লাতিন আমেরিকার স্বৈরশাসন ও গার্সিয়া মার্কেজের গোত্রপিতার হেমন্ত

গার্সিয়া মার্কেজের অটাম অব দ্য পেট্রিয়ার্ক [‘গোত্রপিতার হেমন্ত’] নানা অর্থেই ব্যতিক্রমী। এই প্রথম মার্কেজ সরে এলেন তাঁর কল্পিত মাকন্দোর পটভূমিটি থেকে। এর আগের সবকটি উপন্যাস – লিফ স্টর্ম, নো ওয়ান রাইটস টু কর্নেল, ইভিল আওয়ার, ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড – রচিত হয়েছিল মাকন্দোর পটভূমিতে। এগুলির প্রেক্ষাপট হিসেবে ছিল দশকের পর দশক ধরে কলম্বিয়ায় চলা গৃহযুদ্ধ। গোত্রপিতার হেমন্ত উপন্যাসটি গার্সিয়া মার্কেজ লিখেছেন এক স্বৈরাচারী একনায়ককে নিয়ে।

লাতিন আমেরিকায় এর আগেও কিছু উল্লেখযোগ্য উপন্যাস লেখা হয়েছিল একনায়কদের কেন্দ্র করে। ১৯২৬ সালেই রামোন দেল ভাল্লে ইনক্লান লিখেছিলেন তিরান্দো বান্দেরাস। আর ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত হয় লাতিন আমেরিকান কথাকারদের মধ্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার জয়ী মিগুয়েল আস্তুরিয়াস এর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস দ্য প্রেসিডেন্ট। গার্সিয়া মার্কেজ যখন তাঁর গোত্রপিতার হেমন্ত লিখছেন তখন লাতিন আমেরিকার অপর দুই বিখ্যাত ঔপন্যাসিকও একনায়ক কেন্দ্রিক এই ধরনের দুটি উপন্যাস লেখেন। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় কিউবার কথাকার আলেহো কার্পেন্তিয়েরের রিজনস অব স্টেট নামে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। পরের বছর ১৯৭৫ এ বেরোয় রোয়া বাস্তোসের আই দ্য সুপ্রিম। আর সেই বছর, ১৯৭৫ সালেই প্রকাশিত হয় গার্সিয়া মার্কেজের গোত্রপিতার হেমন্ত।

সত্তর দশকের সেই সময়টায় লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে মিলিটারি একনায়কতন্ত্রী শাসকদের আধিপত্য দেখা যাচ্ছিল। সন্দেহ নেই এরই প্রতিক্রিয়ায় লাতিন আমেরিকার বিখ্যাত কথাকাররা যেন নিজেদের মধ্যে এক শলা পরামর্শের ভিত্তিতেই একের পর এক এরকম আখ্যান লিখছিলেন। সত্তর দশকের সমকালীন একনায়করাই যে কেবল গার্সিয়া মার্কেজের ‘অটাম অব দ্য পেট্রিয়ার্ক’ উপন্যাসের ভিত্তি তা নয়। ১৯৫৮ তে ইউরোপ থেকে গার্সিয়া মার্কেজ যখন আবার তাঁর নিজের মহাদেশে ফিরলেন, সাংবাদিকতার সূত্রে থাকতে শুরু করলেন ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসে, সেই সময়েই সেখানে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। একনায়কতন্ত্রী শাসক পেরেজ হিমেনেজকে জনগণ গদিচ্যুত করে এবং গোটা ভেনেজুয়েলা জুড়ে শুরু হয় এক বড় মাপের উৎসব। তরুণ মার্কেজ ছিলেন একনায়কের বিদায় ও জনগণের এই উৎসবের প্রত্যক্ষদর্শী। এই ঘটনা গার্সিয়া মার্কেজকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং তিনি স্বৈরতন্ত্রী একনায়কদের ইতিহাস, তাদের সম্পর্কে প্রচলিত নানা টুকরো কাহিনী পড়তে শুরু করেন। তিনি দেখেন কোথাও কোথাও বাস্তব ঘটনা কুহকের জগতে পৌঁছে যাচ্ছে। গার্সিয়া মার্কেজ জানান তিনি দুভালিয়ের নামে হাইতির এক স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কের কথা পড়েছেন যিনি তার রাজ্যের সব কালো কুকুরকে হত্যা করার আদেশ জারি করেছিলেন। কারণ দুভালিয়ের বিশ্বাস করতেন তার এক রাজনৈতিক শত্রু মানুষের চেহারা বদলে এক কালো কুকুরের চেহারা ধারণ করেছে। গার্সিয়া মার্কেজ জানিয়েছিলেন এল সালভাদোরের একনায়কতন্ত্রী শাসক ম্যাক্সিমিলিয়ানো হের্নান্দেজের কথা, যিনি এক খাবার আগে এক পেণ্ডুলাম ব্যবহার করে বুঝে নিতে চাইতেন তার খাবারে বিষ মেশানো হয়েছে কিনা। এই উপন্যাস প্রকাশের কিছুদিন আগে চিলিতে বামপন্থী শাসক সালুভাদোর আলেন্দেকে এক মিলিটারি ক্যু এর মাধ্যমে উৎখাত ও হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন স্বৈরশাসক পিনোচেত। স্পেনের শাসক ফ্যাসিস্ট ফ্রাঙ্কো তিরিশের দশক থেকে দীর্ঘদিন সেখানে যে স্বৈরশাসন চালিয়েছিলেন, তাও গার্সিয়া মার্কেজের অভিজ্ঞতার মধ্যে ছিল। বস্তুতপক্ষে বাস্তব ও কল্পনার নানা মিশেলে গার্সিয়া মার্কেজ গড়ে তুলেছিলেন তাঁর গোত্রপিতার হেমন্ত নামক উপন্যাসটির জগৎকে।

