এম এন রায়ের মার্কসবাদ : কয়েকটি তাত্ত্বিক প্রসঙ্গ

জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্ন : এম এন রায়, লেনিন ও কমিন্টার্ন

১৯২০ সালে বিশ্ব-কমিউনিস্ট আন্দোলনে  ভারতের মনীষী বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ধূমকেতুর মত উত্থান অতিশয় চমকপ্রদ। তার চেয়ে অনেক বড় কথা হল সেই উত্থানের সুদূরপ্রসারী ও সুগভীর প্রভাব।

কমিউনিস্ট তৃতীয় আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ১৯২০ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে, প্রথমে পেট্রোগ্রাদ ও পরে মস্কোতে। আগের আন্তর্জাতিকগুলোর তুলনায় এই তৃতীয় আন্তর্জাতিকেই বিভিন্ন মহাদেশের সংগ্রামী প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত হয়, যা আগেরগুলোতে বাস্তবে ছিলনা। "জাতীয় ও ঔপনিবেশিক" প্রশ্নে নীতি নির্ধারণের জন্য একটা কমিশন গঠন করা হয়। এই বিষয়ে বিবেচনা করতে লেনিনের তৈরী করা একটা প্রাথমিক খসড়া দিয়ে শুরু করে তারা। বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়(এম এন রায়) তখন মেক্সিকো থেকে প্রতিনিধি হয়ে প্রথমবারের মতো  ঐ কংগ্রেসে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁর বয়স তখন মাত্র তেত্রিশ বছর। ভারতের প্রতিনিধি অন্য কারও এসে পৌঁছানোর খবর না থাকায়  লেনিনের নির্দেশে তিনি ভারতকেই ঐ কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্ব করেন। মেক্সিকো পার্টির পক্ষে  প্রতিনিধিত্ব করেন রায়ের সঙ্গে আসা ঐ দেশের অন্য আর একজন সদস্য।

              আন্তর্জাতিকের ঐ সেশনটি হয়ে  দাঁড়ালো লেনিন ও রায়ের প্রস্তুত করা জাতীয় ও ঔপনিবেশিক পশ্নে দুজনের দুই প্রস্থ থিসিসের এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বাদ-বিতন্ডার পর্ব। মূলত দুটি প্রশ্নে বিতর্কটা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। (ক) বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রেক্ষিতে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামগুলোকে কীভাবে দেখা হবে। (খ) রণনৈতিক(স্ট্রাটেজি) প্রশ্নে  আন্তর্জাতিকের  কোন নীতি গ্রহণ করা উচিত (বিশ্ব বিপ্লবে এশিয়ার গুরুত্ব) এবং রণকৌশলের স্তর (জাতীয় বুর্জোয়াদের সঙ্গে আঁতাত)। এক  বিশ্ববিপ্লবের মাধ্যমে পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সাধারণ ধারণা উভয়ের প্রস্তাবের মধ্যেই বর্তমান ছিল। কিন্তু দুটো ছোট মাপের ও একটা বড় মাপের মতপার্থক্য তাঁদের দুজনের মধ্যে বিরোধিতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রায় কমিউনিজমের বিশ্ব-রণনীতিতে মৌলিকভাবে ভিন্ন এক পরিকল্পনা হাজির করেন।

সর্বপ্রথমেই, রায় ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলির অর্থনৈতিক চরিত্রকে "প্রাক-পুঁজিবাদী" বলে অভিহিত করায় বেশিরভাগ দেশের প্রতিনিধিরা তার পরিবর্তে তাকে "পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদ অধীনস্ত" কথাটির  দ্বারা প্রতিস্থাপিত করার জন্য মতামত দিলে তিনি  সাথে সাথেই  তাঁর থিসিসে তা সংশোধন করে নেন। দ্বিতীয়ত, রায় সোজাসাপ্টা ঘোষণা করেন যে ইউরোপীয় দেশগুলির বিপ্লবের ভাগ্য পুরোপুরি  নির্ভর করছে এশীয় দেশগুলির বিপ্লবের সাফল্যের ওপর। তাঁর এই  কথার ভিত্তি ছিল যে প্রকল্পটির ওপর তা হল, বিশ্ব-পুঁজিবাদের প্রধান রসদ আসে এশিয়ার শোষণের বাজার ও কাঁচামাল থেকে। লেনিনের "সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর"এ বর্ণিত অতিমুনাফার কথা উল্লেখ করে রায় যুক্তি দেন যে বিশ্ব-পুঁজিবাদের  জীবনী-রক্তের সূত্রকে যদি এশিয় বিপ্লবীদের দ্বারা গোড়ায় আটকানো না  যায়, তাহলে  পশ্চিমী দেশের সর্বহারা তাদের শোষক শ্রেণীকে পরাভূত করতে পারবে না।

