নিকোলাই গোগল ও তাঁর ধ্রুপদী আখ্যান ‘মৃত আত্মা/ ম্যরতভ্যে দুশি/ ডেড সোলস'
- 06 November, 2024
- লেখক: সৌভিক ঘোষাল
১
নিকোলাই গোগল উনিশ শতকীয় রুশ সাহিত্যের আদি জাগরণের প্রথম তিন মহানায়কের অন্যতম। এই জাগরণের শুরুটা হয়েছিল পুশকিনের হাত ধরে। পুশকিনের মাধ্যমে আধুনিক রুশ সাহিত্যের গৌরবজনক যাত্রা শুরুর পরে আসে লেরমন্তেভের বিখ্যাত উপন্যাস 'আমাদের সময়ের নায়ক' এবং নিকোলাই গোগলের নাটক, ছোটগল্প ও উপন্যাস সমূহ৷ রুশ সমাজের জটিলতা, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বাস্তবতার যে প্রকাশ গোগলে দেখা গেল, তার উত্তরাধিকার পরবর্তী সাহিত্যিক মহানায়কদের - যেমন দস্তয়েভস্কি ও চেকভকে - গভীরভাবে প্রভাবিত করল।
গোগলের লেখালিখির সোৎসাহ প্রেরণাদাতা হিসেবে পুশকিনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। গোগলের রচনা ছাপা ও ছড়ানোর কাজেই যে তিনি কেবল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন তা নয়, গোগলের দুই বিশিষ্ট লেখা - দ্য গভর্মেন্ট ইনসপেক্টর এবং ডেড সোলস এর প্রাথমিক ধারণাও তাঁকে জুগিয়েছিলেন পুশকিনই। এই দুটি লেখা এবং পিটার্সবার্গের ছোটগল্পগুলিই গোগলের খ্যাতির মূল ভিত্তি।
গোগল সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর সমকাল থেকে এখনো অবধি স্বদেশে এবং ক্রমশ অনুবাদের হাত ধরে বিশ্বজুড়ে নন্দিত হলেও ব্যক্তিজীবনে ছিলেন এক হতাশ মানুষ। তিনি ছেলেবেলা থেকে সাহিত্যিক হতেই চেয়েছিলেন, স্বয়ং জার বা সেকালের বিখ্যাত সাহিত্য মহারথী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন প্রভূত পরিমাণে - কিন্তু মানসিক শারীরিক ব্যধিকে পরাস্ত করতে পারেন নি। খানিকটা নিজের মন মানসিকতা আর খানিকটা এক ঠক তথাকথিত সিদ্ধপুরুষের পাল্লায় পড়ে শেষজীবনে তাঁর চিন্তাভাবনা এমনই বদলে যায় যে তিনি নিজের অতীত সমস্ত লেখালিখিকে নিস্ফল ও ক্ষতিকর ভাবতে শুরু করেন, নিজের অপ্রকাশিত লেখার পাণ্ডুলিপি - ডেড সোলস এর দ্বিতীয় খণ্ড যার অন্যতম - পুড়িয়ে নষ্ট করে দেন।
গোগলের জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা ইউক্রেনে, যা তখন ছিল রাশিয়ারই অংশ আর পরিচিত ছিল লিটল রাশিয়া নামে। এখানেই তাঁর স্কুল জীবন কাটে। ষোল বছর বয়েসে বাবাকে হারান তিনি। উনিশ বছর বয়সে সাহিত্যিক হবার স্বপ্ন নিয়ে চলে আসেন রাশিয়ার তৎকালীন রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গে। এখানে এসে সরকারী অফিসে ছোটখাটো একটি কাজ পান। সে কাজ তাঁর ভালো লাগে নি। ছেলেবেলা থেকেই অভিনয় জগতে প্রবেশের ইচ্ছে তার ছিল, কিন্তু সেখানেও তিনি সুবিধা করতে পারেন নি। শেষমেষ ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে প্রথমে একটি স্কুলে ও তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর চাকরী নেন। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে তিনি ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হয়ে চাকরী থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। সেই সময় তাঁকে শিক্ষক হিসেবে কাছ থেকে দেখেছিলেন পরবর্তীকালে আর এক দুনিয়া কাঁপানো রুশ সাহিত্যিক ইভান তুর্গেনিভ। তুর্গেনিভের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় গোগল তিনটির মধ্যে দুটি ক্লাসেই অনুপস্থিত থাকতেন। যেটি নিতে আসতেন সেটির জন্যও যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে আসতেন না৷ তাঁর প্রকাশভঙ্গী ও কন্ঠস্বরও ছিল শিক্ষণের অনুপযুক্ত৷
২
