স্বয়ংসম্পূর্ণা আশাপূর্ণা

জনপ্রিয়তা আর ক্লাসিক-সমর্থ লেখকের মধ্যে যে বিরোধ নিয়ে প্রায়শই আলোচনা হয়, আশাপূর্ণা দেবী সেই সূক্ষ্ম ভেদরেখা মুছে দিতে পেরেছিলেন। তিনি একদিকে জনপ্রিয় তো বটেই, সেইসঙ্গে ক্লাসিক এবং স্থায়ী সাহিত্য রচয়িতা হিসেবেও যে সমর্থ, তা তাঁর একশো বছর পেরিয়েও পাঠক হৃদয় জুড়ে থাকাটাই প্রমাণ। আশাপূর্ণা দেবী কিন্তু প্রথমেই বড়োদের জন্য সাহিত্য রচনা করেননি। করেননি, না করতে পারেননি! রক্ষণশীল পরিবারের কন্যা এবং বধূ হওয়ায় লেখালিখির যে সুযোগটুকু পেয়েছিলেন, কালের বিচারে তাঁর কাছে সেটাই যথেষ্ট ছিল। যতদিন তাঁর শাশুড়ি ঠাকরুন বেঁচে ছিলেন, ততদিন তিনি শুধু ছোটোদের মনোরাজ্য নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন। তাই ১৯২২ থেকে টানা ১৯৩৬ পর্যন্ত বড়োদের কথাসাহিত্য ছিল তাঁর স্পর্শবঞ্চিত। তবে ছোটোদের জন্য লিখে তিনি আনন্দ পেতেন। ছোটোদের বা বড়োদের — কখনোই তিনি অবাস্তব কিছু শোনাননি। যে জায়গা তাঁর আয়ত্তের বাইরে ছিল, সেই ক্ষেত্র তাঁর গল্পে স্থান পায়নি, তিনি স্থান দেননি। পাঠকের সঙ্গে এই সততার জন্যই তিনি আজও বাংলা সাহিত্যের নিকোনো আঙিনায় সম্পর্কের আঁকিবুঁকির আসনে ঠায় বিরাজমান।

    আশাপূর্ণার জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯০৯ (বাংলা ২৪ পৌষ ১৩১৫) শুক্রবার। বাবা হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত, মা সরলাসুন্দরী দেবী। বাবা হরেন্দ্রনাথ ছিলেন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। সে যুগের নামকরা পত্রিকাতে ছবিও আঁকতেন তিনি। আশাপূর্ণার ছেলেবেলা কেটেছে উত্তর কলকাতার এক একান্নবর্তী পরিবারে। গৃহকর্ত্রী ছিলেন তাঁর ঠাকুমা নিস্তারিণী দেবী, যাঁর প্রবল প্রতাপের টুকরো টুকরো ছবি আশাপূর্ণার সাহিত্যে লুকোচুরি খেলে গেছে। আশাপূর্ণার বয়েস যখন সাড়ে পাঁচের  মতো, তখন তাঁর বাবা হরেন্দ্রনাথ সপরিবারে আপার সার্কুলার রোডে উঠে আসেন। কিন্তু বালিকা বয়েসের ওই একান্নবর্তী পরিবারের ছবি আশাপূর্ণার হৃদয়ে সুনিবিড় ছাপ ফেলে গেছিল।

আয়রে আয় ছেলের দল বাইরে ছুটে আয়

       বাইরে খেলে সবাই মিলে, আয় চলে আয় সেথায়।

                                  বাইরে এখন নতুন আলো

                                  আঁধার ঘর কি লাগছে ভালো?

  ঘরের কোণে একা একা রহিস কেন হায়? ...”

