রুশ সাহিত্য ও বাবা ইয়াগা

দশ বছরের ফুটফুটে কুমু আজ বায়না ধরেছে ঠাকুমার কাছে গল্প শুনবে। সদ্য স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পড়াশোনা থেকে সাময়িক  ছুটি।  ফ্ল্যাটের দক্ষিণের বারান্দায় মুখোমুখি দুটো চেয়ার পেতে ঠাকুমার গায়ের কাছে বসে উদগ্রীব হয়ে আছে গল্প শোনার আশায়।  মা, বাবা এখনও বাড়ী ফেরেনি। হেমন্তের রাতে আটটা বাজলে প্রায় দশটা বোধ হয়। ঘুটঘুটে অন্ধকার, কারেন্ট চলে গেছে পাঁচ মিনিট আগেই। আগামী পরশু কালীপুজো। বাড়ী বাড়ী টুনি আলো লাগানো হলেও বিদ্যুৎহীন পাড়াটা আজ কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর আঁধারে গা ছমছমে দেখতে লাগছে।  কুমু ঠাকুমার কোলে হাত রেখে বললো, " ও ঠাম্মা,   একটা রূপকথার  গল্প  বলবে? বলো না গো। রাক্ষসী রানীর গল্প। কেমন হাড় কটমট আওয়াজ করছিলো সে। " 

ঠাকুমা পান খাওয়া ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে হালকা হেসে বললেন, 

" আজ বরং তোকে রুশ দেশে এক ডাইনীর গল্প বলি। " 

" রুশ দেশের গল্প? সেখানে কী হয়?" 

কুমুর প্রশ্নে ঠাকুমা বলতে লাগলেন, 

" রুশ দেশ ইউরোপের একটা মস্ত বড় দেশ। ধবধবে সাদা বরফ জমা চারদিকে,  কনকনে ঠান্ডা, হাড় হিম করা গায়ে কামড় বসানো শীতল বাতাস। রাস্তা ঘাট বরফ মুড়ে থাকে, পাইন, পাম, বাওবাম, সাইবেরিয়ান লার্চ গাছের মাথাগুলো সাদা হয়ে থাকে ঝুরঝুরে বরফে। " 

কুমু সাথে বলে উঠলো,  " সেখানে বুঝি ডাইনী বুড়ি থাকে ঠাম্মা?" 

" হ্যাঁ, থাকে তো। তার নাম বাবা ইয়াগা। " 

ঠাকুমার কথায় হাসির ফোয়ারা ছুটিয়ে কুমু বললো, 

" বাবা ইয়াগা! সেকি ছেলে না মেয়ে? ডাইনী হলে তো মা ইয়াগা হবে। বাবা কেন? " 

ঠাকুমা জোরে হেসে কুমুর গাল টিপে বললো,  

" স্লাভিক ভাষায় "বাবা" এর অর্থ  "দিদা ", তবে ভাষা এবং উপভাষায় কখনও এই শব্দের অর্থ  "জাদুকর", "ডাইনী " বা "ভবিষ্যতকারী" ও হয়। " 

"আর ইয়াগা শব্দের মানে কী ঠাম্মা?"

কুমুর প্রশ্নে ঠাকুমা বললো, 

  "ইয়াগা" র মানে হলো  "সাপ,  বা "দুষ্ট মহিলা"। 

একমনে ঠাকুমার দিকে চেয়ে গ্রোগ্রাসে গল্পগুলো গিলতে লাগলো কুমু।  

"  বাবা ইয়াগা কোথায় থাকে , শুনবি ? "

" কোথায় থাকে  ঠাম্মা?"

