কিক অফ : কুর্দ সিনেমায় এক ঘরছাড়া জাতির কথা ও কাহিনী

কুর্দ এমন এক জাতি যাঁদের নিজেদের কোনও ভৌগলিক দেশ নেই। তাঁরা তুরস্ক, সিরিয়া, ইরান, ইরাক, এই চারটে দেশের মধ্যে বিভক্ত। সর্বত্রই তাঁরা সংখ্যালঘু যদিও ইরাকে তাঁদের নিজেদের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল কুর্দিস্তান আছে। রাষ্ট্র এবং প্রতিটি দেশের সরকার তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখে, তাঁদের চোখে কুর্দরা সবাই সন্ত্রাসবাদী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী না হলেও তাঁরা স্বাধীনতাকামী, নিজেদের জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে উদগ্রীব। এই চারটি দেশই কমবেশি কুর্দদের আলাদা জাতিগত পরিচিতি অস্বীকার করে, তাঁদের ভাষা, সংস্কৃতিকে মান্যতা দেয় না, তাঁদের বৃহত্তর, সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মসাৎ করে নিতে চায়। হাজার বছর ধরে কুর্দরা এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এসেছে। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে বিশেষ করে ইরাকে সরকারি বাহিনী ও কুর্দদের মধ্যে সংঘর্ষ চরম আকার ধারণ করে। সত্তরের দশকে জাতিসত্তার আন্দোলন আরও তীব্র হয়, হাজারো কুর্দ শহীদ হন, আরও বহু হাজার পাশ্ববর্তি ইরানে পলায়ন করে।  

সদ্য সমাপ্ত ২৯তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পরিচালক শৌকত আমিন কোর্কির ২০০৯এর ছবি ‘কিক অফ’ প্রদর্শিত হয়। শৌকত আমিনের জন্ম ১৯৭৩ সালে, ইরাকের কুর্দিস্তানের জাখো নামক স্থানে। সেনাবাহিনীর প্রবল নিপীড়নের কারণে তাঁর পরিবার দু বছর বাদে ইরানে পলায়ন করে। চব্বিশ বছর বাদে ইরাকে ফিরে তিনি পরিচালনার কাজ শুরু করেন। ২০০৬য়ে তাঁর প্রথম ছবি ‘ক্রসিং দ্য ডাস্ট’ সিঙ্গাপুর চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালকের পুরস্কার জেতে। ‘কিক অফ’ তাঁর দ্বিতীয় ছবি।  

কির্কুক শহরে একটি পরিত্যাক্ত স্টেডিয়ামে কিছু উদ্বাস্তু পরিবারের জীবনকে কেন্দ্র করে এই ছবির কাহিনী গড়ে উঠেছে। আমেরিকানদের গুন্ডাগিরির কারণে ইরাক তখন গৃহযুদ্ধের আবর্তে বিদীর্ণ, চতুর্দিকে হিংসা ও সন্ত্রাস। কির্কুক শহরে নানা জাতির বাস, নানা জঙ্গি গোষ্ঠী এখানে সক্রিয়। শহরের উপান্তের এই স্টেডিয়ামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঝুপড়িতে বসবাস করে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া মানুষ। উদ্বাস্তু এই শিবির শহরের ক্ষুদ্র সংস্করণ; কুর্দ, আরব, তুর্কি, অ্যাসিরিয়া মানুষদের বসবাস এখানে। নাগরিক সুবিধা ক্যাম্পে নেই বললেই চলে। জলের প্রবল অভাব। শহর থেকে জলের ট্যাঙ্ক আসে, জলের লাইনে হুড়োহুড়ি, ঝগড়াঝাটি। পুরসভার আধিকারিকরা মাঝেমধ্যেই পুলিশ-পরিবৃত্ত হয়ে শিবিরে হানা দেয়, জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য বাসিন্দাদের হুমকি দেয়। মানুষ তাদের ঘিরে ধরে বলে, সাদ্দামের সময়ে উচ্ছেদ হয়ে তারা এখানে আশ্রয় নিয়েছে, বিকল্প ব্যবস্থা না করলে তারা জায়গা ছাড়বে না। সাদ্দাম হুসেনের ঘাড়ে দোষ দেওয়া তখন নিরাপদ, মাত্র কয়েক মাস আগেই তিনি আমেরিকান বাহিনীর হাতে কোতল হয়েছেন।  

