গার্সিয়া মার্কেসের যুগ্ম উপন্যাস : ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ ও ‘অশুভ লগ্ন’

 

‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’

 

‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউডে’র মত সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলা উপন্যাস সত্ত্বেও কেন গার্সিয়া মার্কেসের - নিজে তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’র কথা বলতেন, অন্ততপক্ষে ‘ক্রনিক্যাল অব এ ডেথ ফোলটোল্ড’ লেখার আগে অবধি -  তা ভেবে অনেকে বিস্মিত হতে পারেন। ‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’র মতো উপন্যাস গোটা বিশ্বসাহিত্যেই খুব কম লেখা হয়েছে। তার বিশালতা, বহুস্তরিকতা ও যাদুবাস্তবতার স্বাদ অনন্য। তবুও গার্সিয়া মার্কেজের নিজের পছন্দ কেন তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাসটির দিকে হেলে ছিল ? এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমাদের মনে হয় এই উপন্যাসেই গার্সিয়া মার্কেসের খুঁজে পেয়েছিলেন সৃজনী শক্তির সেই উৎসটি যা বিশেষকে অসামান্য করে তোলে। আর সেই উৎসমুখটি খুঁজে পাবার পর পরবর্তী ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউডের সাফল্যসিদ্ধির রাস্তাটা স্রষ্টার কাছে হয়ত অনেকটা সহজ হয়েছিল।

গার্সিয়া মার্কেস ১৯৫৫ তে যখন ‘লিফ স্টর্ম’ লিখেছিলেন সেখানে কারুকৃতির নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা ছিল। তিনজন কথকের তিনটি আলাদা দৃষ্টিকোণে কথা বলা উপন্যাসটিতে একটি আলাদা মাত্রা সৃষ্টি করতেও সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু একটি স্বরের কথন চলতে চলতে আর একটি স্বরের কথন শুরু হয়ে যাওয়ার মধ্যে নিরীক্ষাগত অভিনবত্ব যতই থাকুক তা অনেক পাঠককে যে খানিক গোলকধাঁধায় ফেলে তাও অস্বীকার করা যায় না। অন্যদিকে ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ নিরলংকার, গীতিকবিতার মত সংহত থেকে রাষ্ট্রনৈতিক কুটিলতা ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাকে আশ্চর্য সরলভাবে উপস্থাপণ করতে সক্ষম হয়েছে। ‘লিফ স্টর্ম’ বা ‘পাতার ঝড়’ প্রত্যাশা তৈরি করেছিল আর ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ সিদ্ধির অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছেছে।

গার্সিয়া মার্কেসের নানা উপন্যাসেই ফিরে ফিরে এসেছে কলম্বিয়ার গৃহযুদ্ধ যা উনিশ বিশ শতকে বারবার সংগঠিত হয়েছে। উনিশ শতকের প্রথম দিকে অন্যান্য লাতিন আমেরিকান দেশগুলির মতো কলম্বিয়াও স্পেনীয় শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী দেড় শতাব্দী ধরে অবিরত গৃহযুদ্ধ সে দেশকে বিদীর্ণ করেছে। এই গৃহযুদ্ধ চলেছিল উদারপন্থী আর রক্ষণশীলদের মধ্যে। উদারপন্থীরা চেয়েছিল অনেক বেশি আঞ্চলিক সায়ত্তশাসন, সবার ভোটদানের অধিকার, প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরের নির্ধারণ, চার্চের ক্ষমতাহ্রাস, রেজিস্ট্রি বিয়ের অধিকার, সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা। অন্যদিকে রক্ষণশীলরা ছিল শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের পক্ষে। বিদেশে জন্মানো বিবাহ বহির্ভূত কলম্বিয়ান সন্তানদের নাগরিকত্ব দেবার পক্ষপাতী তারা ছিল না। চার্চ ও ধর্মের পক্ষে তারা কথা বলত, সমাজে ও রাষ্ট্রে ধর্মের গুরুত্ব বাড়ানোর দিকেই ছিল তাঁদের সায়। কলম্বিয়ার শাসনের প্রকৃতি নিয়ে এই দুই শক্তি কোনও আপোষ রফায় আসতে পারে নি, গড়ে তুলতে পারে নি কোনও বহুজনগ্রাহ্য সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। ১৮২০ তে স্বাধীনতার পর থেকে ১৯০৩ সাল পর্যন্ত প্রায় আশিটি ছোট বড় গৃহযুদ্ধ হয়েছিল সেখানে, অর্থাৎ প্রতি বছরে গড় পড়তা প্রায় একটি। এরকম দীর্ঘ গৃহযুদ্ধবিদীর্ণ রাষ্ট্র যে সামাজিক অর্থনৈতিক ও নৈতিক দিক থেকে নানা ধরনের সঙ্কটের মুখোমুখি হবে তা বলাই বাহুল্য। আর কলম্বিয়ার আখ্যানকারদের রচনায় যে যুদ্ধের ভয়াবহতা নানাভাবে চিত্রিত হবে সেও সহজেই অনুমেয়।