বাকপটু না হলেও গোগল তাঁর কলমে যখন কথা বলতেন, তখন তা পৌঁছত এক অন্য উচ্চতায়। কবিতা দিয়ে আত্মপ্রকাশের প্রথম ব্যর্থতার পর তাঁর সাহিত্য জীবনের সাফল্যের শুরুটা এসেছিল ইউক্রেনের পল্লী জীবনের অভিজ্ঞতামাখা গল্প কাহিনীর মধ্যে দিয়ে। দিকানকা পল্লীর সাঁঝবেলার এই সব গল্পগুলিতে বাস্তব আর রোমান্টিকতা মিলেমিশে আছে৷ এর দুটি খণ্ড বেরোয় যথাক্রমে ১৮৩১ ও ১৮৩২ এ। এরপর প্রকাশিত হয় মীরগারোদ সংকলনের লেখাগুলি। এর মধ্যেই ছিল ঐতিহাসিক উপন্যাস তারাস বুলবা৷ ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত থাকার সময় ইউক্রেনের ইতিহাস ও মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে তিনি যে চর্চা করেছিলেন সেটাই এর উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
তবে গোগলের লেখা যে কারণে আজও বিশ্ববন্দিত, সেই রুশ সমাজ বাস্তবতার তীব্র তীক্ষ্ণ উন্মোচনভিত্তিক লেখাগুলি লেখা হয় এর পরে। প্রথমে আসে ব্যাঙ্গাত্মক নাটক দ্য গভর্মেন্ট ইনসপেক্টর। তারপর আসে পিটার্সবুর্গের আখ্যানমালা - যার অন্তর্ভুক্ত নাক ও ওভারকোটের মতো বিশ্বশ্রেষ্ঠ কয়েকটি ছোটগল্প এবং সবশেষে আসে গোগলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি, বিশ্বসাহিত্যের এক চিরায়ত ক্লাসিক, ডেড সোলস বা মৃত আত্মা নামের উপন্যাস।
ডেড সোলস উপন্যাসকে সমকালীন রাশিয়ার দুর্নীতিগ্রস্থ আমলাতন্ত্র ও ভূমিদাস প্রথার করুণ প্রথাটির উন্মোচনের অন্যতম শীর্ষবিন্দু বলে মনে করা হয়৷ দুর্নীতিগ্রস্থ আমলাতন্ত্রকে উন্মোচনের কাজটা গোগল শুরু করে দিয়েছিলেন পূর্ণ দৈর্ঘ্যের নাটক দ্য গভর্মেন্ট ইনসপেক্টরের মধ্যে দিয়ে৷ এই নাটকের কাহিনীটি অত্যন্ত চমকপ্রদ, যার ভাবনাবীজ তাঁকে দিয়েছিলেন বিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক ও তাঁর অগ্রজ পুশকিন। ইনসপেক্টর জেনারেল খোঁজখবর করতে নিজে আসবেন এই খবর আসে এক শহরে। এই শহরের কোনও নাম উল্লেখ গোগল করেন নি। মেয়র, তার সাঙ্গোপাঙ্গ আর ছোট আমলারা ইন্সপেক্টর জেনারেল আসার খবরে তটস্থ হয়ে ওঠে। কীভাবে দুর্নীতিকে ঢাকা চাপা দেওয়া যায় সেই সংক্রান্ত পরিকল্পনা চলাকালীনই তারা জানতে পারে সপ্তাহ দুয়েক আগে একজন অজানা অচেনা মানুষ রাজধানী থেকে এই শহরে এসেছে এবং এক হোটেলে থাকছে। তারা ধরে নেয় এই লোকটিই হল সেই ইন্সপেক্টর জেনারেল। গোপনে এসে তাদের কুকীর্তির তত্ত্বতালাস করছেন তিনি। আদতে সেই লোকটি মোটেই কোনও পদমর্যাদাবাহী আমলা নন, নিতান্তই সাদামাটা এক মানুষ, যার নাম Ivan Alexandreyevich Khlestakov। তবে সাদামাটা লোক হলেও খেলস্তাকোভ মেয়র ও তার দুর্নীতিগ্রস্থ আমলাদের ভুল ভাবনার ফসল তুলে নিতে কোনও ভুল করেন না। তাদের তোষামোদ, নানা সুযোগ সুবিধে আর উপঢৌকন চেটেপুটে আত্মস্যাৎ করেন। চলে যাবার পরে তার লেখা এক চিঠি খুলে স্থানীয় পোস্টমাস্টার ও তার মাধ্যমে বাকী সকলে জানতে পারেন। কীভাবে খেলস্তাকোভ তাদের সকলকে বোকা বানিয়েছে। এই নিয়ে তারা হাসিঠাট্টা শুরু করলে মেয়র ক্ষোভের সঙ্গে তার দুর্নীতিগ্রস্থ সাঙ্গোপাঙ্গোদের বলেন যে তারা কী বুঝছে যে আসলে তারা নিজেদের নিয়েই হাসছে। ব্যঙ্গের চাবুকে যখন তারা বিদ্ধ হচ্ছে তখনই খবর আসে আসল ইন্সপেক্টর জেনারেল এবার সত্যিই এসে পৌঁছেছেন ও তিনি বাকীদের তলব করেছেন।
দ্য গভর্মেন্ট ইনসপেক্টরের প্রথম অভিনয়ের সময় হাজির ছিলেন স্বয়ং জার প্রথম নিকোলাস। রুশ আমলাতন্ত্র সম্পর্কে কঠোর ব্যঙ্গবিদ্রুপ থাকলেও তিনি নাটকটি উপভোগ করেছিলেন। গোগল এই নাটকের মধ্যে দিয়ে রুশ সাহিত্য জগতের তারকায় পরিগণিত হন।
গোগলের খ্যাতি আরো বাড়ে এর পরে প্রকাশিত ওভারকোট, নোজ প্রভৃতি গল্পের মধ্যে দিয়ে। ওভারকোট গল্পটি আকাকি আকাকিভিচ বাশমাচকিন নামের এক নিচুতলার কেরানির জীবন যন্ত্রণার গল্প। তার ওভারকোটটি শতচ্ছিন্ন, তাকে আর জোড়াতালি দিয়ে চালানো সম্ভব নয় বলে দর্জি জানিয়ে দেয়। অগত্যা সামনের প্রবল শীতের আগেই এক নতুন ওভারকোট কেনা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। কিন্তু সে জন্য যে বিপুল খরচ তা তার হাতে একেবারেই নেই। নানা ধরনের কৃচ্ছসাধন ও সাধ্য সাধনার পর অবশেষে তার একটি নতুন ওভারকোট হয়। এটি গায়ে দেবার পরেই আকাকি আকাকিভিচ বাশমাচকিন যেন এক অন্য মানুষে রূপান্তরিত হয়। তার আত্মবিশ্বাস