দুর্নীতি ও পশ্চিমবঙ্গের ঘাটতির অর্থনীতি
- 07 February, 2023
- লেখক: অমিত দাশগুপ্ত
৩৪ বছরের সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের নিরবিচ্ছিন্ন শাসনের পরে গত ১১-১২ বছর ধরে মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসের শাসন চলছে পশ্চিমবঙ্গে। জনজীবনে দারুণ বা নিদারুণ পরিবর্তন এসেছে এমন কথা ‘পরিবর্তনের’ শ্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় আসা শাসক দলের অকুন্ঠ সমর্থকও কোনো পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেখাতে পারবে না। অপরদিকে ২০১৬ সালের নির্বাচনে যে বামফ্রন্ট ‘প্রত্যাবর্তনের’ ভাবনায় মশগুল ছিল তারাও এই মুহূর্তে ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা দেখছে, তাও তাদের সমর্থকদের কাছে শোনা যায় না। তবে বামফ্রন্ট যেকোনো মূল্যেই তৃণমূলের শাসনের অবসান চায়। এই অবকাশে দই মারার জন্য নেপো হিসেবে বিজেপি অপেক্ষায় রয়েছে, অবশ্যই তাদের সঙ্গে সঙ্গত করতে উপস্থিত রয়েছে ইডি, সিবিআই, এনআইএ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, জাতীয় মহিলা কমিশন, এমনকি, হয়তো বা, আদালত, যা বিগত রামমন্দির, পেগাসাস, নোটবাতিল সমেত বহু স্পর্শকাতর মামলার রায়ে প্রতিফলিত হয়েছে।
তবে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থা যে যথেষ্টই ভঙ্গুর তা সরকারি আচরণে বোঝা যাচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম যখন অগ্নিমূল্য, যার ফলে সুদের হার কমানোর দিকে সদা তৎপর রিজার্ভ ব্যাঙ্কও বারবার ব্যাঙ্ক হারকে বাড়িয়ে সুদের হারের উর্ধাভিমূখী গমনের দিকনির্দেশ করছে, তখনো রাজ্য সরকার তার কর্মীবাহিনীর ডিএ বাড়াতে নারাজ। গত দু’বছরের উপর এক পয়সা ডিএ’ও বাড়েনি সরকারি কর্মচারীদের। চলতি বেতন কমিশনের ক্ষেত্রেই ৩৫ শতাংশ ডিএ বাকি রয়েছে, পূর্ববর্তী কমিশনের বকেয়া ডিএ, যা দেওয়া নিয়ে হাইকোর্টের রায় রয়েছে, তার কথা তো বলাই বাহুল্য। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা বৃদ্ধি অতি সাধারণ নিয়ম, সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে তা নিয়ম মাফিক হয়ে থাকে। কিন্তু রাজ্য সরকারের আর্থিক অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে সরকারি কর্মচারীদের ডিএ বৃদ্ধি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের ডিএ বৃদ্ধি না করার পাশাপাশি প্রকারান্তরে কর্মী সঙ্কোচন করে চলেছে। যদিও সরকারি স্তরে কর্মী সংখ্যা, ফাঁকা পদের সংখ্যা, অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ এসব নিয়ে কোনো শ্বেতপত্রই প্রকাশিত হয়না, কেন্দ্র, রাজ্য বা কোনো রাজ্যেই হয়না, তবুও যা জানা বোঝা যায় তাতে এরাজ্যে প্রায় চার লক্ষ খালি পদ রয়েছে। প্রায় দু’লক্ষ অস্থায়ী কর্মী নিযুক্ত রয়েছে বিভিন্ন পদে। ফলে কর্মী বেতনের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার বেশ কিছু সাশ্রয় করছে। কেবল তাই নয়, ষষ্ঠ বেতন কমিশনের বেতন বৃদ্ধির সুপারিশের ক্ষেত্রেও কোনো প্রকার বকেয়া বেতন প্রদান না করে পূর্বতন সরকারের তুলনায় কর্মীদের বেতন খাতে বৃহৎ পরিমাণ মুনাফা করেছে এই সরকার। তদর্থে রাজ্য সরকারী কর্মীদের প্রতি বঞ্চনা মোটামুটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। আদতে মনে হয় যে সরকার নিজ কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি দাওয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল তো নয়ই, বরং নিস্পৃহ।
