নিকোলাই গোগল ও তাঁর 'রেভিজোর' - 'দ্য গভর্নর জেনারেল'

১৮৩৬ সালের ১৯ এপ্রিল। সেন্ট পিটার্সবার্গের ভরা থিয়েটার হল। এক নতুন নাটকের অভিনয় দেখতে হল সেদিন কাণায় কাণায় ভর্তি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল দর্শকাসনের প্রথম সারিতে মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন রাশিয়ার দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্রাট, জার প্রথম নিকোলাস (Николай I Павлович) স্বয়ং। শুরু হল নাটক। নাটক চলাকালীন দর্শকরা হেসে কুটিপাটি। সে হাসির উৎস রুশ আমলাতন্ত্র সম্পর্কে ভয়ানক ব্যঙ্গবিদ্রুপ। জার প্রথম নিকোলাস এর বিদ্রুপের মর্মার্থ বুঝেছিলেন। উপলব্ধি করেছিলেন যে আমলাতন্ত্রকে তরুণ নাট্যকার নিশানা করেছেন তার মাথা তিনি স্বয়ং। তাও তিনি কূপিত হন নি। বরং নাটকটি শেষ পর্যন্ত উপভোগ করেছিলেন। আর তারপর তার পাত্র মিত্র সভাসদ আমলাকুলকে বলেছিলেন নাটকটি দেখতে।

এই অভিনয়ের মধ্যে দিয়েই রুশ সাহিত্য আকাশে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলেন এর নাট্যকার নিকোলাই গোগল (Николай Гоголь) । আর নাটকের নাম রেভিজোর (Ревизор) শব্দটি (ইংরাজী অনুবাদে The Government Inspector/ The Inspector General) রুশ সমাজ সংস্কৃতিতে চিরায়ত মর্যাদা পেয়ে গেল। গোগল কিন্তু মহৎ সাহিত্যিকের মতো তাঁর এই খ্যাতিতে সন্তুষ্ট না থেকে নাটকটির পরিমার্জন চালিয়েই গেলেন। পরিমার্জন করা শেষ হয় ১৮৪২ সালে। প্রায় আট বছর ধরে নির্মাণ করা দ্য গভর্নমেন্ট জেনারেল বা দ্য ইনস্পেক্টর জেনারেল এখন বিশ্বসাহিত্যের এক চিরায়ত ক্লাসিক হিসেবে পরিগণিত হয়।

রুশরা আমাদের বাঙালিদের মতোই থিয়েটারপ্রেমী মানুষ। আমাদের সবারই জানা আছে বাংলায় ইউরোপীয় ঘরানার থিয়েটারের সূত্রপাতটা হয়েছিল এক রুশ মানুষেরই হাত ধরে। সেই ১৭৯৫ সালে ২৭ নভেম্বর, সিনেমা শিল্পের জন্মের ঠিক একশো বছর আগে, হেরাসিম লিয়েবেদিয়েফ নামে একজন কলকাতায় দুই সন্ধ্যায় দুটি থিয়েটারের অভিনয় করান। শুরু হয় বাংলা থিয়েটারের পথচলা।

ফিরে আসা যাক গোগলের রেভিজোর বা গভর্মেন্ট ইন্সপেক্টরের কথায়। জার প্রথম নিকোলাসের আমলে যে বজ্রকঠিন সেন্সরসিপ চালু ছিল তাতে এই নাটকের অনুমোদন পাওয়া কঠিন বলেই মনে হয়েছিল। তবে অনুমোদন পাওয়া গেল আর অভিনয় জারের প্রশংসাও কুড়োল। তবে তাতে নাটকের বিরূপ সমালোচনা আটকায় নি। যেকোনোও নতুন সাহিত্য সৃষ্টির মতোই এই নাটকও নানান বিরুদ্ধ মতের সম্মুখীন হয়। সরকারি আমলাতন্ত্রের পক্ষ থেকে নাটকটিকে অবাস্তব, রূঢ়, ভালগার, চর্বিতচর্বণ, অতি মাত্রায় নাটকীয় ইত্যাদি নানান বিশেষণে ভূষিত করা হয়।   

