ব্যাঙ্ক সংযুক্তি, বৃহৎ পুঁজি ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা

এটা সর্বজনবিদিত যে আমাদের দেশে নেতা ও ধনকুবেররা হাত ধরাধরি করে চলে, যাকে বলে ওয়াক হ্যান্ড ইন হ্যান্ড। এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাংবাদিক এম কে ভেনু ২০১৫তে আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার ভারত ভ্রমণের সময়কার একটা ঘটনা উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ। ২৫শে জানুয়ারি তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মিলিত হন। ওবামা যখন প্রবেশ করেন তখন প্রায় পঁচিশ জন শিল্পপতি সারি বেধে দাঁড়িয়ে তাঁকে স্বাগত জানান। এঁদের মধ্যে ছয় থেকে আট জনের ব্যাঙ্কে মোট দেনা ৩.৫ লাখ কোটি টাকা, প্রায় সব ব্যাঙ্কই সরকারি। সেই সময় এই ব্যাঙ্কগুলির মোট পুঁজি ছিল প্রায় পাঁচ লক্ষ কোটি, যার ৭০% শতাংশ এই শিল্পপতিদের ব্যবসার ভালোমন্দ, ওঠাপড়া, অনিশ্চয়তার সাথে যুক্ত। এঁদের ব্যবসা ভালো হলে ব্যাঙ্কেও ব্যবসা ভালো হবে, এঁদের ব্যবসায় যদি ধস নামে তাহলে ব্যাঙ্কও ডুববে। ব্যাঙ্কের স্থিতিশীলতা যে কী বিপুল ভাবে হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পপতির ওপর নির্ভর করছে তা এই ছোট ঘটনাটি দেখিয়ে দেয়।   

এটা বলা যেতেই পারে যে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের সুফলগুলি আজ অনেকটাই ক্ষয়প্রাপ্ত; এর পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে ব্যাঙ্ক পুঁজি আরও বেশি বেশি করে বৃহৎ শিল্পপতিদের সেবাদাস হয়ে উঠেছে। অনেকে হয়তো এটা শুনে রে রে করে উঠবেন! এটা তো মনে রাখতে হবে যে উনি আমাদের সর্বদাই ধনসম্পদ সৃষ্টিকারী, ওয়েলথ ক্রিয়েটরদের, সম্মান জানাতে বলেছেন। তাঁদের রমরমার উৎস যে অনেকটাই ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সাধারণ গ্রাহকদের ধনের কারণে সেটা ‘জাতীয় স্বার্থ’, ‘পাঁচ লক্ষ কোটি টাকার ইকনমি’ ইত্যাদির ঢক্কানিনাদে বিস্মৃত হতে বলেছেন। যদি এটাও বলা হয় যে গত কয়েক বছর প্রচুর ঢাকঢোল পিটিয়ে যে ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণ বা মার্জার করা হল তা মূলত বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে তাহলেও অনেকের গোঁসা হবে। বলবেন ছোট ছোট ব্যাঙ্ক রেখে লাভ কি, বড় ব্যাঙ্ক হলে দক্ষতা বাড়বে, পরিষেবা আরও ভালো হবে, বিশ্বের সেরা ব্যাঙ্কের মধ্যে আমাদের ব্যাঙ্কও স্থান পাবে ইত্যাদি। ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের আগের পরিষেবার চেয়ে পরের পরিষেবা কতটা ভালো বা খারাপ হয়েছে তা প্রত্যেকে নিজেই পরখ করে নেওয়াই শ্রেয়। আর এখনো বিশ্বের প্রথম একশোটি ব্যাঙ্কের মধ্যে, সেই সবেধন নীলমণি, স্টেট ব্যাঙ্কই শুধুমাত্র ৫৫ নম্বর স্থানে আছে। ডেলয়েট ‘গ্লোবাল ব্যাঙ্কিং, ২০২৪’ নামক একটা সমীক্ষায় জানাচ্ছে আগামী দশকে আরও ভারতীয় ব্যাঙ্ক এই তালিকাভুক্ত হতে পারে। সেই আশায় বসে থাকতে হবে আর ভাবতে হবে সংযুক্তিকরণের প্রায় পাঁচ বছর বাদে আদৌ লাভটা কি হল? গত কয়েক বছরে ব্যাঙ্ক মার্জারের প্রক্রিয়ার পাশাপাশি বৃহৎ পুঁজির পুষ্টিকরণের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে।