লেনিন রায়ের এই "এশিয়াকেন্দ্রিক" মতকে মেনে নিতে পারেননি। যদিও তিনি মেনে নেন যে ঔপনিবেশিক বিস্তার ইউরোপে পুঁজিবাদকে মজবুত করার পক্ষে সহায়ক হয়ে থাকে। লেনিনের  এই মতবিরোধটা তাঁর নিজের একটা তত্ত্বকে ঘিরেই চলছিল। তা হল, একটা সফল ঔপনিবেশিক বিদ্রোহ ঘটতে পারে কেবল জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে সমর্থন করেই। যেহেতু ঔপনিবেশিক সর্বহারা সফল বিপ্লব ঘটাতে অক্ষম, আর তাই উপনিবেশগুলোতে বুর্জোয়া নেতৃত্বই হল স্বাভাবিক। তিনি বিশ্ববিপ্লবের সাফল্যের ক্ষেত্রে ইউরোপে বিপ্লবের ওপর প্রাথমিকতা রাখেন। কিন্তু অন্যান্য ইউরোপীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে এ ব্যাপারে তফাৎ রেখে একটা মাঝামাঝি রকমের চিত্র তুলে ধরেন। লেনিন রায় সম্বন্ধে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলার অভিযোগ এনে রায়ের এই মতকে খণ্ডন করে দেন যে বিচিত্র প্রকৃতির এশিয় জনগণের সাম্রাজ্যবাদের বন্ধন  থেকে মুক্তি না হলে নাকি ইউরোপে বিপ্লব একেবারে  সম্ভবই নয়। রায়কে তাই বাধ্য হয়ে লেনিনের সঙ্গে অনেকখানি সহমতে পৌঁছে  তাঁর নিজের থিসিসের মধ্যে বেশ খানিকটা পরিমার্জন আনতে হয়। তবুও চরম ইউরোপীয় মতামত ও কিছু পশ্চিমী দেশের দলের (বিশেষত ইতালির প্রতিনিধি সেরাটির) বিরোধ সত্বেও এইবারের দ্বিতীয় কংগ্রেস বিগত বছরের(১৯১৯) পূর্বতন প্রথম কংগ্রেসের লাইনকে পরিবর্তিত করে। ভিন্ন ভাবে সূত্রয়িত করে রায়ের খসড়া গৃহীত হয় এভাবে:  উপনিবেশগুলিতে লাভ করা "বাড়তি মুনাফা" থেকে তৈরী হয় "আধুনিক পুঁজিবাদের প্রধান অবলম্বন" এবং যতদিন না পরেরটা "বাড়তি মুনাফার উৎস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে", "ততদিন পর্যন্ত পুঁজিপতি শ্রেণীকে উৎখাৎ করা ইউরোপীয় শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষে সহজ হবে না।"

এর পরে, তৃতীয় বা প্রধান পার্থক্যটাই কার্যকরী কৌশলগত ও খুবই বাস্তব অনুশীলনের প্রশ্নে থাকায় সোভিয়েত সরকার ও আন্তর্জাতিকের জন্য সর্বদাই একটা মাথা ব্যাথার উৎস হয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত  এটাই হয়ে ওঠে প্রধান ও জীবন্ত এক ব্যাপার। প্রথমে কমিশনের সেশনে আর তারপর বিশ্ব কংগ্রেসের অধিবেশনে এ নিয়ে বিতর্ক চলে। লেনিন তাঁর প্রাথমিক থিসিসে রেখেছিলেন, আন্তর্জাতিক অবশ্যই সিদ্ধান্ত নেবে " উপনিবেশ ও পশ্চাৎপদ দেশগুলির বুর্জোয়া গণতন্ত্রেদের সাথে সাময়িকভাবে জোটে যাওয়ার জন্য, কিন্তু তাদের মধ্যে যেন একেবারে মিশে না যায়, খেয়াল রাখতে হবে।"  তাঁর যুক্তি ছিল, কমিউনিস্টরা সাম্রাজ্যবাদ শাসনের স্থানীয়  বিরোধী  গোষ্ঠীগুলোর সাথে জোট করে আগে নিজেদের শক্তিটা কিছুটা বাড়িয়ে নিক।

