গার্সিয়া মার্কেসের ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’

গার্সিয়া মার্কেসের ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’কে এক মহাকাব্যিক সৃষ্টি বলেই পাঠক সমালোচকেরা মেনে নিয়ে নিয়েছেন। ১৯৬৭ সালের ৩০ মে আর্হেন্তিনার বুয়েনস আইরেসের ‘সুদামেরিকানা’ নামক প্রকাশন সংস্থা থেকে স্প্যানিশ ভাষায় গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশের পরেই একদিকে সাধারণ পাঠক ও অন্যদিকে সাহিত্য বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত সমালোচকরা বইটি নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। রাবাসা কর্তৃক এর অসামান্য ইংরাজী অনুবাদ প্রকাশের পরে একই উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। ফরাসী, ইতালিয়ান, জার্মান, রুশ সহ পৃথিবীর নানা ভাষায় বইটি দ্রুতই অনূদিত হয় এবং সর্বত্রই পাঠকের মুগ্ধতা কেড়ে নেয়। বাংলা ভাষায় এখনো অবধি বইটির তিনটি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। জি এইচ হাবিব প্রথমে বাংলাদেশ থেকে বইটির একটি অনুবাদ করেন, সেটি ছিল রাবাসার ইংরাজী অনুবাদ অবলম্বনে। তারপর পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত হয় স্প্যানিশ ভাষার শিক্ষক তরুণ ঘটকের করা মূল স্প্যানিশ ভাষা থেকে একটি অনুবাদ। মূল স্প্যানিশ থেকে বাংলাদেশের আনিসুজ্জামান আরেকটি পৃথক অনুবাদ করেছেন। প্রতিটি অনুবাদই অত্যন্ত উচ্চমানের। বাংলা ছাড়াও নানা ভারতীয় ভাষাতে গার্সিয়া মার্কেসের এই মহাগ্রন্থটি অনূদিত হয়েছে। সোনিয়া সুরভি অনুবাদ করেছেন হিন্দিতে, এস ভেলাইয়ুদান অনুবাদ করেছেন মালয়ালমে, এন সুকুমারন অনুবাদ করেছেন তামিলে, রবীন্দ্র ঠাকোর অনুবাদ করেছেন গুজরাটিতে। বাংলা ভাষায় গার্সিয়া মার্কেস চর্চার একটি দীর্ঘ ও বলিষ্ঠ ধারা রয়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে গার্সিয়া মার্কেস আশির দশক থেকেই পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত। এই বিভাগের অধ্যাপক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় গার্সিয়া মার্কেসকে অনুবাদ ও চর্চার মাধ্যমে বাঙালি পাঠকের সামনে সম্ভবত প্রথম বারের জন্য হাজির করেন। পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকাশন সংস্থা থেকে তাঁর বিভিন্ন বই অনূদিত হয়েছে। গার্সিয়া মার্কেস রচনাবলীর সিংহভাগই বাংলা অনুবাদে উপলব্ধ। শুধু অনুবাদই নয়, গার্সিয়া মার্কেসকে নিয়ে লেখালিখি, চর্চাও বাংলায় চলেছে নিরন্তর। গার্সিয়া মার্কেসকে নিয়ে অনেক লিটল ম্যাগাজিন তাঁদের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে কবিতীর্থ, আন্তর্জাতিক ছোটগল্প, বিজ্ঞাপনপর্ব ইত্যাদি লিটল ম্যাগাজিনের কয়েকটি বিশেষ গার্সিয়া মার্কেস সংখ্যা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও লেখক সমাবেশ, নিষ্পন্ন, পরিচয়, ক্রান্তিক, অপরাজিত, সাহিত্যচিন্তা, মধুপর্ণী, এবং সাহিত্যপত্র, অতলান্তিক, প্রতিপক্ষ, উত্তরাধিকার সহ নানা পত্রপত্রিকায় গার্সিয়া মার্কেসের লেখালিখির অনুবাদ ও তাঁর সম্পর্কে নানা প্রবন্ধ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বেরিয়েছে গার্সিয়া মার্কেস সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি বইও। অনুষ্টুপ প্রকাশনা সংস্থা থেকে গার্সিয়া মার্কেসের একটি স্বাদু জীবনী লিখেছেন অমিতাভ রায়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য অমিতাভ রায়ের অনুবাদেই দেজ প্রকাশন সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়ে গার্সিয়া মার্কেসের গল্পসমগ্র। ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’ উপন্যাসটিকে কেন্দ্র করে এই বই প্রকাশের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ‘কলিকাতা লেটারপ্রেস’ নামক প্রকাশন সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের নিঃসঙ্গতার অর্ধশতক’ নামের একটি বিশেষ সংকলন যার সম্পাদনা করেছেন ফাবিও রোদ্রিগেস আমাইয়া এবং অরুন্ধতী ভট্টাচার্য। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদে গার্সিয়া মার্কেসের একটি গল্পকে একাদশ শ্রেণির পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ফলে প্রতি বছর বাংলার লক্ষ লক্ষ কিশোর কিশোরী এই গল্পটির মধ্যে দিয়ে গার্সিয়া মার্কেসের সাহিত্য ভুবনে আজ প্রবেশ করছে। সুদূর কলম্বিয়ার এক লেখক অনুবাদ ও চর্চার মধ্যে দিয়ে আজ বাংলার ঘরের লেখক হয়ে উঠেছেন।

‘ঝড়াপাতা’ (১৯৫৫) থেকে শুরু করে ‘আমার বিষণ্ণ বেশ্যাদের স্মৃতি’ (২০০৪) পর্যন্ত পাঁচ দশক জুড়ে লেখা নানা উপন্যাস ও গল্পের মধ্যে দিয়ে গার্সিয়া মার্কেস তাঁর সাহিত্যকীর্তির অনন্যতা প্রমাণ করলেও তাঁর তথা বিশ শতকী উপন্যাস সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রত্ন যে ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’ নামক মহাকাব্যিক সৃষ্টিটি – এ নিয়ে সন্দেহের তেমন অবকাশ নেই। এই উপন্যাস প্রথমবার পড়ার সময় সমস্ত পাঠকই এক ঘোরলাগা অনুভূতির পর্ব পেরোতে থাকেন। বিস্ময়, কৌতূহল, আনন্দ, নেশা তাকে চেপে ধরে। অসংখ্য পাঠকই তার পরেও বারবার ফিরে ফিরে আসেন এই মহাগ্রন্থটির কাছে এবং পুনঃপাঠগুলিও সব সময়েই নতুন নতুন অভিঘাত নিয়ে তাঁদের আন্দোলিত করে। গার্সিয়া মার্কেসের উপন্যাসটির মধ্যেই রয়েছে এমন এক বহুস্তরিকতা, যা নানা পাঠে নানাভাবে পাঠককে উদ্বেল করে।

এই উপন্যাসের বিষয়, গড়ন, উপস্থাপণা, চরিত্রপাত্রদের সমারোহ, ঘটনাগতি, রাজনীতি, দর্শন, ন্যারেটিভ টেকনিক সহ নানা কিছুই আলাদা আলাদা করে এক একটি নিবন্ধ বা গ্রন্থের বিষয় হতে পারে।

গার্সিয়া মার্কেসের এই উপন্যাসটি যে মাকন্দো নামের অঞ্চলটিকে কেন্দ্র করে তৈরি তার প্রতিষ্ঠা, বিকাশ ও ধ্বংসপর্ব এই উপন্যাসটির আখ্যানভাগকে তৈরি করেছে। কলম্বিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসের দুটি বিশিষ্ট ঘটনা – হাজার দিনের গৃহযুদ্ধ (১৮৯৯-১৯০২) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ভিত্তিক ব্যবসায়ী সংস্থা ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানী কর্তৃক কলা চাষের প্রবর্তন ও তার সূত্রে ঘটা শ্রমিক গণহত্যা (১৯২৮) এই আখ্যানপর্বের দুটি বিশিষ্ট মুহূর্ত। অবশ্য এই উপন্যাস পাঠকের মনযোগ আকর্ষণ করে নেয় মাকন্দো নামের গ্রামটির একেবারে প্রতিষ্ঠা পর্বেই। এই পর্বের তিন বিশিষ্ট চরিত্র – হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, তার স্ত্রী উরসুলা ইগুয়ারান এবং মাকন্দোতে আসা জিপসী মেলকিয়াদেস। উপন্যাস শুরু হওয়ার কিছু পরে আমরা জানতে পারি কেন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তাঁর স্ত্রী উরসুলা ও কিছু ভাগ্যান্বেষী পরিবারকে নিয়ে দীর্ঘ কয়েক মাসের পথ পাড়ি দিয়ে এই মাকন্দোতে এসে পৌঁছেছিল। উরসুলার পরিবার বেশ কয়েক প্রজন্ম আগে থাকতেন রিওহাচাতে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষে যখন স্প্যানিশ আর্মাডার সঙ্গে লড়ছেন ইংরেজ নাবিক ও সেনাপতি স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক – সেই সময়ে ঘটে যায় এক দুর্ঘটনা।

যখন জলদস্যু ফ্রান্সিস দ্রেক ষোড়শ শতকে রিওয়াচা আক্রমণ করেন, তখন উরসুলা ইগুয়ারানের পরদাদি বিপদঘণ্টা আর কামানের গোলার শব্দে দিশা হারিয়ে জ্বলন্ত উনুনের ওপর বসে পড়েছিল। সেই আগুনের ক্ষত তাকে করে দিয়েছিল সারা জীবনের জন্য এক অকর্মা বউ। সম্পূর্ণভাবে বসতে পারত না সে, বসত এক পাশে ভর করে, বালিশের সাহায্যে। তার হাঁটাচলায় অজ্ঞাত কিছু একটা ছিল, যে কারণে সে আর কখনোই জনসমক্ষে হাঁটেনি। গা থেকে পোড়া গন্ধ বের হয়, এমন বদ্ধমূল ধারণা থাকায় সব ধরনের সামাজিক কাজ থেকে সে বিরত থাকত।

এরপর যে স্প্যানিশ ব্যবসায়ী স্বামীর ঔরসে তার দুই সন্তান রয়েছে, সে ওষুধপথ্য আর আনন্দফুর্তির পেছনে দোকানের অর্ধেকটা ফতুর করে ফেলে স্ত্রীর ভয় কাটানোর জন্য। সবশেষে ব্যবসা লাটে তুলে তাকে নিয়ে যায় সমুদ্র থেকে দূরে পাহাড়ের পাদদেশে এক নিরীহ আদিবাসীদের লোকালয়ে, সেখানে বানায় স্ত্রীর জন্য এক শোবার ঘর। ওটাতে কোনো জানালা ছিল না, যা দিয়ে তার দুঃস্বপ্নের জলদস্যুরা ঢুকতে পারে। এই আদিবাসী গুয়াহিরাদের লোকালয়েই উরসুলা ইগুয়ারান ও তাঁর জ্ঞাতি হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার পরিবার বংশ পরম্পরায় থাকত। আখ্যানকার আমাদের জানান – ‘সেই গোপন লোকালয়ে অনেক আগে থেকে বাস করত দন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া নামের এক আদিবাসী তামাকচাষি, যার সঙ্গে উরসুলার দাদির বাবা এমন এক লাভজনক অংশীদারি ব্যবসা গড়ে তোলে যে কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের ভাগ্য ফেরে। কয়েক শতাব্দী পর সেই আদিবাসীর নাতির নাতি বিয়ে করে স্প্যানিশ নাতনির নাতনিকে’। … ‘ওরা ছিল জ্ঞাতিভাইবোন। ওদের পূর্বপুরুষদের শ্রম আর প্রথা একসঙ্গে বেড়ে ওঠা প্রাচীন লোকালয়কে প্রদেশের সবচেয়ে ভালো গ্রামগুলোর একটিতে পরিণত করেছিল। যদিও যখন ওরা এই পৃথিবীতে আসে, তখন থেকেই ওদের বিয়ে ছিল পূর্বনির্ধারিত। কিন্তু যখন ওরা পরস্পরকে বিয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করে, তখন ওদের নিজেদের আত্মীয়রাই তাতে বাধা দেয়। ভয় ছিল যে দুই বংশের এই স্বাস্থ্যবান জুটি বংশপরম্পরায় নিজেদের মধ্যে উপর্যুপরি সংকরের ফলে ইগুয়ানার (গিরগিটি) মতো সন্তান জন্ম দিয়ে লজ্জা পেতে পারে’। বিয়ের পরও এই আশঙ্কা থেকে উরসুলা স্বামীর সঙ্গে যৌন সঙ্গম করত না। শক্ত সমর্থ, স্বেচ্ছাচারী স্বামী ঘুমের মাঝে ধর্ষণ করতে পারে, এই ভয়ে উরসুলা শোবার সময় ওর মার হাতে তৈরি প্রাচীনকালের প্যান্ট পরত, যেটাকে মজবুত করা হয়েছিল একধরনের ফিতে ও আড়াআড়ি তার জুড়ে দিয়ে, যেটা বন্ধ করা যেত সামনের দিক থেকে খুব মোটা লোহার বক্লেস দিয়ে। বিয়ের বেশ কিছুদিন পরেও উরসুলা সন্তানসম্ভবা না হওয়ায় চারিদিকে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার যৌন ক্ষমতা নিয়ে রসালো আলাপ আলোচনা শুরু হয়। অবশেষে এক করুণ রোববারে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া স্থানীয় বাসিন্দা প্রুদেনসিও আগিলারের সঙ্গে এক মোরগলড়াই-এ জেতে। ক্রোধোন্মত্ত পাশবিক উত্তেজনায় প্রুদেনসিও সর্বসমক্ষে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার যৌন অক্ষমতা নিয়ে কটু ব্যঙ্গ করলে সে প্রুদেনসিও আগিলারকে লক্ষ্য করে বলে, ‘আর তুইও বাড়ি যা, অস্ত্র নিয়ে তৈরি হ, কারণ তোকে মেরে ফেলব।’ মিনিট দশেক পর দাদার ধারালো বল্লম নিয়ে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ফিরে আসে মোরগ লড়াইয়ের জায়গাটায়, যেখানে গ্রামের অর্ধেক লোক জড়ো হয়েছিল। প্রুদেনসিও আগিলার সেখানেই অপেক্ষা করছিল। আত্মরক্ষার সময়ও প্রুদেনসিও পায় না। ষাঁড়ের মতো শক্তি দিয়ে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বল্লমটাকে এমনভাবে ছোড়ে যে তা গলা ভেদ করে বেরিয়ে যায় প্রুদেনসিওর। সেই রাতে যখন মোরগলড়াইয়ের জায়গায় লাশটার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হচ্ছে, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ঢুকে শোবার ঘরে, ওর বউ তখন যৌন সঙ্গম এড়ানোর প্যান্টটি পরছে। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া উরসুলাকে সেটি খুলতে আদেশ করে আর বলে, ‘যদি ইগুয়ানারই জন্ম দাও, ইগুয়ানাই লালন করব, কিন্তু তোমার দোষে এই গ্রামে আর কেউ মারা যাবে না।’

