গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ও তাঁর নভেলেট 'একটি পূর্বঘোষিত মৃত্যুর ধারাবিবরণী'

চিলিতে প্রতিবিপ্লবের মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচারী একনায়ক পিনোচেতের ক্ষমতা দখল ও বন্ধু রাষ্ট্রপ্রধান আলেন্দের হত্যার পর গার্সিয়া মার্কেস সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পিনোচেত ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি আর কিছু লিখবেন না। অটাম অব দ্য পেট্রিয়ার্ক উপন্যাসে এক স্বৈরাচারী একনায়কের বৃত্তান্ত লেখার পর দীর্ঘদিন তিনি আর লেখেনও নি কিছু। কিন্তু ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড লিখে যিনি লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের গোটা জগৎকেই বিশ্ব সাহিত্যের কেন্দ্রে এনে দিয়েছেন, তাঁর এমত সিদ্ধান্তে অজস্র পাঠক ও লেখক বন্ধুরা খুশি হতে পারছিলেন না। তাঁর লেখক বন্ধুদের উপরোধেই গার্সিয়া মার্কেস আবার কলম ধরলেন এবং দীর্ঘ বিরতি ভেঙে আত্মপ্রকাশ করল এই নভেলেট – ‘ক্রনিকল অব এ ডেথ ফোরটোল্ড’। বাংলা অনুবাদে বলতে পারি ‘একটি পূর্বঘোষিত মৃত্যুর দিনপঞ্জি’। [একটি অতৃপ্তিজনক বাংলা অনুবাদে এর নামকরণ করা হয়েছে মৃত্যুর কড়ানাড়া।] এর ইংরাজী অনুবাদ ১৯৮১ সালে প্রকাশের অল্প পরেই গার্সিয়া মার্কেজের নাম ঘোষিত হল ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপক হিসেবে। এই দিক থেকেও এই নভেলেটটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

 

‘ক্রনিকল অব এ ডেথ ফোরটোল্ড’ নামটি থেকেই বোঝা যাচ্ছে এই উপন্যাস একটি মৃত্যুর ঘটনাকে ঘিরে রচিত। গার্সিয়া মার্কেজের অনেক আখ্যানের মতো এটিও শুরু হয় মাঝখানের এক ঘটনা দিয়ে। তারপর অতীতের ঘটনা সামনে আসে। তবে সেটাও দিনপঞ্জির মতো ক্রমানুসারে নয়। সময়ের বিন্যাসকে ভাঙচুর করে। এই ন্যারেটিভ টেকনিক এই আখ্যানেও রয়েছে। আখ্যানের শুরুতেই আমরা জেনে যাই সান্তিয়াগো নাসার বলে একজনকে খুন করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়েই আমরা জেনে যাই খুনটি করেছে পেদ্রো ও পাবলো ভিকারিও এই দুই ভাই। খুনের কারণটিও জানিয়ে দেন আখ্যানকার। পেদ্রো আর পাবলোর বোন অ্যাঞ্জেলার বিয়ে হয়েছে আগের দিন। বিয়ের পর তার স্বামী বায়ার্দো সান রোমান বুঝতে পারেন তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী বিয়ের আগেই কুমারিত্ব খুইয়েছিলেন। এটা জেনে বিয়ের পাঁচ ঘন্টা পর মধ্যরাতেই তিনি স্ত্রীকে তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেন। মা এবং ভাইদের চাপের কাছে অ্যাঞ্জেলা ভিকারিও জানায় তার কুমারিত্ব হরণ করেছে প্রতিবেশী সান্তিয়াগো নাসার। একথা শুনে সান্তিয়াগোকে হত্যা করার জন্য যে ছুরি দিয়ে তারা শুয়োর কাটে সেই ছুরি নিয়েই বেরিয়ে পড়ে দুই ভাই। সান্তিয়াগোর ঘরে ঢুকে তাকে হত্যা করে।

দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে গল্প পেছনে ফেরে। আমরা ক্রমশ জানতে থাকি ভিকারিও পরিবার ও সান্তিয়াগো নাসার সম্পর্কিত অনেক তথ্য। সান্তিয়াগো নাসার বেশ সম্পন্ন এক পরিবারের একমাত্র ছেলে। তার বাবা আরব তবে সে একজন ধর্মপ্রাণ লাতিন আমেরিকান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে বিশ্বাসী ক্যাথলিক খ্রিস্টান, যে সাগ্রহে অপেক্ষা করে বিশপের হাতের আংটি চুম্বন করে ধন্য হবে বলে। সান্তিয়াগো শহরের অন্যতম সুন্দর এক বাড়িতে থাকে। দুজন মুলাটো রমণী তার ঘরে থেকে যাবতীয় ফাইফরমাস খাটে। ডিভাইন ফেস নামে একটি বড় খামারের মালিক সে। উপন্যাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে ছড়িয়ে থাকা জীবনতথ্য একজোট করে জানা যায় সে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে পার্টিতে হৈ হুল্লোড় করতে ভালোবাসে। উপন্যাস কথক, তার ভাই, লুই এনরিকে, ক্রিস্টো বেদোয়া – এরকম অনেক বন্ধুবান্ধব আছে তার। পনেরো বছর বয়সে সে শহরের এক বারবণিতা মারিয়া আলেজান্দ্রিনা সেরভান্তেসের সঙ্গে তীব্র প্রেমের আশ্লেষে জড়িয়ে পড়ে। শেষমেষ তার বাবা বেশ্যালয়ে ঢুকে চাবুক মেরে তাকে সেই সম্পর্ক থেকে সরিয়ে আনেন আর খামারের এক কোণে আলাদা করে রেখে দেন। পরে তার সঙ্গে বিয়ে স্থির হয় ফ্লোরা মিগুয়েলের। যখন তাকে হত্যা করা হয় তার বছর খানেকের মধ্যেই তাদের বিয়ে হবার কথা ছিল।

অন্যদিকে ভিকারিও পরিবার বেশ সাদামাটা। পরিবারের কর্তা পনসিও ভিকারিও ছিলেন স্বর্ণকার। সোনার সূক্ষ্ম কারুকাজ করতে গিয়ে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অন্ধ হয়ে যান। সংসারের ভার মূলত থাকে তার স্ত্রী পুরিসিমা দেল কারমেন ভিকারিওর ওপর। বিয়ের আগে তিনি ছিলেন এক শিক্ষিকা। সংসারকে তিনি নানা নিয়মের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখেন। তার পাঁচ সন্তান জীবিত, একজন অকাল মৃত। জীবিত সন্তানদের মধ্যে রয়েছে সবচেয়ে বড় দুই মেয়ে, যাদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারপর পেদ্রো ও পাবলো দুই ভাই, যাদের জীবিকা কষাইয়ের। তারা শুয়োর কাটে, বিক্রি করে। সবচেয়ে ছোট মেয়ে হল অ্যাঞ্জেলা। এই অ্যাঞ্জেলা ও তার বিয়েকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের মূল ঘটনাগুলি ঘটে।

অ্যাঞ্জেলার সঙ্গে বিয়ে হয় বায়ার্দো সান রোমান বলে বছর তিরিশেকের এক ধনী ব্যক্তির। তার প্রথম আগমনের সময়েই শহরে বেশ সাড়া পড়ে গেছিল। তার চেহারার চটক মেয়েদের প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। ক্রমশ জানা যায় সাঁতার কাটায় যেমন তার অবিশ্বাস্য দক্ষতা, তেমনি মর্স কোড, রেল প্রযুক্তি, ওষুধশাস্ত্র সহ নানা বিষয়ে অগাধ জ্ঞান। তিনি যেমন অগাধ সম্পদের অধিকারী তেমনি প্রাণোচ্ছ্বল, হৃদয়বান, সৎ মানুষ হিসেবেও আকর্ষণীয়। প্রথমদিকে তার বংশ পরিচয় সম্পর্কে কিছু জানা যায় নি। একদিন তিনি শহরে নিয়ে আসেন তার পরিবারকে। দেখা যায় পরিবারটি অত্যন্ত অভিজাত। তার বাবা হলেন সেই বিখ্যাত কর্ণেল যিনি অরলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে উনিশ শতকের গৃহযুদ্ধের সময় পরাজিত করেছিলেন। বায়ার্দো পরিবার কতটা ধনী সেটা বোঝা যায় যখন ভাবী স্ত্রী অ্যাঞ্জেলার পছন্দের বাড়ির কথা জেনে সেটা বহুমূল্যে কিনে নেন বায়ার্দো। তাদের বিয়েতেও জৌলুসের বন্যা বয়। খরচের বহর দেখে সবার তাক লেগে যায়। এতদ সত্ত্বেও স্ত্রী অক্ষত যোনি কুমারী নয়, এই অভিযোগে বায়ার্দো সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে ফেরৎ পাঠান আর এই সূত্রেই ঘটে যায় সান্তিয়াগো নাসারের হত্যাকাণ্ডটি।

