ওভারকোট : একটি পাঠ

গোগলের ওভারকোট নামক অতিবিখ্যাত গল্পটি থেকে একটা ছোট্ট অংশ প্রথমে একটু উদ্ধৃত করা যাক।

“আকাকি আকাকিয়েভিচ কখনও কোনও রকম আমোদপ্রমোদকে প্রশ্রয় দিত না। … তাকে কখনো কোনও সান্ধ্য আসরে দেখা গেছে এমন কথা কেউ বলতে পারে না। লেখার পর পরম পরিতৃপ্তিভরে সে বিছানায় শুতে যেত আর আগামীকালের কথা ভেবে, আগামীকাল নকল করার জন্য কিছু একটা ভগবান তার কাছে পাঠিয়ে দেবেন এই কথা মনে করে সে খুশি হয়ে আসত। এই ভাবে বয়ে চলছিল এমন একজন মানুষের শান্ত জীবনযাত্রা, যে বছরে চারশ রুবল মাইনে পেয়ে নিজের ভাগ্য নিয়ে সন্তুষ্ট হবার ক্ষমতা রাখত। এই ভাবে হয়ত বয়েই চলত চরম বার্ধক্য পর্যন্ত, যদি না জীবনের পথে ছড়ানো থাকত নানা ধরনের বিপদ আপদ…”।

এই বিপদ কীভাবে এল, তাকে আকাকি আকাকিয়েভিচ বাশ্‌মাচ্‌কিন কীভাবে অতিক্রম করার চেষ্টা করল আর তারপর কীভাবে এক অনতিক্রম্য নিয়তি নির্বন্ধ ও সমাজ সংসারের যৌথ যাঁতাকলে পড়ে তার জীবন আলঙ্কারিক শুধু নয়, আক্ষরিক অর্থেই শেষ হয়ে গেল, ওভারকোট সেই করুণ কাহিনীটি আমাদের শোনায়। গল্পের প্রথমদিকে নিকোলাই গোগল ঈষৎ পরিহাসমিশ্রিত ভাষাভঙ্গীতে আকাকি আকাকিয়েভিচের জীবন বৃত্তান্তটি আমাদের জানিয়ে দেন। এক সরকারী কেরানীর ছেলে ছিল সে। ফটোকপির প্রযুক্তি আসার আগে আপিস আদালতে হাতে লিখে দলিল বা চিঠিপত্র নকল করার কাজ করত যে সাধারণ কর্মচারীরা, সেই কাজেই ঢুকেছিল আকাকি আকাকিয়েভিচ। এই মামুলি কাজটাকে সে অত্যন্ত ভালোবাসত ও অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে দিনের পর দিন এই কাজটা সে করে যেত। এমনকী রাতে এই ভেবে শুতে যেত যে পরদিন আপিসে গেলেই একটা নতুন দলিল নকল করার কাজ সে পাবে। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাকে একবার দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সে কাজে সে উৎসাহ পায় নি, আবার সামান্য নকলনবিশির কাজেই ফেরৎ এসেছিল। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার আমাদের উদ্ধৃত অংশে লেখার পর পরম পরিতৃপ্তিভরে ঘুমোতে যাবার যে প্রসঙ্গ এসেছে তা কোনও সাহিত্যসৃষ্টি বা গবেষণাকর্মর লেখালিখি নয় নয়, নকলনবিশির জীবিকাগত মামুলি কাজ।