অন্যদিকে রায় তাঁর থিসিসে রাখেন, "পরাধীন দেশগুলোতে দুটো পৃথক আন্দোলন" দেখা যায় যারা "প্রতিনিয়ত আলাদা করে নিজেদের মতো বেড়ে উঠছে।"  একটা হল "বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক জাতীয় আন্দোলন" যার কর্মসূচি হল "বুর্জোয়া নিয়মের অধীনে রাজনৈতিক স্বাধীনতা," অন্যদিকে আর একটা হল "দরিদ্র ও অজ্ঞ কৃষক-শ্রমিকের গণ-কার্যকলাপ" তাদের ওপর চাপানো সমস্ত রকমের শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে।" রায় বুঝতেন, "প্রথমটা পরেরটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে উদ্যোগী।" এই অনুভবের কারণেই তিনি আন্তর্জাতিকের কাছে আগ্রহ করেন "সেই নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানোর"  ও "উপনিবেশের শ্রমজীবী জনতার শ্রেণীচেতনার মানোন্নয়নের জন্য।" এর অনুসঙ্গ হিসাবেই, " প্রথম ও সর্বাধিক প্রয়োজনীয় কাজ হল," রায়ের মতে, "কমিউনিস্ট পার্টি তৈরী করা" যা কিনা "কৃষক ও শ্রমিকদের সংগঠিত করবে" তাদের  বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে। লক্ষ্য থাকবে সোভিয়েত সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। সেটা "পুঁজিবাদী বিকাশের মাধ্যমে নয়, বরং অগ্রণী পুঁজিবাদী দেশগুলোর শ্রেণী-সচেতন সর্বহারার নেতৃত্বে।" এইভাবেই, "উপনিবেশগুলোর মুক্তির সংগ্রামের প্রকৃত শক্তি আর কোনোভাবেই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদীদের ক্ষুদ্র গণ্ডীর  মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।"  তিনি দাবী করেন, বেশির ভাগ ঔপনিবেশিক দেশেই ইতিমধ্যেই "খুব বড়ো না হলেও", সংগঠিত "বিপ্লবী পার্টির" অস্তিত্ব রয়েছে। এদের সাথে আন্তর্জাতিকের সম্পর্ক তৈরী করা উচিত। যদিও অবশ্য শ্রেণী-সচেতন শ্রমিকদের নেতৃত্ত্বে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট পার্টিই নেতৃত্ত্বে থাকবে, তবুও রায়ের দৃষ্টিতে "প্রথমাবস্থায় তা কমিউনিস্ট বিপ্লব হবে না।" তাঁর যুক্তি ছিল যে একেবারে শুরু থেকেই যদি নেতৃত্ব "অগ্রণী কমিউনিস্টদের হাতে থাকে", তবে "বিপ্লবী জনগন ভুল পথে বিপথগামী" হবে না।" বরং "পর্যায়ক্রমে বিকাশের ধারায়" এগিয়ে যাবে। ঐ সব দেশের কৃষি সমস্যাড় মোকাবিলা  "অবশ্যই চলবে" একটা "পেটিবুর্জোয়া সংস্কার" এর কর্মসূচি ধরে, পুরোপুরি কমিউনিস্ট নীতিমালার ভিত্তিতে নয়।

রায়ের মতান্তরে লেনিন তীব্র বিরোধিতা করে প্রতিনিধিদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন রাশিয়ায় জারতন্ত্র বিরোধী সংগ্রামের সময়কার  উদারনৈতিক শক্তিগুলোকে বলশেভিকদের সমর্থনের কথা। যদিও লেনিন আবার রায়ের "অপুঁজিবাদী পথে  বিকাশ" এর তত্ত্বকে  জোরালো সমর্থন করে বলেন, "বিষয়টি নিয়ে জীবন্ত বিতর্ক চলেছে।"  তিনি আস্বস্থ করেন যে যদি বিজয়ী সর্বহারা ও সোভিয়েত সরকার তাদের সহায়ক হয়, তবে "পশ্চাদপদ জনগণকে অবশ্যম্ভাবীভাবে পুঁজিবাদী পথেই যেতে হবে ধরে নেওয়াটা ভুল হবে।" এইভাবেই আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেস একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব রায়ের সংযোজন ও লেনিন কর্তৃক তা গ্রহণ করার মধ্যে দিয়ে বৈধতা দিলো এই মর্মে ::  আন্তর্জাতিক  "........ অগ্রণী দেশগুলির সর্বহারার সহায়তায়, পিছিয়ে পড়া দেশগুলি সোভিয়েত ব্যবস্থায় যেতে পারে, এবং কিছু স্তরের পর কমিউনিজমেও পৌঁছাতে পারে পুঁজিবাদী পথে পা না বাড়িয়েও।"

