দস্তয়েভস্কির ব্রাদার্স কারামোজভ প্রসঙ্গে
- 07 February, 2022
- লেখক: নাসির আহমেদ
এ বঙ্গে পাঁচ দশক আগে একটা সময় গিয়েছে, যখন তরুণ প্রজন্মের মফস্সলের কলেজ পড়ুয়ারাও রুশ সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে বিস্তর৷ পুশকিন, টলস্টয়, দস্তয়েভ্স্কি ও চেখভের মতো বিশ্বখ্যাতদের সৃষ্টি বাঙালি বাঠকেরা ইংরেজি বা বাংলা অনুবাদে তখন ব্যগ্র আগ্রহে পড়ছেন বা পড়েছেন৷ সাতের দশকে, ইউরোপীয় অস্তিত্ববাদী সাহিত্যের তিন রথী আলবেয়র কামু, ফ্রান্জ কাফ্কা ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের রচনা কলকাতার পাঠক ও বুদ্ধিজীবী সমাজের বাইরে মফস্সলে তখনও সমাদর পায়নি - যতটা টলস্টয়, দস্তয়েভ্স্কি বা তুর্গেনেভর সৃজনী আদৃত ছিল৷ এর একটা কারণ মস্কোর প্রোগ্রেসিভ পাবলিশার্স, যারা ইংরেজি ও বাংলায় ধ্রুপদী রুশ সাহিত্যসম্ভার অনুবাদে প্রকাশ করেছিল, তাদের পরিবেশকের মফস্সলে ব্যবসায়িক সাফল্য৷ শহরের একটি পরিচিত দৃশ্য ছিল : প্রগতি প্রকাশনের এজেন্টদের ব্যাগ ভর্তি বিভিন্ন বিষয়ের বই - বিশেষত সাহিত্যের পাড়া ঘুরে পরিচিতদের বাড়িতে স্বল্প দক্ষিণায় বিক্রি করা৷ ছয়ের দশক থেকে বামপন্থী মতাদর্শ বাংলার সাধারণ মানুষের অনিবার্য অবলম্বন হয়ে উঠেছিল৷ তাই কমিউনিস্টদের প্রতিপোষণা যে রুশ সাহিত্যকে এ বাংলায় জনপ্রিয় করেছিল, অস্বীকার করা যায় না৷ তাছাড়া সব কিসিমের সাম্যবাদী দলের সমর্থনের কাছে লেনিনের রাশিয়ার জন্য রোমান্টিক আবেগ আজও দুর্মর৷ কলেজ ক্যাম্পাসে, চায়ের দোকানে আড্ডায় তুখোড় যুবকেরা একদা প্রগলভ হয়েছে ওয়ার অ্যান্ড পিসের কাউন্ট বেজুখব, আনা কারেনিনার আনা, দস্তয়েভ্স্কির রাসকলনিখভ, দিমিত্রি কারামাজভের মতো চরিত্রদের নানা দৃষ্টিকোণী আলোচনায়৷ যদিও জার আমলে চিরায়ত সেইসব সাহিত্য একটা মার্কসীয় বিশ্লেষণে ছিল সামন্তবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল - অতএব ব্রাত্য৷ আজ অবশ্য সে অপবাদ ঘুচে গেছে৷
আধুনিক রুশ সাহিত্যের যখন উন্মেষ তখন ইউরোপের ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান সাহিত্য তখন পূর্ণ বিকশিত৷ রুশ সাহিত্যের জাতীয় পরিচয় আলেকজান্ডার পুশকিনের (১৭৯৯-১৮৩৭) হাত ধরে৷ এর আগে মধ্যযুগে খ্রিস্টীয় যাজকদের নীতিভাষ্য ও মৌখিক লোকসাহিত্য ছিল সাহিত্যের উপজীব্য৷ প্রাক পুশকিন পর্বে রুশ সাহিত্য ছিল ইউরোপীয় সাহিত্যের নির্জীব অনুকরণ মাত্র৷ ফরাসি সাহিত্যের যৌনতা, জার্মান সাহিত্যের মানবতাবাদী মরমিবাদ ও ইংরেজ রোমান্টিকতার ছাপ ছিল রাশিয়ার আত্মপরিচয়হীন সাহিত্যে৷ সেই সাংস্কৃতিক সংকটের সময় পুশকিন রাশিয়ার পাঠককে উপহার দেন তাঁর অমর সৃষ্টি ইউজিন ওনিজিন কাব্য৷ ওনিজিন রুশ সাহিত্যের সেই চরিত্র যাকে দস্তয়েভ্স্কি আখ্যায়িত করেছেন রাশিয়ার চিরন্তন নায়ক, জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতীক৷ ওনিজিনের শুভ বোধ, বিবেকী মন, অনিকেত অস্তিত্ব চেতনা থেকে জন্ম নিয়েছে আধুনিক রুশ সাহিত্যের আদর্শ চরিত্র৷ পুশকিনের প্রতি তাই দস্তয়েভ্স্কির অকুণ্ঠ ঋণ স্বীকার৷
