লের একটি দামী সংস্করণও সে এই কারণেই বিক্রি করেছিল। এটা জানাজানি হবার পর অবশ্য তার কপালে যথেষ্ট লাঞ্ছনা জোটে।
ইতোমধ্যে পাখি শিকার নিয়ে তাদের প্রতি অভিযোগ জানানো সেই প্রতিবেশী মিস্টার ওয়েস্টার্নের সঙ্গে টমের সদ্ভাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। টম এবং মিস্টার ওয়েস্টার্ন হয়ে উঠেছেন পরস্পরের শিকার সঙ্গী। টমকে মিস্টার ওয়েস্টার্ন নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসতে শুরু করেছেন। নিজের বন্দুক, ঘোড়া ইত্যাদি সানন্দে তিনি টমকে ব্যবহার করতে দেন।
মিস্টার ওয়েস্টার্নের একমাত্র কন্যা সপ্তদশী সোফিয়ার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিতে দিয়ে হেনরি ফিল্ডিং লেখেন – “Bring on flowers, soft winds and sweet birdsong to welcome the lovely Sophia Western. To imagine her appearance you must think of famous beauties in art and history, and of the woman who is dearest to your own heart.
Sophia was the only daughter of Mr Western. She was now seventeen. Her hair was rich and black, her shape delicate, her eyes bright, her nose regular, her teeth white, her lips red and her neck long and lovely. Such was the outside of Sophia, and inside she was equally fine. Her mind was as charming as her appearance, and her sweet temper lit up her face when she smiled.”
আমরা জেনে যাই সোফিয়া তার বাবার নয়নের মণি। তাও মিস্টার ওয়েস্টার্ন লেখাপড়া শেখার জন্য সোফিয়াকে তিন বছরের জন্য তার বোনের কাছে পাঠিয়েছিলেন। পড়ার সেই অধ্যায় সমাপ্ত করে সোফিয়া ঘরে ফেরার পরে উপন্যাস তার নতুন বাঁকে প্রবেশ করে। অচিরেই আমরা দেখি কুড়ি বছরের টম ও সপ্তদশী সোফিয়া পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। টম প্রথমদিকে তার এই আকর্ষণটা নিজেই ভালোভাবে বোঝেনি আর সোফিয়াও সেটা প্রথম আবিষ্কার করে নিজেই নিজের কাছে লজ্জিত হয়ে গিয়েছিল। টম জর্জকে মিস্টার ওয়েস্টার্নদের পরিবারের কাজে বহাল করার কথাটা সোফিয়ার কাছে উত্থাপণ করে এবং জেনে যায় সোফিয়াও আতান্তরে পড়া পরিবারটির প্রতি একইরকম সহানুভূতি সম্পন্ন। সে ইতোমধ্যেই তাদের কিছু টাকা এবং জামাকাপড় পাঠিয়েছে। সোফিয়া টমের কাছে একটি প্রতিশ্রুতি চেয়ে নিতে পারে কিনা জিজ্ঞাসা করলে টম তার হস্তচুম্বন করে জানায়, সোফিয়া যা খুশি তাই টমের কাছে চাইতে পারে।
টমের ঠোঁট যখন প্রথমবারের জন্য সোফিয়ার অঙ্গস্পর্শ করল, তখন সপ্তদশীর মধ্যে ওঠা শিহরণের এক মধুর কাব্যিক বর্ণনা দিয়েছেন হেনরি ফিল্ডিং। আমরা উপন্যাস থেকে তা সরাসরি শুনে নি –
“And now, Mr Jones, I have something to ask you.'
'Anything, madam,' said Tom, taking Sophias hand and kissing it.
This was the first time his lips had ever touched her, and the blood which before had left her cheeks now rushed back to colour all her face and neck. When she could speak (which was not instantly) Sophia asked Tom not to lead her father through so many dangers when hunting.
পিতা ও প্রেমিক – একইসঙ্গে দুজনকেই শিকারের মতো বিপদজনক অভিযান থেকে এখানে দূরে রাখতে চাইছে সোফিয়া। টম তাকে প্রতিশ্রুতি দেয় উন্মাদের মতো শিকার অভিযানে সে আর জড়াবে না। সোফিয়াও বাবার কাছে গিয়ে জর্জের চাকরীর কথাটা বলে আর সম্মতিও এসে যায় দ্রুত।
জর্জকে সাহায্য করতে টমের চেষ্টাচরিত্রর কথাটা মিস্টার অলওয়ার্দিকে জানিয়ে মাস্টার ব্লিফিল ভাবে টমের প্রতি সে তার জ্যেঠামশাইকে বিদ্বিষ্ট করতে পারবে। মিস্টার থকুম এবং মিস্টার স্কোয়ারও একযোগে জানান টম এই কাজ করে মিস্টার অলওয়ার্দিকে অসম্মান করেছে, কারণ তিনি জর্জকে শাস্তিস্বরূপ কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু মিস্টার অলওয়ার্দি গোটা বিষয়টিকে টমের চারিত্রিক উদারতার পরিচয় হিসেবেই দেখেন ও মিস্টার ওয়েস্টার্নদের কাজে জর্জের পুনবর্হাল হবার বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেন।
তবে টম ও সোফিয়ার প্রেম খুব মসৃণ পথে যে এগোয় তা নয়। এর কারণ জর্জ সিগ্রিমের ষোড়শী কন্যা মলির সঙ্গে আগে থাকতেই টমের তৈরি হওয়া এক সম্পর্ক। এই সময়ে জানা যায় মলি সন্তানসম্ভবা। টম মলির সঙ্গে তার সম্পর্কের কথাটা স্বীকার করে নেয়। মলিকে লোকজন অপমান ও লাঞ্ছনা করলে ভরা রাস্তায় সে মলির হয়ে তাদের সঙ্গে মারপিট করে। মলি ও টমের সম্পর্কের কথা এবং মলির সন্তান সম্ভাবনার কথা চারিদিকে চাউড় হয়ে যায়। তা যথা নিয়মে সোফিয়ার কাছেও আসে। বলাই বাহুল্য এই সংবাদ সোফিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতবিক্ষত করে। সে টমের দিক থেকে তার মনকে সরিয়ে আনুতে চায়, কাটায় বিনিদ্র রজনী।
এইসময় একদিন সোফিয়া শিকারে বেরিয়ে মারাত্মক বিপদে পড়ে। টম সেইখানে হাজির হয় এবং কোনওক্রমে সোফিয়াকে রক্ষা করে। এইসময় টমের হাত ভেঙে যায়। সেই অবস্থাতেই সে সোফিয়াকে নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। ডাক্তার আসেন। টমকে বেশ কয়েকদিন সোফিয়া ও মিস্টার ওয়েস্টার্নের বাড়িতেই বিশ্রামে থাকতে হয়। মিস্টার অলওয়ার্দি প্রতিদিন তাকে দেখতে আসতেন। থকুম এবং স্কোয়ারও তাকে দেখতে আসেন। এমনকী ব্লিফিলও কয়েকবার এসে টমের কুশল সংবাদ নিয়ে যায়। মিস্টার ওয়েস্টার্ন নিয়মিত টমের পরিচর্যা করতেন। টম যখন উঠে বসার মতো সুস্থ হয়, সোফিয়া তাকে দেখতে আসে। এইসময় থেকে তারা ঘন্টার পর ঘন্টা পরস্পরের সঙ্গে গল্প করে। নিজের শারীরিক ক্ষতির ঝুঁকি নিয়েও যেভাবে টম সোফিয়াকে রক্ষা করেছিল, তা তার মনে গভীর রেখাপাত করে। টম সোফিয়ার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, কিন্তু মলির কথাও তার মাথায় আসে। মলি কেন্দ্রিক বিষয়টি হঠাৎই এক সমাধানের দিকে এগোয়। ব্যান্ডেজ বাঁধা হাত নিয়েই মলির বাড়িতে একদিন হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল টম। সে মলির ঘরে গিয়ে আবিষ্কার করে সম্পূর্ণ নগ্ন মিস্টার স্কোয়ারকে। টম মিস্টার স্কোয়ারকে জানায় সে এই ঘটনাটার কথা কাউকে বলবে না। মিস্টার স্কোয়ার যেন মলির দিকে খেয়াল রাখেন। টম যখন মলির বাড়ি ছেড়ে চলে আসছে তখন তার এক বোন টমকে জানায় এর আগেও মলির এক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, যার নাম উইল বার্নস। মলির পেটে যে সন্তান তার বাবা আসলে এই মিস্টার উইল বার্নসই। এই তথ্য টমের মনের ভারকে হালকাই করে দেয় কারণ সোফিয়ার সঙ্গে সম্পর্কতে তার মান আর এইবার পাপবোধে ভুগবে না।
এরপর সোফিয়াকে যখন টম দ্যাখে তার হৃদয় প্লাবিত হয়। সোফিয়ার মধ্যেও তখন একই আবেগ।
“When Sophia came near he became pale, and when her eyes met his, the blood rushed into his cheeks. Mr Western noticed nothing, but Sophia saw and understood, because she felt the same.”