এবং সামাজিক মর্যাদা – দুই ই অনেক বেড়ে যায়। এর পরেই আসে এক অপ্রত্যাশিত ট্রাজেডি। বাড়ি ফেরার পথে একদিন গুণ্ডারা আকাকিভিচের ওভারকোটটি ছিনতাই করে। এটি শুধু তার সাধের জিনিস ছিল না, হয়ে উঠেছিল তারই আর এক সত্তা। এটি হারিয়ে সে পাগলপ্রায় হয়ে যায়। ছুটে যায় পুলিশ থেকে আমলা সকলের দ্বারে। গুণ্ডাদের ধরা বা কোট ফেরৎ পাবার কাজে তারা বিন্দুমাত্র সহায়তা করতে না পারলেও আকাকিভিচকে যৎপরোনাস্তি অপমান করতে ছাড়ে না। সেই অপমান এমনভাবে তার বুকে বাজে যে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে ও প্রাণত্যাগ করে। আকাকি আকাকিভিচ বাশমাচকিন এর ট্রাজিক কাহিনীর মধ্যে দিয়ে শুধু এক ব্যক্তির নয়, রুশ সমাজের তলার দিককার মানুষদের করুণ অবস্থার ছবিটি গোগল ফুটিয়ে তোলেন।
৩
১৮৪২ সালে গোগলের ওভারকোট গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল। সেই বছরেই বেরোয় তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা Мёртвые души (ম্যরতভ্যে দুশি) তথা ‘ডেড সোলস’ বা ‘মৃত আত্মা’ নামের উপন্যাসটি। এই উপন্যাসটি তিন খণ্ডে লেখার ভাবনা ছিল গোগলের। তবে কেবল প্রথম খণ্ডটিই ছাপা হয়েছিল। দ্বিতীয় খণ্ড লেখার কাজ তিনি সমাপ্ত করেছিলেন, কিন্তু তখন তিনি মানসিকভাবে এতটাই বিধ্বস্ত যে ভাবছেন এই সব লেখা ক্ষতিকর, নষ্ট করে দেওয়া উচিত। তাই এর পাণ্ডুলিপি তিনি পুড়িয়ে দেন মানসিক বিকারগ্রস্থ অবস্থায়। পরে এর খণ্ডাংশ পাওয়া যায়। পরিকল্পিত তৃতীয় খণ্ড অবশ্য কখনো লেখাই হয় নি।
বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে, রুশ বিপ্লবের ঠিক আগে, ১৯১৬ সালে ম্যরতভ্যে দুশি বা মৃত আত্মা উপন্যাসটির একটি ইংরাজী অনুবাদ করেন D. J. Hogarth। এর ছ বছর পর রুশ সাহিত্যের বিখ্যাত অনুবাদিকা Constance Garnett এই উপন্যাসের একটি অনুবাদ করেন। এটি ১৯২২ সালে বেরোয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বি জি গুর্নে ১৯৪২ সালে ডেড সোলসের আর একটি অনুবাদ করেন। ১৯৫৭ সালে ডেড সোলস এর একটি অনুবাদ করেন George Reavey। অক্সফোর্ড ওয়ার্ল্ড ক্লাসিকস এর বিখ্যাত সিরিজের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে এটি প্রথমে বেরোয়। পরে নর্টন ক্রিটিকাল এডিশনে এটিই ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে পেঙ্গুইন প্রকাশন সংস্থা বের করে David Magarshack কৃত একটি অনুবাদ। অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক কালের বেরনো অনুবাদগুলির মধ্যে রয়েছে Richard Pevear ও Larissa Volokhonsky র করা যৌথ অনুবাদটি। এটি ১৯৯৬ সালে বেরিয়েছিল।
কিছুদিন আগে, ২০২৩ সালে সাহিত্য অকাদেমি থেকে মূল রুশ ভাষা থেকে করা এর অরুণ সোম এর একটি চমৎকার বাংলা অনুবাদ বেরিয়েছে।
৪
১৮৬১ সালে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার আইন করে রাশিয়া থেকে ভূমিদাস প্রথা তুলে দেবার আগে অবধি এই কুপ্রথার মর্মযন্ত্রণা ভোগ করতে হত রাশিয়ার প্রায় এক তৃতীয়াংশ কৃষককে। সেই সময়ে জমিদারদের থাকত হাজার হাজার বিঘা জমি। কিন্তু সেই জমির পরিমাণ বা জমিতে উৎপন্ন ফসলের পরিমাণের ওপর জমিদারদের বিত্ত নির্ভর করত না। কর ব্যবস্থাও জমির পরিমাণ বা কৃষি উৎপাদন ভিত্তিক ছিল না। পুরো হিসাবটাই করা হত জমিদারের অধীন পুরুষ ভূমিদাসের সংখ্যার ভিত্তিতে। ভূমিদাসরা জমিতে খাটত, উৎপাদন করত আর উৎপাদন বাবদ জমিদারকে টাকা দিত। জমিদার আবার ভূমিদাসপিছু সরকারকে কর বুঝিয়ে দিত। কতজন ভূমিদাসপিছু এই কর দিতে হবে তা ঠিক করার জন্য বেশ কয়েক বছর অন্তত ভূমিদাস গণনা হত। একবার গণনা হবার পরের গণনা হতে হতে দশ, বারো, পনেরো বছরও পেরিয়ে যেত। এই সময়কালের মধ্যে মারা যাওয়া ভূমিদাসদের জন্যও কর দিতে হত। ভূমিদাস সংখ্যাই যেহেতু ছিল সম্পদ পরিমাপের উপায়, তাই ভূমিদাসদের বন্ধক রেখে ব্যাঙ্কঋণও পাওয়া সম্ভব ছিল।