ওরা জেগেছিল সকাল হওয়া পর্যন্ত বিছানায় লুটোপুটি করে আর অন্যদিকে যে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল শোবার ঘরের ভেতর দিয়ে, তা ছিল প্রুদেনসিও আগিলারের আত্মীয়দের কান্নায় ভারী। বস্তুতপক্ষে এই প্রুদেনসিওর মরা মুখের ছবিটি এর পর থেকে ফিরে ফিরে আসতে থাকে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিরার চোখের সামনে ও কিছুতেই একে এড়াতে না পেরে এলাকা ছেড়ে চিরতরে এক নতুন জায়গায় বসতি স্থাপণের জন্য সে উরসুলাকে নিয়ে রওনা হয়। সঙ্গে জুটে যায় আরো কয়েক ঘর ভাগ্যান্বেষী।

ওরা চেষ্টা করছিল রিওয়াচার উল্টো দিক ধরে এগিয়ে যেতে, যাতে কোনো পদচিহ্ন না থাকে বা কোনো পরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা না হয়। ওটা ছিল এক অর্থহীন অভিযাত্রা। চৌদ্দ মাসের মাথায়, বানরের মাংস আর সাপের স্যুপে খারাপ হয়ে যাওয়া পেট নিয়ে উরসুলা জন্ম দেয় মানুষের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গসহ এক ছেলের। দুজন লোক এক লম্বা লাঠিতে দোলখাটিয়ায় ঝুলিয়ে অর্ধেক রাস্তা পার করে উরসুলাকে, কারণ তার পা ফুলে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল আর পায়ের শিরাগুলো ফুলে উঠেছিল। প্রায় দু বছর পর, অবশেষে তারা যাত্রা শেষ করে ছাউনি ফেলে এক পাথুরে নদীর পাড়ে, যার জল ছিল ঠান্ডা কাচের মতো।

বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন এই জনপদের নাম তারা দেয় মাকন্দ। “তখন মাকন্দ ছিল প্রাগৈতিহাসিক ডিমের মতো প্রকাণ্ড, মসৃণ আর সাদা পাথরের পাশ দিয়ে বয়ে-চলা কাকচক্ষু নদীর পাশে মাটি আর নল দিয়ে তৈরি কুড়িটি বাড়ির এক গ্রাম আর পৃথিবী ছিল এতই নতুন যে বহু কিছুই ছিল নামের অপেক্ষায়, আর সেগুলোর উল্লেখ করতে হলে বুঝিয়ে দিতে হতো আঙুলের ইশারায়।”

মাকন্দোর সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর সংযোগ ঘটায় ভ্রাম্যমাণ জিপসীরা। তাঁদের অন্যতম জ্ঞানী মেলকিয়াদেস। আখ্যানকার আমাদের জানান, “প্রতিবছর মার্চে ছন্নছাড়া এক জিপসি পরিবার গ্রামের পাশে তাঁবু খাটাত আর বাঁশি খোল-করতালের হল্লা তুলে দেখিয়ে বেড়াত নিত্যনতুন সব আবিষ্কার। প্রথমবার তারা আনে চুম্বক। বাবুই পাখির পায়ের মতো সরু লিকলিকে হাতওয়ালা দশাসই চেহারার ও বেয়াড়া রকমের দাড়ি-গোঁফওয়ালা জিপসি মেলকিয়াদেস দেখিয়েছিল এক জবরদস্ত প্রদর্শনী, যা ওর মতে মেসিদোনিয়ার আলকেমিদের আবিষ্কৃত অষ্টম আশ্চর্য। সেই ধাতবপিণ্ড টানতে টানতে বাড়ি বাড়ি যায় সে আর গামলা, পাইলা, কড়াই, চুলা আর আংটাগুলো সব যার যার জায়গা থেকে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এসে সবাইকে তাজ্জব করে দেয়। ক্যাঁচকেঁচিয়ে ওঠে ক্রু-পেরেকগুলো বেরিয়ে না আসতে পারার যন্ত্রণায়, এমনকি বহু দিন আগে থেকে খুঁজে না পাওয়া জিনিসগুলো বেরিয়ে আসে একই জায়গা থেকে, যেখানে সবচেয়ে বেশি খোঁজা হয়েছিল, আর জাদুকরি লোহার পেছনে সব টানতে টানতে জিপসিদের অপরিশীলিত উচ্চারণে মেলকিয়াদেস ঘোষণা করে, ‘সব জিনিসেরই নিজস্ব প্রাণ আছে; এ হচ্ছে কেবল ওদের আত্মাকে জাগিয়ে তোলার ব্যাপার।”

মেলকিয়াদেস এই উপন্যাসের এক প্রধান চরিত্র। বুয়েন্দিয়া পরিবারের বেশ কয়েকটি প্রজন্মকে তিনি সরাসরি বা তাঁর লেখা ও কাজের মাধ্যমে প্রভাবিত করেন। এই উপন্যাসের প্রথম প্রজন্ম হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার মধ্যে তিনি জাগিয়ে দেন জ্ঞানের নেশা। মেলকিয়াদেসের সাহয্যেই হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া গড়ে তোলেন তাঁর নিজস্ব গবেষণাগার। মেলকিয়াদেস নানা সময়েই ফিরে ফিরে আসতেন এই গবেষণাগারে এবং হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব আড্ডা জ্ঞান ও গবেষণা বিনিময়ের এর আকর্ষণীয় পর্ব তখন সংগঠিত হত। পরে জানা যায় মেলকিয়াদেস সংস্কৃত ভাষায় লিখে গেছেন বুয়েন্দিয়া পরিবার তথা মাকন্দোর ইতিকথা। আগে লিখে যাওয়া সে ইতিকথা অনুযায়ীই এগিয়েছে পরবর্তী ইতিহাস। অবশ্য সংস্কৃত ভাষায় লেখা এই পার্চমেন্টগুলি নিয়ে বুয়েন্দিয়াদের বিভিন্ন প্রজন্ম নাড়াচাড়া করলেও কেউই এর পাঠোদ্ধার করতে পারে নি। এর পাঠোদ্ধার অবশেষে হয় বুয়েন্দিয়া পরিবারের ষষ্ঠ প্রজন্মের আর এক জ্ঞানতৃষ্ণ যুবক আউরেলিয়ানো ব্যাবিলোনিয়ার হাত ধরে। বুয়েন্দিয়া পরিবারের এই ইতিহাস রচনার সূত্রে মেলকিয়াদেস ও তার পার্চমেন্টগুলি কাহিনীর কাঠামোকে ধরে রেখেছে। গার্সিয়া মার্কেস জানিয়েছিলেন তাঁকে সংস্কৃত ভাষার বিভিন্ন দিক নিয়ে যথেষ্ট পড়াশুনো করতে হয়েছিল এই সংক্রান্ত অংশটিকে জীবন্ত করে তোলার জন্য। ভারতীয় ধ্রুপদী সাহিত্য সম্পর্কে অনভিজ্ঞ গার্সিয়া মার্কেসের লাতিন আমেরিকান বা ইউরোপীয় পাঠকেরা মেলকিয়াদেসের ইতিহাস লেখন সূত্রটি প্রসঙ্গে হয়ত ভেবে উঠতে পারবেন না বাল্মীকির রাম ও রামায়ণের কথা, কিন্তু ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’ উপন্যাসের ভারতীয় পাঠকের চিন্তা চেতনাকে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যেতে পারে না। আমাদের মনে হয় রামের জন্মের আগেই বাল্মীকির রামায়ণ লিখে ফেলার প্রচলিত আখ্যানটি সংস্কৃত ভাষায় মেলকিয়াদেসের বুয়েন্দিয়া পরিবারের ইতিকথা আগেই লিখে ফেলার প্রসঙ্গটি ভাবতে গার্সিয়া মার্কেসকে সাহায্য করে থাকতে পারে। গার্সিয়া মার্কেস এই উপন্যাস লেখার সময় চল্লিশটা খাতায় তাঁর লেখার প্রয়োজনীয় নোট নিয়েছিলেন যা প্রকাশকের মূল কপি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর তিনি তাঁর স্ত্রী মেরসেদেসের সঙ্গে ধ্বংস করে ফেলেন। গার্সিয়া মার্কেস পরে জানিয়েছিলেন এক ধরনের সংকোচবোধ থেকেই তিনি এটা করেছিলেন। কারণ, “ওগুলো ছিল যেন বইটার দর্জির দোকান, রান্নাঘর, অবাঞ্ছিত উচ্ছিষ্ট, বাইরের খোলস, ডিমের খোলা, আলুর খোসা… ওই খাতাগুলো এমন এক গোপনীয়তা যা আর কাউকে দেখানো যায় না”। কিন্তু পরে লেখক বোঝেন কাজটা হয়ত ঠিক হয় নি। “আমার বন্ধুরা আর সমালোচকরা বলেন যে ওটা করা উচিত হয়নি, কারণ ওগুলো গবেষকদের খুব কাজে লাগত।” (এক লেখকের দুঃসাহসিকতা – এলিহিও গার্সিয়া মার্কেস)। লিখন প্রক্রিয়ার ভেতরের খবর যদি এইভাবে ধ্বংস না হয়ে যেত তাহলে হয়ত সংস্কৃত সংক্রান্ত কী ধরনের গবেষণা গার্সিয়া মার্কেস করেছিলেন, রাম জন্মের আগেই বাল্মীকির রামকাহিনী লিখে ফেলার বিষয়টি গার্সিয়া মার্কেসকে কতটা প্রভাবিত করেছিল, তা আমরা জানতে পারতাম।

এই প্রসঙ্গেই আমরা উল্লেখ করতে পারি গার্সিয়া মার্কেস এই উপন্যাস রচনার জন্য কী বিরাট প্রস্তুতি নিয়েছিলেন সেই প্রসঙ্গটি। গার্সিয়া মার্কেসের ছোট ভাই এলিহিও গার্সিয়া মার্কেস তাঁর পূর্বোক্ত রচনায় গার্সিয়া মার্কেসের জবানীতে জানিয়েছেন, “একশো বছরের নিঃসঙ্গতা লেখার জন্য ডাক্তার ও উকিলদের পরামর্শ নিয়েছি আর তার সঙ্গে বাড়িতে জড়ো করেছিলাম ডাক্তারি, অপরসায়ন, দর্শন, বিশ্বকোষ, উদ্ভিদবিদ্যা, ও প্রাণীবিদ্যার অসংখ্য বই, যাতে প্রতিটি তথ্য নিখুঁতভাবে যাচাই করে নিতে পারি।” এছাড়াও বিভিন্ন বন্ধু ও পরিচিতদের তিনি অনুরোধ করতেন কোনও কোনও বিষয়ে পড়াশুনো করে তার নির্যাস তাঁকে জানাতে বা নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর দিতে। হোসে এমিলি পাচেকোকে বলেছিলেন পরশপাথর বিষয়ে জানাতে। হুয়ান ভিস্তেকে গাছপালা বিষয়ে আর কলম্বিয়ার একজনকে কলম্বিয়ার গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে নানা কিছু জানাতে তিনি অনুরোধ করেন লেখার সময়টায়।