গোত্রপিতার হেমন্ত উপন্যাসটি নানা অর্থেই নিরীক্ষাশীল। এখানে ভাষা ও আঙ্গিক নিয়ে গার্সিয়া মার্কেজ যে ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন তা শুধু মার্কেজের আখ্যানগুলির মধ্যেই নয়, সমগ্র লাতিন আমেরিকান কথাসাহিত্যের মধ্যেই অত্যন্ত ব্যতিক্রমী। এই উপন্যাসের বাক্যগুলি প্রায় অশেষ, শব্দগুলি স্রোতের মতো পরস্পরের পাশে এসে বসে কিন্তু পূর্ণচ্ছেদের ব্যবহারে কদাচ থেমে যায়। গোলকধাঁধায় সেনাপতি নামে পরে একটি আখ্যান লিখেছিলেন গার্সিয়া মার্কেজ। এখানে বিচিত্র শৈলির কারণে পাঠকই খানিক গোলক ধাঁধায় পড়েন।

গার্সিয়া মার্কেজের এই আশ্চর্য আখ্যানটি ছটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। প্রথম অধ্যায়টির শুরুতেই আমরা জানতে পারি একনায়কতন্ত্রী শাসকের মৃত্যুর কথাটি। তবে সত্যিই তাঁর মৃত্যু হয়েছে কীনা এ বিষয়ে জনগণের মধ্যে নানা সন্দেহ দানা বাঁধে। কারণ এর আগেও অনেকবার তাঁর মৃত্যু সংবাদ ঘোষিত হয়েছে বা তার মৃতদেহ দেখা গেছে। কিন্তু পরে জানা গেছে সেগুলি হল তার ডামি বা ছায়ামানবের মৃতদেহ। একনায়কটি বারবারই ফিরে এসেছেন ও শাসন চালিয়ে গেছেন। প্রায় দুশো বছর তার বয়েস। তিনি তাঁর শাসনের শততম বার্ষিকীও পালন করেন মহা সমারোহে।

এই শাসককে কেউই প্রায় চোখে দেখে নি। তার প্রকৃত নামটিও পাঠককে জানানো হয় না। অবশ্য এই উপন্যাসের অন্য কিছু চরিত্র তথা স্বৈরশাসকের নিকটবৃত্তের কয়েকজনের নাম পাঠক জানতে পারেন। এরা হলেন তার ডামি বা ছায়ামানব প্যাট্রিসিয় আরাগোনেস, তার প্রেয়সী ম্যানুয়েলা স্যাঞ্চেজ, স্ত্রী নাজারেনো লেটিসিয়া, মা বেনদিসিয়ো আলভারাদো, জেনারেল রডরিগো আগুলিয়ার প্রমুখ।

