মার্কেজের আত্মজীবনী : জীবনের গল্পগুলো বলার জন্য বাঁচা, বেঁচে থাকা
- 06 March, 2023
- লেখক: অয়ন সেন
“Life is not what one lived, but what one remembers and how one remembers it in order to recount it.”
যে ‘খাসমহালের দরজার কাছে পর্যন্ত আসিয়া’ জীবনস্মৃতির পাঠকদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর আত্মকথায় এক অর্থে সেই নিষিদ্ধ পরিসরের দরজার আগল ভেঙে ঢুকেছেন আর অকপট সত্যভাষণে উন্মোচিত হয়েছে লেখকের ব্যক্তিজীবনের নানা স্তর। মূল লেখাটি ২০০২ সালে স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল Vivir Para Contarla নামে। ২০০৪ সালে Edith Grossman কৃত ইংরেজি অনুবাদটি বিশ্ব জুড়ে সমাদৃত হয়।
কলম্বিয়ার সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা আত্মকথনের শুরু হয় সেই সময় যখন মার্কেজের মা এসেছেন তাঁর কছে আরাকাটাকার বাড়ি বিক্রির জন্য, যে বাড়িতে জীবনের প্রথম আট বছর কাটিয়েছেন মার্কেজ, তারপর তাঁকে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটায় পাঠানো হয়েছিল শিক্ষালাভের উদ্দশ্যে। সেখানে সদ্য তেইশে-পা মার্কেজ বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ছেড়েছেন আইনের পাঠ, প্রতিদিন শিখতে চাইছেন লেখার কলাকৌশলগত দিকগুলি, গল্প লিখে ফেলেছেন বেশ কিছু, সংবাদপত্রে প্রতিদিন লেখার জন্য তিন পেসো করে পেতেন - তা দিয়েই তাঁর দিন গুজরান হত, তা সত্ত্বেও চরম অর্থকষ্টের মধ্যেই চরম উপভোগ করছেন জীবনকে, “...living like a king on what I was paid for my daily commentaries in the newspaper El Heraldo, which amounted to almost less than nothing, and sleeping in the best company possible wherever I happened to be at night.” মার্কেজের বোহেমিয়ান জীবনের বিবরণে অনেকেরই মনে পড়ে যেতে পারে নিজের তারুণ্যের দিনগুলির কথা - বুক-খোলা শার্টে, ধূসর জিন্স-এ, বইপাড়ায় শস্তায় তুলে-নেওয়া বিশ্বসাহিত্যের মনিমুক্তোয় বা বাসভাড়া বাঁচানোর জন্যে হিসেব করে একটা স্টপ আগেই বাস-থেকে-নেমে-পড়ার স্মৃতিতে যে দিনগুলো ছিল ঝরা পাতায় ঢাকা; চৈত্রের গনগনে আঁচে জনশূন্য পথে সঙ্গী যখন শুধু ট্রামলাইন, কাঁধের ব্যাগে Joyce-এর Ulysses বা Proust-এর Swan’s Way নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় নিজেকে মনে হত বিশ্বের সবথেকে সুখী মানুষ! এইরকমই কোনো এক দিনে মার্কেজও হয়তো মনস্থির করেছিলেন লেখক-জীবন বেছে নেওয়ার, জীবনের দীর্ঘ পথ পিছনে ফেলে এসে তাঁর স্মৃতি রোমন্থন, “Now, with more than seventy-five years behind me, I know it was the most important of all the decisions I had to make in my career as a writer. That is to say: in my entire life.”
