জেন অস্টেন : একালের মিলেনিয়াল আর জেন জ়েডদের চোখে

জেন অস্টেনের ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’ প্রথমবার পড়ার অভিজ্ঞতাখানা খুব একটা সুখকর ছিল না। বছরপাঁচেক আগে প্রথমবার পড়তে বসে দেখি, পুচকে পুচকে দুটো মেয়ে বিয়ের চিন্তায় চুল ছিঁড়ছে। একজনের বয়েস ষোলো, আরেকজনের বয়েস উনিশ। ষোলো বছর বয়েসে আমার বিয়ে তো দূরের কথা, কোচিং ক্লাসের ছেলেপিলেরা উড়ো টেক্সট করলে মা ডিরেক্ট স্যারের কাছে নালিশ ঠুকে সে হতভাগ্যদের সর্ষেফুল দেখিয়ে দিতেন। আর উনিশে? সুন্দরপানা দাদাদের অ্যাটেনশন পেতে মন্দ লাগতো না, তবে বিয়ে? ফুঃ। কিন্তু ওই বইটার মেয়েদুটোকে দ্যাখো তো, খেয়েদেয়ে কাজ নেই, পরিপাটি পুতুলটি সেজে ‘প্লিজ আমায় কেউ বিয়ে করে উদ্ধার করো’ টাইপ চলতি-ফিরতি বিজ্ঞাপন হয়ে ঘুরছে। ভারী বিরক্ত হয়ে পুরো গল্প শেষ না করেই বইটাকে শেলফের অতি গভীরে ধুলো খেতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।

মাসদেড়েক আগে নিতান্তই বাধ্য হয়ে বইটা ধুলো ঝেড়ে বের করতে হল। যে কাজে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, সে কাজে আমার ভারী আলসেমি। বই চিৎপাত হয়ে রইল পড়ে, আমি আমার মতো খাচ্ছি ঘুরছি ফিরছি। অন্যস্বর পত্রিকা থেকে বলেছিলেন, পুজোর পর লেখা দিতেই হবে। পুজো আসতে ঢের দেরি। বই বাইরে শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। একদিন দেখে ভারী রাগ হল। এই হতকুচ্ছিত উপন্যাসখানা চটপট শেষ করে একে চোখের সামনে থেকে দূর করতেই হবে। পাতাগুলো অগোছালো ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে চোখটা আটকে গেল, ষোড়শী মারিয়ান বলছে "The more I know of the world, the more I am convinced that I shall never see a man whom I can really love. I require so much!" এ তো একদম আমার, মানে আমাদের মনের কথাটি। ষোলো বছরের সে খুকিটি কি এমন দেখে ফেলল, যে এমন পাকাবুড়ির মতো করে ভাবছে! সময়ের প্রেক্ষাপট ১৮১১, তবু কি চমৎকার ভাবে মিলে যায় আমাদের মতো মিলেনিয়াল বা জেন জ়েড-এর সঙ্গে। আমারই বন্ধুবর্গে এমন কতিপয় শিশুসুলভ নারী আছেন, যাঁদের তিনমাসে চারটে ব্রেকআপ হয়, এবং প্রতিটি ব্রেকআপের পর পাবে বসে পাঁচনম্বর বিয়ারের বোতলটা খুলে প্রায় একই ডায়লগ বলতে শোনা যায়—“শা* দুনিয়াটা যত দেখছি না, ঘেন্না ধরে যাচ্ছে ভাই! আমি বুঝে গেছি, ওসব প্রেমফেম আমার দ্বারা হবে না। আই লাইক মাই লাইফ টু বি আ লিইইইইটল একস্ট্রা! ছেলেগুলো আমায় বোঝেই না!” অবিকল মারিয়ান।