উপন্যাসের ঘটনাগুলি কোনও একটি ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ঘটে, কিন্তু তা সুনির্দিষ্ট নয়। গার্সিয়া মার্কেজ নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন গোটা ক্যারিবিয়ান অঞ্চলটাকেই তিনি খুব ভালোভাবে চেনেন আর এখানকারই এমন একটি জায়গাকে এই আখ্যানের ঘটনাস্থল হিসেবে ধরে নিতে হবে যেখানে স্পেনীয় ক্যারিবিয়ান ও ব্রিটিশ ক্যারিবিয়ান উভয়েরই বৈশিষ্ট্যের ছোঁয়া আছে।

উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদের শুরুতে একনায়কের মৃত্যুর সংশয় ঢাকা খবরটি ছিল। পরবর্তী প্রতিটি পরিচ্ছেদের শুরুতেও এই খবরটিই নানা কোণ থেকে বলা হয়েছে। তবে মৃত্যু সংক্রান্ত খবরের পর পরিচ্ছেদগুলি কথা বলেছে ভিন্ন ভিন্ন দিক নিয়ে। প্রথম পরিচ্ছেদে চিল শকুনেরা প্রাসাদের মধ্যে ঢুকছে, এটা দেখে বাকিরা বুঝতে পারে মৃত্যুর বিষয়টি। তারা যখন প্রবেশ করে তখন প্রাসাদ জুড়ে তারা দেখতে পায় অবক্ষয়ের নানা চিত্র। প্রথম কয়েক পাতা জুড়ে এই অবক্ষয়ের ছবিটি ফুটিয়ে তোলার পর আখ্যান কথক শকুনে খুবলে খাওয়া স্বৈরশাসকের মৃতদেহটির বর্ণনা দেন। তার চোখ মুখ শকুনেরা ঠুকরে খাওয়াও চেনা যাচ্ছিল না। তবে আখ্যান কথক এও বলেন যে মুখটি অবিকৃত থাকলেও তাকে চেনা যেত না, কারণ তার আসল মুখ কেউই দেখে নি। দেশের পত্রপত্রিকায় মাঝে মাঝে এই জেনারেলের ছবি ছাপা হয়েছে বটে, কিন্তু সে সব বহু আগে তোলা। হয়ত বা একশ বছর আগে। হয়ত বা সে ছবি আদৌ জেনারেলের নয়, জেনারেলের কোনও ডামির ছবি সেটা। এরপর বিস্তারিতভাবে এসেছে এই স্বৈরশাসক ও তার শাসন সম্পর্কিত নানা বিচিত্র তথ্য। এসেছে স্বৈরশাসকের ডামি বা ছায়ামানব প্যাট্রিসিয় আরাগোনেসের কথা। প্যাট্রিসিয় আরাগোনেসের বিষণ্ণ মুখ দেখে একদিন জেনারেল জিজ্ঞাসা করেন তার খাবারে বিষক্রিয়া হয়েছে কিনা। উত্তরে আরাগোনেস জানান যে প্রেমে পড়ার ফলেই তার এই অবস্থা। এক উৎসবে তিনি এক সুন্দরীকে মুকুট পরিয়েছিলেন আর তার সঙ্গে ওয়াল্টজ নেচেছিলেন। তার পর থেকে তার মুখ আর তিনি ভুলতে পারছেন না। এরপর জেনারেল তার ডামি প্যাট্রিসিয় আরাগোনেসকেও তার রক্ষিতাদের কাছে যাবার ও সঙ্গম করার অনুমতি দেন। এই সূত্রেই জেনারেলের যৌন জীবনের কিছু দিক বর্ণনা করেন আখ্যান কথক। জেনারেলের অসংখ্য রক্ষিতা প্রাসাদের হারেমে থাকত আর তিনি পালা করে তাদের সঙ্গে সঙ্গম করতেন। প্রায়শই একাকীত্বের আড়ালটুকুও নিতেন না। রক্ষিতাদের ছেলেপিলেরা সবাই ছিল সাত মাস বয়সের শিশুর মতো দেখতে। তারা এসে পড়লে তাদের মায়েরা সঙ্গমকালে বিব্রত হতেন, তাদের চলে যেতে বলতেন সঙ্গমস্থল থেকে। জেনারেলের অবশ্য এই নিয়ে কোনও তাপ উত্তাপ ছিল না। আরাগোনেস জেনারেলের রক্ষিতাদের সঙ্গে সঙ্গমের অনুপতি পাবার পর তিনিও তাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করতে থাকেন। সেই সন্তানরাও সবাই সাত মাস বয়সের শিশুর মতোই বামনাকৃতি অবস্থায় আটকে থাকত। কোন সন্তান জেনারেলের আর কোনটি আরাগোনেসের তা কেউই জানতে পারে নি।