লেনিন রায়ের থিসিসকে যে  "খুবই গুরুত্বপূর্ণ" মনে করেন তার কারণ হল, সেটা লেখা হয়েছিল  ভারতবর্ষ ও গ্রেট ব্রিটেন দ্বারা পদানত আরও বেশ কিছু বড় জাতির প্রেক্ষাপটে। "ঔপনিবেশিক দেশগুলোর সামাজিক শক্তিসমুহের আন্তসম্পর্ক বিষয়ে লেনিনের অনেককিছু  অজানা থাকার কারণ হিসাবে স্তালিন পরবর্তীকালে ব্যাখ্যা দেন। লেনিনের থিসিসের পরেও কেন রায়ের পরিপূরক থিসিসের দরকার পড়লো, তা নিয়ে স্তালিন পরে (১৯২৭) চীন বিপ্লবের প্রেক্ষিতে ঘোষণা করেছিলেন যে "দ্বিতীয় কংগ্রেস শুরু হবার অনেক আগেই এবং ঔপনিবেশিক দেশগুলোর প্রতিনিধিরা আসারও অনেক আগে লেনিনের থিসিস লেখা হয়ে গিয়েছিল।" স্তালিনের মতে, "কংগ্রেসের বক্তব্যগুলো থেকে উঠে আসা ভারত, চীন প্রভৃতি দেশের " প্রকাশিত রকমারি প্রয়োজন" থেকেই "পরিপূরক (সাপ্লিমেন্টারী) থিসিসের উদ্ভভ"।

লেনিন কংগ্রেসের ব্যাখ্যা রেখেছিলেন, "বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক" এর বদলে "জাতীয় বিপ্লবী" কথাটি  বসানোর পেছনে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল "সংস্কারমুখী" ও "বিপ্লবী" বুর্জোয়া আন্দোলনের মধ্যে পার্থক্য টানা, যখন সেই আন্দোলনগুলো সত্যিই বিপ্লবী চরিত্রের। যাই হোক, রায় কর্তৃক সমালোচনার ফলে লেনিনের নিজের পেশ করা  "জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্নে থিসিস" এর সংশোধন  ঘটে। আন্তর্জাতিককে পরামর্শ দেওয়া হয় "বিপ্লবী মুক্তি সংগ্রাম" কে সমর্থন করতে, "বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক মুক্তি সংগ্রাম"-এর বদলে। লেনিনের থিসিসের বেশ কিছু সংশোধন আনা হয়। রায়ের থিসিসকেও "পরিপূরক থিসিস" হিসাবেই উপযুক্তভাবে সংশোধিত করে শেষ পর্যন্ত  একই সাথে কংগ্রেস গ্রহণ করে। লেনিনের থিসিস যেখানে  গৃহীত হয় তিনজন প্রতিনিধির ভোটদানে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে, সেখানে রায়ের দেওয়া  থিসিস গৃহীত হয় সর্বসম্মত ভাবে।

