বর্তমান ভারতে এম এন রায় কেন প্রাসঙ্গিক

কমিউনিস্ট তথা বামপন্থী মহলে প্রচলিত প্রধান ধারণা অনুসারে, এম এন রায়ের রেডিকাল হিউম্যানিজম মার্কসবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত বা বিরোধী একটি মতবাদ। এই অভিমত বোধ হয় সর্বজনবিদিত। কিন্তু যে কথা হয়তো সকলে জানেন না তা হল, এর বিপরীত একটি মতও প্রগতিশীল/মার্কসবাদে আস্থাশীল গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিকদের মধ্যে দেখা যায়। তাঁরা মূলত মনে করেন, এম এন রায় সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের ক্রিটিকের মধ্যে দিয়ে মার্কসবাদের কতগুলো কোর ভ্যালু ও ভিশন অর্থাৎ মৌলিক ও কেন্দ্রীয় মূল্যবোধ ও বীক্ষণকেই -- যেমন, মার্কসের নিজস্ব (বা বলা যায় মার্কসবাদে অন্তর্নিহিত) মানবতাবাদকে --তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। এবং এইভাবে মার্কসবাদের দিগন্তকে আরো প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন। সেই প্রয়াসে খামতি থাকতেই পারে, তা নিয়ে বিতর্কও হোক, কিন্তু প্রয়াসটাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। সাফল্যের পথে এগোতে এগোতে কেন কেবল রাশিয়ায় নয়, চীন সহ অন্যত্রও, ফলিত মার্কসবাদের বিপর্যয় ঘটলো? এর মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক কারণগুলি কী? এই আলোচনা করতে হলে, মার্কসবাদের যুগোপযোগী বিকাশ ঘটাতে হলে, অন্য অনেক তাত্তিকের মতো রায়ের গভীর বিশ্লেষণও অবশ্যই অধ্যায়নের দাবি রাখে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি এই দ্বিতীয় বা বিপরীত মতটিকেই সঠিক মনে করি। কিন্তু প্রায় ১০০ বছর আগে তৃতীয় আন্তর্জাতিক থেকে রায়কে বহিষ্কার করাটা ঠিক ছিল কি ছিল না -- এই সাংগঠনিক বিষয়টি নিয়ে বা তাঁর রেডিকাল হিউম্যানিজম তত্ত্ব মার্কসবাদের অনুসারী নাকি বিরোধী তা নিয়ে এখনই বিতর্কে ব্যাস্ত হয়ে পড়াটা আমাদের পার্টির গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে আমি মনে করি না।

আমাদের বরং খুঁজে দেখতে হবে আজ দেশের মাটিতে যে লড়াই আমরা লড়ছি তার প্রয়োজনে আমরা রায়ের কাছ থেকে কি কি পেতে পারি। যেমন ধরুন, আম্বেদকর চর্চায় আমরা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর সংঘাতে কোন পক্ষ কতটা দায়ী ছিল, বা কোথায় কোথায় তার ভুল হয়েছিল, তা নিয়ে গবেষণায় নামছি না। বরং তাঁর কাছ থেকে কোন শিক্ষা কোন প্রেরণা আমরা নিতে পারি ও জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারি সেটাই আমাদের প্রধান বিবেচ্য। অনেকটা একইভাবে, দর্শন ও মতাদর্শের স্তরে জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে মানবেন্দ্রনাথের রচনা থেকে কিছু মূল্যবান অন্তরদৃষ্টি আত্মসাৎ করে আমরা নিজেদের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। আপনাদের সকলের বিবেচনার জন্য সামান্য কিছু নিদর্শন:

জাতীয়তাবাদ

গান্ধীর রাজনীতিতে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার ব্যবহারকে রায় এক প্রতিক্রিয়াশীল উপাদান বলে মনে করতেন, যা শ্রেণীসংগ্রাম ও জাতীয় সংগ্রামকে বিভাজিত করে দুর্বল করে। তাঁর মতে, স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁর ভাষায়,

