সত্যজিতের ফেলুদা কাহিনী : প্রসঙ্গ সঙ্গীত

চলচ্চিত্র নির্মাতা না হলে সঙ্গীতস্রষ্টা হতেন - এমনটাই বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়। মূলত সন্দেশ পত্রিকার পুনরুজ্জীবনের জন্য যে গোয়েন্দা চরিত্র “ফেলুদা”র সৃষ্টি তার কাহিনী ক্রমে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম রহস্য সিরিজে পরিণত হয়েছে। পাঠকের ফেলুদা অভিযানের অন্যতম দোসর সঙ্গীত। আশৈশব দেশীয় ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন যে লেখক-ছবিনির্মাতা তার সৃষ্টিতে সঙ্গীতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব নানা মাত্রায় এসেছে। ব্রাক্ষ্মসমাজের গান, রবীন্দ্রনাথের গান, বিদেশী অপেরা, পাশ্চাত্য ধ্রুপদী যন্ত্রসংগীত ও কন্ঠসঙ্গীতে গভীরভাবে নিমগ্ন সত্যজিৎ বারবার সেই অতল সমুদ্র ঠেলে মণিমাণিক্য তুলে এনে কিশোর সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। গোয়েন্দা প্রদোষ চন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদার সুত্রে পাঠক  আমাটির বেহালা, নেপালের সারিন্দা, নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের লেখা গান, রামপ্রসাদী সুর, আখতারি বাই, বাদ্যযন্ত্র নির্মাতা স্পিগলার কোম্পানি ইত্যাদি নানা সাঙ্গীতিক সংসর্গের সাথে পরিচিত হয়েছে। ১৯৭৪ সালে নির্মিত ফেলুদা-ছবি “সোনার কেল্লা” ও ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত “জয় বাবা ফেলুনাথ” ছবি দুটিতে মূল কাহিনীর বাইরে চিত্রনাট্যে বৈচিত্রপূর্ণ সঙ্গীত সমাবেশ ঘটেছে। বইয়ের স্থির পাতা থেকে ছায়াছবির চলমানতায় রহস্যকাহিনীর অজানা উত্তেজনার টানটান মুহূর্তে স্বরচিত আবহসঙ্গীতের প্রয়োগ ও ফেলুদা থিম মিউজিকের প্রবর্তন বাংলা ছায়াছবির ইতিহাসে অন্যতম মাইলফলক।

১৯৬৫ সালের সন্দেশ পত্রিকায় ডিসেম্বর সংখ্যায় “ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি”র প্রথম কিস্তি প্রকাশিত হয়। ১৯৬৬-৬৭ সালে প্রথম ফেলুদা উপন্যাস “বাদশাহী আংটি” সন্দেশেই প্রকাশিত হয়। লক্ষ্ণৌর পটভূমিতে লেখা এই কাহিনীতে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের প্রসঙ্গে তার লেখা গানের কথা প্রায় ক্লাইম্যাক্সের কাছাকাছি এক সময়ে ফেলুদা বলেন। লখনৌ ছেড়ে হরিদ্বারের পথে চলেছে ফেলুদা, তোপসে, তোপসের বাবা, বনবিহারী বাবু, শ্রীবাস্তব এবং একজন ছদ্মবেশী সন্ন্যাসী। ফেলুদা জানালার বাইরে তাকিয়ে ট্রেনের তালে তালে গান ধরেন -

যব ছোড় চলে লখনৌ নগরী

তব হাল আদম পর ক্যা গুজরী

নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের লেখা গান ফেলুদার মুখে শুনে অবাক সবাই।

বনবিহারী বাবুর প্রশ্নের উত্তরে ফেলুদা জানান যে তার এক জ্যাঠামশাই যিনি খুব ভালো ঠুংরী গাইতেন তার সূত্রে তিনি গানটি জানেন। বনবিহারী বাবু তারপর বলেন,” আশ্চর্য নবাব ছিলেন ওয়াজিদ আলি। গাই গাইতেন পাখীর মতো। গান রচনাও করতেন। ভারতবর্ষে প্রথম অপেরা লিখেছিলেন একেবারে বিলিতি ঢং-এ।”