বঙ্গদেশে দস্তয়েভ্স্কির বিশেষ জনপ্রিয়তার কারণ ব্যাখ্যা করা মুশকিল৷ দস্তয়েভ্স্কির রাজনৈতিক মানস ছিল রক্ষণশীল, খ্রিস্টধর্ম চেতনা ছিল প্রবল - যা বাঙালির তর্কপ্রবণ প্রগতিবাদী সত্তায় খুব একটা সায় দেয় না৷ তাছাড়া টলস্টয়, যাঁর রচনা ও দর্শন রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধিজিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, যিনি প্রতিভা ও সৃষ্টির বিচারে শেক্সপিয়ারের সঙ্গে তুলনীয় হয়ে থাকেন - অনায়াসে হতে পারতেন এ বাংলার বহুল পঠিত লেখক, কিন্তু হননি - হয়েছিলেন ফিয়োদর দস্তয়েভ্স্কি৷ সম্ভবত ইংরেজিভাষী বিশ্বে - ইংল্যান্ডে, সাধারণ পাঠকের দস্তয়েভ্স্কি প্রীতি বাঙালি পাঠককে তাঁর সম্পর্কে কৌতূহলী করেছিল৷ বিশ শতকের প্রথম দিকে ইংল্যান্ডে রুশ সাহিত্যের খুব সমাদর ছিল৷ ওস্কার ওয়াইল্ড থেকে ডি.এইচ. লরেন্স, কনরাড থেকে জেমস জয়েস, অল্ডাস হাক্সলি সকলে রুশ সাহিত্যের শ্রেয়তা স্বীকার করেছেন৷ ইংরেজ পাঠকের কাছে রাশিয়ার সাহিত্য পড়া উন্নত রুচির পরিচায়ক ছিল৷ কিংবদন্তি হাসির লেখক পি.জি. উডহাউসের Jeeves and the Feudal Spirit উপন্যাসে শিক্ষিত খানসামা জিভ্স তার মনিব বার্টি উসটারকে শোনায়, তার রাশিয়ার উপন্যাস বিশেষত দস্তয়েভ্স্কি পড়ার বিশেষ আসক্তি আছে৷
দস্তয়েভ্স্কি রুশ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার৷ পাঠক তাঁর গল্পে ক্ষণিকে আবিষ্ট হয়ে পড়েন, কারণ তাঁর আখ্যানের সুডৌল গ্রন্থন, চরিত্র চিত্রণে উদ্ভাবনী বৈচিত্র্য ও মৌলিকত্ব৷ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয় মানুষের প্রবৃত্তি, তার বেআব্রু মনোজগৎ, শুভ-অশুভ দ্বন্দ্ব ও আধুনিক জগতে নৈতিক অবস্থান৷ দস্তয়েভ্স্কির উপন্যাসশৈলী ও শিল্পচেতনা যাঁরা অনুধাবন করেছেন, অনেকের বিচারে তিনি ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের সঙ্গে তুলনীয়৷ ডিকেন্সের মতো সমাজের নীচু তলার দরিদ্র ও উপেক্ষিত মানুষের প্রতি দস্তয়েভ্স্কির সহানুভূতি তাঁর শিল্পচেতনার অন্যতম প্রেরণা৷
দস্তয়েভ্স্কির আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র ষাট বছর (১৮২১-১৮৮১)৷ আজীবন ব্যাধিগ্রস্ত তাঁর জীবনে দুঃস্বপ্ন ছিল অনিরাময়যোগ্য মৃগীরোগ৷ অনেকে মনে করেন তাঁর এই ব্যাধি একদিকে শাপে বর হয়েছিল৷ রোগের প্রত্যাঘাত থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পর বিদ্যুৎ চমকের মতো দেখা দিত কল্পনা ও সৃষ্টিভাবনার বিচিত্র দিগন্ত৷ দস্তয়েভ্স্কির অভিজাত বংশের গৌরব ছিল না টলস্টয়ের মতো৷ চরিত্ররা