কুমুর উৎসাহ দেখে ঠাকুমা বলতে লাগলো,

" প্রাচীন রুশ বর্ণনা ঘেটে দেখা যায়, বাবা ইয়াগার বাস গভীর জঙ্গলে । লোকালয় থেকে অনেক দূরে। সেখানে সচরাচর মানুষের পা পড়ে না। ইয়াগা এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়,  আশেপাশে থাকে মস্ত ভাল্লুক আর নেকড়ের দল। এমন  ঘন, ভয়ানক জঙ্গলের মাঝে একটা  ফাঁকা জায়গায় বাবা ইয়াগার বাড়ি।  বড়ই বিদঘুটে সে বাড়ী।  একটা মুরগীর পায়ের উপর  লাট্টুর মত বনবন করে ঘুরছে একটা কুঁড়েঘর। কুঁড়ে ঘরের  কোনো দরজা-জানালার নেই। মেঝেতে লুকনো এক ফুটো দিয়েই ভিতরে  প্রবেশ করা যায়। " 

কুমুর কৌতুহল তখন তুঙ্গে। সে প্রশ্ন করে, 

" বাবা ইয়াগা কেমন দেখতে ঠাম্মা?" 

চোখদুটো গোল করে পাকিয়ে ঠাকুমা উত্তর দিলো, 

"  ডাইনী বুড়ি যেমন হয় তেমনই। ছেঁড়া ফাটা জামাকাপড়, হদ্দ ময়লা, মাথায় শণের মতো চুল, প্যাকাটির মত হাত-পা, ইস্পাতের দাঁত। বাবা ইয়াগার কুটীরে একটা  প্রকান্ড এক চুল্লী আছে । উনি সেটার ওপরে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকেন। লম্বা নাক গিয়ে ঠেকেছে বাড়ির ছাদে। পা গিয়ে পড়েছে চৌকাঠে। মাঝে মধ্যে একটু হাওয়া খাওয়ার শখ হলে বুড়ি বেরিয়ে পড়েন একটা হামানদিস্তা নিয়ে।  সে হামানদিস্তাও আকারে বিশাল বড়। ইয়াগা তাতে চড়ে ঘুরে বেড়ান।  সংগে প্রায়ই দেখা যায় পোষা একটা দাঁড়কাককে। অনেক গল্পে দেখা যায়, বাবা ইয়াগার ঘরের চারপাশে মানুষের হাড়ের বেড়া, তাতে মশাল জ্বলছে। এরই ফাঁকে ফাঁকে খুটিতে গাঁথা রয়েছে নরমুণ্ডু।

শুনতে শুনতে কুমু ভয়ে  জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলো। হঠাৎ ডানদিকের দেওয়ালে একটা ছায়ার মতো কি দেখে চিৎকার করে কমু বললো, " ঠাম্মা,বাবা ইয়াগা  এসেছে। আমায় ধরে নিয়ে যাবে।" বলেই চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস প্রায় আটকে রইলো। এমন সময় শুনতে পেলো কুমুর মায়ের গলা, 

এই কুমু, চোখ খোল,  আমি রে। ভয় পাস না। " চোখ খুলে দেখলো মা ওর দিকে তাকিয়ে আছে আর  বাবা পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে, এমনকি ঠাম্মাও।  লজ্জায় কুমু চুপ করে রইলো।   কুমুর মা, বিশাখা কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে ব্রাউন প্যাকেট বের করে বললো,  দেখ তোর জন্য রুশ দেশের রূপকথা এনেছি। এইখানেই তোর বাবা ইয়াগা রয়েছে। " 

প্রায় ছোঁ মেরে মার হাত থেকে বইটা ছিনিয়ে নিয়ে কোলে রেখে কুমু পড়তে বসে গেলো " রুশদেশের উপকথা।"

