শহীদ সারা হেগাজি ও আরব বিশ্বে অধিকার আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি

২০১৭ সালে কায়রোতে মাশরো লায়লা কনসার্টে ক্যুয়ার পতাকা উড়িয়ে গোটা বিশ্বের ভালোবাসা কুড়িয়েছিলেন মিশরীয় সোশ্যালিস্ট, LGBTQ অ্যাক্টিভিস্ট সারা হেগাজি। কিন্তু সেদিনের ওই ঘটনার পর তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় রাষ্ট্রের পোষা পুলিশ, তিন মাস ধরে জেল হেফাজতে চলে অত্যাচার। তার ৩ বছর পর, ২০২০ সালে কানাডার বাড়িতে আত্মহনন করেন তিনি। 

মিশরের প্রগতিশীল ও রক্ষণশীলদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক টানাপোড়েন তাড়া করে বেরিয়েছিল ত্রিশ বর্ষীয় এই লিঙ্গ-রাজনৈতিক কর্মীর ব্যাক্তিগত জীবন। ২০১৭-তে লেবানিজ ব্যান্ডের ওই কনসার্টে প্রকাশ্যে ধর্মীয় ফতোয়ার নাকের ডগা দিয়ে প্রাইড ফ্ল্যাগ উড়িয়ে রাতারাতি গোটা বিশ্বের ক্যুয়ার প্রতিরোধের মুখ হয়ে উঠেছিলেন হেগাজি, একইভাবে গোঁড়া রাষ্ট্রের শাসকেরও নজর এড়াননি। তবুও তার প্রতিবাদ প্রতিরোধ থেমে থাকেনি। রাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন, "মিডিয়া আর মসজিদকে ব্যবহার করে শাসনতন্ত্র মিশরীয় সমাজকে বোঝাতে চাইছে ধার্মিকতা কিভাবে রক্ষা করতে হবে। ধর্ম আর নৈতিকতা রক্ষার দায় আমাদেরও আছে, ধর্ম রক্ষকদের এই নিয়ে আমাদের শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন নেই"। তিনি নিশ্চিত ছিলেন মিশরীয় রাষ্ট্রযন্ত্র আর ইসলামীয় রাজনীতির ধারকরা নিজেদের মধ্যে পুরোনো বৈরিতাকে সরিয়ে একত্রিত হবেই, আর তাদের সম্মিলিত লক্ষ্য হবে ঘৃণা এবং বিদ্বেষকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করা। 

এমনই এক উত্তাল সময়ে সুদানিজ বিপ্লবের পরে যখন সেখানে ত্রিশ বছর ধরে চলে আসা একনায়কতন্ত্রের অবসান হলো, পতন হলো ওমর-আল-বসিরের, ২০১৯ সালে সেই ঐতিহাসিক দিনের এক বছর পূর্ণ হওয়ার উপলক্ষে হেগাজি উপস্থিত ছিলেন স্কারবোরোতে অনুষ্ঠিত সুদানিজ কমিউনিটি আয়োজিত একটি সভায়। সুদানের সেই বিপ্লবের সাফল্য, খামতি, ভবিষ্যত - সবকিছু নিয়ে চলেছিল আলোচনা। সেই আলোচনার একটি অংশ ইংরেজি থেকে বাংলায় (মূল ভাষা মিশরীয়) অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায়, তা খানিক এইরকম -

"মিশরীয় বিপ্লবের উত্থানের কারণ আমি মনে করি পুঁজিবাদ আর ক্ষমতাতন্ত্রের মধ্যে এক গভীর আঁতাত। মিশরে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং শিল্পপতিদের ক্রমাগত দুর্নীতির বিরোধীতাও এই বিপ্লবের কারণ। বিশেষত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাবি বেলাইডলির সময়ে বন্দিশিবিরগুলোতে যে অকথ্য অত্যাচার চলেছিল বন্দিদের উপরে, তা রাষ্ট্রের সামরিক ভিত্তির নৈতিক অধঃপতনই দর্শায়। গোটা দেশেই এই অধঃপতন আর দুর্নীতি পরিবাহিত হয়ে চলেছে ক্ষমতা হস্তান্তরের হাত ধরে। নূন্যতম মজুরি বা পেনশনের মতন মৌলিক জিনিসের কোনো ধারণাই নেই দেশের জনগণের মধ্যে। না আছে শ্রমিক-মজুরদের স্বার্থরক্ষাকারী কোনো আইন, আর না আছে তাদেরকে কাজে বহাল রাখার জন্যে নির্দিষ্ট কোনো নিয়মাবলী বা কোনো স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা, ফলে যেকোনো সময়ে যেকোনো কাউকে কাজ থেকে ছাঁটাই করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, বিপ্লবের পরেও এক্ষেত্রে কোনো সুরাহা হয়নি, সেইদিক থেকে তাই বিপ্লব একপ্রকার ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। 