তা সত্ত্বেও, একজন রাশিয়ানের কাছে দ্য গভর্নমেন্ট জেনারেল বা দ্য ইনস্পেক্টর জেনারেল এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এই কমেডিকে শুধু সাহিত্যিক গুণে বিচার করলে যেন কিছুই বলা হয় না। রাশিয়ান কমেডি কেমন হতে পারে, সেই ধারণা ভেঙ্গে দিয়েছে দ্য গভর্নমেন্ট জেনারেল। মজার ছলে দেশের উচ্চতর থেকে শুরু করে নিচের প্রতিটি স্তরের আমলাতন্ত্রকে বিদ্রুপ করা হয়েছে এই নাটকে। ভিতর থেকে ফাঁপা হয়ে যাওয়া একনায়ক রাশিয়ান সরকার হয়ে উঠেছে এই নাটকের মুখ্য চরিত্র। নাটকটি দেখতে দেখতে সাধারণ মানুষ বারেবারে হেসে ফেলে, কিন্তু সেই হাসি আসলে এক চরম অব্যবস্থা দেখেই আসে। তাই হাসির পিছনে থাকে অসহায় রাগ ও দুঃখ। আর ঠিক সেই কারণেই সাধারণ রাশিয়ান জনমানসে এর জোরালো অভিঘাত এই নাটকটিকে করে তুলেছে অনন্য। রেভিজোর জথাটি রুশ লব্জে প্রবাদে পরিণত হয়েছে।

রাশিয়ান জারতন্ত্রে শুধু একা জার স্বৈরাচারী নন। দেশের প্রতিটি ছোট ছোট শহরেও এক একটি স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র গড়ে উঠেছে। সেখানেও সেই একনায়ক নিজের মর্জি মতন শহর শাসন করেন। তাঁর তৈরি নিয়মকানুনই সাধারণ মানুষ মেনে চলতে বাধ্য হয়। আর ক্ষমতার এই একছত্র আধিপত্য সমস্ত সমাজ ব্যবস্থাকে পরতে পরতে দুর্নীতিগ্রস্থ করে তুলেছে। ক্ষমতার অলিন্দে অবস্থানকারী প্রতিটি ব্যক্তি খোলাখুলি ঘুষ নেন বা নিজের ইচ্ছে মতন আইনকে বাঁকিয়ে চুরিয়ে নিতে পারেন। এমনকি ঘুষ দেওয়া-নেওয়াটা যে কতোটা সহজ ও স্বাভাবিক একটা ব্যাপার তার পক্ষে মতামতও দিয়ে থাকেন তাঁরা। আর ঠিক এই মানসিকতার সুযোগ নেওয়ার মতন লোকেরও অভাব হয় না। 

দ্য গভর্নমেন্ট জেনারেল নাটকটি শুরু হয় এরকমই এক অরাজক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে। এক ছোট শহর। নাটকে শহরের নাম উল্লেখ করা নেই। হয়তো এই অরাজক অব্যবস্থা যে প্রতিটি শহরেরই চিত্র, তা বোঝানোর জন্যই নাটকের ঘটনাস্থল হিসেবে বর্ণিত শহরের কোনও নাম নেই। সেই শহরের গভর্নর থেকে শুরু করে বিচারক, ডাক্তার, পুলিশ, প্রতিটি সরকারি আধিকারিক আপদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত। চরম অব্যবস্থাই এই শহরের চালু ব্যবস্থা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত এই ছোট্ট শহরে হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসা হয় না ঠিক মতন। তাঁদের পোশাক নোংরা আর গোটা হাসপাতালের পরিবেশটাই নিতান্ত অস্বাস্থ্যকর ও অপেশাদার। সরকারি আধিকারিকের যুক্তি রোগীকে দামি ওষুধ দেওয়ার কোনও মানে হয় না। যে সেরে ওঠার সে এমনিতেই সেরে উঠবে। এখানে আদালতের অবস্থাও নিতান্ত করুণ। অব্যবস্থা ও অপরিচ্ছন্নতা প্রকট। সবটাই এতো খুল্লামখুল্লা যে সবাই সবকিছুই জানেন, কিন্তু এই অন্যায় বা দুর্নীতির জন্য কাউকে জবাবদিহি করার কথাও যেন কেউ ভাবেন না।

“Нет ни одного человека, который не имел бы грехов, за которые пришлось бы отвечать. Так Бог создал мир…”

(‘There isn’t a man living who hasn’t some sins to answer for. That’s the way God made the world…’)

