ইডিয়ট : অপাপবিদ্ধ

Andrei Tarkovsky-র ইচ্ছে ছিল দস্তয়েভস্কির জীবন নিয়ে ছবি বানানোর। তাঁর কথায়, There’s almost certainly no point in screening the novels. We must make a film about the man himself. About his personality, his God, his devil, his work.

...For the moment I must read. Everything Dostoievsky wrote. Everything that’s been written about him; ... ‘Dostoievsky’ could become the whole point of what I want to do in cinema.

-      Diary, Moscow, 30 April, 1970

প্রখ্যাত জাপানি চিত্র পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া তার আগেই ১৯৫১-এ বানিয়ে ফেলেছেন দস্তয়েভস্কির মহৎ উপন্যাস The Idiot অবলম্বনে ছায়াছবি Hakuchi। Rashomon ছবির পরই সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর এই ছবির নির্মাণে হাত দেন কুরোসাওয়া, যদিও তার বহু আগে থেকেই এই ছবিটি করতে চেয়েছিলেন তিনি বলে নিজেই জানিয়ে ছিলেন কুরোসাওয়া। উপন্যাসটিতে অসংখ্য ছোটো ছোটো উপকাহিনী, ঘটনাপ্রবাহ, পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিজনিত সম্পর্ক, চরিত্রগুলির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ যেভাবে শাখাপ্রশাখায় পল্লবিত হয়ে উঠেছে, তাকে চলচ্চিত্রায়িত করার সিদ্ধান্তে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন কুরোসাওয়া। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের পরিবর্তে জাপানের হোক্কাইডোর পটভূমি বেছে নিয়েছিলেন তিনি কারণ সম্ভবতঃ জাপানের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় হোক্কাইডো ছিল অনেক বেশি ‘পশ্চিমী’, তা সত্ত্বেও, রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ এবং জাপানের হোক্কাইডোর পটভূমির মধ্যেও যতটা তফাৎ, দস্তয়েভস্কির চরিত্রগুলির সাথে যে কোনো জাপানি চরিত্রের তফাৎ যে ছিল আরও অনেক বেশি, তা বলাই বাহুল্য।

তাঁর কথায়, “Since I was little I’ve liked Russian Literature, and have read the greater part of it, but I find that I like Dostoevsky the best and had long thought that this book would make a wonderful film. He is still my favourite author, and he is the one – I still think – who writes most honestly about human existence. There is certainly no other author who is attractive to me, so – well, so gentle.

When I say gentle, I mean the kind of gentleness that makes you want to avert your eyes when you see something really dreadful, really tragic. He has this power of compassion. And then he refuses to turn his eyes away; he, too, looks; he, too, suffers. There is something which is more than human, better than human about him. He seems so terribly subjective, yet when you have finished the book you find that no more objective author exists.

Anyway, this more than human quality, this compassion, this near godlike quality . . . this is what I admire in Dostoevsky, and what I love terribly in his Prince Myushkin.”

চলচ্চিত্রায়ণের প্রয়োজনেও মূল উপন্যাসের বিশেষ কিছু পরিবর্তনে অনীহা ছিল কুরোসাওয়ার। স্পষ্টতই, কুরোসাওয়ার দস্তয়েভস্কিতে আচ্ছন্নতা – সমালোচকদের মতে, ছবিটির ক্ষতিই করেছিল।  Donald Richie লিখছেন, “. . . This desire to ‘preserve’ Dostoevsky weakens the film at every turn because Kurosawa’s faith in his author was so strong, and so blind, that he seemed to feel that the mere act of photographing scenes from the novel would give the same effect on the screen as they do on the page.”