উপন্যাসের প্রথম প্রজন্ম হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার জ্ঞানতৃষ্ণা সঞ্চারিত হয়েছিল দ্বিতীয় প্রজন্মের কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মধ্যে, কিন্তু তার দাদা হোসে আর্কাদিও এই জ্ঞানতৃষ্ণা দ্বারা সেভাবে কখনো স্পৃষ্ট হয় নি। চতুর্থ প্রজন্মের আউরেলিয়ানো সেগুন্দো মেলকিয়াদেসের পাণ্ডুলিপিগুলি নিয়ে আবার নাড়াচাড়া শুরু করেন। তবে সেই সময়ে অন্যলোক থেকে মেলকিয়াদেস নিজেই যেন ফিরে এসে বার্তা দিয়ে যান একশো বছর পূর্ণ হবার আগে এর পাঠোদ্ধার সম্ভব হবে না। আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর যমজ ভাই আর্কাদিও সেগুন্দো গণহত্যার পরের দিনগুলিতে ফিরে এসে যখন এই পরিত্যক্ত ঘরটিতে লুকিয়ে ছিলেন, তখন তিনিই প্রথম বুঝতে পারেন এই পাণ্ডুলিপি লেখা হয়েছে সংস্কৃত ভাষায়। ষষ্ঠ প্রজন্মের চরিত্র আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার হাত ধরে পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার হয় এবং তার সূত্রেই জ্ঞানতৃষ্ণা আর গবেষণা আবার ফিরে আসে আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দুতে।

গবেষণা ও জ্ঞানতৃষ্ণা যদি ‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’ উপন্যাসের একটি কেন্দ্রীয় থিম হয়, তবে অন্য দুটি নিঃসন্দেহে যুদ্ধ ও যৌনতা। উপন্যাসের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের চরিত্রপাত্ররা যুদ্ধ ও রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে ভীষণভাবে আন্দোলিত হয়েছে। কলম্বিয়ার ইতিহাসের অন্যতম কেন্দ্রীয় ঘটনা ‘হাজার দিনের গৃহযুদ্ধ’ – যা ঘটেছিল রক্ষণশীল ও উদারনৈতিকদের মধ্যে। উদারপন্থীরা চেয়েছিল অনেক বেশি আঞ্চলিক সায়ত্তশাসন, সবার ভোটদানের অধিকার, প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরের নির্ধারণ, চার্চের ক্ষমতাহ্রাস, রেজিস্ট্রি বিয়ের অধিকার, সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা। অন্যদিকে রক্ষণশীলরা ছিল শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের পক্ষে। বিদেশে জন্মানো বিবাহ বহির্ভূত কলম্বিয়ান সন্তানদের নাগরিকত্ব দেবার পক্ষপাতী তারা ছিল না। চার্চ ও ধর্মের পক্ষে তারা কথা বলত, সমাজে ও রাষ্ট্রে ধর্মের গুরুত্ব বাড়ানোর দিকেই ছিল তাঁদের সায়। কলম্বিয়ার শাসনের প্রকৃতি নিয়ে এই দুই শক্তি কোনও আপোষ রফায় আসতে পারে নি, গড়ে তুলতে পারে নি কোনও বহুজনগ্রাহ্য সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। ১৮২০ তে স্বাধীনতার পর থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত প্রায় আশিটি ছোট বড় গৃহযুদ্ধ হয়েছিল সেখানে, অর্থাৎ প্রতি বছরে গড় পড়তা প্রায় একটি। ১৮৯৯ থেকে ১৯০২ অবধি চলা গৃহযুদ্ধটিই ছিল সবচেয়ে বড় মাপের, যা ‘হাজার দিনের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত হয়। এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া ও তাঁর প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠেন। উদারনৈতিকদের প্রধান নায়ক সেনাপতি উরিব উরিবের ঐতিহাসিক চরিত্রটির আদলে এই আখ্যানের কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার চরিত্রটি সৃষ্টি করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া বিয়ে করেছিল মাকন্দোর প্রশাসক হয়ে আসা দন আপলিনার ছোট মেয়ে রেমেদিওস মসকোতেকে। বিয়ের অল্প পরেই আউরেলিয়ানোকে নিঃসঙ্গতায় নিমজ্জিত করে রেমেদিওসের মৃত্যু হয়। অবশ্য প্রশাসক শ্বশুরের সঙ্গে আউরেলিয়ানর বন্ধুত্ব ও প্রতিদিনের আড্ডা অব্যাহত থাকে। সেইসূত্রেই এক নির্বাচনকে অনৈতিকভাবে সম্পন্ন হতে দেখে সে আর রক্ষণশীল শ্বশুরের সঙ্গে সংশ্রব ত্যাগ করে উদারনৈতিকদের হয়ে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘর ছাড়ে। গার্সিয়া মার্কেস এটা উপস্থাপণ করেন পরিমিতি ও নাটকীয়তার সমাহারে। - ‘সামরিক দখলের দুই সপ্তাহ পর এক রোববার আউরেলিয়ানো ঢোকে হেরিনেলদো মার্কেসের বাড়ি তার স্বভাবজাত শান্তভাব নিয়ে আর চিনি ছাড়া এক কাপ কফি চায়। যখন রান্নাঘরে শুধু দুজন, তখন আউরেলিয়ানো তার গলায় আনে এক কর্তৃত্বের স্বর, যেটা কখনোই কেউ জানত না, ‘ছেলেগুলোকে তৈরি হতে বলো’, বলে, ‘যুদ্ধে যাচ্ছি আমরা।’ হেরিনেলদো বিশ্বাস করে না।

‘কোন অস্ত্র দিয়ে’… জিজ্ঞেস করে।

‘ওদের অস্ত্র দিয়ে’—উত্তর দেয় আউরেলিয়ানো। এক মঙ্গলবার মধ্যরাতে আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার আজ্ঞাধীন তিরিশ বছরের কম বয়স্ক একুশজন যুবক খাবারের টেবিলের ছুরি ও ধারালো লোহা দিয়ে এক অভাবনীয় অকস্মাৎ হামলা চালিয়ে দখল করে সেনাশিবির, নিয়ে নেয় তাদের অস্ত্রশস্ত্র, উঠানেই গুলি করে মেরে ফেলে ক্যাপ্টেন আর সঙ্গে চারজন সৈনিককে যারা হত্যা করেছিল মহিলাকে।

ওই একই রাতে যখন সৈনিকদের মেরে ফেলার গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, তখনই আউরেলিয়ানোর আত্মপ্রকাশ ঘটে সামরিক কর্তৃত্ব হিসেবে। কোনো রকমে সময় পায় বিবাহিত বিদ্রোহীরা নিজেদের স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার আর তারা স্ত্রীদের বলে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই যেন করে নেয়। আতঙ্কমুক্ত লোকজনের আনন্দধ্বনির মধ্য দিয়ে ভোরবেলায় ওরা চলে যায় বিদ্রোহী জেনারেল ভিক্তর মেদিনার শক্তির সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য, শেষ খবর অনুযায়ী সে তখন ছিল মানাউরের পথে। যাওয়ার আগে আউরেলিয়ানো দন আপলিনার মসকতেকে বের করে আনে এক জামাকাপড় রাখার দেয়াল আলমারি থেকে। ‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন’ বলে তাকে, ‘নতুন সরকার সম্মানজনক কথা দিচ্ছে পারিবারিক ও নাগরিক নিরাপত্তার।’ এই উঁচু বুট পরিহিত, পিঠে বন্দুক ঝোলানো লোকটাকে তার সঙ্গে রাত নয়টা পর্যন্ত দোমিনো খেলার মানুষটাকে মেলাতে কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় দন আপলিনা মসকতের জন্য। ‘এটা এক পাগলামি আউরেলিতো’, কাতর কণ্ঠে বলে সে। ‘কোনো পাগলামিই নয়’, বলে আউরেলিয়ানো, ‘এটা হচ্ছে যুদ্ধ। আর আমাকে কখনোই আউরেলিতো বলবেন না, আমি হচ্ছি কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া।’

উপন্যাসের ষষ্ঠ অধ্যায় থেকেই বারুদের গন্ধ একে গ্রাস করে। অনেক হত্যা ও উত্থানপতন ঘটতে থাকে দ্রুত। আখ্যানকার আমাদের জানান যে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া বত্রিশটি সশস্ত্র বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয় আর পরাজিত হয় সব কটিতেই। সতেরোজন ভিন্ন রমণীর গর্ভে জন্ম দেয় সতেরোজন পুত্রসন্তানের আর পুত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বড়জনের পঁয়ত্রিশ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে এক রাতেই একের পর এক মেরে ফেলা হয় তাদের। বেঁচে থাকে কেবল চারজন। কর্নেল বুয়েন্দিয়া কিন্তু পালিয়ে বাঁচে প্রাণের ওপর চৌদ্দটি হামলা, তেষট্টিটা অ্যামবুশ আর একটি ফায়ারিং স্কোয়াড থেকে। একটি ঘোড়াকে মেরে ফেলার পরিমাণ স্ট্রিকনাইন (বিষ) মিশিয়ে দেওয়া কফি পান করেও বেঁচে যায় সে। প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টের প্রদত্ত অর্ডার অব মেরিট প্রত্যাখ্যান করে এক সীমান্ত হতে অন্য সীমান্ত পর্যন্ত বৈধ কর্তৃত্ব বজায় রেখে, সরকারের চোখে সবচেয়ে বিপজ্জনক লোক হিসেবে গণ্য হয়ে বিদ্রোহী বাহিনীর সেনাপ্রধানের পদ পেলেও সে কখনো তার ছবি তোলার অনুমতি দেয় না। যুদ্ধের পরে প্রস্তাবিত আমরণ পেনশন নিতে অস্বীকার করে আর বেঁচে থাকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত মাকন্দে, নিজের কর্মশালায় সোনার ছোট ছোট মাছ বানিয়ে। যদিও সে সব সময় সম্মুখভাগে যুদ্ধ করত তবু একমাত্র যে আঘাতটা পায়, সেটা বিশ বছরের গৃহযুদ্ধের ইতি টানানো নিরলান্দিয়ার চুক্তি স্বাক্ষরের পরে, যেটা করেছিল সে নিজের হাতেই, আত্মহত্যার প্রচেষ্টা হিসেবে। এক পিস্তল দিয়ে নিজের বুকে গুলি করে সে আর বুলেট বেরিয়ে যায় বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যক কোনো অঙ্গের ক্ষতি না করেই। অনেক কিছু অর্জনের পরেও একমাত্র যা বেঁচে থাকে তা হচ্ছে, মাকন্দে তার নামে নামকরণ করা এক রাস্তা। যদিও বার্ধক্যজনিত মৃত্যুর অল্প কয়েক বছর আগে তার কথা অনুযায়ী জানা যায় যে সেই সকালে, যখন সে একুশজন ছেলে নিয়ে রওনা হয় জেনারেল ভিক্তর মেদিনার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে, তখন সে এটুকুও প্রত্যাশা করে নি।

বহু সামরিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলেও যুদ্ধক্ষেত্রে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মৃত্যু হয় নি। বার্ধক্যে বাড়িতে এক গাছের নীচে উপন্যাসের নায়কের পরিণত মৃত্যু হয়। কিন্তু বুয়েন্দিয়াদের তৃতীয় প্রজন্মের দুই পুত্র – আর্কাদিও আর অরেলিয়ানো হোসের মৃত্যু হয় তার অনেক আগেই - বুলেটের আঘাতে। যুদ্ধের একপর্বে আবার ঘর ছাড়ার সময় ভাইপো আর্কাদিওকে কর্নেল বলেছিলেন, ‘তোর হাতে রেখে গেলাম মাকন্দকে, … চেষ্টা করিস যাতে ফিরে এসে আরও ভালো অবস্থায় পাই।’