স্বয়ং গভর্নর মনে করেন একটু আধটু ঘুষ, দমন, হুমকি, এসব অন্যায় কিছু না। পৃথিবীটা যদি দুর্নীতি মুক্ত হওয়ারই হতো, তাহলে ঈশ্বর পৃথিবীকে সেভাবেই বানাতেন! ভলতেয়ারপন্থীরা যতই মনে করুন না কেন যে, কেউই, এমন কী ঈশ্বরও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নন, গভর্নর জানেন সেসব বলে কিছুই হবে না।     

তবে এই অব্যবস্থা ঠিক যেন শান্তিতে নেই। খবর এসেছে যে পরিচয় গোপন করে একজন সরকারি পরিদর্শক আসছেন শহরের সব ব্যবস্থা পরিদর্শন করার জন্য। এই খবরে শহরের উচ্চতম শাসক থেকে শুরু করে আমলাতন্ত্রের সবাই ভয় পাচ্ছে। তাদের মধ্যে নেই কোনও অনুতাপ, বরং তাঁরা ব্যস্ত কীকরে সব অন্যায়, অব্যবস্থা আর দুর্নীতিকে ধামাচাপা দেওয়া যেতে পারে। অন্যায় বা দুর্নীতি কেন হয়েছে সেই প্রশ্ন করে না কেউ, বরং সবাই চাইছে আপাতত কীকরে এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। দেশের উচ্চতর মহলে যেন তাঁদের দুর্নীতির খবর পৌঁছে না যায়, তার জন্য গভর্নরের বাড়িতে বসেই নানান ফন্দি আঁটতে লেগে যায় সবাই।

শহরের ব্যবসায়িমহল সরকারি দমন পীড়নে অসন্তুষ্ট। গভর্নর সেকথা জানেন। তিনি সন্দেহ করছেন হয়তো সেই কারণেই সরকারি পরিদর্শক আসছেন। তাই তিনি পোস্টমাস্টারকে অনুরোধ করছেন যে সম্ভব হলে লুকিয়ে লুকিয়ে সব চিঠি যদি একটু দেখে নেওয়া যায়! মানে শহরের আধিকারিকদের বিরুদ্ধে উপরমহলে কেউ কিছু জানাতে চায় কিনা সেটা আগাম জানতে পারলে তো আধিকারিকদের সবার জন্যই ভালো, তাই না! পোস্টমাস্টার জানান যে এই কাজটা তিনি ইতিমধ্যে করেই থাকেন। বিশেষ কিছু না, এই একটু দুনিয়ায় কোথায় কী চলছে সেটা জানার নিস্পাপ আগ্রহেই এই কাজটি করে থাকেন তিনি।

হাস্যকর বিষয় এটাই যে সরকারি পরিদর্শক যে পরিচয় গোপন রেখে শহরে এসে উপস্থিত হয়েছে সেই খবরটাও গভর্নরের কাছে এসে পৌঁছায় তাঁর চামচাদের মাধ্যমে। নাটকে এই চামচাদের বিশুদ্ধ জোকার ছাড়া আর কিছু মনে হবে না। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে নাটকের বাকি চরিত্ররাও আসলে হাসির খোরাক মাত্র। দুঃখ এখানেই যে এঁদের কার্যকলাপে দর্শকের মুখে যে হাসি ফোটে তা মিলিয়ে যেতে সময় লাগে না। একটু পরেই সেই হাসি মিলিয়ে গিয়ে এক অসহায় রাগ জেগে ওঠে মনে।

নাটক ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে। দেখা যায় যাকে সমস্ত আধিকারিকরা সরকারি পরিদর্শক ভাবছেন তিনি আসলে একজন ছোটখাটো সরকারি কেরানি। তাঁর নাম ক্লিবনিকোভ। ব্যক্তিগত চাকরকে সঙ্গে নিয়ে এই শহরে এসেছেন। জুয়া খেলে সব টাকা উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। তাই তাঁর হাত খালি। আপাতত শহরের এক হোটেলে আছেন তিনি। তবে টাকা না দিতে পারায় না খেয়ে থাকছেন। তাতে অবশ্য তাঁর ঠাটবাট বা হম্বিতম্বি কিছু কম হয় নি। এমন পরিস্থিতিতে গভর্নর তাঁর দলবল নিয়ে হাজির হলেন। বিগলিত চিত্তে তিনি জানতে চাইলেন সমস্ত কুশল কীনা! ক্লিবনিকোভ প্রথমে একটু ভয় পেলেও দ্রুত সামলে নিলেন। জানালেন আপাতত একটু আর্থিক টানাটানি চলছে তাঁর। ঘুষ দেওয়া নেওয়ায় অভ্যস্ত গভর্নরের ইঙ্গিত বুঝতে ভুল হলো না। তিনি এই সুযোগে টাকা ধার দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করতেই ক্লিবনিকোভেরও সময় লাগল না সেই প্রস্তাবে সায় দিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিভিন্ন সরকারি আধিকারিক ক্লিবনিকোভকে টাকা দিলেন। অবশ্য এই অর্থের বিনিময় সবই হলো ধার হিসেবে। তাতে ঘুষ দেওয়াও হলো, আবার ভদ্রতার মুখোসও অটুট রইলো। সাপও মরল, আবার লাঠিও ভাঙল না; সবারই মুখ রক্ষা হলো। টাকা ধার দিয়ে আধিকারিকরা এবার একটু স্বস্তি বোধ করতে শুরু করলেন যে ঘুষ নেওয়ার পর ক্লিবনিকোভ আর হয়তো তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করবেন না।