ছোটবেলা থেকে একটা গানে মার্কেস বারবার শুনতেন মামব্রুক তুরীভেরী বাজিয়ে যুদ্ধে যাচ্ছে। দিদিমা ত্রানকিলিনা কোর্তেসকে এই মামব্রুক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে তিনি উত্তর পান এই মামব্রুক তার দাদুর সঙ্গে গৃহযুদ্ধের সময় লড়াই করেছিল। জীবনের প্রথম দশটা বছর দাদু দিদিমার কাছেই থাকতেন গার্সিয়া মার্কেস। দাদু নিকোলাস মার্কেস ইগুয়ারান ছিলেন কর্নেল ও গৃহযুদ্ধের এক সামনের সারির সৈনিক। গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতা গার্সিয়া মার্কেস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীনই প্রত্যক্ষভাবে পান। ১৯৪৭ থেকে তিনি আইন নিয়ে পড়াশুনো করছিলেন কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোতার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরের বছর ১৯৪৮ সালেই ঘটে এক বড় আলোড়ন যা বোগোতাসো নামে পরিচিত। জনপ্রিয় উদার বামপন্থী নেতা হোর্হে এলিয়েসের গাইতানেকে খুন করার পর শুরু হয় ভয়ংকর দাঙ্গা। বোগোতার এই দাঙ্গা যা বোগোতাসো নামে পরিচিত তাতে পুড়ে যায় গার্সিয়া মার্কেসদের ছাত্রাবাসটি। গার্সিয়া মার্কেসের তখনো অবধি লেখা সব পাণ্ডুলিপিও তাতে ভস্মীভূত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে তালা ঝুলল এবং মার্কেস কার্তাহেনার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। বোগোতাসো তথা রাষ্ট্রীয় উপপ্লব শুধু রাজধানী শহরেই সীমাবদ্ধ থাকল না। তা ক্রমশ ছড়ালো গোটা দেশে এবং চলল দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে। কুড়ি বছরের এই ব্যাপক দাঙ্গা হাঙ্গামায় উদারপন্থী ও রক্ষণশীল উভয় দল ও সাধারণ নাগরিক মিলে প্রায় দু লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। অজস্র সম্পত্তি ধ্বংস হয়।

এই হিংসাপর্ব, যা ‘লা ভিওলেন্সিয়া’ নামে কলম্বিয়ায় চর্চিত, তার মধ্যেই গার্সিয়া মার্কেসের প্রথম দিককার কয়েকটি ছোট উপন্যাস ও বেশ কিছু ছোটগল্প রচিত হয়। এর মধ্যে ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ (নো ওয়ান রাইটস টু কর্নেল) এবং ‘অশুভ লগ্ন’ (‘ইন দ্য ইভিল আওয়ার’) র মতো উপন্যাসদুটি সরাসরি ‘লা ভিওলেন্সিয়া’কে তাদের রচনার মধ্যে এনেছে। এর ছাপ রয়েছে মঙ্গলবারের সিয়েস্তা, ‘এইরকমই একদিনে’, ‘মামা গ্রান্দের অন্ত্যেষ্টি’ ইত্যাদি গল্পেও। গার্সিয়া মার্কেস ১৯৫৬ সালে বেকার ও বুভুক্ষু অবস্থায় প্রথমে ‘অশুভ লগ্ন’ উপন্যাসটি লিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু বেশ কিছুটা লেখার পর সেটিকে পাশে সরিয়ে রেখে সেই লেখায় ক্রমশ প্রধান হয়ে উঠতে থাকা একটি চরিত্রকে নিয়ে লেখেন ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ উপন্যাসটি। এটিই প্রকাশিত হয় প্রথমে, ১৯৬১ সালে। পরের বছর ১৯৬২ তে প্রকাশিত হয় ‘অশুভ লগ্ন’।