ঠুংরীর কথা ফেলুদার গল্পে আরো অন্তত দুবার এসেছে। “টিনটোরেটোর যিশু”র গল্পের শুরুতে ঠুংরীর মৃত্যুর কথা জানা যায়। সংগীত প্রিয় সৌম্যশেখরের পোষা দুটি ফক্স টেরিয়ারের ঠুমরি ও কাজরি। এই ঠুমরির মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে ফেলুদা বৈকুন্ঠপুরের নিয়োগী বাড়িতে আসেন। “জয় বাবা ফেলুনাথ” ছবির শুরুতে উমানাথ ঘোষালের অনুরোধে তাদের বাড়ি গিয়ে সিঁড়িতে উঠতে উঠতে ফেলুদার কানে  আসে গ্রামোফোন রেকর্ডে বাজতে থাকা কেসরবাঈয়ের কন্ঠে “কাহে কো দারি” ঠুংরি। ভৈরবী রাগে নিবদ্ধ এই ঠুংরিটি ছাড়াও জোহরবাঈয়ের গাওয়া ঠুংরী এই ছবিতে শোনা যায়। সত্যজিৎ রায় নির্মিত দ্বিতীয় ফেলুদা-ছবি “জয় বাবা ফেলুনাথ” ছবির পটভূমিকা কাশী হওয়ার সুবাদে সঙ্গীতের বিপুল বৈচিত্র্যসম্পন্ন ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ঠুংরীর পাশাপাশি মছলিবাবার দরবারে রেবা মুহুরীর নেপথ্য কন্ঠে গাওয়া হয়েছে মীরার ভজন। মছলিবাবার হাতে বেমানান উল্কি দেখে সন্দিগদ্ধ ফেলুদা অন্য এক দিনে ঘাটের চাতালে দাঁড়িয়ে অন্য এক লোকের হাতে একই উল্কি দেখে চমকে ওঠেন। তাকে অনুসরণ করে পুরনো এক কেল্লার ভেতরে পৌঁছে তার গোপন ডেরার খোঁজ পান। সেই ডেরায় সুটকেসে রাখা ছদ্মবেশের সাজ সরঞ্জাম দেখে বুঝতে পারেন ইনিই আসলে ভন্ড সাধু।এই সময়ে আবহসঙ্গীতে বেজে ওঠে ভক্ত সমাবেশে শোনা মীরার ভজন। ঈশ্বরপ্রেমের সুর যেন এখানে অপরাধীর সূচক। ঘোষাল বাড়িতে আশ্রিত বিকাশ সিংহ জানিয়েছিল মগনলাল মেঘরাজের সাথে উমানাথের কথাবার্তার সময় সে রেডিওতে আখতারি বাঈয়ের গজল শুনছিল। ফেলুদা তদন্তে নেমে জানতে পারে যে সে মিথ্যা কথা বলেছে কারণ ওইদিন রেডিওতে গজল সম্প্রচারিত হয় নি।

১৯৭০ সালে সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত কলকাতার পটভূমিতে লেখা “শেয়ালদেবতা রহস্য” কাহিনীতে গান দোষী ধরার গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। প্রতুল দত্তের বাড়ি থেকে ফেরার পথে ছদ্মবেশী ফেলুদা শুনতে পায় ভিখিরি বালক রামপ্রসাদী সুরে গাইছে,