১৯৯১এ অর্থনৈতিক উদারীকরণের পরেই ব্যাঙ্ক শিল্পে সংস্কারের জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভুতপূর্ব গভর্নর এম নরসিংহমের নেতৃত্বে একটি কমিটি তৈরি হয়। এই কমিটি ১৯৯৮ সালে তাঁদের দ্বিতীয় রিপোর্টে ছোট ব্যাঙ্কগুলি জুড়ে বড় ব্যাঙ্ক তৈরি করার প্রস্তাব পেশ করে। তাঁদের সুপারিশ ছিল --- বিশ্বমানের তিনটি বড় ব্যাঙ্ক থাকবে; সেগুলির নিচে রাজ্য স্তরে সাত আটটি ব্যাঙ্ক; তারও নিচে অনেকগুলি স্থানীয় ও আঞ্চলিক ব্যাঙ্ক। কমিটি সতর্ক করে দেয় কোনও অলাভজনক সংস্থাকে যেন লাভজনক সংস্থার সাথে জুড়ে না দেওয়া হয়। কমিটি ক্রমবর্ধমান এনপিএ (নন পারফর্মিং এসেট-অনুৎপাদনশীল সম্পদ) নিয়েও তাঁদের মতামত দেয়। আশ্চর্যজনক ভাবে তাঁরা জানান যে এর মূল কারণ হল ক্ষুদ্র লোন বা সমাজের পিছিয়ে থাকা অংশের (প্রায়ারিটি সেক্টর) ঋণ। আজ অবধি যত সংযুক্তিকরণ হয়েছে তা ওই কমিটির সুপারিশেরই প্রতিফলন। প্রথম দেড় দশকের প্রচেষ্টায় সেভাবে কোনও উল্লেখজনক সংযুক্তিকরণ হয়নি। এক সময় চিদাম্বরম খুব হাঁকডাক করে তিনটি সি’র (কনসলিডেশন, কনভার্জেন্স, কম্পিটিশন-সুদৃঢ়তা, সমধর্মিতা, প্রতিযোগিতা) মন্ত্র নিয়ে ওই প্রস্তাব কার্যকর করার জন্য নেমে পড়েছিলেন। কিন্তু তখন মিলিঝুলি সরকার, আঞ্চলিক দলগুলির রমরমা। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে আঞ্চলিক শিল্পপতিরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে, আঞ্চলিক দলগুলিও কলেবরে বেড়ে ওঠে। দেখা গেছে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৯ এর মধ্যে আঞ্চলিক দলগুলির ভোট শেয়ার ২৬% থেকে বেড়ে ৪৬% হয়ে যায়। কেন্দ্রের সরকার এদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে এবং নড়বড়ে নেতৃত্ব ও ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের শক্তিশালী আন্দোলনের কারণে মার্জার প্রক্রিয়া থমকে যায়। আর কমিটির সতর্কতা উপেক্ষা করে সেই সময় যে সংযুক্তিগুলি হয়েছে তা মূলত বড় ব্যাঙ্ক সংকটগ্রস্ত ব্যাঙ্ককে অধিগ্রহণ করেছে, যেমন গ্লোবাল ট্রাস্ট ব্যাঙ্ককে ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্ক অফ কমার্স উদ্ধার করেছে।

উদারীকরণের কারণে টেলিকম, যাত্রীবাহী বিমান, সড়ক, বন্দর, বিদ্যুৎ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেসরকারি পুঁজির ব্যাপক প্রবেশ শুরু হয়। ইউপিএ সরকারের শেষ কয়েক বছরে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ লাফ দিয়ে বাড়তে থাকে। ব্যাঙ্ক জালিয়াতি, প্রতারণা, তঞ্চকতা প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পায়। ধড়িবাজ ঋণগ্রহীতারা একটি প্রকল্পের জন্য যখন দেনার আবেদন করে তখন দ্বিতীয় একটি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ করে সেই টাকা প্রথম ব্যাঙ্কে সিকিউরিটি হিসাবে জমা দেয়। দুটি ব্যাঙ্কই এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে অন্ধকারে থাকে। যখন ওই প্রকল্প সংকটে পড়ে তখন দুটি ব্যাঙ্কেরই পতন শুরু হয়। এসবের ফলে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক লোকসানে যেতে শুরু করে। ২০১২য় ক্রেডিট সুইস ‘হাউস অফ ডেট’ নামক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে যাতে ব্যাঙ্কগুলির এই পতন প্রতিফলিত হয়। এই রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৭ এর পরে ভারতীয় ব্যাঙ্কের দেওয়া ঋণ ২০% বৃদ্ধি পায়। নির্দিষ্ট কিছু কর্পোরেট এর দ্বারা উপকৃত হয়। এরা হল আদানি, এসার, রিলায়েন্স, অনিল আম্বানি, জিন্দালদের জেএসডব্লিউ, বেদান্ত, ভিডিওকন  ইত্যাদি। পাঁচ বছরে এই কোম্পানিগুলির ঋণ পাঁচ গুণ বৃদ্ধি হয়, যা সব ব্যাঙ্ক মিলিয়ে মোট ঋণের ১৩%। এই সময় পাব্লিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের খুব রমরমা শুরু হয়। এর ফলে পরিকাঠাম নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যাপক বেসরকারি পুঁজির প্রবেশ ঘটে। এছাড়া স্টিল ও এনার্জি ক্ষেত্রেও প্রচুর বিনিয়োগ হয়। রিপোর্ট উদ্বেগ প্রকাশ করে যে একই ধরণের শিল্পে কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী, যারা মূলত একই ক্ষেত্রে (পরিকাঠাম, এনার্জি, মেটাল ইত্যাদি) বিনিয়োগ করে, তাঁদের ঋণ দেওয়া হয়েছে। এই কেন্দ্রীকরণের কারণে ঝুঁকির পরিমাণ অত্যন্ত বেশি। ক্রেডিট সুইস সঠিক ভাবেই অনুমান করেছিল, কারণ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ওই রিপোর্টে উল্লেখিত দশটি সংস্থার মধ্যে সাতটির বিরুদ্ধে ব্যাঙ্ক দেউলিয়া প্রক্রিয়া শুরু করে।

নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে গৌতম আদানি নামক এক প্রথম প্রজন্মের ব্যবসায়ী গুটি গুটি পায়ে কর্পোরেট দুনিয়ায় তাঁর উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করেন। তাঁর উত্থান নেতা শিল্পপতির যোগসাজশে সাঙাৎ পুঁজি বা ক্রোনি ক্যাপিটাল নির্মাণের এক ক্লাসিক কেস। ১৯৯৮ সালে গুজরাটের কচ্ছ জেলার মুদ্রা বন্দরে তাঁর বাণিজ্যিক কাজকর্ম শুরু হয়। এই বছরই ‘আদানি পোর্টস এন্ড লজিস্টিকস’ এর যাত্রা শুরু হয়। ২০০১এ নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন। পরের বছর কুখ্যাত গুজরাট দাঙ্গা। ২০০৩এ মোদী শিল্প সম্মেলন, ‘ভাইব্রান্ট গুজরাট’ সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। সিআইআই (কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজ) দাঙ্গায় তাঁর ভূমিকার সমালোচনা করে। আদানি সিআইআই থেকে বেরিয়ে এসে শিল্পপতিদের একটি পাল্টা গোষ্ঠী তৈরি করেন। এই গোষ্ঠীর প্রচেষ্টায় ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাট’ বিপুল ভাবে সফল হয়। আদানিকে তাঁর পর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। রাজনৈতিক যোগাযোগের পুরো ফয়দা তুলে ২০০৬ সালে মুন্দ্রা বন্দর এসইজেড (স্পেশ্যাল ইকনমিক জোন) ঘোষিত হয় এবং পরের বছর এর শেয়ার বাজারে আসে। ২০০৮এ আদানির নাম প্রথম ফোর্বেসের অবুর্দপতিদের তালিকায় উঠে আসে। ওই সংস্থার তথ্য অনুযায়ী তখন তাঁর নেট ওয়ার্থ ৭৭১৯০ কোটি টাকা। এরপর থেকে এই শিল্পপতিকে যে ভাবে ন্যক্করজনক ভাবে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে তা ভারতীয় ব্যবসাবাণিজ্যের ইতিহাসে বিরল। বিমানবন্দর সংক্রান্ত কোনও রকম অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও তাঁর হাতে প্রথমে মুম্বাই ও পরে আরও ছটি বিমানবন্দর তুলে দেওয়া হয়েছে।  নির্লজ্জ ভাবে তাঁর ক্ষেত্রে সমস্ত নীতি নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছে। তাঁর সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দীদের নানা ভাবে চাপ দিয়ে, এমনকি গোপনে হুমকি দিয়ে সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।    