‘লা ভিওলেন্সিয়া’ নিয়ে রচিত অন্যান্য কলম্বিয়ান আখ্যানগুলির থেকে ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ কোথায় আলাদা ? অন্যান্য আখ্যানগুলি যেখানে রক্তাক্ত ও পাশবিক হিংস্রতার বর্ণনাকে প্রত্যক্ষভাবে এনেছে গার্সিয়া মার্কেস এই উপন্যাসে তাকে সচেতনভাবে এড়িয়ে ভেতরের রক্তক্ষরণের দিকটার ওপর জোর দিয়েছেন। গার্সিয়া মার্কেসের এই উপন্যাসে খুনোখুনি বা গেরিলা লড়াইয়ের বীভৎসতা নেই, আছে আতঙ্ক ও ভয়ের এক হাড় হিম করা আপাত শান্ত কিন্তু অস্থির পরিবেশ। প্রাত্যহিক কাজকর্ম মানুষ করে যাচ্ছে যন্ত্রের মতো আর ভেতরে ভেতরে কাঁদছে ও কাঁপছে। উপন্যাসের প্রথম দিকেই আমরা দেখি সর্বনাশের মুখে দাঁড়িয়ে একটি স্বাভাবিক মৃত্যুকে সানন্দে বরণ করছে তারা, কারণ এই জনপদে এখন স্বাভাবিক মৃত্যু আর কারো প্রায় হয় ই না। গৃহযুদ্ধ অকালে অপঘাতে কেড়ে নেয় প্রাণ।

যে কর্নেল ও তার স্ত্রী এই উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র তারাও তাদের একমাত্র সন্তান আগুস্তিনকে এই গৃহযুদ্ধের মধ্যেই হারিয়েছেন। ঘটনাকালের নয় মাস আগে একদিন বিদ্রোহের গোপন ইস্তাহার বিলি করার সময় রাষ্ট্রের পুলিশ গুলি করে মারে। সেই পুত্রর রোজগারই ছিল এই বৃদ্ধ দম্পতির পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। বৃদ্ধ কর্নেল দশকের পর দশক অপেক্ষা করে থাকেন প্রতিশ্রুত পেনশনটি রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাবার জন্য। কিন্তু সেই অপেক্ষা কেবল দীর্ঘায়ত হয়। প্রতি শুক্রবার ডাকে চিঠি আসে। কর্নেল উৎকন্ঠিত ও আশান্বিত বুকে চিঠির দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু প্রতি সপ্তাহেই তাকে নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়। উপন্যাসে কয়েকটি রেখার টানে বৃদ্ধ দম্পতির পরিবারের হাড়ির হালটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ঘরে খাবার বাড়ন্ত। জমানো টাকা শেষ। নানা জিনিসপত্র বিক্রি করে কোনওরকমে দিন চলে। মাঝেমধ্যে রান্না বসানোর কিছু না থাকায় প্রতিবেশীদের ধোঁকা দিতে কর্নেলের স্ত্রী পাথর সেদ্ধও করেন। উপন্যাসের একেবারে শুরর দৃশ্যেই গার্সিয়া মার্কেস পাঠককে দেখিয়ে দিয়েছিলেন কর্নেল পরিবারের হাড়ির হাল। কফি বাড়ন্ত। যেটুকু আছে তাতে একজনের এক কাপ কোনওমতে হতে পারে। তাই বৃদ্ধ কর্নেল নিজের ভাগের জলটুকু ফেলে দিয়ে অসুস্থ শয্যাশায়ী স্ত্রীকে এক কাপ কফি করে দেন ও মিথ্যা স্তোকবাক্যে জানান তিনি আগেই খেয়ে নিয়েছেন। দারিদ্র, অসহায়তা এবং অভিনয়ে তাকে লুকিয়ে রাখার এই দুর্মর করুণ প্রচেষ্টা গোটা উপন্যাস জুড়েই আমরা দেখতে পাই।