 

কিশোরী বয়েসে বাইরের ডাক দিয়েছিলেন তিনি — সেই ডাক পরীক্ষার পড়া ফেলে নির্মল আনন্দ নেওয়ার ডাক। পরে  ডাক দিলেন নারীদের — সেই ডাক ক্ষুদ্র গণ্ডি পেরিয়ে জগৎ-সংসারের ডাক। তিনি আশাপূর্ণা — অন্তঃপুরে আবদ্ধ নারীর অন্তরমহলের নিপুণ চিত্রকর। আশাপূর্ণা — নামেই যাঁর পরিপূর্ণতা। যাঁর লেখায় ‘গল্প লিখছি’ এরকম ছদ্ম গাম্ভীর্য নেই, ভাষার আস্ফালন নেই, তথ্য-তত্ত্বের ভারে ভারাক্রান্ত নয় তাঁর রচনা, শুধুমাত্র লেখার আটপৌরে ভঙ্গি, সরল করে গল্প বলার মধ্যে দিয়েই তিনি পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন পাঠকের হৃদয়। মহাশ্বেতা দেবী বলেছেন, “বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থান সম্রাজ্ঞীর মতো।” প্রফুল্ল রায় বলেছেন, “ক্ষমতা থাকলে আশাপূর্ণা দেবীকে নোবেল প্রাইজ দিতাম।”  তিনি ছিলেন যথার্থ সব্যসাচী। দু’হাতে ছোটদের এবং প্রাপ্তমনস্কদের জন্য লিখেছেন। এই দিক থেকে সব্যসাচী তো বটেই; অন্যদিকে গৃহবধূর ভূমিকায় পরিপূর্ণভাবে সফল হয়ে সাহিত্যপরিবারেও অজস্র পুরস্কার নিয়ে একশো বছর পরেও সমানভাবে তিনি বিরাজমান — এদিক থেকেও তিনি সব্যসাচী।  

   আশাপূর্ণার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সৌভাগ্য হয়নি ঠাকুমার আপত্তিতে। আশাপূর্ণা দেবী তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, ইস্কুলে পড়লেই যে মেয়েরা বাচাল হয়ে উঠবে, এ তথ্য আর কেউ জানুক না জানুক, তাঁদের ঠাকুমা জানতেন এবং তাঁর মাতৃভক্ত ছেলেদের এই মতামতের বিরুদ্ধাচরণ করার শক্তি ছিল না। এইরকম প্রতিকূল পরিবেশেও আশাপূর্ণা দেবী অতি অল্প বয়েসেই বর্ণপরিচয় আয়ত্ত করেন কেবলমাত্র দাদাদের পড়া শুনে ও লেখা দেখে। এরপর মায়ের উৎসাহে সাহিত্য জগতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। তিনি নিজে বলেছেন, “ হিসেব মতো আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে, সংসার ঊর্দ্ধ্বের এক স্বর্গীয় জগতে। বই পড়াই ছিল দৈনিক জীবনের আসল কাজ।” ১৯২৪ সালে মাত্র ১৫ বছর ৮ মাস বয়েসে কালিদাস গুপ্তর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। শুরু হয় এক অন্য জীবন। শ্বশুরবাড়িতে পাঁজি ছাড়া কোনো বই নেই। অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে উঠতে থাকে সাধারণ মেয়েদের জীবন যাপন, মনস্তত্ব, আটপৌরে সংসারের টানাপোড়েন, উচ্ছলতা, অভাব, প্রাচুর্য, প্রেম, বিরহ, সংঘাত, আশা আকাঙ্ক্ষা, সংসারের চৌহদ্দিতে থাকা নারীর বারমাস্যায়। পাশাত্ত্য সাহিত্য ছিল তাঁর নাগালের বাইরে, বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাও ছিল তাঁর অজানা। কিন্তু তাঁর পর্যবেক্ষণ এবং অন্তর্দৃষ্টি ছিল প্রখর, যা দিয়েই তিনি বাংলা সাহিত্যে বাজিমাৎ করে দিয়েছিলেন। তিনি নিজেই অকপটে বলেছেন, “আমার লেখার উপজীব্য কেবলমাত্র মানুষ।…মধ্যবিত্ত ঘরোয়া মানুষ আমার একান্ত চেনা। আমি আমার জগতের বাইরে কখনো হাত বাড়াতে যাই না।” এই অভিজ্ঞতা থেকেই ‘শশী বাবুর সংসার’, ‘বালুচরী,’ ‘মিত্তির বাড়ি’ উপন্যাস ডানা মেলেছে।