একথা জলের মত পরিস্কার যে যখনই একটি রাষ্ট্রের শাসন কাঠামো ভেঙে পড়ে, সে চেষ্টা করে বক্রপথ অবলম্বন করে হলেও আগের জায়গায় ফিরে আসতে। ওই সময়ে সুদানে তারাই অভিযুক্ত হয়েছেন যারা কোনো না কোনোভাবে সুন্নি মুসলিম সম্প্রদায়, কতিপয় ধনবান নাগরিকবর্গ অথবা বিষমকামীদের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। সুদানের বিপ্লবের সময়কালে আমরা এমন অ্যাক্টিভিস্টদের পাইনি, যারা শাসনতন্ত্রের পরিকাঠামোর গোড়া থেকে নিরসন চায়, তারা পরিকাঠামোর মুখ বদলে ফেলতে আগ্রহী ছিলেন শুধু। বিপ্লবের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত এই শাসনকাঠামোর গম্বুজকে তার রক্ষকদের মাথার উপরেই চূর্ণ করে ফেলা, এবং তার জায়গায় নতুন পরিকাঠামোর পত্তন করা। মিশরে রাষ্ট্রশাসনের পর্দার আড়ালে মূল চালিকাশক্তি হলো তার সামরিক বাহিনী, এদের উপস্থিতিতে যেন রাষ্ট্রের ভেতরই আরেকটি রাষ্ট্র নির্বিঘ্নে কাজ করছে। যে বিরোধিতার সম্মুখীন তারা হয়েছে, তা থেকে তারা ফসকে বেরোতে চেয়েছে যাতে যেকোনো বিরোধমূলক টালমাটাল পরিস্থিতি তারা সহজে এড়িয়ে যেতে পারে। বিপ্লবের মুখে কিছু কৃত্রিম ও অস্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করে তারা পরিবর্তনের ভ্রম তৈরি করতে চেয়েছে, যাতে আরও সুষ্ঠুভাবে নিজেদের অস্তিত্ব কায়েম রাখতে পারে। হোস্কনি মুবারকের শাসনকালে যে বিতর্ক আর পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল মিশরীয় সামরিক বাহিনী শ্রমজীবী মানুষের প্রতিরোধ দমন করতে, সেই একই পুরনো পদ্ধতি তারা এবারেও ব্যবহার করলো শ্রমিক মজুরদের বৈপ্লবিক ইউনিয়ন করা থেকে দূরে রাখতে। মিশরে এখনও পর্যন্ত এক বিরাট সংখ্যক মানুষ গরাদের পেছনে বন্দি। আর এই পরিস্থিতি কেবল আমাদের দেশেই নয়, গোটা বিশ্বেই এই মুহূর্তে শাসনতন্ত্র আর প্রগতিশীলদের মধ্যে অঘোষিত যুদ্ধের উপক্রম হয়েছে। প্রতিবাদীরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে এই প্রতিরোধে ভূমিকা নিচ্ছেন। অপরদিকে শাসনতন্ত্র-ও ক্ষমতায় পুনরুত্থিত হতে যা যা করা সম্ভব সেইসব কিছু করছে। দরকার হলে পরিকাঠামোর বিভিন্ন স্তরে থাকা কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাধরকে কুরবানি দিতেও তারা পিছপা হবেনা। ঠিক যেমন করে সুদানের বিপ্লবের দিনে বিপদ আশঙ্কা করে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল হোস্কনি মুবারককে, যাতে রাষ্ট্রযন্ত্র তার পরেও নির্বিঘ্নে তার কাজ চালিয়ে যেতে পারে। এসব কিছু ক্ষেত্রে চতুর উপায় অবলম্বন করে তারা সক্ষম হয়েছে বিপ্লবী গতিধারাকে প্রতিহত করতে। মিশরে এবং গোটা বিশ্বেই ধর্মকে রক্ষা করাই মূল কারণ মানুষের যুদ্ধ প্রবণতার, সামরিক বাহিনী সফল হয়েছে ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতার লড়াইয়ে দ্বিতীয় পক্ষটিকে সরিয়ে দিতে। তা সত্ত্বেও এই ক্ষেত্রে গোঁড়া রাষ্ট্র এবং পরিবর্তনপন্থী গতিধারার মধ্যে নীচু এবং উপরস্তরে লড়াই চলছেই। রাষ্ট্র সক্ষম হয়েছে বিপ্লবের দুর্বল দিক লক্ষ্য করে তাকে আঘাত করতে। তারা অত্যন্ত সুসংগঠিত তাদের লক্ষ্যে। তাই যারা এই প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, তারা নিজেরাও জানে এই লড়াইয়ে তাদের মৃত্যু অনিবার্য, এটা বাড়িয়ে বলা বা কথার কথা নয়, এটাই সত্যি! মিশরে এখনও বাস্তব এমনই, বহু মানুষ এখনও গোপন আশ্রয়ে লুকিয়ে, কিংবা আটকা রয়েছেন জেলে, নয়তো তাদের মেরে ফেলা হয়েছে, নির্বাসিত করা হয়েছে। মিশরের ওই ইঞ্জিনিয়ারের উপর হামলার ঘটনাটিও কতটা হিংস্র সেটা আমরা দেখেছি আগেই। অতএব, বিপ্লব পুরোপুরি তার লক্ষ্যে সফল হয়নি, এবং এর থেকে যা যা শিক্ষা আমরা নিতে পারি তার মধ্যে প্রথম হলো ধর্মঘটকে সফল করানো। বনধ, ধর্মঘট এই সবই সামাজিক ন্যায় বিচার আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। দ্বিতীয়ত, বৈপ্লবিক শক্তি ও সংগঠনগুলোর সাথে প্রকাশ্য রাস্তায় সাধারণ জনগণ, মজুর ও ছাত্রদের চলমান আন্দোলনকে সংযুক্ত করার দিকে নজর দেওয়া। তৃতীয়ত, ইসলামের রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে মিত্রতাপূর্ণ কোনো সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার মতন কোনো বিষয় যেন তৈরি না হয়, কারণ তারা কোনো একসময় ঠিক আমাদের ঠকিয়ে রাষ্ট্রের সাথে হাত মেলাবে। আমাদের সংগ্রাম শুধুমাত্র স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র এবং তার বৈষম্যমূলক নীতি, পুঁজিবাদ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ থাকবেনা, বরং এই সংগ্রাম হবে জাতীয় ভ্রাতৃত্ব, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষার্থে। সাধারণ জনগণকে বুঝতে হবে মানুষের মৌলিক অধিকার কোনো আপোষের বিষয় নয়, দরদামের বস্তু নয়। উচ্চ মানের জীবনযাপনের অর্থ সমস্ত রকম ট্র্যাজেডি, শোষণ এবং ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ পরিস্থিতির হিংসামুক্ত জীবনযাপন; আমাদের জমি, আমাদের পুঁজি যদি ব্যবসায়ীদের হস্তগত হয়, দেশের মানুষই যদি তার সদ্ব্যবহার না করে উঠতে পারে, তাহলে সেই অস্তিত্ব অর্থহীন। আমাদের এথেকে শিক্ষা নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এই ফাঁদে আমরা পুনরায় না পড়ি"।