এই বিতর্কের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ও বাস্তব অনুশীলনের জীবন্ত সমস্যা ছিল ভারতের জাতীয় আন্দোলনের বিপ্লবী তাৎপর্য  মূল্যায়নে  বিশেষত গান্ধীর ভূমিকা নিয়ে  লেনিন ও রায়ের মধ্যেকার মতপার্থক্য।রায় পরে জানিয়েছেন, ঔপনিবেশিক ভারতে  গণআন্দোলনের উদ্দীপ্তক ও প্রবাদপ্রতিম নেতা হিসাবে গান্ধীকে লেনিন বিপ্লবী বলেই  মনে করতেন। উল্টে, রায় এই ব্যাপারে  অনড়, যে "ধর্মীয় ও সংস্কৃতিক পুনরুত্থানের প্রবক্তা হিসাবে গান্ধী সামাজিকভাবে একজন প্রতিক্রিয়াশীল হতে বাধ্য, তাঁকে রাজনৈতিকভাবে যতই বিপ্লবী দেখতে লাগুক।" রাশিয়াতেও এরকম কিছু আন্দোলনকারী প্রভাবশালী জননায়ক মানুষের সম্বন্ধে রাশিয়ার বিপ্লবের  পিতৃপ্রতিম  মার্ক্সবাদী নেতা প্লেখানভ চিহ্নিত করে বলেছিলেন,  "সেই আন্দোলনগুলো ছিল  রাজনৈতিক ভাবে বিপ্লবী, কিন্তু সামাজিক ভাবে প্রতিক্রিয়াশীল। "  রায় আলোচ্য বিতর্কে সেই উদাহরণ হাজির করে  লেনিনকে ভারতের সঙ্গে তার সাযুজ্য টেনে নিজের মতের যথার্থ বোঝাতে চেষ্টা করেন। রায়ের মতে ভারতে জাতীয় বুর্জোয়াদেরকে বাইরের থেকে  দেখে যতই চমৎকার  সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনে হোক,  তারা ভেতরে বা অন্তরে সম্ভাব্য পরাক্রমী  প্রতিক্রিয়াশীল। কমিশনের কাছে তিনি যুক্তি দেন, " বিপ্লবের ভয়ে জাতীয় বুর্জোয়ারা  তাদের  শ্রেণীর প্রতি কিছু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ছাড় পাওয়ার বিনিময়ে তারা সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপোষ করে নেবে।" লেনিনের মতে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বর্শামুখ  থাকলে জাতীয়তাবাদীরা একটা প্রগতিশীল শক্তি হয়ে উঠতে পারে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ঔপনিবেশিক দেশে  সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি একই সাথে শ্রেণী সংগ্রামকে  বজায় রেখে চলা যায়। বিপরীতে, রায় আশঙ্কা করেছিলেন জাতীয়তাবাদের অগ্রগতির পেছনে ছুটলে শ্রেণী-সম্পর্ক আবছা হতে বাধ্য। আর সেই কারণেই  মনে করতেন ঐ পথে চললে ঔপনিবেশিক দেশের সর্বহারাকে পশ্চিমের দেশের বিপ্লবের জন্য অনেক ক্ষতি-স্বীকার করতে হবে। এখানে লক্ষ্যনীয় যে,রায়ের থিসিস অনেকটা মাৰ্ক্সের তত্বের কাছাকাছি। কারণ মাৰ্ক্সের কর্মসূচি ও নীতিতে জাতীয়তাবাদের কোনো জায়গা নেই। জাতীয়তাবাদকে মার্কস বুর্জোয়া বিভাগেই ফেলেছেন। তাঁর মতে জাতীয়তাবাদ নয়, শ্রেণীই হল ইতিহাসের মূল উপাদান ও চালিকাশক্তি।

লেনিনের ধারণায় যুক্তফ্রন্ট কৌশল হবে চার শ্রেণীর ঐক্যের জোট, যাতে থাকবে বুর্জোয়া, পেটিবুর্জোয়া, কৃষক ও সর্বহারা। রায়ের ধারণার জোট হল পুঁজিবিরোধী তিনটি শ্রেণীর  একটা জোরদার জোট, যেখানে বুর্জোয়কে বাদ দিয়েই তা গড়ে উঠবে, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বিদেশী ও জাতীয় শোষক উভয়ের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম চালিয়ে।

উভয়ের থিসিসেরই সংশোধন করে পাশ হওয়ায় উভয়ের মধ্যেকার  পার্থক্য আপাত দৃষ্টিতে ক্ষীণ হয়ে আসে। কিন্তু পরবর্তীতে বাস্তবে পার্থক্যটাকে একেবারে সম্পূর্ণ  সরিয়ে রাখায়  রায় ও আন্তর্জাতিকের মধ্যে তা নিয়ে গন্ডগোল দেখা দেয়, যা শুধুমাত্র শব্দচয়ন দিয়ে ঠেকানো যায় না। বিশের দশকের প্রথম দিকে ইউরোপের দেশগুলোতে  প্রবল বিপ্লবী সম্ভাবনা দেখা যাওয়ায় লেনিনের তত্বের ইতিবাচক গুণাবলী পরিলক্ষিত হয়। ঔপনিবেশিক বুর্জোয়ার সাথে আঁতাত হল পরিবর্তনশীল ও  ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতির। লেনিনের ঔপনিবেশিক নীতি সম্পর্কে রায়ের ধারণা সঠিক বলে প্রমান পাওয়া গেলো যখন ঐ ক্ষণস্থায়ী পর্যায় সরে গিয়ে তা এক অনির্দিষ্টকালের  পর্যায়ে পড়ে গেলে। ভারতীয় সর্বহারা সন্পর্কে কিছু ভ্রান্ত মূল্যায়ন থাকা সত্বেও, রায় সঠিক ভাবেই ভবিষ্যদ্বানী করতে পেরেছিলেন, যে একই সাথে জাতীয়তাবাদীদেরকে সমর্থন করা ও শ্রেণী-সংঘর্ষ কে তীব্র করার দ্বিমুখী নীতি নিজের মধ্যেই অন্তর্দ্বন্দের শিকার হয়ে পড়বে। স্বাধীনতা সংগ্রামের পর্যায়ে ভারতীয় কমিউনিস্টদের দোদুল্যমানতা রায়ের আশঙ্কারই প্রতিফলন। উল্টে, বিশের দশকে ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীকে রায়ের সেদিনের নির্ধারক  প্রত্যাখ্যানের অভিঘাত ভারতীয় বিপ্লবের কাছে সর্বহারা শ্রেণীর আধিপত্যের মৌলিক নীতিতে চলার দিশারী হয়েই থেকে যায়। মাঝখানে (১৯৪৩) আন্তর্জাতিকের পতন, পরবর্তীতে (১৯৯১) সোভিয়েতের পতনের পরে এমনকি আজও তার অন্যথা হয়নি। 