অপরদিকে বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে হিমালয়সদৃশ দুর্নীতি করা হয়েছে। ফলে বিদ্যালয়স্তরে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটিই বানচাল হয়ে যেতে বসেছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির তল খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এরাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতি শাসক দলের দুর্নীতির প্রকৃত সূচক হয়ে উঠেছে। স্কুল সার্ভিস কমিশনের বা প্রাথমিক পর্ষদের নিয়োগ পরীক্ষা বা টেট ও সামগ্রিক প্রক্রিয়াটি যেভাবে চালানো হয়েছে টাকাকড়ির লেনদেনের মাধ্যমে তা অভাবনীয়। শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগের জন্য আবশ্যিক বিএড বা ডিএলএড পাঠক্রমকে বেসরকারী উদ্যোগের হাতে ছেড়ে দিয়ে শিক্ষা ব্যবসায়ীদের মুনাফা করতে দেওয়া হয়েছে, অপরদিকে ওই সব বেসরকারী বিএড বা ডিএলএড প্রতিষ্ঠানগুলির অনুমোদন থেকে শুরু করে পরীক্ষা পর্যন্ত উৎকোচ বা ঘুষ চালু হয়েছে, এবং ওই প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমেও নিয়োগের আশ্বাস দিয়ে প্রভূত পরিমাণ অর্থ লেনদেন হয়েছে।
পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারকে তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত সরকার দুর্নীতির মাঠে কয়েক ডজন গোলে পরাস্ত করবে। এরাজ্যে বা দেশে দুর্নীতির সঙ্গে আমাদের ওঠাবসা চিরন্তন। কিন্তু বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলে সমস্ত স্তরে সমস্ত কাজে দুর্নীতি যেভাবে ডালপালা মেলেছে তা সমস্ত হিসেবকে নস্যাত করে ছাড়ছে। আবাস যোজনায় নিজ ব্যাঙ্কে টাকা ঢুকলেও প্রাপককে শাসক দলের নেতাকে সেই টাকার ভাগ দিতে হচ্ছে। ঝড়ে বাড়িঘর লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার পরেও রিলিফের টাকা বা ত্রিপল ক্ষতিগ্রস্থের বদলে শাসক দলের নেতার তহবিল ভারি করেছে। ১০০ দিনের কাজের বন্টন থেকে শুরু করে টাকার বন্টন পর্যন্ত ওই নেতাদের ঘুষ পাওয়া অধিকারে পর্যবসিত হয়েছে। গরু পাচার, কয়লা পাচার, সারদা, নারদার মত বৃহৎ কেলেঙ্কারীর কথা তো সর্বজনবিদিত। ফলে শাসক দলের স্থানীয় নেতৃত্বে রয়েছে এমন কেউ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নেই তা কল্পনা করতেও কষ্ট হচ্ছে। আর উপরের স্তরের নেতা মন্ত্রীদের জীবনযাত্রা ও দুর্নীতিবাজ স্থানীয় নেতাদের প্রশ্রয় দান জানিয়ে দিচ্ছে যে তারাও কতটা ‘সৎ’। দলের সভানেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী অবলীলাক্রমে বলছেন যে, যদি কেউ টাকা নিয়ে থাকেন তাহলে ফেরত দিয়ে মাফ চেয়ে নিন। অর্থাৎ, চুরি করে বা ঘুষ খেয়ে সেই অন্যায় ও বেআইনী ভাবে পাওয়া অর্থ ফেরত দিলেই পাপস্খালন হয়ে যাবে, ঘুষ খাওয়া বা চুরি করা তেমন কোনো পাপ নয় যে তারজন্য শাস্তি পেতে হবে। তৃণমূল কংগ্রেস দুর্নীতির সংজ্ঞাকেই পাল্টে দিতে চাইছে।