ভূমিদাস প্রথা নির্ভর রুশ সমাজ অর্থনীতির এই বাস্তবতাকেই কৌশলে কাজে লাগাতে চায় ‘মৃত আত্মা’ উপন্যাসের নায়ক চিচিকভ। উপন্যাসের শুরুতে আমরা তাকে এক শহরে আসতে দেখি। শহরটির পুরো নাম পরিচয় দেন নি গোগল, কেবল বুঝিয়েছেন মস্কো থেকে এটি বেশ ভালোই দূরে আর কাজান থেকে দূরত্ব আরো বেশি। শহরটিকে ‘ন’ বর্ণ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এর আমলাতন্ত্রের ছবিটি বেশ স্পষ্টভাবেই নিয়ে এসেছেন গোগল। উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়টি মূলত আমলাতন্ত্রের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে চিচিকভের কৌশলী আলাপের আখ্যান।
দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ে বিভিন্ন জমিদার সকাশে চিচিকভের যাত্রা, মৃত ভূমিদাস কেনার ইচ্ছের কথা বলা ও সেই সূত্রে নানা ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। এদের কারো কারো সঙ্গে প্রথম অধ্যায়ে বিশিষ্ট আমলাদের বাড়ির আমন্ত্রণী আড্ডায় চিচিকভের পরিচয় হয়েছিল। আবার পথ ভুলে প্রাকৃতিক দূর্বিপাকের মুখে আশ্রয় নিতে গিয়ে কারো বাড়িতে সে পৌছেছে তার গাড়িচালক সেলিফানকে নিয়ে। কোচোয়ান সেলিফান ছাড়া চিচিকভের চাকর পেত্রুশকাকেও আমরা বেশ কয়েকবার দেখি আখ্যানে।
চিচিকভ যে মৃত ভূমিদাসদের জমিদারদের থেকে কিনে নিতে চায়, এটা সবাইকেই বেশ অবাক করে। মৃত ভূমিদাসরা করের বোঝা বাড়ায়, তাই কেউ কেন খামোকা তাদের কীনবে, সেটা কেউ ভেবে উঠতে পারে না। কেউ কেউ চিচিকভের প্রস্তাবে সানন্দ সম্মতি দেয়। যেমন দ্বিতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত ম্যানিলভ চিচিকভ আদানপ্রদানটি ছিল বেশ সহৃদয় ও উষ্ণ। আবার কেউ কেই সংশয়ী বা নিমরাজী হয়। তৃতীয় অধ্যায়ে চিচিকভকে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে দেখি আমরা। ম্যানিলভের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে চলেছিল সোবাকেয়েভিচের জমিদারির উদ্দেশ্যে। কিন্তু পথ ভুলে এক দুর্যোগের রাতে গিয়ে পৌঁছয় করোবোচকা নামের এক বিধবা জমিদারনীর বাড়িতে। করোবোচকা মৃত ভূমদাস বিক্রির প্রসঙ্গে বেশ হকচকিয়ে যায়। এর ভেতরে কী গোপন ব্যাপার স্যাপার লুকিয়ে আছে তা বুঝতে না পেরে সন্দিহান হয়ে ওঠে। ভূমিদাসের বদলে নানা খামারজাত দ্রব্য বিক্রি করতেই সে বেশি উৎসাহী হয়। চিচিকভ সে সব কিনবে পরে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভূমিদাস কেনাবেচার চুক্তি সেরে নেয়। এরপর চতুর্থ অধ্যায়ে নজদ্রিয়েভের মতো এক পাক্কা শয়তানের খপ্পরে পরে চিচিকভ। চিচিকভের পূর্ব পরিচিত এই নজদ্রিয়েভ গুলবাজ, মাতাল, জুয়ারি এবং গুণ্ডা প্রকৃতির লোক। তার ভূমিদাসদের দিয়ে সে যখন চিচিকভকে মারতে উদ্যত, তখন অন্য এক অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ নজদ্রিয়েভের বাড়িতে এলে চিচিকভ সে যাত্রা রক্ষা পায়। পঞ্চম অধ্যায়ে চিচিকভ যায় ন শহরে আলাপ হওয়া আর এক জমিদার সোবাকিয়েভিচের বাড়িতে। সোবাকিয়েভিচ ভাবে চিচিকভ যখন মৃত ভূমিদাস কিনতে চাইছে, তখন সে জানুক আর নাই জানুক, এর নিশ্চয় কোনও তাৎপর্য আছে। তাই গোপন সন্দেহের বশে মৃত ভূমিদাস বিক্রির জন্য সে চড়া দাম হেঁকে বসে। অনেক দরদস্তুর চলে। সোবাকিয়েভিচের হাঁকা ভূমিদাস পিছু একশো রুবলের বিশাল অঙ্ক দরাদরির পর নেমে আসে আড়াই রুবলে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে চিচিকভ যায় প্ল্যুশকিন নামের এক দুঃস্থ জমিদারের বাড়ি। তার নিজের সংসারই ভালোভাবে চলে না, তার ওপর আছে অনেক মৃত ভূমিদাসের কর মেটানোর অতিরিক্ত দায়। চিচিকভের মৃত ভূমিদাস কিনে নেবার প্রস্তাব সে সানন্দেই মেনে নেয়।
এই অধ্যায়গুলোতে শুধু এক একজন জমিদারের এক এক ধরনের চরিত্র আমরা দেখি না। দেখি বিভিন্ন জমিদারের আর্থিক পরিস্থিতির বিভিন্নতা। রুচি ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য। গোগল দেখান সব বৈচিত্র্য নিয়েই তাঁর মাতৃভূমি রাশিয়া। এ কোনও একঢালা সমাজ সংস্কৃতি নয়।
