গাবো যে কথা লিখে যান নি
- 12 March, 2023
- লেখক: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য
‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’ উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু মাকোন্দোর স্রষ্টা হোসে আর্কাদিয়ো বুয়েন্দিয়া শেষ জীবনে পৌঁছে গেলেন বিস্মৃতির অতল একাকীত্বে। তখন তাঁর কাছে সব দিনই সোমবার। তখন তিনি সংযোগের চেষ্টা করছেন মৃতদের সঙ্গে, অতীতের শত্রু প্রুদেন্সিয়ো আগিলারের সঙ্গে, যাযাবর মেলকিয়াদেসের সঙ্গে। কথা বলছেন ল্যাটিনে, সেই দুর্বোধ্য ভাষা কেউ বুঝতে পারছে না। তাঁকে কোমরে দড়ি বেঁধে রেখে দেওয়া হল উঠোনে চালার নিচে একটা চেস্টনাট গাছের গোড়ায়। মুখ দিয়ে সবুজ গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। তারপর জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই প্রতিভূ যেদিন মারা গেলেন সারা রাত ধরে আকাশ থেকে নিঃশব্দে ঝরে পড়ল অসংখ্য ছোট ছোট হলুদ ফুলের বৃষ্টিস্নাত আশীর্বাদ এবং বহু দিন আগে হারিয়ে যাওয়া আদিবাসী ভৃত্য কাতাউরে হঠাৎ মাকোন্দোয় আবির্ভূত হয়ে বলল, ‘আমি এসেছি রাজার শেষকৃত্যে যোগ দিতে।’
কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া, ‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র, বত্রিশটি যুদ্ধের পরাজিত নায়ক তাঁর পিতা হোসে আর্কাদিয়ো বুয়েন্দিয়ার মতোই জীবন সমাপ্ত করেন বিস্মৃতি ও নিঃসঙ্গতায়। নিজের কর্মশালায় সারাদিন ধরে তিনি সোনার মাছ তৈরি করেন। তারপর সেই মাছ বিক্রি করে তাই দিয়ে সোনা কিনে আবার মাছ তৈরি করেন। এভাবেই চলতে থাকে বছরের পর বছর। একদিন বিকেলবেলা হঠাৎ তাঁর স্রষ্টার খেয়াল হল কর্নেল তো মাছ তৈরি করেই চলেছেন। ‘Ahora sí se jodió’ (এবার শালাকে মারতে হবে), তিনি ভাবলেন। সেদিন বিকেলে মাকোন্দোয় একটা সার্কাস এসেছিল। কর্নেল দেখলেন সোনালি পোশাক পরা একটা মেয়ে হাতির পিঠে চড়ে যাচ্ছে, যাচ্ছে একটা বিষন্ন উট, একটা নাচিয়ে ভাল্লুক, জোকারের দল। তারা চলে গেলে কর্নেল উপলব্ধি করলেন নিঃসীম একাকীত্ব। তারপর গেলেন সেই চেস্টনাট গাছের কাছে। পেচ্ছাপ করতে করতে ভাবতে লাগলেন সার্কাসের কথা, কিন্তু আর বেশি ভাবতে পারলেন না, মাথাটা ঝুঁকে পড়ল ও সেখানেই নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
আরো মনে পড়ে ‘নাবো নামের কালো ছেলেটি যে দেবদূতদের অপেক্ষা করিয়েছিল’ গল্পে সেই মৃত্যুপথযাত্রী ছোট্ট ছেলেটির কথা যে দু’ বছর ধরে কোমায় ছিল। এই কোমাও কিন্তু বিস্মৃতির অন্য নাম, ঠিক যে বিস্মৃতি ও নিঃসঙ্গতার এক দীর্ঘ পর্বের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে জীবন থেকে জীবনান্তের পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন এই সবকটি অবিস্মরণীয় চরিত্রের স্রষ্টা স্বয়ং গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি ডিমেন্সিয়া রোগে আক্রান্ত হন ও আস্তে আস্তে তাঁর স্মৃতি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। স্মৃতিই ছিল তাঁর সৃষ্টির প্রধান উপকরণ। সেটাই যখন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারছেন যে ভুলে যাচ্ছেন, অথচ তা বোঝার মতো বোধটুকু তখনো তাঁর মধ্যে ক্রিয়াশীল রয়েছে, কিন্তু কিছুতেই তা প্রতিরোধ করতে পারছেন না, তখন সেই বিরাট প্রতিভা নিতান্ত অসহায় এক শিশুর মতো বলতেন, ‘আমার কাজই হল স্মৃতিকে নিয়ে। স্মৃতি হচ্ছে আমার কাজ করার যন্ত্র ও প্রাথমিক উপাদান। সেই স্মৃতি ছাড়া আমি কাজ করতে পারব না, তোমরা আমায় দয়া করে সাহায্য করো।’ (গাবো ও মেরসেদেস: চিরবিদায়) একই কথা বলে যেতেন বারংবার আর অধৈর্য হয়ে যেতেন। শেষে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে পড়তেন। তারপর একটা সময় এল যখন তিনি যে ভুলে যাচ্ছেন সেটাই ভুলে গেলেন। তখন ক্রমশ শান্ত হয়ে এলেন। মাঝে মাঝে বলতেনও সেই কথাটা, ‘আমার স্মৃতিভ্রংশ হচ্ছে, কিন্তু তা যে হারিয়ে ফেলছি, সৌভাগ্যক্রমে সেটাই ভুলে যাচ্ছি।’ (গাবো ও মেরসেদেস: চিরবিদায়)
গার্সিয়া মার্কেসের জীবনের এই যে অন্তিম পর্ব তার কথা আমরা কিছুই জানতে পারতাম না যদি না তাঁর জ্যেষ্ঠ্য পুত্র রোদ্রিগো গার্সিয়া বাবা-মায়ের শেষ জীবনের কথা বলার জন্য কলম ধরতেন। ২০২১ সালে প্রকাশিত হয় রোদ্রিগোর পিতৃ-মাতৃ তর্পণ, ইংরাজি ভাষায়, নাম – ‘A farewell to Gabo and Mercedes’ – ‘গাবো ও মেরসেদেস: চিরবিদায়’। এই বইতে তিনি লিখছেন, ‘বাবার সেক্রেটারি আমাকে বলেছিলেন, একদিন বিকেলে তাঁকে দেখতে পান বাগানের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে, তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ বহু দূরে, গভীর কোনও ভাবনায় যেন ডুবে আছেন।
- এখানে কি করছেন, দোন গাব্রিয়েল?
- কাঁদছি।
- কাঁদছেন? কই না তো?
- হ্যাঁ কাদছি, তবে চোখ দিয়ে জল পড়ছে না। বুঝতে পারছ না যে আমার মাথায় আর কিছুই নেই?’
এর বহুদিন আগেই গার্সিয়া মার্কেস লিখেছিলেন, ‘La muerte no llega con el vejez, sino con el olvido’ অর্থাৎ বার্ধক্যের সঙ্গে নয়, মৃত্যু আসে বিস্মরণের সঙ্গে। কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে দৈহিক মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগেই তিনি স্মৃতির মৃত্যুর হাত ধরে হেঁটেছেন। কিন্তু গল্পের জাদু তো আর বাস্তবে কাজ করে না। তাই তাঁর সৃষ্ট মেলকিয়াদেস যে নাকি একটা পুরিয়া দিয়ে মাকোন্দোর অনিদ্রা ও তৎসঞ্জাত বিস্মরণের মহামারীকে মুহূর্তে নিরাময় করে দিয়েছিল, তা সে নিজের স্রষ্টার জন্য করতে পারল না। কারণ ডিমেন্সিয়া নিরাময়ের কোনও ওষুধ আজও আবিষ্কৃত হয়নি। দোন গাব্রিয়েল, বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কথাকার, কথা হারিয়ে ফেললেন। যে তিনি স্বতস্ফূর্তভাবে অনর্গল কথোপকথনে বিশেষ দক্ষ ছিলেন, এখন তিনি কথা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন, ভুলে যান কী নিয়ে কথা বলছেন। তাই চুপ করে যান। এক সময়ের আসর মাতিয়ে রাখা রসিক, প্রাণোচ্ছ্বল, উত্তেজনায় ভরপুর মানুষটি ধীরে ধীরে নীরবতাকে আশ্রয় করলেন।