মিস্টার অলওয়ার্দির অসুস্থতা উপন্যাসের ঘটনাধারায় নতুন মোচড় আনে। অসুস্থতার তীব্রতা এতই বেশি ছিল যে অলওয়ার্দি ভেবেছিলেন তিনি জীবন সায়াহ্নে এসে পৌঁছেছেন। চলে যাবার আগেই তিনি সম্পত্তির বিলি বন্দোবস্ত করে দিয়ে যান। বোনপো মাস্টার ব্লিফিল এবং স্নেহের টমকে তিনি সম্পত্তি সমানভাগে ভাগ করে দেন। তাদের দুই শিক্ষক মিস্টার থকুম ও মিস্টার স্কোয়ারের জন্যও থাকে টাকার ভাগ। কিছু টাকা ভৃত্য এবং খানসামাকুলের জন্য বরাদ্দ হয়। শেষপর্যন্ত অবশ্য তিনি চিকিৎসায় সাড়া দেন, সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে এই সময়েই এসে পৌঁছয় লন্ডনে থাকা তার বোন মিসেস ব্লিফিলের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ।
এর পর ঘটনাবলী নাটকীয় মোড় নিতে শুরু করে। মিস্টার ওয়েস্টার্নের বোন তাঁকে জানান যে সোফিয়া সম্ভবত প্রেমে পড়েছে এবং প্রেমাস্পদ বোধহয় মাস্টার ব্লিফিল।এই সংবাদ মিস্টার ওয়েস্টার্নকে খুশি করে। তিনি অলওয়ার্দি পরিবারকে তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেন। তখন সোফিয়া তার প্রকৃত আবেগকে লুকনোর চেষ্টা করে। টমকে খানিকটা অগ্রাহ্য করে এবং মাস্টার ব্লিফিলের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মেলামেশা করে। এ থেকে মিস্টার ওয়েস্টার্ন ও তার বোনের ভুল ধারণাটিই আরো পোক্ত হয়। মিস্টার অলওয়ার্দিকে আড়ালে ডেকে মিস্টার ওয়েস্টার্ন মাস্টার ব্লিফিল এবং সোফিয়ার সম্পর্কের কথাটি পারেন এবং মিস্টার অলওয়ার্দি এই সম্পর্ক বিষয়ে খুশিমনে তাঁর সম্মতি জানান। বাড়ি ফেরার পথে মিস্টার অলওয়ার্দি মাস্টার ব্লিফিলকে এই বিষয়ে জানালে ব্লিফিল বলে সে এখনও বিয়ের বিষয়ে মনস্থির করে নি, তবে মিস্টার অলওয়ার্দি এ বিষয়ে যা সিদ্ধান্ত নেবেন তাতে তার আপত্তি নেই। মিস্টার অলওয়ার্দি চিঠি লিখে মিস্টার ওয়েস্টার্নকে এই সম্মতির কথা জানিয়ে দেন। পালটা চিঠিতে মিস্টার ওয়েস্টার্ন সেদিনই মাস্টার ব্লিফিলকে তাদের বাড়িতে এসে সোফিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলেন। বোনের মাধ্যমে মিস্টার ওয়েস্টার্ন খবর পাঠান পাঠরতা সোফিয়ার কাছে। পিসির কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে সোফিয়া আকাশ থেকে পড়ে। পিসিকে সে জানায় তাদের ভুল হয়েছে। তার প্রেমাস্পদ মাস্টার ব্লিফিল নয়, টম। এই স্বীকারোক্তি তার পিসির চোখে ক্রোধাগ্নি জ্বালে। তিনি সোফিয়াকে ভৎসনা করেন বেজন্মা টমকে ভালোবাসার জন্য। ঘন্টাখানেক ধরে চলে তার তর্জন গর্জন। মিস্টার ওয়েস্টার্নকে সবকিছু জানিয়ে দেবার হুমকিও তিনি ভাইঝিকে দেন। বাবার ক্রোধ কোথায় পৌঁছতে পারে তা অনুমান করে সোফিয়া তার মিসির পায়ে কেঁদে পড়ে। কাতর অনুরোধ করে তার বাবাকে এ ব্যাপারে কিছু না জানিয়ে সমস্ত ব্যাপারটাকে গোপন রাখতে। পিসি শেষমেষ রাজি হন, তবে শর্ত দেন বিকেলে যখন মাস্টার ব্লিফিল আসবে তখন ভাবী স্বামী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েই সোফিয়াকে তার সঙ্গে মিশতে হবে। উপায়ন্তর না দেখে সোফিয়াকে রাজী হতে হয়, তবে সে অনুরোধ করে বিয়েটা কিছুদিন পেছনোর ব্যবস্থা করতে। তার পিসি কিন্তু এ বিষয়ে সম্মত হন না, বরং দ্রুত বিবাহ সেরে ফেলার জন্যই সোফিয়াকে জোর করেন।
মাস্টার ব্লিফিল আসার পর তার সঙ্গে সোফিয়াকে একাকী বেশ কিছুটা সময় কাটাতে হয়। দু চারটে কথা বলা ছাড়া সোফিয়া মূলত নীরব থাকে। মাস্টার ব্লিফিল ধরে নেন এটা সোফিয়ার নারী সুলভ লজ্জা। টম সম্পর্কে সোফিয়ার অনুরাগ এবং তার সম্পর্কে চরম বীতরাগের কিছুই মাস্টার ব্লিফিল জানতে বুঝতে পারে নি।
মাস্টার ব্লিফিল চলে যাবার পর যখন মিস্টার ওয়েস্টারন্ন সোফিয়ার কাছে আসেন তখন সে বাবার কাছে কেঁদে পড়ে জানায় মিস্টার ব্লিফিলকে সে বিয়ে করতে পারবে না। এই বিয়ে তার কাছে হবে মৃত্যুসম। মিস্টার ওয়েস্টার্ন মেয়ের এই কথায় প্রবল কূপিত হয়ে জানান এই বিয়ে তাকে করতেই হবে। যদি সে বিয়েতে সম্মত না হয়, তবে সম্পত্তির কানাকাড়িও সে পাবে না। পথের ভিক্ষুক হয়ে পড়ে থাকলেও তাকে তিনি এক টুকরো রুটি ছুঁড়ে দেবেন না। একথা জানিয়ে মেয়েকে জোরে ধাক্কা দিয়ে তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান আর সেই ধাক্কায় সোফিয়ার মাথা সজোরে মেঝেতে ঠুকে গিয়ে সে আঘাত পায়।