২০১৪য় পরিস্থিতি আমুল পাল্টে যায়। বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। প্রায় তিন দশক বাদে কেন্দ্রে স্থায়ী সরকার গঠিত হয়। সরকারের নেতৃত্বে আসেন এমন এক নেতা যিনি সর্বশক্তিমান, বিজনেস-ফ্রেন্ডলি, এবং এতোটাই ক্ষমতাশালী যে তিনি নিজের কর্তৃত্বেই লকডাউন, বিমুদ্রাকরণ, জিএসটির মতো বড় বড় সিদ্ধান্ত অনায়াসে নিয়ে ফেলতে পারেন। ২০১৬য় ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বিশ্ব জুড়ে অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির রমরমা বৃদ্ধি পায়। ক্ষমতা ও পুঁজির ব্যাপক কেন্দ্রীকরণ আরও ত্বরান্বিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর সাথে আদানি আম্বানিদের গাঁটছড়া আরও দৃঢ় হতে থাকে। তাঁর মেয়াদের প্রথম চার বছরে নরেন্দ্র মোদী ১৬৫ দিনে বাহন্নটি দেশে সফর করেছেন। এইসব সফরে গৌতম আদানি ও অনিল আম্বানি বহু বার ওনার সঙ্গী হয়েছেন। ষোলোটি দেশে তাঁরা আঠারোটি চুক্তি সই করেন, তেরোটি আদানি ও পাঁচটি আম্বানি। আদানির কাছে এই অভিজ্ঞতা নতুন নয়, মোদী মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি ২০০৮এ তাঁর সাথে কেনিয়া ও উগান্ডা সফর করেছিলেন। ২০১৯ এ তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে অস্ট্রেলিয়া সফর করেন এবং কুইন্সল্যান্ডে কয়লা খনি অধিগ্রহণ করেন। এই প্রজেক্টের জন্য তিনি স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে বিপুল অংকের ঋণ পান, যদিও পরবর্তি সময়ে এই প্রকল্প নানাবিধ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। ব্যাঙ্ক, পুঁজিপতি, রাজনৈতিক নেতার মধ্যে এরচেয়ে গভীর হৃদ্যতার আর কি প্রমাণ দেখান যেতে পারে! অনিল আম্বানির রিলায়েন্স ডিফেন্স ২৮শে মার্চ, ২০১৫ নিগমভুক্ত হয়। এর মাত্র বারো দিন বাদেই ফ্রান্সের সাথে ৩৬টি রাফায়েল জেট বিমান ক্রয়ের চুক্তি হয়। সরকারি সংস্থা হিন্দুস্তান এরোনটিক্স লিমিটেড (হাল) কে টপকে অনিল আম্বানি, যাঁর প্রতিরক্ষা শিল্পে বিন্দুমাত্র পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, তিনি এর বরাত পান। পরের এক বছরে তাঁর কোম্পানি সুইডেন ও ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা সংস্থার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। নেতা ব্যবসায়ীর এই ধরণের সখ্যতা এবং কোনও চক্ষুলজ্জার পরোয়া না করে নিজের প্রিয়পাত্রকে নানা বরাত পাইয়ে দেওয়া বাণিজ্যের ইতিহাসে অভুতপূর্ব!  