এরকম এক ‘পরিবর্তনের’ সরকার যে পরিসংখ্যানগুলিকে পছন্দমত পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে বাজারে ছাড়বে তা বলাই বাহুল্য। এতদসত্ত্বেও সরকারী পরিসংখ্যানকে ধরেই পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা ছাড়া উপায় থাকেনা। পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রায়শই রাজ্যের মোট আভ্যন্তরীণ উৎপন্নের বৃদ্ধির হারকে নিয়ে গর্ব করে থাকে। কিন্তু তেমন গর্ব করার কিছু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। ২০১৫-১৬ সাল থেকে ২০১৯-২০ সাল, এই ৪ বছরে রাজ্যের মোট আভ্যন্তরীণ উৎপন্ন ৬.৫ শতাংশ হারে বেড়েছিল, দেশের ক্ষেত্রে সেই হার ছিল সামান্য কম, ৬.৩ শতাংশ। কিন্তু পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের আমলের শেষের দিকের বছরগুলির সঙ্গে যদি তৃণমূল শাসনের প্রথম ৯ বছর তুলনা করা যায় তাহলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এরাজ্য যে পিছিয়ে পড়ছে তা সহজেই বোধগম্য হয়। ২০০৪-০৫ থেকে ২০১০-১১ পর্যন্ত বামফ্রন্টের শেষ ৬ বছরে ওই বৃদ্ধির হার ছিল বার্ষিক ৬.৮ শতাংশ; বর্তমান সরকারের প্রথম ৯ বছরে তা বার্ষিক ৫.২ শতাংশ। [বামফ্রন্টের শেষ ৬ বছরের তথ্য সহজে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাচ্ছে ও তাকে ২০১১-১২ সালের মূল্যে পরিণত করা যাচ্ছে বলে ওই ৬ বছরকে বিশ্লেষণের জন্য নেওয়া হয়েছে; তৃণমূল শাসনের ক্ষেত্রে ২০১৯-২০ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে কারণ পরবর্তী সময়ে কোভিডের প্রভাব পড়েছে, ফলে সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি অনেক কমেছে।] তবে বিজেপির এক্ষেত্রে কাজকর্ম আরো ভয়ানক। ত্রিপুরায় বাম সরকার শেষ দু’বছরে বৃদ্ধির হারকে বার্ষিক ১১.১ শতাংশে নিয়ে গিয়েও ২০১৮ সালের নির্বাচনে সরকার বাঁচাতে ব্যর্থ হয়; ওদিকে দ্রুততর বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসা বিজেপি সরকার তাদের প্রথম দু’বছরে বৃদ্ধির হারকে ৭.২ শতাংশে নামিয়ে নিয়ে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে বাম সরকারের শেষ ৬ বছরে মাথাপিছু আয় বাড়ছিল ৫.৫ শতাংশ হারে, তৃণমূল সরকারের প্রথম ৯ বছরে তা কমে গড় বার্ষিক ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রেও ত্রিপুরায় বাম আমলে মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধির হার ছিল ১০.৩ শতাংশের উপরে, বিজেপি আমলে সেটি ৫.৮ শতাংশে নেমে এসেছে।
জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার পঞ্চম দফায় (২০১৯-২১) দেখা গেছে এরাজ্যে ৬ মাস থেকে ৫৯ মাস পর্যন্ত বয়সের শিশুদের ৬৯ শতাংশ রক্তাল্পতায় ভুগছে, আগের দফার (২০১৫-১৬) সমীক্ষায় তা ছিল ৫৪ শতাংশ। ওই দুই দফার সমীক্ষায় গর্ভবতী মায়েদের মধ্যেও ৬২ শতাংশ (২০১৯-২১) রক্তাল্পতায় ভুগছিল, যা তার আগের দফায় (২০১৫-১৬) ছিল ৫৪ শতাংশ। ২০২১ সালে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১৫৩৩টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ৫৫৮টি চিকিৎসকের পদ খালি রয়েছে। মাতৃত্বকালীন মৃত্যুর নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ সারা ভারতের থেকে পিছিয়ে পড়েছে। ২০১৭-১৯ সালের হিসেব অনুযায়ী প্রতি লক্ষ শিশু জন্মপিছু ১০৯ জন মায়ের মৃত্যু হয়েছে, ২০১৪-১৬ সালের ১০১ থেকে বেড়ে। অপরদিকে ওই সময়কালে সারা ভারতে তা ১৩০ থেকে কমে ১০৩ হয়েছে। বেকারত্বের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা ভারতীয় গড়ের তুলনায় ভালো অবস্থানে রয়েছে। গ্রামীণ সামগ্রিক বেকারির হার দেশে ৩.৩ শতাংশ, এরাজ্যে তা ৩.২ শতাংশ; শহুরে সামগ্রিক বেকারির হার এরাজ্যে ৪.৪ শতাংশ, সারা দেশে ৬.৭ শতাংশ (সূত্র: রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রকাশিত সংকলন)