   আশাপূর্ণার কথাসাহিত্যে ভৌগোলিক বিস্তার কম। বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্করের মতো গ্রামজীবন বা আঞ্চলিকতার সুস্পষ্টতাও নেই। কিন্তু গল্পের প্রয়োজনে তিনি তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বাইরে যে পটভূমি এঁকেছেন, তাতে কোনো খাদ নেই। তিনি ছিলেন মধবিত্তের গার্হস্থ্য জীবনের মানবীয় ছবি আঁকিয়ে। বিশেষত নারীদের গল্পই বলে গেছেন তিনি, দেখেছেন যেমন ভাবে। নারী স্বাধীনতা, নারীবাদ, নারী আন্দোলন এইসব শব্দ যখন সমাজকে সেইভাবে প্রভাবিত করেনি, সেই সময়েই আশাপূর্ণা নারীদের হয়ে কলম ধরেছিলেন। এ সম্পর্কে তাঁর স্বীকারোক্তি — “প্রথম জীবনে মেয়েদের অবরোধ সমস্যাই আমাকে সবচেয়ে বেশি পীড়িত করত। মেয়েদের সব বিষয়েই তো অনধিকার।” তাই গার্হস্থ ঘেরাটোপের মধ্যে মেয়ারা সামাজিক সীমাবদ্ধতাগুলি যে মেনে নিতে বাধ্য হয়, এই-ই হয়ে উঠেছিল আশাপূর্ণার বড়োদের কথাসাহিত্যের মূল উপজীব্য।

    নবনীতা দেবসেনের মতে, “আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাসে এবং ছোটোগল্পেও নায়ক প্রায় সর্বদা নারী, তারা নায়িকা নয়, কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র। অর্থাৎ তাদের ঘিরেই কাহিনি তৈরি হয়। বাক্যের মধ্যে ক্রিয়াপদের মতো কাহিনিতে চালিকাশক্তি তারাই।” ঠিক এই কারণে তাঁকে ‘ঘরকন্নার লিখিয়ে’ বলে তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। কিন্তু একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, এই ঘরকন্নার কাহিনি বলা তাঁর দুর্বলতা নয়, এ তাঁর শক্তি। এই যে মেয়েদের কথা অবিরাম বলে গেছেন, তাতেও রয়েছে নিখুঁত কালচেতনা ও ঐতিহ্যগুণ, সামাজিক দায়বদ্ধতা।      

    আশাপূর্ণা দেবীর সাহিত্যাকাশে আবির্ভাব কিশোরী বয়েসে, ছোটোদের কবিতা ও গল্প দিয়ে এবং নিরন্তর তা চলতেই থাকে। আশাপূর্ণার ছোটোদের গল্প উপন্যাসের সংকলন প্রায় ত্রিশ চল্লিশটার মতো। তঁর প্রথম ছোটোদের গল্পের বই ‘ছোটঠাকুর্দার কাশীযাত্রা’। ছোটোদের জন্য তাঁর উপন্যাস পাই অনেক পরে, ১৯৫৯-এ। ছোটোদের গল্পে তিনি কখনো ছোটোদের চোখ দিয়েই ভুবন দেখেছেন, কখনো আবার নিজেই কথকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। কখনো আবার ছোটোদের চোখ দিয়ে দেখেছেন বড়দের কাণ্ডকারখানা। যেমন ‘ছোটঠাকুর্দার কাশীযাত্রা’ গল্পটির কথাই ধরা যাক। বালকের দৃষ্টি দিয়ে আত্মাভিমানী ছোটঠাকুর্দাকে দেখতে পাবে পাঠক। তেমনি এই গল্পের নিরীহ ঠানদিকেও চিনে নিতে পারা যায় বালকের চোখ দিয়ে। শিশুদের আমরা মুখে নানাভাবে উপদেশ দিই; কিন্তু তাদের সামনে বড়োরাই এমন আচরণ করি, যা ছোটোদের কাছে বিপরীত বার্তা যায়। আশাপূর্ণা সেই পথে হাঁটেননি। তিনি ছোটোদের বিচার বুদ্ধি দিয়েও গল্পের ভিত রচনা করেছেন।

