নভেলের আদিপর্ব ও স্যামুয়েল রিচার্ডসনের পামেলা

আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগে ১৭৪০ সালে প্রকাশিত হয় স্যামুয়েল রিচার্ডসনের সাড়া জাগানো উপন্যাস পামেলা এবং প্রকাশের পরেই তা প্রবল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইংরাজী উপন্যাস অষ্টাদশ শতকের প্রথম অর্ধে যে কয়েকটি মুষ্টিমেয় লেখার হাত ধরে বিকশিত হয়েছিল, এটি তার অন্যতম। ১৭১৯ সালে ড্যানিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রুসোর মধ্যে দিয়ে ইংরাজী সাহিত্যে উপন্যাসের ধারাটি শুরু হয় বলে বেশীরভাগ সমালোচকেরা মনে করেন। (রবিনসন ক্রুসো সম্পর্কে আলোচনা এখানে পাওয়া যাবে।) রবিনসন ক্রুসোর পর ডিফো লেখেন আরো কয়েকটি উপন্যাস, যার অন্যতম হল ১৭২২ সালে প্রকাশিত মল ফ্ল্যান্ডার্স। ড্যানিয়েল ডিফো ছাড়া ইংরাজী উপন্যাসের আদিপর্বের অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা হলেন জোনাথান সুইফট, স্যামুয়েল রিচার্ডসন, হেনরি ফিল্ডিং, লরেন্স স্টার্ন প্রমুখ।

আদিপর্বের ইংরাজী ঔপন্যাসিকদের অন্যতম স্যামুয়েল রিচার্ডসন সারা জীবন জড়িয়ে ছিলেন মুদ্রণ ব্যবসার সঙ্গে। সফল মুদ্রণ ব্যবসায়ী হিসেবে পাঠকের চাহিদা কী তা তাঁর ভালোই জানা ছিল। পামেলা লেখার ক্ষেত্রে এর সঙ্গে যুক্ত হয় সমকালীন দুই প্রকাশকের আগ্রহ। বন্ধু অ্যারন হিলকে লেখা রিচার্ডসনের এক চিঠি থেকে পামেলা উপন্যাস লেখার প্রেক্ষাপটটি জানতে পেরেছি আমরা। হিলকে রিচার্ডসন জানিয়েছেন মিস্টার রিভিংটন ও মিস্টার অসবোর্ন নামের দুই প্রকাশক এমন এক চিঠির সংকলন লিখে দেবার প্রস্তাব তাঁকে দিয়েছিলেন, যেখানে থাকবে ‘ইউজফুল কনসার্নস ইন কমন লাইফ’। সেইসময়ে ইংলণ্ডে সাক্ষরতার হার বাড়ছে, অনেকেই লিখতে পড়তে শিখছেন, কিন্তু গুছিয়ে ভালোভাবে চিঠি লেখা সদ্য সাক্ষর অনেকের পক্ষেই বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাঁদের জন্য প্রয়োজন পড়ছে চিঠি লেখার এমন এক গাইড বুক, যেখানে বেশ কিছু চিঠি উদাহরণ হিসেবে থাকবে। প্রকাশকরা এরকম এক সংকলন যখন রিচার্ডসনের কাছ থেকে চেয়ে বসলেন তখন বাজারের চাহিদা বুঝে তার জোগান দিতে কাজে নামলেন রিচার্ডসন। কিন্তু শুধু কয়েকটি চিঠির এক গাইডবুক লেখার বদলে সেই চিঠিগুলিকে একটি আখ্যানের মধ্যে গেঁথে দিতে চাইলেন। এভাবেই জন্ম হল ইংরাজী সাহিত্যের প্রথম পর্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস পামেলার। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র পামেলা পনেরো বছর বয়সী এক কিশোরী। চিঠি লিখতে সে ভালোবাসে। তাছাড়া পরিস্থিতির প্রয়োজনেও সে চিঠি লিখতে বাধ্য হয়। পামেলা তার বাবা, মাকে চিঠি লেখে, বাবা মায়ের কাছ থেকে জবাবী চিঠিও পায়। চিঠির পর চিঠি সাজিয়েই তৈরি হয় এই উপন্যাস। চিঠির আকারে লেখা এই ধরনের উপন্যাসকে বলে এপিস্টোলারি নভেল বা পত্রোপন্যাস। রিচার্ডসনই ইংরাজী সাহিত্যে এই ধরনের উপন্যাসরীতির জনক।

বাবা ও মাকে লেখা পামেলা অ্যান্ড্রুজের প্রথম চিঠিটিই আখ্যানের কয়েকটি মূল বিষয় ও প্রধান চরিত্রদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। আমরা জেনে যাই পামেলা এক দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। বারো বছর বয়েসে সাংসারিক অভাবের তাড়নায় সে এক ধনী পরিবারে পরিচারিকার কাজ করতে আসে। এই পরিবারের কর্ত্রী ছিলেন জনৈকা মিসেস লেডি বি। লেডি বি পামেলাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। পামেলা তারই আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে লেখালিখিতে বেশ দক্ষ হয়ে ওঠে, যার প্রমাণ বহন করছে তার লেখা চিঠিগুলি। পামেলা তার বাবা মাকে যখন প্রথম চিঠিটি লেখে, তার কিছুদিন আগেই তার মালকিন লেডি বির মৃত্যু হয়েছে। দয়াপরবশ ও স্নেহশীল এই মালকিনের প্রয়াণ শোকে পামেলা কাতর। লেডি বির মৃত্যুর পর সে এখন আছে তার পুত্র ‘মিস্টার বি’র আশ্রয়ে। লেডি বি কত ভালো মহিলা ছিলেন, তিনি পামেলার দিকে কতটা খেয়াল রাখতেন, পামেলাকে কতটা ভালোবাসতেন – সে সব কথা রয়েছে এই প্রথম চিঠিটিতে।

দ্বিতীয় চিঠিটি পামেলার বাবা মা জন অ্যান্ড্রুজ ও এলিজাবেথ অ্যান্ড্রুজের লেখা জবাবী চিঠি। তারা এই জবাবী চিঠিতে মেয়েকে জানিয়ে দেন সংযমী জীবনের গুরুত্ব ও মহত্ব। এক যুবকের আশ্রয়ে নিজের কিশোরী মেয়ে থাকছে জানতে পেরেই পামেলার বাবা মায়ের এই চেতাবনী, একথা বুঝতে অসুবিধে হয় না। পামেলা আগাগোড়া নৈতিক সংযম মেনে চলে। শুধু বাবা মায়ের দেওয়া পরামর্শ সূত্রেই নয়, এই সংযম আসে তার নিজের চরিত্র বৈশিষ্ট্য ও সংস্কার থেকেও।

তৃতীয় চিঠিটি পামেলা লেখে তারা বাবাকে, চতুর্থটি মাকে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ চিঠিটি বাবা মাকে লেখা যৌথ চিঠি।  সপ্তম চিঠিটি বাবাকে লেখে পামেলা। অষ্টম চিঠিটি বাবা মায়ের তরফে পামেলাকে লেখা যৌথ চিঠি। তার প্রত্যুত্তর পামেলা বাবা ও মাকে দেয় নবম চিঠিতে। প্রথম থেকে নবম চিঠি পর্যন্ত একটি গুচ্ছ, যেখানে পামেলা তার নতুন মনিব মিস্টার বির গৃহে কেমন আছে সেই সংক্রান্ত কথাবার্তাই সে মূলত জানায়। চতুর্থ চিঠিতে সে জানিয়েছিল যে মিস্টার বির বোন লেডি ডেভারের বাড়িতে পরিচারিকা হিসেবে চলে যাবার একটা কথা উঠেছে, কারণ মিস্টার বি একজন অবিবাহিত পুরুষ। কিন্তু পরে পামেলা জানায় এখনো যাবার কথা কিছু এগোয় নি। সেইসঙ্গে সে এও জানায় মিস্টার বির বাড়িতেই এক গৃহপরিচালিকা আছেন, যার নাম মিসেস জার্ভিস। এই মিসেস জার্ভিস পামেলাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন ও আগলে রাখেন। পঞ্চম চিঠিতে পামেলা জানিয়েছিল মিস্টার বির জনৈক পরিচারক হ্যারি যখন পামেলার রূপের প্রশংসা শুরু করেছিল এবং তাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বনে উদ্যত হয়েছিল, তখন মিসেস জার্ভিস হ্যারিকে কেমন শাস্তি দিয়েছিলেন। ষষ্ঠ ও সপ্তম চিঠিদুটিতে পামেলা জানায় মিস্টার বি মিসেস বির ব্যবহৃত অনেক মূল্যবান পোশাক পরার জন্য পামেলাকে দিয়ে দিয়েছেন। বাবা ও মাকে লেখা ষষ্ঠ চিঠিটি পামেলা শুরুই করে এই উপহারের বিবরণ দিয়ে এবং বোঝা যায় এইসব মহার্ঘ্য পোশাক পেয়ে সে বেশ খুশি। এও পামেলা জানায় যে এই পোশাকগুলি উপহার হিসেবে যখন মিস্টার বি দিচ্ছেন, তখন মিসেস জার্ভিসও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সপ্তম চিঠিতে আরো কিছু পোশাক উপহার পাওয়ার কথা জানায় পামেলা এবং এও জানাতে ভোলে না এইবার যখন মিস্টার বি এই পোশাকগুলি দিয়েছেন, তখন মিসেস জার্ভিস বা আর কেউ সামনে ছিল না। এইসময় মিস্টার বি যে পামেলাকে প্রীতিপ্রদ কিছু কথা বলেন এবং তাতে সে লজ্জা পায়, সে সব পামেলা রাখঢাক না রেখেই বাবা মাকে জানায়। এরপর বাবা মার কাছ থেকে আসে জবাবী অষ্টম চিঠিটি এবং সেখানে তাঁরা পামেলাকে নৈতিক আচরণ ও শুচিতা সম্পর্কে পুনরায় সতর্ক করেন। জীবন রক্ষার থেকেও কৌমার্য রক্ষার সম্মানই হবে পামেলার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ – তাঁদের চেতাবনীকে পামেলার বাবা মা এই পর্যায়ে পর্যন্ত নিয়ে যান। আমাদের এখনকার পাঠে এই ধরনের যৌন শুচিতাবোধ আশ্চর্য ও অমানবিক ঠেকলেও অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগের ইংলণ্ডের সমাজের একাংশের মধ্যে খ্রিস্টিয় পাপবোধ কেমন ছিল, তার পরিচয় এখানে পাওয়া যাবে। নবম চিঠিতে পামেলা জানায় মিসেস লেডি ডেভারের বাড়িতে পরিচারিকা হিসেবে পামেলার যাবার ব্যাপারটি পুরোপুরি বাতিল হয়ে গেছে মিস্টার বির আপত্তিতে। মিস্টার বি নাকী মনে করেন লেডি ডেভারের বাড়িতে জকি নামে তার যে ভাইপো থাকে, সে পামেলার দিকে কুনজর দিতে পারে। তাই মিস্টার বি চান পামেলা লেডি ডেভারের বাড়িতে না গিয়ে তার কাছেই থাকুক।