কিন্তু ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ শুধু এই কারুণ্য আর হতাশার আখ্যান নয়। এই আখ্যান প্রতিরোধ আর প্রতিস্পর্ধার। বস্তুত সেই প্রতিস্পর্ধাটুকুই এই আখ্যানের মূল আকর্ষণ। কর্নেলের ছেলে আগুস্তিন মৃত্যুর সময় রেখে গিয়েছিল একটি কুঁকড়োকে। কিন্তু সেই মোরগকে বিক্রি করে বেশ কিছু পয়সা রোজগারের কথা বারবার আলোচিত হলেও শেষপর্যন্ত এটিকে তারা বিক্রি করে উঠতে পারে না। একবার বিক্রির জন্য অগ্রিম নিয়েও সেটা ফিরিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। এই কুঁকড়ো একটি আশাবাদের প্রতীক হিসেবে এই আখ্যানে থেকে যায়। যাকে বিক্রি করা নয়, লালন করাই কর্নেলের ব্রত হয়ে দাঁড়ায়। এর কারণ কুঁকড়োটি শুধুই যে তার শহীদ পুত্রের স্মৃতি বহন করছে তা নয়। কুঁকড়োটি গোটা যুব সমাজের সম্পত্তি হয়ে উঠেছে। আগুস্তিনের সহকর্মীরা – আলভারো, আলফোনসো, বা এরনানের মতো দর্জিরা একটি বর্ণহীন সময়ে এই কুঁকড়োর লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে তারা তাদের জীবনযুদ্ধে জেতার ও জীবনের আশা বাঁচিয়ে রাখার স্বপ্নকে লালন করে। তারা গোপন ইস্তাহার ছড়িয়ে দেয়, ডাক্তারের মতো একজন শহর থেকে আসা মানুষও এই গুপ্ত প্রতিরোধ বাহিনীর সদস্য হিসেবে প্রতিস্পর্ধার স্বপ্নকে ঝুঁকি নিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন। তাই ডন সাবাসের মতো ন্যায়নীতিহীন বিবেকবর্জিত বড়লোকের কাছে কুঁকড়োটাকে বেঁচে দেওয়া চলে না, যে ডন সাবাস রাজনৈতিক সহকর্মীদের কথা পুলিশকে জানিয়ে তার বিনিময়ে অন্যায় ও অসাধুভাবে বড়লোক হয়েছে। উপন্যাসের প্রথম দৃশ্যে যদি কর্নেলের জীবনযন্ত্রণা ও দারিদ্রের ছবিটি ফুটে থাকে তাহলে শেষ দৃশ্যে সেই যন্ত্রণা ও দারিদ্রের মধ্যেই বড় হয়ে উঠেছে তার প্রতিস্পর্ধার দিকটি। স্ত্রী যখন জিজ্ঞাসা করেন খাবে কী তখন কর্নেল একটি শব্দে জানান গু। বুঝিয়ে দেন পরিস্থিতি যাই হোক - না খেয়ে থাকবেন তাও সই, কিন্তু আপোষ করবেন না।

 

ইন ইভিল আওয়ার বা অশুভ লগ্ন

গার্সিয়া মার্কেস ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’-র মতো ‘ইন ইভিল আওয়ার’ উপন্যাসটিও কলম্বিয়ার ‘লা ভিওলেন্সিয়া’ বা গৃহযুদ্ধের হিংসার প্রেক্ষাপটে রচনা করেন। এই দুই উপন্যাসের কোনও কোনও চরিত্রও অভিন্ন৷ সব মিলিয়ে অনেকে এই দুটি আখ্যানকে একটি যুগ্মক হিসেবেই পড়তে চান। 

‘ইন ইভিল আওয়ার’ উপন্যাসে অবশ্য কর্নেল চরিত্রটি একেবারেই অনুপস্থিত। শহরের মেয়র, যার পার্শ্বিক উপস্থিতি ছিল ‘নো ওয়ান রাইটস টু কর্নেল’ উপন্যাসটিতে, তিনিই এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। এছাড়া রয়েছে ডাক্তার অক্টাভিও জিরালদো চরিত্রটি, উভয় উপন্যাসেই তার উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি। ‘ইন ইভিল আওয়ার’ উপন্যাসে এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে আছেন ফাদার অ্যাঞ্জেল নামের এক পাদ্রী আর আর্কাদিও নামের এক বিচারপতি।