মৃত্যুর ১ বছর আগে ওই সভায় হেগাজির উচ্চারিত শব্দ যেন গোটা পৃথিবীর শোষিত মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর গান। পৃথিবীর এমন চরম দুঃসময়ে হেগাজির মত স্বপ্নের ফেরিওয়ালাদের খামতি অনুভূত হয় প্রতি মুহূর্তে। হেগাজির মত মানুষরা সারা পৃথিবীকে দিন বদলের স্বপ্ন দেখতে শেখান, তারপর হারিয়ে যান ছায়া আর তারাদের অনন্তের মধ্যে - সেই তারা আর ছায়া, যাদের কথা রোহিত ভেমুলা লিখে রেখে গেছিলো তার শেষ চিঠিতে। তবু মনে হয়, সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষের সংগ্রামের গল্প লেখা হয়ে আসছে ওই তারাদের দেশ থেকেই, সে গল্পের কোনো শেষ নেই। ইতিহাস তো ফিরে ফিরে আসবেই, তার পুনর্লিখন হবে উমর খালিদের মুষ্টিবদ্ধ হাতে, ভারভারা রাওয়ের কলমে, ইরানী বালিকার কেশাবশেষে বা সিরিয়ান শিশুর হাসিতে। ঘৃণার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মহব্বতের জয় হবেই - যে মহব্বতের সাতরঙা স্বপ্ন নিয়ে পৃথিবীর বুকে শেষ নিঃশ্বাস নিয়েছিলেন ত্রিশ বছর বয়সের প্রতিবাদী তরুণী সারা হেগাজি।

 

(সারা হেগাজির ইন্টারভিউয়ের অংশটি The Spring Magazine এর ইউটিউব চ্যানেল থেকে নেওয়া)