সুদের পরিমাণ ২০১০-১১ সালে ১৪ হাজার কোটি টাকা থেকে ২০২০-২১ সালে ১৪০ শতাংশ বেড়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। অনুরূপ সময়ে সমস্ত রাজ্যের ক্ষেত্রে সুদের পরিমাণ ১২৮ হাজার কোটি টাকা থেকে ২১০ শতাংশ বেড়েছে, পৌঁছেছে ৩৯৩ হাজার কোটি টাকায়। সামগ্রিক ঋণের পরিমাণ ১৯২ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৫৬৩ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, সমস্ত রাজ্যকে ধরলে ওই সময়কালে ওই ঋণের পরিমাণ ১৮৯৪ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৬৯৪৭ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ এই রাজ্যের সামগ্রিক ঋণ বেড়েছে ১৯৪ শতাংশ, দেশের সমস্ত রাজ্যের ক্ষেত্রে তা ২৬৭ শতাংশ। ফলে ঋণের বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ দেশের অন্য রাজ্যের থেকে দ্রুততর গতিতে এগিয়েছে তা বলা যাবেনা।
২০১০-১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব কর আদায় ছিল ২১ হাজার কোটি টাকা, দেশের সমস্ত রাজ্যের সামগ্রিক পরিমাণ ছিল ৪৭৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে তা বেড়ে যথাক্রমে ৬০ হাজার ও ১২৪১ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। ফলে ওই দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব কর রাজস্ব আদায় বেড়েছে ১৮৬ শতাংশ, সমস্ত ভারতের রাজ্যসমূহের বেড়েছে ১৫৯ শতাংশ। এক্ষেত্রেও ‘এগিয়ে বাংলা’। এরাজ্যের প্রাথমিক ঘাটতি ২০১০-১১ সালে ছিল ৫৭১৮ কোটি টাকা, সব রাজ্য মিলিয়ে তা ছিল ৩৩,৭০৯ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তা ৩ গুণের কিছু বেশি বেড়ে হয়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা; ভারতের সমস্ত রাজ্যগুলির অনুরূপ ঘাটতি প্রায় ১৬ গুণ বেড়ে হয়েছে ৫৩৮ হাজার কোটি টাকা। ফলে পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক ঘাটতিকে রাজ্যের আর্থিক দুরবস্থার জন্য দায়ী করা যায়না। ২০১০-১১ সালে এরাজ্যের রাজস্ব ঘাটতি ছিল ১৭ হাজার কোটি টাকা, ২০২০-২১ সালে তা বেড়ে দ্বিগুণ (৩৪ হাজার কোটি টাকা) হয়েছে। সমস্ত রাজ্যের মিলিত রাজস্ব উদ্বৃত্ত ছিল ২০১০-১১ সালে ১৩ হাজার কোটি টাকার, ২০২০-২১ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৩৯৫ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং রাজস্ব ঘাটতির বৃদ্ধির নিরিখেও এরাজ্যের সরকার তুলনামূলক শ্লথ গতিতেই এগোচ্ছে। রাজকোষ ঘাটতি ২০১০-১১ সালে ১৮ হাজার কোটি টাকা থেকে ১৯০ শতাংশ বেড়ে ২০২০-২১ সালে ৫২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। সারা দেশের সমস্ত রাজ্যগুলির মিলিত রাজকোষ ঘাটতি অনুরূপ সময়ে ১৬১ হাজার কোটি টাকা থেকে ৪৮০ শতাংশ বেড়ে ৯৩২ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এক্ষেত্রেও এরাজ্য ভারতের সমস্ত রাজ্যের সামগ্রিক ঘাটতির তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানেই আছে।
