এম এন রায় ও ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা

মানবেন্দ্রনাথ রায় বা এম এন রায় আজ ভারতের বামপন্থী উদারবাদী শিবিরে প্রায় বিস্মৃত একটি নাম। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রারম্ভিক পর্বের অত্যন্ত বর্ণময় আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই নেতার মৃত্যুর পর সত্তর বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। জন্মশতবর্ষও আমরা পেরিয়ে এসেছি প্রায় চার দশক আগে। পরাধীন ভারতে আজকের উত্তর চব্বিশ পরগনার আরবেলিয়া এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কোদালিয়া থেকে যে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের যাত্রা শুরু হয়েছিল তিনি কালক্রমে কীভাবে মানবেন্দ্রনাথ রায় নামে পরিচিতি লাভ করলেন এবং অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর গোষ্ঠীর বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী ধারা থেকে মার্ক্সবাদী মতাদর্শের প্রবক্তা হয়ে উঠলেন তা ভারতের স্বাধীনতা এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসের এক মনোগ্রাহী কাহিনী।

মেক্সিকোতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পর মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে ১৯২০ সালে লেনিনের সঙ্গে একযোগে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম প্রশ্নে অনুপূরক প্রস্তাব পেশ করা এম এন রায়ের কমিউনিস্ট পর্যায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পরবর্তীতে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের প্রতিনিধি হিসেবে চীন সফর এবং অবশেষে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর ভারতে ফিরে এসে দীর্ঘ কারাবাস এবং জীবনের শেষ পর্যায়ে সংগঠিত কমিউনিস্ট আন্দোলন বা মার্ক্সবাদী মতাদর্শ থেকে আলাদা হয়ে রাডিকাল হিউম্যানিস্ট বা বিপ্লবী মানবতাবাদী ধারার  প্রবর্তন - এম এন রায়ের এই ঘটনাবহুল জীবন প্রগতিশীল ধারার ছাত্র, গবেষক বা আন্দোলনকারীদের কাছে অবশ্যই গম্ভীর অধ্যয়নের বিষয়।

এম এন রায়ের যে বইটি নিয়ে এই আলোচনা তার বিষয়বস্তু অবশ্য অত্যন্ত নির্দিষ্ট - ফ্যাসিবাদকে বোঝা এবং গণতন্ত্র ও মানবতার স্বার্থে ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করার কর্মসূচীর গুরুত্বকে অনুধাবন করা। রুশ বিপ্লবের অব্যবহিত পরে যখন ইউরোপে বড় আকারে বিপ্লবের প্রত্যাশা দানা বাঁধছে, জার্মানীতে বিপ্লবের প্রচেষ্টায় রোজা লুক্সেমবার্গ এবং কার্ল লিবনেখটের মতো প্রথম সারির বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা শহীদ হচ্ছেন, তখনই প্রতিবিপ্লবের আবির্ভাব ঘটল ইতালিতে। দুনিয়া জুড়ে সমাজবাদের সাড়া জাগানো আলোড়নের মাঝে পৃথিবী দেখল বিংশ শতাব্দীর নতুন অশনি সংকেত - ফ্যাসিবাদ। বেনিটো মুসোলিনি এবং মুসোলিনির দার্শনিক সহচর জিওভান্নি জেন্টাইল রীতিমত ফ্যাসিবাদের তত্ত্ব হাজির করলেন - ডকট্রিন অফ ফ্যাসিজম। এম এন রায় ফ্যাসিবাদকে এই দর্শনের আয়না এবং আঙিনাতেই সবার আগে ধরার চেষ্টা করেছেন।

মুসোলিনির চোখে উনবিংশ শতাব্দী ছিল সমাজবাদ, গণতন্ত্র এবং উদারবাদের আধিপত্যের যুগ। এর বিপরীতে বিংশ শতাব্দীকে ফ্যাসিবাদের শতাব্দী বানানো ছিল তার লক্ষ্য। সমাজবাদ, গণতন্ত্র এবং উদারবাদের কেন্দ্রে ছিল ব্যক্তি মানুষ, মুসোলিনির ফ্যাসিবাদের যাবতীয় কর্তৃত্ব রাষ্ট্রের হাতে। সবকিছুই রাষ্ট্রের অধীনে, কোন কিছুই রাষ্ট্রের বাইরে বা বিরুদ্ধে নয় - এই ছিল ইতালির ফ্যাসিবাদের গোড়ার কথা। উনবিংশ শতাব্দী ছিল ব্যক্তির, বিংশ শতাব্দী হবে রাষ্ট্রের - এই ছিল মুসোলিনি-জেন্টাইল জুটির স্পষ্ট ঘোষণা। ইতালির পরে জার্মানীতে ফ্যাসিবাদ পেল নতুন নাম - ন্যাশনাল সোশ্যালিজম বা নাজিবাদ বা নাৎসিবাদ। রাষ্ট্র বনাম ব্যক্তির সাধারণ যুদ্ধরেখা পেরিয়ে নাজি জার্মানী ব্যক্তিকে বিভাজিত করল প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে, ক্ষমতাসম্পন্ন শিবির বনাম স্থায়ী অভ্যন্তরীণ শত্রু, 'শ্রেষ্ঠতম' জার্মান জাতি বনাম ইহুদী ও বিভিন্ন প্রান্তিক গোষ্ঠী যাদের পোকামাকড়ের মত নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে।