শুরু থেকেই নানা সমস্যার সম্মুখীন হয় ছবিটির নির্মাণ। Shochiku, যে studio ছবিটির distributionএর দায়িত্বে ছিল, ২৬৫ মিনিট পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবিটির বিভিন্ন অংশ কেটেছেঁটে ৯৯ মিনিট কমিয়ে দেয় পরিচালককে না জানিয়েই। স্বভাবতই, ক্ষুব্ধ কুরোসাওয়া নাকি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘তার চেয়ে বরং দৈর্ঘ্য বরাবরই কেটে ছোটো করতে পারত ওরা!’ দর্শক ঔদাসীন্য ও অন্যান্য নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল এই ছবি, এমনকি পশ্চিমী দুনিয়াতেও প্রাথমিকভাবে সমাদৃত হয় নি ছবিটি, এক কথায় ছবিটি ছিল ‘more literary than cinematic’।

উপন্যাসটিও যখন লেখা হয়, দস্তয়েভস্কি স্বয়ং সংকটজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন যাপন করছিলেন। ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৬৭ সালে জেনিভায় উপন্যাসটি লেখা শুরু হয়, শেষ হয় ১৮৬৯ সালে, ফ্লোরেন্সে। জুয়ার নেশা, মৃগির প্রকোপ, চরম দারিদ্রতা, রুশি ঋণদাতাদের এড়াতে স্ত্রী আনা গ্রিগোরিয়েভনাকে নিয়ে সুইজারল্যান্ড, ইটালিতে ছুটে বেড়ানো, কন্যা সোফিয়ার জন্মের তিন মাসের মধ্যেই মৃত্যু, - এর মধ্যেই সৃষ্টি হয় মিশকিনের মতো এক চরিত্র, এক Positive Good Manএর আদল যার পিছনে স্রষ্টার অধ্যাত্ম দর্শন নিহিত, যা বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে অভূতপূর্ব ছিল।

এ হেন উপন্যাসটিকে জাপানের পটভূমিকায় নিয়ে আসেন কুরোসাওয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাপানের ক্ষতবিক্ষত সমাজ, বিশ্বাস ও মানবিকতার অনুপস্থিতি উঠে আসে ছবিতে। দুর্নীতিগ্রস্ত ও ঘুণধরা সমাজের ওপরমহলে বসবাসকারী মানুষগুলিকে দেখানো হয় কপট, বিচারবুদ্ধিহীন হিসেবে, এদের মধ্যে কেউ বা ব্যবসায়ী, কেউ বা ভূস্বামী। এদের লালসার শিকার হয় এক অসহায় নারী, নাস্তাসিয়া, যে এসেছে সমাজের নীচু স্তর থেকে। এই চরিত্রে Setsuko Hara অসামান্য অভিনয়ে উজ্জ্বল এ ছবি।

মূল উপন্যাসের আগলাইয়া চরিত্রটি মিশকিনকে প্রকান্তরে ডন কিহোতের সাথে তুলনা করে, আদর্শ নায়কের চরিত্র বিশ্লেষণে দস্তয়েভস্কির মনে হয়েছে সারভান্তেসের নায়কের মতো তাঁর এই উপন্যাসের নায়কও এমনই এক বিশুদ্ধতার প্রতিভূ যে তার মিজের মূল্য সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আত্মসচেতন নয়। অরুণ সোম উপন্যাসটির স্বকৃত অনুবাদের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, ‘দস্তইয়েভস্কি যখন এই উপন্যাসটি লিখতে শুরু করেন তখন তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী ইভানোভাকে লেখা একটি চিঠিতে জানিয়েছিলেন: উপন্যাসের মূল আইডিয়া একজন আদর্শ নায়কের চরিত্রবর্ণন। পৃথিবীতে এর চেয়ে দুরূহ কাজ আর কিছু হতে পারে না – বিশেষত আজকের দিনে। লেখকমাত্রেই – শুধু আমাদের দেশে কেন, ইউরোপেও যারা প্রকৃত সুন্দরকে ফুটিয়ে তোলার সমস্যা সমাধানে ব্রতী হয়েছেন, তাঁরা সকলেই ব্যর্থ, কারণ এটা একটা বিশাল কাজ। সুন্দর হল একটা আদর্শ, আর আদর্শ বলতে যা বোঝায়, তার প্রতি না আমাদের দেশে, না ইউরোপে – কোথাও তেমন একটা দৃষ্টি দেওয়া হয় নি।’