জেনারেলের শখ ছিল তাঁকে প্রজারা কতটা সম্মান করে, তাঁর শাসন সম্পর্কে তাদের কতটা সমীহ, সে সব জরীপ করা। তাই তিনি একটি ঢাকা ওয়াগনে চেপে শহর ঘুরতে শুরু করেন, দেখতে থাকেন তার শাসনের প্রভাব। পোপের দূত জনৈক বিশপ তাঁকে খ্রিস্ট বিশ্বাসে দীক্ষিত করতে চাইলে স্বৈরশাসক বলেন তিনি যখন সবকিছুই ঠিক করছেন তখন আর তার দীক্ষিত হবার প্রয়োজন কী! জেনারেল মহাদেশের নানা দেশের ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রনায়কদের আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁর রাজ্যে। তিনি তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতা চালাতেন শৈলশিখরের ওপরে এমন এক জায়গায় যেখান থেকে মহাসাগরের তটরেখা দেখা যায়। তাঁদের সঙ্গে সেখানে তিনি ডমিনো খেলতেন। তাঁরা ক্ষমতাচ্যুত আর তিনি প্রবল ক্ষমতাধর এবং তাঁদের আশ্রয়দাতা – এটা তাঁকে তৃপ্তি দিত। তবে ক্ষমতা চ্যুতির ভয় যে তাঁরও ছিল না, তা নয়।

জেনারেল সবসময়েই সেনাবাহিনীর বিদ্রোহের ভয়ে থাকতেন। এই সেনাবাহিনী যেমন একদিকে সামরিক শাসকদের ভরসা আবার তারা সেখান থেকেই ক্যু দে তা-র ভয়ে কেমন আচ্ছন্ন থাকেন গার্সিয়া মার্কেজ এই উপন্যাসে তা স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন। আখ্যানের একনায়ক জেনারেলটি সেনাবিদ্রোহের ভয়ে এমনই আচ্ছন্ন থাকেন যে সেনা বাহিনী অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছে এই আশঙ্কায় তিনি তাজা দশ রাউন্ড গুলির বদলে আটটি শূন্য কার্তুজ পাঠান। গোলাবারুদের পাউডারের সঙ্গে মিশিয়ে দেন সমুদ্রতীরের বালি। সমস্ত গোলাবারুদ রাষ্ট্রপতি ভবনে নিজের নাগালে একটি অস্ত্রাগারে রেখে দেন। সেই অস্ত্রাগারের একটিমাত্র চাবিই ছিল, কোনও নকল ছিল না। আর চাবিটি রাখা থাকত তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত রড্রিগো দ্যু আগুইলারের কাছে।