ক্রোধান্ধ হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে মিস্টার ওয়েস্টার্ন দেখতে পান টমকে এবং তিনি তাকে পাঠান সোফিয়াকে বোঝাতে। তখনও মিস্টার ওয়েস্টার্ন জানেন না যে টমই সোফিয়ার দয়িত। টম যখন ঘরে ঢুকে আহত সোফিয়ার সঙ্গে কথা বলছে, দুজনকেই দুজনের রক্তাক্ত হৃদয়ের কথা জানাচ্ছে, তখন পাশের ঘরে সোফিয়ার পিসি তার ভাই তথা সোফিয়ার বাবাকে সম্পূর্ণ বৃত্তান্তটি জানিয়ে দেন। মিস্টার ওয়েস্টার্ন দূর কল্পনাতেও কখনো ভাবেন নি যে তার মেয়ে টমের মতো জন্মের ঠিক ঠিকানাহীন একজনকে ভালোবাসতে পারে। তিনি আবারো ক্রোধোন্মত্ত হয়ে চিৎকার করতে করতে সোফিয়ার ঘরে ঢোকেন ও সোফিয়া তখনই টমের বাহুডোরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। একদিকে চলতে থাকে সোফিয়ার চিকিৎসা, অন্যদিকে টমকে গালিগালাজ করতে থাকেন মিস্টার ওয়েস্টার্ন।
পরদিন সকালেই মিস্টার ওয়েস্টার্ন মিস্টার অলওয়ার্দির বাড়িতে যান এবং রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে পুরো বিষয়টি খুলে বলেন। এও বলেন সোফিয়াকে তিনি তার সম্পত্তির এক কানাকড়িও দেবেন না, কারণ সে টমের মতো এক বেজন্মাকে ভালোবেসেছে। তিনি সোফিয়াকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবেন একথাও জানান অলওয়ার্দিকে। তারপর কাহ্নিক শান্ত হয়ে বলেন সোফিয়া যেন মাস্টার ব্লিফিলকে বিয়ে করে সেটা তিনি নিশ্চিত করবেন। বেজন্মা টমকে যেন সোফিয়ার থেকে দূরে রাখা হয়, সেটা মিস্টার অলওয়ার্দিকে দেখতে বলেন।
এই সময়টাকে মাস্টার ব্লিফিল তার চিরকালের শত্রু টমের বিরুদ্ধে কাজে লাগায়। এর কিছুদিন আগে মিস্টার অলওয়ার্দি যখন মারা যাবেন ভাবছিলেন তখন টম সহ সকলেই বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কদিন চিকিৎসার পর শেষমেষ তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। মিস্টার অলওয়ার্দি সুস্থ হয়ে উঠেছেন এই খবর পেয়েই আনন্দে বেরিয়ে পড়ে টম এবং মদ্যপানে নিজেকে নিমজ্জিত করে। এই ঘটনাটিকে এইবার সত্য মিথ্যা মিশিয়ে অন্যভাবে মিস্টার অলওয়ার্দির কাছে পেশ করে ব্লিফিল। জানায় মিস্টার অলওয়ার্দি মারা যাচ্ছেন এবং সে অনেক টাকা পয়সার মালিক হতে যাচ্ছে, এই আনন্দ উপভোগ করতেই টম মদ্যপানে নিমজ্জিত হয়েছিল। একটি মেয়ের সঙ্গে মাঠে শুয়েও ছিইল একসঙ্গে। মাস্টার ব্লিফিল এই নিয়ে টমকে প্রশ্ন করায় সে তাকে তখন মারধোর করে। শুধু মাস্টার ব্লিফিল না, মিস্টার থুকামও যে সেই সময়ে একই কারণে টমের হাতে প্রহৃত হয়েছিলেন, তাও সে জানায়। টমকে ডেকে ব্লিফিলের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চান মিস্টার অলওয়ার্দি। ব্লিফিল সত্য মিথ্যা মিশিয়ে ঘটনাটিকে যেভাবে উপস্থাপণ করে তাকে সর্বৈব মিথ্যা বলা টমের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ মিস্টার অলওয়ার্দির মৃত্যু হতে যাচ্ছে শুনে টম খুশি, এই অভিযোগ পুরোপুরি বানানো হলেও মাঠের মহিলা কেন্দ্রিক ঘটনা ও মারধোরের বিষয়টি পুরোপুরি মিথ্যা ছিল না। আগে অনেকবার টম সম্পর্কে মিস্টার অলওয়ার্দিকে বিরূপ করে তোলার চেষ্টা ব্যর্থ হলেও এইবার ব্লিফিলের দূরভিসন্ধি সফল হয়। প্রিয় টম সম্পর্কে অলওয়ার্দির মন পরিবর্তন ঘটে এবং তিনি তার প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে ওঠেন। টম যদিও ক্ষমা চায় মিস্টার অলওয়ার্দির কাছে, কিন্তু এইবার তিনি টমকে ক্ষমা করতে রাজী হন না। টমকে সেই মুহূর্তেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন মিস্টার অলওয়ার্দি। যদিও তাকে তিনি কিছু টাকা দিয়েছিলেন, কিন্তু রটে যায় কপর্দকশূন্য অবস্থাতেই টমকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর নিজের উচাটন অবস্থা খানিক শান্ত হলে টম প্রথমেই একটি চিঠি লেখে সোফিয়াকে। সোফিয়াকে ছেড়ে আসতে তার হৃদয় কতখানি ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, তা সে সেখানে জানায়। বন্ধু জর্জের মাধ্যমে এই চিঠি সে সোফিয়ার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। কোথায় যাবে ভাবতে ভাবতে সে সমুদ্র তীরবর্তী কোনও বন্দর অঞ্চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। অষ্টাদশ শতকের সেই পর্বে ব্রিটিশ নৌ বাণিজ্য ক্রমশ্যই ফুলেফেঁপে উঠছে এবং তা তরুণদের ভাগ্য পরীক্ষার এক আকর্ষণীয় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। টমের সিদ্ধান্তের পেছনে সেই সমকালীন বাস্তবতাকে ফিল্ডিং মাথায় রেখেছিলেন বলে আমরা সিদ্ধান্ত নিতেই পারি। কথক ফিল্ডিং এই সময় পাঠকের সঙ্গে আরেকবার সরাসরি কথা বলেন। তিনি জানান, “He decided to go to sea. But before we follow him we must return to see what has happened to the charming Sophia.”