পাদ্রী অ্যাঞ্জেলের উপস্থিতি কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না তে ছিল সামান্য। এখানে তা অনেক বিস্তারিত। পাদ্রী অ্যাঞ্জেল ও তার চার্চ এর কথা দিয়েই উপন্যাসটি শুরু হয়। আমরা দেখি প্রার্থণার সময়জ্ঞাপক ঘন্টা বাজানোর কাজটি দড়ি টেনে টেনে করতে বাষট্টি বছরের বৃদ্ধের যথেষ্ট সমস্যা হয়। কিন্তু তাও এই কাজটা তিনি নিষ্টার সঙ্গে করেন৷ বস্তুতপক্ষে এই আখ্যানে পাদ্রীর কাজ মূলত দুটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ৷ একটি হল কেউ খুন জখম করে ফেললে আততায়ীর ঈশ্বরের কাছে পাপস্বীকারের আয়োজন। অন্যটি হল শহরের একমাত্র সিনেমা হলের সিনেমাকে নৈতিকতার নিরিখে নিয়ন্ত্রণ করা। 

পাদ্রীর এই সেন্সরশিপ হল মালিক ও দর্শকদের বিব্রত করে সন্দেহ নেই তবে মার্কেজ দেখান গোটা শহরটাই আসলে রয়েছে এক সেন্সরশিপের মধ্যে৷ কলম্বিয়ার ইতিহাস উনিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকেই উদারনৈতিক ও রক্ষণশীলদের মধ্যে একটানা রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ দেখেছে দশকের পর দশক। মাঝে মাঝে বিরতি এসেছে। দমবন্ধ ও গুমোট বাঁধা পর্বের পর আবার নতুন করে তা শুরু হয়েছে। এই উপন্যাসটি রচিত হয়েছে এমন একটা গুমোট বাঁধা পর্বে, যখন যুদ্ধ ও হিংসা প্রত্যক্ষভাবে নেই। গৃহযুদ্ধের বিজয়ীরা চেষ্টা করছে নিজেদের আইনী শাসনকে নিরঙ্কুশ করতে৷ কিন্তু এই তথাকথিত আইনী শাসন কতটা স্বৈরতান্ত্রিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও গণতন্ত্রবিরোধী তা গার্সিয়া মার্কেজ এখানে স্পষ্ট করে দিয়েছেন৷ আর তার নানা অনুপুঙখ ও ইঙ্গিৎময় নানা ভাষ্য কেবল কলম্বিয়ার নয়, যে কোনও দেশকালের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের কদর্য ও রুদ্ধশ্বাস অবস্থাটাকে প্রতিবিম্বিত করে৷ এই আখ্যানের আপাত শান্তির দিনগুলি অস্থির হয়ে থাকে যে কোনও সময়ে একটা বিস্ফোরণের আশঙ্কায়। চাপা স্বরের কথাবার্তা বা গোপন আলাপ আলোচনাকেও সরকার ও তার কর্তাব্যক্তিরা সন্দেহের চোখে দেখে। সেই চাপা স্বর থেকেই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করে। 

এই উপন্যাস জুড়ে বিভিন্ন ল্যামপুন বা গোপন পোস্টারের কথা আছে৷ এই ল্যামপুনগুলি শহরের গোপন যৌনাচারগুলিকে প্রকাশ্যে এনে দেয়। সেগুলিকে কর্তৃপক্ষ রুখতে চায় যেন তেন প্রকারে৷ খুঁজে বের করতে চায় কে বা কারা এগুলো করছে৷ এমন নয় যে ল্যামপুনগুলি গোপন যৌনাচারের যে বয়ান হাজির করে তা লোকের অজানা। শহরবাসী ফিসফাসে ধনী মানী খ্যাতজনেদের সে সব কথা আওড়ে চলে অবিরত৷ কিন্তু পোস্টারগুলি গোপনকে প্রকাশ্যে আনার ও চর্চার যে সাহস দেখায় তার সংক্রমণকে ভয় পায় কর্তৃপক্ষ৷ সব কথা খোলাখুলি চর্চিত হওয়ার মধ্যেই বিদ্রোহ বিস্ফোরণের সম্ভাবনা আঁচ করে তারা। ফাদার অ্যাঞ্জেলের কাছে যে সব সমস্যা নৈতিক, মেয়রের কাছে সেই সব সমস্যাই আদ্যন্ত রাজনৈতিক। সে তার অভিজ্ঞ রাজনৈতিক চোখে যৌনতার আখ্যানের মধ্যেই বিদ্রোহের বারুদকে লুকিয়ে থাকতে দেখে। তাই একে দমন করা ও প্রচারকারীকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়াটা তার দায় হয়ে দাঁড়ায়।