গার্সিয়া মার্কেসের অভ্যাস ছিল নিজের প্রকাশিত লেখা ফিরে না পড়া। স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ার পরে মাঝে মাঝে নিজের বই হাতে তুলে নিতেন। রোদ্রিগো তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখছেন, ‘বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজের লেখা বই তিনি পড়তে শুরু করলেন এবং যেন প্রথমবার গল্পটা পড়ছেন এমনভাবে আমাকে একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, “কোন চুলো থেকে এসব বেরিয়েছে?” বইগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে গেলেন। এক একবার মনে হচ্ছিল প্রচ্ছদটা যেন তাঁর চেনা, কিন্তু বিষয়বস্তু বিশেষ বুঝতে পারছিলেন না। কখনো কখনো বইটা বন্ধ করার পর পিছনের পাতায় নিজের ছবি দেখে এমন চমকে উঠতেন যে আবার বইটা ফিরে পড়ার চেষ্টা করতেন।’
কখনো কখনো তিনি বাড়ি যেতে চাইতেন। মেহিকোতে নিজের বাড়ির বিছানায় শুয়ে তিনি বলতেন এ বাড়ি তাঁর নয়। যেতে চান বাবার বাড়িতে, যেখানে বাবার খাটের পাশে তাঁর খাট আছে। কোন সে বাড়ি? সে হল তাঁর দাদামশাইয়ে বাড়ি, আরাকাতাকার যে বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যেখানে দাদুর খাটের পাশে একটা ছোট্ট তোষকে তিনি ঘুমোতেন এবং যে বাড়ি ছেড়ে এসেছিলেন বহু বহু বছর আগে, তখন তাঁর বয়স নয় কি দশ। এমনকি নিজের ছেলেদেরও চিনতে পারতেন না। জিজ্ঞাসা করতেন পাশের ঘরের ওই লোকগুলো কারা? যখন বলা হত ওঁরা আপনার ছেলে, বিশ্বাসই করতে পারতেন না। বরং নিজের সেক্রেটারি, গাড়ির চালক, বাড়ির রাঁধুনি এঁদের সঙ্গে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। আর যে মানুষটিকে চিনে নিতে কখনোই তাঁর অসুবিধা হয়নি (মাঝখানের একটি সংক্ষিপ্ত সময় ছাড়া) তিনি হলেন সেই অনন্যা নারী, ৫৭ বছর ধরে যাঁর সঙ্গে যূথবদ্ধ জীবন কাটিয়েছেন, সেই মেরসেদেস বার্চা। বন্ধুরা তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘পবিত্র কুমীর’ ও ডাকতেন ‘লা গাবা’ বলে। গার্সিয়া মার্কেসের আদরের ডাক নাম ‘গাবো’ বা ‘গাবিতো’ আর তাই তাঁর স্ত্রী ‘লা গাবা’। আর গাবো নিজে তাঁকে ডাকতেন কত যে নামে! ‘মেচে, মেরসেদেস, জননী, লা মাদ্রে সান্তা (অর্থ: পবিত্র জননী অর্থাৎ মা মেরী)।’
তবে ভুলে গেলে চলবে না বিস্মৃতির অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানো এই মানুষটি কিন্তু আসলে ছিলেন রাজাধিরাজ! যখন (আজও) লাতিন আমেরিকা মহাদেশটি পৃথিবীর তাবড় শক্তিশালী দেশগুলোর শোষণে ও শাসনে নিঃস্ব, রিক্ত। বিশেষ করে কলোম্বিয়া দেশটি যখন গৃহযুদ্ধের পর গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত, পর্যুদস্ত। একনায়কতন্ত্রের বিভীষিকায় মৃত্যুমিছিল ও অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার মিছিল অব্যাহত। যখন উত্তর আমেরিকার দূরদর্শনের একটি অনুষ্ঠানে গুন্টার গ্রাসের সঙ্গে আলোচনায় ইটালির লেখক আলবের্তো মোরারিয়া সদর্পে ঘোষণা করছেন উপন্যাসের মৃত্যু হয়েছে। যখন ‘বুম’ সাহিত্য আন্দোলনের উজ্জ্বল নক্ষত্রদের বিপ্লবাত্মক আবির্ভাবকে, বিশেষ করে মেহিকোর লেখকদের অসম্মান করে নাম দেওয়া হচ্ছে ‘লা মাফিয়া’। ঠিক সেই সময় সুদূর ক্যারিবীয়ার প্রান্তবর্তী জনপদ থেকে আগত খুবই গরীব, রোগা, কলেজ-অনুত্তীর্ণ, মুখচোরা, বখে-যাওয়া, ইংরাজি-না-জানা একটি ছেলে গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়ে এক কল্পভূমি মাকোন্দো ও কিছু ‘জন্মগত পাগল’ চরিত্রকে আশ্রয় করে লিখে ফেলল ‘দোন কিহোতে’-র পরেই স্প্যানিশ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসটি। তারপর যা