শিক্ষকদের কথা, বিবিধ উপন্যাসের প্রতি তাঁর মুগ্ধতা, সংবাদপত্রে নিজের গল্প প্রকাশিত হওয়ার স্মৃতিচারণ, স্বদেশ ছেড়ে ইউরোপ যাওয়ার কথা – সমস্তই বর্ণিত হয়েছে এক ঘোর-লাগা গদ্যে। এসেছে রাজনীতির অনুষঙ্গও - উনিশ শতকের প্রথমার্ধে স্পেনীয় শাসন থেকে মুক্ত হওয়া কলম্বিয়া দীর্ঘকাল ক্ষতবিক্ষত হয়েছে গৃহযুদ্ধে, মার্কেজের দাদু নিকোলাস ছিলেন কর্নেল ও গৃহযুদ্ধের অগ্রণী সৈনিক, যার সাথে জীবনের প্রথম দশ বছর কাটিয়েছেন মার্কেজ। যে রাজনৈতিক ঘটনা প্রথম গভীর রেখাপাত করে মার্কেজের জীবনে, তা হল ১৯৪৮-এ Jorge Eliecer Gaitan-এর হত্যা ও দেশ জুড়ে পরবর্তী অসন্তোষ যার ফলে পুড়ে যায় মার্কেজের ছাত্রাবাসটিও, মার্কেজ তখন বোগোটার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তাঁর কথায়, ‘on April 9 1948, the 20th century began in Colombia.’ গাইতানের হত্যা সূত্রপাত ঘটায় দেশ জুড়ে হিংসার যা La Violencia নামে পরিচিত। সেই মুহূর্তে বোগোটার রাজপথে নিয়ন্ত্রণহীন ভীড়, ছোটাছুটির মধ্যে ছিলেন ভবিষ্যতের এক দেশনায়কও – ফিদেল কাস্ত্রো, যাঁর সাথে মার্কেজের এক অনন্য বন্ধুত্বের ইতিহাস পরবর্তীকালে রচিত হবে! “I met him eleven years later, when I was present as a reporter for his triumphant entry into Havana, and in time we achieved a personal friendship that has endured countless difficulties over the years.”(P-298)
বইটি পড়তে পড়তে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে কীভাবে কাল্পনিক শহর মাকোন্দো বা বুয়েন্দিয়া-পরিবারের জন্মসূত্র অন্তর্লীন হয়ে অছে মার্কেজের নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার ঠাসবুনোটের মধ্যে, তাঁর যাপিত জীবনেরই ‘পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ’ যেন তাঁর রচনা। যে জাদু বাস্তবতার মহাকাব্যিক বিস্তার ঘটিয়েছিলেন মার্কেজ, ব্যাক্তিজীবনে তার ইশারা কী এসেছিল সাংবাদিকতা করার সময়ই? ১৯৫০ এর সেপ্টেম্বর ‘এল উনিভার্সাল’-এর পাতায় সম্পাদকীয় প্রতিবেদন লিখতেন মার্কেজ, ‘সেই বছরগুলো জুড়ে আমি মায়েস্ত্রো সাবালাকে বারবার অনুরোধ করেছিলাম আমাকে প্রতিবেদন রচনার কৌশল শেখাতে... তিনি কখনোই আমাকে শেখাবেন বলে ঠিক করেন নি, বরং বারো বছরের এক মেয়ের ধাঁধা দিয়ে আমাকে সমস্যায় ফেলে দিলেন। মেয়েটাকে কবর দেওয়া হয়েছিল সান্তা ক্লারার কনভেন্টে। মেয়েটার চুল তার মৃত্যুর পর দুই শতাব্দীতে কুড়ি মিটারের বেশি বেড়েছিল।’ এর প্রায় চল্লিশ বছর পর এই ঘটনাকে তাঁর উপন্যাস Of Love and Other Demons-এ নিয়ে আসেন মার্কেজ!
লেখক মার্কেজের পাশাপাশি পাঠক মার্কেজকেও আমরা আবিস্কার করি এখানে। আইন বিভাগে পড়ার সময় অবসরের বিকেলগুলোতে তিনি ঘরে বসে অথবা কাফে’তে বসে বন্ধুদের থেকে ধার করে আনা বইগুলি পড়ে শেষ করতেন, সময়মতো ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কখনও বা রাত জেগেও পড়তে হত। এইভাবেই তিনি আবিস্কার করেছিলেন বোর্হেস, লরেন্স, অলদাস হাক্সলি, গ্রাহাম গ্রীন এবং আরও অনেককে। জেমস জয়েসের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখার সাথে তাঁর পরিচয়ের কথা পাই এইভাবে:
“One day Jorge Alvaro Espinosa, a law student who had taught me to navigate the Bible and made me learn by heart the complete names of Job’s companions, placed an awesome tome on the table in front of me and declared with his Bishop’s authority: “This is the other Bible.” It was, of course, James Joyce’s Ulysses, which I read in bits and pieces and fits and starts until I lost all patients. It was premature brashness. Years later, as a docile adult, I set myself the task of reading it again in a serious way, and it not only was the discovery of a genuine world that I never suspected inside me, but it also provided invaluable technical help to me in freeing language and in handling time and structures in my books.”