ডন সাবাসের মতো দলত্যাগীরা এই সব কাজে সবসময়েই শাসকের সাহায্যকারী হিসেবে উপস্থিত হয়। এই ঘৃণ্য চরিত্রটি ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ আর ‘অশুভ লগ্ন’ দুই উপন্যাসেই উপস্থিত। সে একদা ছিল বিপ্লবী দলে। তারপর সে শুধু নয়া শাসকদের দিকে এল তাই নয়, নিজের পুরনো দলের কমরেডদের গোপন তালিকা তুলে দিল শাসকদের হাতে। তার বিনিময়ে প্রভূত টাকা পেয়ে বড়লোক হল এই রেনিগেড লোকটি। কিন্তু সমাজের চোখে হীন আর বিপ্লবীদের চোখে চরম ঘৃণ্য হয়ে উঠল।

কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না তে আমরা দেখেছিলাম কর্নেলের ছেলে বিপ্লবী লিফলেট ছড়াতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা যাচ্ছে। তবে তাতে বিদ্রোহ বিপ্লবের গোপন প্রস্তুতি থেমে যাচ্ছে না। কর্নেলের ছেলের শাকরেদরা আর ডাক্তারের মতো কেউ কেউ গোপনে বিদ্রোহ বিপ্লব সংগঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যায়৷ সেই ডাক্তার চরিত্রটি এই উপন্যাসেও আছে৷ স্বৈরতন্ত্রের প্রতিভূ মেয়র দাঁতের যন্ত্রণায় বাধ্য হয়ে তার কাছে যান আর ডাক্তার তার চিকিৎসক সত্তার প্রতি দায়বদ্ধ থেকে রোগীর উপশমে যত্নবান থাকেন বটে, কিন্তু এই দুই শিবিরের দুই চরিত্রের বৈরিতা, পরস্পরকে অবিশ্বাস ও অপছন্দের বিষয়গুলি তাতে আড়াল হয় না৷ 

উপন্যাসের প্রথম দিকেই একটি খুনের ঘটনা ঘটে যায় যখন একটি কেচ্ছাসূচক ল্যামপুনের বয়ানের সূত্র ধরে রাখালিয়া গায়ক পাস্তরকে তার বাড়িতে ঢুকে গুলি হত্যা করে সেসার মনটেরো। এই হত্যাকাণ্ডের পরেই অপরাধীকে গ্রেপ্তার ও শাস্তিবিধানের প্রক্রিয়ায় ময়দানে অবতীর্ণ হন মেয়র৷ এরপর থেকে শহরের যাবতীয় কার্যকলাপের নিয়ন্ত্রক হিসেবে তিনিই সামনে থাকেন। আর্কাদিও নামের একজন বিচারককে আমরা মাঝেমধ্যে মঞ্চে দেখি বটে কিন্তু তিনি মূলত মেয়রের হাতের পুতুল। স্বৈরতন্ত্রের জমানায় শাসকের কথাই যে আইন তা মেয়রের কথায় বিচারপতির ওঠাবসার মধ্যে দিয়ে মার্কেজ স্পষ্ট করে দেন। বিচারপতি আর্কাদিও একটি মেয়েকে প্রবল সঙ্কট থেকে উদ্ধার করেন। আনুষ্ঠানিক বিবাহ না হলেও কার্যত সেই এখন তার স্ত্রী। তাদের বোঝাপড়া, টানটান শরীরী আশ্লেষের একটি নিবিড় ছবি রয়েছে আখ্যানে। পাদ্রী ফাদার অ্যাঞ্জেল চান আর্কাদিও বিধিমতে তার সঙ্গিনীকে বিবাহ করুন। মেয়রকে আলগোছে সেসার মনটেরোর শোচনা স্বীকারোক্তির বিষয়ে তাগাদা দিয়ে প্রতিহত হয়ে বেশিদূর তিনি এগোতে পারেন না। স্বৈর শাসকের প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আনুগত্য ও বোঝাপড়ার দিকটি মেয়র ও ফাদার অ্যাঞ্জেলের সম্পর্ক থেকে উঠে আসে৷ আর বিচারপতি আর্কাদিও ও মেয়রের সম্পর্ক দেখিয়ে দেয় স্বৈরশাসনের সঙ্গে বিচারব্যবস্থার বোঝাপড়ার দিকটি। 