এরপর চিঠি লেখায় কিছুদিন বিরতি থাকে। দশম চিঠি থেকে এক নাটকীয় পট পরিবর্তন হয় ঘটনাধারার। দশম চিঠিটি থেকে আমরা জানতে পারি মিস্টার বি পামেলার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন ও পামেলাকে শারীরিকভাবে উপভোগ করতে চেয়েছেন। পামেলা বাবা মাকে এও জানায় বয়সে বড়, সামাজিকভাবে অনেক উচ্চ অবস্থানে অধিষ্ঠিত তার বেতনদাতা পুরুষটির অনৈতিক শরীরী সম্ভোগের আকর্ষণকে দৃঢ়তার সঙ্গে সে প্রত্যাখ্যান করতে সক্ষম হয়েছে। একাদশ চিঠিটি কেবল মাকেই লেখে পামেলা এবং সেখানে কীভাবে মিস্টার বি তাকে একাধিকবার জোর করে চুম্বন করেছেন, তার উল্লেখ সে করে। মাকে পামেলা এও জানায় ঘটনাটি গোপন রাখার জন্য মিস্টার বি তাকে কতগুলি স্বর্ণমুদ্রা ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সে সেগুলি প্রত্যাখ্যান করেছে। চিঠির সে পামেলা জানায় যদিও সে খানিকটা ভয়ের মধ্যে আছে, তবু এখনো সে তার জীবিকা ছেড়ে ফিরে যাবার কথা ভাবছে না।

বারো নম্বর চিঠিতে পামেলা জানায় প্রথমে যদিও সে মিসেস জার্ভিসকে ঘটনাটির কথা জানায় নি, কিন্তু পরিশেষে সে প্রবাসে তার সবচেয়ে ভরসার মাতৃসমা এই মহিলাকে সবকিছুই খুলে জানিয়েছে। আগের চিঠিটি মিস্টার বি চুরি করেছিলেন বলে পামেলা ও মিসেস জার্ভিসের সন্দেহ হয়। কেননা মিস্টার বি মিসেস জার্ভিসকে এর মধ্যে জানিয়েছেন পামেলা যেন চিঠি লেখার পেছনে এত সময় অপব্যয় না করে। পামেলা ও মিসেস জার্ভিস অনুমান করে মিস্টার বি চাইছেন না চিঠির মাধ্যমে মিস্টার বির কুকীর্তিগুলি বাড়ির বাইরে বেরোক, পামেলার বাবা ও মায়ের কাছে সেগুলি পৌঁছক। পামেলা চিঠির শেষে জানায় এখন সে আর একা শুচ্ছে না, তার পাশে রাতে থাকছেন মিসেস জার্ভিস এবং এটা তাকে আনন্দিত ও নিশ্চিন্ত করেছে।

তেরো নম্বর চিঠিটি পামেলার বাবা ও মায়ের জবাবী চিঠি। এই চিঠিতে পামেলার বাবা মা জানান তারা পামেলার জন্য উৎকন্ঠিত। এও স্পষ্ট করে দেন এরপর মিস্টার বির তরফে কোনও বাড়াবাড়ি হলেই যেন পামেলা সেই বাড়ি ছেড়ে চলে আসার জন্য প্রস্তুত থাকে। মিসেস জার্ভিসের সাহায্য সহযোগিতা পরামর্শ নিয়ে এগনোর কথাও তাঁরা বলেন। চতুর্দশ চিঠিটিতে পামেলা তার বাবা মাকে জানায় এর মধ্যে একদিন মিস্টার বি মিসেস জার্ভিসের সঙ্গে পামেলার বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি মিসেস জার্ভিসের কাছে জানতে চেয়েছেন পামেলাকে গৃহসহায়িকা হিসেবে প্রয়োজন আছে কিনা, সে ঠিকমত কাজ করছে কিনা। মিসেস জার্ভিস বলাবাহুল্য পামেলার পক্ষেই কথা বলেছেন। মিসেস জার্ভিসের কাছে মিস্টার বি এও জানতে চেয়েছেন যে পামেলা কোনও পরিচারকের সঙ্গে কোনও সম্পর্কে জড়িয়েছে কিনা। মিসেস জার্ভিস স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন এমন কোনও কিছুই ঘটে নি।

প্রথম প্রত্যাখ্যানের পরও মিস্টার বি কিশোরী পামেলার দৃঢ়তার সীমাটি বুঝতে পারেন নি এবং কয়েকদিনের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের জন্য আরো জোরের সঙ্গে পামেলাকে সম্ভোগে উদ্যোগী হন। পামেলার মাকে লেখা পঞ্চদশ চিঠিটিতে মিস্টার বির তরফে পামেলার ওপর চালানো এই দ্বিতীয় যৌন নিপীড়নের বিস্তারিত বর্ণনা আছে। এবারের প্রত্যাখ্যান হয় আরো দৃঢ়। পামেলা এও জানায় এইসব অপমান অসম্মানের প্রেক্ষিতে একান্ত বাধ্য হয়েই মিস্টার বির বাড়ি ছেড়ে বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। আগেরবার মিসেস জার্ভিসের কথায় সে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কিন্তু এইবার মিসেস জার্ভিসকেও সে জানিয়ে দিয়েছে সে কোনওমতেই আর মিস্টার বির বাড়িতে থাকতে প্রস্তুত নয়। মিসেস জার্ভিস পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে পামেলার সঙ্গে সহমত হয়েছেন।

ষোড়শ চিঠিতে পামেলা বাবা মাকে জানায় মিস্টার বির বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর্বটি খানিকটা দীর্ঘায়িত হচ্ছে, কারণ একটি পোশাক তৈরির কাজ বকেয়া রয়েছে। সে এও জানায় মিসেস জার্ভিস মিস্টার বির থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছেন যে তিনি পামেলাকে আর কোনওভাবেই কোনও অসম্মান করবেন না। মিস্টার বিও নাকী পামেলাকে তার বাবা মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেবার কথা ভেবেছেন।

সতেরো নম্বর চিঠিতে পামেলার বাবা মা তাকে লেখেন যে তাঁরা পামেলার বাড়ি ফেরার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন। সংসারের স্বাস্থ্য বিষয়ে পামেলাকে নিশ্চিন্ত করতে চেয়ে তাঁর বাবা পামেলাকে জানান যে তারা সবাই মিলে অনেক পরিশ্রম করবেন। তবে সেইসঙ্গে এই খবরও দেন যেপামেলার মার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছে, ফলে সেলাই এর কাজ আর তাঁর পক্ষে তেমনভাবে করা সম্ভব হবে না। মিস্টার বি তাঁদের যে চারটি সোনার মুদ্রা দিয়েছিলেন, তাও তিনি ফিরিয়ে দেবার সংকল্পের কথা জানান। যদিও এর একটি ইতোমধ্যেই খরচ হয়ে গেছে, কিন্তু ধার করে হলেও সেটা তিনি ফিরিয়ে দিতে চান।

আঠারো নম্বর চিঠিতে পামেলা বাবা মাকে জানায় সে মিস্টার বির বাড়ি ছেড়ে ফিরে যাচ্ছে শুনে মিসেস জার্ভিস কতটা ভেঙে পড়েছেন ও কেমন কান্নাকাটি করেছেন।