বন্ধু আলভারোর কাছে ভার্জিনিয়া উলফের নাম প্রথম শোনেন মার্কেজ, তাঁর ভাষায়, “it was the first time I heard the name of Virginia Woolf, whom he called Old Lady Woolf, like Old Man Faulkner.”(p-338) উলফের লেখা এতটাই প্রভাবিত করে তাঁকে যে, “I went back to Cartagena with the air of someone who had discovered the world. Then the recitations after meals in the house of the Franco Munera family were not poems of the Golden Age and Neruda’s Twenty love Poems, but paragraphs from Mrs. Dalloway and the ravings of its heartbreaking character, Septimus Warren Smith. I turned into another person, restless and difficult....”(P-339)
“He (Gustavo Ibarra) introduced me to Melville: the literary feat of Moby-Dick, the magnificent sermon about Jonah for whalers weathered on all the oceans of the world under the immense dome constructed by with the ribs of whales. He lent me Nathaniel Hawthorne’s The House of the Seven gables, which marked me for life. Together we attempted a theory of the fatality of nostalgia in the wanderings of Ulysses Odysseus, where we became lost and never found our way out. Half a century later I discovered it resolved in a masterful text by Milan Kundera.” (P.340-41) এভাবেই এগিয়ে চলে তাঁর বিশ্বসাহিত্য পাঠ, কখনও বোগোটার পথে ঘুরে-বেড়ানো মার্কেজ নিজেই যেন কাফকার রচিত এক চরিত্র, তাঁর নিজের কথায়, ''The truth of my soul was that the drama of Colombia reached me like a remote echo and moved me only when it spilled over into rivers of blood. I would light a cigarette without finishing the one before, I would breathe in the smoke with the longing for life seen in asthmatics gulping down air, and the three packs I consumed each day were evident on my nails and in an old dog's cough that disrupted my youth. In short, I was shy and sad, like a good Caribbean, and so jealous of my intimate life that I would answer any question about it with a rhetorical digression. I was convinced my bad luck was congenital and irremediable, above all with women and with money, but I did not care, because I believed I did not need good luck to write well. I did not care about glory, or money or old age, because I was sure I was going to die very young, and in the street.''
বহুমাত্রিক এই জীবনের কথা পড়তে পড়তে বারংবার বিস্মিত হতে হয় এর ঘটনাবহুল, মহাসাগরপ্রমাণ বিস্তৃতিতে, আর যে ইচ্ছেটা ফিরে ফিরে আসে তা হল মার্কেজের রচনাকে আবার নতুন করে পড়ার। মনে পড়ে, শেষ জীবনে আর কিছুই লিখতে পারছিলেন না মার্কেজ স্মৃতিভ্রংশের শিকার হয়ে, তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রচনার সেই অংশের মতোই নয় তো, যেখানে চিরকুটে লিখে সমস্ত কিছুর নাম মনে রাখত গ্রামশুদ্ধ লোক! যদি তাঁকেও আরেকটি বার ধরিয়ে দেওয়া যেত জীবনের খেই – সম্ভব হয় নি, কারণ আমাদের সকলেরই জীবন যাপনের হিরণ্যপ্রভ মুহূর্তগুলির যাদুবাস্তবতাও তো এমনই – যা আমরা হারিয়ে ফেলেও হৃদয় খুঁড়ে জাগাতে ভালোবাসি, বেঁচে থাকি গল্পটা বলব বলে, সেই বলার মধ্য দিয়ে আরেকবার ফিরে যাই যাপিত জীবনের মধ্যে।
|