লুই আলথুজার : মার্কসীয় দার্শনিক ঐতিহ্যে এক অনুসন্ধানী

একালের দর্শনের ইতিহাস যারা লিখেন তাদের প্রায়শই বলতে শোনা যায় যে পৃথিবীতে দর্শন ও চিন্তা চর্চার ইতিহাস বিস্তৃত হলেও ইতিহাসের সকল পর্যায়ে এবং সকল প্রেক্ষাপটে দার্শনিক ও তত্ত্বচিন্তা চর্চার সংস্কৃতি সবসময় ছিলোনা। মোটাদাগে ইতিহাসের তিনটি উল্লেখযোগ্য যুগ অর্থাৎ কাল কে ইতিহাসবিদেরা দার্শনিক ও তত্ত্বচিন্তার চর্চার শ্রেষ্ঠ যুগ বলে অভিহিত করে থাকেন। প্রাচীন গ্রীস দেশে দর্শন ও তত্ত্ব চর্চার যুগ, আঠারো শতকের জার্মানী তে (তৎকালীন প্রাশিয়া) যাকে জার্মান ভাবাদর্শের যুগ বলে অভিহিত করেছিলেন ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস এবং বিশ শতকের গোড়া থেকে বিশ শতকের একদম শেষ পর্যন্ত প্রায় আট টি দশকে ফরাসি দেশের প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক দর্শন ও তত্ত্ব চিন্তার যুগ। ফরাসি দেশের ইতিহাস যারা পড়েন জানবেন যে বিশ শতকে বিশুদ্ধ তত্ত্ব ও দর্শন চর্চা উৎকর্ষতা লাভ করেছিলো ফরাসি দেশে। ফরাসি বিপ্লবের আগে এবং বিপ্লবোত্তর প্রায় শত বছর পর্যন্ত ফরাসি দেশে গভীর তত্ত্ব চর্চা ও দার্শনিক পটভূমি গড়ে উঠার নজির দেখা যায়নি, যতোটা দেখা গিয়েছিলো জার্মান দেশে এবং কিছুটা ইতালিতে। প্রাজ্ঞ ইতিহাসবিদেরা এই দর্শন চর্চা কে মহাদেশীয় দর্শন বলেও অভিহিত করেন (Continental Philosophy) যার শুরু টা হয়েছিলো প্রাশিয় ভূমি তে, শেষ না হলেও বলা যায় শেষ হয়েছে ফরাসি দেশের নান্দনিক প্যারিস নগরীতে।  দর্শনের ইতিহাস আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়, সেই ক্ষমতাও আমার নাই, প্রাজ্ঞজনেরা তা করবেন বলে আশা করি, আমার উদ্দেশ্য জ্ঞান ও তত্ত্বচর্চার একটি সোনালী ঐতিহ্য নিয়ে কিছু কথা বলা যার অন্যতম হোতা মহাত্মা লুই আলথুজার। পণ্ডিতরা বলেন মহাদেশীয় দর্শন মহাদেশীয় কারণ এর স্থায়ীত্ব এবং অবস্থান নির্দিষ্ট দেশে সীমাবদ্ধ থাকেনা, বরং জলতরঙ্গের মতো এর গতিশীলতা, চলে যায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে। জার্মান ভাষায় দর্শনের চর্চা যা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিলে দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের হাত ধরে সেই দার্শনিক ধারা সমাপ্তি ঘটেছিলো ডায়োনিসীয় পাদ্রী ফ্রিডরিখ নীটশের শেষ রক্তমাখা কালিতে। জার্মান দেশে দর্শন চর্চা, তত্ত্ব চর্চার একটা পরিসমাপ্তি ঘটলেও সেই ধারার  মর্ম (Spirit) পরবর্তীতে আশ্রয় নেয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, অস্থিতিশীল, অস্তিত্ব সংকটাপন্ন এক শত বছরের পুরোনো নগরীর আর্কেডে। সেই প্যারিসিয়ান আর্কেড যার চিত্তে আশ্রয় নিলো আধুনিক মিনার্ভার ধূসর পেঁচা, উত্থান ঘটলো শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্যের এক মহা আন্দোলন।  শিল্পের ইতিহাস যারা লিখেছেন তারা ত্রিশের দশকের প্যারিস কে হেগেলীয় রীতিতে ঘোষণা করেছেন শিল্পের চূড়ান্ত বিকশিত বাস্তবায়ন, যা চূড়ান্ত মানসিক বিকাশের সাথে সাথে সভ্যতার দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে নিজেকে স্থাপিত করেছে একটি চূড়ান্ত এবং অতি মাত্রায় সামষ্টিক বাসনা পূরণের প্রতিফলন হিসেবে। সকল উৎকৃষ্ট মহাদেশীয় তত্ত্ব চিন্তার পুনর্জাগরণ ঘটে প্যারিসে। ১৯৩০-১৯৫০ সালের মধ্যে প্যারিস হয়ে উঠে ইউরোপের সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর এবং ইউরোপীয় তত্ত্বচিন্তার এক ধরণের কেন্দ্র বিশেষ। কতিপয় বৌদ্ধিক ধারা তথা মনোবিশ্লেষণ (Psychoanalysis) , অভিজ্ঞাবিদ্যা (Phenomenology), মার্কসবাদ (Marxism), অস্তিত্ববাদ (Existentialism) এবং কাঠামোবাদ (Structuralism) , এসবের মূল মন্ত্রের উদ্ভব ফরাসি দেশের না হলেও, এই সবগুলো ধারার উৎকৃষ্ট বিকাশ ঘটেছিলো ফরাসি দেশে। এমনকি যেসকল মহাত্মাদের দ্বারা এর প্রাথমিক বিকাশ ঘটেছিলো তারাও ফরাসি দেশের ছিলেন না। ফ্রান্সে অভিজ্ঞাবিদ্যা (Phenomenology) জনপ্রিয় করেছিলেন আলেক্সান্ডার কোজেভ। বলা যায় ফ্রান্সে আধুনিক দর্শন, বিজ্ঞানের ইতিহাস, বিজ্ঞানের দর্শন, ধর্মতত্ত্বের ইতিহাস এ সকল বিষয়ের অধ্যয়নের যে সংস্কৃতি, তার  আগমন ঘটেছে আলেক্সান্ডার কোজেভ এবং আলেক্সান্ডার কোয়েরের হাত ধরে, যারা উভয়ই ফরাসি ছিলেন না। ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত হেগেলের উপর প্রদত্ত কোজেভের লেকচার ফ্রান্সের উঠতি প্রত্যেকটি চিন্তাবিদ ও তাত্ত্বিকের মন কেড়েছিলো এবং প্রভাবিত করেছিলো৷ জ্য পল সার্ত্রে, জ্যাঁক লাকাঁ, সিমন দ্য বুভ্যোয়া, জর্জ বাতাই, মরিস ব্লাশো, সিমন ওয়েইল, আলবেয়ার কাম্যু, মার্লো পন্তি, মিশেল ফুকো থেকে শুরু করে সকলেই উক্ত সেমিনারে অংশ নিতেন বলে জানা যায়। ফরাসি দেশের তত্ত্ব চিন্তা ও দর্শন চর্চা সংস্কৃতি বিকাশের ঐতিহাসিক কারণ গুলো কি সেটা অনুসন্ধান করলে অনেক কারণ বের হয়ে আসবে কিন্তু কোজেভ ও কোয়েরের যে বিশেষ অবদান এক্ষেত্রে অন্যতম মূল কারণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য।  জ্যাঁক লাকাঁর হাত ধরে ফ্রান্সে ফ্রয়েডের চর্চা, জ্য পল সার্ত্রে থেকে অস্তিত্ববাদ এবং কোজেভের সেমিনারে প্রতিফলন হিসেবে মরিস মার্লো পন্তিদের নতুন করে অভিজ্ঞাবিদ্যার উদ্ভব, পাশাপাশি জর্জ কাঙ্গিলহাম ও জ্য কাভাইয়ের বিজ্ঞানের ইতিহাস চর্চা যার শুরুটা আলেক্সান্ডার কোয়েরের বিজ্ঞানের ইতিহাস বিষয়ক সেমিনার থেকে। ইতোমধ্যে জ্যঁ হিপ্পোলিতের অনুবাদে হেগেল এবং তার উদ্যোগে প্যারিসে নতুন করে হেগেল চর্চার উদ্ভব  ফ্রান্সে আরো একটি দার্শনিক প্রজন্মের উত্থানের পেছন একটি বড় কারণ ছিলো। অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মে লুই আলথুজার, এতিয়েন বালিবার, জ্যাঁক দেরিদা, জ্যাঁক রেন্সেয়ার, জিল দ্যোলুজ, আলা বাদিয়্যু, জ্যাঁ লুক ন্যান্সি ইত্যাদি প্রমুখ। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন উঠে ফরাসি দেশে মার্ক্সবাদের উদ্ভব কি করে এবং সেটার চর্চা কি বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে নাকি রাজনৈতিক ভাবে হয়েছে? ১৯১৪ সালের দিকে জ্যাঁ জুরে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা করেন, বলা যায় ফরাসি দেশে প্রাতিষ্ঠানিক বামপন্থী রাজনীতির সূচনা,  যদিও পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বড় গণমানুষের আন্দোলন হয়েছেই ফরাসি দেশে এমনকি সমাজতন্ত্রের ধারণা, মতাদর্শ এবং মর্মবাণী যা মার্ক্স পেয়েছিলো ফরাসি সমাজতন্ত্রী দের কাছে থেকে, তাদের লেখা পাঠ করেই। একটি বিপ্লবী ইতিহাস বহনকারী দেশ, যেখানে সমাজতন্ত্রের রূপকথা রচিত হয়েছিলো শত শত বছর আগেই সেখানেই কেনো মার্ক্সবাদের মতো একটি সর্বজনীন চিন্তাধারার বিকাশ এতো দেরিতে হলো? কেনো অন্যান্য দেশেের মতো ফরাসি দেশে মার্ক্সবাদী বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় এতো দূরত্ব, এতোটা শূন্যতা? কেনো রাশিয়া, ইতালি, চীনের মতো ফরাসি দেশে তার নিজস্ব প্রেক্ষাপট, সংস্কৃতি, রীতি ও নিজস্ব জাতীয় ধারায় মার্ক্সবাদের বিকাশ ঘটলোনা? এই প্রশ্ন গুলো ছিলো বিশ শতকের ফরাসি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজন্মের দ্বিতীয় প্রজন্ম অর্থাৎ ষাটের দশকের ফ্রান্সের একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের, একজন রোগা, মানসিক ভাবে দুর্বিষহ, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন একজন অধ্যাপকের করা প্রশ্ন। অধ্যাপক মহাত্মা লুই আলথুজারের প্রাথমিক অনুসন্ধানের বিষয় ছিলো এটাই এবং যেহেতু উক্ত প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক উত্তর উনি পাননি, সুতরাং নিজেই উদ্যোগ নিলেন সেই সকল ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক শূন্যতা পূরণ করার। ১৯১৮ সালের ১৬ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন আলজেরিয়াতে (আলজেরিয়া তখন ফরাসি দেশের উপনিবেশ এবং তার আলথুজারের বাবা চার্লস আলথুজার ছিলেন একজন সামরিক কর্তা) মার্সেই ও লিওনে প্রাথমিক শিক্ষা ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের পর ফ্রান্সের বিখ্যাত একোলে নরম্যাল সুঁপিরিয়েরে পড়তে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে নাৎসী আক্রমণের প্রভাবে প্রায় পাঁচবছর নাৎসী বন্দীশিবিরে তাকে থাকতে হয়। বিশ্বযুদ্ধের পর উক্ত প্রতিষ্ঠানে হেগেলের উপর ডক্টরেট থিসিস লিখে শিক্ষকতায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ পান, কিন্তু ঠিক সেই সময় থেকেই বিভিন্ন মানসিক রোগে তিনি আক্রান্ত হোন।  আলথুজারের প্রায় অর্ধেক জীবন কেটেছে মানসিক হাসপাতালে এবং মানসিক চিকিৎসার অধীনে।  কিন্তু তারপরও তত্ত্বচর্চায় তিনি থেমে থাকেননি৷ ১৯৪৮ সালে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টি (PCF) তে যোগদান করেন। ফরাসি দেশে তখন বামপন্থী অর্থাৎ কমিউনিজম একটি জনপ্রিয় সংস্কৃতি তে পরিণত হয়েছিলো, ফরাসি দেশের সেই সময়কার খুবই অল্প শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন যারা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেননি, যদিও প্রায় সকলেই পরবর্তী তে কোনো না কোন সময় কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করেন, তারমধ্যে কেউ কেউ পরবর্তী তে মার্ক্সবিরোধী হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন।  আলথুজার এই রীতির ব্যতিক্রম ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার পর প্রায় দশ বছরের মাথায় অর্থাৎ মার্ক্সের ক্যাপিটাল বই লেখার প্রায় ৯০ বছরের মাথায়, আলথুজার মার্কসবাদ এবং কমিউনিজমের সম্পূর্ণ ইতিহাস উপলব্ধি করতে থাকেন। ইতিহাস সম্বন্ধে কমিউনিস্ট দের লুকোচুরি, সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি পুলিশি-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া, ইউরোপীয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর ঐ রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে থাকা, মার্কসীয় রাজনৈতিক ও তাত্ত্বিক বিতর্কগুলোর পরিসমাপ্তি ঘটা, ঠান্ডা যুদ্ধের উদ্ভব, এই সকল বিষয় গুলো আলথুজারকে প্রভাবিত করেছিলেন কিছু মৌলিক সিদ্ধান্তে পৌছানোর ক্ষেত্রে এবং যেখান থেকেই তার মার্ক্সবাদ কে দেখার নতুন প্রস্তাবনা গুলো তিনি হাজির করেন। আলথুজার প্রথাগত মার্ক্সবাদী ছিলেন না এমনকি ফরাসি দেশের যে জনপ্রিয় রীতি চলছিলো মার্ক্সবাদ ও কমিউনিজম সম্বন্ধে সেই ধারায় ও আগ্রহী ছিলেন না। তার মতে ফ্রান্সের অধিকাংশ মার্ক্সবাদী বুদ্ধিজীবি ও কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়া শিল্পীরা নেহাৎ ফ্যাশন ও জনপ্রিয় হওয়ার উদ্দেশ্যে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছে এবং যার ফলাফল একজনও পার্টিতে থাকেননি, যদিও এর পেছনে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির ও দোষ ছিলো, কারণ বেশ কিছু গভীর দার্শনিক ও চিন্তাশীল লোকেরাও ঐ পার্টি ত্যাগ করেছিলোন যাদের মধ্যে জ্যঁ পল সার্ত্রে, ফ্রাসোয়া ফুউরে্হ, মিশেল ফুকোরা ছিলেন। আলথুজার পার্টি ত্যাগ করেননি কিন্তু পার্টির সাথে তার ভয়ংকর বোঝাপড়া ছিলো এবং প্রায় সবসময় তিনি ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সীমাবদ্ধতা, ব্যর্থতা, অক্ষমতা ও অজ্ঞতা নিয়ে পার্টিকে আক্রমণ করতেন, কিন্তু তারপরও তিনি ঐ পার্টি ত্যাগ করেননি। কেনো তিনি পার্টি ত্যাগ করেননি তার কারণ তিনি তা কোথাও সরাসরি উল্লেখ করেননি, কিন্তু তার তত্ত্ব চর্চা, দর্শন এবং আলোচনা পড়লে সেই প্রশ্নের উত্তর কিছুটা পাওয়া যায়। দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে দর্শনের ইতিহাস বিষয়ক তত্ত্ব তার মূল আগ্রহের বিষয় ছিলো মার্ক্সবাদের সাথে অঙ্গাঅঙ্গী ভাবে জড়িয়ে যাবার আগ পর্যন্ত। ম্যাকিয়াভেল্লি, স্পিনোজা, রুশো, মন্তেস্কু, হেগেলে, এ সমস্ত দার্শনিক দের উপর তার প্রবন্ধ গুলো দেখলে বোঝা যায় যে আলথুজার দর্শন বলতে ঠিক গতানুগতিক জ্ঞান অনুসন্ধান কিংবা অস্তিত্বগত চিন্তা, অধিবিদ্যা তা বুঝতেন না বরং তার কাছে দর্শনের সংজ্ঞা ভিন্ন। মার্ক্সবাদ আত্মস্থ করার মধ্যে দিয়ে আলথুজার দর্শনের অর্থ ও এর ধরণ, বিজ্ঞান ও রাজনীতির সাথে এর সম্পর্ক এবং এর ফলশ্রুতিতে সামাজিক সম্পর্ক, এসমস্ত বিষয় গুলোর নতুন অর্থ হাজির করেন। আলথুজার শুরু করেন মূলত দর্শনের ইতিহাস ও বিজ্ঞানরে ইতিহাস থেকে, যেখানে তার মতে প্রতিটি যুগের দর্শন চর্চার পাটাতন হিসেবে সেই যুগের বৈজ্ঞানিক চর্চা উপস্থিত ছিলো। তার মতে দার্শনিক ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, তত্ত্ব এবং মতাদর্শ এগুলো একটি নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক কাঠামো অর্থাৎ যুগকাঠামোর মাঝে সীমাবদ্ধ এবং নির্ধারিত। 