বল, মা তারা দাঁড়াই কোথা

আমার কেহ নাই শঙ্করী হেথা

রহস্য সমাধানে ফেলুদা যখন গভীর ভাবে মগ্ন তোপসে একই গান একই কন্ঠে আবার শুনতে পায়। তোপসেদের বাড়ি এসে সেই ভিখিরি বালকেরা যখন ভিক্ষা চাইল তাদের পয়সা দিতে গিয়ে তোপসে আবিষ্কার করে নীলমণি বাবুর ভাগ্নে ঝন্টুর সাথে ভিখিরি বালকের মুখে আশ্চর্য মিল আছে। কাহিনীর শেষে জানা যায় এই ঝন্টু আসলে একজন বামন যাকে ব্যবহার করে নীলমণি দত্ত শেয়াল দেবতা আনুবিসের মূর্তি চুরির গল্প ফেঁদেছিল। গানের চেনা সুর যেমন এই গল্পে অপরাধীর উপস্থিতি বুঝিয়ে দিয়েছে তার ঠিক উল্টো প্রয়োগে যন্ত্রসংগীতের সুরের পরিবর্তন দোষীদের গোয়েন্দা বা তার সহযোগীর অস্তিত্ব সম্বন্ধে সতর্ক করে দিয়েছে। ১৯৮০ সালে দেশ পত্রিকায় পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত” যত কান্ড কাঠমান্ডুতে” কাহিনীতে তোপসে আর আর জটায়ু পাটন শহরে ঘুরতে ঘুরতে সন্দেহভাজন একজনকে দেখে  তাকে ফলো করে একটি গলির মুখে পৌঁছে যায়। সেই গলির ডানে বসে এক ভিখিরি সারিন্দা জাতীয় যন্ত্রে নেপালি গৎ বাজাচ্ছিল। ভিখিরিকে পয়সা দিয়ে সাহস করে সেই গলি লাগোয়া বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে তোপসে আর জটায়ু শুনতে পায় সারিন্দার সুর পালটে গেছে।

”হঠাৎ খেয়াল হলো যে এর মধ্যে কখন জানি সারিন্দার সুর পালটে গেছে। আগেরটা ছিল করুণ, মোলায়েম ; এটা নাচানি হাল্কা সুর।” আর উল্টোদিক থেকে কেউ আসার পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। ঠিক এই সময়েই ওষুধের চোরাকারবারিরা তাদের আক্রমণ করেন।

কলকাতার পটভূমিতে লেখা  “বোসপুকুরে খুনখারাপি” ও “গোরস্থানে সাবধান” কাহিনীতে পাশ্চাত্যসংগীতের যন্ত্র ও যন্ত্রীর প্রসঙ্গ বিশেষভাবে এসেছে।

১৯৭৩ সালে দেশে প্রকাশিত ‘সমাদ্দারের চাবি” কাহিনীর রহস্যভেদের চাবিকাঠি আকারমাত্রিক স্বরলিপি। বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রাহক রাধারমণ সমাদ্দার তার সঞ্চিত অর্থ হারমোনিয়ামের মতো দেখতে এক অক্টেভের মেলোকর্ড নামক যন্ত্রে লুকিয়ে রেখেছিলেন। জার্মানির স্পিগলার কোম্পানিতে বিশেষ নির্দেশ দিয়ে এই যন্ত্রটি তৈরি করা হয়েছিল। মৃত্যুর আগে তিনি বলে যান,”আমার নামে চাবি”। ফ্রি স্কুল স্ট্রীটের সালদানহা কোম্পানির বাদ্যযন্ত্রের দোকান ঘুরে, ভারতীয় যাদুঘরের বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহ দেখে, কলেজস্ট্রিট থেকে কেনা সংগীতশিক্ষা বই পড়ে, পাশের বাড়ি থেকে আনা হারমোনিয়াম বাজিয়ে নানারকম চর্চা করে ফেলুদা ধরতে পারেন নামেই ইঙ্গিত আছে। আকারমাত্রিক পদ্ধতিতে আ-কার যোগ করে স্বর লেখা হয় এবং কোমল স্বর ও কড়ি স্বর বোঝাতে ভিন্ন বর্ণ বা যুক্ত বর্ণ ব্যবহার করা হয়। সেই অনুসারে মেলোকর্ডে রা(রে)-ধা(ধা)-র(রে)-ম(মা)-ণ(কোমল নি) স(সা)-মা(মা)-দ(কোমল ধা)-দা(কোমল ধা)-র(রে) বাজাতেই তার ডালা আশ্চর্যজনক ভাবে খুলে য্য আর তাতে রাখা নোটের তাড়া দেখা যায়। মেলোকর্ড ছাড়াও খামাঞ্চে নামে বাদ্যযন্ত্রের কথা এই কাহিনীতে জানা যায়। তার একটি ছবিও বইতে ছাপা হয়েছিল।