মেয়র সমস্ত শহরকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান এবং এই কাজে তিনি আপাত সফল হলেও জানেন যে কলম্বিয়ার গৃহযুদ্ধের ইতিহাস শাসককে দীর্ঘমেয়াদী স্বস্তির অবকাশ দেয় না। আপাত শান্তির সময়ে একদিকে আইনের শাসনকে প্রসারিত করার চেষ্টা যেমন তিনি করে যান, তেমনি তীক্ষ্ণ নজর রাখেন যেন বিদ্রোহের বাষ্প ধূমায়িত না হতে পারে। মুক্ত গণতন্ত্রের বদলে নজরদার রাষ্ট্রের দিকে হাঁটতেই তিনি পছন্দ করেন। 

আখ্যানের প্রথমে একটি হত্যাকাণ্ডের সূত্র ধরে মেয়র শহরকে কীভাবে তার কর্তৃত্বাধীনে রাখছেন তা মার্কেজ দেখিয়েছিলেন। আখ্যানের শেষে আরেকটি হত্যাকাণ্ড ঘটে এবং সেটির সূত্র ধরে তার কর্তৃত্বকে ডাক্তারের মতো বিপ্লবীরা প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ জানান। 

কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না উপন্যাসে কর্নেলের ছেলে আগুস্তিন মোরগের লড়াইয়ের সময় গোপন ইস্তাহার বিলি করতে গিয়ে গুলি খেয়ে শহীদ হয়েছিল। অশুভ লগ্ন উপন্যাসে পেপে আমাদোর মোরগ লড়াইয়ের সময়েই রাজনৈতিক প্রচারপত্র বিলি করতে গিয়ে ধরা পড়ে।

শহরে আবার কেউ রাজনৈতিক প্রচারপত্র ছড়িয়েছে এই খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে ও শহরের বিভিন্ন জায়গায় এই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। আখ্যানকার দেখান সাধারণ মানুষজন – যেমন জনৈক টোটো ভিসবল, মিনা নামের এক রমণী ও তার মা ও অন্ধ বৃদ্ধা ঠাকুমা পর্যন্ত এই নিয়ে আলোচনা করছে পেপে আমাদোরের গ্রেপ্তারীর পরেই। তারা বলাবলি করে যে বিপ্লবীরা আবার ফিরে এসেছে। রাস্তায় আবার রক্তগঙ্গা বইবে। কারোর ক্ষমতা নেই তাকে ঠেকানোর। তাদের সবাইকে রক্তে স্নান করতে হবে। ফাদার অ্যাঞ্জেল সেখানে এসে পড়লে তিনিও এই আলোচনায় ঢুকে পড়েন।

একদিকে যখন গেরিলা যোদ্ধাদের লিফলেট ছড়ানোর ব্যাপারে উত্তেজনা তৈরি হয়, সেই সময়েই আমরা দেখি বিচারপতি আর্কাদিও চুল কাটতে গিয়ে নাপিতের সঙ্গে আলোচনা করছে মেয়রের ক্রমশ বাড়তে থাকা আধিপত্য নিয়ে। আর্কাদিও মনে করে মেয়র একদিকে যেমন ক্রমশ সম্পদশালী হচ্ছে তেমনি অন্যদিকে বেড়ে চলেছে তার পরাক্রম। সে এই স্থিতাবস্থাটা যেন তেন প্রকারে তাই রক্ষা করতে চাইবে।