কিন্তু আর্কাদিও হয়ে ওঠে এক দুর্নীতি পরায়ণ স্বৈরশাসক। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই আদেশ করার প্রতি টান দেখা যায় আর্কাদিওর ভেতরে। মাথার মধ্যে কোনো আদেশের চিন্তা খেলে গেলে দিনে চারবার করে পড়ে শোনাত সেটা। আঠারো বছর বয়সের বেশি বয়স্ক লোকদের জন্য সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়, সন্ধ্যা ছয়টার পর রাস্তায় জীবজন্তু ঘুরে বেড়ালে সেটাকে জনসাধারণের সম্পত্তি বলে গণ্য হবে বলে জানায় আর বৃদ্ধদের বাধ্য করে বাহুতে লাল ফিতা বাঁধতে। মৃত্যুদণ্ডের ভয় দেখিয়ে ফাদার নিকানোরকে পাদরিদের ঘর থেকে বের হতে, আর কোনো রকমের উপদেশ দেওয়া নিষিদ্ধ করে। অবৈধ করা হয় উদারপন্থীদের বিজয় উৎসব ছাড়া অন্য কোনো কারণে গির্জার ঘণ্টা বাজানোও। যাতে কারও মনে তার আদেশের গুরুত্ব নিয়ে সন্দেহ না জাগে সে ফায়ারিং স্কোয়াডের সৈন্যদের আদেশ করে প্লাজায় এক কাকতাড়ুয়া বানিয়ে ওতে গুলি করার জন্য। প্রথম দিকে কেউ ওর আদেশের তেমন গুরুত্ব দেয় না। ওরা ভাবছিল, আসলে এরা হচ্ছে স্কুলের বাচ্চা, বড়দের খেলা খেলছে। কিন্তু এক রাতে আর্কাদিও কাতরিনার দোকানে ঢোকার সময় ঢোলবাদক আনুষ্ঠানিক বাজনা বাজিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানালে খরিদ্দারদের মধ্যে হাসির রোল ওঠে, আর কর্তৃপক্ষের প্রতি অসম্মান দেখানোর অপরাধে আর্কাদিওর আদেশে গুলি করে মেরে ফেলা হয় তাকে। যারা এর প্রতিবাদ করে তাদের গোড়ালিতে বেড়ি পরিয়ে রুটি আর জল দিয়ে স্কুলের এক কামরায় আটক করা হয়। ‘তুই এক খুনি’, উরসুলা চেঁচাত যখন নতুন কোনো বিচারের কথা তার কানে যেত, ‘যখন আউরেলিয়ানো জানতে পারবে, তখন তোকে গুলি করে মারবে আর তাতে সবার আগে আমিই খুশি হব।’ কিন্তু এসব কিছুই বৃথা যায়। আর্কাদিও অকারণেই শাসনযন্ত্রের সব ক্রুকে এমনভাবে টাইট করতে থাকে যে সে হয়ে ওঠে মাকন্দের শাসকদের মধ্যে নিষ্ঠুরতম। ‘এখন উপভোগ কর তফাতটা’—দন আপলিনার মসকতে এক সময় বলে। ‘এই হচ্ছে উদারপন্থীদের স্বর্গ।’ আর্কাদিও জানতে পারে কথাটা। পাহারাদারদের সামনেই হামলা চালায় দন আপলিনারের বাড়িতে। ধ্বংস করে সব আসবাব। মেয়েদের ধরে পেটায় আর টানাহেঁচড়া দাগ রেখে যায় দন আপলিনার মসকতের শরীরে।

উদারপন্থী সৈন্যরা মাকন্দোর দখল নিলে আর্কাদিওর স্বৈরশাসনের সংক্ষিপ্ত পর্বটি শেষ হয়। উদারপন্থীদের পরাজয়ের সংবাদ ক্রমেই আরও দৃঢ় হতে থাকে। মার্চের শেষের দিকে এক অকাল বৃষ্টির মধ্যে ভোরের কিছু আগে, সপ্তাহগুলোর উৎকণ্ঠায় ভরা শান্ত অবস্থাটা হঠাৎ করেই ভেঙে পড়ে এক অনাকাঙ্ক্ষিত রণনিনাদে আর তার পশ্চাদ্ধাবন করে এক কামানের গোলা, যা ভেঙে দেয় গির্জার চূড়াটা। সত্যিকার অর্থে আর্কাদিওর প্রতিরোধের ইচ্ছাটা ছিল এক পাগলামি। অপ্রতুল অস্ত্রসহ তার ছিল সাকুল্যে পঞ্চাশজন লোক, যাদের একেকজনের কাছে বিশটির বেশি কার্তুজ ছিল না। তারা সবাই নিহত হয়। ধরা পড়ে আর্কাদিও। এক সংক্ষিপ্ত কোর্ট মার্শালের পর সমাধিস্থলের দেয়ালে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয় তাকে।

আর্কাদিওর ভাই তথা কর্নেল আউরেলিয়ানোর পুত্র আউরেলিয়ানো হোসেও বুলেট বিদ্ধ হয়ে মারা যায়। তবে যে বুলেটটা তার পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক ঝাঁঝরা করে দেয়, সেটা চলছিল তাসের আসরে।

এক মে মাসে গৃহযুদ্ধর একটি পর্ব শেষ হয়। সরকারপক্ষ কর্তৃক বিদ্রোহীদের কঠিন শাস্তি দেওয়ার অঙ্গীকারে সোচ্চারিত ঘোষণার দুই সপ্তাহ আগেই ধরা পড়ে যায় কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া। যে একুশজন ওর সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল, তাদের মধ্যে চৌদ্দজন মারা যায় যুদ্ধে, ছয়জন হয় আহত আর চূড়ান্ত পরাজয়ের সময় তাকে সঙ্গ দিয়েছিল শুধু একজন, কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস। বিচারের পর ফায়ারিং স্কোয়াডে তাঁর প্রাণদণ্ড কার্যকর হবার মুহূর্তে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তিত হয়। নতুন অভিযানে অংশ নিতে আবার বেরিয়ে যান কর্নেল আউরেলিয়ানো।

গৃহযুদ্ধ চলাকালীনই মারা যান হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া। এই মৃত্যুদৃশ্যটি রচনায় গার্সিয়া মার্কেসের মুন্সিয়ানা লক্ষ করার মতো। কাতাউর; অনিদ্রা রোগের সময় বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ভিসিতাসিওনের ভাই, কখনোই যার কোনো খবর পাওয়া যায়নি, হঠাৎ করেই ফিরে আসে মাকন্দোতে। কেন ফিরে এসেছে এই প্রশ্ন করলে সে নিজেদের ভাষায় গাম্ভীর্য নিয়ে উত্তর দেয়, ‘এসেছি রাজার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে।’ উরসুলা তখন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার ঘরে ঢুকে সব শক্তি দিয়ে একসঙ্গে ধাক্কা দেয়, কানের কাছে সকলে চিৎকার করে, নাকের ফুটোর কাছে এক আয়না ধরে, কিন্তু ওকে আর জাগাতে পারে না। কিছুক্ষণ পর যখন ছুতোর কফিন বানাতে মাপ নিচ্ছে, সবাই তখন জানালা দিয়ে দেখতে পায় একরাশ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হলুদ ফুলের গুঁড়ি বৃষ্টি। রাতভর গোটা গ্রামের ওপর সেই নীরব ফুলের ঝড় বয়ে যায়, বাড়ির ছাদগুলো ঢেকে দেয়, দরজাগুলো আটকে দেয় আর খোলা বাতাসে ঘুমানো সব জীবজন্তুর দম বন্ধ হয়ে আসে। আকাশ থেকে এত ফুল ঝরে যে রাস্তাগুলো জেগে ওঠে এক নিবিড় হলুদ ফুলের গালিচা হয়ে, আর শবযাত্রার জন্য সেগুলোকে বেলচা আর আঁচড়া দিয়ে পরিষ্কার করতে হয় ওদের।

‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’ উপন্যাসে যুদ্ধ শেষপর্যন্ত হতাশা আর অবসাদকেই বয়ে নিয়ে আসে। কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসই প্রথম বুঝতে পারে গৃহযুদ্ধের অসারতা। মাকন্দের সামরিক ও বেসামরিক প্রধান হিসেবে সপ্তাহে দুবার তাকে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার সঙ্গে টেলিগ্রাফের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হতো। প্রথম দিকে এগুলো এক জলজ্যান্ত যুদ্ধের প্রতি মুহূর্তের গতি প্রকৃতি আর তার ভবিষ্যৎকে সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করত। কিন্তু আস্তে আস্তে যুদ্ধটা যখন তীব্র হতে থাকে আর তার ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তখন তার প্রতিচ্ছবি মিলিয়ে যেতে থাকে এক বিশাল অবাস্তবতায়। কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসের যুদ্ধ সংক্রান্ত নিস্পৃহতা ক্রমশ ছড়িয়ে যায় কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মধ্যেও। তার ঔদাসীন্য এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে যুদ্ধের অচলাবস্থা নিয়ে আলোচনার জন্য তার দল থেকে ভারপ্রাপ্ত কিছু লোকের আগমনী সংবাদ পাওয়ায় সে সম্পূর্ণরূপে না জেগে দোলবিছানায় পাশ ফিরে শোয়, বলে - ‘বেশ্যাদের কাছে নিয়ে যা ওদের’। শান্তিচুক্তির পর নিজের বুকে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল কর্নেল বুয়েন্দিয়া। গুলিটা গুরুত্বপূর্ণ কোনও অঙ্গকে স্পর্শ না করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় সে মরে না, কয়েক মাস চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ওঠে। এরপর থেকে বাড়ির মধ্যে একটি ঘরে নিজেকে আজীবনের জন্য নিঃসঙ্গতার বৃত্তে আবদ্ধ করে ফেলে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া আর একটার পর একটা সোনার মাছ বানিয়ে যেতে থাকে ক্লান্তিহীনভাবে।

‘রাজনীতির কথা আর আমাকে বলিসনে’, বলত কর্নেল, ‘আমাদের কাজ হচ্ছে মাছ বিক্রি।’ সে কর্মশালায় কাজ করে ধনী বনে যাচ্ছে বলে দেশের ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চায় না, এই গুজব উরসুলার কানে এলে সেটা তার হাসির উদ্রেক করে। তার প্রখর বাস্তব বুদ্ধি দিয়েও সে কর্নেলের ব্যবসাটাকে বুঝতে পারত না, কারণ সোনার মাছগুলোর বিনিময় হতো স্বর্ণমুদ্রাগুলোর বদলে, পরে স্বর্ণমুদ্রাগুলোকে রূপান্তর করত কর্নেল ছোট ছোট সোনার মাছে, আর এভাবেই যত বেশি সে বিক্রি করত, তাকে তত বেশি কাজ করতে হতো এক ক্লান্তিকর দুষ্টচক্রকে সন্তুষ্ট করতে। সত্যি বলতে কি, যে ব্যাপারটা তাকে অকৃষ্ট করত, তা ব্যবসাটা নয়, তা হচ্ছে কাজ। আঁশগুলোকে জোড়া দিতে, চোখগুলোতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রুবি লাগাতে, কানকো বানাতে আর ডানা লাগাতে এত মনোযোগের প্রয়োজন পড়ত যে সে এক মুহূর্ত সময় পেত না যুদ্ধের মোহভঙ্গ নিয়ে চিন্তা করার। হাতের কাজটার সূক্ষ্মতার প্রয়োজনে এতই মনোযোগের প্রয়োজন হতো যে অল্প সময়ের মধ্যেই যুদ্ধের সব সময়ের চেয়েও বেশি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিল একনাগাড়ে একই ভঙ্গিতে বসে থাকার ফলে, তার শিরদাঁড়া বাঁকা হয়ে গিয়েছিল আর সূক্ষ্ম কাজের ফলে তার চোখের জ্যোতি গিয়েছিল কমে। কিন্তু গভীর মনঃসংযোগ তাকে উপহার দিয়েছিল আত্মার শান্তি। শেষবার তাকে যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কিছু করতে দেখা গিয়েছিল যখন দুই দলেরই পুরাতন যোদ্ধারা সব সময় আশ্বাস দেওয়া আজীবন অবসর-ভাতা না পেয়ে তার সমর্থন চাইতে যায়। ‘ভুলে যান আপনারা এগুলো’, ওদের বলে সে, ‘দেখছেন যে আজীবন ওটার জন্য অপেক্ষা করার চাইতে আমি পেনশন প্রত্যাখ্যান করেছি।’

এই উপন্যাসের  দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্ম যেভাবে গৃহযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেভাবেই চতুর্থ প্রজন্মর দুই যমজ ভাই - আউরেলিয়ানো সেগুন্দো আর হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোর জীবনবৃত্তটি মূলত কলা কোম্পানীর আখ্যানের সঙ্গে সংযুক্ত। ১৯২৮ সালে সিয়েনাগাতে কলা কোম্পানীর ধর্মঘটী শ্রমিকদের ওপর গুলি চালিয়ে যে নৃশংস গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল গার্সিয়া মার্কেসের এই উপন্যাস তাকে আখ্যানের অন্যতম প্রধান ঘটনা হিসেবে ধরে রেখেছে। কলা কোম্পানীর প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারের কথা গার্সিয়া মার্কেসের প্রথম উপন্যাস ‘লিফ স্টর্ম’ এও এসেছিল। ‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’তেই অবশ্য তা সবিস্তারের বর্ণিত হয়েছে।