     ‘ও কে?’ গল্পে দুটো ছোটো বালক, পুকুড় পাড়ে চাষী মজুরের মতো দেখতে লোকটার রহস্যজনক কাণ্ডকারখানা দেখে কখনো আশ্চর্য, কখনো ভয় পেয়েছে। তাদের মনের গভীরে খেলে যাওয়া শিশু হৃদয়ের অভিব্যক্তি আশাপূর্ণা ছোটোদের মতো করেই এঁকেছেন। তঁর লেখার সম্পদ সজীবতা যা সহজ-সরল, টাটকা বাতাসের মতো। তাঁর ছোটোদের জন্য লেখা গল্পের ছোটোরা বড়োদের কাছ থেকে তারা কতটা কী পেতে পারে, বড়োরা কী আচরণ করতে পারে, তা যেন ঠিক বুঝতে পারে। তাদের বিচক্ষণতা শিশুসুলভ হয়েও যেন পরিণত। শিশুদের চোখ দিয়ে বড়োদের জগতকে চুলচেরা বিশ্লেষণের যে পাঠ, তা যেন আশাপূর্ণা বড়োদেরও দিতে চেয়েছেন। তাঁর ছোটোদের জন্য লেখা গল্পে ছোটোদের সংলাপ এবং বড়োদের সংলাপ একেবারে যথাযথ। আর্থ সামাজিকতার তারতম্য অনুযায়ী তাঁর গল্পের চরিত্ররা ব্যবহার করেছে, কথা বলেছে। তবে তিনি যখন পরিণতমনস্কদের জন্য গল্প লিখেছেন, তখন মেয়েরা তাঁর গল্পের জায়গা জুড়ে থেকেছে; কিন্তু তাঁর কিশোর গল্পে কিশোরীরা সেভাবে জায়গা করে নিতে পারেনি।

    বড়োদের জন্য আশাপূর্ণা লিখতে শুরু করেন তাঁর আঠাশ বছর বয়েসে। ১৯৪৩-এ শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘পত্নী ও প্রেয়সী’ গল্পের মধ্যে দিয়ে বড়োদের গল্প জগতে তাঁর পা রাখা। অন্দরমহলের গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেও নারীর জীবনবীক্ষা, নিরন্তর দ্বন্দ্ব, আত্মমর্যাদার স্ফূরণ চালাকিবিহীন নির্মেদ গদ্যে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। এরপর থেকে নিরন্তর চলতে থাকে আশাপূর্ণার কথাসাহিত্যের বিজয়রথ। একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর ছোটো গল্প এবং উপন্যাস। যদিও আশাপূর্ণা দেবী নিজে বলেছেন “উপন্যাস আমার অনেকটাই প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে তবুও ছোটোগল্পের ওপরই আমার পক্ষপাত। ছোটোগল্পেই আমার মনটা ভরে যায়।” তাঁর প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। প্রত্যেকটি কাহিনি বিষয় বৈচিত্র্যে সমুজ্জ্বল। তবে প্রায় গল্পেই অনেকখানি অংশ জুড়ে রয়েছে নারীরা। সংসারের একেবারে অভ্যন্তরের নারীদের মননের ইতিবৃত্তকে তিনি যেভাবে বিভিন্নতায় রূপ দিয়েছেন, খুব কম কথাশিল্পীই এ কাজে তাঁর মতো সফল হয়েছেন।

     সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠা নারী, সংসারের অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে দৃঢ় করতে উদ্যোগী নারী, ব্যক্তিগতভাবে ব্যর্থ নারী, সফল নারী, প্রতিকূলতা জয় করা নারীর জয়গান আশাপূর্ণার গল্পের বীজমন্ত্র। নারীরা তাঁর কাহিনিতে নানা রঙে রঙিন। ধূসরতার মাঝেও রঙের বাহার। ‘সম্ভ্রম’ গল্পে আশাপূর্ণা এঁকেছেন এক অসহায় নারীর আত্মমর্যাদার কাহিনি। বড়োলোক দাদার কাছে অকর্মণ্য স্বামীর ভুয়ো চাকরির গল্প শুনিয়ে দাদার দেওয়া চাকরি নিতে চায়নি সে। পাঠকের মন দ্রব হয়ে যায়, যখন দেখে লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে শেষ টাকাটি বের করে দাদার জন্য মিষ্টি আনায়। আশাপূর্ণার আরেকটি নারী চরিত্র পাঠক হৃদয় জয় করে নিয়েছে, যে নারীটির স্বামী পাগল। যে স্বামীকে নিয়ে সে বাপের বাড়িতে থাকে। বাপের বাড়ির এক বিয়ের অনুষ্ঠানে তার স্বামীকে নিয়ে গোণ্ডগোল হলে সে রাগ করে ছাদের ঘরে খিল দিয়েছিল। বর বউ বিদায়ের পর দরজা খুলে দেখা গেল, মেয়েটির স্বামী আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু বিয়েবাড়িতে বাপের বাড়ির সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সে সারারাত স্বামীর মৃতদেহ আগলে থেকেছে।

     নারীর বৈধব্য নিয়ে আশাপূর্ণা যা লিখেছেন, তার মধ্যে ‘প্রহরী’ গল্পটি অন্যতম। মি. বোসের মৃত্যুর পর পরিবারে আসে আর্থিক অস্বাচ্ছন্দ্য। বিধবা স্ত্রী নন্দিতা বোস তার দুই কন্যা নিয়ে আতান্তরে পড়েছে; কিন্তু তার সেই অসুবিধা, অসহায়তা কাউকে বুঝতে দিতে চায়নি সে। ঋণের ভারে বিক্রি হয়ে গেছে বাড়ির সব দামি আসবাব, সেই শূন্যস্থান তাকে পূরণ করতে হয়েছে ভাড়া করা আসবাব দিয়ে। বাড়ির মালিককে ভাড়া বাকি পড়লে সে মিথ্যে করে বলেছে ড্রাফট ভাঙানো যায়নি। নন্দিতা স্বপ্ন দেখে তার ছোটো মেয়েকে সিনেমায় নামিয়ে সে পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার করবে। একদিকে ওই নারী অসহায়, অন্যদিকে কিন্তু সে তার অহংকার বোধকে বিসর্জন দিতে পারেনি।

     ‘বাকি খাজনা’ এবং ‘আহত ফণা’ দুটি ভিন্ন স্বাদের অমর সৃষ্টি। প্রথম গল্পে সন্তানহারা এক দম্পতির মর্মন্তুদ কাহিনি মূল উপজীব্য। সন্তানের মৃত্যু উপলব্ধি করতেই একজন মায়ের একমাসের উপর লেগে গেছে এবং সেই মায়ের অস্তমিত সূর্য দেখে প্রথম অনুভব হয় তার সন্তান নেই, তার কাঁদা উচিত। এ কাহিনি পাঠককে সমূলে নাড়া দেয়। দ্বিতীয় গল্পের কাহিনিও একেবারে ভিন্ন ধারার। গল্পের প্রধান নারী চরিত্র পাখি, পিতৃ-মাতৃহীন। দিদিমার কাছে মানুষ। দিদিমা, মাসতুতো দিদির আশ্রয় থেকে বহু পথ পার করে আশ্রয় নেয় রাস্তা তৈরির কোম্পানির। সেখানে সে ঘুণধরা সমাজের প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠে। শ্রেণি বৈষম্যর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো পাখি এবং স্বৈরিণী পাখি — দুইয়ের মিশেলে আশাপূর্ণার এক অনবদ্য সৃষ্টি।

