“ঠাকুরমার ঝুলি” : রাক্ষসী ও নারী বিদ্বেষ
- 07 December, 2023
- লেখক: সুকন্যা দত্ত
রূপকথা কি কেবল কল্পনা নাকি সমাজে প্রোথিত চিরাচরিত বিশ্বাসের প্রতিফলন? রূপকের আড়ালে কোন কথা লুকোচুরি খেলে? ভেসে বেড়ায় মনন, মানস, বিশ্বাস, সংকীর্ণতা, চিরাচরিত ঐতিহ্য। রূপকথা কি unpredictable? রূপের গভীরতা পাঠকের কাছে কুয়াশার মতো, ভেদ করলে দৃষ্টির সম্মুখে নতুন জগৎ ফুটে ওঠে । শিশু সাহিত্য কথাটির প্রতিশব্দ Children's Literature হলেও বাংলা শিশু সাহিত্যের পাঠক কেবল শিশু নয়, বালক, বালিকা, কিশোর কিশোরী, প্রবীণ প্রবীণা সকলেই।
বুদ্ধদেব বসুর মতে, “ অনেক সময় বোঝা যায় যে (শিশুসাহিত্যের) লেখক যদিও মুখ্যত বা নামত ছোটোদের জন্য লিখেছেন, তবু সাবালক, নাবালক পাঠকও তার লক্ষ্যের বর্হিভূত ছিলো না৷ “ ( বাংলা শিশু সাহিত্য, সাহিত্য চর্চা, ১৯৫৪)
বাঙালির রূপকথায় যার নাম স্বর্ণাক্ষরে উজ্জ্বল তিনি শ্রীযুক্ত দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার মহাশয়৷ বাংলা লোকসাহিত্য অজস্র রূপকথার নক্সা সুতোয় বোনা হলেও আমার আলোকপাত “ঠাকুরমার ঝুলি “ কেন্দ্রিক। বিশ শতকের গোড়ার দিকে যুবক দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার মহাশয় পল্লী গ্রামে ঘুরে অগ্রজদের মুখ নিঃসৃত গল্প শুনে ফোনোগ্রাফের মোম রেকর্ডে তাদের লিপিবদ্ধ করেন। এরপর ১৯০৭ সালে নীল মলাটে মোড়া ‘ঠাকুরমার ঝুলি ‘ প্রকাশিত হয়। শ্রী অরবিন্দের মতে,
“ The book has marked out an epoch in our literature. This is sure to give him a prominent place in the rank of prominent poets and writers ‘- ( Bandemataram)
রূপকথা ফ্যান্টাসির , যুক্তির আগে ডানা মেলে ওড়ে মনের খেয়াল খুশী , যা ইচ্ছা তাই করার স্বপ্ন। চিন্তার সম্মুখে বিস্ময় দোল দিয়ে যায়। গল্পের চরিত্ররা নানান বেশে কাছে আসে, শুনিয়ে যায় রাজা, রানী, রাক্ষস, খোক্কস, পশু, পাখীর কথা। এগুলো শুধুই কি কল্পনা, শিশু ভোলানো কথা নাকি এর পিছনে গভীর আকর লুকিয়ে আছে? আসুন সে কথায় আসি।
পৃথিবীর রূপকথায় রাক্ষসীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। “ঠাকুরমার ঝুলি” তে রাক্ষসী চরিত্ররা সমাজের মায়াবিনী, কুহকিনী, কুটিলা, হিংসাপরায়ণা রূপে উঠে এসেছে। ভালো বা মন্দ সব দায়টাই তাদের উপর বর্তায়। সংগৃহীত গল্পগুলোর নারীরা হয় ভালো না হয় মন্দ এই দুই রূপে প্রতিষ্ঠিত। সমাজের স্রোতের সাথে প্রবহমান রমনীরা সহনশীলতার প্রতিমূর্তি, দুঃখিনী ইতিবাচক চরিত্র। আর যদি নারী ভিন্ন মতাদর্শে সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদী হতে চায় তবে তার কপালে জোটে রাক্ষসী তকমা। গার্হস্থ্য শাসন, বশ্যতা, উপেক্ষা করলে অপমান স্বরূপ নারী রাক্ষসী রূপে চিত্রিত হয়।