পরবর্তী উনিশ নম্বর চিঠিতে পামেলা জানায় মিসেস জার্ভিস পুনরায় জানিয়েছেন যে মিস্টার তাকে আর চুম্বন করতে বা তার সঙ্গে শরীরী সম্পর্কে যেতে চেষ্টা করবেন না। পামেলা এও বাবা মাকে জানায় তার পোশাক তৈরির কাজ কবে শেষ হবে, কবে সে বাড়ি যাবে, তা বলা যাচ্ছে না। কুড়ি নম্বর চিঠিতে পামেলা বাবা মাকে জানায় তার চিঠি পাঠাতে দেরি হল কারণ পত্রবাহক জনকে মিস্টার বি অন্য কাজে অন্যত্র পাঠিয়েছিলেন। পামেলা এও জানায় চারটি স্বর্ণমুদ্রা ফেরৎ দেবার ব্যাপারে তাদের ব্যতিব্যস্ত হতে হবে না।

একুশ নম্বর চিঠিতে পামেলা বাবা মাকে লেখে মিসেস জার্ভিসকে মিস্টার বি জানিয়েছেন পামেলা সামাজিক মর্যাদা সম্পন্না কোনও ভদ্রমহিলা হলে মিস্টার বি পরদিনই তাকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। মিসেস জার্ভিসকে পামেলা জানিয়ে দেয় সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন ভদ্রমহিলা হলে মিস্টার বি পামেলাকে জোর করে চুম্বন করার সাহস করতেন না। বাইশ নম্বর চিঠিতে পামেলা জানায় সে যে মিস্টার বির বাড়ি ছেড়ে বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাচ্ছে এটা পরিচারক মহলে খবর হয়ে গেছে। পামেলা চলে যাবে শুনেওনেকেই ব্যথিত আর তা জেনে মিস্টার বি বলেছেন পামেলা জাদুটোনা জানে আর তার দ্বারাই সে আশেপাশের লোককে বশ করছে। মিসেস জার্ভিস পামেলার সম্ভাব্য বিদায়ের কারণ হিসেবে সবাইকে জানিয়েছেন যে পামেলার বাবা মা এখন বৃদ্ধ হয়েছেন। তাদের সেবা শুশ্রুষা ও দেখভাল করার জন্যই পামেলা বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।

তেইশ নম্বর চিঠিতে পামেলা মিস্টার বির বাড়ির একটি নৈশভোজের বর্ণনা দেয়। সমাজের মান্যগণ্য লোকেরা সেই নৈশভোজে এসেছিলেন এবং তারা সবাই পামেলার রূপের প্রশংসা করেছেন। এও বলেছেন পামেলাই সম্ভবত দেশের সবচেয়ে সুন্দরী পরিচারিকা। পামেলা সম্পর্কিত এইসব স্তুতিবাক্য যে মিস্টার বিকে খুশি করে নি, সেকথাও পামেলা তার চিঠিতে বাবা মাকে জানিয়েছে। পামেলা এই চিঠিতেও দ্রুত বাড়ি ফেরার সম্ভাবনার কথা জানায়। কীভাবে সে ফিরবে তা যদিও স্থির হয় নি। হয়ত মিস্টার বির পরিচারক ও তার পত্রবাহক জন যখন সে পথে যাবে, পামেলা তার সঙ্গী হতে পারবে।

বাবা মাকে লেখা ২৪ নম্বর চিঠিতে পামেলা জানায় নিজের জন্য সে যে পোশাকটা বানাচ্ছিল, যেটা ছাড়া তার বাড়ি ফেরা নিরাপদ হতো না, অবশেষে সেটি বানানো সমাপ্ত হয়েছে। সেটা পরে তাকে আরো সুন্দর ও অন্যরকম লাগছিল বলে মিসেস জার্ভিস পর্যন্ত তাকে চিনতে পারেন নি। চিনতে পারেন নি মিস্টার বিও। তিনি পামেলার নবরূপে মুগ্ধ হয়ে যান। পামেলা বাড়ি ফেরার কথা জানালে মিস্টার বি তাকে আরো কিছুদিন থেকে যেতে বলেন। জেনে নিতে চান তার বোন লেডি ডেভারর্স এর বাড়িতে পামেলার প্রয়োজন আছে কীনা। এই চিঠিতে পোশাক ও সামাজিক সম্মানের সম্পর্কটি কেমন ছিল অষ্টাদশ শতকের ইংলণ্ডে, তার একটি ধারণা আমরা পাই। এও বোঝা সম্ভব হয় বাড়ি ফেরার জন্য উপযুক্ত একটি পোশাক বানানোর জন্য পামেলা কেন এত ব্যগ্র ছিল। মিস্টার বি যৌন হেনস্থা শুরু করার আগের পর্বে যখন পামেলাকে মিসেস বির ব্যবহৃত সুন্দর ও দামি পোশাকগুলি দিয়ে দিয়েছিলেন, তখন সে কেন এতখুশি হয়েছিল, তাও এই সূত্র ধরে বোঝা সহজ হয়।

২৫ নং চিঠিতে পামেলা আর একটি অনভিপ্রেত ঘটনার কথা জানায়। সে যখন মিসেস জার্ভিসের ঘরে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলছে তখন তারা কিছু শব্দ শুনতে পান। তা অনুসরণ করে দেখা যায় মিস্টার বি আড়ালে লুকিয়ে আছেন ও তাদের কথা শুনছেন। মিস্টার বি আবারো পামেলাকে এইসময় শারীরিকভাবে স্পর্শ করেন, তার বুকে হাত দেন। পামেলা অজ্ঞান হয়ে যায়। মিসেস জার্ভিস মিস্টার বিকে জানান যে কোনও মূল্যেই তিনি পামেলাকে রক্ষা করবেন। মিস্টার বি মিসেস জার্ভিসের প্রতিও কূপিত হন এবং তাকেও বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার হুমকি দেন। পরের ২৬ নং চিঠিতে পামেলা বাবা মাকে জানায় মিসেস জার্ভিস মিস্টার বিকে জানিয়ে দিয়েছেন যে পামেলা বাবা মার কাছে ফিরে যাবে এবং মিসেস জার্ভিস পামেলার যাত্রাসঙ্গী হবেন। মিস্টার বি জানান তিনি এতে সম্মত আর এও জানান অনতি বিলম্বেই তিনি বিবাহ করতে চলেছেন। পরের ২৭ নং চিঠিতে পামেলা বাবা মাকে জানায় সে বাড়ি ফিরবে, কিন্তু ঠিক কবে তা স্থির হয় নি। মিসেস জার্ভিসও তার সঙ্গে যাবার প্রস্তুতি নেবেন। মিস্টার বি লন্ডনে যাবেন বলে স্থির করেছেন। এর মধ্যে একদিন তিনি পামেলাকে নতুন পোশাক ছেড়ে পুরনো পোশাকে ফিরে যেতে বলেছিলেন, কিন্তু পামেলা তার কথা শোনার প্রয়োজন বোধ না করে নতুন বানানো পোশাকগুলিই যে ব্যবহার করছে, তাও সে বাবা মাকে জানিয়ে দেয়। ২৮ নং চিঠিতে পামেলা জানায় মিস্টার বি মিসেস জার্ভিসকে থেকে যেতে অনুরোধ করেছেন এবং এই কথা রাখলে পাঁচটি সোনার গিনি দেবারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই চিঠিতে পামেলা আরো জানায় তাদের স্টুয়ার্ট বা বাড়ির দেওয়ান মিস্টার লংম্যানকে মিস্টার বি লম্বা ভাষণে বোঝাতে গেছিলেন পামেলার দোষত্রুটির কথা। কিন্তু মিস্টার লংম্যান পামেলার পক্ষই অবলম্বন করেছেন। মিস্টার বি ধনী ও সামাজিকভাবে প্রতিপত্তিশালী হলেও সবসময় যে আর নিজের ঘরে অধস্তনকর্মীদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হচ্ছেন না, পরিস্থিতি বদলাচ্ছে, পামেলার এই চিঠিতে তার ইঙ্গিৎ আছে। ২৯ নম্বর চিঠিতে পামেলা জানায় সে বাড়ি ফিরে নাচে গানে আনন্দে থাকার পরিকল্পনায় মশগুল। সে যখন মিসেস জার্ভিসের সঙ্গে তাকে দেওয়া মিস্টার বির সোনার গিনি ও অন্যান্য উপহার ফেরৎ নিয়ে কথা বলছিল, তখন তার সবটাই মিস্টার বির কানে যায়। পামেলা জানতে পারে মিসেস জার্ভিস মিস্টার বি র সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন এবং কাকে কতটা বিশ্বাস করা যাবে, তাই নিয়ে পামেলা শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ৩০ নম্বর চিঠিতে পামেলা জানায় মিস্টার বি হঠাৎই তার আচরণে পরিবর্তন এনেছেন। রূঢ় আচরণ ছেড়ে তিনি ভদ্রভাবে পামেলাকে জানিয়েছেন তিনি পামেলাকে ভালোবাসের। পামেলাকে তিনি আর চাকরাণীর দৃষ্টিতে দেখেন না। তিনি পামেলাকে কাতর অনুরোধ করেন আরো কয়েকটা দিন থেকে যাবার। পামেলা অবশ্য মিস্টার বি বাড়ি ছাড়তে সে যে কৃতসংকল্প, সে কথাই লেখে। ৩১ নং চিঠিতে পামেলা জানায় মিস্টার বি পামেলাকে আবারো কিছুদিন থেকে যাবার অনুরোধ করেছেন। তিনি চেয়েছেন পামেলা যাতে আরো অন্তত দু সপ্তাহ থাকে। তিনি পামেলাদের পরিবারকে ৫০ গিনি দিতে চান। প্রতি বছর পামেলার বাবাকে এই অর্থ দেবার প্রতিশ্রুতিও তিনি দেন। পামেলাকে তার চ্যাপলিন মিস্টার উইলিয়ামস এর মতো কারো সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার মনোবাসনাও তিনি ব্যক্ত করেন। এত কিছুর পরেও মিস্টার বি আবারো পামেলাকে চুম্বনে উদ্যত হন। পামেলা মিস্টার বিকে জানান মিস্টার উইলিয়ামসকে বিবাহের যে কথা মিস্টার বি বলেছেন, সে সম্পর্কে কিছু বলতে হলে তাকে আগে বাবা মার সঙ্গে কথা বলতে হবে এবং এজন্য তার বাড়ি ফেরা প্রয়োজন। মিস্টার বি এরপর মিসেস জার্ভিসকে দিয়ে পামেলাকে বলে পাঠান যে তিনি পামেলাকে বাড়ি যেতে দিতে সম্মত আছেন এবং পামেলাকে উপহার হিসেবে পাঁচটি সোনার গিনিও তিনি মিসেস জার্ভিসের মাধ্যমে পাঠান।

