নাসিকাপুরাণ : গোগল ও আকুতাগাওয়ার দুটি ছোটগল্পের পাঠ

এক যে ছিল জাপানি পুরুত, নাম তার জেনচি নাইগু। নাকখানা তার ইয়া লম্বা, আড়েবহরে যেন দিব্যি একখানা হৃষ্টপুষ্ট সসেজটি। সারাজীবন এই নাক নিয়েই তিনি মহা বিব্রত। লোকে ফিসফাস মশকরা করে। এমন গুজবও চালু আছে, অমন মনুমেন্টের মতো নাক যার, তার কস্মিনকালেও ঘরণী জুটবে না— এ ধ্রুবসত্য জেনে ফেলেই নাকি নাইগু সব ছেড়েছুড়ে মানে মানে যাজকত্বটি বরণ করে নিয়েছেন। নাইগুর সমস্যা সত্যিই বেশ ঘোরালো। ইঞ্চি ছয়েকের এই লম্বা নাকখানা নিয়ে কম নাকাল হন না জেনচি নাইগু। তিনি খেতে বসলে শিষ্যদের কাউকে এসে চিমটে দিয়ে তাঁর নাকখানা তুলে ধরে রাখতে হয় নয়তো সে নাক নাকি ডুবে যেতে পারে খাবারে! নাক ছোট করার যাবতীয় টোটকা জড়িবুটি তিনি পরখ করে দেখেছেন। সেদ্ধ চিচিঙ্গের ক্কাথ গিলে খেয়েছেন, ইঁদুরের হিসিতে নাক ঘষে এসেছেন। ফল লবডঙ্কা। নাইগুর নাক যেন অজেয় অমর অক্ষয় পরমায়ু নিয়ে এসেছে এ ধরাধামে।

একদিন তাঁর এক শিষ্য একজন চীনা ডাক্তারের থেকে শিখে এল এক অভিনব চিকিৎসাপদ্ধতি। নাকখানা সেদ্ধ করে তাকে পায়ে মাড়িয়ে দিতে হবে! বেশ নির্ঝঞ্ঝাট সহজ উপায় বটে! অনেক কসরত করে মুখ বাঁচিয়ে স্রেফ নাকটুকু সেদ্ধ করা হল, এক শিষ্য আচ্ছা করে পায়ে দললেন গুরুদেবের নাকখানা। নাইগুর অবশ্য ব্যথাবেদনার বালাই নেই। উল্টে তাঁর দিব্যি আরাম লাগছে। একসময় তাঁর নাকের ওপর দেখা দিল খুদে খুদে শস্যদানার মতো গুঁড়ি গুঁড়ি ফোসকা, অচিরেই তাঁর নাকখানা হয়ে গেল ঠিক যেন এক ছালছাড়ানো রোস্টেড পাখির মতো। এইবার নাকি চিমটে দিয়ে ফোসকাগুলো আলাদা করার পালা। তারপর আবারও একদফা নাকসেদ্ধ হল। আশ্চর্যের বিষয়, এবার যেন সত্যিই নাকটাকে বেশ একটু ছোটই লাগছে। স্বাভাবিকত্ব ফিরে পেয়ে নাইগুর খুশি হওয়াই স্বাভাবিক ছিল বটে, কিন্তু এতদিনের সঙ্গী সেই ঠোঁটের ছ’ইঞ্চি নীচ পর্যন্ত ঝুলে থাকা নাসিকাপ্রবরটিকে তিনি যেন একটু একটু মিস করছেন! বারবার ভুলে হাত চলে যায় নাকের কাছে, ঝুলে থাকা বাড়তি অংশটুকুর অভাব যেন আজ বড় বিষম লাগছে। দুটো দিন কাটল, ছোট নাকে নাইগু মোটামুটি ধাতস্থ হলেন। তিনদিনের দিন বাধল বিরাট গোলযোগ। যে-ই দেখে নাইগুকে, সেই হেসে অস্থির। এতদিন নাইগু অস্বাভাবিকত্বই সকলের কাছে এতবেশি স্বাভাবিক ছিল, আলাদা করে সেটি কারওর চোখেই পড়ত না। এখন হঠাৎই সেই অস্বাভাবিকত্ব ঘুচে যাওয়ায় নাইগুর স্বাভাবিক নাকটাই হয়ে উঠেছে তার ব্যক্তিত্বের মূল আকর্ষণ। আর হাসি-ঠাট্টা? লেখক আকুতাগাওয়া বলছেন, মানবহৃদয় বড়ই জটিল। একজন অসহায় জনমদুখী মানুষের জন্য অন্যরা সহমর্মিতাবোধ করে ঠিকই, কিন্তু যদি সেই মানুষটির ভাগ্যের চাকা হঠাৎ ঘুরে যায়, রাতারাতি মানুষটি যদি অসহায়ত্বের কবল থেকে বেরিয়ে এসে অন্যদের পাশেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ায়, সেইটি যে কোনওমতে সহ্য করা যায় না! প্রসঙ্গত মনে পড়ল, রাজকুমার হিরানি পরিচালিত ‘থ্রি ইডিয়টস’ মুভিটির কথা। ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। তিনবন্ধুর মধ্যে দু’জন ফেল করতে করতে বেঁচে গেছে, কিন্তু একজন হয়ে গেছে ক্লাস টপার। মাধবনের সেই যুগান্তরকারী ডায়লগ, ‘বন্ধু যদি ফেল করে, দুঃখ হয়। কিন্তু বন্ধু যদি ফার্স্ট হয়ে যায়, আরও আরও আরও বেশি দুঃখ হয়!’