জেনারেল জানতে চান তার মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হলে দেশে কীরকম প্রতিক্রিয়া হবে। বিশেষত ক্ষমতালিপ্সু অধস্তনরা তার কী মূল্যায়ন করবে এবং কোন পথে হাঁটবে। আড়াল থেকে এইসব দেখার জন্য তিনি এক কৌশল অবলম্বন করেন। জেনারেল তার ডামি প্যাট্রিসিয় আরাগোনেসকে বিষ দিয়ে হত্যা করেন। তার মৃত্যুর পর জেনারেল আরাগোনেসের গায়ে চাপিয়ে দেন জেনারেলের নিজের পোশাক, সাজসজ্জা ও অলঙ্কার। জেনারেল নিজেই নিজের মৃত্যু সংবাদ রটতে সাহায্য করেন তারপর গোপনে দেখতে থাকেন এর প্রতিক্রিয়া। প্রজাদের মধ্যে, সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে, সর্বোপরি ক্ষমতালিপ্সুদের প্রতিক্রিয়া তিনি আড়াল থেকে দেখতে থাকেন। কারা তার মৃত্যুতে উল্লসিত আর কারা বেদনার্ত এসব বুঝে নিতে থাকেন। গোপন আস্তানা থেকে এসব ভালোভাবে দেখে নেবার পর তিনি ফেরেন রাষ্ট্রপতি প্রাসাদে। সেখানে মন্ত্রীকক্ষে তখন কাঠবাদাম কাঠের টেবিলের চারপাশে বসে ছিল তার বিরুদ্ধপক্ষের লোকেরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন উদারনৈতিক ও রক্ষণশীল উভয় দলের নেতারাই। ছিলেন হাই কম্যান্ড জেনারেলবর্গ, মন্ত্রী পরিষদের কয়েকজন সদস্য, প্রধান আর্চবিশপ, বিদেশী রাষ্ট্রদূত। তাঁরা শতাব্দীর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থেকে ক্ষমতার নতুন ভাগবিন্যাসের কথা বলছিলেন আর তাঁদের চোখে ছিল লোভ। এই সময়েই জেনারেল অতর্কিতে সেখানে প্রবেশ করলেন আর টেবিলের ওপর মারলেন এক চাপড়। এতেই ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে মন্ত্রণাকারীরা ছিটকে পালাল। অবশ্য পালানো তাদের পক্ষে সম্ভব হল না। জেনারেলের পরম বিশ্বস্ত রডরিগো দ্য আগুইলারের অনুগতরা তাদের ওপর মেশিনগানের গুলি চালালো নাগাড়ে আর শুরু হয়ে গেল এক বিরাট গণহত্যা। রাজধানী ছাড়িয়ে মফস্বলের শহরগুলোতেও এই গণহত্যার রেশ ছড়িয়ে পড়ল। জেনারেলের মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে যাওয়ার পর যারা আনন্দ উৎসব করেছিল তাদেরও হত্যা করা হল একে একে। আর যারা সে সময় শোক প্রকাশ করেছিল তারা নানাভাবে পুরস্কৃত হল।

দ্বিতীয় অধ্যায়টিতে আমরা জেনারেলের ভালোবাসার মানুষ মানুয়েলা স্যাঞ্চেজের কথা শুনি। ম্যানুয়েলা শ্রমজীবী পরিবারের মেয়ে। জেনারেল নিজেও যে দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন সেটি তাঁর মায়ের প্রসঙ্গ থেকে আমরা বুঝতে পারি। তাঁর মা এও বলেছিলেন যে তিনি যদি জানতেন জেনারেল শেষপর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রধান হবেন তাহলে কষ্টেসৃষ্টে যেভাবে হোক তাকে স্কুলে পাঠাতেন ছোটবেলায়। এই অধ্যায়ের শেষে অবশ্য ম্যানুয়েলা স্যাঞ্চেজ রহস্যময়ভাবে হারিয়ে যান। যদিও শোনা যেতে থাকে তাঁকে কখনো আরাকাতাকা, কখনো পানামা – ক্যারিবিয়ানের নানা জায়গায় নাকী দেখা যাচ্ছে।

তৃতীয় অধ্যায়টি ক্ষমতার রাজনীতির নানা দিক তুলে ধরে। জেনারেল অস্বাভাবিক সব ক্ষমতার কেন্দ্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বলে বলা হয়। দেখানো হয় তিনি এমনকী আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতিকেও নিয়ন্ত্রণ করছেন। তিনিই বলে দিচ্ছেন কখন গাছের ফল হবে, কখন পশুরা বড় হবে, কখন কোন মানুষের উন্নতি হবে। এই অধ্যায়েই একজন বিদেশী তরুণ রক্ষণশীল রাজনীতিবিদ জেনারেলের রাজ্যে আসে। সেই তরুণ নিজের মতাদর্শকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাসস্থান সহ নানা রাজনৈতিক সাহায্য চায় জেনারেলের কাছে। কিন্তু জেনারেল সে আবেদনে কর্ণপাত করার প্রয়োজন বোধ করেন না।