অ্যাঞ্জেলার সঙ্গে বায়ার্দোর কোনও প্রেম সম্পর্ক তৈরি হয় নি। পরিবারের চাপেই তাকে এই বিয়েতে সম্মতি দিতে হয়। তার মা বলেন ভালোবাসা না থাকলেও অসুবিধে নেই। ক্রমশ সেটা আয়ত্ত করে নিলেই চলবে। বায়ার্দো পরিবারের বিপুল বৈভবের দিকে নজর রেখেই যে ভিকারিও পরিবার অ্যাঞ্জেলাকে বিয়েতে জোর করেছে – এই বিষয়ে কোনও অস্পষ্টতা রাখেন নি আখ্যানকার।

কিন্তু সান্তিয়াগো নাসারই অ্যাঞ্জেলার সেই গোপন প্রেমিক, নাকি অন্য কোনও এক প্রকৃত প্রেমিককে আড়াল করতে সান্তিয়াগোর নাম করেছিল অ্যাঞ্জেলা – তাই নিয়ে আখ্যানকার নিজেই বেশ খানিকটা ধন্দ তৈরি করেছেন। আমাদের জানানো হয়েছে যে সান্তিয়াগো অ্যাঞ্জেলাকে কখনো একসঙ্গে কেউ দেখে নি। এই সন্দেহের সমাধান সূত্র আখ্যানের মধ্যে নেই।

এই আখ্যানে আরেকটি চমক রেখেছেন আখ্যান কথক। সান্তিয়াগো নাসারের হত্যাকাণ্ড ও নিজের বিবাহের পর সতেরো বছর ধরে দূরে থাকা স্বামী বায়ার্দোকে একের পর এক চিঠি লিখে গেছে অ্যাঞ্জেলা। সতেরো বছর পর হঠাৎ করেই বায়ার্দো ফিরে এসেছে স্ত্রীর কাছে। সঙ্গে একত্র থাকার ইঙ্গিৎবাহী জামাকাপড়ের তোরঙ্গ আর একটি চিঠির বাক্স। সেখানে রয়েছে অ্যাঞ্জেলার লেখা সেই দু হাজার চিঠি। তবে সবগুলিই অপঠিত, খাম বন্ধ।

১৯৮১ তে এই উপন্যাস প্রকাশের ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে গার্সিয়া মার্কেসের পরিচিত বৃত্তে এমনই এক হত্যাকাণ্ড হয়েছিল। বেশ কিছু চরিত্রের নাম ধাম বদলে বাস্তবের সেই হত্যাকাণ্ডটিকেই গার্সিয়া মার্কেস তুলে এনেছেন এই আখ্যানে। তবে একটি বদল এনেছেন। বাস্তব ঘটনায় স্ত্রীকে বিয়ের রাতে কুমারিত্ব না থাকার অভিযোগে ত্যাগ করা পুরুষটি আর কখনো স্ত্রীর কাছে ফেরেন নি। এখানে সতেরো বছর পর পুনর্মিলনের যে কথাটি রয়েছে তা বিশুদ্ধ উপন্যাস কল্পনা।

গার্সিয়া মার্কেস বাস্তবের কাহিনীকে প্রায় অবিকৃতভাবে এখানে তুলে আনলেও এটি বিশিষ্ট আখ্যান হয়ে উঠতে পেরেছে এর অসামান্য ন্যারেটিভ টেকনিক আর চরিত্র চিত্রণের অসামান্য দক্ষতার জন্য। সাধারণভাবে গার্সিয়া মার্কেজের উপন্যাসে কেবল কয়েকটি চরিত্র নয়, একটি গোটা জনপদের অসংখ্য মানুষ হাজির থাকে। আকারে ছোট, নভেলেটধর্মী এই অনধিক একশো পাতার বইটিতেও অসংখ্য চরিত্র সহ একটি গোটা জনপদ উপস্থিত। রয়েছে সময়ের একটি বিস্তৃত প্রেক্ষাপট আর গার্সিয়া মার্কেস সুলভ আখ্যানের সময়ক্রমকে ভাঙচুর। সাধারণ একটি স্বল্প পরিসর কাহিনীকে উপস্থাপনগুণে কতটা নাটকীয়, ব্যঞ্জনাময় ও ব্যাপ্ত করে তোলা যায় ক্রনিক্যাল অব এ ডেথ ফোরটোল্ড তার এক অসামান্য দৃষ্টান্ত।