মিখাইল লেরমন্তভ এবং তাঁর উপন্যাস ‘এ হিরো অব আওয়ার টাইম’

পুশকিন এবং গোগল এর সমকালে মিখাইল লেমন্তিয়েভের লেখা একটি উপন্যাস আলোড়ন তুলেছিল। উপন্যাসটির নাম আমাদের সময়কার নায়ক, এ হিরো অব আওয়ার টাইম। 

লেমন্তিয়েভ সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন।  সেই অভিজ্ঞতার ছাপ তার এই উপন্যাসটাতে রয়েছে। তবে এই উপন্যাস কোনও যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনী নয়।  ১৮২৫ সালে রাশিয়ায় ডিসেম্ব্রিস্ট বিদ্রোহ দমন করার পর যে প্রতিক্রিয়াশীল যুগ শুরু হয়েছিল, সেই যুগের মন মানসিকতার ছাপ এই উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে। 

এই উপন্যাসের নায়ক পেচোরিন। সে তরুণ, প্রতিভাশালী, বুদ্ধিমান, সুপুরুষ কিন্তু নিরাবেগ। প্রেমের ক্ষেত্রে নিস্পৃহ৷ তাঁর জীবনে অনেক নারী এসেছে, সে তাদের ভালোওবেসেছে খানিক কিন্তু ভালোবাসার আবেগে ভেসে যেতে পারে নি। বরং কিছু পরেই ভালোবাসা বদলে গেছে নিস্পৃহতায় আর তার প্রেয়সীরা কষ্টে ডুবে গেছে।

উপন্যাসটির বিন্যাস খানিকটা চমকপ্রদ। এটি পাঁচটি অসমান দৈর্ঘ্যের গল্পের সমষ্টি। তাদের মধ্যে তিনটি উপন্যাস হিসেবে বইটি প্রকাশের আগেই ‘অতেচেস্তভেন্নীয়ে জাপিস্কি’ নামের এক প্রগতিশীল পত্রিকায় আলাদা আলাদা গল্প হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। তখন মনে হয় নি এগুলি কোনও একটি উপন্যাসের অংশ। সব গল্পগুলিতেই ছিল ককেসীয় সেনাদলে বদলি হওয়া এক অফিসার, যার নাম পেচোরিন।

এই উপন্যাসে দুটি খণ্ড ও পাঁচটি পরিচ্ছেদ রয়েছে। প্রথম খণ্ডে রয়েছে তিনটি পর্ব। সেগুলির নাম বেলা, মাক্সিম মাক্সিমীচ, তামান। এই তামান হল পেচোমিনের ডায়রীর মুখবন্ধ। উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে পেচোরিনের ডায়েরি। এর দুটি পর্ব হল রাজকুমারী মেরী ও অদৃষ্টবাদী। এই পাঁচটি পর্বের মধ্যে প্রথম খণ্ডের প্রথম পর্ব বেলা ও দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম পর্ব রাজকুমারী মেরীই কাহিনীর দিক থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় খণ্ডের ঘটনাগুলি প্রথম খণ্ডের আগে ঘটেছে। উপন্যাসের বর্ণনাক্রম ছেড়ে যদি আমরা পেচোরিনের জীবনক্রম তথা সময়ক্রমের দিক থেকে দেখি তাহলে দেখব এক সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ করার পর পেচোরিন এক স্বাস্থ্যকর স্থানে যায়। প্রথমে পিয়াতিগোর্স্কে ও তারপরে কিস্‌লভোদ্‌স্কে থাকে। এই সময়েই সে ডুয়েলে রাজকুমারী মেরীর প্রেম কেন্দ্রিক বিতর্কে সহকর্মী সামরিক অফিসার গ্রুশ্‌নিৎস্কির সঙ্গে ডুয়েল লড়ে ও তাকে হত্যা করে। এরপর পেচোরিনকে এর শাস্তি হিসেবে বদলি করা হয় ককেশাস সীমানা বাহিনীর এক দুর্গে। সেখানেই বেলার সঙ্গে তার আলাপ ও বিবাহ। এই পর্বেই তাঁর সহকর্মী ছিলেন মাক্সিম মাক্সিমীচ, যার মুখ থেকে গল্পকথক পেচোরিনের জীবনকথা শুনেছিলেন। অদৃষ্টবাদী নামের সংক্ষিপ্ত ও শেষ পর্বের ঘটনাবলী ঘটে এই দুর্গবাস পর্বেই। এই সময়ে দিন পনেরোর জন্য পেচোরিন এক কসাক গ্রামে যায় ও ভুলিচের সঙ্গে বাজি ধরে। ভুলিচ টোটা ভরা বন্দুক নিজের মাথায় চালানোর পরেও গুলি না বেরনোয় বেঁচে গিয়েছিল আর জিতে নিয়েছিল সেই অদ্ভুত বাজি। তবে তারপরেই হঠাৎ এক পথচলতি কসাকের ছুরির আঘাতে সে রাতেই তার মৃত্যু হয়, পেচোরিনের সেই রাতে ভুলিচের মৃত্যুসংক্রান্ত চিন্তা আশ্চর্যভাবে মিলে যায়। এর পাঁচ বছর পর পেচোরিন যখন পারস্যে যাচ্ছে তখন সেখানে মাক্সিম মাক্সিমীচ ও গল্পকথকের সঙ্গে পেচরিনের এক ঝলক দেখা হয়। মাক্সিম মাক্সিমীচের দিক থেকে প্রবল উষ্ণতা থাকলেও তার একদা সহকর্মী ও বন্ধু পেচোরিন ছিল অবিশ্বাস্যরকম নির্লিপ্ত। পরে জানা যায় পারস্য থেকে ফেরার পথে পেচোরিনের মৃত্যু হয়েছে।