প্রত্যেক যুগের দর্শন ও দার্শনিক চিন্তাভাবনার এক ধরণের যৌক্তিক এবং বৈজ্ঞানিক সনদের প্রয়োজন হয়, যেই সনদ টা সে পেয়ে থাকে ঐ নির্দিষ্ট যুগের বৈজ্ঞানিক এবং গাণিতিক (Framework) কাঠামো থেকে। এক্ষেত্রে আলথুজার গ্রীক দর্শনের পাটাতন হিসেবে গ্রীক গণিত অর্থাৎ জ্যামিতির কথা বলছেন, একই ভাবে তার মতে গ্যালিলিওর পরীক্ষিত পদার্থবিজ্ঞান ই দেকার্ত, স্পিনোজা প্রমুখ চিন্তাবিদদের চিন্তা কে যুক্তিগ্রাহ্য (validate) করে, অর্থাৎ সনদ দিয়েছিলো। অর্থাৎ এখানে আলথুজার দার্শনিক চিন্তাধারা বিবর্তনের সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার বিবর্তনের ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছেন। বিজ্ঞানের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে আলথুজার মনে করেন যে বিজ্ঞানের বিবর্তনের ইতিহাসে একেক সময় একেকটি জ্ঞান তাত্ত্বিক বিচ্ছেদ (Epistemological Break) ঘটেছে এবং ঐ বিচ্ছেদের গোড়াটা এমন কিছু দিয়ে তৈরি যা সম্পূর্ণই নতুন এবং পূর্ববর্তী জ্ঞান (epistem) এর সাথে যার কিছুতেই যোগসাজশ হচ্ছেনা, যার ফলে উক্ত বিচ্ছেদ (break) কে একটি নতুন যুগ-সন্ধিক্ষণ  (conjuncture) হিসেবে দেখা যায়। আলথুজারের মতে এরকম যুগ-সন্ধিক্ষণ ইতিহাসে কয়েকবার এসেছে, যেমন মধ্য যুগে গ্যালিলিও এর পরীক্ষিত পদার্থবিজ্ঞান এবং সতেরো শতকে আইজ্যাক নিউটন, উনিশ শতকের জীববিজ্ঞানী চালর্স ডারউইন, উনিশ শতকের শেষের দিককার মনস্তাত্ত্বিক সিগমুন্ড ফ্রয়েড। আলথুজারের মতে এরা সকলে বিজ্ঞানী নন কিন্তু সকলেই ঠিক ঐ অর্থে বিজ্ঞানী কারণ এদের আবিষ্কার ই এদের পরবর্তী যুগ ও পূর্ববর্তী যুগের মাঝে একটি বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে।  আলথুজারের মতে এই জ্ঞানতাত্ত্বিক জগতে এরকম বিচ্ছেদ বিপ্লব নির্মাতাদের মধ্যে মার্ক্স অন্যতম মূখ্য, এমনকি আধুনিক যুগে সবচেয়ে মূখ্য।  মার্ক্স একটি নতুন ইতিহাসবিজ্ঞানের জন্ম দিয়েছেন অর্থাৎ যাকে আলথুজার বলছেন science of history যা একেবারেই নতুন এবং যা দর্শনের জগতেও একদম অভিনব।