শিবিরের ছেলে ছোকরারা ফুটবল খেলা নিয়ে মেতে থাকে, স্বপ্ন দেখে। তারা আসো নামে এক যুবক ও তার বন্ধুর নেতৃত্বে ছোট একটা টিভি যোগাড় করে এশিয়ান কাপ ফাইনালে ইরাক ও সৌদি আরবের খেলা দেখার আয়োজন করে। বন্ধু নিশ্চিত ইরাক জিতবে কারণ দলে কুর্দ খেলোয়াড় আছে। কুর্দিস্তান একদিন বিশ্ব কাপ জিতবে, সে সবাইকে উল্লসিত হয়ে বলে। এক প্রৌঢ় তাকে আওয়াজ দেয়, কুর্দরা হেরো, তারা কখনো কিছু জেতেনি। একটু তফাত থেকে আসোর ভাইও খেলা দেখে। তার একটি পা নেই, অন্যদের সাথে মিশতে সে কুণ্ঠা বোধ করে। একদিন খেলতে খেলতে বল্ গিয়ে পড়েছিল, মাইন-অধ্যুষিত একটা ঘেরা জায়গায়। সতর্ক করার জন্য জায়গাটায় কয়েকটা খুলির ছবি পোঁতা। সে সতর্কতা উপেক্ষা করে, পা টিপে টিপে বলটা আনতে যায়……….

ইরাক জেতে, সবাই উল্লাস করে। পাশের ঝুপড়ির মেয়েটির সাথে আসোর মাঝেমাঝে চোখাচুখি হয়, তাকে সে একটা কবিতার বই দেয়। আকাশে হেলিকপ্টার ঘোরাফেরা করে, চাপা বিস্ফোরণের আওয়াজ, ধোঁয়ার কুন্ডলি এঁকেবেঁকে ছড়িয়ে পড়ে, কয়েকজন স্টেডিয়ামের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দূরে সেই ধোঁয়ার উৎস চাক্ষুষ করে। শহর থেকে ভ্যান নিয়ে ফেরিওয়ালা আসে। সবাই টুকটাক জিনিস কেনে। আসো জার্সি কিনতে চায়, তার মাথায় নতুন আইডিয়া, সে একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট করতে চায়, চার সম্প্রদায়ের চারটে টিম! ফেরিওয়ালা তাকে ধমক দেয় ওসব শহরে পাওয়া যায়, সেখানে যেতে ভয় পাও কেন তুমি? ইতিমধ্যে আরও জাঁদরেল এক অফিসার আরও বড় পুলিশ বাহিনী নিয়ে এসে হাজির, অবিলম্বে আসোদের জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে। আসো তাদের টুর্নামেন্টের কথা বলে, এমনকি শহরের কেবল টিভিকেও সে খবর দেয়। মেয়েটির বাবা অন্যত্র কাজ পেয়েছে, তার পরিবার তল্পিতল্পা গুটিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যায়। আসো গ্যালারির ওপরে উঠে তাকে শেষবার দেখার চেষ্টা করে।

আকাশে আবার যন্ত্রপাখি উড়ে বেড়ায়, দিগন্তবিস্তৃত নীলের মাঝে কালো ধোঁয়ার আঁকিবুকি। চার দল তৈরি, টুর্নামেন্ট শুরু হবে, কেবলওয়ালাও এসে গেছে। গোল বাঁধে রেফারিকে নিয়ে, আসোকে কেউ রেফারি মানতে রাজি নয়। সে কুর্দ, নিজের দলকে টেনে খেলাবে! একই কারণে কেউ তুর্ক, আরব বা অ্যাসিরিয় কাউকে রেফারি মানতে রাজি নয়। হঠাৎ চোখে পড়ে টিভির ক্যামেরাম্যান এক শ্বেতাঙ্গ, সেই হতভম্ব লোকটাকে সবাই রেফারি হিসাবে মেনে নিতে রাজি। মুসলিম জাতি উপজাতিগুলির মধ্যে কি পরিণাম অবিশ্বাস, বিদ্বেষ যে বিদ্যমান তা এই ছোট ঘটনাতেই পরিচালক বুঝিয়ে দেন। খেলার মাঝে বল ফেটে যায়। নিরুপায় আসো স্কুটারে চেপে বন্ধুকে নিয়ে শহরে বল আনতে যায়। তার ভাই স্নানঘরে, তার হাতে ব্লেড, কবজি দিয়ে রক্ত ঝড়ছে। মেয়েটির পরিবার ফিরে আসে। চারিদিকে রাস্তা অবরোধ, অন্যত্র যাওয়ার উপায় নেই। প্রবল এক বিস্ফোরণ, আসোর বন্ধু স্কুটারের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, দড়ির ওপরের জামাকাপড় অস্বাভাবিক ভাবে দুলে ওঠে, গোলপোস্টের নেট যেন ঝলসে ওঠে, চারিপাশে একটা ধুম্রঝড়, দু হাত দূরের কোনোকিছু দেখা যায় না……….