রুপকথা নিয়ে এমন ভালোবাসা আট থেকে আশি প্রায় সকলের।  রুশ গল্পও তার ব্যতিক্রমী নয়। বাবা ইয়াগা পূর্ব ইউরোপীয় রুশ লোককাহিনীতে, বিশেষত স্লাভিক পৌরাণিক কাহিনীতে একজন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব। ডাইনী শব্দটা শুনলেই একটা  অতিপ্রাকৃত হাড় হিম করা সত্তার ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ।  কাহিনী অনুসারে, বাবা ইয়াগা  বাস করে মুরগির পায়ের উপর  দাঁড়িয়ে থাকা একটি কুঁড়েঘরে । পশু পাখিদের মধ্যে মুরগী কেন বাবা ইয়াগার বাসস্থান হিসেবে নির্বাচিত, এই প্রশ্ন আমার মাথায় আসায়, অনেক খুঁজে জানতে পারি, স্লাভিকরা মুরগীকে নারীদের সৃষ্টিশীলতা ,সন্তান প্রসবের  ক্ষমতার  প্রতীক মনে করে।   রাশিয়ায়, বিয়ের সময় মেয়েরা মাথায়  উপর একটি কাপড় বাঁধে, যার নাম 'কোকোশ্নিক'।   স্লাভিক  'কোকোশ থেকে আসা এই শব্দের অর্থ  মুরগী ।  বাবা ইয়াগা স্লাভিক লোককাহিনীতে একটি জটিল চরিত্র। কখনও তাকে ভালো মনে হয় , কখনও বা মন্দ। পৃথিবীর মানব সমাজে প্রতিটি চরিত্র সাদা কালো , ভালো মন্দে মেশানো ।  ইয়াগার  গল্পের প্রেক্ষাপট এবং তার সাথে জড়িত চরিত্রগুলির ক্রিয়াকলাপের উপর নির্ভর করে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয়ই হতে পারে।  Bell Laboratories  এর এক মুখপাত্রের  "  The Dark Theory ", অনুসারে,  অন্ধকারের ভর  আলোর চেয়ে ভারী এবং অন্ধকার আলোর চেয়ে দ্রুততর।  এই কারণে হয়তো আলোকিত চরিত্রগুলো আমাদের মনে প্রশান্তি দিলেও তমসাচ্ছন্ন চরিত্ররা মনের গহীনে  আঁচড় কেটে থাকে। তা সে ভীতির কারণে হোক না কেন। প্রাচীন চীনের ইন ইয়াং দর্শন অনুযায়ী,  বিপরীত শক্তি একে অপরের পরিপূরক,  সম্পর্কযুক্ত।  বাবা ইয়াগাকে আমরা কিছুটা সাদা কিছুটা কালোর ছায়ায় পাই।  কিছু লোককাহিনীতে, সে  সাহায্য  করে, সঠিক  পথ দেখায়,   মানুষের বুদ্ধি এবং সাহস পরীক্ষা করে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন।  "যাদুকরী ভাসিলিসা " গল্পে সওদাগর পুত্র ইভান বাবা কে খুঁজতে দূর দেশে যাত্রা করলো। বন, প্রান্তর পেরিয়ে এসে পৌঁছালো গভীর বনে। ইভানের আপ্যায়নে  বাবা ইয়াগা তৎপর। খাবার খাইয়ে পরদিন সকালে বাবা কে খুঁজতে যাওয়ার পথ বাতলে দিলো ইয়াগা। 