 

মার্ক্সের সকল রচনা,  ইউরোপের কমিউনিস্ট রাজনীতির ইতিহাস, সোভিয়েত বিপ্লব এবং এর পরিণতি, ইউরোপীয় ক্লাসিকাল মার্ক্সবাদী বুদ্ধিজীবি,  মার্ক্সের রচনার বিশ্লেষণ, মার্কসকে মানবতাবাদী হিসেবে হাজির করার চেষ্টা, অস্তিত্ববাদের সাথে মার্ক্সবাদের মেলবন্ধন, এসকল কিছুই আলথুজার কে একদমই সন্তুষ্ট তো করতে পারেই নি বরং আরো হতাশ করেছেন। আলথুজার সম্বন্ধে ফরাসি দার্শনিক আলা বাদিয়্যু লিখেছিলেন আলথুজার মার্ক্সবাদী তত্ত্বের যে ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, ভাষ্য এবং মার্ক্সের রচনা কে কেন্দ্র করে যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা গড়ে উঠেছিলো সেগুলো কে দুর্বল, অক্ষম, ব্যর্থ এবং অকার্যকর হিসেবে দেখেছেন। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির অসম্ভব নির্ভরশীলতা, অন্যদিকে মার্ক্স কে নিয়ে বিবিধ ফ্যাশন, স্টাইল এবং নানাবিধ মতাদর্শগত চিন্তার নির্মাণ আলথুজার কে চিন্তিত করেছিলো এবং ঠিক সেই জায়গা থেকেই মার্ক্সবাদের প্রতি তার ঐতিহাসিক কর্তব্য তিনি পালন করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। আলথুজার নিজেও বিবিধ জ্ঞানতাত্ত্বিক ও অন্যান্য দার্শনিক চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। জ্যাঁক লাকাঁর মনোবিশ্লেষণ এবং ফার্দিনান্দ সস্যুরের থেকে আগত কাঠামোবাদ যা ষাটের দশকের প্রায় সকল তপ্ত ফরাসি চিন্তাবিদদের নতুন নতুন চিন্তার চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ করে। আলথুজার ও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না, ফরাসি সংস্কৃতির বাহিরে তিনি নন, সেই চেষ্টাও করেননি, তাই তো তিনি খুজেছিলেন ফরাসি ঐতিহ্যের এক অভিনব মার্ক্সবাদ যা সমানতালে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক।  দর্শন কে আলথুজার তত্ত্বের জগতে শ্রেণীসংগ্রাম মনে করতেন।

 

যার কারণেই হয়তো আলথুজার শেষ পর্যন্ত ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করেননি। কারণ তার মতে দর্শন মাত্রই রাজনীতি, যেই মূহুর্তে দার্শনিক দর্শন চর্চা করার পরিসর অনুসন্ধান করে ঠিক সেই মুহূর্তেই সে রাজনৈতিক হয়ে উঠে।  মার্ক্স এক নতুন ইতিহাস বিজ্ঞানের রচনা করেছেন এমনটা মনে করতেন আলথুজার, সুতরাং এই বিজ্ঞান কে বুঝতে হলে দরকার মার্ক্স কে আরো গভীর ভাবে মনযোগ দিয়ে পাঠ করা অর্থাৎ Symptomatic Reading, তার মতে মার্ক্স কোনো মানবতাবাদী ছিলেন না, বরং মার্ক্স ছিলেন একজন বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার চিন্তাবিদ যার হাত ধরে ইতিহাসে নতুন করে জ্ঞানতাত্ত্বিক বিচ্ছেদ হয়েছে এবং সৃষ্টি হয়েছে ইতিহাস কে বোঝার একট যুগান্তকারী বিদ্যা এবং এই বিদ্যা এক মাত্র হেগেলের প্রভাবমুক্ত মার্ক্সের দ্বারা হয়েছে, অর্থাৎ এখানে আলথুজার "আদি মার্ক্স বনাম প্রবীন মার্ক্স" তর্কে শামিল হচ্ছেন। আলথুজারের মতে আদি মার্ক্স অথবা তরুণ মার্ক্স ছিলো একজন মতাদর্শিক ব্যক্তি যিনি মানবসমাজের তীব্র দ্বন্দ্বের ফলে আটকে থাকা প্রগতিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক ধরণের যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, অর্থাৎ মতাদর্শিক যুদ্ধ (Ideological war), যেই মার্ক্সের মাঝে অনুভূতি ও আবেগের প্রশ্রয় অতি মাত্রায় বেশি, যেই মার্ক্স তখনো পর্যন্ত কার্ল মার্ক্স হয়ে উঠেননি যিনি একটি নতুন ইতিহাসের বিজ্ঞানের সূচনা করেন (Historical materialism). আলথুজার গুরুত্ব দেন পরিণত মার্ক্সের উপর, অর্থাৎ যেই মার্ক্স ক্যাপিটাল লিখেছেন, যেই ক্যাপিটাল লেখার মাধ্যমে সে একটি ঐতিহাসিক জ্ঞানতাত্ত্বিক বিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন পূর্ববর্তী যুগের সাথে তার পরবর্তী যুগের, যেই মার্ক্স দর্শনকে অর্থাৎ জ্ঞানতত্ত্ব কে বিপ্লবী করেছেন, অর্থাৎ এমন এক সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি যেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গোটা মানবসভ্যতা কে দেখা যায় সবচেয়ে স্পষ্ট ভাবে।

 

আলথুজারের মতে মার্ক্স পরিণত মার্ক্স হয়ে উঠেছে যখন থেকে সে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সম্পর্ক ও সেই অনুসারে পুঁজির পুনরুৎপাদন বিষয়ে লেখালেখি শুরু করেন এবং  হেগেলীয় রহস্যবাদীতা থেকে সে মুক্ত হয়ে ইতিহাসকে বোঝার এক সর্বজনীন বিজ্ঞান রচনার কর্মে কর্মরত হয়েছেন তিনি যার সর্বোচ্চ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ফলাফল হলো ক্যাপিটাল বইটি। ঠিক এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ১৯৬১ সাল থেকে আলথুজার মার্ক্সের উপর একটি লেখাসংখ্যা বের করেন যার ভূমিকায় লিখেন "If one really wishes to grasp the dramatic genesis of Marx’s thought, it is necessary to renounce the spirit of Hegelian .analysis . . . and inquire into the sudden emergence of real history in ideology itself "