তাঁরই মতো মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে উঠে আসা, যেখানে ভিড় করে আছে - ছাত্র, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মচারী - রাশিয়ার সুবিশাল প্রান্তরভূমির গ্রামজীবন নয়, তাঁর গল্প উপন্যাসের পটভূমি শহর মূলত মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গ৷ মেধাবী ছাত্র দস্তয়েভ্স্কি ছিলেন মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কৃতী ছাত্র৷ তবু বাধ্যতামূলক দূই বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করে তিনি সেখান থেকে ইস্তফা দেন - লক্ষ্য আর স্বপ্ন ছিল লেখক হওয়ার৷ দস্তয়েভ্স্কির উপন্যাসের সংখ্যা বারো, তার সঙ্গে যুক্ত চার ছোটো উপন্যাস (novella) মোট ষোলো৷ এদের মধ্যে তিনটি উপন্যাস Crime and Punishment, The Idiot ও Brothers Karamazov সর্বাধিক আলোচিত, প্রশংসিত - বলা যায় লেখকের অমরত্ব নিশ্চিত করেছে৷
দস্তয়েভ্স্কির সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী উপন্যাস --- Brothers Karamazov তাঁর জীবনের সেরা রচনা৷ টলস্টয়ের War and Peace ততদিনে বিশ্ববিখ্যাত৷ ওই উপন্যাসের কথা ভেবে দস্তয়েভ্স্কির ইচ্ছে ছিল পাঁচ পর্বে তাঁর উপন্যাসের কাহিনি পরিসরকে বিস্তৃত করতে৷ শেষে দুই পর্বে প্রায় নয়শো পৃষ্ঠার এক ঠাসবুনোট থ্রিলারের মতো গতিময় এক পরিবার কাহিনি Brothers Karamazov পাঠকের কাছে পৌঁছোলো৷ তর্কসাপেক্ষে এই উপন্যাস দস্তয়েভ্স্কির শ্রেষ্ঠ রচনা৷ আয়ুসীমার শেষে লেখক তাঁর না-বলা ভাবনা ও কথা সব ব্যক্ত করেছেন যেন৷ Brothers Karamazov লেখকের সারাজীবনের আচ্ছন্ন অন্বেষণ, শুভ ও অশুভের দ্বন্দ্বের নিরীক্ষা, তাঁর ধর্ম ভাবনা, আত্মার সংকট ও মুক্তির কথা৷ প্রায় পঞ্চাশটি চরিত্রের ভিড়ে মূল কাহিনি বিস্তৃত হয়েছে বিভিন্ন উপকাহিনিতে৷ উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রগুলি রাশিয়ার সমাজ ও ব্যক্তি মানসের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলিত রূপ৷
উপন্যাসের মূল কাহিনি সংক্ষেপে এই : কারামাজভ পরিবারের প্রধান ফিয়োদোর পাভলোভিচের চার পুত্র৷ তার প্রথম স্ত্রী অ্যাডেলাইভার একমাত্র পুত্র দিমিত্রি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা৷ দ্বিতীয় স্ত্রী সোফিয়ার দুই পুত্র, মধ্যম জন আইভান ও তৃতীয় আলেক্সিস বা আলিওশা৷ চতুর্থ সন্তান স্মারডিয়াকভ যে stinky নামে নিন্দিত - ফিয়োদরের জারজ সন্তান, পারিবারিক ভৃত্য৷