উপন্যাসে এইবার প্রথমবারের জন্য চিঠির বাইরে এসে হাজির হন উপন্যাস কথক। তিনি জানিয়ে দেন মিস্টার বির পামেলাকে উইলিয়ামস এর সঙ্গে বিয়ে দেবার কোনও ইচ্ছাই নেই। পামেলাকে বাড়ি ফিরতে দিতেও তিনি চান না। মিস্টার বির মনোবাসনা হল বাড়ি ফেরার ছলে তাকে নিজের লিঙ্কনশায়ার এস্টেটে নিয়ে গিয়ে সেখানে বন্দী করে রাখা।

পামেলা বাড়ির পথে রওনা হয় কিন্তু দেখে তার গাড়ি যাচ্ছে এক অচেনা পথে। পরে কোচোয়ান জানায় তারা পথ হারিয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও গাড়ির গতি কমে না। ইতোমধ্যে সন্ধ্যে হয়ে আসে ও গ্রামের এক খামার বাড়িতে পামেলারা শ্রয় নিতে বাধ্য হয়। সেই গ্রামের জনৈক কৃষককে জিজ্ঞাসা করে পামেলা জানতে পারে এই খামার বাড়ির মালিক হলেন মিস্টার বি। ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়ে পামেলা শঙ্কিত হয়ে ওঠে। কৃষক ও তার স্ত্রী পামেলাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন। তারা চলে যাবার পর পামেলা তার নামে আসা একটি চিঠি পড়তে বসে। এই চিঠিটি জনৈক অনুরাগীর নামে এলেও বুঝতে অসুবিধে হয় না এর লেখক মিস্টার বি। এই চিঠিতে বলা হয় পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার জন্য পামেলার কয়েক সপ্তাহ দূরে কোথাও নির্জন বাস প্রয়োজন। কৃষক ব্যক্তিটি তাকে লেখা মিস্টার বির একতি চিঠিও পামেলাকে দেখান। সেখানে মিস্টার বি জানিয়েছেন যে পামেলা এক প্রেম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও ফার্ম হাউসে পামেলাকে কিছুদিন থাকতে হবে।

পরদিনই অবশ্য কোচম্যান পামেলাকে নিয়ে মিস্টার বির এস্টেটের দিকে রওনা দেয়্য। পথে তারা থামে এক সরাইখানায়। মিসেস জিউকিসের বোন সেই সরাইখানায় আগেই পৌঁছে গেছিলেন। তিনি সেখানে পামেলাকে নজরবন্দী করে রাখেন। মিস্টার বির এস্টেট হাউসের কর্ত্রী মিসেস জিউকিস সরাইখানায় এসে পৌঁছান এবং তারপর তিনি পামেলাকে নিয়ে মিস্টার বির এস্টেটের বাড়ির দিকে রওনা হন। মিসেস জিউকিস পামেলাকে ম্যাডাম বলে সম্বোধন করতে থাকেন। বিবাহিত মহিলাদের যে সম্বোধন করার হয়, সেই সম্বোধনে পামেলা অস্বস্তির কথা জানালে মিসেস জিউকিস জানান এরকম সম্বোধনের নির্দিষ্ট কারণ আছে। সেই এস্টেট বাড়িতে পামেলার জন্য আলাদা কোনও শয্যার ব্যবস্থা করা হয় নি।  পামেলা মিসেস জিউকিসের সঙ্গেই রাত্রিবাসে বাধ্য হয়। বোঝা যায় সবসময়েই পামেলাকে চোখে চোখে রাখার দায়িত্ব মিসেস জিউকিসকে দেওয়া হয়েছে। মিসেস জিউকিস ঘরে রাতে তালাচাপি দিয়ে সেই চাবি নিজের হাতে বেঁধে রাখেন। পরদিন সকালে উঠে পামেলা সেই এস্টেট বাড়িতে দেকতে পায় মিস্টার উইলিয়ামসকে এবং বিশেষ খুশি হয়। সে ততদিনে বুঝে গেছে মিস্টার উইলিয়ামসের সঙ্গে পামেলার বিবাহ সম্ভাবনার যে কথা মিস্টার বি বলেছিলেন, তা পুরোপুরি বানানো। কিন্তু তা সত্ত্বেও পামেলা খুশি হয় কারণ সে ভাবে মাত্র কয়েক মেইল দূরের বাসিন্দা যাজক সম্প্রদায়ের মানুষ মিস্টার উইলিয়ামস পামেলাকে কিছু সাহায্য করলেও করতে পারেন। মিস্টার উইলিয়ামসও পামেলাকে সাহায্য করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু সমস্যা হল তিনি মিস্টার বির ওপর নির্ভরশীল এবং পামেলাকে কোনও সাহায্য করলে মিস্টার বি মিস্টার উইলিয়ামস এর ওপর কূপিত হবেন এবং তার ফল হবে মারাত্মক।

পামেলা চিঠি লেখার উপকরণ চেয়ে নেয় এবং তার অন্যতম প্রিয় কাজ লেখার মধ্যে নিজেকে এই কঠিন সময়ে ডুবিয়ে দেয়। বাবা মা কে চিঠি পাঠানোর উপায় যখন নেই, তখন দিনলিপি হিসেবেই সে নিজের কথা লিখে রাখতে থাকে।

পামেলার জার্নাল

পামেলা রবিবারে স্থানীয় চার্চে যেতে চায়, কিন্তু মিসেস জিউকিস তাকে সেই অনুমতি দেন না। এস্টেট বাড়িতে এরপর আসে জন। সে মিসেস জিউকিস এবং পামেলার জন্য কিছু চিঠি নিয়ে আসে। তার পত্রবাহককে দেখে পামেলা খুশি হয়। তখনো সে জানত না তার চিঠিগুলি সে মিস্টার বিকে দেখিয়ে দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। পামেলা মিস্টার বির কাছ থেকে এক চিঠি পায়। সেখানে মিস্টার বি জানিয়েছেন যে তিনি বুঝতে পারছেন যেভাবে পামেলা গৃহবন্দী হয়ে আছে তাতে তার মানসিক সমস্যা হচ্ছে। পামেলা যাতে তার বাবা ও মাকে তার সুস্থতার কথা জানাতে পারে সেজন্য মিসেস জার্ভিসের মাধ্যমে পামেলাকে তার বাবা মার কাছে খবর পাঠাতে বলেন তিনি। লক্ষ করার বিষয় হল পামেলাকে সরাসরি তার বাবা মাকে চিঠি লেখার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। কী লিখতে হবে তা পামেলা জানাবে মিসেস জার্ভিসকে। মিসেস জার্ভিস, হয়ত মিস্টার বির ছাড়পত্রের ভিত্তিতে যে বয়ান লিখবে, তা পামেলার সংবাদ হিসেবে পৌঁছবে তার বাবা ও মায়ের কাছে। পামেলা তার মাকে খবুর জানানোর জন্য এতই ব্যগ্র ছিল যে এই পদ্ধতি সে মেনে নেয়। মিসেস জার্ভিসকে একটা চিঠি লিখে জনিয়ে দেয় কী লিখতে হবে। সেইসঙ্গে মিস্টার বিকেও সে একটি চিঠি লেখে, যেখানে থাকে তার বাধ্যতার কথা আর থাকে মিস্টার বির কাছে করুণাভিক্ষা। পামেলা অনুধাবন করে সে কতটা বিপদের মধ্যে আছে এবং পরিস্থিতি যে একেবারেই তার অনুকূল নয় সেকথা বুঝে সেই অনুযায়ী নিজের আচরণকে খানিকটা সাজিয়ে গুছিয়ে নেয়। মিস্টার বির কাছে চিঠিতে করুণাভিক্ষা এই পরিণত পামেলার পরিচয় বহন করে।