এরপর ঝাড়া তিনটে দিন লাগল উপন্যাসটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য। আর পড়ার পর? স্বয়ং অস্টেনের কথাই ধার করে বলা যাক, ‘If a book is well written, I always find it too short.’ সর্বসাকুল্যে তেতাল্লিশখানা অধ্যায় জুড়ে রোমান্স, আঠেরো শতকীয় সমাজের উদ্ভট সব চাহিদা আর সেই চিরকালীন সারকথাটি— ‘পয়সা না থাকলে প্রেম জানলা গলে পালায়!’ এলিনর এবং মারিয়ান দুই বোন— এবং চরিত্রগতভাবে একজন সাউথ পোল, অপরজন নর্থপোল। বছর উনিশের এলিনর ধীরস্থির, সংযমী, ভীষণ প্র্যাক্টিকাল। আবেগে দুম করে ভেসে যাওয়ার মেয়ে সে নয়। ষোড়শী মারিয়ান প্রচণ্ড আবেগী, ইমপালসিভ, জেদী একরোখা মেয়ে। অনেকটা যেন সেই পাবে বসে গ্লাসের পর গ্লাস বিয়ার ওড়ানো মেয়েটির মতোই, যার জীবনেও একের পর এক ভুলভাল উইলোবি-রা এসে একটু একটু করে তার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়ে গেছিল। শুনেছি, এখন সে বেশ খানিকটা থিতু হয়েছে, হয়তো বা এসেছে তার পারফেক্ট কর্নেল ব্র্যান্ডন। পুরো উপন্যাস জুড়েই যুক্তি ও আবেগের টানাপোড়েন, আর ক্ষণে ক্ষণেই একটা অস্বস্তিকর খোঁচাদায়ক প্রশ্ন মাথায় ঘুরেফিরে আসতে থাকে, ‘তবে কি টাকাই সব? হৃদয়টিদয় সব বকওয়াস?’ আঠেরো শতকের ইংল্যান্ডের বদলে এ যদি হত উনিশ শতকের কলকাতা, অনেকটা একই ছবি কি দেখা যেত না? মেয়ের বাবা কত ভরি সোনা দিচ্ছেন সেইটিই তখন সুলক্ষণ বিচারের একমাত্র মানদণ্ড। এ শতকেও খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা থাকে ‘পাত্র সরকারি চাকুরে হতে হবে’। ওই যে শুরুতেই বলছিলাম না আমার শিশুসুলভ বান্ধবীদের কথা, তাঁরা প্রত্যেকে বাজারচলতি ডেটিং অ্যাপগুলিতে জাঁকিয়ে বসে রয়েছেন। কার সঙ্গে পরবর্তী ডেটে যাবেন, সেইটি ঠিক করা হয় বেশ কিছু প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে। ‘ডু য়্যু ড্রাইভ?’— এর অন্তর্নিহিত অর্থটি হল, ‘বাপু, তোমার গাড়িফাড়ি আছে তো? নাকি ভাঁড়ে মা ভবানী? গরিব হা-ঘরের সাথে আমি কফি খাই না!’ ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’—তেও খানিক অমনই সুর। বাবা মারা গেছেন, পথে বসেছে দুই বোন। আঠেরো শতকের ইংল্যান্ডে অভিজাত পরিবারের কন্যেরা তখনও নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখেননি। অগত্যা বিয়ের পিঁড়ি থুড়ি অল্টারেই উঠতে হবে এলিনর ও মারিয়ান-কে। তাই খোঁজ, খোঁজ, বর খোঁজের পালা। ওসব ভালোবাসাটাসা কিসসু নয়, মাথার ওপর ছাদটা আশু প্রয়োজন। এলিনরের অবশ্য ভালো লেগে গেছে এডওয়ার্ড ফেরার্সকে এবং সে মনেপ্রাণে চাইছে তাদের যে নুন আনতে পান্তা ফুরোনো দশা এ খবরটি যেন চাপাই থাকে নচেৎ এডওয়ার্ড ফস্কে যাবে। ওদিকে মারিয়ানের সঙ্গে মুলাকাৎ হয়েছে জন উইলোবি-র এবং প্রথম দর্শনেই মারিয়ান কুপোকাত। জন উইলোবি সত্যিই দর্শনধারী, গুণপনার মধ্যে সে বেশ মিষ্টি কথা বলতে পারে, কাব্যিটাব্যি পড়েছে আর আলগা পিরিতে তার পিএইচডি করা আছে। ষোলো বছরের মারিয়ান তাতেই মজেছে আর উইলোবিকেই সে ভেবে বসেছে তার স্বপ্নের রাজপুত্তুরটি। উইলোবি ব্যাটাও কম যায় না। মারিয়ানের পা মচকেছে, সটান তাকে কোলে তুলে চলল কোরিয়ান ড্রামার হিরো-র মতো। আদিখ্যেতা! জন উইলোবির বরাবরের নজর টাকার দিকেই, যখন তার মালুম হল মারিয়ানকে ঘরণী করলে পকেট গড়ের মাঠই থাকবে, তখনই পাখি ফুড়ুৎ! এই ছেলেটিই হচ্ছে একজন আদর্শ গোল্ড ডিগার।

    