ভূমিদাসরা এই ব্যবস্থায় যে মূলত সম্পত্তির হিসাব, নামহীন অবয়বহীন সংখ্যা, সেই করুণ ছবিটি মৃত আত্মা উপন্যাসে যখন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তখনই সপ্তম অধ্যায়ে ভূমিদাস তালিকার সূত্র ধরে অধুনা মৃত ভূমিদাসদের একদা প্রাণচঞ্চল জীবনযাপনের ছবিটি সামনে আসে। শোনা যেতে থাকে তাদের নাম, ধাম এমনকী কর্মদক্ষতার পরিচয়বৃত্তান্তও। এখানে আখ্যানকারের নিজ উদারনৈতিক স্বর যেন নায়ক চিচিকভের ভাবনার স্বাভাবিক গতিবিধিকে প্রভাবিত করেছে। সপ্তম অধ্যায়ের শেষে আদালতে বিধিসম্মতভাবে জমিদারদের কাছ থেকে চিচিকভের ভূমিদাস কেনাবেচার দলিলটিও তৈরি করার কাজটি সহজে সুসম্পন্ন হয়ে যায়।
অষ্টম অধ্যায়ে এক বল নাচের আসরে নজদ্রিয়েভ আবার আসরে উপস্থিত হয়। বাড়িয়ে কথা বলার স্বভাব বজায় রেখেই সে চিচিকভের মৃত ভূমিদাস কেনার বৃত্তান্তটি অতিথি সমাগমের মাধ্যমে হাট করে দেয়। তবে দু চারটে সত্যি কথার সঙ্গে এত বেশি পরিমাণ বাড়তি মিথ্যা সে বলে, যে সবাই তার সবকিছুই মোটের ওপর অবিশ্বাস করে। তবে চিচিকভের কর্মকাণ্ড নিয়ে একটা সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়ে যায়। চিচিকভ আসলে কে, কী তার উদ্দেশ্য সে নিয়ে শুরু হয় প্রবল জল্পনা। নবম অধ্যায়ে একটি বলনাচের আসরে চিচিকভ সহ অনেকে জমায়েত হলে জল্পনা প্রবল হয়ে ওঠে। চিচিকভ গভর্নরের কিশোরী মেয়ের পাশে বসে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কথাবার্তা বললে সকলেই ধরে নেয় সে মেয়েটিকে নিয়ে পালাতে চায়, হয়ত তাকে বিয়েও করতে ইচ্ছুক। নবম ও দশম অধ্যায়েও চিচিকভের পরিচয় নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলে। নবম অধ্যায়ে দুই মহিলার এই সংক্রান্ত বিস্তারিত কথোপকথনে রুশ অভিজাত মহিলামহলের এক পার্শ্বিক ছবি ভেসে ওঠে। দশম অধ্যায়ে চিচিকভ কে এই চলমান জল্পনার মধ্যে ঢুকে পড়ে নগরের ডাকবাবু বর্ণিত ক্যাপ্টেন এককড়ির উপাখ্যান।
৫
চিচিকভ আসলে কে, কী তার উদ্দেশ্য তা জানতে এই উপন্যাসের (প্রথম খণ্ডের) শেষ তথা একাদশ অধ্যায় পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয়। একেবারে বাল্যকাল থেকে চিচিকভের জীবনবৃত্তান্তটি পরিশেষে আমাদের জানিয়ে দেন গল্পকথক। আমরা জেনে যাই চিচিকভ খুব সাধারণ এক পরিবারে জন্মেছিল। চিচিকভের বাবার একজন মাত্র ভূমিদাস ছিল। সঙ্গতিহীন বাপ ছেলেকে রেখে আসে এক বড় শহরে, তাদের আত্মীয়া এক বুড়ির বাড়িতে। এখানেই শুরু হয় চিচিকভের স্কুল জীবন। চিচিকভ পরদিন থেকেই স্কুলে যেতে আরম্ভ করে। কোনও বিদ্যাতেই বিশেষ কোনও দক্ষতা তার মধ্যে দেখা যায় নি। তবে তার মধ্যে ছিল অধ্যাবসায় আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ ঝোঁক। তবে তার বুদ্ধিবৃত্তির বড় রকমের পরিচয় পাওয়া গেল অন্য আরেক দিকে – সেটা ছিল জীবনের বৈষয়িক দিক। সে বন্ধুবান্ধবদের পেছনে টাকা খরচ করত না। মিতব্যয়ী সঞ্চয়ী জীবনযাপন করত। ছেলেবেলাতেই মোম দিয়ে বুলফিঞ্চ পাখি বানিয়ে রঙ করে বেশ লাভজনক দামে বিক্রি করে সে। বোঝা যায় অর্থ উপার্জনে তার আগ্রহ প্রবল। লোককে প্রভাবিত করতেও তার ছিল জুড়ি মেলা ভার। পড়াশুনোতে বিশেষ আগ্রহী না হলেও ক্লাসে তার মত শান্তশিষ্ট হয়ে মতো বসে থাকতে আর কেউ পারত না। ফলে গুরু মহাশয়ের মার বকুনি সে সহজেই এড়াতে পারত। নম্বরও শান্ত বিনয়ী আচরণ দিয়ে ভালোই জুটিয়ে নিত। স্কুল শেষ করার পর যে সার্টিফিকেট পেয়েছিল তাতে সব বিষয়ে তাঁর বিশেষ কৃতিত্বের উল্লেখ ছিল। সে যখন স্কুল শেষ করল ততদিনে সে দেখতে শুনতে রীতিমতো আকর্ষণীয় এক নবীন যুবা, তার বাপও ততদিনে মারা গেছে। কোনও একটা কাজে ঢুকে পড়ার আগ্রহ চিচিকভের মধ্যে বরাবরই ছিল প্রবল। স্কুল থেকে বের হবার পর বিশ্রাম করার প্রবৃত্তি জাগেনি একটুকুও। স্কুল সার্টিফিকেটের