মিখাইল বাখতিন, টমাস মান প্রমুখ লেখকরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই সর্বগ্রাসী ফ্যাসিজমের গভীরতর সাংস্কৃতিক ভিত্তি অন্বেষণ করেছিলেন তাঁদের সৃষ্টিতে, কুরোসাওয়ার ছবিটিও ঠিক একই অন্বেষণে ব্রতী, শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের নৈতিক ভূমিকা যেখানে সমালোচনার সম্মুখীন, পাশ্চাত্যের অনুকরণে সামরিক শক্তির আস্ফালন ও দেদার শিল্পায়ন যার প্রেক্ষাপট, আর এখানেই তাঁর ‘প্রাচ্য’ এসে দাঁড়ায় ‘পাশ্চাত্য’এর সাথে এক সারিতে।  তাঁর আত্মজীবনীতেও তিনি অকপট এ বিষয়ে, ‘I offered no resistance to Japan’s militarism. Unfortunately, I have to admit that I did not have the courage to resist in any positive way and I only got by, ingratiating myself when necessary and otherwise evading censure. I am ashamed of this, but I must be honest about it.’ এই আত্মসমালোচনা শুধু কুরোসাওয়ার ব্যক্তিগত অনুভূতি ছিল না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আসা একটি সম্পূর্ণ প্রজন্মর মানসিক যন্ত্রণার হেতু ছিল এই অনুভূতি, এক collective consciousness। কুরোসাওয়ার দস্তয়েভস্কিতে ফিরে আসা বা বলা ভালো আস্থা রাখার অন্যতম কারণও ছিল তাই। দস্তয়েভস্কি উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেই সর্বগ্রাসী ক্ষমতার আসন্নতা আন্দাজ করেছিলেন, তার বিশ্লেষণ করে সর্বগ্রাসিতার দ্বারা নৈতিকতা ও দায়িত্বের অপসারণকে – যার মাধ্যমে মানবতার বিসর্জনকেও নস্যাৎ করেছিলেন চরমভাবে। এ হেন লেখক যে কুরোসাওয়াকে প্রভাবিত করবেন তা বলাই বাহুল্য। তাই ‘Akira Kurosawa and Intertextual Cinema’এ James Goodwin লেখেন, In explanation of his enduring interest in Dostoevsky, Kurosawa has said that the novelist’s era, with social oppression and the destruction of truth under the tsars, is a direct analogy to the epoch of Japan’s imperial expansion in Asia and the Pacific, during which he matured as an individual and an artist. He finds in Dostoevsky a sensibility that is at once empathic in response to a great range of human experiences and objective in its methods of representing those experiences.’

যুদ্ধোত্তর পর্বে যে মানসিক ও সাংস্কৃতিক শূন্যতায় আচ্ছন্ন ছিল ইউরোপ, জাপানও তার সমান অংশীদার ছিল। ইউরোপ সঠিকভাবেই দস্তয়েভস্কির মধ্যে খুঁজেছিল নতুনের সম্ভাবনা, কারণ দস্তয়েভস্কির সৃষ্টিতে ছিল এক নতুন ভোরের আভাস, খ্রিষ্টিয় Resurrection-এর আদলে নবজন্মের সম্ভাবনা, কুরোসাওয়াও এই শূন্যতা থেকে পরিত্রাণ চাইলেন দস্তয়েভস্কির লেখাতে।

শুধু সেই সময় নয়, বর্তমান সময়েও যদি বিশ্বাস রাখতেই হয় মানবতায়, ফ্যাসিবাদের আস্ফালন উপেক্ষা করেই মনের কোণে জিইয়ে রাখতে হয় এই বিশ্বাস, তবে দস্তয়েভস্কিতে বার বার ফিরে যেতেই হয় আমাদের, আমাকে।

“আমি হৃদয়বান মূর্খ, কিন্তু মস্তিষ্ক নেই, আর তুমি মস্তিষ্কনির্ভর মূর্খ, কিন্তু হৃদয়হীন; এবং আমরা দুজনেই অসুখী, এবং আমরা দুজনেই কষ্ট পাই।”

তথ্যসূত্র:

১. The films of Akira Kurosawa – Donald Richie

২. ইডিয়ট -     অনুবাদ.অরুণ সোম

৩. Something like an autobiography - Akira Kurosawa

৪. Akira Kurosawa and Intertextual Cinema - James Goodwin

৫. Andrei Tarkovsky's diary, 1970