ঔপনিবেশিকতা-বিলুপ্তি (ডি কলোনিয়ালাইজেশন) বিষয়ক মহা-বিতর্ক ও এম এন রায়  

[কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ষষ্ঠ কংগ্রেস (মস্কো,১৯২৮)]

স্তালিন-নেতৃত্বধীন সোভিয়েত-ইউনিয়ন নিজেকে ভালোরকম সংহত করার পর প্রথম অনুষ্ঠিত এই কংগ্রেসে উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশ সংক্রান্ত রননীতি প্রনয়ণে এক বাঁক দেখা গেলো। ভারতের প্রতিনিধিরা কেউই সিপিআই -এর অফিসিয়াল প্রতিনিধি ছিলেন না। আন্তর্জাতিকের বড় নেতা  এম এন রায়  বার্লিনে চিকিৎসাধীন থাকায় কংগ্রেসে যেতে পারেননি। তাই তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের উত্তর দেওয়ার কোনো সুযোগই তাঁর ছিল না। আগের বছর রায়কে বলা হয় এই বিষয়ের ওপর একটি খসড়া তৈরী করতে। রায় তা জমা দিলেও  কংগ্রেসের আলোচনার মাঝে তা পেশ করা হয়নি। আন্তর্জাতিকের  অফিসিয়াল নেতৃত্বের পক্ষে কুসিনেন(ফিনল্যান্ড) একতরফাই রায়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানান। সেখানেই রায়ের খসড়া থেকে অল্প কিছু বাক্য তিনি সর্বসমক্ষে উদ্ধৃত করেন।

১৯২২ সালে রায় তাঁর বিখ্যাত লেখা "ইন্ডিয়া ইন ট্রাঞ্জিশন" বইয়ের থেকেই শুরু করেছিলেন একটা তত্ত্ব খাড়া করার। তা হল ভারতে শিল্পায়নের প্রচেষ্টা, যার সৃষ্টি হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের সংকটের বাস্তব পরিস্থিতিতে ব্রিটিশের ভারতে লগ্নিপুঞ্জি রপ্তানির বাধ্যতা থেকে। বিষয়বস্তুটাকে তিনি আরও বিকশিত করেন তাঁর "দ্য ফিউচার অব ইন্ডিয়ান পলিটিক্স" (১৯২৬) বইয়ে এবং আরও কিছু লেখার মাধ্যমে। রজনীপাম দত্ত তাঁর "মডার্ন ইন্ডিয়া" (১৯২৬) শীর্ষক বইয়ে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থার কমবেশি ঐ একই রকম বিশ্লেষণ করেন। সব শেষে রায় তাঁর উপরোক্ত কংগ্রেসে পেশ করার জন্য অপ্রকাশিত "ড্রাফট রেজলিউশণ অন দ্য ইন্ডিয়ান কোয়েশ্চেন" পাঠিয়ে দেন। রায় তাতে লেখেন, " নতুন পলিসির নিহিতার্থ দাঁড়াবে ভারতের 'ঔপনিবেশিকতা-মোচন', যেটা তার 'নির্ভরতা'র অবস্থা থেকে 'স্বনির্ভরতা' (ডোমিনিয়ন স্টেটাস)এর  দিকে যেতে অনুমোদন করবে। ভারতের বুর্জোয়া শ্রেণীকে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী করে চেপে রাখার বদলে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের অধীনেই তাকে দেশের আর্থিক বিকাশের ভাগিদারি বরাদ্দ করা হবে। পশ্চাদপদ, কৃষিভিত্তিক ঔপনিবেশিক দখলের বদলে, ভারত একটা আধুনিক শিল্পপ্রধান দেশে পরিণত হবে,--যাতে কিনা ভারত হয়ে দাঁড়াবে  'স্বাধীন জাতিসমুহের সম্মিলিত কমন-ওয়েলথ এর অন্যতম সদস্য'। ভারত একটা 'উপনিবেশ-মুক্তির' প্রক্রিয়ায় রয়েছে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ওপর আরোপিত নীতির কারণে, যুদ্ধোত্তর কালীন পুঁজিবাদী সংকটের দ্বারা সৃষ্ট ঔপনিবেশিক শোষণের প্রাগৈতিহাসিক রূপ মুছে ফেলে  নতুন রূপ ও পদ্ধতি অবলম্বনের স্বপক্ষে এটা সম্ভব হবে। উৎপাদিকা  শক্তিগুলির মধ্যে যাদের স্বাভাবিক বিকাশের সম্ভাবনাকে এতদিন অস্বীকার করা হত, তারা শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছে। জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তিটারই পরিবর্তন ঘটছে। পুরাতন শ্রেণী সম্পর্ক বদলে নতুন শ্রেণী সম্পর্ক আসছে। বুনিয়াদি শিল্প, কৃষি বিপ্লবের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে (ভূমি মালিকানার প্রচলিত ব্যবস্থা যা কৃষি উৎপাদনের বাধা হয়ে থাকছিল তা ধ্বংসের মুখে)। দেশীয় বুর্জোয়ারা দেশের অর্থনৈতিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্ব অর্জন করছে। অর্থনৈতিক জগতের এই পরিবর্তনের রাজনৈতিক  প্রতিচ্ছবিও দেখা যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে 'ঔপনিবেশিকতা বিলোপ'-এর এই  প্রক্রিয়ার মধ্যে সাম্রাজ্য ছত্রখান হয়ে যাওয়ার বীজ নিহিত রয়েছে। বাস্তবত, তাৎক্ষণিক ভেঙে পড়ার বিপদ এড়াতে সাম্রাজ্যের সংহতকরণের লক্ষ্যে নতুন নীতির অবতারণা দেখিয়ে দেয় যে সাম্রাজ্য কেঁপে গেছে। সাম্রাজ্যবাদ হল পুঁজিবাদী সমৃদ্ধির এক উগ্র প্রকাশ। পুঁজিবাদের অবক্ষয়ের যুগে, তার ভিত্তি টলে যাচ্ছে।"