এই সময়েই মেয়র জেনে যান বিচারপতি আর্কাদিও শহর ছেড়ে অজ্ঞাতে কোথাও চলে গেছেন। নানা জটিল অঙ্ক ঘুরতে থাকে মেয়রের মাথায়। তিনি বিপদের আশঙ্কা করতে থাকেন।  বিচারপতির স্ত্রীকেই হুমকির স্বরে জানিয়ে দেন যে আর্কাদিও সুড়ঙ্গের ভেতর বা মাতৃগর্ভ বা অন্য যে কোনও জায়গাতেই গিয়ে থাকুক না কেন, তাকে ঠিক খুঁজে বের করা হবেই। রাষ্ট্রের হাত যে অনেক লম্বা এটা ভুলে যাবার কোনও কারণ নেই।

পেপে আমাদোরের থেকে বিদ্রোহ বিপ্লবের কাজে লিপ্ত গেরিলা যোদ্ধাদের খবর বের করার জন্য অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয় কারাগারে। মেয়র তার শাকরেদকে নির্দেশ দেন, “ওকে বোঝাবার চেষ্টা কর যাতে অন্য যারা এই গোপন প্রচারপত্র শহরে নিয়ে আসছে তাদের নামগুলো যেন তোমাকে দিয়ে দেয়। যদি সোজা আঙুলে ঘি না ওঠে, সে স্পষ্ট করে বললে, ‘ওর মুখ থেকে কথা বের করবার জন্য যে কোনও উপায় তুমি বেছে নিতে পারো।”

পেপের ওপর কারাগারে অকথ্য নির্যাতন চলে। “পাহারার পুলিশের কাছ থেকে প্রতিবেদন পাবার পর, মেয়র তাদের বললে কয়েদখানার দরজাটা খুলে দিতে, যেখানে, দেখে মনে হলো, ইঁটের মেঝেয় মুখ গুঁজে পেপে আমাদোর যেন গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। পায়ের ঠোক্কর দিয়ে মেয়র তাকে উলটে দিলে, আর গোপন করুণার সঙ্গে একঝলক তাকিয়ে দেখলে মুখটা, আঘাতে আঘাতে সেটা বিকৃত ও কিমাকার।

… দুজন পুলিশ যখন তাকে ধরে বসিয়ে রেখেছে, অন্যজন তার চুলের ঝুঁটি ধরে তার মাথাটা তুলে রাখলো। দেখে মনে হতো মরেই গিয়েছে বুঝি যদি না অনিয়মিত নিঃশ্বাস পড়ত তার আর ঠোঁটে থাকতো অপরিসীম অবসাদের আবেশ। …

মেয়র হাজত থেকে বেরিয়ে এল, ওদের হুকুম দিলে তাকে কিছু খেতে দিয়ে যেন খানিক্ষণ ঘুমোতে দেয়। তারপর সে বলল ‘ওর ওপর কাজ চালিয়ে যাও যতক্ষণ না সে যা জানে সব উগড়ে দেয়। আমার মনে হয় না আর বেশিক্ষণ সে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে।”

বিপ্লবী পেপে আমাদোরকে কারাবন্দী অবস্থায় খুন করা হলে ডাক্তার মেয়রকে দৃঢ় স্বরে জানান মৃতের ময়নাতদন্ত করতেই হবে৷ এতদিনের বশ্যতাকে সরিয়ে রেখে সে মোলাকাতে ডাক্তারের সঙ্গী হন ফাদার অ্যাঞ্জেলও। মেয়র স্বাভাবিকভাবেই এই কর্তৃত্বকে মেনে নিতে পারেন না। রিভলবার উঁচিয়ে হুমকি দিতে বাধ্য হন ডাক্তার আর পাদ্রীকে। স্বৈরশাসনকে চাপা সন্ত্রাসের আবডাল ভেঙে সরাসরি এভাবে আগ্নেয়াস্ত্র সহ সামনে আসতে হয় আর তার আইনী শাসনের মুখোশটা বেআব্রু হয়ে পড়ে। জানা যায় দলে দলে লোকজন শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে আর গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে। শাসক ও দমনমূলক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বিপ্লবের নকশা তৈরি হচ্ছে আরো একবার।