১৯৬৪ সালে Freud and Lacan নামে একটি বই লিখেন যেটা সেই সময়ে মার্ক্সবাদের সাথে মনোবিশ্লেষণের সম্বন্ধ কে নতুন করে দেখায়। "For Marx" নাম দিয়ে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সালে আলথুজারের বেশ কিছু প্রবন্ধ সহ একটি সংকলন বের হয়, যেখানে তিনি মার্ক্সের চিন্তার বিবর্তন, পরিবর্তন এবং সারবস্তু তুলে ধরেছেন, যা এখনো পর্যন্ত মার্ক্সীয় চিন্তা ধারার ঐতিহ্যে লেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখা গুলোর মধ্যে অন্যতম। "On young marx" এবং "Contradiction and Overdetermination" প্রবন্ধ দুটি সবচেয়ে বেশি সাড়া জাগিয়েছিলো। জ্যাঁক লাকার মতো আলথুজার সম্বোধন করলেন মার্ক্সে ফেরত যাওয়ার জন্য, অর্থাৎ মার্ক্সের একটি ভিন্ন, বিস্তৃত এবং গভীর বিশ্লেষণী পাঠ হাজির করলেন তিনি। তার মতে মার্ক্স কে বুঝতে হবে তার ক্যাপিটাল বইয়ে কাঠামোবাদী এবং যাকে বলে Symptomatic reading তার মধ্যে দিয়ে। লেনিনের উপর আলথুজারের অতিরিক্ত গুরুত্বারোপ দিয়েছিলেন কারণ তার মতে মার্ক্সবাদের সত্যিকার অর্থেই যদি কোনো রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবায়নে চেষ্টা হয়ে থাকে সেটা একমাত্র লেনিনই করতে পেরেছিলেন, কারণ লেনিন মার্ক্সকে একদম চূড়ান্ত আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে বুঝতে পেরেছিলেন এবং রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জায়গা থেকে লেনিন মার্ক্সবাদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন। আলথুজারের মতে একাডেমিক দর্শনে এমনকি ইউরোপীয় মার্ক্সবাদী দার্শনিক আলাপে "লেনিন" অনুপস্থিত, অথচ লেনিনের থেকে সবচেয়ে বেশি শেখার আছে। Contradiction and Overdetermination প্রবন্ধে আলথুজার প্রথাগত মার্ক্সবাদী তথা "অর্থনৈতিক নিয়তিবাদ" (Economic determinism) কে ভিন্ন ভাবে সমালোচনা করেছেন। নেহাৎ জ্যঁ পল সার্ত্রে কিংবা ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের মতো নয়, বরং বিশ শতকের নতুন কিছু অনস্বীকার্য মানবিক উপাদান কে হিসেব করেই তার ঐ সমালোচনা এবং সমালোচনার সাথে সাথে নতুন তত্ত্বের প্রস্তাবনা।  অর্থনৈতিক কাঠামোই একটি সমাজের সকল কিছু কে নির্ধারণ করে এই তত্ত্ব আলথুজার মানেননি, এমনকি মার্ক্স নিজেও এই বিষয়ে এতোটাও দৃঢ় ছিলোনা৷ ওয়াল্টার বেঞ্জামিন কিংনা আন্তনিও গ্রামসির মতো আলথুজার ও চেষ্টা করেছেন "সামাজিক সম্পর্ক" যা একটি পুঁজিবাদী সমাজের মূল চরিত্র, তাকে উপরিকাঠামো ও সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-আইনী প্রেক্ষাপট থেকে বিচার করা। মনোবিশ্লেষণ তত্ত্ব থেকে ধার করে তিনিও সমাজ কে ব্যক্তির দ্বন্দ্ব আকারে দেখার চেষ্টা করেছেন অর্থাৎ মনোবিশ্লেষণে ব্যক্তির অজ্ঞানের  (unconscious) প্রতিফলন হিসেবে প্রকাশিত হয় তার আলামত (symptom), অর্থাৎ বিবিধ আলামত, ঠিক একটি সমাজের দ্বন্দ্বের (contradiction) কারণ হিসেবে থাকে বিবিধ আলামত, যা কিনা অতি মাত্রায় বহু ধারায় নির্ধারণ করে সমাজের পরিবর্তন কিংবা সামাজিক দ্বন্দ্ব কে। আলথুজার রুশ বিপ্লব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে রাশিয়া পুঁজিতান্ত্রিক দেশ ছিলোনা সত্য কিন্তু সেটা পুরোপুরি সামন্ততান্ত্রিক দেশ ও ছিলোনা। তাছাড়া লেনিনের Capitalist development in Russia তে লেনিন রাশিয়ে কে the weakest chain of capitalism বলে অভিহিত করেছেন, অর্থাৎ আলথুজারের মতে একটি সমাজের সামাজিক সম্পর্ক শুধু মাত্রই অর্থনৈতিক অবস্থা দ্বারা নির্ধারিত হয়না, সেই সমাজে আরো কিছু নির্ধারক থাকে, রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র সেরকম একটি বড় নির্ধারক, যাকে লেনিন বোঝাপড়া করেছিলো তার নিজের মতো করে মার্ক্সীয় চিন্তার আদলে। আলথুজার লেনিন কে এতো গুরুত্ব দিয়েছিলেন কারণ লেনিন মার্ক্সবাদ কে কোনো মতাদর্শ (Ideology) আকারে গ্রহণ করেনি কিংবা কোনো সামাজিক মতবাদে (Social Dogma) পরিণত করেননি, যদি করতেন ই তাহলে মেনশেভিকদের মতো কিংবা সোসাল ডেমোক্রেট দের মতো বুর্জোয়া পার্লামেন্ট গঠন করার জন্য উঠে পড়ে লাগতেন আর যুক্তি দিতেন যে রাশিয়ার সমাজতন্ত্র সম্ভব না কারণ রাশিয়ার আগে গণতন্ত্র হবে তারপর সমাজতন্ত্র হবে "ঐতিহাসিক" ভাবে। এই "ঐতিহাসিকবাদ বা ইতিহাসবাদ" (Historicism) যার বিরুদ্ধে আলথুজার নিজেও তাত্ত্বিক লড়াই চালিয়েছেন। জাতিরাষ্ট্রের যুগে "রাষ্ট্র" মানবজীবনে একটি অনস্বীকার্য বিষয় আকারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অন্যভাবে লেনিনের চিন্তার জায়গা থেকে বলা যায় যে রাষ্ট্র মাত্রই একটি শ্রেণীভিত্তিক সমাজের সাংগঠনিক রূপ। আলথুজার 'রাষ্ট্র' কে দেখেছেন শ্রেণীসংগ্রাম ও শ্রেনী দ্বন্দের একটি নৈতিক এবং মতাদর্শিক আলামত হিসেবে যার কাজ হচ্ছে বিভিন্ন উপায়ে পুঁজির পুনরুৎপাদন ঘটাতে সহায়তা করা অর্থাৎ বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্ক কে নিয়মের মধ্যে দিয়ে স্থির রেখে, পুঁজির পুনরুৎপাদন করাই রাষ্ট্রের মূল কাজ, যেকারণে আলথুজার রাষ্ট্রকে বিমূর্ত উপাদান বলতে নারাজ বরং তার কাছে রাষ্ট্র একটি জটিল যন্ত্র, যার রয়েছে বিবিধ কলকব্জা। যন্ত্র কখনো নিজে পরিচালিত হতে পারেনা, এরজন্য দরকার হয় পরিচালক, আর পরিচালক মাত্রই পরিচালনের পরিকল্পনা ও নকশা৷ অর্থাৎ প্রতিটি রাষ্ট্রযন্ত্রের রয়েছে তার নিজস্ব মতাদর্শ (Ideology) যাকে আলথুজার বলেছেন "রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ"  (State Ideology) । ১৯৭০ সালে লেখা তার বিখ্যাত প্রবন্ধ "Ideology and the ideological state apparatus " প্রবন্ধ আলথুজার মূলত শুরু করেছেন মার্ক্সের মৌলিক চিন্তাধারা থেকে অর্থাৎ পুঁজি কি? পুঁজি হলো সামাজিক সম্পর্কের একটি মূর্ত রূপ, অর্থাৎ যেই রূপের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় সমাজের বিবিধ উৎপাদনমূলক প্রতিষ্ঠান এবং কর্পোরেশনে৷ কিন্তু পুঁজির মূল চরিত্রই হলো সমাজিক সম্পর্ক। এই সমাজিক সম্পর্কের পুনরুৎপাদন মানেই পুঁজির পুনরুৎপাদন। তাহলে প্রশ্ন উঠে যে একই সামাজিক সম্পর্ক প্রতিনিয়ত কিভাবে পুনরুৎপাদিত হয়? এখানে আলথুজারের মৌলিক তত্ত্বের দেখা মেলে অর্থাৎ মতাদর্শ (Ideology)।  আলথুজারের মতে মতাদর্শ হলো প্রতিটি সামাজিক সম্পর্কের কাল্পনিক প্রতিফলন যা বাস্তবতার ছদ্মবেশ মানষের অজ্ঞান এবং সজ্ঞানে বাস করে। একটি সমাজে দুটি কাঠামো মার্ক্স নির্দেশ করেছিলেন, সাধারণ আলাপে যাকে বলে কাঠামো (base) এবং উপরিকাঠামো (superstructure)। কাঠামো বলতে সমাজের অর্থনৈতিক সম্পর্ক , উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন ব্যবস্থার কথা বোঝায় এবং উপরিকাঠামো বলতে সমাজের নীতি, নৈতিকতা, রাজনীতি, বিজ্ঞান, বিভিন্ন মতবাদ ও বিমূর্ত চিন্তাকে বোঝায়। আলথুজারের মতে কাঠামো যে উপরিকাঠামো কে সবসময় নির্ধারণ করে এমন টা নয়, বরং উপরিকাঠামো ও অনেক সময় স্বতন্ত্র থাকে এবং কাঠামোকে নির্ধারণ করে৷ অর্থাৎ, সামাজিক সম্পর্ক যার একটি বড় ভিত্তি হলো উৎপাদনী শক্তি (Productive force)  এবং উৎপাদনের সম্পর্ক (Relations of the production) তা প্রভাবিত হয়, টিকে থাকে মূলত উপরিকাঠামোর কিছু উপাদানের দ্বারা, রাষ্ট্র হলো সেইরকম একটি উপাদান অর্থাৎ একটি যন্ত্র, একটি উপায়, একটি মূর্ত রূপ, যার মধ্যে দিয়ে সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি গুলো একটি নিয়মতান্ত্রিক ভাবে টিকে থাকে। রাষ্ট্র কে দুইটি উপাদানে ভাগ করেছেন আলথুজার, একটি হলো রাষ্ট্র ক্ষমতা (State Power) এবং আরেকটি হলো রাষ্ট্রের মতাদর্শ (State Ideology)