২০১০-১১ সালে সামাজিক ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের ব্যয় ছিল ৩১ হাজার কোটি টাকা, ২০২০-২১ সালে তা ৩.৬ গুণ হয়ে পৌঁছেছে ১১২ হাজার কোটি টাকায়, ২০২১-২২ সালের বাজেট ধরলে তা পৌঁছেছে ১৪২ হাজার কোটি টাকায়, অর্থাৎ ২০১০-১১ সালের ব্যয়ের তুলনায় ৪.৬ গুণ, ২০২০-২১ সালের তুলনায় ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি। দেশের সমস্ত রাজ্যের সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়ের সাথে তুলনা করা যাক। ২০১০-১১ সালে তা ছিল ৪৬৪ হাজার কোটি টাকা, ২০২০-২১এ তা ৩.৭ গুণ বেড়ে পৌঁছায় ১৭০৬ হাজার কোটি টাকায়। ২০২১-২২’র বাজেট বরাদ্দ ধরলে তা ৪.২ গুণ হয়েছে, ১৯৪৬ হাজার কোটি টাকা। ফলে সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয় বরাদ্দের বিষয়ে এরাজ্য খুব আহামরি কিছু করছে তা বলা যায় না।
উপরোক্ত আর্থিক পরিসংখ্যানকে যাচাই করার জন্য কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) রাজ্যের আর্থিক অডিটের (২০১৯-২০) দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। সিএজি রাজ্যের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য এবং আর্থিক হিসেব নিকেশ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। ওই রিপোর্ট অনুসারে ২০১৯-২০ সালের রাজস্ব খাতে আয় আগের বছরের তুলনায় ২.১ শতাংশ কমেছে। রাজ্য সরকার সম্পদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ব্যয় কমিয়েছে ৩২.৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ মূলধনী ব্যয় কমেছে, তা কমেছে মূলতঃ গ্রামোন্নয়নে, রাস্তা ও সেতু নির্মাণে, চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যে। সিএজি’র রিপোর্ট অনুসারে আগের অনুচ্ছেদগুলিতে দেওয়া ঘাটতির তথ্যগুলিতে জল মেশানো রয়েছে। রাজস্ব ঘাটতি, প্রাথমিক ঘাটতি ও রাজকোষ ঘাটতির পরিসংখ্যানে কারচুপি করা হয়েছে। ফলে রাজ্য সরকারের তথ্য সঙ্কলিত করে (যা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সংকলনে করা হয়েছে) রাজ্যের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অনুধাবন সমস্যাসঙ্কুল।
অর্থনৈতিক খুঁটিনাটি নিয়ে বিশ্লেষণ অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা করলেও সাধারণ মানুষ তাদের জীবনের অভিজ্ঞতায় সরকারের কাজকর্মকে বুঝতে চেষ্টা করেন। এরাজ্যে লক্ষ্মী ভান্ডার, কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথীর মত সামাজিক সুবিধা প্রদানের প্রকল্পগুলি থেকে সাধারণ মানুষ যেমন উপকৃত হচ্ছেন, তেমনি রাজ্যজুড়ে দুর্নীতি, টাকা লুঠ, কাটমানির দৌরাত্ম্য তাঁরা প্রত্যক্ষ করছেন। সেগুলির বিরোধিতা করতে গেলেই অত্যাচার নামিয়ে আনছেন শাসক দলের নেতারা, পুলিশ অত্যাচারীদেরই সাথ দিচ্ছেন। সর্বব্যাপী ঔদ্ধত্য ও সরকারী বরাদ্দের লুঠপাট নিয়েই চলছে রাজ্য শাসন। সেই ফাঁক দিয়ে শাসন ক্ষমতায় আসতে চাইছে বিজেপি, যাদের অত্যাচার, ঔদ্ধত্য, দুর্নীতি ও গণতন্ত্রহীনতা বর্তমান শাসকদের তুলনায় শতগুণ বেশি। তাদের গতিপথ উগ্র দক্ষিণমুখী, জনবিরোধী। ফলে একমাত্র বামপন্থী উত্থানই বিকল্প হতে পারে বর্তমান শাসকের দুর্নীতি রাহাজানির বিরুদ্ধে।