নাইগুর সৌভাগ্যে আশেপাশের লোকজনের চোখ টাটিয়েছিল। অবধারিতভাবে নাইগুর ব্যবহার গেল বদলে। তার মেজাজ হল তিরিক্ষি। তা দেখে লোকের মনে অসন্তোষ বাড়ল বই কমল না। যে যেভাবে পারছে তাঁকে উত্যক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাগালেই যে রাগে, তাকে রাগাতে মজা তো লাগবেই। দেখা গেল, যে লম্বা কাঠের চিমটে দিয়ে খাবার সময় তাঁর লম্বা ঝুলে পড়া নাক তুলে ধরা হত, সেইটি দিয়ে এক দুষ্টু শিষ্য কুকুরকে খোঁচাচ্ছে আর নাইগুকে শুনিয়ে বলছে, ‘হুঁঃ হুঁঃ কেমন মজা! আর আমার নাকে হাত দিতে পারবে না!’ দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে নাইগু দিয়ে বসল ছেলেটিকে এক ঘা! নাইগু আর পারে না এ ছোট নাকের বোঝা বইতে। এ স্বাভাবিকত্ব যে বড়ই অস্বাভাবিক ঠেকছে।

এরপর এক রাতে ঘটল এক আজব ব্যাপার। সেদিন সূর্য অস্ত যাওয়ার পর হঠাৎই হাওয়ার জোর গিয়েছিল বড্ড বেশিরকম বেড়ে। ঠান্ডায় বুড়ো নাইগুর ঘুম আসেনা, তার বালিশে পর্যন্ত এসে পৌঁছচ্ছে ঝোড়ো হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ। হঠাৎ তার নাকখানা বেশ কুট কুট করতে লাগল। অন্ধকারেই হাত দিয়ে ছুঁয়ে বুঝল নাকটি কিছুটা ফুলে গেছে এবং ফোলা নাক যেন কিছুটা গরমও। মনে হচ্ছিল শুধুমাত্র শরীরের এই অংশটিই যেন জ্বরে আক্রান্ত। নাক ছোট করতে এতসব কাণ্ড হল, হয়তো এ তারই সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভেবে নাইগু পড়ল ঘুমিয়ে।

অভ্যাসমতো পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতেই নাইগু দেখল মন্দিরের গিঙ্কো এবং হর্সচেস্টনাট গাছের সব পাতা রাতারাতি ঝরে পড়েছে, মন্দির চত্বরে যেন কেউ এক উজ্জ্বল সোনালী কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে। প্যাগোডার চূড়োয় জমা তুষারে সূর্যের আলো পড়ে  ন'রিংযুক্ত শিখাটি ঝিকমিক করছে। সকালের এই পবিত্র বিশুদ্ধ হাওয়ায় জেনচি নাইগু বুক ভরে গভীর শ্বাস নিল। আর তখনই এ ক’দিনে প্রায় ভুলতে বসা একটি আজন্মকাল লালিত একটি অনুভূতি যেন আবার ফিরে এল। দ্রুত নাইগু-র হাত পৌঁছল তার নাকের কাছে। সে জায়গায় ফিরে এসেছে তার আদি ও অকৃত্রিম সেই পুরনো নাকটি, যা আগের মতোই ঠোঁটের ইঞ্চিছয়েক নীচ পর্যন্ত ঝুলে আছে। মাত্র এক রাতের মধ্যেই যে তার নাক আবার আগের মতোই লম্বা হয়ে গেছে, এটি বুঝতে পেরে নাইগু ভারী খুশি হল, ঠিক যেমনটা হয়েছিল প্রথমবারের জন্য যখন তার নাক ছোট হয়েছিল। ‘যাক, এখন তো কেউ আর আমায় নিয়ে হাসবে না’, নাইগু নিশ্চিন্তে পরম আরামে তার লম্বা নাক ভোরের শরতের হাওয়ায় দোলাতে থাকল।