এই দুইয়ের মিশ্রণেই একটি রাষ্ট্র স্থায়ী হয় একটি যন্ত্র হিসেবে। রাষ্ট্রযন্ত্রের রয়েছে দুুইটি যান্ত্রিকতা, একটি হলো দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র (Repressive State Apparatus) এবং আরেকটি হলো মতাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র (Ideological State Apparatus)

মতাদর্শ (Ideology) আলথুজারের মতে কোনো মতবাদ, ধারণা কিংবা বিশ্বাসের মধ্যেই সীমিত নয়, মতাদর্শের একটা বিশাল মূর্ত রূপ অর্থাৎ বস্তুগত অস্তিত্ব আছে, যেটা ব্যক্তি বা সমাজের ব্যবহারিক ক্রিয়ার মধ্যে পাওয়া যায়। আলথুজার মতাদর্শ কে ফ্রয়েডের অজ্ঞান (unconscious)  এর সাথে তুলনা করেছেন।

 

আলথুজার মতাদর্শ (Ideology) কে একটি স্বতন্ত্র অধ্যয়নের বিষয় হিসেবে দাড় করাতে চেয়েছিলেন। তার মতে মতাদর্শ ইতিহাসের প্রতিটা পর্যায়ে প্রতিটা সমাজে ছিলো এবং আছে। মতাদর্শ ছাড়া কোনো শ্রেণীব্যবস্থা এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থা চলতে পারেনা। এজন্য আলথুজার মতাদর্শ কে একটি আলাদা জ্ঞান তত্ত্ব (Theory of knowledge) হিসেবে অধ্যয়ন করতে চেয়েছে। তার মতে মতাদর্শ বিষয় টি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের দৈনন্দিন কাজের সাথে অঙ্গাঅঙ্গী ভাবে জড়িত। আমরা যে সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে বাস করি, যে সামাজিক সম্পর্ক আমাদের উৎপাদনী শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ, সেই সামাজিক সম্পর্ক কে আমরা কাল্পনিক এবং ফ্যান্টাসির আদলে কল্পনা করি, বাস্তব অর্থে নয়৷ আলথুজারের মতে আমরা আমাদের সকল সামাজিক অস্তিত্ব এবং অর্থনৈতিক অস্তিত্ব, সবকিছুকেই একটি কাল্পনিক জায়গা থেকে চিন্তা করি এবং যার কারণে আমরা ঐ সকল বিষয়ের আসল উৎস এবং আসল কারণ বিশ্লেষণ করতে পারিনা। যেমন শ্রমিক তার মালিকের সাথে তার সম্পর্ক কে কাল্পনিক জায়গা থেকে চিন্তা করে, বস্তুবাদের জায়গা থেকে চিন্তা করে না। "একজন শ্রমিকের দায়িত্ব কর্তব্য এবং সততা যে সে ঠিকমতো কাজ করবে, কাজের বিনিময়ে অর্থ নিবে এবং কাজ শেষ হলে সে মালিক কে ভক্তি করবে" অর্থাৎ এই সামাজিক সম্পর্ক কে কতগুলো কল্পনা, গুণ, বিমূর্ত চিন্তা দিয়ে বিচার করা হয়। এরকম প্রতিটি সামাজিক সম্পর্ক পুনরুৎপাদিত হয় কাল্পনিক চিন্তা, ভাবনার আদলে। আলথুজারের যুক্তি হলে রাষ্ট্র এখানে সবচেয়ে মূখ্য কাজ টি করে, অর্থাৎ সে তার নিজস্ব কলকব্জা দিয়ে সকল ধরনের মতাদর্শ উৎপাদন করে এবং পুনরুৎপাদন করে। আলথুজার শ্রমবিভাজন (Division of labour)  কে আরো জটিল ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। যেমন সমাজের একটি মূখ্য নির্ধারক হচ্ছে "উৎপাদন ব্যবস্থার ধরন" (Mode of Production) যা দুইটি বিষয় তথা উৎপাদন শক্তি (productive force) এবং উৎপাদন সম্পর্ক (production relation) এর সম্মিলনে তৈরি হয়। উৎপাদন শক্তির মধ্যেই থাকে মূলত কারিগরি উৎপাদন শক্তি ও শ্রমবিভাজনের ধারণা, আর উৎপাদন সম্পর্কের মাঝে সেই শ্রমবিভাজন থেকে নির্গত শ্রেণী মতাদর্শ, অর্থাৎ শ্রমিক তার উপরে সুপারভাইজার তার উপরে ব্যবস্থাপক তার উপরে মহাব্যবস্থাপক এরকম কতগুলো ধাপ। এই সকলের স্বীকৃতি এবং মূল্য এক রকম না। শোষণ এবং শোষিতের সম্পর্ক কে আড়াল রাখার জন্য সমাজে এতো এতো শ্রমবিভাজন এবং সেই শ্রমবিভাজন দ্বারা সামাজিক সম্মান ও সামাজিক সম্পর্কের মূল্য নির্ধারিত হয়। এখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে রাষ্ট্র তার মতাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র (Ideological state Apparatus) দ্বারা। সমাজের বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্ক যা সামাজিক সম্পর্কের চাদরে ঢাকা থাকে তাকে স্থির রাখার জন্য রাষ্ট্র তার মতাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা বিভিন্ন মতাদর্শ উৎপাদন করে এবং সেগুলো সমাজে তার বিভিন্ন প্রতিনিধিত্ব মূলক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেগুলো প্রচার করে। অর্থাৎ আলথুজারের মতে বাজার কেন্দ্রিক একটা সমাজে রাষ্ট্রের কাজ খুবই কম এ কথা ভুল, বাজার এবং পুঁজিপতিরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে ঠিকই কিন্তু রাষ্ট্র তাদের একটি বড় সহায়ক হিসেবে কাজ করে৷ রাষ্ট্র ব্যস্ত থাকে সেই সকল পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তার নিজস্ব দুইটি রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে সমাজের বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্ক কে স্বাভাবিক করে রাখা এবং এটাকেই আদর্শ হিসেবে স্থির রাখা। আলথুজারের মতে রাষ্ট্রের কাজ মূলত এটাই, সে রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হোক কিংবা স্বৈরতান্ত্রিক, তাতে কিছু যায় আসেনা। স্কুল, কলেজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠন মূলতই রাষ্ট্রের মতাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র হিসেবে কাজ করে যাকে আলথুজার বলছেন মতাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র (Ideological state apparatus), আর এর পাশাপাশি রাষ্ট্রের আরো একটি বিশেষ কলকব্জা আছে, তা হলো দমন মূলক রাষ্ট্রযন্ত্র (repressive state apparatus), অর্থাৎ পুলিশ, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, বিভিন্ন শান্তিরক্ষা বাহিনী, সেনাবাহিনী, এসকল কিছু, অর্থাৎ শারীরিক উৎপীড়নের (physical violence) হাতিয়ার৷ কিন্তু মতাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র মূলত এক ধরণের মানসিক ক্রিয়ার মাধ্যমে চলে৷ আলথুজার রাজনীতি কে তথাকথিত মার্ক্সবাদী দের মতো সম্পূর্ণই উপরিকাঠামো তে ফেলতে নারাজ, বরং তিনি একজন গভীর রাজনৈতিক দর্শনের অনুরাগী ছিলেন। ইতিহাস থেকে সে বারংবার উদাহরণ দিয়েছেন ম্যাকিয়াভেলি, রুশো, মন্তেস্কু প্রমুখের। রাজনীতির অবশ্যই স্বতন্ত্রতা আছে এবং সেই স্বতন্ত্রের জায়গায় রাষ্ট্র তৈরি হয় জনগনের সম্মতির মধ্যে দিয়ে যার ফলে রাষ্ট্রের দ্বারা উৎপাদিত মতাদর্শ খুব সহজেই প্রভাবিত করে জনগণ কে।