গভর্নর ক্লিবনিকোভকে খুশি করার জন্য তাঁকে তাঁর নিজের বাড়িতে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। এবার ক্লিবনিকোভও স্বস্তি পেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে ভুল করে সবাই তাকে উচ্চপদস্থ সরকারি পরিদর্শক ভেবেছে। এরপর নাটকের বাকি অংশে এরকমই নানান সরকারি আধিকারিক এক বা একাধিক বার ধার হিসেবে ক্লিবনিকোভকে টাকা দিলেন। আর তিনিও যথা শীঘ্র সম্ভব ফেরত দেওয়ার কথা বলে সেসব আত্মসাৎ করলেন। শুধু সরকারি আমলা বা আধিকারিক না, গভর্নরের উপর ক্ষুব্ধ ব্যবসায়িরা অভিযোগ জানাতে এলে তাঁদের থেকেও টাকা আদায় করলেন ক্লিবনিকোভ। ব্যবসায়ী সমিতি ক্লিবনিকোভের কাছে আসে শহরের আমলাতন্ত্রের অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকেই ঘুষ দিতে বাধ্য হয় তাঁরা।   

গভর্নরের স্ত্রী ও তাঁর মেয়ের মধ্যেও এক অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা যে কে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছেন ক্লিবনিকোভের। গভর্নরের স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে ফ্লার্ট করে শেষ পর্যন্ত ক্লিবনিকোভ গভর্নরের মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। আর সবাই তাতে সানন্দে রাজিও হয়। হবে নাই না কেন! যতই দুর্নীতিগ্রস্থ হন না কেন, আদতে তো ক্লিবনিকোভ এক উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা! আর তিনি ধনীও বটে!

ক্লিবনিকোভ যখন বুঝতে পারেন যে তাকে সবাই সরকারি পরিদর্শক হিসেবে ভুল করেছে তখন তিনি তাতে বেশ আমোদিত বোধ করেন। একটি চিঠিতে এক বন্ধুকে তিনি পরিস্থিতি বর্ণনা করেন আর তাঁর চাকর সেই চিঠি পোষ্ট করে দেয়। এরপর ক্লিবনিকোভ পিঠটান দেন শহর থেকে। যাওয়ার আগে অবশ্য গভর্নরের কাছ থেকে আরও কিছু টাকা ধার নিতে ভোলেন না তিনি। নাটকের শেষ দিকে এই চিঠিই পোস্টমাস্টারের হাতে গিয়ে পড়ে। আর তখনই এই রহস্যের পর্দা ফাঁস হয়। শহরের সব আধিকারিক জানতে পারেন যে তাঁরা বোকা বনেছেন ক্লিবনিকোভের কাছে। ঠিক এই সময়ই সরকারিভাবে সবাই জানতে পারেন যে একজন সরকারি পরিদর্শক শহরে এসে উপস্থিত হয়েছেন আর তিনি সমস্ত কাগজপত্র দেখতে চান। নাটকটি এখানেই শেষ হয় সকলকে চরম অপ্রস্তুত অবস্থায় রেখে।  