তারপর আরও লিখছেন, - "ভারতীয় বুর্জোয়া যে পূর্ণ-ঔপনিবেশিক দশার দমন-পীড়ন থেকে বেরিয়ে আসছে, তা কিন্তু তার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের ফসল নয়। ক্রমান্বয়ে "ঔপনিবেশিকতা-বিলোপ"এর এই প্রক্রিয়াটি সৃষ্টি হয়েছে দুটি উপাদানের কারণে, যথা (১) যুদ্ধোত্তর পুঁজিবাদের সংকট এবং (২) ভারতীয় জনগণের বৈপ্লবিক জাগরণ। অর্থনৈতিক ভিত্তির স্থায়িত্ব এবং ভারতে অবস্থান জোরদার করতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এক পলিসি গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে, যা ভারতীয় বুর্জোয়াদের  কিছু কিছু ছাড় না দিয়ে অনুশীলনে নামানোই যাবে না। এই ছাড়গুলো ভারতীয় বুর্জোয়া দের অর্জন করা বিজয় নয়। এগুলো হল  সাম্রাজ্যবাদের দেওয়া উপহার (অনভিপ্রেত কিন্তু বাধ্যতামূলক)। তাই "ঔপনিবেশিকতা-মোচন" চলছে ভারতীয় বুর্জোয়াদের "অ-বিপ্লবীকরণ" প্রক্রিয়ার সমান্তরালে।

আন্তর্জাতিকের ষষ্ঠ কংগ্রেসের অধিবেশনে অটো ভি কুসিনেন তাঁর পেশ করা রিপোর্ট, "দ্য রেভলিউশানারি মুভমেন্ট ইন দ্য কলোনীজ"-এ রায়ের  উক্ত তাত্বিক অবস্থানের এবং তার সঙ্গে আর পি দত্ত ও জিএ লুহানি কর্তৃক প্রায়  অনুরূপ বক্তব্যের  জোরদার বিরোধিতা করেন। এর ফলে সেশনে তুমুল বিতর্ক হয়।

বিতর্ক আরও জটিল আকার ধারণ করে দুটি মতের যায়গায় সর্বমোট তিনটি আলাদা মতের উপস্থিতির কারণে। প্রথম মতটি রায়ের, তা হল , ভারতে দ্রুতগতিতে শিল্পায়ন দেশকে সায়ত্ত-শাসনের(ডোমিনিয়ান স্টেটাস) মাধ্যমে রাজনৈতিক ভাবে ঔপনিবেশিকতা-মুক্তির দিকে এগিয়ে নিচ্ছে, যাতে  ভারতীয় বুর্জোয়ার সাথে ব্রিটিশ বুর্জোয়ার সংঘাত কমছে বা এমনকি দ্বিতীয় শক্তির দিকে  প্রথম শক্তির ঝুকে পড়ার সম্ভাবনাও থাকছে। দ্বিতীয় মত হল ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের তরফে, যা ঔপনিবেশিকতা-বিলোপের রাজনৈতিক দিকটি মানে না, কিন্তু উক্ত শিল্পায়ন-বিকাশের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াটিকে যথাযথ ও  বাস্তবসম্মত মনে করে।