গোরস্থানে সাবধান(১৯৭৭) উপন্যাসে পুরনো কলকাতা নিয়ে উৎসাহী ফেলুদা ঘটনাচক্রে পার্কস্ট্রিট গোরস্থানে গিয়ে যে মানিব্যাগ খুঁজে পায় তার ভেতরে থাকা কাগজের সূত্রে সিধু জ্যাঠার মাধ্যমে টমাস গডউইনের কাসকেডের কথা জানতে পারে। এলিজাবেথের চিঠির সংকলন খুঁজতে আবার পার্কস্ট্রিটে গিয়ে ট্রিংকাস রেস্টুরেন্টে স্যান্ডুইচ খেতে গিয়ে চোখে পড়ে “ক্রিস গডউইন আ্যন্ড হিজ ব্যান্ড” এর নাম। ক্রিস গডউইনের ঠিকানায় গিয়ে একের পর এক রহস্যের পরত খুলে অবশেষে ধরা পড়ে দোষী।সময়ের আয়নায় ধরা পড়ে সত্তরের দশকের কলকাতায় আ্যংলো ইন্ডিয়ান সমাজের সাথে পাব মিউজিকের সংবদ্ধতা।

“বোসপুকুরে খুনখারাপি “(১৯৮৫) তে যাত্রার নাট্যকার ও সঙ্গীত পরিচালক ইন্দ্রনারায়ণ আচার্য খুন হন এবং তার লেখা নাটকের স্ক্রিপ্ট ইত্যাদির সাথে চুরি যায় উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত আমাটির বেহালা। ইন্দ্রনারায়ণের ঠাকুরদার বাবা কন্দর্পনারায়ণ বিলেতে গিয়ে এক ঋণগ্রস্ত বাজিয়ের কাছ থেকে দুহাজার পাউণ্ড দাম দিয়ে বেহালা যন্ত্রের অন্যতম রূপকার নিকোলো আমাটির নির্মিত বেহালা।

ফেলুদার জবানিতে, “ইতালির বেহালা প্রস্তুতকারকদের মধ্যে তিনজনের নাম সবচেয়ে বিখ্যাত। এরা তিনজনেই শতাব্দীর লোক। প্রথমজন আনটিন স্ট্রাডিভারি, দ্বিতীয় আন্দ্রেয়াস গুয়ারনেরি, আর তৃতীয় নিকোলো আমাটি।” কন্দর্পনারায়ণ রসিকতা করে এই বেহালাকে বলতেন “আম আঁটির ভেঁপু”। কাহিনীর শেষে জানা যায় ইন্দ্রনারায়ণের মেজ ভাই যার কাছে  “বিদেশী গানবাজনার বিরাট কালেকশন“ ছিল এবং যিনি ফেলুদাকে জানিয়েছিলেন তার প্রিয় কম্পোজার চাইকোভস্কি ,সুমান, ব্রাহমস, শোপাঁ তিনি নিজের আর্থিক ক্ষতি মেরামতির জন্য আমাটির বেহালাটি চুরি করে বিক্রি করেন। এই কাহিনীর সূত্রে ফেলুদা পাশ্চাত্য সংগীতের এনসাইক্লোপিডিয়া পড়াশোনার পাশাপাশি মেলোডি, হারমনি, পলিফনি, কাউন্টার পয়েন্ট এসব বিষয় শেখেন এবং পাঠকের কাছে খুলে যায় আপাত অপরিচিত কিন্তু সংগীত সৃষ্টিতে অপরিহার্য এক গানের জগত। জটায়ুর সাথে তারাও শিখে নেয় হাইডন, মোৎসার্ট আর বেটোফেনের শুদ্ধ উচ্চারণ।

১৯৮৮ সালে প্রকাশিত ‘'শকুন্তলার কন্ঠহার” গল্পে আবার আসে এই ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রসঙ্গ। শকুন্তলার ছোট মেয়ে সুনীলা উত্তরাধিকার সূত্রে তার মায়ের যে কন্ঠহারটি পেয়েছিল তা চুরি হয়। তার আগেই পাঠক জানতে পেরেছে যে তার দিদি মার্গারেট সুশীলা গোয়ার স্যামুয়েল সালডানহাকে বিয়ে করেছিল এবং তাদের একটি বাদ্যযন্ত্রের দোকান আছে। একটি পার্টিতে তার সাথে পরিচয়ের পর ফেলুদাকে হযরতগঞ্জের সেই দোকানে (যেটি লখনৌর প্রথম বাদ্যযন্ত্রের দোকান) যাবার আমন্ত্রণ জানান স্যামুয়েল। প্রসঙ্গত জানান তারা এখন দোকানে সেতারও রাখছেন। আশির দশকের শেষে ফিউশন মিউজিক যে ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছিল তার ছোট্ট ইঙ্গিত যেন দেয়া রইল।

ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রাণপুরুষ সত্যজিৎ হিন্দি ফিল্মি গানের রস থেকে ফেলুদা কাহিনীকে বঞ্চিত করেন নি।যদিও চলচিত্র বিষয়ক প্রবন্ধে তিনি আক্ষেপ করেছেন যে হিন্দি ছবির গান মোটামুটিভাবে বাজারে জনপ্রিয় আধ-ডজন প্লে-ব্যাক গায়কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

“সোনার কেল্লা “(১৯৭১) বিষয় বৈচিত্র্যে, “হু ডান ইট” কাঠামোর টানটান উত্তেজনায় ভরপুর সম্ভবত জনপ্রিয়তম ফেলুদা কাহিনী।কাহিনীর শুরুতে তোপসের জবানিতে জানা যায় পুজোর ছুটি শুরু হয়েছে এবং নীহার পিন্টুদের বাড়ির পুজোর প্যান্ডেলে “কটি পতঙ্গ” ছবির “ইয়ে যো মহাব্বত হ্যায়” গানটি বাজছে। সেই লাউডস্পিকারে যখন “জনি মেরা নাম” ছবির একটা গান বেজে উঠল তখনি ফেলুদার বাড়ির দরজায় জাতিস্মর মুকুল ধরের বাবা কড়া নাড়েন। ‘সোনার কেল্লা’ সত্যজিৎ রায় নির্মিত প্রথম ফেলুকাহিনীর ছায়াছবি। এই ছবিতে ফেলুদা ফ্যানদের তার উপহার ফেলুদার সিগনেচার টিউন।

সম্প্রতি একটি ভিডিও সাক্ষাৎকারে ফেলুদার চরিত্রাভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী জানিয়েছেন এই ফেলুদা টিউন এর সাথে পাশ্চাত্য সুরে রবীন্দ্রনাথের রচনা “ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে” গানটির সুরের সাযুজ্য আছে। মূল গানটির স্বরলিপির প্রতিটি তালভিত্তিক বিভাগ থেকে প্রথম স্বরটি বাদ দিলে যা পাওয়া যায় তাই ফেলুদা টিউন।

পুরো ছবিতে তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতের নানা প্রকরণের সাথে ব্যবহার করেছেন রাজস্থানী লোকসংগীত ও মীরার ভজন। ছায়াছবিতে মুকুল মীরার ভজনের সুর শুনে ছুটে যায়, দেখে ফেলে ছদ্মবেশী আসল ডক্টর হাজরাকে যাকে ‘দুষ্টুলোক’ বলে বুঝিয়েছে ভবানন্দ আর তার চ্যালা মন্দার বোস। তার পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে আবার রামদেওড়া স্টেশনে রাবণহাত্তা আর খঞ্জনি বাজিয়ে মান্ড রাগে আধারিত রাজস্থানী ভজনের  আসরে দাঁড়িয়ে হাতের আংটি দেখে ছদ্মবেশী অপরাধী মন্দার বোসকে ফেলুদা চিনতে পারেন। মুকুলের পূর্বজন্মের সাথে তার যোগাযোগের সূত্র হিসেবে সুরকেই বেছে নিয়েছেন লেখক-পরিচালক আবার সুরের আবহের রহস্যের জাল আরেকটু গুটিয়ে এনে মন্দার বোসকে অপরাধী হিসেবে সনাক্ত করছেন ফেলুদা। বিজয়া রায়  “আমাদের কথা” বইতে লিখেছেন এই ছবির শুটিংয়ের সময় রাজস্থানে গিয়ে গ্রামের লোকেদের গান শুনে তাঁরা অবাক হয়েছিলেন এবং সত্যজিৎ ঠিক করেন ওই গানের একটি দৃশ্য রাখবেন। জয়সলমীরের কাছে একটি গ্রামের কথা তারা জানতে পারেন যেখানে সবাই সঙ্গীতজ্ঞ কিন্তু দরিদ্র। শুধুমাত্র ট্যুরিস্টদের গান শুনিয়েই তাদের রোজগার হয়।রামদেওরার স্টেশনের দৃশ্যে তাদের দেখা মেলে। এছাড়া সেই সময়ে রাজস্থানের বিখ্যাত গায়িকা সোহিনীদেবীর কন্ঠে মীরার ভজন “মন মেরা রাম রাম রচে” র সাথে বেজে ওঠে সারিন্দা ও কাঠের খঞ্জনি আর চেনা সুর শুনে উৎসুক হয়  মুকুল।