পুরাণ বা রূপকথায় কুৎসিত, বৃহদাকার, অমানবিক, মাংস ভক্ষক। “ঠাকুরমা ঝুলি” বইয়ের ‘রূপ তরাসী’ অংশটি রাক্ষস জগতের অবতরণিকা। রূপ - তরাসী অর্থাৎ যার রূপ দেখলে তরাস বা ত্রাস কিংবা ভয়ের সঞ্চার হয়। কিন্তু রূপকথায় ভীতিকর বিষয় সংযোজনের কি বিশেষ কোনো কারণ আছে? তাহলে উত্তর সন্ধানে রূপকথার জগতে একটু ভ্রমণ করা যাক। বাংলা রূপকথায় রাক্ষসী অর্থাৎ স্ত্রী রাক্ষসদের আধিপত্য। রাক্ষস, খোক্কসরা হুড়মুড়িয়ে মানুষদের ভয় দেখাতে আসে, নগর ধ্বংস করে কিন্তু মানুষের সাহসিকতা ও শৌর্যের বিপরীতে লড়াই করার শক্তি তাদের কম। রাক্ষসরা রাক্ষসীদের আজ্ঞাবহ, আধিপত্য বিস্তারে রাক্ষসীদের মতো পটু নয়৷ কাহিনীগুলোতে পুরুষরা হয়ে উঠেছে দয়ার পাত্র আর রাক্ষসীরা কুড়িয়েছে ঘৃণা৷ “ঠাকুরমার ঝুলি “ গ্রন্থে নারীকে রাক্ষসী রূপে প্রতিষ্ঠার পিছনে তৎকালীন পুরুষ তান্ত্রিক সমাজের নারী বিদ্বেষী মনোভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। নীতিশিক্ষা এবং আনন্দবোধে শিশুকে ভুলিয়ে রাখতে গিয়ে রূপকথার মাধ্যমে নারীদের হীন, নীচু করে দেখানোর প্রচেষ্টা চলেছে ক্রমাগত৷ “ঠাকুরমার ঝুলি” র গল্পগুলোয় রাক্ষসী চরিত্র অঙ্কনে নারী বিদ্বেষী মনোভাব প্রকাশিত।
‘ রূপ তরাসী’ অংশের কয়েকটি পক্ততি এ প্রসঙ্গে তুলে ধরি।
“ রূপ দেখতে তরাস লাগে, বলতে করে ভয়,
কেমন করে রাক্ষসীরা মানুষ হয়ে রয়। “ ( ঠাকুরমার ঝুলি)।
রূপকথার রাক্ষসীদের বর্ণনায় দেখা যায়, তারা কুৎসিত, কদাকার, ‘দাঁত - বিকটী’ ( সোনার কাঠি রূপার কাঠি) দেখলে ভয় তৈরি হয়। এরা যে কোনো মুহূর্তে মানুষের বেশ ধারণ করতে দক্ষ। ‘ডালিম কুমার’ গল্পে বলা হয়েছে,
“ রাক্ষসী, এক ভিখারিনী সাজিয়া রাজপুত্রের কাছে গিয়া পাশা জোড়া চাহিল;”
আবার “ নীল কমল আর লাল কমল গল্পে ‘ ও রাজার এক রানী লক্ষী ( মানুষ) অপরজন রাক্ষসী। কি অসম্ভব বৈপরীত্য, তাই না?
গল্পে বলা হয়েছে,
“ এক রাজার দুই রানী ; তাহার এক রানী যে রাক্ষসী! কিন্তু এ কথা কেহই জানে না। “
‘সোনার কাটি রূপার কাটি’ গল্পেও দেখা যায় রাজার পুত্র ও মন্ত্রী পুত্র একসাথে ভ্রমণে বেরোলে, এক রাক্ষসী মন্ত্রী পুত্র, ও তাদের ঘোড়াগুলো গিলে রাজার ছেলের পিছু নেয় । রাক্ষসীর থেকে প্রাণ বাঁচাতে রাজপুত্র এক আমগাছের ভিতর আশ্রয় নেওয়ায় রাক্ষসী “ এক রূপসী মূর্তি ধরে সেই গাছের তলায় বসিয়া কাঁদিতে লাগিলো। “
আকস্মিকভাবে সে সময় পথ দিয়ে যাওয়া রাজা পরমা সুন্দরী মেয়েটির প্রকৃত পরিচয় না বুঝতে পেরে রাজপুরীতে এনে তাকে বিবাহ করে । রাক্ষসী হয়ে ওঠে রাজ্যের রানী। রূপকথাগুলোয় নিখুঁত বেশধারী রাক্ষসীর প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে রাজা, প্রজা, দাস দাসী, রাজপুত্র কেউ একেবারেই অবগত নয়। কার্য সিদ্ধির জন্য রাক্ষসীর ভোল বদলের রূপটিকে তুলে ধরা হয়েছে গল্পগুলোয়। নারী যেন ছলনাময়ী, শঠ, মুখোশধারী, দ্বৈত সত্তার অধিকারিনী৷
‘রূপ তরাসী’ মুখবন্ধে দেখা যায়,
“ হাউ মাউ কাউ শব্দ শুনি
রাক্ষসেরি পুর,
না জানি সে কোন দেশে না জানি কোন দূর। “