প্রশংসাবাক্যের জোরে সে ঢুকে পড়ে সরকারি কাছারির এক কাজে। মাসে তিরিশ চল্লিশ রুবলের সামান্য কাজটাও সে খুব মন দিয়ে করার চেষ্টা করত। অন্যান্য কর্মচারীদের বিপরীতে চিচিকভ তার সুন্দর চেহারা, কন্ঠস্বরের মাধুর্য, কড়া পানীয়ের প্রতি প্রবল অনীহার কারণে বিশিষ্ট ও চোখে পড়ার মতো হয়ে উঠেছিল। ওপরওয়ালা বড়বাবুকে সে বাবা বলে ডাকত, ঢুকে পড়েছিল তার বাড়িতে, তার মেয়ের সঙ্গে ভাব জমিয়েছিল আর দেখতে অনাকর্ষণীয়া সেই মেয়েকেই সে বিয়ে করতে পারে এমন আবহ তৈরি করেছিল। বড়বাবু সব মিলিয়ে তাকে উঁচু পদ দেবার জন্য নিজের সমস্ত শক্তি ও আগ্রহ নিয়োগ করেন এবং এর ফলে সেই পদ তার জুটেও যায়। জীবনের এই কঠিন বাঁধাটা পেরিয়ে যাবার পর সে অবশ্য বড়বাবুর বাড়িতে যাওয়া ছেড়ে দেয়, তার মেয়েকে বিয়ের প্রসঙ্গ ওঠানোর কোনও সুযোগও রাখে না। বড়বাবুর সঙ্গে দেখা হলে মধুর ব্যবহার চালিয়ে যায় বটে, কিন্তু বড়বাবু বুঝতে পারেন চিচিকভ তাকে ঠকিয়েছে।
এরপর শুরু হয় ঘুষ নিয়ে চিচিকভের ধনী হবার অধ্যায়। সরকারী ব্যবস্থাপণাকে ব্যবহার করে আমলাতন্ত্র কীভাবে স্বার্থসিদ্ধি করে, দুর্নীতি কীভাবে সরকারী বড়বাবুদের বড়লোক করে তোলে - এই পর্বের বিস্তারিত বর্ণনার মাধ্যমে গোগল তা পাঠকের সামনে উন্মোচিত করে দিয়েছেন। এক সুবিশাল সরকারী দালানের নির্মাণকর্ম তত্ত্বাবধানের জন্য একটি কমিশন গঠিত হয়েছিল। সেই কমিশনের সক্রিয় সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হল চিচিকভ। কমিশন ছয় বছর এই দালান তৈরির কাজ নিয়ে পড়ে রইলো। সরকারী দালান তৈরি হল না, কিন্তু শহরের অন্য প্রান্তে কমিশনের প্রতিটি সদস্যের একটি করে সুন্দর বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়াল। এই সময় থেকে চিচিকভের সংযমব্রতেও এলো শৈথিল্য। অনেক মাইনে দিয়ে সে একজন ভালো পাচক রাখল, ফিনফিনে সুতির জামাকাপড় পরতে শুরু করল। অত সুন্দর কাপড় সেই অঞ্চলে আর কাউকে পরতে দেখা যেত না। খয়েরি ও লালচে রঙের বাহারি জামাকাপড়ের দিকে তার বিশেষ ঝোঁক দেখা গেল। নিজের গাড়ির জন্য খুব ভালো জাতের একজোড়া ঘোড়াও সে কিনে ফেলল। সরকারের ওপর মহল দুর্নীতির খবর পেয়ে একজন কড়া ধাঁচের মিলিটারি অফিসারকে পাঠালেন। কমিশনের সদস্যদের ব্যক্তিগত বাড়িগুলো বাজেয়াপ্ত করে সেখানে নানা সরকারী দপ্তর তৈরি করা হল। নতুন মিলিটারি অফিসার চিচিকভকে বিষ নজরে দেখতে শুরু করলেন। তার চাকরিটা গেল। চিচিকভ অবশ্য কিছুদিনের মধ্যে আর একটি নতুন চাকরী খুঁজে নিল। এই চাকরীটা ছিল শুল্ক বিভাগে। এই বিভাগে চাকরীর প্রতি চিচিকভের বরাবরের আগ্রহ ছিল, কারণ এখানে ঘুষ খাবার সুযোগ প্রবল। প্রথমদিকে অবশ্য সে ঘুষ না খেয়ে কড়া ধাঁচের শুল্প অফিসার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করল। কর ফাঁকি দেবার ফাঁকফোকরগুলিকে বের করে লুকানো মাল বাজেয়াপ্ত করতে সে সবচেয়ে বেশি দক্ষতার পরিচয় দিল। স্বাভাবিকভাবেই তার সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ীরা রফায় আসতে চাইল। প্রথমদিকে চিচিকভ তাদের ফিরিয়ে দিয়ে জানাল এটা উপযুক্ত সময় নয়। তারপর সে যখন দপ্তরের সর্বেসর্বা হয়ে উঠল, তখন রফায় সাড়া দিত। কারণ এবার ঘুষের সিংহভাগ সে নিজেই পকেটস্থ করতে পারবে। আর এক উচ্চপদস্থ অফিয়ারকেও সে এই কাজে সঙ্গী করে নিল। চোরাকারবার যত বাড়ল শুল্ক বিভাগের মদতে, ততই এর দুই কর্তা ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল। চিচিকভের সম্পত্তি পাঁচ লক্ষ রুবল ছাড়িয়ে গেল। কিন্তু এই দুই কর্তার অন্তর্বিবাদ এই কারবারের গোপন খবর বাইরে এনে দিল। তাদের সম্পত্তিই শুধু বাজেয়াপ্ত হল না, চিচিকভের চাকরীটিও গেল। কিছুদিন পর চিচিকভ আবার নতুন উদ্যমে কিছু করার কথা ভাবতে শুরু করল। তখনই তার মাথায় এল মৃত ভূমিদাসদের অতি সামান্য দামে কিনে তা বন্ধক দিয়ে বিপুল ব্যাঙ্ক নোট হাতানোর অভিনব পরিকল্পনা। আখ্যানের শুরুতে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতেই তাকে আমরা আসতে দেখি ‘ন’ নামে উল্লিখিত শহরটিতে আসতে।