“গান্ধীর জাতীয়তাবাদ ধর্ম ও চরকার নীতিশিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে আপোস করতে শেখায়, যেখানে প্রয়োজন ছিল জ্ঞান ও সংগঠনের অস্ত্রে তাঁদের সজ্জিত করা, যাতে সেই দুঃখ-দুর্দশা চিরতরে দূর করা যায়।”

গান্ধীর রক্ষণশীল ধর্মাশ্রয়ী বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের বিপরীতে রায় তুলে ধরেছিলেন শ্রমিক-কৃষকের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের আদর্শ। তিনি মনে করতেন, ভারতের মুক্তিসংগ্রাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত বিশ্ব প্রলেতারিয় আন্দোলন ও অন্যান্য ঔপনিবেশিক জনগণের সংগ্রামের সঙ্গে।

ফ্যাসিবাদ

রায় গান্ধীকে হিটলারের সঙ্গে কখনো এক করে দেখাননি। কিন্তু তিনি বারবার সতর্ক করেছেন যে, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের মিশ্রণ এবং গান্ধীয় ধাঁচের গণআন্দোলন — যা রাজনৈতিক চেতনা নয়, ব্যক্তিপূজার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং একনেতা-কেন্দ্রিক — ভারতে এক বিশেষ ধরনের ফ্যাসিবাদের উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। 'হিন্দু রাজ' সম্পর্কে আম্বেদকরের হুঁশিয়ারির মতোই, রায়ের এই সতর্কবার্তা আজ আমরা বাস্তবে পরিণত হতে দেখছি।   

সংস্কৃতি ও মানবসত্ত্বা

“যে জাতীয় সংস্কৃতি নিজেকে শাশ্বত বলে দাবি করে, তা প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।"

“সংস্কৃতি কোনো মন্দির বা ধর্মগ্রন্থে সংরক্ষিত উত্তরাধিকার নয়। তা ক্রমাগত সমৃদ্ধ হতে থাকে বিভিন্ন জাতির অবদান দ্বারা এবং বিজ্ঞান ও স্বাধীনতার অগ্রগতির মধ্যে দিয়ে।”

রায়ের এই ধরনের বক্তব্য গুলো মনে করিয়ে দেয় "থিসিস অন ফয়েরবাখ"-এ মার্ক্সের অসামান্য উচ্চারণ:

"ফয়েরবাখ ধর্মীয় সারবস্তু বা সত্তাকে মানবীয় সত্তায় পরিণত করেছিলেন। কিন্তু মানবসত্তা প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে আলাদাভাবে বিদ্যমান কোনো বিমূর্ত গুণ নয়। আসলে এটি হল সবরকম সামাজিক সম্পর্কের সমাহার।”

রায় আরো বলছেন:

“ভারতীয় সংস্কৃতি সর্বদাই ছিল সম্মিলিত। ইসলাম এসেছিল জাতপাতজনিত স্থবিরতার বিরুদ্ধে এক মুক্তির শক্তি হিসেবে; হিন্দু একাধিপত্যের খোলস ভেঙে দিয়ে তার সভ্যতাকে এক নতুন প্রেরণায় সমৃদ্ধ করেছিল।”

 

সংস্কৃতিকে তিনি দেখেছেন জীবন্ত, পরিবর্তনশীল ও বহুমুখী এক মানবিক প্রক্রিয়া হিসেবে। তাঁর মতে "ভারতের জাতীয় সংস্কৃতি কোনও একক ধর্ম বা ঐতিহ্যের ওপর দাঁড়িয়ে নেই। আসলে তা হল বহু স্বরের মিলনে গড়া এক আধুনিক, যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী সংস্কৃতি।"

আসুন আমরা ফ্যাসিস্ট হিন্দুত্বের আর্থিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একজোট হই। মার্কিনঘেঁষা হিন্দি-হিন্দু- হিন্দুস্তান মার্কা প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদকে পরাস্ত করে প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরি। আজ যখন ফ্যাসিবাদের নিষ্ঠুরতা দিকে দিকে মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে, তখন আসুন অতীত ও বর্তমানের সমস্ত মানবতাবাদী গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল পরম্পরাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এগিয়ে চলি।