এই তৃতীয় অধ্যায়ের শেষেই আসে উপন্যাসের চরম নাটকীয় এক দৃশ্য। প্রথম অধ্যায়ে আমরা বারবার শুনেছিলাম স্বৈরশাসক জেনারেলের সবচেয়ে কাছের ও বিশ্বস্ত মানুষ হলেন জেনারেল রডরিগো দ্য আগুইলার। তাঁর কাছেই থাকত সামরিক সরঞ্জাম রাখার গুদামের চাবি। তিনিই জেনারেলের শত্রুদের নিকেশ করার ব্যবস্থা করেন। স্বৈরশাসক জেনারেল তাঁরই নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর আস্থা রেখে নিশ্চিন্তে থাকেন। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়। স্বৈরশাসক জেনারেল ভাবতে থাকেন তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে আরো একটি ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তার খলনায়ক হিসেবে তিনি রডরিগো দ্য আগুইলারকে দোষী সাব্যস্ত করেন ও হত্যা করেন। তারপর তার মৃতদেহটিকে রোস্ট করে একটি রূপোর থালায় রেখে ফুলকপি ও নানাপাতা দিয়ে সজ্জিত করে অপেক্ষমান জেনারেলদের খাবার টেবিলে পাঠিয়ে দেন। তার শরীরটা তারপর কেটে কেটে অন্যান্য জেনারেলদের প্লেটে তুলে দেওয়া হলে স্বৈরশাসক জেনারেল সেগুলো খেয়ে ফেলার নির্দেশ দেন।

পরবর্তী চতুর্থ অধ্যায় থেকেই স্বৈরশাসকের ক্ষমতার অবনমনের নানা ইঙ্গিৎ পাওয়া যেতে থাকে। শাসক তাঁর মাকে মহান করে তুলে ধরার চেষ্টা করেন, তাঁকে ঘোষণা করেন জাতির অভিভাবিকা হিসেবে। এই অধ্যায়ের শেষে নাজারেনো লাতাসিয়ার সঙ্গে জেনারেলের ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা জানা যায়, যাকে তিনি পরে বিয়ে করবেন। বস্তুত অসংখ্য রক্ষিতা বা ম্যানুয়েলা স্যাঞ্চেজের মতো প্রেমিকার কথা আগে জানা গেলেও তাঁর কোনও বৈধ স্ত্রীর কথা আগে জানা যায় নি। সেই অর্থে নাজারেনো লাতাসিয়া হলেন ব্যতিক্রমী।

পাঁচ নম্বর অধ্যায়ে স্বৈরশাসক ও নাজারেনো লাতাসিয়ার বিয়ের কথা জানতে পারেন পাঠক। তাদের একটি সন্তানও হয়। তবে সন্তান সহই নাজারেনো লাতাসিয়াকে হত্যা করা হয়। একটি জনবহুল বাজারে তাঁদের মৃতদেহ পড়ে থাকে ও কুকুরে সেগুলি ছিঁড়ে খায়। সরকারের দরকার মতো হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করার জন্য স্বৈরশাসক সায়েজঁ দ লা বাররা বলে একজন ঘাতককে নিয়োগ করেন।

ছয় নম্বর অধ্যায়ে স্বৈরশাসক ক্ষমতাসীন হবার শততম বছর উদযাপন করেন। কিন্তু এরপর থেকেই তাঁর শাসন সার্বিক অস্থিরতার মুখোমুখি হয়। শাসন ক্ষমতার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে যখন তিনি সংশয়ী, সে সময়েই তাঁর মৃত্যু হয়।

'অটাম অব দ্য পেট্রিয়ার্ক' উপন্যাসটি যখন ছাপাখানায় রয়েছে, সেই সময়ে গার্সিয়া মার্কেজের একটি সাক্ষাৎকার নেন গঞ্জালেজ বারমেহো। সেখানে বারমেহো মার্কেজকে এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রশ্ন করলে গার্সিয়া মার্কেজ বলেন, "অনেকে বলেন নি:সঙ্গতার একশো বছর লাতিন আমেরিকার সমগ্র ইতিহাসের এক সাংকেতিক উপস্থাপণ। যদি তা হয় তাহলে বলতে হবে এটা একটা অসম্পূর্ণ ইতিহাস। কারণ এটা ক্ষমতার সমস্যা নিয়ে কিছু বলে নি। গোত্রপিতার হেমন্ত উপন্যাসের বিষয়বস্তু এটাই।" 

একচ্ছত্র ক্ষমতা কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তার নিদর্শন হিসেবে অটাম অব দ্য পেট্রিয়ার্ক উপন্যাসটি শুধু সাহিত্য নয়, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি, ইতিহাস - সমস্ত ক্ষেত্রের আঙিনাতেই গুরুত্বপূর্ণ।