আকাকি আকাকিয়েভিচের কোনও কারুবাসনা ছিল না, সম্পদ বা যশের লোভ ছিল না, বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা মশগুল আমোদ প্রমোদেও ছিল না বিন্দুমাত্র উৎসাহ। সাধারণ কাজ ও অল্প মাইনেতে খুশি হওয়া এই যুবকটি কারোর সাতে পাঁচে থাকত না। এই ধরনের মানুষের জীবনে বড় বিপদ আসার কথা নয়। কিন্তু শেষমেষ এলো সেই বিপদ। এই বিপদ আকাকি আকাকিয়েভিচের কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা চরিত্রস্খলনের জন্য আসে নি, এসেছে খানিকটা ভাগ্যদোষে আর অনেকটাই দারিদ্রপীড়িত সমাজকাঠামোর অভিশাপে। সেন্ট পিটার্সবার্গের শীতকালীন প্রবল ঠান্ডা অতিক্রম করার সাধ্য আকাকি আকাইয়েভিচের জীর্ণ ওভারকোটটির আর ছিল না। শত তালি মারা কোটটিকে আর মেরামত অযোগ্য বলে পরিচিত দর্জি পেত্রোভিচ রায় দিয়ে দিয়েছিল। ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে একটি নতুন ওভারকোট বানানো ছাড়া আকাকির গত্যন্তর ছিল না। সমস্যা হয়ে দাঁড়াল নতুন ওভারকোট বানানোর বিপুল দাম, যা দেড়শ রুবলকে ছাড়িয়ে যাবে বলে পেত্রোভিচ জানালেও দরাদরি আর কম সম করে আশি রুবল অন্তত যে হবেই, তা নিয়ে আকাকি আকাকিয়েভিচেরও কোনও সন্দেহ ছিল না। আকাকি আকাকিয়েভিচের কাছে এটা ছিল বিপুল অঙ্ক। চলতি ভাষায় বলতে পারি বাজেটের অনেক বাইরের ব্যাপার। শেষমেষ বহু বছর ধরে কষ্টেসৃষ্টে জমানো চল্লিশ রুবল আর আগামী অনেকগুলো মাস অনেক কৃচ্ছসাধন করে চলার হিসাব নিকাশ করে অবশেষে কোটটি বানানোর কথা যখন সে ভাবছে, সেই সময়ে বড় সাহেবের দেওয়া ষাট রুবল বোনাস তার হাতে এসে গেল। এটা তাকে চরম বিপদের সময় অনেকটাই সাহায্য করল। টাকার সংস্থান হতেই চমৎকার এক ওভারকোট দর্জি পেত্রোভিচ তার জন্য বানিয়ে দিল কিছুদিনের মধ্যে। কোটটি শুধু আকাকিকে ঠান্ডার হাত থেকেই বাঁচালো না, মানুষ হিসেবেও তাকে দিল বদলে। কোটটি গায়ে জড়ানোর পরেই তার মন মানসিকতা গেল বদলে। সে হয়ে উঠল অনেক আত্মবিশ্বাসী। নতুন বাহারী ওভারকোটের দৌলতে তার সামাজিক মর্যাদাও গেল অনেকখানি বেড়ে। সে ওভারকোটের সুবাদে সামাজিক আসরে নিমন্ত্রণ ও এমন খাতির পেতে শুরু করল, যা সে আগে কখনো পায় নি।

যে ওভারকোট তাকে সাধারণ কেরানী থেকে নিজের কাছে এবং পরিচিতবৃত্তে প্রায় এক নায়ক করে তুলেছিল, সেই ওভারকোটটি একদিন হঠাৎ চুরি গেরাল। এক ভোজসভায় নিজের চিরাচরিত সংযম অতিক্রম করে সে কিছুটা শ্যাম্পেন পান করেছিল আর বাড়ি ফেরার পথ ধরতে অনেকটা রাতও করে ফেলেছিল। শোকে আর ক্রোধে অভিভূত আকাকি আকাকিয়েভিচ পুলিশ, প্রশাসন, সরকারী কর্মচারী, গণ্যমান্যব্যক্তিদের দোরে দোরে ঘুরতে শুরু করল ওভারকোটটি উদ্ধার করে দেবার কাতর করুণ আবেদন নিবেদন নিয়ে। কেউ তাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিল না। এমনকী এক গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছে তাকে অকারণে প্রবল অপমানিতও হতে হল। এই অপমান, প্রাণপ্রিয় ওভারকোট হারানোর যন্ত্রণা এবং ভালো ওভারকোট বিহীন সেন্ট পিটার্সবার্গের শীতের ভয়ংকর কামড় সে আর সহ্য করতে পারল না। শোকে দুঃখে ক্রোধে হতাশায় রোগে জর্জরিত হয়ে তার মৃত্যু হল মাত্র পঞ্চাশ বছর পেরোতে না পেরোতেই। ওভারকোট হারানো জীবন হারানোর পরিণতিতে ঠেলে দিল আকাকি আকাকিয়েভিচকে। মৃত্যুর আগে বলা অসংলগ্ন প্রলাপমালায় সে একদিকে ওভারকোট হারানোর বেদনা ও অন্যদিকে আমলাতন্ত্রের নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতার প্রতি ক্ষোভকে প্রকাশকরে যায়।