 "the state is therefore, under the power of the state, 1) the Repressive State Apparatus, and 2) the Ideological State Apparatuses. The unity of the State Apparatus and the Ideological State Apparatuses is ensured by the class politics of those who hold state power, acting directly in the class struggle by means of the Repressive State Apparatus and indirectly by means ef the realization of the State Ideology in the Ideological State Apparatuses." ( Althusser, on the reproduction of capital) 

শ্রমিক শ্রেণীর মতাদর্শ আর বুদ্ধিজীবির মতাদর্শ কি এক? আলথুজারের মনে প্রশ্ন ছিলো সবসময়ই এই নিয়ে এবং লেনিনেরও এই নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন ছিলো, চিন্তা ছিলো৷ একজন বুদ্ধিজীবী সে একজন শ্রমিকের মতো একই মতাদর্শ পোষণ করতে পারে? একজন শ্রমিক, তার বস্তুগত অস্তিত্ব, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং তার শ্রেণীচেতনা তাকে বিপ্লবের তাগিদ দেয়, তাকে বিপ্লবী চেতনায় পর্যবসিত করতে পারে, কিন্তু একজন বুদ্ধিজীবি যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং বুদ্ধির চর্চা করেন শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষেই, তার পক্ষে কি ঐ শ্রমিক শ্রেণীর মতো হওয়া সম্ভব?  তার শ্রেণী চেতনা তো তাকে পেটি-বুর্জোয়া কিংবা যাকে বলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে প্রকাশ করে, এই প্রকাশের সাথে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রশ্নে শ্রমিকের সাথে তার মেলবন্ধন কি হয়? নাকি সে শ্রমিকের থেকে আলাদ ই থাকে? মার্ক্সীয় রাজনৈতিক দর্শনে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জটিল প্রশ্ন আর নাই এবং আলথুজারের মতে এই প্রশ্নের সমাধান তত্ত্বে পাওয়া যাবেনা, যাবে রাজনীতি তে, তাইন তিনি লেনিনের দর্শন ও রাজনৈতিক যে প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি সেই বিষয়ক লেখার আশ্রয় নিয়েছিলন।

 

বিশ শতকের ফরাসি দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক চর্চার যে তীব্র স্ফুরণ ঘটেছিলো সেই স্ফূরণের প্রভাব ফরাসি রাজনীতি, সামাজিক সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক পরিসর ও তত্ত্ব চর্চার কাঠামোতে পড়েছিলো প্রবলভাবে।  বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সাথে সমাজের জনমানসের আপোষহীন সম্পর্কের একটি উজ্জ্বল প্রমাণ ছিলো বিশ শতকের ফরাসি দর্শন ও ফরাসি চিন্তা।  ১৯৩০ থেকে মোটামুটি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ কয়েক দশকে ফরাসি দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপর ফরাসি বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতির প্রভাব ব্যাপক ভাবে দেখা যায়। বিশেষ করে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টি কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবিতা এবং উত্তরাধুনিকতাবাদ, উত্তর-কাঠামোবাদের উদ্ভব ও কমিউনিস্ট পার্টির বাহিরে যে বিশেষ করে মার্ক্সীয় বামপন্থী ধারায় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, তা গোটা ইউরোপীয় তত্ত্ব চর্চার ধারা কে বিকশিত করেছে। আলথুজারের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ও সেই ফরাসি সংস্কৃতির মধ্যে দিয়েই হয়েছিলো। প্যারিসের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় একোলে নরম্যাল সুপিরিয়র থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে সেখানকার শিক্ষতার পেশা থেকে একদম সর্বোচ্চ পদ অর্থাৎ গ্রান্ড ইকোলে (প্রধান শিক্ষক) পদে উন্নীত হয়েছিলেন। অথচ তার জীবনের প্রায় অর্ধেকের মতো সময় খণ্ড খণ্ড ভাবে কেটেছে প্যারিসের হাসপাতালে, ক্লিনিকে এবং মানসিক চিকিৎসকের অধীনে৷ শৈশবের কিছু ভয়ংকর স্মৃতি, কিছু শারীরিক সমস্যা, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের বাজে প্রভাব, বিশ্বযুদ্ধে নাৎসী ক্যাম্পে পাঁচ বছর বন্দী থাকা, পরিবারের থেকে বারংবার যন্ত্রণা পাওয়া, সবমিলিয়ে বিশ্বযুদ্ধের পর ভয়ংকর মানসিক অসুস্থতার মধ্যে পড়লেন।  তার আত্মজীবনী যেটা তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছিলো সেখানে সে লিখেছিলেন তার মানসিক পীড়ন, যন্ত্রণা এবং বিষণ্ণতার কথা এবং সেটা বারংবার তার জীবনে এসে হাজির হয়েছে। আরো লিখেছিলেন তার প্রিয় ভালোবাসার মানুষ হেলেনের কথা, যাকে আলথুজার বিয়ে করেছিলেন ভালোবেসে। আলথুজারের প্রতি হেলেনের ভালোবাসা অটুট ছিলো, তার মানসিক সংগ্রামের সবসময়কার সঙ্গী ছিলো তার প্রিয় হেলেন যিনি নিজেও ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। জীবনের এতো দুঃখ, মানসিক পীড়ন, তীব্র যন্ত্রণা, হতাশার, বিচ্ছিন্নতার মধ্যে যেই হেলেন তার সাথে ছিলেন, তাকেই শেষ পর্যন্ত সেই ভয়ংকর মানসিক ব্যাধি তে আক্রান্ত হয়ে আলথুজার মেরে ফেলেন যা বুদ্ধিজীবি হিসেবে ব্যক্তি আলথুজারকে নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করে। ১৯৮০ সালের নভেম্বর মাসের ১৬ তারিখে আলথুজার তার স্ত্রী কে মেরে ফেলেন গলা টিপে বলে জানা যায় তার আত্মজীবনী থেকে। গোটা ফরাসি বুদ্ধিজীবি সমাজ বিস্মিত হয়েছিলো কিন্তু সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ছিলো যে মোটাদাগে অধিকাংশ ফরাসি বুদ্ধিজীবিরা আলথুজারের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন যে তিনি মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলো এবং এই ঘটনার পেছনে তার চৈতন্য দায়ী নয়। ফরাসি দেশের   এতো কিছুর মধ্যেও সে তার তত্ত্ব চর্চা এবং গবেষণা বন্ধ করেনি। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো তাকে এরকম অবস্থার পরও ইকোলে নরম্যালের প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদন্নোতি দেওয়া হয়েছিলো, পাশাপাশি এরকম তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়েও সে একটার পর একটা মাস্টারপিস রচনা করে গেছেন। পাশ্চাত্যের মার্ক্সবাদী তত্ত্বের যে ইতিহাস সেই ইতিহাসের আলথুজার একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরোধা৷ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক তত্ত্বের পাশাপাশি মার্ক্সবাদ যে একটি দর্শন এবং এই দর্শন দিয়ে যে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার গতিসূত্র স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব এটা আলথুজারের অন্যতম একটি বিরাট অবদান৷

ফরাসি দেশের আধুনিক পেনাল কোডের বরাতে আলথুজার অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত হলেও অপরাধী হিসেবে স্বীকৃত হোন না বরং মানসিক অসুস্থ অবস্থায় এই ধরণের অপরাধ করার পরেও সে মানসিক অসুস্থ এবং অপরাধের পেছনে তার চৈতন্য দায়ী নয় সেই কারণে সে সাজা থেকে মুক্ত থাকেন।