পামেলা জনের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলবে বলে ঠিক করেছিল কিন্তু মিসেস জিউকিস এমন কড়া নজরদারী রাখেন যে জনকে চিঠি বিনিময় করেই ফিরে যেতে হয়। পামেলা যে চিঠিগুলি পায় তার একটা জনের লেখা। জন স্বীকার করে মিস্টার বির অনুগ্রহ পাবার জন্য পামেলার প্রতি সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বাবা মাকে লেখা পামেলার চিঠি সে মিস্টার বিকে দেখিয়ে দিয়েছে। পামেলার বিশ্বাসের জগৎটি ক্রমশ ভেঙে পড়তে  থাকে। কাকে আর কতটা বিশ্বাস করা যাবে, সে বিষয়ে সে সন্দিহান হয়ে ওঠে। পামেলা অনুভব করে অনেককেই দেখলে ভদ্রলোক বলে মনে হয়, কিন্তু সবাই ভদ্র নয়, বিশ্বাসযোগ্য নয়। মিস্টার উইলিয়ামসকে পামেলা বার্তা পাঠায় এবং অনুরোধ করে তার জন্য শ্রেয়োতর কোনও আশ্রয়, যা হতে পারে মিস্টার বির বোন লেডি ডেভারের বাড়ি, তার ব্যবস্থা করতে। পামেলাকে যেভাবে মিসেস জিউকিস নজরবন্দী করে রাখেন তাতে তার প্রবল ক্ষোভ হয়। সে মিসেস জিউকিসকে ‘জেজেবল’ বলে আক্রমণ করে। এই অপশব্দ শুনে মিসেস জিউকিস মাথা ঠান্ডা রাখতে না পেরে পামেলাকে চড় মারেন। পরে পামেলা মিসেস জিউকিসের কাছে এই শব্দ ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চান এবং মিসেস জিউকিস আন্তরিকভাবেই তাকে ক্ষমা করেন। পামেলা মিস্টার উইলিয়ামসের কাছ থেকে এক চিঠিতে কিছু আশাব্যঞ্জক খবর পায়। মিস্টার উইলিয়ামস জানান তিনি চেষ্টা করছেন স্থানীয় কিছু রমণী পামেলাকে আশ্রয় দিতে পারে কীনা, সে ব্যাপারে খোঁজখবর করতে। মিসেস ডেভারকেও আশ্রয় বিষয়ে চিঠি লেখার কথা তিনি মনস্থ করেছেন বলে পামেলাকে চিঠিতে জানান। পামেলা জবাবী চিঠিতে তাঁকে ধন্যবাদ জানায় এবং অনুরোধ করে পামেলা তার বাবা মাকে কিছু অর্থ পাঠাতে চায়, তার ব্যবস্থা করা যায় কীনা তা দেখতে। এরপর পামেলা মিসেস জিউকিসের সঙ্গে মাছ ধরতে যায়। এই সুযোগে বাগানের মধ্যে লুকিয়ে থাকার জায়গাগুলি সে অনুসন্ধান করে।

একদিকে পামেলা যেমন মিসেস জিউকিসের নজর এড়িয়ে পালানোর ছক কষতে থাকে, অন্যদিকে মিসেস জিউকিসকে পামেলাকে আটকে রাখার জন্য আঁটঘাট বেঁধে নামেন। তিনি পামেলার থেকে টাকা ধার নিয়ে আর ফেরৎ দেবার নাম করেন না। পামেলা যেখানে তার জিনিসপত্র রাখে সেখানে তালা দিয়েও তার চাবি মিসেস জিউকিস নিজের কাছে রেখে দেন। এইভাবে পামেলার অর্থ ও জিনিসপত্র নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে তিনি পামেলার পলায়ন সম্ভাবনাকে আটকে দিতে চান।

পামেলা ও মিসেস জিউকিসকে মিস্টার বি আলাদা আলাদাভাবে চিঠি লেখেন। পামেলাকে  লেখা চিঠিতে মিস্টার বি জানানপামেলা নিশ্চয় ভালো আছে। যদি মিসেস জিউকিস পামেলাকে যথেষ্ট সম্মান না করেন তাহলে তিনি তাকে কাজ থেকে বিতাড়িত করবেন। পামেলার বাবা ও মা ভালো আছে – একথা জানিয়ে তিনি পামেলাকে নিশ্চিন্ত করতে চান। পামেলা মিস্টার উইলিয়ামসের কাছ থেকেও একটি চিঠি পান। সেই চিঠিতে উইলিয়ামস জানান পামেলার জন্য তিনি যে নতুন কাজের জায়গার সন্ধান করছিলেন তার মধ্যে সম্ভাব্য একজন পামেলাকে কাজে বহাল করতে গররাজী হয়েছে। তবে তিনি অন্যত্র পামেলার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পামেলা জবাবী চিঠিতে মিস্টার উইলিয়ামসকে জানায় সে তার বন্দীদশা থেকে বেরিয়ে কোথাও যাবার জন্য উদগ্রভাবে অপেক্ষা করে আছে। পামেলা এরপর মিস্টার বির উদ্দেশ্যে এক চিঠি লেখে ও তাকে অনুরোধ জানায় তিনি যেন পামেলাকে তার বাবা মায়ের কাছে যাবার ব্যাপারে শীঘ্র অনুমতি দেন। মিস্টার উইলিয়ামস পামেলার পলায়নে সাহায্য করার জন্য বাড়ির একটি চাবি গোপনে তৈরি করে তাকে দেন। একটি ঘোড়া জোগার করারও চেষ্টা করতে থাকেন। মিস্টার উইলিয়ামস নিয়মিত পামেলার কাছে আসতে থাকেন ও মিসেস জিউকিস সন্দেহ করেন তিনি পামেলার প্রেমে পড়েছেন। পামেলা মিস্টার উইলিয়ামসের একটি চিঠি খুলে দেখেন সেখানে সত্যিই তিনি পামেলাকে বিবাহ প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। পামেলা যদিও স্বীকার করে মিস্টার উইলিয়ামসের অনেক গুণাবলী আছে, তবুও সে তার বিবাহ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। মিস্টার উইলিয়ামস পামেলার প্রত্যাখ্যানকে সহজভাবে গ্রহণ করেন এবং তারপরেও তাকে সাহায্য সহযোগিতা করতে চান।

এরপর পামেলার সঙ্গে একইসঙ্গে দেখা হয় মিসেস জিউকিস এবং মিস্টার উইলিয়ামসের। তারা দুজনেই পামেলাকে মিস্টার উইলিয়ামসের বিবাহ প্রস্তাব স্বীকার করার জন্য অভিনন্দন জানালে পামেলা বিস্মিত হয়, কারণ এরকম কোনও প্রস্তাবে বাস্তবে সে রাজিই হয়নি। পামেলা বুঝতে পারে মিস্টার বির থেকে আসা চিঠিই তাদের দুজনকে বিভ্রান্ত করেছে আর এও বোঝে মিস্টার বি পামেলার সঙ্গে মিস্টার উইলিয়ামসের বিবাহ সম্ভাবনাকে এখন গুরুত্ব দিয়েই দেখছেন। ঘটনাধারার আশ্চর্য মোড়কে চমকিত হয়ে পামেলা জানায় এই বিষয়ে তার বাবা মায়ের সম্মতি প্রয়োজন। সে বাবা মাকে চিঠি লেখে এবং চিঠিতে জানিয়ে দেয় যতক্ষণ না পামেলা সশরীরে তাদের সামনে উপস্থিত হচ্ছে, ততক্ষণ যেন তারা এর কোনও উত্তর না দেন। পামেলা এও বাবা মাকে জানায় যে মিস্টার উইলিয়ামস যদি তাঁদের কাছে বিবাহ প্রস্তাব নিয়ে যান, তাঁরা যেন তাঁকে ইতিবাচক কিছু না বলে বসেন।

মিস্টার বির কাছ থেকে মিসেস জিউকিসের উদ্দেশ্যে আসা একটি চিঠি পামেলা ভুলক্রমে খুলে পড়ে ফেলে। দেখা যায় সেখানে মিস্টার জিউকিসকে পামেলার পলায়ন সম্ভাবনার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দিচ্ছেন। যদি মিস্টার উইলিয়ামস বেশি সমস্যা তৈরি করেন, তাহলে তাকে জেলে পাঠানোর কথাও তিনি ভাববেন বলে এই চিঠিতে মিস্টার বি লেখেন। মিস্টার বি জানান তিনি তার বোন লেডি ডেভারের সঙ্গে তিন সপ্তাহের জন্য লন্ডনে যাচ্ছেন এবং সেখানে তারা পরামর্শ করে পামেলার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবেন।