মানো খলিলের জন্ম সিরিয়ার কুর্দ অধ্যুষিত অঞ্চলে। তাঁর বাবা তুরস্কের ও মা সিরিয়ার কুর্দ অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর স্কুলে কুর্দ ভাষা বলা নিষিদ্ধ ছিল। ভুল করে কেউ কুর্দ বলে ফেললে তাকে প্রহার করা হত। তাঁর পরিবার সুইজারল্যান্ডে আশ্রয় নেয়। বহু বছর বাদে তিনি যখন সিরিয়ায় ফিরে যান তখন একটি পত্রিকায় তাঁকে কুর্দ ছাত্র বলে অভিহিত করা হয়। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, অভিযোগ কেন সে নিজেকে কুর্দ বলে পরিচয় দিচ্ছে যখন দেশে সেই জাতির কোনও অস্তিত্বই নেই।

তাঁর তথ্যচিত্র ‘বিকিপার’ (Beekeeper) আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া ফেলে। এটা ইব্রাহিম গেজার নামে এক তুর্কি কুর্দের জীবনের কাহিনী। তুরস্কের সেনা পার্বত্য অঞ্চলে তাঁর ঘরবাড়ি ধ্বংস করে, তাঁর পরিবারকে হত্যা করে। দেশে কয়েক বছর গোপনে থাকার পর তিনি সুইজারল্যান্ডে পলায়ন করেন এবং চৌষট্টি বছর বয়সে পুনরায় মৌমাছি পালন শুরু করেন। চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর সাম্প্রতিক ছবি ‘সোয়ালো’ দেখান হয়। ছবিটির মূল চরিত্র মীরা সোয়ালো পাখির মতো নীড়ে ফিরে আসতে চায়। কুর্দ মেয়ে মীরা ছবির মতো সুন্দর এক শহরে প্রেমিকের সাথে নতুন সংসার শুরু করার অপেক্ষায়। সে খুশি কিন্তু তবুও তার মনে শান্তি নেই, তার পিতা বহু বছর ধরে নিখোঁজ। তার খোঁজে সে ইরাকের কুর্দিস্তানে চলে যায়। বিদেশিনি হওয়ার কারণে সেখানে সে সবার চোখে পড়ে, সবাই যেন তাকে সন্দেহের চোখে দেখে। হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় যখন সে ফটো তোলে, রাইফেল উচিয়ে পুলিশ ধেয়ে আসে, তার ক্যামেরা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তাকে বাঁচাতে এক যুবক এগিয়ে আসে, তার নাম রামো। তার নিজের গাড়ি আছে, সে কুর্দিস্তান নিজের হাতের তালুর মতো চেনে। মীরার পিতার অন্বেষণে সে তার সঙ্গী হয়। এই খোঁজ তাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে যায়, সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে পুলিশ তাদের গাড়ি বারবার তল্লাশি করে, এমনকি রামোকে নিগ্রহ করে। একই সাথে এই সফর তাদের নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলে। মীরা যখন রামোর বাড়িতে যায় তার পরিবার কিন্তু তাকে মেনে নিতে পারে না, বিশেষ করে তার মা। রামোর পিতাকে পেশমের্গা (কুর্দ গেরিলা যোদ্ধা) সন্দেহে ইরাকি সেনা তার গ্রামে তাকে খুন করেছিল, বেইমান কুর্দরা তাদের সঙ্গ দিয়েছিল। রামোরও স্বপ্ন সে পেশমের্গা হবে, কিন্তু মীরার সাথে ঘুরে বেড়াবার কারণে সে কুর্দ জঙ্গিদের নজরে পড়ে যায়।

উদ্বাস্তু, অভিবাসী হওয়ার যন্ত্রণা কুর্দ, প্যালেস্টিনিয়ান, রোহিঙ্গাদের মতো বিশ্বে বোধকরি আর কোনও সম্প্রদায়ই এতো তীব্র ভাবে উপলব্ধি করতে পারবে না। গার্ডিয়ান পত্রিকার সাথে একটি সাক্ষাৎকারে খলিল বলছেন ধনী দেশগুলো উদ্বাস্তুদের একটা ব্যাধি হিসাবে দেখে, এটা নিয়ে তারা আলোচনাই করতে চায় না। তারা তাদের ঘরবাড়ি, বৈভব আর কারো সাথে ভাগ করে নিতে চায় না। তাদের কে বোঝাবে যে উদ্বাস্তুরা তাদেরই মতো মানুষ, তাঁদের সন্তান আছে, তাঁদেরও জীবনে হাসিকান্না আছে। এই একবিংশ শতাব্দীতেও তারা আশ্রয়প্রার্থীদের সাথে যে ভাবে ব্যবহার করে তা লজ্জার! সিরিয়ায় তার বাড়ি আইসিস (ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক এন্ড লেভান্ত) ধ্বংস করে দিয়েছে। তাঁর অনেক বন্ধুরা পেশমের্গা হতে চান, খলিলের হাতিয়ার সিনেমা, সেলুলয়েডের পর্দায় তিনি তাঁর জাতির আশা-আকাঙ্খা, সুখদুঃখ ফুটিয়ে তুলতে চান।