ফিয়োদোর পাভলোভিচ কারামাজভ এক ছোটো প্রাদেশিক শহরের ভূ-স্বামী - অভিজাতদের জাতে উঠতে না পারলেও যথেষ্ট বিত্তশালী৷ তার বিশৃঙ্খল জীবন কেটেছে যৌনাচার ও ভাঁড়ামিতে৷ কৃপণ ও পুত্রদের প্রতি উদাসীন পাভলোভিচ বড়ো ছেলে দিমিত্রির প্রতি ক্ষুব্ধ কারণ সে বাবার কাছে তার বিচ্ছেদ নেওয়া মা-র পারিবারিক প্রাপ্য অর্থ চায়৷ পাভলোভিচ দিমিত্রিকে টাকা দিতে অস্বীকার করে৷ দিমিত্রির বয়স সাতাশ৷ পাভলোভিচের আর দুই পুত্র আইভান ও আলেক্সি স্বভাবে আচরণে সম্পূর্ণ বিপরীতে৷ আইভান ইউরোপপ্রেমিক উচ্চশিক্ষিত, নেতিবাদী, দর্শন ও সাহিত্যের ছাত্র৷ আলেক্সি বিনয়ী নম্র গভীর ধর্মানুরাগী, স্বদেশের প্রতি সমর্পিত প্রাণ৷ আইভান মধ্যযুগের স্পেনের খ্রিস্ট বিরুদ্ধ, অপরাধ সন্ধানী যাজকের প্রশংসা করে কবিতা লিখতে চায়৷ ক্ষমাসুন্দর খ্রিস্টের আদর্শ তার নয়৷ আইভান এক পতিত আত্মা, অ্যালেক্সি করুণার আর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দিমিত্রি শুভ ও অশুভ বোধের দ্বন্দ্বে এক বিক্ষত প্রাণ৷ গূঢ়ার্থে দিমিত্রি তার চরিত্রের স্ববিরোধিতা নিয়ে সমগ্র রাশিয়ার প্রতীক৷
অ্যালেক্সির ধর্মগুরু ফাদার জোশিমা দিমিত্রি ও তার বাবা ফিয়োদরের তিক্ত সম্পর্কের নিরসনে মধ্যস্থতা করতে আসেন৷ ফিয়োদর রাজি হয়, তবু পুত্রের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে আর ফাদার জোশিমাকে তাচ্ছিল্য৷ ফাদার রুষ্ট না হয়ে পাভলোভিচ ও তার নাস্তিক পুত্র আইভানকে শোনান কিছু অপ্রিয় সত্য৷ দিমিত্রির জন্য বলেন তার দুঃখ, যন্ত্রণার জীবন অনিবার্য৷ শেষে জোশিমা অ্যালেক্সিকে বলেন, ধর্মশালার নির্জনবাস ছেড়ে জীবনের যুদ্ধে অংশ নিতে - তার ভ্রষ্ট ভাইদের রক্ষার প্রয়োজনে৷
দিমিত্রি তার বাবার মতোই উচ্ছৃঙ্খল ও নারী অভিলাষী, যদিও বাবার মতো সে ব্যাভিচারী নয়৷ সে মানসিক শক্তি পেয়েছে তার মায়ের৷ কৃপণ পাভলোভিচ দিমিত্রিকে তার মায়ের টাকা দিতে অস্বীকার করলে দিমিত্রি ধনী কলোনেলের কন্যা ক্যাটেরিনার সঙ্গে বিবাহে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়৷ দিমিত্রি কিন্তু ক্যাটেরিনাকে নয়, গ্রুশেঙ্কাকে ভালোবাসে যার সঙ্গ তার বাবা ফিয়োদরও কামনা করে৷ দিমিত্রি ক্যাটেরিনার কয়েক হাজার রুবল নিয়ে গ্রুশেঙ্কার সঙ্গে পালিয়ে যায়, সে সব ব্যয় করে মত্ত আনন্দে৷ তারপর ছোটোভাই আলেক্সিকে অনুরোধ করে বাবাকে বলে তার মা-র টাকা ফেরত দিতে৷ কারণ ক্যাটেরিনাকে তার ঋণের অর্থ ফেরত দিতে হবে৷ দিমিত্রি একদিন গ্রুশেঙ্কাকে বাবার ঘরে খুঁজে পেতে পারে, এই সন্দেহে ফিয়োদোরকে আক্রমণ করতে চায়৷ নিজের বাবার অধঃপতিত চরিত্র সে মেনে নিতে পারে না৷ আলেক্সি ইতিমধ্যে ক্যাটেরিনাকে বলে গ্রুশেঙ্কাকে কিছু টাকা ঘুষ দিতে যায়, যাতে সে দিমিত্রির সংস্রব ত্যাগ করে৷ এদিকে আইভান ভালোবাসে ক্যাটেরিনাকে৷ ক্যাটেরিনা দিমিত্রিকে ভালোবাসে, আইভানকে নয়৷ আইভান চায় দিমিত্রি গ্রুশেঙ্কাকে বিয়ে করুক - তখন ক্যাটেরিনাকে পেতে অসুবিধে হবে না৷ আইভানের প্রস্তাব ক্যাটেরিনা প্রত্যাখ্যান করে৷ প্রত্যাখাত-র বেদনা নিয়ে তবুও আইভান ক্যাটেরিনাকে গভীর ভালোবাসে৷ গ্রুশেঙ্কাকে ঘিরে পিতা-পুত্র ফিয়োদোর ও দিমিত্রির