এই জাতীয় গল্পগুলিতে বাবা ইয়াগা  একজন জ্ঞানী,   পরোপকারী  ব্যক্তিত্ব। যে সকল মানুষ শ্রদ্ধা এবং ভদ্রতার সাথে তার কাছে আসে,  ইয়াগা   তাদের বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা করে  পুরস্কৃত করে।  চরিত্র পরীক্ষকের ভূমিকায় সে  বিচক্ষণ, তাই অনায়াসেই ইভানের  সততা, নিষ্ঠা  বুঝতে পারে । " ঝলমলে বাজ ফিনিস্ত" গল্পে ও মারুশুকা  বাজ ফিনিস্ত পাখির বেশে রাজকুমারকে খোঁজার জন্য যাত্রা শুরু করলে পরপর তিনজন বাবা ইয়াগার সাথে দেখা হয়। তারা সকলেই মারুশুকা কে সাহায্য করেছিলো।  নৈতিকতায় ইয়াগা ব্যতিক্রমী।  বাবা ইয়াগাকে কখনও কখনও পার্থিব  জগতের  বিশেষত জঙ্গলের  অভিভাবক হিসাবে দেখা হয়।  প্রকৃতির বন্য এবং অনিয়ন্ত্রিত দিকগুলির প্রতীক ইয়াগা প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সম্মান এবং বসবাসের গুরুত্বের উপর জোর দেন। স্ত্রী শক্তির প্রতীক রূপে  বাবা ইয়াগা লোককাহিনীতে একটি শক্তিশালী মহিলা চরিত্র, যা নারীর শক্তি এবং স্বাধীনতার প্রতিনিধিত্ব করে। সে নিজের শর্তে কাজ করে, জঙ্গলে একা বসবাস করেন এবং জাদুকরী শক্তির আদেশ দেয় । সেইদিক থেকে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়,  ইয়াগা  প্রথাগত লিঙ্গের ভূমিকা এবং স্টেরিওটাইপগুলিকে চ্যালেঞ্জ করে মহিলা শক্তির প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে । বাবা ইয়াগা স্লাভিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তার গল্পগুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে, লোককাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলি সংরক্ষণ করে এবং মানুষকে তাদের সাংস্কৃতিক শিকড়ের সাথে সংযুক্ত করে রেখেছে । সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ নিজেই একটি ইতিবাচক দিক, পরিচয় এবং ধারাবাহিকতার অনুভূতিকে উৎসাহিত করে। বাবা ইয়াগা  রূপান্তরমূলক অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত থাকে। যারা তার মুখোমুখি হয় এবং সফলভাবে তার  আরোপিত কাজগুলি সম্পন্ন করে,  তারা ব্যক্তিত্বের বিকাশ  এবং রূপান্তরের মাধ্যমে আত্ম আবিষ্কার করতে পারে।  কথায় আছে দোষে গুণে মিলে  মানুষ আর বাবা ইয়াগা রুশ গল্পে ভয়ংকর, অসৎ ,  নরমাংস খাদক রূপে  চিত্রিত। " রাজহাঁস আর ছোট মেয়ে " গল্পে দেখা যায়, চাষী আর  চাষীর বউ এর অনুপস্থিতিতে রাজহাঁসের ঝাঁক তাদের একমাত্র পুত্র সন্তানকে তুলে নিয়ে গেলে কন্যা সন্তানটি ভাইকে খুঁজতে খুঁজতে বাবা ইয়াগার কুটীরের সামনে চলে আসে। সেখানে ইয়াগার হুকুমে তকলিতে সুতো  কাটতে  কাটতে মেয়েটি জানতে পারে, ইয়াগা তাকে ধুয়ে পাকলে, উনুনে চড়িয়ে ভেজে খাবে, মেয়েটির হাড়ে চড়ে ঘুরে বেড়াবে। শিশুদের মধ্যে সতর্কতা বৃদ্ধি  ও ভীতি প্রদর্শনের জন্য গল্পে  বাবা ইয়াগার জন্ম বলা যেতে পারে। এমনকি জনমাধ্যমে  সামাজিক রীতিনীতি এবং মূল্যবোধকে শক্তিশালী করে  বাবা ইয়াগার আর্বিভাব অন্ধকারে, তিনি কখনও মৃত্যু কখনও এবং অতিপ্রাকৃত জগতের সাথে যুক্ত।  তাকে জীবিতদের জগৎ এবং মৃতদের জগতের মধ্যে দ্বাররক্ষী হিসাবে দেখা হয়। এই মেলামেশা তার ভয়ংকর এবং নেতিবাচক সত্তাকে আরও  বাড়িয়ে তোলে।

মনোবিজ্ঞানের দিক থেকে বাবা ইয়াগার চরিত্রে জাঙ্গিয়ান মনোবিজ্ঞানের ছায়া দেখা যায়।  সুইশ মনোবিজ্ঞানী কার্ল গুস্তাভ জাঙ্গ রোগ নিরাময় এই পদ্ধতির  প্রবক্তা।  তাঁর পদ্ধতিতে ধারণাগুলি হলো পৃথকীকরণ,  ব্যক্তিগত অবচেতন, যৌথ অবচেতন,  মূল আদর্শ, জটিলতা, ব্যক্তিত্ব, ছায়া। তিনি প্রাকৃতিক বৈজ্ঞানের পরিবর্তে পৌরাণিক কাহিনী, স্বপ্ন,  লোককাহিনীর মাধ্যমে মানুষের মন বোঝার উপায় নির্ধারন করেন।  স্বতন্ত্র মানসিকতা সন্ধানের জন্য জাঙ্গ ব্যক্তিগত অনুসন্ধানের গুরুত্বকে প্রাধান্য দেন। 