এছাড়া আলথুজারের হয়ে সে সময়কার বড় বড় ফরাসি বুদ্ধিজীবিরা বিবৃতি দেন, তার পক্ষে কথা বলেন, তাকে সাজা না দিয়ে বরং মানসিক চিকিৎসায় রাখা কে যৌক্তিক বলে দাবিও করেন। এই ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনার মধ্যে একটি, যে একজন মানুষ তার স্ত্রী কে হত্যা করেছে, সেই মানুষ টি ঐ সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরের একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং একজন বড় মাপের দার্শনিক ও চিন্তাবিদ এবং তার হয়ে সকল বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদেরা বিবৃতি দিয়েছে তাকে যেনো অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত না করে বরং তাকে মানসিক চিকিৎসার অধীনে নেওয়া হয়, এই ঘটনাটিকে শুধু একটি উন্নত ও সভ্য সমাজের উদাহরণ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যাবেনা, বরং একটি উৎকৃষ্ট ও উচ্চ মানের সাংস্কৃতিক-দার্শনিক-বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের উদাহরণ এবং যা অতিমাত্রায় ব্যতিক্রম, সেই হিসেবে দেখা উচিত, অথচ আলথুজার ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, বামপন্থী বুদ্ধিজীবি এবং একদম যাকে বলে চূড়ান্ত মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক, কিন্তু ফরাসি সরকার মোটেও বামপন্থী দূরে থাক কমিউনিজমের বিরোধী ছিলো বলা চলে, অথচ আলথুজারের প্রতি তারা সহমর্মিতার কমতি রাখেনি। এটা কে ফরাসি সংস্কৃতি, কিংবা ফরাসি দেশের নাগরিক সহিষ্ণুতা, নাগরিক সভ্যতা নাকি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ কোন টা বলা যায় আমার জানা নাই। ফরাসি দেশের বুদ্ধিজীবীদের সাথে চিরকাল ই সরকারের রেষারেষি ছিলো, কিন্তু কখনই তাদের কে বন্দী করা এবং কোনো ধরনের যন্ত্রণা দেওয়া বা গ্রেফতার করার চর্চা কখনই ছিলোনা,  এমনকি জেনারেল গলের সময় জ্যাঁ পল সার্ত্রেরা যখন রাস্তায় মিছিল করেছিলেন, হরতাল করেছিলেন, গল কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন সার্ত্রে কে যাতে পুলিশ না ছোঁয়, কারণ গল বলেছিলেন "ভলতেয়াদের জেলে ভরে রাখা যায়না। "

আলথুজারের ক্ষেত্রে একই প্রতিক্রিয়া ছিলো সরকারের। কিন্তু আলথুজার সেটাকে ঠিক সেই শ্রদ্ধা এবং বুর্জোয়া উদারনৈতিক জায়গা থেকে দেখেননি কারণ সে মার্ক্সবাদী এবং মতাদর্শ তত্ত্বের একজন সাধক৷ তার মতে এটা নিজেও একটা মতাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্রের (Ideological state apparatus) ফলাফল, কারণ তার মতে তার জায়গায় যদি কোনো শ্রমিক শ্রেণীর ব্যক্তি অথবা ফরাসি দেশে প্রতিষ্ঠিত কেউ না এরকম যদি কেউ হতো তাহলে তার জন্য বুদ্ধিজীবীরা কি এরকম বিবৃতি দিতো? এবং তাকে কি ফরাসি সরকার একই ভাবে সাজা না দিয়ে থাকতে পারতো ? তার আত্মজীবনী তে সে লিখেছেন যে শ্রমিক শ্রেণী কিংবা নিম্ন শ্রেণীর মানুষের মানসিক সমস্যা হোক বা না হোক তাতে কিছুই যায় আসেনা, কারণ সে রাষ্ট্রযন্ত্রের হাত থেকে কখনই মুক্তি পায়না। বিশ শতকের বলতে গেলে পুরো সময়টাই আলথুজার পেয়েছেন তার জীবনে, অর্থাৎ বিশ শতকে ঘটা সব বড় বড় ঘটনার সাক্ষী তিনি ছিলেন, সোভিয়েত পতন ও দেখে গেছিলেন, যদিও সেটার প্রতিক্রিয়া হিসেবে কিছুই বলে যেতে পারেননি কারণ আলথুজার অসুস্থ ছিলেন, শারীরিক অবস্থার ভয়ংকর রকমের অবনতি হতেই থাকলো এবং শেষে ১৯৯০ সালের ২২ অক্টোবর হার্ট এটাক করে মারা যান। ১৯৬৮ সালে প্যারিসে ছাত্র আন্দোলন হয়, যার প্রভাব ফরাসি সমাজে ব্যাপকভাবে পড়েছিলো, মানুষ রাস্তায় নামা শুরু করেছিলো, বুদ্ধিজীবীরা পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন, আলথুজার তখনো প্রচন্ড অসুস্থতায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন কিন্তু তার অসুস্থতা তাকে তার তত্ত্ব চর্চা ও সমাজ বিশ্লেষণ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। ফরাসি দেশে ষাটের দশক এবং সত্তরের দশক কে বলা যায় আলথুজারের যুগ, যেই সময়ে আলথুজার তার তত্ত্বে, চিন্তায় এবং দর্শনের ফরাসি শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় পর্যবসিত হোন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে তার সম্মান ও তার সম্বন্ধে আলোচনার মাত্রা বেড়ে যায়। তার সমস্ত তত্ত্ব চর্চা ও দার্শনিক আবিষ্কার, এসব কিছুর মূল উৎস তার যাপিত জীবন থেকে পাওয়া৷ এই যে অভিজ্ঞাবিদ্যা (Phenomenology), এটা বিশ শতকের প্রায় সকল ফরাসি চিন্তাবিদের ক্ষেত্রেই সাধারণ।  যে নিজের যাপিত জীবন এবং নিজস্ব চেতনা ও তার পারিপার্শ্বিক যা কিছু তাকে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে এনে যৌক্তিক বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে ব্যাখ্যায় পৌছানো। আলথুজার মার্ক্সবাদ এবং অন্যান্য সকল ধরনের বিশেষ দার্শনিক চিন্তাকে নিজের জীবনের মধ্যে দিয়ে অনুভব করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন এবং উপসংহারে পৌছেছেন, যেটা ঐ সময়ের প্রায় সকল দার্শনিক ও তাত্ত্বিকেরা করতেন৷ মনোবিশ্লেষণ নিয়ে ছিলো তার গভীর আগ্রহ, বিশেষ করে লাকানীয় মনোবিশ্লেষণ। ১৯৬৪ সালে তিনি ফ্রয়েড এবং লাঁকা নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন ৷ তার মতে ফ্রয়েড এবং মার্ক্স, দুইজনই ইতিহাসের দুইজন যুগান্তকারী আবিষ্কারক, যাদের চিন্তার আদলে ইতিহাস এবং মানসভ্যতাকে ও মানব সমাজ কে নতুন করে দেখা যায় এবং এই দেখা বিপ্লবাত্মক, আগমনী ভবিষ্যতের নির্ধারক। আলথুজারের মতে ফ্রয়েডও মার্ক্সের মতো একটি নতুন বিজ্ঞানের আবিষ্কার করেছেন, মানব জীবনের এমন কিছু নতুন দিক উন্মোচন করেছেন যেগুলো মানুষ কে একজন "ব্যক্তি" (Subject) হিসেবে যে তার অবস্থান তাকে ব্যাখ্যা করে। অর্থাৎ একটি বাচ্চা শিশু থেকে একজন ব্যক্তির যে বিকাশ, যে ব্যক্তি সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক হোন এক পর্যায়ে, এই যে বিকাশ এই বিকাশ কি সে নিজে ঘটান? নাকি জন্মলগ্ন থেকে তার মধ্যে এমন কিছু ছিলো এবং আছে যার দ্বারা সে চালিত এবং এই চালনার মধ্যে দিয়েই তার ব্যক্তি হিসেবে সমাজে-রাষ্ট্রে তার হাজিরা। কি তার সেই চালিক শক্তি? ফ্রয়েডের বরাতে আমরা জানতে পারি সেটা হলো অজ্ঞান (unconscious) যার শুরুটা অ-ভাব থেকে (অভাব) থেকে, অর্থাৎ মানুষ শৈশবেই এমন কিছুর অভাবে পর্যবসিত হয় যে অভাব কাটানোর জন্য যে তাগিদ সেই তাগিদের ভেতর দিয়েই ঐ মানুষের ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে উঠা এবং নাগরিক ও সভ্য মানুষ হিসেবে বিকশিত হওয়া। মার্ক্সের মতো ফ্রয়েড এমন কিছু আবিষ্কার করেছে যাকে জ্যাঁক লাকা পরবর্তীতে বৈজ্ঞানিক রূপে রূপ দান করেছেন, সেই সময়কার আরো কিছু বৈজ্ঞানিক জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তিতে, অর্থাৎ ভাষাতত্ত্ব। লাকাঁ কে আলথুজার এতো গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন কারণ তার মতে মার্ক্সের পরে মার্ক্সের দর্শন ও তত্ত্ব নিয়ে না না ধরণের অযৌক্তিক, অযাচিত তত্ত্ব ও চিন্তার উদয় ঘটেছিলো যেগুলো সঠিক নয়, ঠিক তেমনি ফ্রয়েডের মৃত্যুর পর তার তত্ত্ব কেও বিকৃত করে, অশোধিত করে এর চর্চার উদ্ভব ঘটে, সেখান থেকে জ্যাঁক লাকাঁ সম্বোধন করলেন সবাইকে "Return to Freud" বলে, অর্থাৎ ফ্রয়েডে ফেরত যাওয়ার জন্য, এর মানে এই না যে ফ্রয়েডে শৈশবে ফেরত যাওয়াশ এর মানে হলো ফ্রয়েডের তত্ত্বের যে পরিণত অবস্থা ছিলো সেখানে ফেরত (মার্ক্সের মতো পরিণত) যাওয়া এবং সেখান থেকে পুনরায় নতুন আঙ্গিকে শুরু করা, যেটা জ্যাঁক লাকাঁ করেছিলেন। ফ্রয়েড কে আলথুজার মার্ক্সের শ্রেণীর চিন্তাবিদ বলে অভিহিত করেছেন সবসময়ই।