উপন্যাসে পরের ঘটনা আগে, আগের ঘটনা পরে - এই রকম বিন্যাস থাকলেও আমরা যদি নায়কের জীবনকথাকে সরলরৈখিকভাবে দেখি তাহলে তিনজন মেয়েকে আমরা পেচোরিনের জীবনে আসতে দেখব। একজন ভেরা। তাদের প্রেমের শুরুর দিনকালের কথা উপন্যাসে নেই। পেচোরিন যখন ককেসাস অঞ্চলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আছে, তখন আবার ভেরার সঙ্গে তার দেখা হয়। পেচোরিনের সঙ্গে প্রেম ভাঙার পর যে তার প্রথম স্বামী হয়েছিল, তার সঙ্গে ভেরার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। নিজের এবং সন্তানের ভরণপোষণের জন্য সে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে এক ধনী বৃদ্ধকে। এই সময়ে পেচোরিনের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয় ভেরার। সে স্বামীকে ও সমাজকে লুকিয়ে পেচোরিনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়। পেচোরিনকে আলিঙ্গন ও আতপ্ত চুম্বনে ভরিয়ে দেয়। পেচোরিন ভেরার সঙ্গে নতুন এই সম্পর্ককে আড়াল দেবার অছিলায় যাতায়াত বাড়ায় মস্কো থেকে আসা রাজকুমারীর বাড়িতে। সেখানে রানী লিগোভস্কায়া আর তার মেয়ে মেরীর সঙ্গে তার আলাপ হয়। মেরী তার প্রেমে পড়ে। মেরীর প্রেমপ্রার্থী ছিল সেনাবাহিনীর সতীর্থ গ্রুশনিৎস্কি। এই প্রেম জনিত বিবাদকে কেন্দ্র করে তাদের ডুয়েল হয় ও গ্রুশনেৎস্কি পেচোরিনের গুলিতে মারা যায়। 

এরপর রানী লিগোভস্কায়া সব আড়াল ভেঙে নিজেই তার মেয়ে মেরীর বিবাহপ্রস্তাব নিয়ে দাঁড়ান পেচোরিনের সামনে। মেরীও তার হৃদয়কে খুলে দেয় পেচোরিনের সামনে। কিন্তু পেচোরিন মেরীর প্রতি আকৃষ্ট হলেও প্রেম বা বিবাহের প্রস্তাবে সাড়া দেয় নি। এরপর পেচোরিনকে ডুয়েলে সহকর্মীকে হত্যার দায়ে বদলি করে দেওয়া হয়। 

এই বদলি জীবনের ছবিই রয়েছে উপন্যাসের প্রথম পর্বে৷ এখানে এক ভবঘুরে পাহাড়ী জনজাতির মেয়ে বেলার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয় পেচোরিন। নানা কৌশলে তার ভাই আজামাৎকে বশ করে তার সাহায্যে বেলাকে ঘরেও নিয়ে আসে। বিবাহিত দম্পতির মতো থাকাও শুরু করে। প্রথম দিকে আড়ষ্ট থাকলেও বেলা পেচোরিনের প্রেমে ডুবে যায় ক্রমশ। অন্যদিকে কিছুদিন পর পেচোরিনের নিরাসক্তি ফিরে আসে আবার। সে বেলাকে ছেড়ে শিকার করতে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। বেলা একাকী বিরহকাতর দিন কাটাতে থাকে। পেচোরিনের অনুপস্থিতির সুযোগে বেলার এক প্রাক্তন প্রেমিক কাজবিচ এসে তাকে ঘোড়ায় চাপিয়ে পালায়। পথে পেচোরিন তাকে ধরে ফেলে। বেলাকে উদ্ধার করার আগেই কাজবিচ বেলার পেটে ছুরি বসিয়ে দেয়। পেচোরিন ঘরে এনে সার্জেনকে দিয়ে বেলার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেও তাকে বাঁচাতে পারে নি। 