আমাদের জগত থেকে বহুদূরে তাদের বাস, দূর দ্বীপবাসিনী। এদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখাই হয়তো বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তার কাজ। ভয়ংকরের কাছে গেলে ধ্বংস হওয়ার ভয় থাকে। শিশু মনকে সতর্ক করে নারীদের নিকট না যাওয়ার ইঙ্গিত তুলে ধরা হয়েছে এ অংশে। রূপকথায় বোঝানো হয়েছে, “ নারী মানেই বিপদ৷ “
প্রয়োজনে নিজ রূপ ধারণ করে রাক্ষসীরা। রাতের অন্ধকারের কালোর মধ্যে অবাধ বিচরণের জন্য মানবী খোলস ত্যাগ করে নিজ মূর্তিতে প্রকট হয় । ‘নীল কমল আর লাল কমল ‘ গল্পে দেখা যায়, রাতের বেলা হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, গোহালের গরু মরে যাচ্ছে, রানী সব ভক্ষণ করছে। ঐ একই গল্পে লেখা, রাক্ষসী রানী তার মৃত মায়ের
“ মাথা দেখিয়াই নিজ মূর্তি ধারণ করে “
ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে বিকট মূর্তি ধারণ করে সে নীল কমল, লাল কমলের রাজ্যে যায়। রাক্ষসী রূপে আক্রমন করার মধ্যে ফুটে উঠেছে নারী চরিত্রের স্বার্থপরতা, নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার লিপ্সা । কার্যসিদ্ধি করতে যেমন মানব মূর্তি ধারণ করে তেমন প্রয়োজনে স্বমহিমায় ফিরেও আসে। ‘ সোনার কাটি রূপার কাটি ‘ গল্পে রাজপুত্র রাক্ষসীকে মারতে উদ্যত হলে, সে নিজ স্বরে বলে ওঠে,
“ খাঁব না খাঁব না, রাঁখ রাঁখ!! তোর পায়ে পড়ি। “
যে রাজপুত্রকে রাক্ষসী অতীতে ঘোরতর বিপদে ফেলেছিলো , প্রাণভিক্ষা করার সময় তার স্বরূপ প্রকাশ পেয়ে যায় ।
“নীল কমল আর লাল কমল গল্পে”, রাক্ষসী রানী খিদের জ্বালায় মানব সন্তান কুসুম কে গিলে খেতে আসে। খাওয়া শেষে নিজের সন্তান অজিতকে গিলে খেতেও সে পিছ পা হয় না। এখানে নারী চরিত্রের মায়াদয়াহীনতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কাহিনীতে এরা সকল প্রকার মাংস ভক্ষণকারী। হাতি, ঘোড়া এমনকি নর মাংস কিছুই যেন বাদ দিতে চায় না৷
“ঠাকুরমার ঝুলি “তে বর্ণিত রাক্ষসীরা সংসারী। সমাজের উচ্চ বর্গের মানুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, , সন্তানের জন্ম দেয় এবং তাকে লালন পালন করে। রাক্ষসীদের সাথে মানুষের বিবাহ অনুলোম বিবাহ কিন্তু ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ র কোথাও রাক্ষসের সাথে মানব কন্যার বিবাহের উল্লেখ আছে কি ? তাই প্রতিলোম বিবাহ তৎকালীন পুরুষ সমাজ হয়তো মেনে নিতে নারাজ ছিলো ।
রাজার ঔরসে রাক্ষসী রানীর পুত্র সন্তান হয় অথচ সেই সন্তানের হাতে মা রাক্ষসীর মৃত্যু ঘটে, এ যেন পুরুষতন্ত্রের নারীর প্রতি অত্যাচারের ইঙ্গিতবাহী। নারীর স্বাধীনতা খর্ব হয় পুরুষের হাতে। কখনও স্বামী, কখনও সন্তানের সংকেতে চলা নারীর নিজের পরিচয় বলে কিছুই থাকে না। “ঠাকুরমার ঝুলি” র গল্পগুলোয় রাক্ষসীর পুত্র সন্তানের জন্মের কথা আছে কিন্তু কন্যা সন্তানের জন্মের উল্লেখ নেই। এভাবেই হয়তো “বংশের বাতি” পুত্রদের এগিয়ে রাখার প্রয়াস করা হয়েছে রূপকথায়।
“ঠাকুরমার ঝুলি”তে রাক্ষসীরা মানুষের গন্ধ পেয়ে লালসায়িত হয়। ‘ডালিম কুমার ‘ গল্পে লেখা ,
“ কেবল রাজপুত্র দেখিলেন, খাবার দিবার সময়, মায়ের জিভের একফোঁটা জল টস করিয়া পড়িল।!