ইংল্যান্ডই হোক বা আমাদের কলুটোলা লেন— মেধা, সৌন্দর্য সবই বিকিয়ে যেত কানাকড়িতে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বাদ থেকে দু’দেশের মেয়েই ছিল বঞ্চিত গোবিন্দদাস। বাবার সম্পত্তির সবটুকুই সরকারি নিয়মমাফিক সৎভাইয়ের দখলে চলে গেলে এলিনর, মারিয়ান-কে বাধ্য হয়েই নিজেদের রাস্তা নিজেদেরই দেখে নেওয়ার চেষ্টা করতে হয়। তাদের একমাত্র ধ্যান জ্ঞান হয়ে ওঠে, এমন কাউকে বিয়ে করতে হবে যার নিজের টাকার অভাব নেই এবং যে মনের দিক থেকেও বেশ ধনবান। এদেশেও মেয়ের বিয়ে স্বচ্ছল পরিবারে দিয়ে উঠতে না পারলে মা-বাবাদের মাথায় হাত পড়ে যেত, বা, এখনও যায়! এখন অতটা না হলেও দু-তিন দশক আগে পর্যন্তও বিবাহযোগ্যা অবিবাহিতা মেয়েদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করার লোকের অভাব ছিল না। যেন তেন প্রকারে সাততাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, যাতে বাকি জীবনটা একপাল বাচ্চাকাচ্চা সামলাতে সামলাতে আর হেঁশেলে খুন্তি নাড়তে নাড়তে ‘মহাসুখে’ কাটাতে পারে! ‘মেয়েরা কুড়ি পেরোলেই বুড়ি’ এমনধারা ছেঁদো কথার আঁতুড়ঘর এই মানসিকতাই। সেদিক থেকে দেখতে গেলে অস্টেনের হিরোইনরা কিঞ্চিৎ ভাগ্যবতী। বাঙালি মেয়েগুলো যেখানে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে বাপ-কাকার হাতে নিজের ভূত-ভবিষ্যৎ সমর্পণ করে বসে আছে, সেখানে অস্টেনের নায়িকারা সেজেগুজে পার্টি অ্যাটেন্ড করছে, ড্রয়িংরুমে ফিল্মি স্টাইলে প্রেমে পড়তে পারছে, ইচ্ছেমতো পছন্দসই পুরুষের সঙ্গে বাতচিত চালাতে পারছে। যদিও হরেদরে সবার দশাই এক, তবু বদ্ধ জীবনে এক চিলতে খোলা হাওয়ার আভাস— এই বা কম কী?

অস্টেনের উপন্যাসই হোক বা এদেশের দেবযানী বণিক, অরুণিমা সিংহ— বিয়েটা ঠিক মিষ্টিমধুর না- ফুরনো স্বপ্নের মতো কখনই হয় না, হয় রূঢ় বাস্তব আর  দায়বদ্ধতার মেলবন্ধন। গৃহবধূ দেবযানী বণিক, ১৯৮৩। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মিলে খুন করেছিল, নেপথ্যে ছিল টাকাপয়সার সংঘাত। অরুণিমা সিংহ, ২০১৪। দেবযানীর মতোই তারও শ্বশুরবাড়ির লোক খুন করে সুইসাইড বলে চালিয়ে দেওয়ার মতলবে ছিল। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (NCRB)-র দেওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে, বিয়ের পণ-কে কেন্দ্র করে বছরে ৭০০০-৮০০০ গৃহবধূর হত্যা ও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে, Dowry Prohibition Act of 1961 এবং Section 498A কায়েম থাকা সত্ত্বেও গড়ে দিনে কুড়িটি করে মৃত্যু! দুটো দুই আলাদা মহাদেশ অথচ কি অদ্ভুত মিল! পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বিয়েই এই মেয়েগুলোর জন্য আর্থিক নিরাপত্তার একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। বাস্তববাদী এলিনর, যে কিনা উপন্যাসের ‘সেন্স’-এর প্রতীক, এই সারকথাটুকু বুঝেছিল অনেক আগেই। শুধুমাত্র ভালোবাসা তাকে আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারবে না। অপরদিকে ‘সেন্সিবিলিটি’র প্রতীক মারিয়ান স্রেফ আবেগের বশে জড়িয়ে পড়ে একজন আদ্যন্ত ভুল মানুষের সঙ্গে।

তাই আঠেরো শতকের অমন বিচ্ছিরিরকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আটকে পড়া এলিনর, মারিয়ানদের ওপর না চাইতেও করুণা হয়। পাশাপাশি মনে পড়ে যায়, রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী, নিরুপমা-দের।