ইতিমধ্যে ক্রমবর্ধমান এনপিএর কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। ২০১৪য় রঘুরাম রাজন গভর্নর থাকাকালীন আরবিআই একটি রিপোর্ট প্রস্তুত করে যাতে দেখা যায় যে গত এক বছরে সরকারি ব্যাঙ্কের সম্পদের প্রভূত ক্ষয় ঘটে গেছে। পরের বছর আরবিআই এসেট কোয়ালিটি রিভিউ (AQR) চালু করে যার ফলে ব্যাঙ্ক সমস্ত অনাদায়ী ঋণ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে কয়েক বছরের মধ্যে এনপিএ দু লাখ কোটি থেকে নয় লাখ কোটি হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৮-১৯এ বিজয় মাল্যা, নীরব মোদী, মেহুল চোক্সি, যতিন মেহতার মতো জালিয়াতরা প্রায় প্রায় আশি হাজার কোটি টাকা ঋণ লোপাট করে বিদেশে পলায়ন করে। এসবিআই, পিএনবি, আইওবি প্রবল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সামগ্রিক ভাবে  বিভিন্ন ব্যাঙ্ক সংকটাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তাদের পক্ষে এতো এনপিএর ভার বহন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। পিসিএ (প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন) নামক একটা প্রথা চালু হয়। এর দ্বারা আরবিআই একটি ব্যাঙ্ককে কড়া নজরদারিতে রাখে, তাদের বড় লোন দেওয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে, অন্যান্য কাজকর্মেও বেড়ি পড়ায়। এই করে এই সব ‘বিপথগামী’ ব্যাঙ্কগুলিকে শুধরানোর চেষ্টা করা হয়। দুএকটা সংস্থার শোধরালেও বাকিদের আরও অবনতি হয়। ২০২০ সালে বিবেক ভেলাঙ্কার নামে এক আরটিআই অ্যাক্টিভিস্ট অনুৎপাদক সম্পদ নিয়ে যাবতীয় তথ্য যোগাড় করে জানতে পারেন যে গত আট বছরে বারোটি সরকারি ব্যাংক ৬.৩২ লক্ষ কোটি ঋণ রাইট অফ করেছে, এর মধ্যে ২.৭৮ লক্ষ কোটি ঋণ বৃহৎ ঋণগ্রহীতা, যাদের ঋণের পরিমাণ ১০০ কোটির ওপরে। অনেক ছোটাছুটি, অনুনয় বিনয়, কোর্ট-কাছারি করে ব্যাংকগুলি এদের থেকে মাত্র ৭% অর্থাৎ ১৯২০৭ কোটি পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে। ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণ অবশ্যম্ভাবি হয়ে পড়ে। ২০১৭ সালে স্টেট ব্যাঙ্কের সাথে তার অনুষঙ্গি (অ্যাসোশিয়েট) ব্যাঙ্কগুলি মিলে যাওয়ার পর মার্জার প্রক্রিয়া গতি লাভ করে। ২০১৯ এ ব্যাঙ্ক অফ বরোদা, দেনা ব্যাঙ্ক ও বিজয়া ব্যাঙ্ক একত্রিত হয়। এরপরে দশটি ব্যাঙ্ক চারটি বড় ব্যাঙ্কে রূপান্তরিত হয়। মোট ২৭টি সরকারি ব্যাঙ্ক মিলেমিশে হয়ে দাঁড়ায় ১০। এই সংযুক্তিগুলি খুব বিচক্ষণতার সাথে করা হয়েছিল এমনটা নয়। গত কয়েক বছর ধরে অলাভজনক ভাবে চলা সংস্থাকে লাভজনক ব্যাঙ্কের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ধরণের সংযুক্তির ফলে হিতে বিপরীতও হয়েছে। এনপিএর রাশ টেনে ধরা যায়নি। ২০২১এ মোট এনপিএ হয়ে দাঁড়ায় ৬.১৭ লক্ষ কোটি।

ব্যাঙ্ক মার্জারের সাথে সাথে পুঁজির কেন্দ্রীভবনও চলতে থাকে। টেলিকম, পরিকাঠাম, বন্দর, বিমানবন্দর, বিদ্যুৎ, স্টিল, সিমেন্ট, গাড়ি, টিভি ও অন্যান্য ইলেক্ট্রিকাল সামগ্রী ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর দু তিনটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। দেখা যায় এইসব ক্ষেত্রের ৫০%র অধিক দুতিনটে কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ একই গোষ্ঠী বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির বাজারের মূল অংশ করায়ত্ত করে নেয়; যেমন রিলায়েন্স (টেলেকম, খুচরো ব্যবসা বা রিটেল, পেট্রোকেমিকাল), টাটা (স্টিল, বাণিজ্যিক গাড়ি, আইটি), আদানি (বন্দর, ভোজ্য তেল, বিমানবন্দর), আদিত্য বিড়লা (সিমেন্ট, এলুমিনিয়াম)। শিল্পের এই কেন্দ্রীভবন, ছোট সংস্থাগুলিকে বড় সংস্থা গিলে খাওয়ার প্রক্রিয়া, বিমুদ্রাকরণ ও জিএসটি চালু হওয়ার ফলে আরও সহজ হয়ে যায়। বহু ছোট ও মাঝারি সংস্থা এগুলির মোকাবিলা না করতে পারার কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে অথবা লুপ্ত হয়ে যায়। ২০১৬তে অনাদায়ী ঋণ উদ্ধার করার জন্য ‘ইনসল্ভেন্সি এন্ড ব্যাঙ্করাপ্টসি কোড’ (আইবিসি) প্রণয়ন হয়। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এতে ব্যাঙ্কের সামান্যই লাভ হয়, উল্টে শিল্পের কেন্দ্রীভবনকে আরও জোরদার করে। যেমন ভিডিওকনের মোট অনাদায়ী ঋণের (৮৮০০০ কোটি টাকা) মাত্র ৪.১% দিয়ে বেদান্ত সেটাকে অধিগ্রহণ করে, ব্যাঙ্কের লোকসান প্রায় ৯৬%। এসার স্টিলও আইবিসিতে যায়, আর্সেলর মিত্তাল সেটা অতি সস্তায় কিনে নিয়ে স্টিল সেক্টরে চতূর্থ শীর্ষ স্থানে চলে যায়। একই ভাবে আদিত্য বিড়লার আল্ট্রাটেক বিনানি সিমেন্ট অধিগ্রহণ করে আরও শক্তিশালী হয় এবং মুকেশ আম্বানির জিও টেলিকমে বিনা মূল্যে ভয়েস কল এবং অতি সস্তায় ডেটা দিয়ে এমন আগ্রাসী অভিযান শুরু করে যে এয়ারসেল সহ আরও তিনটি কোম্পানি ওই সেক্টর থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয়। প্রবল কেন্দ্রীভবনের কারণে একটা হিসাব অনুযায়ী ১৯৯০এ কুড়িটি সবচেয়ে লাভজনক কর্পোরেট থেকে কর্পোরেট সংস্থাগুলির ১৪% লাভ প্রাপ্ত হয়, যেটা ২০১০এ হয়ে দাঁড়ায় ৩০%, ২০১৯এ লাফ দিয়ে হয় ৭০%।