প্রশ্ন হল নায়ক চিচিকভের জীবন বৃত্তান্তটিকে প্রথমে না বলে, একদম শেষে একাদশ অধ্যায়ে কেন বললেন আখ্যানকার? আমাদের মনে হয় এই উপন্যাসের মূল উদ্দেশ্য চিচিকভের জীবনবৃত্তান্ত বর্ণনা নয়। মূল উদ্দেশ্য চিচিকভের অভিনব পরিকল্পনাটিকে সামনে রেখে রাশিয়ার ভূমিদাস প্রথা, সামন্ততান্ত্রিক সমাজের বাস্তবতাকে হাজির করা। সে জন্যই চিচিকভের নিজস্ব বৃত্তান্ত প্রথমে না এনে রাশিয়ার বিভিন্ন জমিদার, তাদের খামার, তাদের আওতায় থাকা ভূমিদাস, তাদের কাজ কারবার, রোগভোগ মৃত্যু, রাশিয়ার রাস্তাঘাট, সরাইখানা, যানবাহন, খাবার দাবার ইত্যাদি বর্ণনার মাধ্যমে রুশ বাস্তবতাকে যথাসম্ভব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। একাদশ অধ্যায়ে বর্ণিত চিচিকভের জীবনবৃত্তান্তর বর্ণনা অংশটি রৈখিক, কিন্তু উপন্যাসের আগের দশটি অধ্যায়ের চরিত্র অনেকটাই এপিসোডিক। সেইসঙ্গে এও লক্ষ করার বিষয় যে রাস্তা ও যাত্রা এই উপন্যাসে একটি বড় অংশ জুড়ে আছে। এইসব কারণে এই উপন্যাসটির গঠন ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে হোমারের ওডিসি, সার্ভেন্তেসের দন কিহোতে ইত্যাদি মহৎ সাহিত্যকীর্তির কথা উল্লেখ করেছেন কোনও কোনও সমালোচক।
৬
এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখা দরকার উপন্যাসটি ১৮৪২ সালে প্রথম প্রকাশের সময় এর শিরোনাম যদিও ছিল ‘চিচিকভের অ্যাডভেঞ্চার বৃত্তান্ত ও মৃত আত্মা’ কিন্তু এটি খানিকটা বাধ্য হয়ে নেওয়া শিরোনাম। বইটি প্রকাশের আগে পাণ্ডুলিপিটি প্রথমে যায় মস্কোর সেন্সর বোর্ডের কাছে। তখন উপন্যাসের প্রস্তাবিত নাম ছিল মৃত আত্মা। সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান মনে করেন এটি ধর্মবিরোধী শিরোনাম। কারণ ধর্মমত অনুসারে আত্মা অবিনশ্বর, তার মৃত্যু হতে পারে না। মৃত আত্মা বলাটা তাই সরাসরি ধর্মবিরোধিতা। গোগল বোঝানোর চেষ্টা করেন এখানে আত্মা বলতে মানুষের চেতনা জাতীয় কিছুকে বোঝানো হয় নি। ভূমিদাসদের রাশিয়ায় আত্মা বলা হয়। এই আখ্যান সেই সংক্রান্ত তাই তার নাম মৃত আত্মা। সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান এরপরেও নতুন আপত্তি তোলেন। বলেন সেক্ষেত্রে এই নাম ভূমিদাসপ্রথার সমালোচনা করছে। এমন সরকার বিরোধী বইকে তিনি ছাড়পত্র দিতে পারেন না। এমত পরিস্থিতিতে কষ্টে লেখা উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটি গোগল পাঠান সেন্ট পিটার্সবুর্গের সেন্সর বোর্ডে। তখন গ্রন্থের নামটি বদলে শুরুতে রাখেন চিচিকভের অ্যাডভেঞ্চার বৃত্তান্ত ও তারপর সংযোজক অব্যয়ের পরে রাখেন মৃত আত্মা কথাটি। আখ্যাপত্রে কাব্য কথাটিও জুড়ে দেওয়া হয়।
৭
প্রথম প্রকাশের সময় মৃত আত্মা উপন্যাসের আখ্যাপত্রতে কাব্য কথাটি লেখা থাকলেও গোগলের লক্ষ্য যে রোমান্টিক আখ্যান লেখা ছিল না, তা স্পষ্ট। উপন্যাসের সপ্তম অধ্যায়ে শিল্পলোকে বিচরণকারী রোমান্টিক কবির ভাববিশ্ব ও আখ্যানকারের কঠোর জীবনচিত্র ভিত্তিক বাস্তববিশ্বের দুই আলাদা নন্দনতাত্ত্বিক ধারণার কথা গোগল বেশ বিস্তারিতভাবেই বলেছেন। সেটি উল্লেখের মধ্যে দিয়ে আমরা গোগলের উপন্যাস নন্দনের ধারণাটিকে তাঁর লেখা দিয়েই বুঝে নিয়ে আপাতত এই উপন্যাস পর্যালোচনায় যতি টানব।