মাকন্দোতে বরাবরই স্থানীয়ভাবে কলাচাষ হত। মার্কিন ব্যবসায়ী মিস্টার হেরবের্ট সেখানে আসত। মাকন্দোর কলার স্বাদ তাঁকে বিস্মিত করে। তখন সে বের করে তার সর্বক্ষণের সঙ্গী অপ্টিক্যাল যন্ত্রপাতির এক ছোট্ট বাক্স। হিরে ক্রেতার মতো সন্দিগ্ধ মনোযোগ নিয়ে বিশেষ এক ছুরি দিয়ে ছোট ছোট করে কেটে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে, ফার্মেসিতে ব্যবহৃত দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে আর অস্ত্র কারবারিদের ব্যবহৃত ক্যালিপার দিয়ে আয়তন হিসাব করে। পরে বাক্স থেকে বের করে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ও মাপে তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতা ও আলোর তীব্রতা। ঘটনাটা এমনই কৌতূহলজনক হয়ে ওঠে যে মিস্টার হেরবের্টের মুখ থেকে শেষমেশ এক চূড়ান্ত ও রহস্য উন্মোচন করার মতো ফলাফলের অপেক্ষায় থেকে কারোরই ঠিকমতো খাওয়া হয় না। কিন্তু সে এমন কিছুই বলে না যাতে করে তারা তার পরিকল্পনা বুঝতে পারে।

পরের দিনগুলোতে তাকে দেখা যায় একটা জাল ও ঝুড়ি নিয়ে গ্রামের চারপাশে প্রজাপতি ধরতে। বুধবারে হাজির হয় একদল ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, পানিবিজ্ঞানী, ভূ- জরিপকারী ও ভূ-সংস্থানবিদ। যারা পরের বেশ কয়েক সপ্তাহ যাবৎ অনুসন্ধান চালায়, যেখানে মিস্টার হেরবের্ট প্রজাপতি শিকার করেছিল। আরও পরে আসে হলুদ ট্রেনের লেজের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া সম্পূর্ণ রুপার পাতে মোড়া, নীল কাচ দিয়ে বানানো চাঁদওয়ালা, মখমল দিয়ে মোড়া যাজকদের চেয়ারসমেত বিশেষ ওয়াগনে মিস্টার ব্রাউন। ওই একই ওয়াগনে মিস্টার ব্রাউনের চারপাশে থাকে ভাবগম্ভীর কালো পোশাক পরিহিত তোষামোদকারী উকিলের দল, যারা অন্য সময় সর্বত্রই অনুসরণ করত কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে। তার ফলে মনে হয় দড়ি লাগানো বেলুনের মিস্টার হেরবের্টের ও তার রঙিন প্রজাপতির মতো ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, পানিবিজ্ঞানী, ভূ-জরিপকারী ও ভূ-সংস্থানবিদ, তার চারপাশে ঘুরে বেড়ানো তোষামোদকারী দল, ও তার হিংস্র জার্মান কুকুরদের সঙ্গে যুদ্ধের একটা সম্পর্ক আছে। কিন্তু এ নিয়ে বেশি কিছু ভাববার মতো সময় থাকে না কারোরই, কারণ যখন মাকন্দবাসী কেবল জিজ্ঞেস করতে শুরু করে কী ছাই মাথা ঘটে চলছে, ততক্ষণে গ্রামটা রূপান্তরিত হয় দস্তার চালওয়ালা কাঠের বাড়ির এক শিবিরে, যেখানে বাস করতে আরম্ভ করে ট্রেনভর্তি অর্ধেক দুনিয়ার বিদেশিরা। তারা আসে শুধু আসনগুলো ও পাদানিতে প্রবেশপথের সিঁড়িতে বসেই নয়, এমনকি ওয়াগনের ছাদ ভর্তি করেও। রেললাইনের অপর পারে পামগাছ দিয়ে ঘেরা রাস্তা, লোহার গ্রিল করা জানালা, উঠানে সাদা ছোট ছোট টেবিল, সিলিং থেকে ঝোলানো পাখা ও বিশাল লনে ঘুরে বেড়ানো ময়ূর ও তিতিরসমেত বাড়ি দিয়ে আলাদা একটি গ্রাম তৈরি হয়। ‘গ্রিংগোরা (আমেরিকান) নিয়ে আসে মসলিনের কাপড় পরিহিত ও শিফনের টুপি মাথায় দেওয়া তাদের স্ত্রীদের। এক বিশাল মুরগির খামারের মতো সারাটা এলাকা ঘেরা ছিল লোহার বিদ্যুতায়িত জাল দিয়ে। গ্রীষ্মের শীতল সকালগুলোতে ঝলসানো সোয়ালো পাখি দিয়ে ভরে কালো হয়ে যেত জালটা। তখনো কেউ বুঝত না ওরা কী খুঁজছে, অথবা সত্যিই ওরা শুধুই কি লোকহিতৈষী। ইতিমধ্যেই ওরা বিশাল বিশৃঙ্খলা ঘটিয়ে ফেলে, প্রাচীন জিপসিদের চেয়ে অনেক বেশি বিরক্তিকর কিন্তু এরা হয় মাকন্দে অনেক বেশি স্থায়ী ও এদের কাজ হয় অনেক কম বোধগম্য। অন্য সময়ে যা শুধু ঐশ্বরিক শক্তির জন্য সংরক্ষিত ছিল, হাতে পেয়ে তারা এলাকার বৃষ্টির ধরন বদলে দেয়, ফসল ফলানোর সময়টাকে বাড়িয়ে দেয়, নদীকে সরিয়ে ফেলে ওটার সাদা পাথর ও বরফশীতল স্রোতসুদ্ধ।

কলা কোম্পানী যখন মাকন্দোতে আধিপত্য বিস্তার করেছে তখন মার্কিনী কর্তাব্যক্তি আর পরিযায়ী শ্রমিকদের ঢল নামে এখানে। বড় শহর হিসেবে বিকশিত হয় মাকন্দো। ফুলে ফেঁপে ওঠে বুয়েন্দিয়া পরিবার। আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর গৃহপালিত পশুর ব্যবসা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল। সে একদিন খোশমেজাজে ঘুম থেকে উঠে এক বাক্স টাকা, এক ক্যান আঠা ও একটা বুরুশ নিয়ে সে বাড়িতে হাজির হয় আর ফ্রান্সিসকো এল অমব্রের পুরোনো গানগুলো গলা ছেড়ে গাইতে গাইতে বাড়িটা মুড়ে দেয় ভেতর-বাহির, ওপর-নিচ, আগাপাছতলা এক পেসোর নোট দিয়ে। মাকন্দোর সমস্ত পরিবারগুলিই সম্পদশালী হয়ে উঠতে থাকে। আখ্যানকার আমাদের জানান, ‘মাকন্দ ডুবে ছিল এক অলৌকিক বৈভবে। পত্তনকারীদের কাদা আর গোল পাতার ছাউনিগুলোর বদলে তখন এসেছে ইটের দালান, কাঠের জানালার পর্দা আর সিমেন্টের মেঝে’। এই সূত্রেই মাকন্দে প্রথমবার পাতা হয় রেললাইন আর তার পর আসে রেলগাড়ি। এর বাসিন্দাদের জন্য তৈরি হয় এক নতুন বিস্ময়।

‘এই সময় জনবসতি কেঁপে ওঠে এক ভয়ংকর শিস ও প্রচণ্ড হাঁপানির শব্দের শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রতিধ্বনিতে। আগের সপ্তাহগুলোতে দেখা যাচ্ছিল একদল লোককে রেললাইন ও স্লিপার পাততে কিন্তু কেউ তাতে আমল দেয়নি, কিন্তু যখন ট্রেনের সিটির ও বাষ্পের আওয়াজ সামলে ওঠে সমস্ত বাসিন্দা রাস্তায় নেমে আসে, দেখতে পায় আউরেলিয়ানো ত্রিস্তে বাষ্পীয় ইঞ্জিন থেকে হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে আর দেখা যায় পরিকল্পনা থেকে আট মাস পিছিয়ে আসা ফুল দিয়ে ঢাকা মাকন্দে আসা প্রথম ট্রেনটাকে। সেই নিষ্পাপ হলুদ ট্রেনটা যেটা মাকন্দে নিয়ে আসবে কত না অনিশ্চয়তা ও স্বচ্ছতা, কত না আনন্দ ও বেদনা, কত না পরিবর্তন, বিপর্যয় ও স্মৃতিকাতরতা।’

মাকন্দে আসে সিনেমা হল। তা মাতিয়ে দেয় এখানকার অধিবাসীদের। কিছু নতুন বিপদ এই সূত্রে এলে তা সামাল দিতে হয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের। ‘চোখধাঁধানো এত সব ও এত আশ্চর্যজনক আবিষ্কারে, মাকন্দের মানুষ বুঝতে পারছিল না তারা কোন দিক থেকে তাজ্জব হতে শুরু করবে। ট্রেনের দ্বিতীয় যাত্রায় আউরেলিয়ানো ত্রিস্তের নিয়ে যাওয়া প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ দিয়ে জ্বলা পাণ্ডুর বাল্বগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে রাত কাবার করে দেয় ওরা, আর ট্রেনটার টুমটুম শব্দে অভ্যস্ত হতে সময় লাগে ও কষ্ট করতে হয় ওদের। সফল ব্যবসায়ী ব্রুনো ক্রেসপি যখন সিংহের মাথাওয়ালা টিকিট কাটার ঘরওলা থিয়েটারে, মৃত্যুবরণ করার পর দাফন করা এক চরিত্রের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি দেখায় এক ছবিতে, যার দুঃখে সমব্যথী হয়ে চোখের জল ফেলে দর্শকেরা; সেই একই প্রতিচ্ছবি যখন পরের ছবিতে আবির্ভূত হয় এক আরবে পরিবর্তিত হয়ে, জীবন্ত অবস্থায়, তখন তারা ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। চরিত্রগুলোর জীবনের উত্থান-পতনের সাথি হতে যে জনসাধারণ দুই সেন্ট করে দিত, তারা এই ধরনের অভূতশ্রুত বিদ্রূপ সহ্য করতে না পেরে আসনগুলো ভেঙে ফেলে। ব্রুনো ক্রেসপির অনুরোধে এক বিশেষ ঘোষণার মাধ্যমে মেয়র সবাইকে জানিয়ে দেয় যে, সিনেমা হচ্ছে এক মরীচিকা সৃষ্টিকারী যন্ত্র, যা নাকি দর্শকদের আবেগতাড়িত হওয়ার মতো উপযুক্ততা রাখে না।’

এত অল্প সময়ে এত বড় পরিবর্তন ঘটে যায় যে, মিস্টার হেরবের্টের আগমনের আট মাস পর মাকন্দবাসী প্রতি সকালে জেগে উঠত নিজেদের গ্রামকে চেনার জন্য।

আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর আনন্দের সীমা থাকে না বিদেশিদের এই আকস্মিক ঢলে। অতি সত্বর বাড়িটা ভরে যায় অচেনা সব অতিথিদের দিয়ে, বেপরোয়া পার্টি, পার্টিপ্রিয় দুনিয়াজোড়া লোকজনে, আর ফলে উঠানে যোগ করতে হয় কিছু শোবার ঘরের, বাড়াতে হয় রান্নাঘরটাকে আর প্রাচীন খাবার টেবিলটা বদলে বসাতে হয় ষোলো জন বসার মতো এক টেবিল, নতুন বাসনকোসন আর তার পরও সবার একসঙ্গে জায়গা না হওয়ায় পালা করে দুপুরের খাবার খেতে হয়। নিয়মনিষ্ঠতার কথা ভুলে গিয়ে সবচেয়ে বিকৃত রুচির লোকটাকেও রাজার মতো করে আপ্যায়ন করতে বাধ্য হয় ফের্নান্দা।

পুঁজিবাদী উন্নয়নের এই মোহমায়ার পর্বটিতে অভ্যস্ত হতে হতেই নেমে আসে বিপর্যয়। বেরিয়ে পড়ে কোম্পানী রাজের দানবীয় রূপটি। কলা কোম্পানীর সূত্রে আসা সমৃদ্ধির আবহে মাকন্দো প্রায়ই ভরে থাকত নাচ, গান, উৎসবের। এমনই এক উৎসবের মধ্যে হঠাৎ নেমে আসে বিপর্যয়। রাইফেলের গুলি ডুবিয়ে দেয় আতশবাজির জেল্লা। ভয়ার্ত চিৎকারে চাপা পড়ে বাজনার শব্দ, আর আনন্দের আসর রূপান্তরিত হয় আতঙ্কের আসরে। অনুপ্রবেশকারী রাজার রাজকীয় রক্ষীদের মধ্যে ছিল এক স্কোয়াড্রন সামরিক বাহিনী আর তাদের দামি আলখাল্লার নিচে লুকানো ছিল সরকার প্রদত্ত রাইফেল। সরকার এক বিশেষ ইশতেহারে সব অভিযোগ অস্বীকার করে, অঙ্গীকার করে এই রক্তাক্ত ঘটনার চূড়ান্ত তদন্তের। কিন্তু সত্য ঘটনা কখনোই উদ্‌ঘাটিত হয় না। কিন্তু সব সময়ই যা রটনা হিসেবে রয়ে যায়, তা হচ্ছে রাজরক্ষীর একটি দল কোনো রকমের উসকানি ছাড়াই তাদের কমান্ডারের ইঙ্গিতে যুদ্ধের পজিশন নেয় এবং দয়ামায়া ছাড়াই ভিড়ের ওপর গুলি চালায়। পরিস্থিতি শান্ত হলে যখন মিথ্যা বেদুইনের একজনকেও গ্রামে দেখা যায় না, তখন প্লাজায় হতাহতদের মধ্যে পড়ে থাকে নয়জন, তার চারজন কলম্বিনা (কলম্বিয়ার মহিলা), সতেরোজন তাসের রাজা, এক শয়তান, তিনজন যন্ত্রশিল্পী, দুই জোড়া ফ্রান্সিয়া (নৃত্যনাট্যের চরিত্র), আর তিন জাপানি সম্রাজ্ঞী।