তিক্ত সম্পর্ক সহিংস পরিণতির দিকে যেতে থাকে৷ দিমিত্রি বাবাকে হত্যা করতে যায়৷ আক্রান্ত হয় বাড়ির পুরোনো ভৃত্য, ফিয়োদোর প্রাণে বেঁচে যায়৷ কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে ফিয়োদোরকে কেউ হত্যা করে - সেইসঙ্গে তার সমস্ত অর্থও চুরি হয়ে যায়৷ পুলিশ দিমিত্রিকে ফিয়োদোরের ঘাতক মনে করে গ্রেফতার করে৷ দিমিত্রি বলে সে নির্দোষ - বাবার খুনী নয়৷ ইতিমধ্যে স্মারডিয়াকভ - বাড়ির চাকর, ফিয়োদোরের জারজ সন্তান আইভানকে জানায় সে ফিয়োদোরকে খুন করেছে৷ সে এমন সময় ঘটনাটি ঘটিয়েছে যাতে দিমিত্রি অভিযুক্ত হয়৷ ফিয়োদোরকে হত্যার প্ররোচনার জন্য স্মারডিয়াকভ আইভানকে দায়ী করে৷ কারণ আইভান তার কাছে বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ করত যে বাবা ফিয়োদোর পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে পরিবারে শান্তি আসবে৷ ফিয়োদোরের চুরি যাওয়া টাকা স্মারডিয়াকভ আইভানকে ফেরত দেয়৷ অনুশোচনায় দগ্ধ আইভান প্রলাপ বকতে থাকে যে সে শয়তানের আত্মাকে ধারণ করে আছে৷ স্মারডিয়াকভ আত্মহত্যা করে৷ দিমিত্রি ও গ্রুশেঙ্কার প্রেমে ঈর্ষান্বিত ক্যাটেরিনা দিমিত্রির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চায়৷ সে পুলিশকে দেখায় দিমিত্রির তাকে লেখা একটি চিঠি যেখানে দিমিত্রি ক্যাটেরিনাকে জানায় তার পিতাকে হত্যা করার ইচ্ছে৷ সে কাজ সম্পন্ন হলে তার মায়ের অর্থ পেতে আর বাধা থাকবে না৷ আর সে টাকা ক্যাটেরিনাকে ফেরত দিয়ে সে ঋণমুক্ত হতে চায়৷ দিমিত্রি যে পিতৃহন্তা - এ চিঠি তার প্রমাণ৷ দিমিত্রি গ্রেফতার হয়৷ বিবেকের দংশনে প্রায় অপ্রকৃতিস্থ আইভানের প্রলাপ কথনে স্বীকারোক্তি দাদা দিমিত্রিকে বাঁচাতে পারে না৷ কিন্তু দিমিত্রি সম্পূর্ণ নির্দোষ - ফিয়োদোরের খুনী স্মারডিয়াকভ৷ যদিও দিমিত্রি খুনী নয় তবু তার উচ্ছৃঙ্খল পাপদগ্ধ জীবনের প্রায়শ্চিত্ত করতে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন অক্লেশে মেনে নেয়৷ ক্যাটেরিনা অ্যালেক্সি ও গ্রুশেঙ্কার সামনে দিমিত্রির কাছে ক্ষমা চায়৷ সম্পূর্ণ কলুষমুক্ত, কোমল প্রাণ দরদি মানবপ্রেমিক অ্যালেক্সি দাদা দিমিত্রির সঙ্গে সাইবেরিয়ায় স্বেচ্ছা নির্বাসনে সহযোগী হয় - পদচিহ্ণ রেখে যায় আগামী প্রজন্মের রাশিয়ার নাগরিকের প্রতীক হয়ে৷
Brothers Karamazov উপন্যাসের দুটি ঘটনায় দস্তয়েভ্স্কির জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে৷ এক, পিতৃহত্যার প্রশ্ন৷ দস্তয়েভস্কির কৈশোরের অন্যতম বেদনাবহ ঘটনা ভৃত্যদের আক্রমণে তাঁর পিতার মৃত্যু৷ যদিও উপন্যাসে পিতৃহত্যার প্রসঙ্গটি উচিত-অনুচিতের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা৷ দস্তয়েভ্স্কির অভিজ্ঞতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন৷ দ্বিতীয়ত, যৌবনে দস্তয়েভ্স্কি একটি উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদী, পশ্চিমী সংস্কৃতি বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে জার কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন৷ শেষে জারের আদেশে মৃত্যুর শাস্তি থেকে রেহাই পেলে তাঁকে কয়েক বছর সাইবেরিয়ায় কারাবাস জীবন কাটাতে হয়৷ বিবেচনাহীন, হঠকারী জার বিরোধিতার জন্য কারাবাসকে তিনি উচিত শাস্তি মনে করেছিলেন৷ তিনি যেন রাশিয়ার কোনো এক দিমিত্রির আত্মার মুক্তির জন্য প্রায়শ্চিত্ত করেছেন৷ দস্তয়েভ্স্কির ধর্মভাবনা উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ লেখক দিমিত্রি চরিত্রকে দেখেছেন সমসাময়িক রাশিয়ার এক স্খলিত মানব - পাপ-পুণ্যের দ্বন্দ্ব চেতনায় যার নিরন্তর অন্তর্দহন৷ দস্তয়েভ্স্কি তাঁর চরিত্রদের যাপনের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন৷ তবে তাদের কর্মের নৈতিক দায়িত্ব স্কন্ধে চাপিয়েছেন৷ খ্রিস্ট তাঁকে মুক্ত ইচ্ছাধীন জীবনের বোঝা বহন করতে বলেছেন নৈতিক কর্তব্যজ্ঞানে৷ ক্যাথলিক চার্চে যাজকের উপযাচকতার বিধান - পাপীর পাপমুক্তি ব্যবস্থায় যাজকতন্ত্রের মতো সবরকম কল্যাণকামী স্বৈরতন্ত্রের, এমনকি সমাজবাদেরও তিনি বিরোধিতা করেছেন, যা মানুষের মুক্ত ইচ্ছাধীন জীবনকে শৃঙ্খল পরাতে চায়৷
দস্তয়েভস্কির মানবের এই মুক্ত স্বেচ্ছাধীন জীবন তুর্গেনিভের নৈরাজ্যবাদে রাষ্ট্র ও সমাজের নিয়ন্ত্রণ কে যে অমান্য করার কথা বলে - তার সঙ্গে তুলনীয় নয়। দস্তয়েভস্কির দেশের সমাজ, সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল, জাতীয়তাবাদী মন ছিলো - 'ব্রাদার্স কারামাজভে' ছোট ভাই আলেক্সির মতো। তবে নৈতিক নৈরাজ্যবাদের তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন। দার্শনিক কান্টের নৈতিক বিশ্বের স্বতঃসিদ্ধ অস্তিত্ব কে তিনি মানতেন। অবশ্য সেই নৈতিকতাকে লেখক গোঁড়া রুশ চার্চের খ্রিস্টবাদে রঞ্জিত করেছেন।
দস্তয়েভস্কি তাঁর দুই উপন্যাস Crime and Punishment ও Brothers Karamazov এ স্খলিত মুখ্য চরিত্রদের মুক্তিলাভের পথ দেখিয়েছেন দুই ভাবে। Crime and Punishment এ রাসকলনিকভ বুঝেছে , পার্থিব নৈতিকতার ঊর্ধ্বে থাকা মহাজাগতিক করুণার প্রতিমূর্তি সোনিয়ার সান্নিধ্যই তাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে এ জীবনে। সোনিয়ার মতো করুনাময়ী নারী Brothers Karamazov এ নেই, আছে ভোগবাদী রক্ত মাংসের ক্যাটরিনা ও গ্রুশেঙ্কা, যারা ভ্রষ্ট দিমিত্রির পরিত্রাতা হবার যোগ্য নয়। স্বেচ্ছা নির্বাসনের নিঃসঙ্গ দহনে দিমিত্রিকে শেষ জীবন কাটাতে হবে। তার পুনরুজ্জীবন হবে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। অপাপবিদ্ধ আলেক্সি বুঝেছে এই সত্য, তার সমবয়সী বন্ধুর করুণ মৃত্যুতে।