‘লেখকদের মধ্যে সৌভাগ্যবান তাঁকেই বলবো যিনি একঘেয়ে বিরক্তিকর উদ্রেককারী চরিত্রগুলিকে এড়িয়ে যেতে পারেন। যাদের করুণ বাস্তবতা মানুষকে মর্মাহত করে, তাদের পরিহার করে যে সমস্ত চরিত্র মানবজাতির উচ্চ মূল্যবোধের মধ্য প্রকাশ তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারেন। ঘূর্ণিপাকের মধ্যে আবর্তিত নমুনা থেকে অল্পসংখ্যক কিছু ব্যতিক্রম তুলে আনতে পারেন। তাঁর বীণার চড়া সুরে বাঁধা তন্ত্রীর কখনো হেরফের ঘটান না। তাঁর উচ্চাসন থেকে নিজের হতদরিদ্র ভাই বন্ধুদের কাছে আসেন না। মাটি স্পর্শ করেন না। মাটির পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে একান্তভাবে তার নিজস্ব অনেক দূরের কোনও এক সমুন্নত রূপসৃষ্টিতে নিমগ্ন থাকেন। তাঁর ভাগ্য এত ভালো যে তা দ্বিগুণ ঈর্ষার যোগ্য। তিনি যেন লেখকের সাথে একই পরিবারভুক্ত অথচ তাঁর খ্যাতি বহুদূর বিস্তৃত, দূর দূরান্তে ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত। তিনি ধুম্রজালের মায়া বিস্তার করে মানুষের দৃষ্টিকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখে দিয়েছেন, মানুষের দুর্দাশাকে গোপন করে তাকে সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা রূপে দেখিয়ে তার আশ্চর্য রকম প্রশংসায় মেতেছেন। লোকে করতালিধ্বনি তুলে হুড়োহুড়ি করে তাকে অনুসরণ করে, তাঁর বিজয় রথের পশ্চাৎধাবন করে। তারা তাঁকে একজন মহান বিশ্বকবি আখ্যা দিয়ে থাকে। ঈগল পাখি যেমন আকাশে আর সব পাখির মাথা ছাড়িয়ে ওড়ে, বিশ্বের তাবৎ প্রতিভার তুলনায় তাকেও তাঁরা তেমনি অনেক উঁচু বলে মনে করে। শুধুমাত্র তাঁর নামেই যৌবনদীপ্ত হৃদয় আবেগে উচ্ছ্বসিত, উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। চোখের কোনায় তাঁর উদ্দেশ্যে নিবেদিত অশ্রুকণা চিকচিক করতে থাকে। তাঁর সমকক্ষ আর কেউ নেই। তিনি ঈশ্বর।
কিন্তু এমন লেখকও আছেন যাঁর ভাগ্য ও রকম নয়, একেবারেই অন্যরকম। যে সমস্ত বস্তু অহরহ আমাদের চোখের সামনেই আছে অথচ আমাদের উদাসীন চোখে ধরা পড়ছে না, আমাদের সব তুচ্ছ বস্তু সেগুলির যত বিভীষিকাময় বীভৎস আবিলতা যা আমাদের জীবনকে জটিল করে তোলে, আমাদের পার্থিব জীবনের একঘেয়ে বিরক্তিকর যে পথ সময় সময় মনের মধ্যে তিক্ততার সঞ্চার করে, সে পথে তাপ উত্তাপহীন ভগ্নদশাপ্রাপ্ত অসংখ্য চরিত্রের যে ভিড় - এসব কিছুরই স্বরূপ প্রকাশে তুলে ধরার দুঃসাহস তার আছে। নিরলস চেষ্টায় নির্মম হাতে ছেনি দিয়ে সযত্নে সেগুলি সুস্পষ্ট রূপ গড়ে তুলে সর্বসমক্ষে উপস্থিত করার স্পর্ধা তিনি দেখিয়ে থাকেন। জনসাধারণের হাততালি কুড়ানো বা জনমানসে চাঞ্চল্য সঞ্চারের সকলের সম্মিলিত আননদোচ্ছ্বাস, তাঁদের কৃতজ্ঞচিত্তের অশ্রু বিসর্জন চোখে দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয় না। তাঁকে দেখে তার মহান কীর্তিকলাপে মুগ্ধ কোন ষোড়শী ভাবাবেগে মাথা ঘুরে তাঁর বাহু পাশে ঢলে পড়বে না। নিজেরই সুমধুর সুর মূর্ছনার মধ্যে যে আত্মবিসৃত হয়ে থাকবেন তাও তাঁর ভাগ্যে নেই। শেষ কথা এই যে সমসাময়িকদের বিচার এড়ানোর উপায় তাঁর নেই।’
গোগল মনে করেছিলেন, তাঁর মতো যে সব লেখকেরা এই ধরনের কঠোর তিক্ত বাস্তবতার ছবি তাঁদের লেখায় তুলে ধরবেন, ‘ভণ্ডামিপূর্ণ নির্মম এক বিচারে তাঁর এতদিনের সযত্নে লালিত সৃষ্টিসমূহ অতি নগণ্য ও নিম্নমানের বলে আখ্যাত হবে। মানবজাতির অবমাননাকারী ঘৃণিত লেখকদের মধ্যে কোন এক কোনায় তাঁর ঠাই হবে৷’ মনে করেছিলেন, ‘তিনি তাঁর রচনায় যে সমস্ত চরিত্র সৃষ্টি করেছেন যাবতীয় বৈশিষ্ট্য তাঁর নিজের ওপর আরোপিত হবে। তাঁর কাছ থেকে তাঁর হৃদয়, তাঁর মন, তাঁর প্রতিভার স্বর্গীয় বহ্নিশিখা ছিনিয়ে নেওয়া হবে।’ গোগলের আশঙ্কা ছিল যে কাঁচের সাহায্যে সূর্যকে নিরীক্ষণ করা যায়, আবার যার সাহায্যে অলক্ষিত প্রায় কীট পতঙ্গের গতিবিধিও পর্যবেক্ষণ করা যায় - সেই দুটো কাচই যে সমান বিস্ময়কর সমসাময়িক বিচার তা স্বীকার করবে না। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে গোগলের এই আশঙ্কা সত্যি হয় নি। রুশ সমাজের যে ক্ষত ও ক্ষয়ের কথা তিনি নির্মম ব্যঙ্গের ভাষায় লিখে রেখেছেন, তার নান্দনিক মূল্য শুধু রুশ জনগণ নয়, গোটা বিশ্ববাসী তাঁর সমকালেই স্বীকার করে নিয়েছিল। পরেও সেই ধারা অক্ষুণ্ণ থেকেছে। গোগলের নাটক ছোটগল্পের পাশাপাশি ‘মৃত আত্মা’ উপন্যাসটিকেও বরণ করে নেওয়া হয়েছে বিশ্বসাহিত্যের এক অমর ধ্রুপদী চিরায়ত কীর্তি হিসেবে।