আকাকির করুণ মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই কিন্তু গোগল এই গল্প শেষ করেন নি। কারণ ব্যক্তি আকাকির ভাগ্যবিড়ম্বনাটুকু দেখানো কেবল তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল রুশ আমলাতন্ত্রের অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতার উন্মোচন। তাই কোট হারানোর পর জনৈক গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছে আকাকির অকারণ লাঞ্চনার বিস্তারিত চিত্র গোগল এই গল্পে তুলে ধরেছিলেন। তিনি যে একজন কেউকেটা এটা তার বন্ধুকে দেখানোর তাগিদে এবং সম্ভবত নিজেও সে গরিমা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার মনোবাসনায় তিনি আকাকি আকাকিয়েভিচকে অনেক্ষণ বিনা কারণে বসিয়ে রাখেন। তারপর দেখা করলেও সম্পূর্ণ অকারণে তার ওপর চোটপাট করে নানা কড়া কথা শুনিয়ে তাকে তাড়িয়ে দেন।

মৃত্যুর পরেও আকাকি আকাকিয়েভিচের অতৃপ্ত আত্মা নাকী হারানো ওভারকোটের শোক ভুলতে পারে নি। কথক জানিয়েছেন সে নাকী রাতের অন্ধকারের অশরীরী আক্রমণ চালিয়ে পথচারীদের ওভারকোট ছিনিয়ে নিতে চাইত। এই ভুতুড়ে ঘটনাবলী পুলিশ প্রশাসন আমলাতন্ত্রের মধ্যে প্রবল আতঙ্ক তৈরি করে। অনেকেই এই ভূতের দ্বারা আক্রান্ত হন। বিশেষ পুলিশি নজরদারীর ব্যবস্থা করেও লাভ কিছু হয় না। সেই অনামা গণ্যমান্য ব্যক্তিটিও একদিন ভূতের খপ্পরে পড়েন। আকাকী আকাকিয়েভিচের প্রেতাত্মা তাঁর ওভারকোটটি ছিনিয়ে নেয়। ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় তিনি কোনওমতে বাড়ি ফেরেন।

গোগল এই গল্প যখন লিখছেন তার বেশ কিছু বছর আগেই ডিসেম্ব্রিস্টদের আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করে রাশিয়ায় নামিয়ে আনা হয়েছিল জার প্রথম নিকোলাই এর চরম প্রতিক্রিয়াশীল শাসন। তখনো অবধি নারোদনিক বা জনগণের বন্ধুশক্তির দেখা মেলে নি, রুশ কমিউনিস্টদেরও আবির্ভাব হয় নি। এমনকী তরুণ মার্কস ও এঙ্গেলস তখনো জার্মানীতে বসে কমিউনিস্ট ইস্তাহার লেখেন নি, যেখানে তাঁরা ইউরোপকে এক ভূতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আতঙ্কের কথা বলবেন, যে ভূত হল কমিউনিজমের ভূত। কমিউনিস্ট ইস্তাহার বর্ণিত এই কমিউনিজমের ভূতের আতঙ্কের কথা আসার আগেই গোগল ওভারকোট গল্পে আনলেন এক সামান্য কেরানির ভূতের কথা, যে ভূত তৎকালীন রুশ রাজধানীর তাবড় আমলাতন্ত্র ও পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।

এই গল্পে গোগল দেখান এক অমানবিক রুশ সমাজকে। দেখান দারিদ্র পীড়িত তলার দিককার সামান্য বেতনের কর্মচারীদের দিন আনা দিন খাওয়া জীবনের কৃচ্ছতা ও যন্ত্রণাকে। ওপরতলার আমলাতন্ত্র ও গণ্যমান্যদের তলার দিকের মানুষ সম্পর্কে নিস্পৃহতা, উদাসীনতা এমনকী ঘৃণার মনোভাবও। শুধু ব্যক্তির মন মানসিকতার সমস্যাকেই এই গল্পে গোগল দেখান নি। ক্ষমতাশালীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সমাজ কাঠামোর অমানবিক নীচ দিকটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন আশ্চর্য মুন্সিয়ানায়। “আমরা সবাই গোগলের ওভারকোট থেকে জন্মেছি” - দস্তয়েভস্কি গোগলের এই গল্পটি মনে রেখে সত্যিই এমন বলেছিলেন কীনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে গোগলের আঁকা করুণ সমাজ বাস্তবতা যে দস্তয়েভস্কি, চেকভ সহ অনেক বিশিষ্ট রুশ কথাসাহিত্যে নির্মাণে সহায়ক হয়েছিল, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।