সোফিয়াকে ব্লিফিলের সঙ্গে বিয়েতে রাজী করানোর জন্য বোনকে আরেকবার মেয়ের কাছে পাঠান মিস্টার ওয়েস্টার্ন এবং এইবারেও পিসিকে সোফিয়া সরাসরি জানিয়ে দেয় সে ব্লিফিলকে ঘৃণা করে। সে তাকে কোনওমতেই বিয়ে করবে না। এই সময়ে মিস্টার ওয়েস্টার্ন সেই ঘরে ঢোকেন এবং বোনের সঙ্গেই কলহে জড়িয়ে পড়েন। তিনি অভিযোগ করেন আগে সোফিয়া ছিল এক বাধ্য মেয়ে। কিন্তু বোনের কাছে তিন বছরের জন্য সোফিয়াকে পড়াশুনো শিখতে পাঠানোর পরেই হল সর্বনাশ। সোফিয়া সবকিছুকে অমান্য করতে শিখল। এই অভিযোগ শুনে মিসেস ওয়েস্টার্ন গাড়ি ডেকে তক্ষুণি ভাইয়ের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে সোফিয়া বাবাকে হস্তক্ষেপ করতে বলে। এও জানায় মিসেস ওয়েস্টার্ন তার সম্পত্তি থেকে হয়ত মিস্টার ওয়েস্টার্নকে বঞ্চিত করবেন। মিস্টার ওয়েস্টার্নের বিষয়বুদ্ধি ও চেতনা জাগ্রত হয় এবং তিনি অনুনয় বিনয় করে আবারো বোনকে তার বাড়িতে ফিরিয়ে আনেন। এরপরই তিনি যান মিস্টার অলওয়ার্দির বাড়িতে এবং পরদিনই যাতে সোফিয়া ও মাস্টার ব্লিফিলের বিয়ে হয়ে যায়, তার সব বন্দোবস্ত পাকা করে ফেলেন। মাস্টার ব্লিফিল এমন ভাব দেখায় যেন সোফিয়াকে সে ভালোবাসে, যদিও তার মূল লোভ ছিল সোফিয়ার পারিবারিক সম্পত্তির ওপর।
খানসামার কাছ থেকে সোফিয়া জানতে পারে পরদিনই তার বিবাহের ব্যবস্থা করা হয়্যেছে। উপয়ান্তর না দেখে সে বাড়ি ছেড়ে রাজধানী শহর লন্ডনে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়, যেখানে রয়েছে তার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়া, যিনি আগেই অনেকবার সোফিয়াকে সেখানে যাবার আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে সেই সময়ে সমারসেট থেকে বিয়াল্লিশ মাইল দূরবর্তী বন্দর শহর ব্রিস্টলের থেকে রওনা দেয় টম।
ব্রিস্টলের রাস্তায় যাবার পথে টম যখন এক সরাইখানায় আশ্রয় নেয়, সেখানে আসেন একদল সৈন্য। জানা যায় তারা রাজা দ্বিতীয় জর্জের হয়ে লড়াই করছেন এক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ১৭২৭ সালে দ্বিতীয় জর্জ সিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন। আঠারো বছর পরে ১৭৪৫ সালে চার্লস এডওয়ার্ড স্টুয়ার্ট স্কটল্যান্ড থেকে তাকে চ্যালেঞ্জ জানান। দুই বাহিনীর মধ্যে সংগঠিত ১৭৪৬ সালের এপ্রিলের কুলোডন যুদ্ধে এর নির্ণায়ক ফয়সালা হয়। সেই যুদ্ধে এডওয়ার্ড স্টুয়ার্টের বাহিনীকে রাজা দ্বিতীয় জর্জের বাহিনী পরাস্ত করে। তাদের সেই লড়াইয়ে টমের থাকে রাজনৈতিক সমর্থন। এই অংশে সমকালীন ব্রিটিশ রাজনীতির এক ঘটনাবহুল পর্বকে সামনে আনেন হেনরি ফিল্ডিং।
সরাইখানার পানরত সেনাদের মধ্যে যখন বিল মেটানো নিয়ে কলহ বিবাদ পেকে ওঠে, তখন টম সেই বিল দিয়ে দেয়। তাতে সৈন্যরা তার ওপর খুশি হয়। তবে সৈন্যদের মধ্যে নর্দানটন বলে একজন কোনও এক কারণে টমের ওপর বিরুপ হন। তিনি মদ্যপ অবস্থায় টমের সঙ্গে গল্প করার সময় যখন টমের মুখে সোফিয়ার কথা শোনেন, তখন নানা নির্জলা মিথ্যা বলেন। সোফিয়া এবং তার পিসি বাথ শহরে থাকার সময়ে অনেকেরই শয্যাশঙ্গী হয়েছে, একথা শুনে টম বোঝে ইচ্ছাকৃতভাবে নর্দানটন এসব অলীক কথা বলছেন। সে তাকে মিথ্যাবাদী বললে নর্দানটন টমের মাথায় বোতলের বাড়ি মারেন। সে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে এবং তার জীবন মরণ সঙ্কট উপস্থিত হয়। সৈন্যদলের ক্যাপ্টেন টমের সেবা শুশ্রুষার ব্যবস্থা করেন। ডাক্তার ডাকা হয়। নর্দানটন পালিয়ে গেলে কয়েকজন সৈন্যকে পাঠানো হয় তাকে ধরে আনার জন্য।
এইসময়ে সরাইখানার মালকিনের মুখে এক আশ্চর্য সংলাপ বসান হেনরি ফিল্ডিং। সেখানে সেই মহিলা জানান তিনি চান সব যুদ্ধের অবসান হোক। তাহলে জনগণকে কর কম দিতে হবে আর তারা বেশি সুখে থাকতে পারবে।
“ I hope all our enemies are killed, for then the war will end and our taxes will be lower.”
ইংলণ্ড যখন ইউরোপ ও পৃথিবীর নানা অঞ্চলে বাণিজ্য স্বার্থে যুদ্ধ করে বেড়াচ্ছে তখন সেখানকার এক নাগরিকের মুখে এই ধরনের সংলাপ বেশ উল্লেখযোগ্য।
টম তার চেতনা ফিরে পায়। তবে প্রচুর রক্তক্ষরণের পর তখনো সে বেশ দুর্বল। ক্যাপ্টেন তাকে বিশ্রাম নেবার পরামর্শ দেন। ক্রমশ তার সঙ্গে টমের সৌহার্দমূলক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একজন নাপিতকে ডাকা হয় টমকে সাফসুতরো করার জন্য। দেখা যায় নাপিত হলেও সে বেশ শিক্ষিত, মার্জিত, লাতিন ভাষাও জানে। টম বিস্মিত হয়। ক্রমশ জানা যায় সে অলওয়ার্দি পরিবার এবং টমকে আগে থাকতেই চেনে জানে। টম তার ভাগ্য বিড়ম্বনার কাহিনী এই নতুন বন্ধু নাপিতটিকে খুলে বলে। পরে জানা যায় এই নাপিত আসলে এক চিকিৎসক। আরো পরে তিনি তাকে জানান তার আসল পরিচয়। তিনি সেই পাত্রিজ, যাকে অলওয়ার্দি সমারসেট থেকে বিতাড়িত করেছিলেন।পাত্রিজ জানান যদিও সবার ধারণা ছিল, তিনিই টমের পিতা, কিন্তু তা আসল সত্য নয়। পাত্রিজ এরপর টমের যাত্রাসঙ্গী হিসেবে তার সঙ্গে পথ চলতে থাকেন। এক জায়গায় তারা দেখেন এক রমণীকে এক পুরুষ নির্দয়ভাবে মারছে। রমণীর পোশাক আশাক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। টম গিয়ে তাকে উদ্ধার করে এবং পুরুষটিকে যৎপড়নাস্তি প্রহার করে। তারপর সে তাকে চিনতে পারে। দেখ যায় সে হল নর্দানটন, যে সরাইখানায় সোফিয়া সম্পর্কে বিশ্রী অপবাদ দিয়েছিল আর টমকে প্রাণাত্মকভাবে আঘাত করেছিল। রমণীকে তার হাত থেকে উদ্ধার করে তাকে নিয়ে টমেরা পথ চলতে শুরু করে এবং আপটন শহরে এসে পৌঁছে এক সরাইখানায় আশ্রয় নেয়। জানা যায় এই মহিলা হলেন এক ক্যাপ্টেনের স্ত্রী, তার নাম মিসেস ওয়াটার্স। প্রথমে সেই অভিজাত সরাইখানার মালিক ও মালকিন ছিন্ন পোশাক পরিহিতা এই রমণীকে দেখে কটু মন্তব্য করলেও পরে তার প্রকৃত পরিচয় জেনে ক্ষমা প্রার্থণা করেন। এইসময়ে এক তরুণী তার খানসামাকে নিয়ে সেই অভিজাত সরাইখানায় প্রবেশ করেন। সরাইখানার মালকিন তাদের যথাসাধ্য আপ্যায়ণ করে দোতলার এক সুরম্য কামরায় নিয়ে যান।
মিসেস ওয়াটার্স তার কামরায় টমকে খাবার নিমন্ত্রণ জানান। তিনি সুবেশ তরুণ টমের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তাকে কোনওভাবে সেটা জানান দিতে ব্যগ্র হয়ে ওঠেন। যতক্ষণ টম প্রবল খিদে নিয়ে খেতে ব্যস্ত ছিল, ততক্ষণ সে মিসেস ওয়াটার্সের করা ইঙ্গিৎগুলির প্রতি মনোযোগী হয় নি। পরে সে সেটা টের পায় এবং নিজেও মিসেস ওয়াটার্সের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তারা সে রাতে পরস্পরের শয্যাসঙ্গী হয়। কে এই মিসেস ওয়াটার্স, কী তার বৃত্তান্ত টম সৌজন্য বশত সে সব প্রশ্ন তাকে করেন নি। কিন্তু উপন্যাসকথক মনে করেন পাঠকের সে বিষয়ে কৌতূহল জাগ্রত হয়েছে, তাই তাদের এটা জানানো প্রয়োজন।
“Though Tom was careful not to ask her questions which might embarrass her, the reader will surely want to know. So, here are the real facts.”