জার্মান জাতির বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তারের উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফলে জার্মানীর ভেতরের ফ্যাসিবাদের মহাতাণ্ডব ছড়িয়ে পড়ল বিভীষিকাময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। সঙ্গে দোসর হিসেবে ইতালি এবং জাপান, বিশ্বজুড়ে এই ফ্যাসিবাদী অক্ষের বিরুদ্ধে গড়ে উঠল ব্যাপক সামরিক-রাজনৈতিক প্রতিরোধের মঞ্চ। অপরিসীম ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ইউরোপ সেদিন এই বিধ্বংসী ফ্যাসিবাদী ঝড়ের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল। এম এন রায়ের চোখে কিন্তু ফ্যাসিবাদের এই পরাজয় ছিল মূলতঃ সামরিক পরাজয় - ইউরোপে ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থানের আশঙ্কা বা ভারতে ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে পঞ্চাশের দশকের গোড়াতেই সোচ্চার ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে গোড়া থেকেই এম এন রায় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হিসেবে দেখেছেন, ফ্যাসিবাদের আবির্ভাবের সাথে সাথে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধের সঙ্গে ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতাকেও তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অপরিহার্য শর্ত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

এম এন রায়ের এই রচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল ফ্যাসিবাদের বিপদের উৎস শুধু পুঁজিবাদের সংকটের মধ্যে না খুঁজে তার পেছনে ভাববাদী দর্শনের প্রেক্ষাপটকেও সম্যক উপলব্ধি এবং মোকাবিলা করা প্রয়োজন। ঠিক যেমন মধ্যযুগের ইউরোপীয় রাজতন্ত্রে ধর্মের ভিত্তিতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে রাজা যেমন তার শাসন চাপিয়ে দিত, বুর্জোয়া গণতন্ত্রে ধর্ম এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার আপাত বিচ্ছেদ সত্ত্বেও নিরঙ্কুশ ক্ষমতার স্বার্থে সবসময় স্বৈরশাসকেরা ধর্মকে ব্যবহার করেছে। আজ যখন নির্বাচনের প্রাক্কালে নরেন্দ্র মোদী নিজেকে পরমাত্মার নন-বায়োলজিক্যাল প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরেন তখন আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই কীভাবে ব্যক্তিপূজার রাজনীতিকে ব্যাপক ধর্মবিশ্বাসী জনগণের ধার্মিক আস্থার বেদীর উপর দাঁড় করানো হচ্ছে।

ভারতের জাতীয়তাবাদী চেতনায় ধর্ম এবং রাজনীতির ব্যাপক মিশ্রণের ফলে এম এন রায় ভারতে ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে বিশেষ সতর্ক ছিলেন। ধার্মিক পুনরুত্থানবাদকে ভিত্তি করেই ফ্যাসিবাদ ভারতে মাথা চাড়া দেবে, এই সতর্কবাণী তাঁর লেখায় বারংবার শোনা যায়। একই সতর্কবাণী আমরা শুনেছি বাবাসাহেব আম্বেদকারের মুখেও যখন তিনি বলেন ধর্মে ভক্তি মোক্ষলাভের পথ হলেও রাজনীতিতে ভক্তি গণতন্ত্রের পতন ডেকে আনতে বাধ্য। আরও নির্দিষ্ট ভাষায় আম্বেদকার বলেছিলেন ভারতে যদি হিন্দু রাজ কখনও বাস্তবে পরিণত হয় তাহলে তার চেয়ে বড় বিপর্যয় আর কিছু হতে পারে না।