    আশাপূর্ণা দেবীর যে তিনটি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে অসামান্য মর্যাদা পেয়েছিল, সেই তিনটি উপন্যাস হলো, ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’ এবং ‘বকুল কথা’। নবনীতা দেবসেন এই ট্রিলজিকে বলেছেন ‘ইতিকথা’ বা ‘মহান্যাস’। ছোটোবেলা থেকে যে সমস্যার সম্মুখীন তিনি হয়েছিলেন, নারী পুরুষের যে বৈষম্য তাঁকে পীড়িত করত, নারীদের ছোটো বড় যেসব চাওয়া পাওয়াগুলো তাঁকে সমূলে ভেতর থেকে নাড়া দিত, তাদের দুঃখ-দৈন্য এসব এক জায়গায় জড়ো হয়ে আশাপূর্ণার ভেতরে এর প্রস্তুতি চলছিলই। ‘কথাসাহিত্য’ পত্রিকা থেকে ধারাবাহিক লেখার অনুরোধ এলে জন্ম হল ট্রিলজির প্রথম পর্ব ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’র। গ্রামীণ সমাজের প্রেক্ষাপটে মেয়েদের নানা সামাজিক অবস্থান নিয়ে এই কাহিনি যখন প্রকাশিত হলো, তখন বঙ্গীয় সমাজে প্রবল আলোড়ন পড়ে গেল। পরের বছর বইটি পেল রবীন্দ্র পুরস্কার। এরপর ‘সাপ্তাহিক বসুমতী’ থেকে আরেকটি বড়ো উপন্যাস লেখার অনুরোধ এলে আশাপূর্ণা লিখতে শুরু করলেন ট্রিলজির দ্বিতীয় ভাগ ‘সুবর্ণলতা’। ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ যেখানে শেষ হয়েছিল, ‘সুবর্ণলতা’র শুরু সেখানেই। সুবর্ণলতা প্রথম প্রতিশ্রুতির সত্যবতীর কন্যা সুবর্ণলতা। কলকাতার শহর জীবনের মধ্যবিত্ত ঘরের যৌথ পরিবারের চৌহদ্দির মধ্যে আটকে থাকা সুবর্ণলতার নিজের জগৎ গড়তে চেয়ে অসহনীয় জীবনকে মেনে নেওয়ার গল্প। সুবর্ণলতার সমসাময়িক ট্রিলজির তৃতীয় ও শেষ ভাগ ‘বকুল কথা’ ‘কথাসাহিত্য’ পত্রিকাতেই ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল। বকুল ছিল সুবর্ণলতার মেয়ে। তিন প্রজন্মের নারীর নানা ধরণের অসহায়তা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, ডুবেও ভেসে ওঠার চেষ্টা এই ট্রিলজিকে অনন্য করে তুলেছে। আশাপূর্ণার এই অনন্যতায় ভরপুর ট্রিলজি সম্পর্কে প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন, “একই সূত্র এই তিনটি গ্রন্থ বিধৃত হয়েছে। যেন লেখিকার মাতামহী, মাতা এবং স্বয়ং লেখিকা — এই ত্রিকালের তিনজন নারীকে প্রতিনিধি করে তিন যুগে নারী জীবনের তিনটি বিভিন্ন রূপকে ফুটিয়েছেন।”

   রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “সহজ কথা যায় না বলা সহজে”। আশাপূর্ণা দেবী ঠিক এই কাজটাই সহজে করে দেখিয়েছেন। বালিকা বয়েস থেকে শুরু করে পরিণত বয়েস পর্যন্ত জীবনকে, সময়কে, যুগ পরিবর্তনকে যেভাবে দেখেছেন, চরিত্রানুগ সেই মতো বিশ্বাসযোগ্য কাহিনি-সংলাপ দিয়ে তিনি সহজভাবে মালা গেঁথেছেন। ‘অন্তঃপুরের লেখিকা’, ‘হাঁড়ি হেঁশেলের লেখিকা’ বলে তাঁকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেও পারা যায়নি। অজস্র ছোটোগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ লেখিকা কিন্তু সযত্নে সংসারও করেছেন। তাঁর মতো আর কোনো বাঙালি নারী এভাবে জীবন দেখিয়েছেন কী! তিনি যথার্থ অর্থেই মহিয়সী, মহিয়সী লেখিকা।