মিস্টার ওয়াটার্স ছিলেন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন। বিয়ে না হলেও মিসেস ওয়াটার্স তার স্ত্রী পরিচয়েই থাকতে শুরু করেন এবং তার পদবীও ব্যবহার করেন। টমকে সরাইখানায় আঘাত করে নর্দানটন পালিয়ে চলে যায় মিসেস ওয়াটার্সের কাছে। তার দুজন ছিলেন পরস্পরের বন্ধু। টম মারা গেছে ভেবে এবং এই হতাকাণ্ডের জন্য তার ফাঁসির সাজা হতে পারে ভেবে নর্দ্দানটন কোনও বন্দর দিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। মিসেস ওয়াটার্স তাকে কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করতে চান। ক্যাপ্টেন ওয়াটার্স তখন ঘরে ছিলেন না। পথ চলার সময় মিসেস ওয়াটার্সের কাছে মূল্যবান গয়্যনা এবং টাকা পয়সা আছে দেখে তাকে হত্যা করে নর্দানটন মিসেস ওয়াটার্সকে হত্যা করে সেগুলো কেড়ে নিতে উদ্যত হয়। তখনই মিসেস ওয়াটার্সের আর্তনাদ শুনে টম সেখানে উপস্থিত হন এবং তাকে উদ্ধার করেন।
টম যখন সরাইখানায় মিসেস ওয়াটার্সের শয্যাসঙ্গী সেই সময়েই সে সরাইখানায় সোফিয়া তার এক খানসামাকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে প্রবেশ করে। রান্নাঘরে সেই খানসামা পাত্রিজের সঙ্গে কথোপকথনের সূত্রে জানতে পারে টমও সেই সরাইখানায় আছে। খানসামা সূত্রে সে কথা শুনে সোফিয়া পাত্রিজকে অনুরোধ করে টমকে ডেকে দিতে। পাত্রিজ জানিয়ে দেন যে টম তখন মিসেস ওয়াটার্সের শয্যাসঙ্গী। খানসামা সুসান এই তথ্য যে ঠিক তা গিয়ে দেখে আসে। বিষাদে, ক্ষোভে সেই মুহূর্তেই সোফিয়া সেই সরাইখানা ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। যাবার আগে তার চিহ্নমাখা আংটিটি টমকে দেবার জন্য সুসানের হাতে দিয়ে যায়। সেই আংটি যখন টমের কাছে আসে সে বোঝে সোফিয়া এসেছিল। সে যখন তার পিছু নিতে সরাইখানা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেইসময়েই লোকলস্কর নিয়ে সেখানে প্রবেশ করেন সোফিয়ার বাবা ও পিসি মিস্টার ওয়েস্টার্ন ও মিসেস ওয়েস্টার্ন। তারা মেয়েকে সেই রসরায়খানায় তন্নতন্ন করে খোঁজেন কিন্তু পান না। তারা আবার সেই সরাইখানা ছেড়ে সোফিয়ার খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। মিস্টার ফিজপ্যাট্রিক, যিনি তাঁর পালিয়ে যাওয়া বউকে খুজতে এসেছিলেন এই সরাইখানায়, নিজের গাড়িতে মিসেস ওয়াটার্সকে বাথ শহরে পৌঁছে দেবার কথা বলেন।
সোফিয়া সরাইখানা থেকে বেরিয়ে লন্ডন অভিমুখে যাবার সময় দেখা পায় তার আত্মীয়া তথা তুতো বোন হ্যারিয়েটের, যখন সোফিয়া পড়াশুনোর জন্য তার পিসি মিসেস ওয়েস্টার্নের বাড়িতে ছিল, হ্যারিয়েটও তখন সেখানেই থাকত। মিস্টার ফিজপ্যাট্রিকের সঙ্গে বিয়ের পর সে এখন মিসেস হ্যারিয়েট ফিজপ্যাট্রিক। তারা এক সরাইখানায় আশ্রয় নেয় ও সেখানে পরস্পর পরস্পরকে নিজেদের দুর্ভাগ্যের কাহিনী শোনায়। হ্যারিয়েটের বিবাহ জীবন খুবই অশান্তির। মিস্টার ফিজপ্যাট্রিক নিষ্ঠুর, হিংসুটে এবং অর্থলোভী। তিনি হ্যারিয়েটের সমস্ত অর্থ হস্তগত করতে চান, তাকে মাঝেমধ্যেই ঘরে বন্দী করে রেখে দেন। একদিন হ্যারিয়েট তার বন্দিনী দশা থেকে পালাতে সমর্থ হন। ডাবলিন থেকে নৌকায় করে তিনি ইংলণ্ডে আসেন। বাথ এর পথে যেতে যেতে আপটনের সেই সরাইখানায় আসেন, যেখানে কিছু সময়ের জন্য সোফিয়াও ছিল। মিস্টার ফিজপ্যাট্রিক তাকে খুঁজতে খুঁজতে সেই সরাইখানায় এসে পৌঁছলে তাকে সেখান থেকে পালাতে হয়। সরাইখানাতে তাই তাদের দেখা হয় নি। দেখা হল দুজনেই আপটনের সরাইখানা থেকে বেরিয়ে লন্ডনমুখী রাস্তায় পথচলার সময়। তারা যখন পরস্পরকে নিজেদের বেদনাভরা জীবনকাহিনী শোনাচ্ছে তখন সেখানে আসেন হ্যারিয়্যেটের আয়ারল্যান্ডের এক বিশ্বস্ত প্রতিবেশী, এক আইরিশ লর্ড, যিনি হ্যারিয়েটকে ঘোর বিপদ থেকে পালাতে সাহায্য করেন। সেই সম্ভান্ত ধনী ব্যক্তিটি আবারও সাহায্যকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এবার হ্যারিয়েট ও সোফিয়া দুজনকেই সঙ্গীসাথীসহ তিনি তাঁর গাড়িতে লন্ডন পৌঁছে দেবার কথা জানান। দুদিনে নব্বই মাইল পথ পেরিয়ে তাঁরা অবশেষে লন্ডনে পৌঁছন। লন্ডনে পৌঁছে সোফিয়া আশ্রয় নেন তার আত্মীয়া লেডি বেলাস্টোনের বাড়িতে।
টম এবং তার যাত্রাসঙ্গী পাত্রিজ পথিমধ্যে এক ভিক্ষুকের থেকে একটি নোটবই পায় এবং দেখে সেটা সোফিয়ার পড়ে যাওয়া এক ডায়েরি। ভিক্ষুককে পুরস্কৃত করে লন্ডনের পথ ধরে টম পাত্রিজ। কথক এ সময়ে উপন্যাসের মধ্যে প্রবেশ করে তাঁর পাঠককে সরাসরি জানিয়ে দেন, “Reader, my pen will not describe the roads, the rivers and the other beauties which passed by as our travellers rode towards London.”