আধুনিক ভারতে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সাংবিধানিক নৈতিকতা এবং যুক্তিনির্ভর জ্ঞানের প্রসারের উপর আমরা আম্বেদকারকে নিরন্তর জোর দিতে দেখেছি। একই ধ্বনির অনুরণন এম এন রায়ের ফ্যাসিবাদ বিষয়ক রচনায়। বুঝতে অসুবিধে হয় না, সংবিধানের উপর সরাসরি আঘাত হানার পাশাপাশি আজ মোদী জমানায় খুবই সংগঠিত ও পরিকল্পিত কায়দায় কেন ভারতের সমস্ত শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে কুক্ষিগত করে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং মিথ্যা ও ঘৃণা প্রচারের স্থায়ী বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। সংবিধান রচনার দু দশক আগে যে মনুসংহিতাকে সার্বজনিক ভাবে দহন করে আম্বেদকার সামাজিক অসাম্য এবং পরাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন,  পরবর্তীতে সংবিধানকে অস্বীকার করে আরএসএস খোলাখুলি ভাবে সেই মনুসংহিতাকেই ভারতের প্রকৃত সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করার ওকালতি করেছিল। স্বাধীনতা ও সাম্যের লক্ষ্যে আধুনিক সংবিধানের বিরুদ্ধে সামাজিক অসাম্য ও পরাধীনতার লিখিত-অলিখিত নিয়ম চাপিয়ে দেওয়ার সেই ষড়যন্ত্র ও দুঃসাহস মোদী জমানায় যখন ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে তখন মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ফ্যাসিবাদ বিরোধী সতর্কবাণী এবং মানবতাবাদের বলিষ্ঠ আহ্বান বলাই বাহুল্য আজ আরও অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।

দর্শনের পাশাপাশি ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক যাত্রাপথের বৈশিষ্ট্যের প্রতিও মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ছিল তীক্ষ্ণ নজর। ভারতে ফ্যাসিবাদের আশঙ্কাকে আজও নির্বাচনের উদাহরণ দেখিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়। আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের খোলসের মধ্যেই ইতালি বা জার্মানীতে ফ্যাসিবাদ নিজেকে সংহত করেছে, সামরিক অভ্যুত্থান নয়, নির্বাচনের পথ ধরেই ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা করায়ত্ত করেছে ইতালি এবং জার্মানীতে। মুসোলিনি এবং হিটলারের উত্থান এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করার এই নির্বাচনী যাত্রাপথের কথা যথোচিত গুরুত্ব সহকারে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এম এন রায় তাঁর এই রচনায়। ভারতে নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক বিবর্তন এবং নির্লজ্জ পক্ষপাতপূর্ণ আচরণ, বিশেষ করে ইভিএমের অপব্যবহার, ভোটচুরি ও এসআইআর সংক্রান্ত ব্যাপক নির্বাচনী কেলেঙ্কারির নিরিখে এই ফ্যাসিবাদী প্রবণতা অত্যন্ত সুস্পষ্ট।

হাজার বছরের পুরনো ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থার শৃঙ্খল, গভীর সামাজিক আর্থিক বৈষম্য এবং মানবতার চূড়ান্ত অপমান, ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো এবং সেই শাসনের হাত ধরে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও দেশভাগের ক্ষত যাকে আজও খুঁচিয়ে ঘা করার অবিরাম চেষ্টা চলছে, সরকারী আশীর্বাদে লালিত কর্পোরেট কালসাপ, আর অধিকারসম্পন্ন নাগরিককে ক্রমাগত অনুগত প্রজায় পদদলিত করতে থাকা সর্বকর্তৃত্বময় রাষ্ট্র - ভারতে ফ্যাসিবাদী উত্থানের এই প্রেক্ষাপট আজ আর নিছক তাত্ত্বিক গবেষণা ও বিতর্কের বিষয় নয়, ভারতীয় জনগণ বা সংবিধানের ভাষায় 'উই দ্য পিপল অফ ইন্ডিয়ার' ব্যাপক অংশের জন্য এ আজ প্রতিদিনের নির্মম বাস্তব। তাই এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক গণ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আজ সময়ের দাবি। মার্ক্সবাদী প্রগতিশীল ইতিহাসচেতনা এবং সমাজ ও সংস্কৃতির গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে সমৃদ্ধ মানবেন্দ্রনাথ রায়ের এই রচনা আজকের ভারতে ফ্যাসিবাদকে চিনতে, বুঝতে এবং তাকে পরাজিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নিশ্চয়ই আমাদের সাহায্য করবে।