আকুতাগাওয়ার এই গল্পটি লেখা হচ্ছে ১৯১৬-তে। তারও অনেক অনেক আগে, ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে নিকোলাই গোগোল লিখেছেন নাক নিয়ে নাকাল হওয়ার আরেক মুখরোচক গল্প। গোগোলের অন্যান্য ছোটগল্পগুলির মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত গল্প ‘The Nose’। গল্পটি তিনটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশে শহরের এক নাপিত ইভান নিজের পাঁউরুটিতে তার খদ্দের মেজর কভালিয়ভের নাক পায়। নাকটা চুপিচুপি ফেলতে গিয়ে সে বমালসুদ্ধু ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। দ্বিতীয় অংশে দেখা পাওয়া যায় মেজর কভালিয়ভের। মেজর কভালিয়ভ একজন মহা আতম্ভরী, উন্নাসিক, দাম্ভিক মানুষ। তার নাকটি খোয়া যেতে যেন তার গোটা অস্তিত্বখানাই বেমালুম হাপিশ হওয়ার জোগাড়। আসলে এই নাকই ছিল তার যাবতীয় উন্নাসিকতার উৎস। নিজেকে সে অনেক বড় কিছু হিসেবে দেখানোর ভান করত, আর সেইসঙ্গে ছিল উল্টোদিকের মানুষজনকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখার স্বভাব। কিন্তু এখন কভালিয়ভের নাক যে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে সরকারি উর্দি চাপিয়ে। কভালিয়ভের নাক তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এক সত্তা হয়ে গিয়েছে। এখন নাকই সর্বেসর্বা, কভালিয়ভের মূল্য কানাকড়িও নয়। কভালিয়ভ আপ্রাণ চেষ্টা করছে নাক ব্যাটাকে ধরতে, কিন্তু সে তো আদতে কভালিয়ভেরই নাক! চাতুর্যে খোদ কভালিয়ভকেও টেক্কা দেওয়ার এলেম রাখে। বারেবারে তার চোখে ধুলো দিয়ে নাক পালাচ্ছে, কিছুতেই তার নাগাল পাচ্ছে না কভালিয়ভ। পেপারে হারিয়ে যাওয়া নাকের বিজ্ঞাপন দিতে গেল কভালিয়ভ, সংস্থার পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপন নেওয়াই হল না। শেষমেশ পুলিশ তার নাক এনে দিল বটে, কিন্তু জোড়া আর লাগাতে পারেন না ডাক্তারবাবু। কভালিয়ভ ভাবল, এ নিশ্চয়ই সেই বুড়ির কাজ, যে ওর মেয়ের সঙ্গে কভালিয়ভের বিয়ে দিতে চায়। কভালিয়ভ বিয়ে করতে চায় না বলে হয়তো বুড়ি জাদু করেছে। বুড়িকে সে চিঠি লিখল। বুড়ি কিন্তু চিঠির মানে উল্টো বুঝল, সে ভাবল কভালিয়ভ বুঝি তার মেয়েকে প্রোপোজ করেছে। বুড়ির উত্তর পড়ে কভালিয়ভ বুঝল, বুড়ি নির্দোষ। এদিকে শহর জুড়ে কভালিয়ভের নাক নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে। লোকজন বিনোদনের নতুন খোরাকও পাচ্ছে। গল্পের তৃতীয় এবং শেষ অংশে দেখা গেল, কভালিয়ভের নাক যথাস্থানে ফিরে এসেছে। নাক হারিয়ে কভালিয়ভ যে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছিল, তাও দিব্যি সে কাটিয়ে উঠেছে। গোগোলের এই গল্পের প্লট আপাতদৃষ্টিতে খুবই সহজ, সরল। অতি সাধারণ সব মানুষ এবং তাদের আপাত সাধারণ জীবনযাপন, কিন্তু সেখানে যখন হঠাৎই এক আকস্মিকের অনুপ্রবেশ ঘটে তখন পূর্ব প্রতিষ্ঠিত সামাজিক তথা বিশ্বাসের কাঠামোটা সম্পূর্ণ ভেঙেচুরে যায়।