সরকারি ব্যাঙ্কের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয় কিন্তু এনপিএর সমস্যা তো মেটে না। বড় ব্যাঙ্ক তৈরি করেও এখনো দেশের সর্ব বৃহৎ দশটি ব্যাঙ্কের মধ্যে ছটি প্রাইভেট। প্রথম পাঁচটির মধ্যে একটি মাত্র সরকারিঃ স্টেট ব্যাঙ্ক। সুতরাং বেসরকারিকরণের যে সম্মিলিত আওয়াজ যা সেই জাতীয়করণের সময় থেকে শুরু হয়েছে তা আজও একই ভাবে জোরদার। কীভাবে ব্যাঙ্কগুলিকে প্রাইভেট করা যায়, কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া যায় তার জন্য নানা ছল তৈরি হচ্ছে। সংসদের প্রতিটি অধিবেশনের আগে আওয়াজ ওঠে এবার দুটো ব্যাঙ্ক বেচে দেওয়া হবে। প্রবল গুজব ব্যাঙ্ক ক এবার গেল, কি ব্যাঙ্ক খ গেল! কিন্তু কিছুই হয় না! হবে কী করে ক্রেতা নেই। ভারতীয় শিল্পপতিরা সেয়ানা, তারা সবকিছুই ফোকটে পেতে চায়; ভুরিভুরি এনপিএওয়ালা ব্যাঙ্ক নিতে তারা একেবারেই আগ্রহী নয়। সুতরাং ব্যাঙ্কের ব্যালেন্স শিট পরিষ্কার করতে হবে, সেগুলোকে ক্রেতার কাছে লোভনীয় করে তুলতে হবে। রাইট-অফ তো শেষ উপায়, ব্রহ্মাস্ত্র, তার আগে অন্য সব পন্থার চেষ্টা হোক।   

সেই কারণে ‘ফিন্যান্সিয়াল রিজলিউশন এন্ড ডিপোজিট ইন্সিউরেন্স’ (এফআরডিআই) বিল এল। এতো দিন কোনও ব্যাঙ্ক ডুবে যাওয়ার অবস্থা হলে সরকার সেটাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসত। হয় সরকার নিজে সংকটাপন্ন সংস্থাটিতে পুঁজি বিনিয়োগ করত কিংবা তাদের নির্দেশে কোনও বৃহৎ সংস্থা সেটিকে অধিগ্রহণ করত। যেমন আইডিবিআই ব্যাঙ্ককে সংকট থেকে উদ্ধার করার জন্য সরকার এলআইসির দ্বারস্থ হয়। ক্রমবর্ধমান এনপিএর কারণে বিপর্যস্ত এই ব্যাঙ্কটিকে উদ্ধার করার জন্য এলআইসিকে ৫১% শেয়ার ক্রয় করতে বাধ্য করা হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘বেইল আউট’। এফআরডিআই এর উল্টো ‘বেইল ইন’ নামক এক ভয়ঙ্কর ধারণা নিয়ে এল। অর্থাৎ কোনও ব্যাঙ্কে ধস নামলে, সেই ব্যাঙ্কের গ্রাহকদের গচ্ছিত আমানত কাজে লাগিয়ে সংস্থাটিকে উদ্ধার করা হবে। গ্রাহকরা শুধু মাত্র বিমা করা এক লক্ষ টাকাই ফেরত পাবেন। এফআরডিআই করে সরকার সম্ভাব্য ক্রেতাদের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করল যে ব্যাঙ্ক লোকসানে গেলেও মালিকের ক্ষতি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই, গ্রাহকদের টাকাতেই ক্ষতি পুষিয়ে যাবে। এই প্রস্তাব মানুষের মধ্যে প্রবল আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং জোরালো প্রতিবাদের কারণে ২০১৮র অগস্ট মাসে সেটা স্থগিত করে দেওয়া হয়। তিন মাস বাদে আমানতের ওপরে বিমার অংক পাঁচ লাখ করে দেওয়া হয়। গ্রাহকরা আশ্বস্ত হওয়ার পরিবর্তে সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান হয়। তাঁদের আশঙ্কা যে অমূলক নয় সেটা বোঝা গেল যখন কয়েক মাস বাদে খবরে প্রকাশিত হল যে এফআরডিআই বিল ঝাড়পোঁচ করে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে।