এই গল্পেই বলা হয়েছে,
“ তাঁ কেঁন মঁনিষ্যি মঁনিষ্যি গঁন্ধ পাঁই?
বৃদ্ধা রাক্ষসী “ আয়ীর মুখে সাত কলস লাল গলিল!” মানুষের মাংসের গন্ধ পেয়ে।
‘ সোনার কাটি রূপার কাটি ‘ তে লেখা,
‘ নাতনি লোঁ নাতনি! মাঁনুষ মাঁনুষ গঁন্ধ কঁয়-
মানুষ আঁবার কোঁথায় রঁয়? ‘
আসলে রাক্ষসী তথা নারীদের সাথে সমাজের বিভেদ রেখা সৃষ্টি করা হয়েছে হয়তো এভাবেই ।
’নীল কমল আর লাল’ কমল গল্পে আতু বুড়ি নীলের রাক্ষসী দিদা, ‘সোনার কাটি রূপার কাটি’’ গল্পে রাজকন্যাকে বাঁচিয়ে রেখেছে বুড়ী রাক্ষসী। রাক্ষসরা যাওয়ার আগে রাজকন্যাকে ঘুম পাড়িয়ে যায় কিন্তু বৃদ্ধা রাক্ষসী, রাজকন্যা কে নিজ নাতনীর মতো যত্ন করে বলে,
“ এঁই নে নাতনি তোঁর জঁন্যে কঁত খাঁবার এঁনেচি। রাজকন্যাও আয়ী বুড়ির যত্ন করে, পাকা চুল তুলে দেয়, উকুন বেছে দেয়।”
যুবতী রাক্ষসীর সাথে বুড়ী রাক্ষসীর সূক্ষ্ম ফারাক রয়েছে রূপকথাগুলিতে। বৃদ্ধা রাক্ষসীর মধ্যে দয়া, মায়া, ইতিবাচকতা থাকলেও যুবতী রাক্ষসী আপাদমস্তক তথাকথিত খল নায়িকা। কিন্তু এও কি নারীর প্রতি বিভাজন মূলক মনোভাব নয়?
সেই মহাভারতের সময় থেকে নারীর সাথে পাশা খেলার যোগ রয়েছে। পাশা খেলায় বার বার নারীর পরাজয় যেন অবশ্যম্ভাবী। ‘ ডালিম কুমার ‘ গল্পে রাক্ষসী আর ডালিম কুমারের লড়াইয়ে রাক্ষসীর বারংবার হার যেন পূর্ব নির্ধারিত। ‘মহাপাশা’ খেলায় পুরুষ সমাজের প্রতিনিধি ডালিম কুমার রাক্ষসীকে হারিয়ে পৌরুষের ভিত্তি স্হাপন করে।
রূপকথার গল্পগুলিতে বার বার দেখা যায় রাক্ষসীদের প্রাণ শরীরের বাইরে ভিন্ন স্থানে, সে যেন প্রাণহীন। কখনও তার প্রাণ পুকুরের ভিতর এক স্ফটিক স্তম্ভের মাঝে সাত ফণা সাপের ভিতর ( সোনার কাটি রূপার কাটি), কখনও কুয়োর মাঝে সোনার কৌটোর ভিতর ‘জীয়নকাটি মরণকাটি’ দুই ভীমরুল ভীমরুলীর ভিতর। কঠিন স্বভাব, পাষাণ হৃদয় বোঝাতে আমরা প্রাণহীন শব্দের প্রয়োগ করি, কেবল আয়ু বোঝাতে নয়। নারী বিদ্বেষী প্রকাশ করতে এর প্রয়োগ বলা যায়।
রবীন্দ্রনাথের কথায়, "শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে? সে কথার রেশ ধরেই বলছি, পাঠক মহল না হয় উত্তর খুঁজুন। তবে রূপকথা গভীর জলধি, তার ভিতর থেকে আমি দু একখানি মনি মুক্তার ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করলাম।