ঘটেছিল সে সবই তো ইতিহাস আর তা সকলেরই জানা। জীবিতাবস্থায় খুব কম লেখকেরই ভাগ্যে এমন যশপ্রাপ্তি ঘটে যা গার্সিয়া মার্কেস এক জীবনে উপভোগ করেছেন। তাঁর নিজের ছেলের ভাষ্যেই তিনি ছিলেন ‘one of the most fortunate and privileged lives ever lived by a Latin American’। তাই ডিমেন্সিয়া তাঁর স্মৃতি কেড়ে নিলেও বোধহয় স্পর্শ করতে পারেনি তাঁর অন্তঃপ্রকৃতির রসবোধ। রোদ্রিগো গার্সিয়া লিখছেন, ‘এক যুবক চিকিৎসক একদিন বিকেলে বাবাকে দেখতে এলেন। তিনি হাসপাতালের প্রশিক্ষিত চিকিৎসকদের প্রধান এবং তাঁর বাবা ছিলেন কলোম্বিয়ার মানুষ। তিনি বাবাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছেন। বাবা উত্তর দিলেন ‘খোদিদো’ (অর্থ: screwed)। তখন যে নার্সটি সেখানে উপস্থিত ছিলেন তিনি তাঁর দীর্ঘ বিবৃতির শেষে বললেন যে বাবার যৌনাঙ্গের ত্বকে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং সেখানে ক্রিম লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাবা কথাটা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই হেসে ফেললেন আর তাতেই বোঝা গেল যে তিনি মজা করছেন। তারপর ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট করার জন্য বললেন: “ও আসলে আমার বিচির কথা বলতে চেয়েছে।” সবাই তখন হো হো করে হাসছে। মনে হত তাঁর রসবোধ তাঁর স্মৃতিভ্রংশতাকেও জয় করতে পেরেছিল। সেটা ছিল তাঁর সত্ত্বার অবিচ্ছিন্ন অংশ।’
এরকমই আরেকদিনের কথা বলেছেন রোদ্রিগো যখন শেষের সেদিন সমাগতপ্রায়, বেশিরভাগ সময়েই তাঁর বাবা ঘুমিয়ে থাকতেন। ‘কখনো কখনো মহিলাদের (শুশ্রুষাকারিণী) সম্মিলিত কন্ঠস্বরে তিনি জেগে উঠতেন। চোখ খুলতেন আর যেই ওই মহিলারা তাঁর দিকে ফিরে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে তাঁর কুশল জিজ্ঞাসা করতেন সঙ্গে সঙ্গে চোখদুটো জ্বল জ্বল করে উঠত। এরকমই একটি সময়ে আমি তাঁর পাশের ঘরে ছিলাম। শুনতে পেলাম যে মেয়েগুলো খুব হাসছে। ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলাম কী হয়েছে। তাঁরা বললেন যে বাবা চোখ খুলে খুব মনোযোগ দিয়ে তাঁদের দেখেছেন এবং তারপর শান্ত স্বরে বলেছেন:
- আমি একসঙ্গে তোমাদের সবার সঙ্গে পারব না।’
আসলে ডিমেন্সিয়ার প্রবল পরাক্রম বা মরফিনের মতো ওষুধ কোনোটাই তাঁর মস্তিষ্কের সৃজনশীল সত্ত্বাকে পুরোপুরি গ্রাস করতে পারেনি। কিন্তু শেষ হাসি তো হাসবে মৃত্যু, যে অপ্রতিরোধ্য ও অবধারিত। তাই চিকিৎসকদের যখন আর কিছু করার রইল না তখন তাঁকে বাড়ি নিয়ে আসা হল। মেহিকো শহরের ফুয়েগো স্ট্রিটের ১৪৪ নম্বর বাড়ির দোতলায় কোনের দিকের একটা নিরিবিলি ঘরে তাঁকে রাখা হল। সে ঘরে বাজছে শুধু বাইয়েনাতো গানের সুর, দিবারাত্র। গার্সিয়া মার্কেসের প্রিয় সুর। দীর্ঘ সাতাশি বছরের বহুবর্ণরঞ্জিত জীবন তখন অনন্তশয়ানে।
তাঁর যখন প্রায় সত্তর বছর বয়স পুত্র রোদ্রিগো একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, রাতে আলো নিভে যাওয়ার পর তিনি কী ভাবেন। বলেছিলেন, ‘ভাবি যে প্রায় শেষ হয়ে এল, তবে আরও কিছু সময় বাকি আছে, এখনই দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই।’