লন্ডনে পৌঁছে টম সোফিয়াকে খুঁজতে শুরু করে। প্রথমে যায় সেই আইরিশ লর্ড এর লন্ডনস্থ বাড়িতে। সেখান থেকে এক ভৃত্যের মাধ্যমে পায় মিসেস হ্যারিয়েট ফিজপ্যাট্রিজের বাড়ির সন্ধান পায়। হ্যারিয়েট প্রথমে টমকে কিছু না জানিয়ে ব্যস্ততার অজুহাতে পরে আসতে বলেন। সমুদয় বৃত্তান্ত হ্যারিয়েট জানান সোফিয়ার আশ্রয়দাত্রী লেডি বেলাস্টোনকে। এক চিঠিতে লেডি বেলাস্টোন টমকে এক পার্টিতে ডেকে পাঠান, যেখানে সবাই ছিল মুখোশ পরা অবস্থায়। প্রথমে টম ভেবেছিল মুখশধারী এই রমণী বোধহয় হ্যরিয়েট। পরে মুখোশ খুললে সে দেখে তিনি লেডি বেলাস্তোন। তাঁর বিষয়ে তখনো অবধি টমের কিছি জানা ছিল না। তবে সে অনুভব করছিল সোফিয়ার কাছে পৌঁছতে হলে এই রমণীর সাহায্য তার দরকার হবে। কপর্দকশূন্য টমকে লেডি বেলাস্টোন অনেকটা টাকা পয়সা দেন।
লেডি বেলাস্টোন টমের প্রতি আকৃষ্ট হন ও তার সঙ্গে বাড়ির বাইরে নিয়মিত মিলিত হতে থাকেন। একদিন যেখানে তারা মিলিত হতেন সেই বাড়িটি খালি ছিল না। বাধ্য হয়ে মিসেস বেলাস্টোন নিজের বাড়িতেই টমকে ডাকেন। সোফিয়ার সঙ্গে যাতে টমের দেখা না হয়, তাই তিনি আগেভাগেই সোফিয়াকে পাঠিয়ে দেন থিয়েটার দেখতে। নির্ধারিত সময়ের আগেই টম মিসেস বেলাস্টোনের বাড়িতে চলে যায়। তখনো মিসেস বেলাস্টোন বাড়ি ফেরেন নি। এদিকে থিয়টার ভালো না লাগায় সোফিয়া অনেক আগেই বাড়ি ফিরে আসে। ঘন্টি বাজলে সেই গিয়ে দরজা খোলে ও টমকে দেখে। ঘটনার আকস্মিকতায় সে যখন প্রায় মূর্ছিত হয়ে পড়ে যাবার উপক্রম, টম তাকে ধরে ফেলে। টম সোফিয়ার খোয়া যাওয়া ডায়েরি ও ব্যাঙ্কনোট তাকে ফিরিয়ে দেয়। আপটনের সরাইখানায় মিসেস ওয়াটার্সের সঙ্গে সম্পর্কের জন্য টম সোফিয়ার কাছে ক্ষমা চায়। মিসেস ওয়াটার্সের সঙ্গে টমের এরপর আর দেখা হয় নি শুনে সোফিয়া সন্তুষ্ট হয়। সোফিয়া জানায় সেই সরাইখানায় টম যে অচেনা অজানা সবাইকে বলে বেরিয়েছিল সে সোফিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে পেছনে ফেলে পালাতে চাইছে, তা তার খুব খারাপ লেগেছিল। তাদের কথাবার্তা চলার সময়েই মিসে বেলাস্টোন প্রবেশ করেন। তিনি সোফিয়াকে থিয়েটারের বদলে বাড়িতে দেখে অবাক হয়ে যান। মিসেস বেলাস্টোন এবং টম যে আগে থাকতেই পরস্পরকে চিনেছেন ও ঘনিষ্ট হয়েছেন, তা তারা সোফিয়ার কাছে গোপন রাখেন। টম চলে যাবার পর এই অজানা যুবক কে তা সোফিয়ার কাছে জানতে চান মিসেস বেলাস্টোন এবং ভাণ করেন যেন এই প্রথমবার তিনি টমকে দেখলেন।
মিসেস বেলাস্তোন ভাবতে থাকেন কীভাবে টমের থেকে সোফিয়াকে দূরে সরানো যায়। সেই সুযোগও তার হাতে আসে পরদিন সকালেই। তার এক বন্ধু লর্ড ফেলামার সোফিয়াকে বেশ পছন্দ করে ফেলেছিলেন।আগের দিন সোফিয়া থিয়েটার হল ছেড়ে কেন আগে চলে এল, সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে কিনা এসব জানার অছিলায় তিনি আসেন লেডি বেলাস্টোনের বাড়িতে। লেডি বেলাস্টোন বুঝতে পারেন লর্ড ফেলামারের আকুতি ও জিজ্ঞাসা করেন তার আত্মীয়া সোফিয়াকে লর্ড ফেলামারের মনে ধরেছে কিনা, তিনি তাকে বিয়ে করবেন কিনা। লর্ড ফেলামার ইতিবাচক উত্তর দিলে তিনি কথাটা সোফিয়ার বাবার কাছে বলবার প্রতিশ্রুতি দেন। লর্ড ফেলামারকে লেডি বেলাস্টোন জানান টম বলে এই ভালোবাসায় তার এক প্রতিদ্বন্দ্বী আছে। সেও সোফিয়াকে ভালোবাসে। তবে টম কপর্দকশূন্য আর তার জন্মেরও ঠিক নেই। বিষয়টাকে কীভাবে কাজে লাগাবেন তা লর্ড ফেলামারকে তিনি ভাবতে বলেন। সেদিন সন্ধ্যায় লর্ড ফেলামার আবার লেডি বেলাস্টোনের বাড়িতে এসে যখন সবেমাত্র সোফিয়াকে প্রেম প্রস্তাব দিয়েছেন ও সোফিয়া শোনামাত্র তা খারিজ করেছে, সেই সময়ে নাটকীয়ভাবে সেখানে প্রবেশ করেন সোফিয়ার বাবা মিস্টার ওয়েস্টার্ন। তার সামনেও লর্ড ফেলামার আর একবার সোফিয়াকে বিবাহ প্রস্তাব দেন, কিন্তু মিটার ওয়েস্টার্ন তা ক্রুদ্ধভাবে প্রত্যাখ্যান করে সঙ্গে আনা গাড়িতে সোফিয়াকে তুলে বেরিয়ে যান। গোটা ঘটনা দেখে খানসামা অনার ছুটে যায় টমের কাছে ও তাকে সবটা খুলে জানায়। উপন্যাস কথক পাঠককে জানিয়ে দেন মিসেস ওয়েস্টার্নকে হারিয়েট ফিজপ্যাট্রিকের লেখা চিঠির সূত্র ধরে কীভাবে মিস্টার ওয়েস্টার্ন সোফিয়ার অবস্থান জানতে পেরেছিলেন।
টম লেডি বেলাস্টোনকে এড়িয়ে চলবে ঠিক করে, কিন্তু তাদের সম্পর্ককে কীভাবে শেষ করবে তা বুঝতে পারে না। এই সময়ে তার পরামর্শদাতা হিসেবে এগিয়ে আসেন তার লন্ডনস্থিত বন্ধু মিস্টার নাইটিঙ্গেল। তিনি টমকে জানান টমের উচিত লেডি বেলাস্টোনকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠানো। লেডি বেলাস্টোন কখনোই বিয়েতে রাজি হবেন না। এর আগেও তিনি এরকম অনেক তরুণ যুবককে প্রেমের জালে ফেলেছেন কিন্তু বিবাহে এগোন নি। এক্ষেত্রেও নিশ্চিত তাই করবেন। টম বন্ধুর পরামর্শ মেনে চিঠিলেখে এবং জবাবী চিঠিতে মিসেস বেলাস্টোন জানিয়ে দেন, “I see your purpose. You wish me to put my whole fortune in your power. Do you imagine that I am a fool? If you come to my house again I shall not be at home.” টমের উদ্দেশ্য সফল হয়, সে নিজের ওপর দায় না নিয়েই মিসেস বেলাস্টোনের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে মুক্ত হতে পারে।