তৃতীয় মত হল আন্তর্জাতিকের অফিসিয়াল মত যা পূর্বোক্ত অন্য দুটি মতকেই নস্যাৎ করে দেয়। সেটি হল (১) কিছুমাত্রায় শিল্পবিকাশের অর্থ কখনোই "শিল্পায়ন" নয়, অর্থাৎ একটি সামন্ততান্ত্রিক-কৃষি অর্থনীতির এক শিল্পোন্নত-পুঁজিবাদী দেশে রূপান্তর সাধন নয়। (২) শিল্পের বিকাশ আদতে ভারতীয় ও ব্রিটিশ বুর্জোয়ার মধ্যে দ্বন্দ্বকে আরও গভীরতর করবে। (৩) "ঔপনিবেশিকতা-বিলোপ"এর তত্ত্ব হচ্ছে "মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ বিরোধী " এবং তা হল রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর।

প্রায় এক শতাব্দী সময় পার হয়ে যাওয়ার পর আজকে বিচার করলে দেখা যাবে সে সময় রায়ের তত্ত্বকে হঠকারী বলে মনে হলেও পরিবর্তনের মূল গতিপথটি তিনি ধরতে পেরেছিলেন ও তাঁর সময়কে অতিক্রম করে দুরদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। তা হল, যুদ্ধোত্তর কালে ভারতের শিল্প-বৃদ্ধি(উপনিবেশ সাপেক্ষে লক্ষ্যনীয় মাত্রায়), এবং ক্রমান্বয়ে ক্ষমতার বাঁটোয়ারা (যত থেমে থেমেই হোক না কেন ) যা ভারতের জন্য একটা আধা-ঔপনিবেশিক চরিত্র প্রদান করেছিল, যেটা ভারতকে কমনওয়েলথ এর সদস্য  করার মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয়। বিপরীতে আন্তর্জাতিকের অবস্থানকে আপাত দৃষ্টিতে তখন সঠিক বলে মনে হলেও তা ছিল নিতান্তই যান্ত্রিকভাবে দেখা লেনিনের "সাম্রাজ্যবাদ" তত্বের এক আধিবিদ্যক সমঝদারি, যা কিনা বাস্তব জীবনের গতিপথকে উপেক্ষা করে চলে। প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে যেটা প্রয়োজন ছিল তা হল এই বিষয়ের একটা সুস্থ বিতর্ককে চলতে দেওয়া। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো ও তাদের উপনিবেশ বা আধা উপনিবেশগুলোর মধ্যেকার রাজনৈতিক পরিবর্তন তাদের উভয়ের (বিশেষত প্রথমটির) এবং গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক বিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে কীভাবে হচ্ছে তা  মার্ক্সবাদী অধ্যয়নের এক  গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এবং আজও অবধি তার সেই গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক তাকে এক কথায় "মার্ক্সবাদ বিরোধী" তকমা দিয়ে বিতর্কের পুরো পর্যায়টিকে সমাপিত না হতে দিয়ে গবেষণাটিকে বন্ধই করে দেয়। এই কট্টরপনা আন্তর্জাতিকের মধ্যে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে বিতর্ক সমাধান (দ্বিতীয় কংগ্রেসে রায়-লেনিনের বিতর্ক স্মরণীয়)এর  থেকে পরিষ্কার বিচ্যুতিকে দেখিয়ে দেয় এবং ঔপনিবেশিক প্রশ্নে মার্ক্সবাদী -লেনিনবাদী বোঝাপড়ার প্রয়োজনীয় বিকাশকে বাধাপ্রাপ্ত করে। এই শেষণের পরেই  রায় এ নিয়ে ক্ষুরধার যুক্তি সহ  বিশদ এক লেখা লিখেছিলেন। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়  আন্তর্জাতিকের অবসানের অব্যবহিত পরেই রায় তাঁর আন্তর্জাতিকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিয়ে  লেখাতেও এ নিয়ে আক্ষেপ জানিয়েছিলেন এবং  ঐতিহাসিক পরিণতিতে নিজের সঠিকতা দাবী করেছিলেন। "ঔপনিবেশিকতা-বিলোপ" তত্ত্বে এম এন রায়ের তখনকার মূল বক্তব্যটি ছিল বাস্তবত "প্রফেটিক"।