এছাড়া “গ্যাংটকে গন্ডগোল” (১৯৭০) উপন্যাসে রুমটেক গুম্ফায় যে তিব্বতী মুখোশ নাচের অনুষ্ঠান হয়েছিল তার আবহসঙ্গীতের উল্লেখ পাওয়া যায়।

ফেলুদার কাহিনী প্রকাশের অবসানের পর তাকে নিয়ে গান বাঁধা হয়েছে।সেই গানে ফেলুদা আর সত্যজিৎ পরস্পরের সমার্থক। যে কিশোর মন তোপসের সঙ্গী সে-ই লালমোহনের টাটকা মনে মজেছে আর ফেলুদা মুগ্ধতা বাঙালির রীতিমতো শ্লাঘার বিষয়। নব্বইয়ের দশকের খ্যাতনামা ত্রয়ী সুমন-অঞ্জন-নচিকেতার কন্ঠে "ফেলুদার গান" কবীর সুমনের কথায় সুরে “ছোট বড় সবাই মিলে” ডবল ক্যাসেট আ্যলবামের শেষ গান ছিল। এ যেন শৈশব থেকে কৈশোর যাত্রার শেষ মাইলফলক।

গানের শেষে বলা ছিল,

“অনেক জানা অনেক চেনা অনেক কিছু করার পর

স্মৃতির মধ্যে আটকে থাকা আমার পক্ষে কষ্টকর।

লালমোহন আর তোপসেটারও একই দশা দেখতে পাই

ইচ্ছে করে সবাই মিলে নতুন কিছু করতে যাই

তখন আবার গল্প হবে রহস্যকে ভর করে

ছুটবে আবার কল্পনাটা সত্যজিতের হাত ধরে”

“তাই ঘনালে অন্ধকার নেই কারণ ভয় পাওয়ার

গল্প নিয়ে ফেলুদা ফিরছে আবার”

আশার কথা এই নতুন ফেলুকাহিনী লেখা না হলেও ফেলুদাকে নিয়ে গান লেখা হয়েছে।  ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ কাহিনীর ওয়েব সিরিজের জন্য পরিচালক সৃজিত মুখার্জি ফেলুদাকে নিয়ে আবার গান লেখেন। তার পরের বছর একই পরিচালকের আরেকটি ফেলুকাহিনীর জন্য নব্বইয়ের  দশকের বাংলা আধুনিক গানের বাঁক বদলের যারা কারিগর তাদের তিন যোগ্য উত্তরসূরী অনিন্দ্য-শিলাজিৎ-সিধু ফেলুদা ফেরত ওয়েব সিরিজের জন্য শ্রীজাতর লেখা  জয় সরকারের সুর করা ফেলুদার গান গেয়েছেন।

“নয় অপেক্ষা নয় রে আর বাঁধল কান্ড ধুন্ধুমার

ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি জমবে এবার”

বাংলা রহস্যকাহিনীতে গানের সন্নিবেশ সাহিত্য ও সঙ্গীতের পারস্পরিক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিশোর পাঠকের কাছে বিশ্বসঙ্গীতের বিরাট বিপুল ভাণ্ডার এভাবেই খুলে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। শ্রোতা এবং সুরস্রষ্টা হিসেবে নিজস্ব সাঙ্গীতিক অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝেছিলেন সুর এক সীমানাহীন সাম্রাজ্য যেখানে পূর্ব-পশ্চিম, শাস্ত্রীয়-লোকজ বা ভাষার বিভেদ নেই।