মিস্টার ওয়েস্টার্ন মেয়ে সোফিয়াকে নিয়ে যান লন্ডনের পিকাডেলি অঞ্চলে তার ডেরায়। সেখানে গিয়ে তিনি মাস্টার ব্লিফিলকে যেন মেয়ে বিয়ে করে, তার জন্য আর এক দফা কড়া নির্দেশ দেন। সোফিয়া গররাজি হলে তিনি মেয়েকে ঘরে তালাবন্ধ করে আটকে রাখেন আর জানিয়ে দেন ব্লিফিলকে বিয়ে করতে রাজি না হলে এই ঘর থেকে সে মুক্তি পাবে না। মিস্টার ওয়েস্টার্ন তার যে সমস্ত চাকরদের লন্ডনে এনেছিলেন তার মধ্যে টমের বন্ধু জর্জও ছিল। সে সোফিয়াকে খাবারের সঙ্গে একদিন টমের লেখা একটা চিঠিও পৌঁছে দেয়, যেখানে টম জানিয়েছে সোফিয়া চাইলে টম তাকে আগের মতোই ভালোবাসে এবগ সোফিয়া চাইলে তাকে সে নিজের বাহুডোরে গ্রহণ করবে সানন্দে তবে যদি সোফিয়া তার বাবার নির্দেশকেই শিরোধার্য করবে বলে ঠিক করে থাকে, তাকেও সে মেনে নেবে। এই সময়েই মিস্টার ওয়েস্টার্নের বোন সেখানে এসে পৌঁছন এবং সোফিয়াকে বন্দী করে রাখার জন্য দাদাকে যৎপরোনাস্তি আক্রমণ করেন। ঘরের মেয়েরা যে দাসীবাঁদী নয়, তাদের ইচ্ছামতো এইভাবে বন্দী করে রাখা অন্যায়, সেকথা জোরের সঙ্গে জানানোর পাশাপাশি তিনি মিস্টার ওয়েস্টার্নকে এও জানান এই জায়গাটা সোফিয়ার থাকার উপযুক্ত নয়। তিনি সোফিয়াকে নিজের আবাসে নিয়ে যেতে চান। মিস্টার ওয়েস্টার্ন সম্মত হন। মিসেস ওয়েস্টার্নের আস্তানায় যায় সোফিয়া এবং সেখান থেকে টমকে চিঠির প্রত্যুত্তর পাঠায়। জানায় সে তার পিসিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে টমের সঙ্গে সে সম্পর্ক রাখবে না। তবে সে অন্য কোনও পুরুষকে বিয়ে করবে না বলেও টমকে লেখে।
মাস্টার ব্লিফিল লন্ডনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই মিস্টার ওয়েস্টার্ন তাকে নিয়ে বোনের বাড়িতে চলে এসেছিলেন। কিন্তু সোফিয়া আর ব্লিফিলের সাক্ষাৎকারকে মিসেস ওয়েস্টার্ন সন্ধ্যা অবধি পিছিয়ে দেন। লর্ড ফেলামারের কথা সোফিয়ার কাছ থেকে জেনে তিনি ভাইঝির সঙ্গে এই সম্পর্কটি কেমন দাঁড়াবে তা খতিয়ে দেখতে চান। লর্ড ফেলামাররের বিবাহ প্রস্তাব নিয়ে পাঠানো দূতকে মিস্টার ওয়েস্টার্ন মেরে তাড়িয়ে দিলেও সোফিয়া সম্পর্কে তখনো লর্ড ফেলামার প্রবল আশাবাদী ছিলেন। তিনি তার বন্ধু মিসেস বেলাস্টোনকে এই বিষয়ে কিছু করা যায় কীনা তা দেখতে অনুরোধ করেন। টমের প্রতি ততদিনে বিদ্বিষ্ট হয়ে ওঠা মিসেস বেলাস্টোন লর্ড ফেলামারকে পরামর্শ দেন টমকে অপহরণ করার ব্যবস্থা করতে। অন্যদিকে টমের বিবাহ প্রস্তাব পাঠানো চিঠিটি মিসেস ওয়েস্টার্নের হাতে তুলে দিয়ে মিসেস বেলাস্টোন বলেন এই চিঠিটি টমের বিরুদ্ধে সোফিয়ার মনকে বিষিয়ে দিতে ব্যবহার করতে। এই চিঠি সত্যিই সোফিয়ার মনকে বিরূপ করে তোলে ও দু লাইনের এক স্পষ্ট চিঠিতে সে টমকে জানিয়ে দেয়, “My aunt has just shown me a letter which you wrote to Lady Bellaston. I never want to hear your name again. - SW”
টম সোফিয়ার বিষয়ে সাহায্য চাইতে যখন মিসেস হ্যারিয়েট ফিজপ্যাট্রিকের বাড়ির দরজায় উপস্থিত, তখন মিসেস ওয়েস্টার্নের থেকে খবর পেয়ে সেখানে হাজির হন মিস্টার ফিজপ্যাট্রিকও। টমকে তার স্ত্রী হ্যারিয়েটের প্রেমিক ভেবে নিয়ে ক্রোধান্ধ মিস্টার ফিজপ্যাট্রিক তাকে আক্রমণ করেন। টম তাকে পালটা আঘাত করলে তিনি প্রায় মৃত্যুমুখে পতিত হন। ডাক্তার জানিয়ে দেন মিস্টার ফিজপ্যাট্রিক মরতে চলেছেন। পুলিশ এসে টমকে গ্রেপ্তার করে। খুনের অপরাধে তার ফাঁসির সাজা হবার কথা। কথক উপন্যাস পাঠককে জানান – “Fortune now threatens to see our hero hanged in public, and if our reader enjoys such scenes, I think he should book a seat in the first row now. This I faithfully promise: if he does not find some natural means to escape a sad end, I will not help him with unnatural means.”
মাস্টার ব্লিফিলকে নিয়ে লন্ডনে আসা মিস্টার অলওয়ার্দির কাছে টমের খুন করে গ্রেপ্তার হওয়ার খবর যায়। মিস্টার ওয়েস্টার্ন টমের ফাঁসি হবার সম্ভাবনার কথা শুনে আনন্দে নাচতে থাকেন। টম কারাগার থেকে সোফিয়াকে একটি চিঠি লেখে। তা পড়ে সোফিয়া সারারাত কাঁদে। এই সংবাদ পেয়ে মিসেস ওয়েস্টার্ন আবার তার ভাইঝির ওপর ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন। বলেন পরদিন সকালেই তিনি সোফিয়াকে মিস্টার ওয়েস্টার্নের কাছে পাঠিয়ে দেবেন।
টম কারাগারে একদিন দেখে তাকে দেখতে এসেছেন মিসেস ওয়াটার্স। আপটনের সেই সরাইখানায় টমের সঙ্গে সহবাসের পর মিস্টার ফিজপ্যাট্রিকের সঙ্গে তার সম্পর্ক হয় এবং তারা বিয়ে না করে স্বামী স্ত্রীর মতো থাকা শুরু করেন। লন্ডনে টমের সঙ্গে সেই মারামারির পর তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন বটে, তবে এখন সেরে উঠছেন। তার মৃত্যুর সম্ভাবনা নেই। এই খবর টমকে আনন্দিত করে, স্বস্তি দেয়। তবে মিসেস ওয়াটার্স টমকে দেখে বেরিয়ে যাবার পরেই সেখানে ছুটে আসেন মিস্টার পাত্রিজ। তিনি মিসেস ওয়াটার্সের সঙ্গে টমের শয্যাসম্পর্ক হয়েছে জেনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কারণ এই মিসেস ওয়াটার্সই হলেন জেনি জোনস। পাত্রিজ জানতেন যে জেনি জোনসই টমের মা। টম যখন এটা জেনে প্রবল আতঙ্কত তখনই মিসেস ওয়াটার্সের কাছ থেকে এক বার্তা আসে, যেখানে তিনি জানান তিনি পরের সাক্ষাতে কিছু খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা জানাবেন। মিসেস ওয়াটার্স তথা জেনি জোনস চলে আসেন মিস্টার অলওয়ার্দির কাছে। সেখানে তখন পাত্রিজও ছিলেন। তিনি জানান টমের বাবা হলেন মিস্টার অলওয়ার্দির বাড়িতে একদা আসা এক ছাত্র, যার নাম ছিল মিস্টার সামার। তিনি অকালে মারা যান। মারা যাবার আগে তার সঙ্গে গোপনে সম্পর্ক হয়েছিল অলওয়ার্দির বোন মিস অলওয়ার্দির, যিনি পরে মিস্টার ব্লিফিলের সঙ্গে বিবাহসূত্রে মিসেস ব্লিফিল হবেন। মিস্টার সামার ও মিস