স্যাটায়ারের তীব্র ব্যবহারে দ্য গভর্নমেন্ট জেনারেল বা দ্য ইনস্পেক্টর জেনারেল নাটকটি যেমন রাশিয়ান জনমানসে এক অনন্য স্থান দখল করে আছে, তেমনই এর এক বিপরীত দিকটিও সমালোচকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি। নিকোলাই গোগোল আমলাতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রকে অপছন্দ করলেও সিস্টেমকে প্রশ্ন করেন নি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতায় বিশ্বাসী গোগোল সমাজের দায়ভার সমাজের প্রতিটি ব্যাক্তির উপরেই চাপিয়ে দিয়েছেন। তিনি প্রতিষ্ঠানগতভাবে একনায়কতন্ত্র বা আমলাতন্ত্রের কোনও ত্রুটি দেখেননি। তাঁর মতে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি ব্যক্তি যদি নীতির প্রশ্নে সঠিক আচরণ করেন তাহলে সমাজটাও ভালোভাবে চলবে। ত্রুটিপূর্ণ সমাজ যে ব্যক্তি মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত হতে উৎসাহিত করতে পারে, ফল স্বরূপ সমগ্র সমাজব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি বাসা বাঁধতে পারে, তা যেন গোগোলের চিন্তা জগতের ভিতরে আসার সুযোগ পায় না। ফলে দ্য গভর্নমেন্ট জেনারেল বা দ্য ইনস্পেক্টর জেনারেল নাটকটি সামাজিক বার্তার বদলে এক নীতিগত বার্তাবাহী নাটকে পর্যবসিত হয়। যেন নাটক দেখে মানুষ নিজেকে শুধরে নিলেই সমাজ শুধরে যাবে, সমাজ ব্যবস্থার এই নাটক থেকে শিক্ষা নেওয়ার কিছু নেই।   

এতো কিছুর পরেও দ্য গভর্নমেন্ট জেনারেল বা দ্য ইনস্পেক্টর জেনারেল নাটকটি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আর সেটি সামাজিক বার্তা দেওয়ার কারনেই। হাস্য ব্যঙ্গ রসের আড়ালে তৎকালীন রাশিয়ার সরকারি ক্ষেত্রে প্রতিটি স্তরের দুর্নীতি বর্ণিত হয়েছে এই নাটকে। মানুষের লোভ, আর অসৎ সরকারি আধিকারিকদের নাটক দেখে দর্শকের ঠোঁটে যে হাসি ফুটে ওঠে সেই হাসির পিছনে এক অসহায় রাগ, দুঃখ, কষ্টের অনুভূতিও যেন গলায় দলা পাকিয়ে ওঠে। 

আজ আমরা নিজেদের দেশের বা রাজ্যের যেদিকে তাকাই সেখানেই দুর্নীতির কালো ছায়া দেখতে পাই। খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতন ন্যূনতম প্রয়োজনের ক্ষেত্রেও পরিকাঠামোগত দিক থেকে যে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে তা বোঝার জন্য বিশেষ কষ্ট করতে হয় না। সামাজিক অন্যায় নির্বিঘ্নে ঘটে চলে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। যা দেশের আমলাতন্ত্রের দুর্নীতিকে আরও পাকাপোক্ত করে তোলে। আজ অসুস্থ হলে সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার কথা ভাবতে কষ্ট হয়। সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। এমনকী সরকারি পরিবহন ব্যবস্থাও ধীরে ধীরে বিলুপ্তপ্রায়। ধনের অসমবন্টন সাধারণ মানুষের জীবনকে করে তুলেছে অসহনীয়।

আমাদের চারপাশে ঘটে চলা সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও চাপানউতোরে মাঝেমাঝে হাসি পেলেও সেই হাসি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এক অবোধ রাগ আর দুঃখ কষ্টের মিশেল আমাদের অবশ করে দেয়। আমাদের চারপাশের রাজনৈতিক নাটক দেখে ব্যক্তি আমরা হেসে ফেলি আবার এই ব্যক্তি আমরাই রেগে উঠি, দুঃখ পাই। কিন্তু সমাজ কি তাতে বদলায়? সমাজ ব্যবস্থা যেন ঠিক যেমন আগেও চলত, এখনও তেমনই চলছে। কোনও কিছুরই বদল হয় না। আর তাই আমাদের ব্যক্তি জীবনেরও কোনও উন্নতি বা বদল হয় না। আর এখানেই সর্বকালের সেরা রাশিয়ান কমেডি দ্য ইনস্পেক্টর জেনারেল নাটকটি তাই দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে আজও বাস্তব ও প্রাসঙ্গিক থেকে যায়।