বাংলায় ‘নাক’ নিয়ে এক চলতি বাগধারা আছে না? ‘পরের ব্যাপারে নাক গলানো’, যার অর্থ হল অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে অনধিকার চর্চা। ধারণাটি কেবল বাংলা সংস্কৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। অন্যান্য দেশের ভাষাতেও প্রায় এই ধরনের অভিব্যক্তি পাওয়া যায়, যেখানে নাক অনধিকার চর্চার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইংরেজিতে "keep your nose out of it" বা "nosy" কথাগুলি এমন একজন ব্যক্তিকে বোঝায়, যিনি অন্যের বিষয়ে অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ করছেন। জাপানি সংস্কৃতিতেও অন্যের ব্যাপারে ‘নাক গলানো’ জাতীয় ইডিয়মের ব্যবহার রয়েছে, যদিও এটি কিঞ্চিৎ ভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়। জাপানি ভাষায় ইয়াজিউমা (野次馬) শব্দটি ব্যবহৃত হয়, যার আক্ষরিক অর্থ ‘Spectator Horse’, কিন্তু এটি এমন একজন ব্যক্তিকে বোঝায় যিনি অন্যের ব্যাপারে অযথা কৌতূহল দেখান বা নিজের এক্তিয়ারের বাইরের বিষয়ে মতামত দিতে বড্ড ভালোবাসেন। এটি কিন্তু "অন্যের ব্যাপারে নাক গলানো"-র ধারণার সাথে হুবহু মিলে যায়।

গোগোল এবং আকুতাগাওয়ার গল্পদুটির আপাতদৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় মিল যেটি চোখে পড়ে, তা হল, দুজনেরই গল্পের কেন্দ্রবিন্দু নাক। তবে বিষয়বস্তু, উপস্থাপনা, প্রেক্ষাপট সবই আলাদা। গোগোলের গল্পটির প্রেক্ষাপট উনিশ শতকের রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ। তৎকালীন রাশিয়ান সমাজ এবং উচ্চপদমর্যাদার প্রতি জনসাধারণের মোহকেই প্রতিফলিত করে। গল্পটি স্যাটায়ারধর্মী, নাকের রূপকের আড়ালে রাশিয়ান সামাজিক স্তরবিন্যাসের সমালোচনাই সেখানে মুখ্য বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। আকুতাগাওয়ার গল্পটি মধ্যযুগীয় জাপানের প্রেক্ষাপটে নির্মিত। গল্পটিতে জাপানি মূল্যবোধ, বৌদ্ধ দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে। গোগোলের গল্পে মেজর কভালিয়ভ নিজের নাক নিয়ে গর্বিত, তাঁকে দুনিয়ার তামাম নাকউঁচু মানুষদের প্রতিনিধি বলা যেতেই পারে। অন্যদিকে আকুতাগাওয়ার গল্পের জেনচি নাইগু নিজের লম্বা নাক নিয়ে যারপরনাই বিব্রত ছিলেন। তিনি চাইতেন না, স্রেফ একটি শারীরিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই লোকে তাঁকে আলাদা করে দেখুক। গোগোলের গল্পটি অবাস্তব, অতিরঞ্জিত। তা যে আসলে রূপকধর্মী  স্যাটায়ার, গল্পের শুরুতেই মালুম হয়ে যায়। তুলনায় আকুতাগাওয়ার গল্পটি অতিরঞ্জিত নয়। বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলি দিয়েই তো সৌন্দর্যের বিচার চলে আসছে আদি অনন্তকাল ধরে। শারীরিক খুঁত খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, তা নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে ভোগা মানুষের সংখ্যাও অগুন্তি। তবে, সেই ‘খুঁত’টিকে ‘খুঁত’ হিসেবে না দেখে একান্তই স্বাভাবিকের পর্যায়ে ফেলতে পারা মানুষ সত্যিই বিরল।