অলওয়ার্দির সম্পর্কসূত্রে যে সন্তানের জন্ম সেই হল টম। প্রাক বিবাহের সন্তান বলে মিস অলওয়ার্দি কোনওদিনও একথা কাউকে জানাতে পারেন নি। জেনি জোনসের সাহায্য সহযোগিতায় তিনি সন্তানের জন্ম দেন ও জেনি জোনসই এই নবজাতককে মিস্টার অলওয়ার্দির বিছানায় গোপনে শুইয়ে দেয়। এরপর থেকে যাকে সন্তানস্নেহে মিস্টার অলওয়ার্দি লালন পালন করেছেন, সেই টম জোনস আসলে তার বোনপো। মিস অলওয়ার্দি তথা মিসেস ব্লিফিলের উকিল আসার পর এই তথ্য সমর্থন করেন এবং জানান তিনি ভেবেছিলেন মিস্টার অলওয়ার্দি এটা আগেই জানতেন। কারণ মৃত্যুর আগে মিসেস ব্লিফিল শেষ চিঠিতে তার ভাইকে সবটাই জানিয়ে গিএছিলেন। মিস্টার অলওয়ার্দি জানান তিনি নিজেই তখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। সেই চিঠি তিনি তখন পান নি। পরেও পান নি। জানা যায় মাস্টার ব্লিফিল সেই চিঠি পেয়ে সেটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল। তিনি মাস্টার ব্লিফিলকে সেই চিঠি নিয়ে আসতে বলেন।
এরপর মিস্টার অলওয়ার্দি যান সোফিয়ার কাছে। তাকে সব কথা খুলে বলেন। মাস্টার ব্লিফিলের পরিবর্তে টমের সঙ্গেই সোফিয়ার বিবাহের প্রস্তাব রাখেন। এই সময়ে কারাগার থেকে টমের মুক্তির খবরও এসে পোঁছয়। মিস্টার ওয়েস্টার্ন টমের প্রতি রূঢ় আচরণের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেন ও শুরুর দিনগুলোর সৌহার্যমূলক সম্পর্কে ফিরে যেতে চান। টম সোফিয়ার কাছে তার পরনারী গমন সহ অন্যান্য অপরাধগুলির জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমা চায় এবং বলে এর আর পুনরাবৃত্তি হবে না। সোফিয়া টমকে খুশি মনে বরণ করে। মিস্টার অলওয়ার্দি টমকে বিপুল সম্পত্তি দেন। টম সোফিয়ার বিবাহের সংবাদে উপন্যাসের আনন্দময় সমাপ্তি ঘটে।
নাটকীয় উত্থান পতনে পরিপূর্ণ এক আকর্ষণীয় প্লট যদি টম জোনস নামক উপন্যাসটির আকর্ষণের একটি প্রধান দিক হয়, অন্যটি অবশ্যই চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে ফিল্ডিং এর দক্ষতা ও বাস্তবতাবোধ। এই উপন্যাসে একদিকে কিছু টাইপ চরিত্র আছে।এই বিশালাকার উপন্যাসে সব চরিত্রই রাউন্ড হবে, তা আশা করাও যায় না। মিস্টার অলওয়ার্দি যদি দানধ্যান ও উদার হৃদয়ের প্রতিমূর্তি হন, তার বিপরীতেই আছেন জমিদারী ঠাঁটবাটে মজে থাকা ও বিষয় সম্পত্তির স্বার্থের দৃষ্টিতে সবকিছুকে দেখা মিস্টার ওয়েস্টার্ন। মাস্টার ব্লিফিল আদ্যন্ত এক মিচকে, স্বার্থপর, ছোট মনে মানুষ হিসেবেই এখানে উপস্থাপিত। নারী চরিত্রদের মধ্যে বেশ কয়েকজন শরীরী সম্ভোগে প্রবল আগ্রহী এবং পুরুষদের প্রলুব্ধ করতে পটু। এদের মধ্যে সমাজের নিম্নকোটির মলি বা মিসেস ওয়েটার্স যেমন আছেন, তেমনি আছেন উচ্চকোটির মানুষ লেডি বেলাস্টোন। নারীকে নৈতিকতার দৃষ্টিকোণেই দেখতে চেয়েছিলেন সমকালিন ঔপন্যাসিক স্যামুয়েল রিচার্ডসন। হেনরী ফিল্ডিং কিন্তু নারীর জীবন ও যৌন তৃষ্ণাকে সবিস্তারে উপস্থাপণ করতে দ্বিধাবোধ করেন নি।
তবে এই উপন্যাসের মূল আকর্ষণ নিঃসন্দেহে এর নায়ক টম জোনস, যে ভালো মন্দ, ঠিক ভুলের নানা সমন্বয়ে প্রতিমুহূর্তে পাঠককে আকর্ষণ করে রাখে। টম জোনস সোফিয়াকে ভালোবেসেছে এবং সেই সম্পর্কের জটিলতার নানা পর্বে নানা নারীর সঙ্গে শরীর মনের দেওয়া নেওয়ায় জড়িয়ে পড়েছে। মলি সিগ্রিমস, মিসেস ওয়েটার্স এবং লেডি বেলাস্টোন – অসম বয়সের এই তিন নারীই টমকে প্রলুব্ধ করেছে এবং টমও সেই আহ্বানে সাড়া দিতে দ্বিধা করে নি। এর পাশাপাশি টম একজন সহৃদয় দয়ালু ব্যক্তি। জর্জ সিগ্রিমস থেকে পাত্রিজ – নানাজনকে বিপদে আপদে সে সর্বদাই সাহায্য করতে উৎসুক। শ্রেণিগত কোনও উচ্চমন্যতা তার মধ্যে নেই, বরং সে এই বিষয়টিকে ভাঙতেই চায়। জমির পরিচর্যাকারী জর্জ ও তার পরিবারের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের মধ্যে এর পরিচয় আছে।
সোফিয়া চরিত্রটি রোমান্টিক নারী চরিত্রের চিরন্তন আদলে তৈরি। আরামদায়ক পারিবারিক জীবন, মর্যাদাপূর্ণ সামাজিক অবস্থান, বিপুল জমিদারি সম্পত্তির উত্তরাধিকার – সবই সে ছাড়তে তৈরি তার মনের মানুষটিকে পাবার জন্যে। জমিদার ওয়েস্টার্ন সম্পত্তির লোভে ব্লিফিলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য তার ওপর কম শাসন দমন চালান নি। কিন্তু সোফিয়াকে কিছুতেই টমের প্রতি নিবেদিত শপথ ও স্বপথ থেকে সরানো যায় নি। ব্লিফিলের সমস্ত প্রলোভনকেও সে অক্লেশে প্রত্যাখ্যান করেছে। পিসিমার তর্জন গর্জন বা উপদেশ বর্ষণ কোনও কিছুই তাকে টলাতে পারে নি। সে কেবল বিহ্বল হয়েছে যখন জেনেছে তার প্রেমাষ্পদ টম অন্য নারীতে বারবার আসক্ত হচ্ছে, তাদের সঙ্গে শয্যা ভাগ করে নিচ্ছে। এইসব খবর তাকে এতটাই উদ্বেল করে তুলছে সে সচেতন প্রয়াসে তার মনকে সরিয়ে আনতে চাইছে টমের দিক থেকে, প্রতিজ্ঞা করছে তাকে জীবন থেকে মুছে ফেলার, কিন্তু তার অবচেতন মন আবার টমের দিকেই ছুটে যাচ্ছে প্রবল আকর্ষণে, উন্মুখ হয়ে থাকছে তার ফিরে আসার জন্য। হেনরি ফিল্ডিং এর স্বদেশী পাঠকের মনে না এলেও ভারতীয় পাঠক সোফিয়া চরিত্রটি প্রসঙ্গে বৈষ্ণব সাহিত্যের শ্রীরাধিকার কথা না ভেবে পারেন না। কৃষ্ণের এক নারী থেকে অন্য নারীতে গমন রাধাকে বিমর্ষ ও ক্ষুব্ধ করে, কৃষ্ণের থেকে তিনি সচেতন মনে সরে আসতে চান, কিন্তু তার অবচেতন মনটি সর্বদাই কৃষ্ণপ্রেমে আকুল হয়ে থাকে। সামাজিক সমস্ত বিধিনিষেধকে পেরিয়ে কৃষ্ণকে নিজের করে নেবার জন্য অজস্র প্রতিবন্ধকতা ও যন্ত্রণাকে তিনি হাসিমুখে মেনে নেন। দেশকালের ভিন্নতা পেরিয়ে সোফিয়া ও রাধিকা কোথাও একাকার হয়ে যায়।