আউরেলিয়ানো সেগুন্দো কলা কোম্পানীর কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে দহরম মহরম রেখেই প্রথম জীবনটা কাটিয়েছিল। কিন্তু আর্কাদিও সেগুন্দো হয়ে ওঠে কলা শ্রমিক সংগ্রামের অন্যতম নেতৃত্ব। হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো ও অন্যান্য সিন্ডিকেটের নেতারা এত দিন আত্মগোপন করে থাকা জায়গা থেকে, এক সপ্তাহান্তে হঠাৎ করেই উদয় হয় আর কলা অঞ্চলের শহরগুলোতে মিছিল করে। পুলিশ শুধু নাগরিক নিরাপত্তা রক্ষা করেই সন্তুষ্ট থাকে। কিন্তু সোমবার রাতে নেতাদের বাড়ি থেকে বের করে পাঁচ কিলোর বেড়ি পায়ে পরিয়ে, পায়ে হাঁটিয়ে প্রাদেশিক রাজধানীর জেলে পাঠানো হয়। ওদের মধ্যে ছিল হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো ও লরেন্স গাবিলান, মাকন্দে নির্বাসিত মেহিকানো বিপ্লবের এক কর্নেল, যার কথানুযায়ী সে তার কম্পাদে আরতেমিও ক্রুজের বীরত্বের চাক্ষুস সাক্ষী। যদিও তিন মাসের মধ্যেই ওরা ছাড়া পেয়ে যায় কারণ সরকার ও কলা কোম্পানি একমত হতে পারছিল না কাকে জেলে ঢোকাবে এ ব্যাপারে। এসব কর্মচারীর ক্ষোভের ভিত্তি ছিল অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাসস্থান, চিকিৎসার সুবিধা প্রদানের ব্যাপারে প্রতারণা, আর কর্মস্থলের শোচনীয় পরিবেশ। এ ছাড়া তারা জোর করে বলে যে তারা নগদ টাকায় বেতন না দিয়ে জিনিসপত্র কেনা যায়, এমন টিকিট দেয়, যার বিনিময়ে কমিসারি থেকে ভার্জিনিয়া হ্যাম ছাড়া আর কিছুই কেনা যায় না। হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোকে জেলে পোরা হয়, কারণ সে-ই ফাঁস করে দিয়েছিল যে টিকিট দিয়ে বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা আসলে ফলের জাহাজগুলোর জন্য টাকা জোগানোর ব্যবস্থা, কারণ, তা না হলে জাহাজগুলোকে খালি ফিরতে হতো কলা ওঠানোর ডক থেকে নিউ আরলিন্স পর্যন্ত। অন্য অভিযোগগুলো ছিল সর্বজনবিদিত কোম্পানির ডাক্তাররা রোগীদের পরীক্ষা করত না, তার বদলে রোগীদের ডিসপেনসারির সামনে লম্বা লাইনে দাঁড় করিয়ে এক নার্সকে দিয়ে তাদের জিবের ওপর কপার সালফেটের রঙের বড়ি দেওয়াত। তা ম্যালেরিয়া, গনোরিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য যে রোগই হোক না কেন, সব রোগের বেলাতেই ছিল একই চিকিৎসা।

আরম্ভ হয় মহা ধর্মঘট। চাষবাস পড়ে থাকে অসমাপ্ত, ফল পচতে থাকে গাছে আর এক শ বিশ ওয়াগনের ট্রেন পড়ে থাকে রেললাইনের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায়। বেকার শ্রমিকে উপচে পড়ে শহরটা। তুর্কদের রাস্তায় সম্মিলিত চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়। অনেক দিনের মধ্যে এক শনিবারে আর হোটেল জ্যাকবের বিলিয়ার্ড রুমগুলোতে চব্বিশ ঘণ্টার শিফট চালু করা হয়। যেদিন ঘোষণা করা হয় জনসাধারণের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর হাতে দেওয়া হয়েছে, সেদিন হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো ওখানেই ছিল।

শ্রমিকেরা দাবিদাওয়া নিয়ে সমবেত হলে কলা কোম্পানীর পক্ষে দাঁড়িয়ে সরকার সেনাবাহিনী পাঠায়। সামরিক আইন এই বিরোধে মধ্যস্থতা করার সুযোগ করে দেয় সেনাবাহিনীকে। কিন্তু ওরা সমঝোতা ঘটানোর কোনো চেষ্টাই করে না দুপক্ষের মাঝে। মাকন্দে মুখ দেখানো মাত্রই বন্দুক একপাশে সরিয়ে রেখে কলা কেটে বোঝাই করে ট্রেন চালিয়ে দেয়। শ্রমিকেরা, যারা এযাবৎ অপেক্ষা করেই সন্তুষ্ট ছিল। তারা নিজেদের একমাত্র কাজের হাতিয়ার মাচেতে (বড় কাস্তে) নিয়ে টিলায় ঢুকে অন্তর্ঘাতের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতে নেমে পড়ে। আগুন জ্বালিয়ে দেয় কলাবাগানে ও রসদের দোকানে, ধ্বংস করে রেলপথ, বাধা সৃষ্টি করে সেই সব রেল চলায়, যে রেলগুলো মেশিনগানের গুলি ছুড়ে পথ করে নেওয়া শুরু করেছিল, আর কেটে দেয় টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের তার। সেচের খালগুলো রক্তে লাল হয়ে ওঠে। বিদ্যুতায়িত মুরগির খোঁয়াড়ের ভেতরে তখনো জীবিত সেনঞর ব্রাউনকে তার অন্যসব সঙ্গী, পরিবারসহ মাকন্দ থেকে সরিয়ে ফেলা হয় নিরাপদ জায়গায় সামরিক বাহিনীর প্রহরাধীনে। পরিস্থিতি যখন এক অসম রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে, তখন কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের মাকন্দে জড়ো হতে আহ্বান করে। সেখানে ঘোষণা করা হয় সামরিক ও বেসামরিক প্রাদেশিক নেতারা বিরোধে মধ্যস্থতা করতে পরের শুক্রবারে এসে পৌঁছাবে।

শুক্রবার ভোর হতে রেলস্টেশনে জড়ো হওয়া ভিড়ের মধ্যে ছিল হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো। আগেই সে অংশগ্রহণ করেছিল ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে এক বিশেষ আলোচনায়, আর কর্নেল গ্যাভিলান ও তার দায়িত্ব ছিল ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে অবস্থানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার। খুব একটা ভালো বোধ করছিল না সে আর আঠালো কিছু দলা অনুভব করতে শুরু করেছিল তার টাকরার ওপর, যখন থেকে সে দেখতে পায় ছোট্ট প্লাজার চারদিকে মেশিনগান বসানো হয়েছে ও কলা কোম্পানির তার ঘেরা শহর সুরক্ষিত করা হয়েছে গোলন্দাজ বাহিনীর অস্ত্র দিয়ে তখন থেকেই। বারোটা বাজতে চলেছে, না আসা রেলের জন্য অপেক্ষা করছে তিন হাজারের বেশি লোক, যাদের মধ্যে ছিল শ্রমিক, মহিলা ও শিশু, যাদের দ্বারা রেলস্টেশনের সামনের খালি জায়গাটা ভরে উপচে পড়েছে পার্শ্ববর্তী রাস্তায় সারি বেঁধে রাখা সামরিক বাহিনীর মেশিনগানধারীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। অভ্যর্থনা জানানোর অপেক্ষারত ভিড়ের চেয়ে, তাদের মনে হচ্ছিল আনন্দমুখর এক মেলা। তুর্কদের রাস্তা থেকে ভাজাভুজি ও পানীয়ের ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো স্থানান্তরিত হয়েছে ওদের মাঝে আর লোকেরা প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে সহ্য করছিল অপেক্ষা ও গা জ্বলানো রোদের যন্ত্রণা। তিনটে বাজার কিছু আগে গুজব ওঠে, সরকারি রেলটা পরের দিনের আগে আসছে না। ক্লান্ত ভিড় ফেলে এক হতাশার দীর্ঘশ্বাস। এই সময় ভিড়ের দিকে তাক করা চারটে মেশিনগান বসানো স্টেশনের ছাদের ওপর ওঠে সেনাবাহিনীর এক লেফটেন্যান্ট আর মুহূর্তের জন্য নেমে আসে নীরবতা।

ক্যাপ্টেন গুলির আদেশ দেয় আর চৌদ্দটি মেশিনগান তাদের নীড় থেকে সাড়া দেয় সেই আদেশের। কিন্তু সবকিছুকেই মনে হচ্ছিল প্রহসনের মতো। যেন মেশিনগানগুলো ছিল আতশবাজির খেলা দেখানোর জন্য মিথ্যা গুলি ভরা। কারণ, শোনা যাচ্ছিল ওগুলোর ঘর্ঘর শব্দ, দেখা যাচ্ছিল ওগুলোর জ্বলন্ত উদ্‌গার কিন্তু সামান্যতম প্রতিক্রিয়াও লক্ষণীয় ছিল না ভিড়ের মধ্যে, একটি শব্দও নয়, এমনকি কোনো দীর্ঘশ্বাসও নয়, যেটাকে মনে হচ্ছিল তাৎক্ষণিক অভেদ্যতায় জমে যাওয়া কঠিন কিছু। হঠাৎ করেই স্টেশনের পাশ থেকে এক মরণচিৎকার ভেঙে দেয় সেই সম্মোহন ‘হায় হায় রে, আমার মা’; এক ভূমিকম্পের শক্তি, এক আগ্নেয়গিরির নিশ্বাস, এক বিপর্যয়ের গর্জন, ভিড়ের কেন্দ্র থেকে প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে।

তারা গুলি চালিয়ে নিমেষে তিন হাজার শ্রমিককে হত্যা করে। অগুন্তি লাশ পাচার করে দেওয়া হয় মালগাড়িতে করে। মৃত ভেবে ভুল করে সেই লাশের সঙ্গে পাচার হয় আর্কাদিও সেগুন্দোর। যখন হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো জ্ঞান ফিরে পায়, তখন অন্ধকারে চিত হয়ে শুয়েছিল সে। টের পায় যে যাচ্ছে সে এক নিঃশব্দ অন্তহীন ট্রেনে, আর শুকনো রক্তে চুলগুলো তার শক্ত হয়ে আছে, ব্যথা করছে সারা শরীর। অদম্য এক ঘুমের ইচ্ছা জাগে তার। আতঙ্ক ও সন্ত্রাস থেকে দূরে অনেক ঘণ্টা ঘুমানোর ইচ্ছায়, শরীরের যেদিকটায় কম ব্যথা, সেদিকে পাশ ফিরে সে, আর কেবল তখনই বুঝতে পারে, সে শুয়ে আছে মৃতদেহের ওপর। মাঝের করিডর ছাড়া ওয়াগনটায় বিন্দুমাত্র জায়গা খালি ছিল না। মাঝপথে সে ঝাঁপ দিয়ে পালায়। অনেক পরে লুকিয়ে ফিরে আসে মাকন্দোতে। আত্মগোপন করে থাকে বাড়ির এক পরিত্যক্ত ঘরে। তারপর একদিন যমজ ভাইয়ের সঙ্গে এক ই মুহূর্তে মৃত্যুবরণ করে।

গার্সিয়া মার্কেজের ‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’ আখ্যানের দিক থেকে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনই বর্ণাঢ্য এর চরিত্রদের মিছিল। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার জীবনের প্রথম পর্বের কর্মময়তা পরবর্তীকালে জিপসী মেলকিয়াদেসের সাহচর্যে জিজীবিষায় রূপান্তরিত হয়। গবেষণাগারে নিজের মানসিক মুক্তি খুঁজে পান তিনি। স্ত্রী উরসুলা তাঁর এই সব গবেষণায় যতই বিরক্ত ও সময় বিশেষে ক্রুদ্ধ হোক না কেন, প্রজন্মান্তরে এই কৌতূহল ও জ্ঞানতৃষ্ণাকে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