বেসরকারিকরণের প্রচেষ্টা যখন বারবার ধাক্কা খেতে লাগল তখন সরকার সিদ্ধান্ত নিল কর্পোরেটকেই সরাসরি ব্যাঙ্ক খোলার লাইসেন্স দেওয়া হোক। ২০১৩ সালে এই রকম একটি প্রস্তাব এসেছিলো কিন্তু আইডিএফসি এবং বন্ধন ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস ব্যতীত আর কেউই শীর্ষ ব্যাংক নির্ধারিত যোগ্যতার মান অর্জন করেনি। ২০১৪ সালে রঘুরাম রাজন যখন রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন তখন কর্পোরেটদের ব্যাংক খোলা নামঞ্জুর করে দেওয়া হয়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবার সেই প্রস্তাবটি ঝুলি থেকে বার করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এটা ব্যাংক শিল্পে অবধারিত ভাবে বিপর্যয় ডেকে আনবে। প্রথমত কোন কর্পোরেট সংস্থা ব্যাংক চালানোর অর্থ মালিক ও পরিচালক এক হয়ে যাবে, বাণিজ্যিক পুঁজি ও ব্যাংক পুঁজি হবে একাকার। ‘কানেকটেড’ লেন্ডিং, অর্থাৎ যে ঋণ দিচ্ছে এবং যে ঋণ নিচ্ছে দুজন একই ব্যক্তি হয়ে যাবে। ইয়েস ব্যাংকে যে সংকট হয়েছিল তা  এই ধরণের লেন্ডিংয়ের জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। ব্যাঙ্কের মূল প্রমোটার রানা কাপুর তাঁর তাঁবেদার বিভিন্ন সংস্থাকে দেদার ঋণ দেয়, সেখান থেকে দফায় দফায় বিপুল পরিমাণ অর্থ তাঁর স্ত্রী, কন্যাদের অ্যাকাউন্টে জমা হয়। ২০০৪ থেকে শুরু করে দশ বারো বছরের মধ্যে ব্যাঙ্ক ফুলেফেঁপে ওঠে তারপর হুড়মুড় করে সেটির পতন হয়। শেষমেশ স্টেট ব্যাঙ্ক তাদের ৪৯% শেয়ার কিনে আমানতকারীদের রক্ষা করে (বেইল আউটের আর একটি উদাহরণ)। প্রায় ৪৫০০ কোটি টাকা তছরুপের দায়ে রানা কাপুর এখন ইডির তদন্তনাধীন। ‘কানেকটেড’ লেন্ডিং বাস্তবে ক্রোনি লেন্ডিং। ঋণগ্রহীতার ব্যবসার ঠিক মতো যাচাই হয় না, তাঁর লেনদেনের মূল্যায়ন করা হয় না, শুধুমাত্র মালিক/পরিচালকের সাথে সম্বন্ধ বা যোগসাজশের কারণে তাকে সাধারণ মানুষের গচ্ছিত অর্থ পাইয়ে দেওয়া হয়। চাটুকারদের রমরমা বাড়ে, ব্যাঙ্ক ধসে পড়ে।

দ্বিতীয়ত কর্পোরেটরা যদি ব্যাংকের মালিকানা পায় তাহলে তারা প্রায় একছত্র অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হবে যা তারা খেয়ালখুশি মতো ব্যবহার করতে পারবে। মনে রাখতে হবে সরকারি ব্যাংকের আমানত প্রায় ১৪০ লক্ষ কোটি টাকা যা আদানি, আম্বানিরা সামান্য কিছু বিনিয়োগ করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এই ধনকুবেররা তাদের সীমাহীন অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে ছোটখাটো ব্যাংক এবং আর্থিক সংস্থাগুলি করায়ত্ত করবে, ব্যাঙ্ক শিল্পে তাদের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম হবে। বাণিজ্যিক ও ব্যাঙ্ক পুঁজির মেলবন্ধন এবং সেটির  একচেটীয়াকরণ পুরো অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেই অসহায় ও সংকটাপন্ন করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তৃতীয়ত এই কর্পোরেটদের আরও বহু ব্যবসায় বিনিয়োগ আছে। যেমন আম্বানিদের টেলিকমে বিপুল বিনিয়োগ আছে, আদানিদের আছে তেল, গ্যাস, বিদ্যুতে। এই বিশাল সাম্রাজ্যে বিনিয়োগ উত্তরোত্তর বাড়াতে তারা সরকারি ব্যাঙ্কের সম্পদ কাজে লাগাবে, এই সম্পদ ঐ ঝুঁকির শিকার হবে অথচ সেটি থেকে মুনাফার কারণে ব্যাঙ্ক শিল্পের এতটুকুও লাভ হবে না। সরকারি ব্যাঙ্কের এই সম্পদ তাঁদের অন্যান্য ব্যবসার উত্থান পতনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জুড়ে যাবে। এর ফলে ব্যাঙ্কে টাকা জমা রাখা আম আদমির পক্ষে আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।