তাঁর বয়স যখন আশির কোঠায়, আবার ছেলে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন লাগছে এখন। উত্তরে বলেছিলেন চিত্রটা তাঁর বেশ আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে আর শেষের সেই ক্ষণ এগিয়ে আসছে।
এল সেই ক্ষণ। ১৭ এপ্রিল দুপুরবেলায় নিষ্পন্দ অচঞ্চলতায় তাঁর সোনার তরী আহৃত সকল সঞ্চয় নিঃশেষে উজার করে দিয়ে এই পার থেকে অন্য পারে রওনা দিল।
সেই দিনটা ছিল সান্তা মার্তা উৎসবের সময়ের এক বৃহষ্পতিবার। ‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’-র কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র উরসুলাও মারা গিয়েছিলেন এমনই এক পবিত্র বৃহষ্পতিবারে। সেদিন সকালে উড়তে উড়তে দিগভ্রান্ত হয়ে বাড়ির কাচের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে একটা পাখি মরে পড়েছিল সোফার উপর, ঠিক যেখানে বসতেন গার্সিয়া মার্কেস। বাড়ির কর্মচারীরা সেই মৃত পাখিটাকে বাগানে কবর দেয়। আর কী আশ্চর্য যেদিন উরসুলা মারা যান সেদিনও ‘এত বেশি গরম ছিল যে পাখির দল দিগভ্রান্ত হয়ে ছররা গুলির মতো দেওয়ালে ধাক্কা খাচ্ছিল ও জানলার তারজালি ভেঙে ফেলছিল শোবার ঘরে ঢুকে মরবে বলে।’ (একশো বছরের নিঃসঙ্গতা)
১৯৮৭ সালের একটি সাংবাদিক প্রবন্ধে গার্সিয়া মার্কেস লিখেছিলেন, ‘Lo que más me dolerá es que el último episodio, que seguramente será muy interesante y fundamental en la vida de uno, que es el de la muerte, es el único que no podré escribir.’ অর্থাৎ ‘আমাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয় শেষের সেই অধ্যায়, যা জীবনের মুখ্য একটি অংশ এবং খুব আকর্ষণীয় হবে নিশ্চয়ই, অথচ সেই মৃত্যু নিয়ে আমি কিছুই লিখতে পারব না।’ কারণ মৃত্যুর মতো জীবনের এই নিশ্চিত অধ্যায়টি বাদ দিলে তাঁর জীবনে আর যা কিছু ঘটেছিল, যত কিছুর তিনি সাক্ষী ছিলেন, যে সমস্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তার সব কিছুই তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন, হয় কাহিনির মধ্যে দিয়ে অথবা সংকেতের আকারে।
যাই হোক, এরপর তাঁর নশ্বর দেহকে ভষ্মীভূত করে দেওয়ার উৎসবের আয়োজন। কলোম্বিয়ার খ্যাতনামা প্রাবন্ধিক ওরলান্দো মেহিয়া রিবেরা তাঁর ‘মাকোন্দোর আদি রূপ’ প্রবন্ধে সেই মুহূর্তটির দিগন্তপটে চিরভাস্বরের রঙে এক অনন্য ছবি এঁকেছেন: ‘মেহিকো শহরে যখন মারা গেলেন আর আমরা দেখলাম তাঁর অগণন পাঠক ও ভক্তের ঢল, প্রত্যেকের হাতে হলুদ ফুল, তাঁরা কাঁদছেন, আবার গানও গাইছেন। আমার সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল যখন বুঝতে পারলাম “সেই ছোট্ট ছোট্ট হলুদ ফুলের বৃষ্টি” আবার ঝরে পড়ছে আর আমরা সবাই এসেছি এক “রাজাকে” বিদায় জানাতে। সে ছিল তাঁর দ্বিতীয় ও অন্তিম মৃত্যু, খুব শীঘ্রই তিনি মিলিত হবেন যাযাবর মেলকিয়াদেস এবং অবশ্যই নিজের দ্বিতীয় সত্তা, মাকোন্দোর স্থপয়িতা ও অধিপতি, মহান হোসে আর্কাদিয়ো বুয়েন্দিয়ার সঙ্গে।’ রাজার প্রস্থান ঘটল, কিন্তু লেখক? গার্সিয়া মার্কেসের মতো আমরা সবাই জানি ‘Al escritor no lo mata nadie. Ni siquiera la muerte’ - ‘লেখককে কেউ মারতে পারে না, এমনকি মৃত্যুও নয়।’ তাঁর সৃষ্ট বর্ণমালায় এখন তিনি হলুদ গোলাপের রঙ বুলিয়ে দিচ্ছেন।