মেলকিয়াদেসের চরিত্র কল্পনাটি গার্সিয়া মার্কেসের সাহিত্যভাবনার এক বলিষ্ঠ প্রকাশ। এই একাকী মানুষটি দুনিয়ার নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, অজস্র প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছেন, মৃত্যুর সঙ্গে আশ্চর্য পাঞ্জায় জিতে যাচ্ছেন বারবার আর শেষমেষ ফিরে আসছেন প্রায় দুনিয়া বিচ্ছিন্ন এক অখ্যাত বিরল জনপদ ছোট্ট গ্রাম মাকন্দোতে ও এখানেই আশেপাশের মানুষের অজানা সংস্কৃত ভাষায় এক অনাগত ভবিষ্যতের ইতিহাস লিখে কাটিয়ে দিচ্ছেন তাঁর শেষজীবনটি।

উরসুলা এই উপন্যাসের মেরুদন্ড স্বরূপ। গার্সিয়া মার্কেস আখ্যান বিন্যাস প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন একটা সময় তাঁর মনে হয় উরসুলার যথেষ্ট বয়স হয়ে গিয়েছে, আর তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু সেই সময় উরসুলার মৃত্যুর ঘটলে আখানের বিন্যাস সমস্যায় পড়ত বলে তাঁকে আরো অনেককাল বাঁচিয়ে রাখতে হয় আখ্যানকারকে। এ থেকেই বুয়েন্দুয়া পরিবার ও গোটা মাকন্দোতে তাঁর গুরুত্বটি বোঝা যায়। বাস্তব বুদ্ধিতে, সক্রিয়তা ও বিচক্ষণতায় উজ্জ্বল উরসুলা পরিবারের ছাতা হয়ে উঠতে না পারলে জ্ঞানতৃষ্ণায় মেতে থাকা হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ও গৃহযুদ্ধে ঘরছাড়া কর্নেল আরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার পরিবারটি অনেককাল আগেই ধ্বংস হয়ে যেত।

কর্নেল আরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া এক সহজ স্বাভাবিক চরিত্র হিসেবেই বেড়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ভোট লুঠের একটি আপাত সাধারণ ঘটনা তাঁকে টেনে আনল এক বিরাট গৃহযুদ্ধের মধ্যে এবং ক্রমশ এর একপক্ষের মূল সেনাপতি হয়ে উঠলেন তিনি। দুনিয়াদারির সেই পর্ব শেষ করে যখন ঘরে ফিরলেন আবার তখন তিনি সম্পূর্ণ রূপান্তরিত এক পুরুষ। বাইরের পৃথিবীর কোনওকিছুই আর তাঁকে ছোঁয় না। একটার পর একটা সোনার মাছ বানিয়ে সময় কাটাতে থাকেন তিনি। নিজেকে শুধু বাইরের পৃথিবী নয়, নিজের আত্মীয় পরিজন থেকেও বিচ্ছিন্ন করে নেন।

নারী পুরুষের প্রেম ‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’ উপন্যাসে আগাগোড়াই জটিলতার মুখোমুখি হয়েছে। ইতালিয়ান সঙ্গীতজ্ঞ পিয়েত্রো ক্রেসপীর প্রেম নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল দ্বিতীয় প্রজন্মের দুই নারী রেবেকা আর আমারান্তার। পরে রেবেকা হোসে আর্কাদিওকে বিয়ে করায় আমারান্তা ও পিয়েত্রা ক্রেসপীর বিবাহ সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছিল, সবার সানন্দ সম্মতিও ছিল এই বিয়েতে। কিন্তু আমারান্তা কুমারীত্বের জীবনই কোনও এক অজ্ঞাত কারণে বেছে নেওয়া পছন্দ করল আর তা পিয়েত্রা ক্রেসপীকে ঠেলে দিল আত্মহত্যার করুণ পরিণতির দিকে। এরপর কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার অন্তরঙ্গ বন্ধু হেরিনেলদো মার্কেসের সঙ্গে সম্পর্ক ও বিবাহ সম্ভাবনা তৈরি হয় আমারান্তার। উরসুলা এই বিয়েতে প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু আমারান্তা এক রহস্যজনক কারণে এই বিয়ের থেকেও দূরে থাকে। অথচ আমারান্তা যে কামশীতল তা নয়। আমারানতাই অনেক কমবয়সী ভাইপোর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিল।

যৌনতার সমাজ নিষিদ্ধ ধারণাগুলিকে উপন্যাসের চরিত্রপাত্ররা একেবারেই আমল দেয় নি। ক্যারিবিয় অঞ্চলে নারী পুরুষের খোলামেলা বিচরণ গার্সিয়া মার্কেসের পরিবারেও ঢুকে ছিল। গার্সিয়া মার্কেসের জীবনীকার জেরাল্ড মার্টিন আমাদের জানিয়েছেন গার্সিয়া মার্কেসের দাদু এবং বাবা উভয়েই বিয়ের আগে একাধিক সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন এবং এই সম্পর্কসূত্রগুলি সূত্রে সন্তানের জন্মও দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় প্রজন্মের আমারান্তাই কিন্তু একমাত্র ব্যক্তি নয়, যে এই উপন্যাসে পরিবারের ভেতরে যৌন সম্পর্কে জড়িয়েছে। একই ঘটনা ঘটেছে পঞ্চম প্রজন্মের আমারান্তা উরসুলার ক্ষেত্রেও। চতুর্থ প্রজন্মের মূল চরিত্র আউরেলিয়ানো সেগুন্দোকে আমরা দেখি আজীবন স্ত্রী ফেরনানদা ও রক্ষিতা পেত্রা কোতেসের সঙ্গে সমান্তরাল সম্পর্কে লিপ্ত থাকতে।

দ্বিতীয় প্রজন্মের কর্নেল আরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার দাদা হোসে আর্কাদিও এক যৌন কাম তাড়িত পুরুষ হিসেবেই আখ্যানে আগাগোড়া চিত্রিত। হোসে আর্কাদিও আর কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া দুজনেই পিলার তারনেরার শয্যাশঙ্গী হয় এবং তার গর্ভে আলাদা আলাদাভাবে সন্তান উৎপাদন করে। হোসে আর্কাদিও যখন রেবেকাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে তখন ইতালিয় পিয়েত্রো ক্রেসপি তার সংস্কার অনুযায়ী এতে খুব অবাক হয় এবং জানায় সে তার তুতো বোন, এই বিবাহ অনুচিত। হোসে আর্কাদিওর মধ্যে এই সংস্কার ও আপত্তি কোনও প্রভাবই ফেলতে পারে না, সে নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকে। তৃতীয় প্রজন্মের আর্কাদিওর স্থানীয় এক দোকানদারের কন্যা সান্তা সোফিয়ার যৌনতার ব্যবস্থা করে দেয় তার গর্ভদাত্রী পিলার তারনেরাই। সান্তা সোফিয়ার সঙ্গে পরে আর্কাদিওর বিয়েও হয়। আর্কাদিওর অকাল মৃত্যুর পর সান্তা সোফিয়া একদিকে পরিবারের নানা কাজের ভার নিজের কাঁধে তুলে দেয় ও অন্যদিকে বহু পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে থাকে।

যৌনতা ছাড়া আর যে দিকটি বুয়েন্দিয়া পরিবারের পুরুষ চরিত্রদের গঠনে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে তা হল রাজনীতি। দ্বিতীয় প্রজন্মের কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াই পরিবারের মধ্যে প্রথম সক্রিয় রাজনীতিতে জড়ায় এবং গৃহযুদ্ধের অন্যতম প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠে। বুয়েন্দিয়া পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের আর্কাদিওকে আমরা দেখি এক স্বৈরতান্ত্রিক শাসক হিসেবে বেড়ে উঠতে। চতুর্থ প্রজন্মের দুই যমজ ভাই আরেলিয়ানো ও হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো এই স্বৈরশাসকের পুত্র। তাঁদের শৈশব যতই এক রকমের হোক, কর্মধারা একেবারেই আলাদা। আরেলিয়ানো সেগুন্দো যেখানে নব্য প্রতিষ্ঠিত বুর্জোয়া কলা কোম্পানির সঙ্গে দহরম করে পার্থিব উন্নতির পথে হাঁটে, সেখানে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো কলা শ্রমিকদের লড়াইয়ের নেতা হয়ে ওঠে। শ্রমিক গণহত্যার পর তাঁকেও মৃতভেবে লাশ হিসেবে পাচার করে দেওয়া হয়েছিল। জ্ঞান ফেরার পর সে ফেরে মেলকিয়াদেসের পরিত্যক্ত ঘরে ও তার রেখে যাওয়া পাণ্ডুলিপি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করে।

উপন্যাসের পঞ্চম প্রজন্মেরা মাকন্দো ছেড়ে কোনও না কোনও সময়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে ও প্রবাসেই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পর্ব কাটিয়েছে। অরেলিয়ানো সেগুন্দো আর ফের্নান্দার বড় ছেলে হোসে আর্কাদিও দীর্ঘদিন ছিল রোমে। মায়ের মৃত্যুর পর সে বাড়ি ফেরে। খুঁজে পায় উরসুলার লুকিয়ে রাখা সম্পদ। চার উঠতি যুবক একদিন স্নানের সময় তাকে অতর্কিতে পিটিয়ে খুন করে ও সমস্ত ধনসম্পদ লুঠ করে নিয়ে পালায়। অরেলিয়ানো সেগুন্দো আর ফের্নান্দার দ্বিতীয় সন্তান রেনাতা রেমেদিউস প্রেমে পড়ে মাউরিসিও ব্যাবিলোনিয়ার। ফের্নান্দা এই প্রেমকে মেনে নিতে পারে নি। এই উপন্যাসে তার মধ্যে এক রক্ষণশীল নারীর নানা মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। মুরগি চুরির বদনাম দিয়ে সে গুলি করিয়ে পঙ্গু করে দেয় সম্ভাব্য জামাতা অভিসাররত ব্যাবিলোনিয়াকে আর মেয়ে রেনাতা রেমেদিউস মেমেকে এক কনভেন্টে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে আগেই সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়া মেমে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বুয়েন্দিয়াদের বাড়িতে। ফের্নান্দা নাতিকে পরিচয় গোপন করে কুড়িয়ে পাওয় আশ্রিত হিসেবে পরিবারে স্থান দেয়। এজন্য অরেলিয়ানো ব্যাবিলোনিয়া দীর্ঘকাল নিজের প্রকৃত পরিচয় জানতে পারে নি। অরেলিয়ানো সেগুন্দো আর ফের্নান্দার তৃতীয় সন্তান আমারান্তা উরসুলা গ্যাস্টনকে বিয়ে করে ইউরোপ প্রবাসী হয়েছিল। পরে অবশ্য সে মাকন্দোতে ফিরে আসে ও থিতু হয় স্বামীর অনিচ্ছা সত্ত্বেই। গ্যাস্টন ইউরোপে ফিরে গেলে তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় অরেলিয়ানো ব্যাবিলোনিয়ার, যার প্রকৃত পরিচয় ফের্নান্দা লুকিয়ে রেখেছিল, কিন্তু বাস্তবে যে ছিল বুয়েন্দিয়া পরিবারের ষষ্ঠ প্রজন্মের একমাত্র প্রতিনিধি। ভাইপোর সঙ্গে আমারান্তা উরসুলার প্রেম ও যৌন সম্পর্কর সূত্রে জন্ম হয় বুয়েন্দিয়া পরিবারের সপ্তম প্রজন্ম অরেলিয়ানোর। জন্মের দিনেই তার মৃত্যু হয় আর সন্তান জন্মের পরবর্তী রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় আমারান্তা উরসুলারও। বুয়েন্দিয়া পরিবারের ধারাটি মিলিয়ে যায় আর শুকিয়ে যায় মাকন্দোর টিঁকে থাকা শেষ প্রাণস্পন্দনটুকুও।

গার্সিয়া মার্কেস এই উপন্যাসে লাতিন আমেরিকান অনেক মিথকে যেমন অকাতরে ব্যবহার করেছেন, তেমনি নিজের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে মিশিয়ে দিয়েছেন উপন্যাসের নির্মাণে।