গ্রাহক এবং ব্যাঙ্ক ইউনিয়ানগুলির প্রতিবাদের কারণে সরকারের এই প্রস্তাবও বাতিল হয়ে যায়। নানাবিধ এইসব প্রচেষ্টার পাশাপাশি সরকার এনপিএ সমস্যা সমাধানের জন্য মরীয়া হয়ে উঠেছে। অগস্ট মাসে সংসদের অধিবেশনে জানা যায় যে গত নয় বছরে, অর্থাৎ ২০১৪-১৫ থেকে মার্চ ২০২৩ অবধি, ১৪,৫৬,২২৬ কোটি টাকার এনপিএ ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে বৃহৎ শিল্প ও পরিষেবার কাছে অনাদায়ী হচ্ছে ৭,৪০,৯৬৮ কোটি। ইউপিএ জমানার দশ বছরে রাইট-অফের অংক ছিল ৩.৭৬ লক্ষ কোটি। রাইট-অফ নিয়ে সমালোচনা করলেই সরকার যুক্তি দেখায় যে এর অর্থ এই নয় যে সেই ঋণ আর শোধ হবে না। ব্যাঙ্ক অনাদায়ী টাকা উদ্ধারের প্রচেষ্টা লাগাতার চালিয়ে যায়। এই প্রচেষ্টার পরিণতি ক্রমশ হাস্যকর হয়ে আসছে। একটা হিসাব অনুযায়ী ২০১৭-১৮তে ১.১৮ লক্ষ কোটি রাইট-অফ ঋণ উদ্ধার হয়েছিল, ২০২১-২২ এ ৯১ হাজার, যা ২০২২-২৩এ আরও কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮৪ হাজার।

বিপুল অংকের ঋণ ক্রমাগত মুছে ফেলার কারণে কিছু ব্যাঙ্কের ব্যালান্স শিট এখন অনেক সাফ। এটা নিশ্চিত বেসরকারি হাতে ব্যাঙ্ক তুলে দেওয়ার জন্য যা যা করা প্রয়োজন তা বিজেপি সরকার করতে বদ্ধপরিকর। বৃহৎ শিল্পের কাপ্তানরা এখন ‘জাতীয় স্বার্থে’ প্রভুর সমস্ত প্রকল্প, যেমন ডিজিটাল ইন্ডিয়া, আত্মনির্ভর ভারত, ইত্যাদিতে শামিল হচ্ছেন। ‘জাতীয় স্বার্থে’ এবং দেশের ঐতিহ্য ও পরম্পরা রক্ষার্থে তাঁরা সদলবলে রামমন্দির উদ্বোধনে শামিল হয়েছেন। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের কারণে বিপুল ক্ষতি হওয়ার পরেও আদানির রথ আবার ছুটছে। তিনটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির বিপুল জয়লাভের পর এক ধাক্কায় তাঁর ধন ১,৫৬,০০০ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তি মুকেশ আম্বানির থেকে তিনি এখন মাত্র আটান্ন হাজার কোটি টাকা পিছনে। কিন্তু আলোর নিচেই তো অন্ধকার! বিপুল তাঁর ঋণ, প্রায় তিন লক্ষ কোটি টাকা, যার ৩২% ভারতীয় সরকারি, বেসরকারি ব্যাঙ্ক, এনবিএফসি (নন-ব্যাংকিং ফিন্যান্সিয়াল কোম্পানি) থেকে নেওয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে তাঁর সামগ্রিক ব্যবসার তুলনায় তাঁর ঋণের পরিমাণ তিন গুণ বেশি। স্টেট ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক অফ বরোদা, পাঞ্জাব ন্যাশানাল ব্যাঙ্ক, যে তিনটি ব্যাঙ্ক থেকে তাঁর সর্বাধিক ঋণ তাঁদের কর্তাদের মুখে কিন্তু কুলুপ।    

তথ্যসূত্রঃ