এরপর পেচোরিন সেনাবাহিনীর কাজে চলে গিয়েছিল পারস্যে। সেখান থেকে ফেরার পথে এই মিলিটারি অফিসারের মৃত্যু হয়। 

পেচোরিন বুদ্ধিমান, উচ্চশিক্ষিত, সুদর্শন, ধনী, সুনিপুণ পর্যবেক্ষণশক্তির অধিকারী ও নানা গুণের আকর। কিন্তু তার জীবনযাত্রায় কোনও উদ্দেশ্য নেই, নেই আবেগের দীপ্তি। প্রেম বা বন্ধুত্ব – কোনও কিছুই অল্পদিনের পর আর তাঁকে আকর্ষণ করে না। তার জীবনের সুসময়ের দিনগুলি কেটে যায় নিষ্ক্রিয়তায়। তার গুণাবলীকে সে ইতিবাচক কাজে ব্যবহারের উৎসাহই পায় না।

প্রশ্ন হল কেন পেচোরিন যুবক অবস্থাতেই যেন বার্ধক্যের ক্লান্তি ও নিরাসক্তির শিকার? কেন তার স্বপ্ন নেই, আবেগ নেই, ভালোবাসায় ভেসে যাওয়া উচ্ছল হৃদয়বৃত্তি নেই?

লেরমেন্তভ সেনাবাহিনীতে চাকরী করার পাশাপাশি তাঁর সাতাশ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনকালে রোমান্টিক কবি হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। তবে তাঁর একমাত্র উপন্যাসে যখন তিনি বাস্তবঘনিষ্ট কাহিনী লিখলেন তখন তাঁর নায়ককে রোমান্টিক ভঙ্গীতে আঁকতে পারলেন না। কারণ তাঁর সময় ও সমকালের বাস্তবতা ও সেই সময়ের যুগ মানসিকতা। একটি বিপ্লবকে নির্মমভাবে দমন করা ও পরবর্তীকালের বিপ্লবীদের আগমনের মাঝের হতাশা স্থিতাবস্থা প্রতিক্রিয়ার সময় তখন পেরোচ্ছিল জার প্রথম নিকোলাই এর প্রতিক্রিয়াশীল শাসনে থাকা রাশিয়া। সেই সময়ের প্রতিভাধর বুদ্ধিমান যুবকেরা তাই তখন ছিলেন হতাশ, নিরাবেগ ও নিরাসক্ত। মিখাইল লেরমন্তভের নায়ক পেচোরিন সেই যুগ মানসিকতারই প্রতিভূ।

এই প্রসঙ্গে মিখাইল লেরমন্তভের সমকালীন আলেক্সান্দর গের্ৎসেন বলেছেন, “১৪ ডিসেম্বরে অংশগ্রহণ করার পক্ষে আমরা সকলেই ছিলাম নিতান্ত তরুণ। এই মহান দিনটিতে জাগ্রত হয়ে আমরা দেখলাম শুধু প্রাণদণ্ড আর নির্বাসনের শাস্তি। বাধ্য হয়ে নীরব থেকে, চোখের জল আটকে রেখে আমরা নিজের মধ্যে ডুবে থাকলাম, নিজেদের ভাবনাচিন্তাকে ভেতরে রেখে লালন করতে শিখলাম। আর সেই ভাবনাচিন্তা জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত উদারতন্ত্রের ভাবধারা নয়, প্রগতির ভাবধারা নয়, সেই ভাবনাচিন্তা সন্দেহ, অস্বীকৃতি আর আর রাগে পরিপূর্ণ। … লেরমন্তভ একান্তভাবে আমাদের প্রজন্মভূক্ত।”

লেরমন্তভের এই উপন্যাস যুগবৈশিষ্ট্যকে নিখুঁতভাবে ধারণ করতে পেরেছিল বলেই ১৯৪০ সালে উপন্যাসটি প্রকাশের অব্যবহিত পরে তা নিয়ে রাশিয়ায় প্রবল সাড়া পড়ে যায়। দুর্ভাগ্য এর পরে লেরমন্তভ আর বেশীদিন বাঁচেন নি। বছর খানেক পরেই এক ডুয়েল লড়াইতে তাঁর মৃত্যু হয় মাত্র সাতাশ বছর বয়সে। এই একটিমাত্র উপন্যাস লিখলেও সেখানে যুগবৈশিষ্ট্যকে ধারণ করার ক্ষেত্রে অসামান্য মুন্সিয়ানার কারণে লেরমন্তভ কবিতার পাশাপাশি রুশ কথাসাহিত্যের অঙ্গনেও চির স্মরণীয় হয়ে আছেন।