গার্সিয়া মার্কেসের প্রথম উপন্যাস ‘লা ওহারাস্‌কা’ (ঝরাপাতা) প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। সাহিত্য জীবনের শুরুর সেই রচনাতেই আমরা দেখেছিলাম গার্সিয়া মার্কেস আখ্যান নির্মাণে তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতি ও অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করছেন। তবে সেই স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা আরো নানাকিছুর সঙ্গে মিলে মিশে এক স্বতন্ত্র বিষয় হয়ে উঠছে। ১৯০৩ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত সময়পর্বের কিছু ঘটনা নিয়ে ঝরাপাতা নামের যে আখ্যানটি দিয়ে গার্সিয়া মার্কেসের উপন্যাস রচনার সূত্রপাত সেখানেও ঘটনাস্থল মাকন্দো। এক চিকিৎসকের আত্মহত্যার পর তিন প্রজন্মের তিন চরিত্রর আত্মকথনের মাধ্যমে এই উপন্যাস তৈরি হয়েছিল। এই গল্পে এক বৃদ্ধ কর্নেল-এর চরিত্র আছে, যা আমরা তার পরবর্তীকালের উপন্যাসেও দেখতে পাব। ‘ঝরাপাতা’ হল কলা ব্যবসায়ীদের কোম্পানির সূত্রে নানাভাবে বদলে যাওয়া এক জনপদের কথা। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে ওই ব্যবসায়ীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। গার্সিয়া মার্কেস যেখানে বড় হচ্ছিলেন সেখানেই গড়ে উঠেছিল কলা চাষের অঞ্চল। আরাকাতাকা নামক স্থানে জন্মের পর থেকে গার্সিয়া মার্কেস তার দাদু ও দিদিমার সঙ্গে বাস করেছেন। তার আট বছর বয়সে দাদুর মৃত্যু হয়। ১৯১৫ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত আরাকাতাকায় কলা ব্যবসার প্রভূত শ্রীবৃদ্ধি ঘটে, সঙ্গে সঙ্গে স্থানটিরও উন্নতি হয়। পরবর্তী কালে লেখকের স্মৃতিতে বারবার ভেসে উঠবে জন্মস্থানের কথা, কিন্তু তার আর সেখানে ফেরার কোনো আশা থাকবে না। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে পারিবারিক স্মৃতির ভূমিকা কম নয়, বলেছেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মারিও ভার্গাস ইয়োসা। ঝরাপাতার সামনে বসে থাকা নিশ্চল শিশুর ছবি ফিরে আসবে গার্সিয়া মার্কেস-এর ভবিষ্যতের লেখায়; ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষে’ আমারানতা উরসুলা নিজের শবাচ্ছাদন বস্ত্র বোনে–এই দৃশ্যের সঙ্গে হুবহু নিল ছিল তাঁর এক কাকিমার। আরাকাতাকায় ঠিক এমন ভাবে তিনি তাঁর শবাচ্ছাদন-বস্ত্রটি বুনতেন। চোখে দেখা দৃশ্য বা চরিত্র কি আশ্চর্যভাবে চলে আসে তার উপন্যাসে। পেরুর নোবেলজয়ী কথাসাহিত্যিক মারিও ভার্গাস ইয়োসা গার্সিয়া মার্কেসের ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড প্রকাশের পর এতই আলোড়িত হয়েছিলেন যে এই উপন্যাসটি সম্পর্কে এক বিপুল কলেবর বই লিখে ফেলেন। একদা গার্সিয়া মার্কেসের অন্তরঙ্গ বন্ধু ইয়োসা এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে আমাদের জানিয়েছেন যে ‘ঝরাপাতা’ উপন্যাসে ইসাবেল-এর চরিত্র মিলে যায় লুইসা সান্তিয়াগো নামে বাস্তব এক নারীর সঙ্গে। মাত্র চার কী পাঁচ বছর বয়সে গার্সিয়া মার্কেস তাঁকে প্রথমবার দেখেন। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসের শেষদিকে মের্সেদেস্‌ নামের যে এক কেমিস্টকে আমরা দেখি, ‘বাররানকিয়াতে’ লেখক তাঁকে দেখেছিলেন। এই উপন্যাসের চরিত্র আমারানতা উরসুলা স্বপ্ন দেখে তার গর্ভে দুই ছেলের জন্ম হবে, তাদের নাম হবে রোদরিগো এবং গনসালো। আমরা জানি বাস্তবে এ দুটি হল গার্সিয়া মার্কেস-এর ছেলেদের নাম। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে মাকন্দোর শেষ অবস্থায় ষষ্ঠ প্রজন্মের  আউরেলিয়োনো ব্যাবিলোনিয়ার বন্ধুরা হল বাররানকিয়া বাসকালে গার্সিয়া মার্কেসের তিন সঙ্গীর দুজন; আলভারো (সেপেদা), আলফনসো (ফোয়েনমাইয়োর) এবং এরমান (ভার্গাস)। গার্সিয়া মার্কেস গবেষকরা আমাদের জানিয়েছেন উরসুলা ইগুয়ারানের দীর্ঘস্থায়ী বার্ধক্য, অন্ধত্ব এবং পাগলাটে ভাব মিলে যায় তাঁর দিদিমা দন্যা ভ্রানকিলনার চরিত্রের সঙ্গে, যদিও উপন্যাসের চরিত্র চিত্রণে অতিশয়োক্তি আছে। মারিও ভার্গস ইয়োসা পূর্বোক্ত গ্রন্থে এও জানিয়েছেন যে গার্সিয়া মার্কেস ভাবতেন ‘উপন্যাসটির শুরুর লাইনগুলোর প্রেরণা এসেছিল দাদু দন নিকোলাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গার্সিয়া মার্কেসের নিজের স্মৃতি থেকে। দাদু দন নিকোলাস বালক গার্সিয়া মার্কেসকে হাত ধরে তাকে নিয়ে যেতেন সার্কাস দেখাতে। উপন্যাসে আমরা দেখি আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া বালক বয়সে বাবার হাত ধরে বরফ দেখতে যায়। বুয়েন্দিয়া পরিবারটির আদি নিবাস রিওয়াচায়, সেখানেই জন্মগ্রহণ করেন দন নিকোলাস এবং দন্যা ত্ৰাণকিলিনা। ওরা ছিল তুতো ভাইবোন, যেমন ভরসুলা ইগুয়ারান এবং হোসে আরকাদিও বুয়েন্দিয়া (ইগুয়ারান পদবিটা সাহিত্য ও বাস্তবে একই) এবং প্রথম বোয়েলদিয়ার পিতৃপুরুষদের মতো তাদেরও শুয়োরের ল্যাজ নিয়ে জন্ম হয়েছিল। যে কারণে হোসে আরকাদিও বুয়েন্দিয়া বাসভূমি পরিত্যাগ করে মাকন্দ নামক স্থানে স্থায়ী বাসস্থান গড়ে তুললেন তা হল প্রতিবেশী প্রুদেনসিও আগিলারকে তিনি হত্যা করার পর সেখানে তার মনে শান্তি ছিল না, বারবার মৃত মানুষটা তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। দন নিকোলাসও এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলেন এবং সেই জন্যে তিনি আরাকাতাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন; নিহত মানুষটির পদবিও ছিল এক। দন নিকোলাসের অভিধান-পাগলামো ছিল, শব্দার্থ নিয়ে তিনি মেতে থাকতে ভালোবাসতেন। বুয়েন্দিয়া পরিবারের সন্তান আউরেলিয়ানো ব্যাবিলোনিয়া গোপন অভিধানের শব্দগুলোর অর্থ উদ্ধার করার চেষ্টায় জীবন অতিবাহিত করে।

নিজের পরিবার এবং গল্পের বিষয়বস্তু সমূহ নিয়ে এক উপন্যাস রচনার ভাবনা লেখালিখির শুরুতেই এসেছিল গার্সিয়া মার্কেসের মাথায়। বাড়ি নিয়ে গার্সিয়া মার্কেস একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন, শিরোনাম ছিল ‘বুয়েন্দিয়ার বাড়ি’; লেখা হয়েছিল ১৯৫০-এর মে-জুন মাসে আর কিছু অংশ ওই বছর নভেম্বরে। কিন্তু তখন আর বিষয়টিকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া হয়নি। গার্সিয়া মার্কেস খুঁজছিলেন এমন এক প্রকরণ যার সাহায্যে তিনি পরিবারের ব্যক্তিগত কাহিনী, সংশ্লিষ্ট জনপদের আখ্যান, কলম্বিয়ার দীর্ঘ ইতিহাস এবং গোটা লাতিন আমেরিকার প্রাণস্পন্দনকে ধরতে পারেন। এই প্রকরণ অবশেষে খুঁজে পেলেন গার্সিয়া মার্কেস, যে প্রসঙ্গে বারবার সমালোচক সাহিত্যবেত্তারা বলেছেন জাদুবাস্তবতা বা ম্যাজিক রিয়ালিজমের কথা।

দিদিমার মুখে গার্সিয়া মার্কেস শুনেছিলেন মার্লরোর ভিউক ‘মামরু’র গল্প যিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন। কর্নেল বুয়েন্দিয়ার ক্যাম্পে বাঘের ছদ্মবেশে এক অদ্ভুত যোদ্ধার উপস্থিতির আখ্যানটি ঠাকুমার মুখে শোনা এই গল্পের অবলম্বনে গার্সিয়া মার্কেস তৈরি করেন। কিন্তু এইরকম কিছু গল্পের কাহিনী অংশর কথা বললে ঠাকুমার মুখে শোনা কাহিনীর গুরুত্ব গার্সিয়া মার্কেসের সাহিত্যকীর্তিতে কতটা তা বোঝা যাবে না। গার্সিয়া মার্কেস তাঁর দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে ঠাকুমা যে গল্পগুলো বলতেন সেখানে বাস্তব আর অতিবাস্তব, আকাস কুসুম কল্পলোকের ব্যাপার স্যাপার তিনি একই সুরে একইভাবে বলতেন। বলার সময় স্বরের কোনও বদল হত না। গার্সিয়া মার্কেস লেখালিখির সময় অনুভব করেন তাঁকে অতিবাস্তবকে এইভাবে উপস্থাপণ করতে হবে, যা বাস্তবের মতোই একই স্বরে বলা হবে। তবেই তা পাঠকের বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। কারণ উপন্যাসের মূল বিষয় হল পাঠকের বিশ্বাস উৎপাদন। জাদু বাস্তবতা হল সেই প্রকরণ যা বাস্তব আর জাদু বা অতিবাস্তবকে সমানভাবে পাঠকের বিশ্বাসের মধ্যে নিয়ে আসে।

এই প্রকরণ জাদু আর বাস্তবতা, ফ্যাক্ট আর ফ্যান্টাসির মিলন শুধু এটুকু বললে পুরোটা বোঝা যাবে না। ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড থেকে এক দৃষ্টান্ত তুলেই এর আলোচনা শুরু করা যেতে পারে।

সুন্দরী রেমেদিওস’–এর স্বর্গে উঠে যাওয়ার দৃশ্যটি সম্পর্কে গার্সিয়া মার্কেস এর সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন – এটি খুব সাধারণ ব্যাপার, মানুষ যা ভাবে তার চেয়ে অনেক সহজ। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে ‘সুন্দরী রেমেদিওস’-এর যে চরিত্র আমি লিখেছি ঠিক এই রকম এক মেয়ে ছিল। আসলে সে বাড়ির এক পুরুষের সঙ্গে পালায়, লজ্জা আর সইতে পারে না তার পরিবার; একজন বলে যে বাগানে চাদর ভাঁজ করতে দেখা গেছে তাকে আর তারপর সে আকাশে উড়ে গেল…লেখার সময় পরিবারের গল্পটি আমি নিয়েছি। আসলে ঘটনাটা হল যে মেয়েটি এক পুরুষের সঙ্গে পালিয়েছিল। এ ঘটনা তো আকছার ঘটে, এর মধ্যে কোনো সাহিত্যের রস নেই’। কিন্তু যখন তাঁকে এইভাবে বর্ণনা করা হল তখন তা সাহিত্যরসে মণ্ডিত হল। অতিবাস্তবকে বাস্তবের মতো বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার লিখনরীতিটিই ম্যাজিক রিয়ালিজম। গার্সিয়া মার্কেস এর আবিষ্কর্তা হয়ত নন, আলেহো কার্পেন্তিয়ের সহ অনেকের রচনায় এর আগেই লাতিন আমেরিকান সাহিত্য এই প্রকরণের দেখা পেয়েছে। কিন্তু গার্সিয়া মার্কেস যে এর ব্যাপক ও সফলতম প্রয়োগের অন্যতম কারিগর, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। এই প্রসঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার গার্সিয়া মার্কেস বা আলেহো কার্পেন্তিয়ের বা অন্যান্য লাতিন আমেরিকান কথাকাররা যে এই প্রকরণকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন তাঁদের সাহিত্যে, তা কেবল আঙ্গিকগত পরীক্ষা নিরীক্ষাই ছিল না। তাঁরা তাঁদের উপমহাদেশের যে নিজস্বতার কথা উপন্যাসে আনতে চাইছিলেন, তা ইউরোপীয় বাস্তবতা থেকে একেবারেই আলাদা। ইউরোপীয় রিয়ালিস্ট ন্যারেটিভ তাই তাঁদের নিজস্ব আখ্যান, ইতিহাস, রাজনীতিকে প্রকাশের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। লাতিন আমেরিকার মিথ, লোককথা, ইতিহাস, রাজনীতির ভিন্নতর অভিজ্ঞতাকে রূপ দেওয়ার জন্যই ম্যাজিক রিয়ালিজমকে আশ্রয় করতে হল তাঁদের। ‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’ লাতিন আমেরিকা তথা কলম্বিয়ার ইতিহাসের যে অন্তরমহলের গল্প বলে, এই টেকনিক ছাড়া তাঁর পূর্ণ প্রকাশ সম্ভব ছিল না।