 

 

বিশ শতকের প্যারিসের অলিতে গলিতে, বাজারে বন্দরে, আকাশে বাতাসে, ধূলিকণাতে শিল্প-সাহিত্য, দর্শন ও তত্ত্ব চিন্তার সুঘ্রাণ পাওয়া যেতো, ঝাকে ঝাকে দার্শনিক এবং শিল্পীদের আবির্ভাব ঘটছিলো। বিবিধ দার্শনিক মতবাদ ও তত্ত্বের প্যারিসের আর্কেড গুলো জ্বলে উঠেছিলো। আলথুজারের ছবিও সেই প্যারিসিয়ান আর্কেডে অন্যান্য শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিকদের মতো প্রতিফলিত হয়েছে৷ শিল্প সাহিত্য নিয়ে আলথুজারের আগ্রহ ছিলো না বোধ হয়, কখনো তেমন কোনো লেখা বা তত্ত্বের চর্চা করেননি কোনে শিল্প কে সামনে রেখে। জীবনভর দার্শনিক ও রাজনৈতিক দর্শনের চর্চা করে গেছেন এবং মৃত্যুর আগ মুহূর্তে লিখে গেছেন এক অকপট আত্মজীবনী।  অনেকে মনে করেন আলথুজার এই আত্মজীবনী চরম অসুস্থতার মাঝে লিখেছিলো তাই হয়তো অনেক কিছু যুক্ত করতে পারেনি, ভুলে গিয়েছিলো, কিন্তু আমার মতে এটা সঠিক নয়, আত্মজীবনী তে মানুষ সবকিছু লিখেনা, আবার যা সে কখনই বলতে পারেনা বা প্রকাশ করতে পারেনা, মৃত্যু কালে আত্মজীবনী তেই সে সেগুলো লেখার বাসনা অনুভব করে, আলথুজার তেমন ছিলেন কিনা আমার জানা নাই, তবে তিনি তত্ত্ব চর্চার কালে তার অসুস্থতা তাকে বিভ্রান্ত করেনি, তত্ত্ব চর্চার কালে তিনি বেশ শক্ত ভাবে, খাটি দার্শনিক ও তাত্ত্বিকদের মতোই তত্ত্ব চর্চা করেছেন, নিস্তেজ হোননি, ছিলেন সবসময়ই হাসিখুশি এবং প্রাণবন্ত, প্যারিসের বুদ্ধি চর্চা ও বামপন্থী বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে ছিলেন তিনি সকলের মধ্যে একজন মধ্যমণি, রাজনীতি তে সক্রিয় ছিলেন। দূষিত ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টি কে জীবনভর সমালোচনা ও আক্রমণ করেও থেকে গেছেন সেই পার্টিতেই, কারণ তার মতে আপাদমস্তক মার্ক্সবাদী কোনো পার্টির সংযুক্ত হওয়া ছাড়া কখনই সম্ভব না এবং রাজনীতি কে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন কারণ তার তে মতাদর্শ আর বিজ্ঞান এক নয়, রাজনীতি হলো এক ধরণের বস্তুবাদী চর্চার, যেখানে মতাদর্শের বালাই কম, তত্ত্ব ও কৌশলের বালাই বেশি, তার ম্যাকিয়াভেলি সম্বন্ধে বইটা পড়লে এগুলো বোঝা যায়৷

 

আলথুজারকে রাজনৈতিক দার্শনিক বললে ভুল হয়না, বরং মার্ক্সীয় চিন্তাধারায় "রাষ্ট্র" কে কিভাবে দেখা যায়, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি কে মার্ক্সীয় জায়গা থেকে কিভাবে বোঝা যায় সেটা আলথুজার লেনিনের লেখা ধার করে সেখান থেকে আলাপ শুরু করেছেন, পাশাপাশি হেজেমনির যে ধারণা যেটা আন্তনিও গ্রামসি বলেছিলেন সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে, সেটা কে সে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চিন্তা করার চেষ্টা করেছেন। তবে সবশেষে প্রত্যেক বামপন্থী চিন্তাধারার দার্শনিকদের একটা আশা থাকে, ভরসা থাকে ভবিষ্যত ও মার্ক্সবাদ নিয়ে এবং কমিউনিজম নিয়ে।

আলথুজার জানতেন কমিউনিজম সহজ কিছু নয়, এটা স্বপ্ন মাত্র এখনো, এটাকে বাস্তবায়ন করাটা মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তাই তিনি কোনো মিথ্যা আশা না দেখিয়ে, বরং সত্যিকার ভাবে কমিউনিজম কে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কি কি পূর্বশর্ত আছে তা তুলে ধরেছেন তার মতো করে এবং কমিউনিজমের জন্য বুদ্ধিবৃত্তির কোনো বিকল্প নাই, এটা পৃথিবীতে আসা এমন একটি মতাদর্শ যার প্রতিষ্ঠা এবং স্থায়িত্ব বৈজ্ঞানিক ও মানবিক দুই ধরণের নীতির সম্মিলনে সম্ভব। কমিউনিজম নিশ্চয়ই রাজনৈতিক মতাদর্শ ও রাজনৈতিক চর্চা বটে, আলথুজার তা অস্বীকার করছেন না, কিন্তু তার মতে কমিউনিজম শুধুই "রাজনৈতিক মতাদর্শ" নয়, বরং এটা একটি বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রকল্প, গোটা মানবসভ্যতার প্রকল্প, কোনো রাষ্ট্রীয় মতাদর্শিক প্রকল্প নয়।

দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনে যতোটা উজ্জল ছিলেন ব্যক্তিগত জীবনে ঠিক ততোটাই বিমর্ষ, বিষাদগ্রস্ত ও পীড়াগ্রস্ত ছিলেন, যার কারণ তার দীর্ঘ মানসিক অসুস্থতার ইতিহাস, যা তাকে দিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে তার ভালোবাসার মানুষ কে হত্যা করালো। সামাজিক রাজনৈতিক জীবনে আলথুজার ছিলেন সকল জ্ঞানদীপ্ত আলোচনার অন্যতম মধ্যমণি অথচ যখনই তার ব্যক্তিগত জীবনের দিকে নজর যায়, তখনই অনেক সমীকরণ মিলে না, মেলানো যায়না, অদ্ভুত মনে হয়, নিয়তি এবং চৈতন্যের প্রতি শত সহস্র প্রশ্ন তৈরি হয়, এক অন্যরকম অনুভূতির জন্ম হয়, যার উত্তর নেই, প্রতিক্রিয়া, নেই কোনো প্রতিচিন্তা। কিন্তু মার্ক্সবাদী এবং দার্শনিক আলথুজার দর্শন ও মার্ক্সীয় চিন্তাধারা ইতিহাসে একজন প্রথম শ্রেণীর তাত্ত্বিক ও চিন্তাবিদ হিসেবে সবসময়ই সম্মানিত হতেই থাকবেন। 

আকর

1.     On the reproduction of Capital, Louis Althusser

2.     Lenin and philosophy, Louis Althusser

3.     For Marx, Louis Althusser

4.     Reading Capital, Louis Althusser

5.     Freud and Lacan, Louis Althusser

6.     Philosophy and the spontaneous philosophy of scientists, Louis Althusser

7.     The future lasts forever, Louis Althusser

8.     Pocket pantheon, postwar philosophers, Alain Badiou

9.     Althusser, Jacque Ranceire

10.   Transitions "Louis Althusser", Warren Montag

11.   Twentieth century French thought, Columbia University press

12.   মনন বিশ্ব পরিচয়, চিরঞ্জীব শূর