কিছুদিন পর মিস্টার বি সত্যি সত্যিই মিস্টার উইলিয়ামসকে জেলে পাঠান। পামেলা এবার নিজের চেষ্টাতেই পালাবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। একবার জানলা গলে পালাবার চেষ্টার সময় পামেলার গোড়ালি মচকে যায়। তারপর দরজা অবধি গিয়ে সে দেখে মিস্টার উইলিয়ামস তালা খোলার জন্য তাকে যে চাবিটা বানিয়ে দিয়েছিলেন সেটা কাজ করছে না। হতাশ পামেলার মাথায় এইসময় আত্মহত্যার কথা আসে। কিন্তু তার বাবা মা ও ঈশ্বর কেউই তাকে ক্ষমা করবেন না ভেবে এ যাত্রা সে সেই ভাবনা পরিত্যাগ করে। পামেলার পলায়নচেষ্টা ধরা পড়ার পর মিসেস জিউকিস তাকে লেখালিখির উপকরণ দেওয়া কমিয়ে দেন, বাইরে বেরনোর সুযোগও প্রায় বন্ধ করে দেন। এইসময় পামেলারা খবর পায় মিস্টার বি নদী পেরনোর সময় ডুবতে ডুবতে কোনও মতে বেঁচে ফিরেছেন। মিস্টার বির বেঁচে যাওয়া তাকে ভেতরে ভেতরে আনন্দিত করছে দেখে পামেলা নিজেই অবাক হয়ে যায়। তার অবচেতন মন তাকে মিস্টার বি সংক্রান্ত এক ভিন্ন ইঙ্গিৎ পাঠাচ্ছে, আখ্যানের এই অংশ এমন সম্ভাবনাকেই মূর্ত করে। অন্যদিকে পামেলাকে সাহায্য করার অপরাধে মিস্টার বি জনকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন আর মিসে জার্ভিসও ঘোর বিপদের মধ্যে আছেন শুনে পামেলা ব্যথিত হয়।

মিসেস জিউকিস পামেলাকে জানান মিস্টার বি পামেলার সঙ্গে এইবার মঁসিয়ে কোলব্রান্ডের বিবাহের কথা ভাবছেন, যে স্থানীয় যুবকটি মিস্টার বির এস্টেটের বাড়িতে ইতোমধ্যেই কয়েকবার এসেছেন ও পামেলার পরিচিত হয়েছেন। এইসময়ে একদিন মিস্টার বি তার এস্টেটের বাড়িতে সশরীরে হাজির হন। এইবার মিস্টার বি পামেলার সঙ্গে আর এক যুবক, স্যর সাইমন ড্যানফোর্ডের বিবাহের প্রস্তাব পেশ করেন। এই বিবাহ হলে পামেলা প্রচুর জিনিস পাবে বলেও মিস্টার বি জানান। পামেলা এইসব কিছুই প্রত্যাখ্যান করে এবং জানায় সে শুধু মুক্তি চায়। মিস্টার বি এইসময় আবারও পামেলার অসম্মতিতে জোর করে তাকে কয়েকবার চুম্বন করেন। পামেলা দিন দুয়েক পরে চিন্তা করে দেখে মিস্টার বিকে সে যতখানি শয়তান ভাবছিল, তিনি হয়ত তা নন। পামেলার মনে মনে স্বীকার করে মিস্টার বি যথেষ্টই সুদর্শন এক যুবক। পামেলার অবচেতন মন হয়ত এখানে আরো একটু অনুরক্ত হয়েছে মিস্টার বির প্রতি। মিস্টার বি এইসময়ে মিস্টার উইলিয়ামসে জেল থেকে মুক্তি দেবার ব্যবস্থা করছেন পামেলা খুশি হয়। বাস্তবে অবশ্য মিস্টার বি এমন কিছুই করেন নি। এটা ছিল এক চিঠি লিখে সেটা পামেলার সামনে এমনভাবে রাখা যাতে সেটা সে পড়ে ও বিভ্রান্ত হয়। পামেলা দেখে এক নান তার সঙ্গে সে রাতে বিছানায় শুতে এসেছে। খানিক পরেই সে বুঝতে পারে মিস্টার বিই আসলে এসেছেন নানের ছদ্মবেশে। বিছানায় অবশ্য মিস্টার বি আর পামেলা ছাড়াও ছিলেন মিসেস জিউকিস। মিস্টার বি ও মিসেস জিউকিস দুজনে পামেলার দুহাত চেপে ধরেন। মিস্টার বি পামেলার বুকে হাত দেন। ভয়ে অপমানে পামেলা অজ্ঞান হয়ে যায়। পরদিন সকালে পামেলা কিছুটা সুস্থ বোধ করে এবং মিস্টার বিকে পুনরায় অনুরোধ করে তাকে তার বাবা মার কাছে পাঠাতে। মিস্টার বি বলেন পামেলা যদি আগামী দু সপ্তাহ তার কথা শুনে চলে, তবে পামেলাকে তিনি কিছু কিছু স্বাধীনতা দেবেন। মিস্টার বি এইসময়ে আবারও পামেলার অসম্মতিকে তাকে কয়েকবার চুম্বন করেন। একদিন মিস্টার বি পামেলাকে নিয়ে হাঁটতে বেরোন এবং পথিমধ্যে আবারো পামেলাকে চুম্বন করেন। তবে তিনি পামেলার সঙ্গে সাধারণভাবে ভালো ব্যবহার করতে শুরু করেন।

পামেলা তার বাবা মাকে লেখা এক চিঠিতে জানায় সে লজ্জা আর বিষণ্ণতার দিকে এগোচ্ছে না সুখের দিকে, তা সে নিজেই বুঝতে পারছে না। পামেলাকে মিস্টার বি অন্ত্রঙ্গতার সুরে জানান তিনি বেশ গভীর চিন্তায় পড়েছেন। পামেলাকে ভালোবাসলেও পামেলার নিচু সামাজিক অবস্থানের জন্য মিস্টার বি তাকে বিয়ে করতে পারছেন না। নিজের সামাজিক অবস্থানের কাউকেও মিস্টার বি বিয়ে করতে চান না। তিনি পামেলাকেই জীবনে চান।

পামেলা অনুভব করে মিস্টার বি এইবার ভদ্রজনোচিত আচরণ করছেন।  সে মিস্টার বিকে জানায় তার মূল

চিন্তা ছিল মিস্টার বি তাকে অসম্মান করবেন অর্থাৎ সামাজিক মর্যাদা না দিয়ে কেবল শরীরীভাবে ভোগ করবেন। মিস্টার বি পামেলাকে জিজ্ঞাসা করেন সে মিস্টার উইলিয়ামস বা অন্য কাউকে মনে মনে ভালোবাসে কিনা। পামেলা জানায় এমন কোনও ভালোবাসার ব্যাপারই নেই তার। মিস্টার বি নানা কথা বলে যেতে থাকলে পামেলা এইসময় তার আঙুল মিস্টার বির ঠোঁটের ওপর রেখে তাকে থামিয়ে দেয়। সে জানায় সে কেবল ভেবেছে মিস্টার বি তার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তাকে অসম্মান করবেন। মিস্টার বি জানান তিনি পামেলাকে মর্যাদা দেবেন। একথা বলে তিনি পামেলাকে কাছে টেনে নেন। মিস্টার বি শেষপর্যন্ত তাকে মর্যাদা দিচ্ছেন ও সত্যিকার অর্থে ভালোবাসছেন দেখে পামেলা খুশি হয়।

একটি বল নাচের নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য এস্টেট বাড়ি থেকে মিস্টার বিকে ফিরে যেতে হয়। ফেয়ার আগে তিনি পামেলাকে জানিয়ে দেন যে মিসেস জার্ভিস, মিস্টার লংম্যান সহ তাঁর আরো কর্মচারীকে মিস্টার বি বরখাস্ত করেছেন, কারণ তাঁরা মিস্টার বি ও তার বোন লেডি ডেভারর্সের মধ্যে অশান্তি পাকানোর চেষ্টা করছিল।

মিস্টার বি কিছুদিন পর পামেলার কাছে ফিরে আসেন। এইবার সন্দেহের দৃষ্টিতে পামেলাকে তিনি কিছু প্রশ্ন করেন, যার মধ্যে অন্যতম হল মিস্টার উইলিয়ামসকে পামেলা প্রেমপত্র লিখেছে কীনা সেই সংক্রান্ত। পামেলা যদিও জানায় এমন কিছুই সে লেখে নি, তবু মিস্টার বি পামেলার কাছে থাকা সব কাগজপত্র দেখতে চান। কিছু সাম্প্রতিক চিঠি সরিয়ে রেখে পামেলা তার সব কাগজ মিস্টার বির হাতে তুলে দেয়।

মিসেস জিউকিস একদিন হঠাৎ এসে পামেলাকে জানান তাকে এখনই বাবা মাকে দেখার জন্য রওনা হতে হবে। পামেলা অবাক হলেও কোচম্যানের সঙ্গে যাত্রা শুরু করে। পামেলার রক্ষক হিসেবে তার গাড়ির পাশে পাশে মঁসিয়ে কোলব্রান্ডও পিস্তল পকেটে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে রওনা হন। কোলব্রান্ড যাত্রাপথে পামেলাকে মিস্টার বির লেখা একটি চিঠি তুলে দেন। পামেলা দেখে মিস্টার বি সেখানে লিখেছেন তিনি পামেলার জার্নাল পড়ে মুগ্ধ হয়েছেন ও পামেলার প্রকৃত স্বরূপ অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। এই জার্নালপাঠ পামেলার প্রতি তার ভালোবাসাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে বলেও মিস্টার বি চিঠিতে জানান। এই চিঠি পড়ে মিস্টার বি সম্পর্কে পামেলার মনে ইতিবাচক মনোভাবের উদয় হয়।  এইসময় পামেলার কাছে মিস্টার বির আরো একটি চিঠি এসে পৌঁছয়।  তাতে মিস্টার বি জানান যে পামেলার বিহনে তিনি কষ্ট পাচ্ছেন ও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি পামেলাকে ফিরে যাবার জন্য কাতর অনুরোধ জানান। পামেলা এই চিঠি পড়ে মিস্টার বির কাছে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। পামেলা ফেরার পর মিস্টার বি আনন্দে আত্মহারা হন ও পামেলার হস্তচুম্বন করে তাকে স্বাগত জানান। মিস্টার উইলয়ামসও এইসময় মিস্টার বির চেষ্টায় জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। মিসেস জিউকিসেইসময় থেকে পামেলাকে লেডি ডেভার্সের মতোই সম্মান করতে শুরু করেন। মিস্টার বি পামেলাকে জানান তিনি লেডি ডেভার্সের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে চাইছেন না, কারণ তার বোন পামেলার সঙ্গে তার সম্পর্ককে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। পামেলা ও মিস্টার বি তাদের ভবিষ্যৎ সংসার সম্পর্কে আলচনা শুরু করেন। মিস্টার বির পারিবারিক চ্যাপেলে পামেলা ও মিস্টার বির বিবাহের দিন তারা আলোচনা করে স্থির করে। মিস্টার বি বিয়ের দিন গোপন রাখতে চান। তবে পামেলা চায় কেবল তার বাবা ও মাকে দিনটা জানাতে। মিস্টার বি পামেলাকে বলেন তাদের বাড়িতে পামেলা এক অপ্রত্যাশিত অতিথিকে দেখবে এইবার।পামেলা ভেবেছিল এই অতিথি হয়ত হবেন মিস্টার উইলিয়ামস। কিন্তু তার বাবাই সেই অতিথি এটা দেখে পামেলা একইসঙ্গে আশ্চর্য ও খুশিতে আত্মহারা হয়। পামেলা ও তার বাবা নিভৃতে অনেক কথা বলেন ও পামেলার বাবা খুশির খবর তার মাকে জানানোর জন্য ব্যাগ্র হয়ে পড়েন। মিস্টার বি পামেলার বাবাকে তাদের বিয়ে অবধি থেকে যেতে অনুরোধ করেন। মিস্টার উইলিয়ামস্পামেলা ও মিস্টার বির বিবাহে যাজকের ভূমিকা পালন করেন। লেডি ডেভার্স এই বিয়ের খবরে প্রথমে ক্রুদ্ধ হলেও ক্রমশ পামেলাকে পরিবারে খুশিমনে মেনে নেন। তার ও মিস্টার বির মধ্যেকার ভাই বোনের সম্পর্ক আবারো মধুর হয়ে ওঠে। এক ডিনারে আগত মিস্টার বির মান্যগণ্য অতিথিরাও পামেলা সম্পর্কে প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেন।

‘কেমনভাবে চিঠি লিখতে হয়’ – সেই গাইডবই এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য পেরিয়ে পামেলা কেন উপন্যাসের ইতিহাসে এক চিরায়ত সৃষ্টি হিসেবে পরিগণিত হল, তা বোঝা দরকার। এর প্রথম এবং প্রধান কারণ নিঃসন্দেহে পামেলার চরিত্র চিত্রণের বিশিষ্টতা। তার সারল্য, ধর্ম সঙ্কটেও দৃঢ় মানসিকতা সমকালীন পাঠককে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল। অষ্টাদশ শতকের নৈতিক পাঠক উপন্যাসের কাছ থেকে যা চাইতেন, পামেলায় তার অকৃপণ জোগান রয়েছে।

পামেলা উপন্যাস বা এর প্রধান চরিত্রের মূল আকর্ষণ তার দৃঢ় নৈতিক অবস্থান হলেও সেটিই এই চরিত্রের একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়। দৃঢ়তার পাশাপাশি পামেলার মধ্যে কখনো কখনো দেখা গেছে এক দ্বন্দ্ব আর এই দ্বন্দ্বসংঘাতের মুহূর্তগুলি পামেলা উপন্যাসটিকে বাস্তবের আরো কাছাকাছি এনেছে, মূল চরিত্রের মধ্যে যোগ করেছে বহুমাত্রিকতা। পামেলার মন একদিকে মিস্টার বির যৌন তাড়নাকে প্রতিহত করেছে, তার আশ্রয় থেকে পালাতে চেয়েছে, অন্যদিকে আবার সেই মিস্টার বির প্রতিই নিজের অজান্তে সে এক বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছে। পামেলা মিস্টার বির বাড়ি ছেড়ে যাবার পর যখন তার কাছ থেকে এক চিঠি পায় এবং জানতে পারে তার গৃহত্যাগে মিস্টার বি কাতর ও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তখন সে আবার ফিরে যায় তার সেই মালিকের কাছে, যাকে সে প্রবলভাবে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল। প্রত্যাবর্তনের পর পামেলা যে এইবার মিস্টার বিকে ভালোবাসে ও জীবনে গ্রহণ করে তার কারণ মিস্টার বির মন মানসিকতা ও পামেলার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গীর আমূল বদল। মিস্টার বি এখন আর এমন মালিক নন, যিনি জোরজুলুম করে পামেলাকে শারীরিকভাবে ভোগ করবেন। মিস্টার বির রূপান্তরিত চেহারা এক প্রেমিকের, যিনি পামেলাকে মর্যাদা দিয়ে স্ত্রী হিসেবে পেতে চান। ভালোবাসার টানে উপেক্ষা করতে প্রস্তুত হন ভিন্ন সামাজিক অবস্থানের সমস্ত বাধাকে।

পামেলাকে কেউ কেউ বলেছেন ভালো আচরণবিধি শেখানোর আখ্যান, ‘ফিকশনালাইজড কনডাক্ট বুক’। আর এ কারণেই একে ফেলেছেন ‘ডাইডাক্টিক নভেল’ এর গোত্রে, যা একধরনের নীতিশিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা হয়। আমরা যদি পামেলা উপন্যাসের উপশিরোনামটি খেয়াল করি, তাহলে দেখব সেখানে লেখা আছে –‘ভারচু রিওয়ার্ডেড’। গ্রন্থনামের মধ্যেই এই ইঙ্গিৎ স্পষ্ট পামেলা যে তার নৈতিক অবস্থানকে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও দৃঢ়তার সঙ্গে ধরে রাখল, তাই শেষপর্যন্ত তার জীবনকে সুখের করল, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা সম্পন্ন, মর্যাদাপূর্ণ এক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারল সে।

পামেলার সঙ্গে যদি তুলনা করা যায় প্রায় দু দশক আগে লেখা ড্যানিয়েল ডিফোর উপন্যাস ‘মল ফ্ল্যান্ডার্স’ এর, তাহলে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পর্যবেক্ষণের মুখোমুখি হব আমরা। ডিফোর উপন্যাসের নায়িকা মল ফ্ল্যান্ডার্স নামক অনাথ চরিত্রটি আশ্রিতা হিসেবে বেড়ে উঠছিল এক পরিবারে। মল ফ্ল্যান্ডার্সকে শারীরিকভাবে কামনা করেছিল সেই পরিবারের বড় ছেলে, ঠিক যেভাবে এই উপন্যাসে পামেলাকে কামনা করেছিলেন মিস্টার বি। পামেলা মিস্টার বির কামনাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করতে পারলেও ডিফোর মল ফ্ল্যান্ডার্স তা পারে নি। আশ্রয়দাতা পরিবারের বড় ছেলে মলকে ভোগ করে কিন্তু মল ফ্ল্যান্ডার্সের বিবাহ প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে। মল ফ্ল্যান্ডার্স এর পরবর্তী জীবন অনিশ্চিতি, অসম্মান ও যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে কাটে। একটার পর একটা বিবাহ করে সে, কিন্তু প্রায় কোনওটাই তার জন্য সুখের হয় না। মল ফ্ল্যান্ডার্স জীবনে কখনো স্থিতি বা স্বচ্ছলতা খুঁজে পায় না। পেটের দায়ে তাকে নামতে হয় চৌর্যবৃত্তিতে এবং তাতে ধরা পড়ে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাতেও সে দণ্ডিত হয়। শেষ মুহূর্তে অবশ্য মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা বদলে যায় দ্বীপান্তরের শাস্তিতে। মল ফ্ল্যান্ডার্স এর বিপরীতে পামেলার জীবন কিন্তু প্রাথমিক সংকটের পর সুখ, সমৃদ্ধি ও স্থিতির। নৈতিকতাকে আদ্যন্ত আঁকড়ে থাকার পুরস্কার হিসেবেই এই পরিণতিকে দেখান ঔপন্যাসিক স্যামুয়েল রিচার্ডসন।

প্রশ্ন উঠতে পারে আশ্রয়দাতা মিস্টার বির দূরভিসন্ধি বোঝার অব্যবহিত পরেই কেন পামেলা তার নিজের বাবা মায়ের কাছে ফিরে যায় নি? জরুরী পরিস্থিতি উদ্ভূত হলেও পোশাক বানানোর কাজ শেষ করাটা কেন এত বাধ্যতামূলক হয়ে উঠল? উপন্যাসের মধ্যে এর উত্তর একভাবে তৈরি হয়ে আছে বাবা মাকে লেখা পামেলার একেবারে প্রথম চিঠিটির মধ্যে। পামেলার পরিবার এতই দরিদ্র ও ঋণগ্রস্থ যে উপার্জনের জায়গা ছেড়ে বাবা মার কাছে ফিরে গিয়ে সে তাদের বোঝা হয়ে উঠতে চায় নি। মিসেস বির মৃত্যুর পর তাঁকে সেবার পুরস্কার হিসেবে যে সোনার গিনিগুলি পামেলা পেয়েছিল, সেগুলিকে সে দ্রুত পাঠিয়ে দেয় বাবা মার কাছে আর আশা করে এগুলি দিয়ে তাদের ঋণের একাংশ শোধ করে দেওয়া সম্ভব হবে। ভবিষ্যতের উপার্জনও বাবা মাকে যথাসম্ভব পাঠিয়ে সে কন্যা হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করতে চায়। এজন্যই সে কষ্ট ও অপমান সহ্য করেও কিছুদিন মুখ বুজে পড়ে থেকেছে মিস্টার বির আশ্রয়ে। কিন্তু তারপর পরিস্থিতি যখন একেবারেই প্রতিকূল হয়ে ওঠে, তখন সে মিস্টার বির আশ্রয় ছেড়ে নিজের ঘরে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়।

আমরা আগেই দেখেছি পামেলা যখন মিস্টার বির ঘর ছেড়েছে তখন সে এমন একটি চিঠি পায় যা তার জীবনের ও উপন্যাসের গতির মোড় ফিরিয়ে দেয়। মিস্টার বি পামেলার বিহনে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন, চিঠিতে একথা জেনে পামেলা মিস্টার বির কাছে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রশ্ন হল কেন এই প্রত্যাবর্তন? কেবল ঘৃণাই যদি সে করবে মিস্টার বিকে, এই প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত তো তাহলে নেওয়ার কথা না পামেলার। পামেলার সচেতন মন একদিকে যখন নৈতিক দিকটিকে প্রাধান্য দিয়েছে, তখনই তার অবচেতন মনে কোথাও মিস্টার বির প্রতি কোনও টান কি তবে তৈরি হয়েছিল? এমন কি হওয়া সম্ভব যে নিজের নবজাগ্রত যৌবনের আগুনে উত্তাপ কতটা তা সে বুঝে নিতে পারছিল মিস্টার বির কামদৃষ্টি থেকে? পামেলার নৈতিক মনের পাশাপাশি তার নারী শরীরমনের নতুন জাগরণের দিকটিকে একালের পাঠক কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারেন না। অষ্টাদশ শতকের নৈতিক পাঠকের থেকে আজকের দিনের পাঠক অন্যভাবেই পড়তে চাইতে পারেন রিচার্ডসনের এই অমর সৃষ্টিকে। ভাবতে পারেন মিস্টার বির শরীরি আকর্ষণকে অনৈতিক বলে ঘৃণা করলেও মনে মনে তার প্রতি সে দুর্বল হয়েছিল কিনা। সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার কোনও বাসনা পামেলার মনের কোণে বাসা বেঁধেছিল কিনা সে প্রশ্নও মনে আসা অসম্ভব নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই উপন্যাস প্রকাশের পরের বছরেই সমকালীন ব্রিটেনের আর এক খ্যাতনামা লেখক হেনরি ফিল্ডিং বেনামে শামেলা বলে একটি ব্যাঙ্গাত্মক আখ্যান লেখেন। সেখানে পামেলার নৈতিকতাকে বানানো বলে আক্রমণ করে এইসব বিষয়ই উপস্থাপিত হয়েছিল। বলা বাহুল্য ‘শামেলা’তে করা আক্রমণগুলি রিচার্ডসনকে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ করে।

রিচার্ডসন নৈতিকতাকে পামেলা উপন্যাসে প্রাধান্য দিয়েছেন – একথা ঠিক। কিন্তু পাশাপাশি এও ঠিক পামেলার প্রত্যাবর্তনের মধ্যে দিয়ে তিনি নৈতিকতার প্রোটোটাইপ এক চরিত্র চিত্রণের বদলে তাঁর নায়িকাকে মানবিক পামেলায় উন্নীত করে দিয়েছেন। ‘পামেলা অর ভার্চু রিওয়ার্ডেড’ উপন্যাসটির বিশিষ্টতা এখানেই যে পামেলার মনের মধ্যে ওঠা দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, আলোড়নের সূত্রকে ধারণ করেই শেষমেশ নৈতিক জয়কে প্রতিষ্ঠা দেবার পথে এগিয়েছেন রিচার্ডসন; আর এ কারণেই উপন্যাসটি আরো জীবন্ত হয়ে উঠতে পেরেছে। যে নৈতিক শিক্ষা এই উপন্যাসটি নান্দনিকভাবে দিয়েছে, তা চার্চের শুষ্ক বাণীর চেয়ে বেশি কার্যকরী – এমনই মনে করেছিলেন বিশিষ্ট কবি সমালোচক আলেকজান্ডার পোপ। রিচার্ডসনের পামেলা প্রকাশের পরেই তা যে জনপ্রিয়তার ঝড় তুলেছিল, তা থেকে বোঝা যায় ইংরাজী উপন্যাসের ঊষালগ্নে ড্যানিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রুসো বা মল ফ্ল্যান্ডার্সের মতো অ্যাডভেঞ্চারধর্মী ঘটনাবহুল উপন্যাসগুলির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা গোত্রের এক আখ্যান, যেখানে থাকবে চরিত্রপাত্রদের অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণ ও আদানপ্রদান, তার জন্যও অষ্টাদশ শতকের পাঠক সাগ্রহে অপেক্ষা করে ছিলেন।

চরিত্র চিত্রণ বা উপন্যাস দর্শনে নৈতিকতার দিকটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিলেও আখ্যান রীতির দিকটিকে রিচার্ডসন উপেক্ষা করেন নি। পামেলাতে রয়েছে আখ্যান বর্ণনার এক অভিনব ও জীবন্ত রীতি। চিঠির মাধ্যমে শুধু চরিত্রপাত্রদের মনোজগতের কথাই আবরণহীনভাবে উঠে আসে নি, জীবনের গতিময়তাও ধরা থেকেছে। উদাহরণ হিসেবে আমরা প্রথম চিঠিটির কথা ভাবতে পারি। এই চিঠিতে পামেলা জানাচ্ছে এই চিঠির পাতা ও কালি ভিজে যাচ্ছে, কারণ চিঠিটি লেখার সময়ে সে যখন তার স্নেহশীলা মালকিন মিসেস বির কথা লিখছে, তার চোখের জল বাঁধ মানছে না। চিঠির শেষে আমরা একটি পুনশ্চ অংশ পাই। তার কারণ চিঠি শেষ করার পর তার নয়া আশ্রয়দাতা মালিক মিস্টার বি সেখানে আসেন ও পামেলা কী লিখেছে দেখতে চেয়ে চিঠিটি পড়েন। মিস্টার বির চিঠি পড়া ও পামেলাকে চিঠি সংক্রান্ত তার বলা কিছু কথার প্রসঙ্গর উল্লেখ থাকে এই পুনশ্চ অংশে এবং এভাবে এই রীতিটি বাস্তব ঘনিষ্ট চলমানতাকে ধারণ করে। স্যামুয়েল রিচার্ডসন জানতেন চিঠি লেখা সেখানোর গাইডবুক পেরিয়ে তিনি এক নতুন ধরনের সাহিত্যরীতির জন্ম দিচ্ছেন, যাকে আমরা এখন উপন্যাস বলে জানি। বন্ধু অ্যারন হিলকে লেখা পূর্বোক্ত চিঠিতে রিচার্ডসন স্পষ্টভাবেই ‘এ নিউ স্পিসিস অব রাইটিং’ কথাটি উল্লেখ করেছেন। জানাচ্ছেন আখ্যানের জনপ্রিয়তার শর্তগুলিকে তিনি কীভাবে মাথায় রেখেছিলেন সেইসব কথাও। এক জায়গায় বন্ধু অ্যারন হিলকে স্যামুয়েল রিচার্ডসন লিখছেন, “এ ন্যারেটিভ হুইচ হ্যাজ ইটস ফাউন্ডেশন ইন ট্রুথ অ্যান্ড নেচার, অ্যান্ড অ্যাট দ্য সেম টাইম ইট অ্যাগ্রিয়েবলি এন্টারটেইনস, বাই এ ভ্যারাইটি অব কিউরিয়াস অ্যান্ড অ্যাফেক্টিং ইনসিডেন্টস” এর কথা। বোঝা যাচ্ছে উপন্যাসের নৈতিক দিকটিকেই শুধু বিবেচনায় রাখেন নি রিচার্ডসন, আখ্যানের নান্দনিক দিকগুলি, পাঠকের আগ্রহকে জাগিয়ে রাখার বিষয়গুলি নিয়েও গভীরভাবে ভেবেছেন।