জাঙ্গিয়ান মনোবিজ্ঞানে, আর্কিটাইপগুলি সার্বজনীন প্রতীক বা থিম যা মানবতার সম্মিলিত অচেতনতায় উপস্থিত । রুশ লোক গল্পে বাবা ইয়াগা নারীমনস্তত্ত্বের রহস্যময়  দিকগুলির প্রতিনিধি ।   তিনি মানব প্রকৃতির জটিলতাকে প্রতিফলিত করে প্রজ্ঞা এবং ধ্বংসাত্মক বিশৃঙ্খলা লালনের দ্বৈততার প্রতীক। ইয়াগা মানব  মানসিকতার অচেতন এবং নিপীড়িত দিকগুলির প্রতীক, মানুষের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ভয় এবং আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। লোককাহিনীতে বাবা ইয়াগার মুখোমুখি হওয়া প্রকৃতই ছায়ার সাথে সংঘর্ষ হিসাবে দেখা যেতে পারে, যা মানুষকে  তাদের অভ্যন্তরীণ ভয় এবং প্রতিবন্ধকতার  মুখোমুখি হতে বাধ্য করে।  বাবা ইয়াগা একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির ভয়, বিশ্বাস এবং মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করে। তার চরিত্রটি সাংস্কৃতিক উদ্বেগের প্রতীক এবং একটি সতর্কতামূলক ব্যক্তিত্ব হিসাবে কাজ করে, সামাজিক রীতিনীতি এবং নৈতিক পাঠ শেখায়। একদিকে গল্পগুলিতে ইয়াগা যেমন নারীর ক্ষমতায়ন এবং স্বাধীনতা তুলে ধরেছে অপরদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অবদমনের কারণে কোনো গল্পে সে হয়ে উঠেছে খল নায়িকা।  বাবা ইয়াগার সাথে প্রকৃতি সম্পর্কিত। গভীর অরণ্যে তার বাস । অরণ্য যদি রহস্য, গভীরতা, মানুষের অচেতন  হয় তাহলে মনস্তাত্ত্বিক পরিভাষায়, সেই  গভীর অরণ্যে অর্থাৎ মনের অবচেতনে  বাবা ইয়াগার বাসস্থান। সে  অচেতন এবং মানুষের মানসিকতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা রহস্যগুলির অনুসন্ধানের প্রতীক হতে পারে।

সোভিয়েত সমাজে রুশ লোককথার গুরুত্ব অপরিসীম।  সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য ভাষা যেমন ইউক্রেনীয়, বেলারুশীয়, জর্জিয়ান, আর্মেনিয়ান  ভাষার আধিপত্য বিস্তারে রাশিয়ার ভাষা   সংরক্ষণ  জরুরী হয়ে পরে।  তাই এই ভাষার সংরক্ষণ, শব্দ ভান্ডার, ব্যাকরণ এবং শৈলী বজায় রাখার জন্য  লোককথা সংগ্রহ শুরু হয়। কাহিনীগুলি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠী এবং অঞ্চলগুলির মধ্যে জাতীয় ঐক্য এবং গর্বের অনুভূতি বাড়ানোর একটি উপায় হিসাবে দেখা দিতে থাকে। এর ফলে  রাশিয়ার জনগণের সাধারণ ঐতিহ্য, মূল্যবোধ এবং আকাঙ্ক্ষাগুলি প্রদর্শন করে এবং প্রতিটি গোষ্ঠী এবং অঞ্চলের বৈচিত্র্য এবং স্বতন্ত্রতা প্রকাশ পায়। বন্ধুত্ব, আনুগত্য, সাহস, ন্যায়বিচার,  সহানুভূতি, সহযোগিতা বিস্তারিত হয়।

রুশ লোককাহিনীগুলি সোভিয়েত জনগণের শৈল্পিক এবং সাহিত্যিক সৃজনশীলতাকে অনুপ্রাণিত করতে থাকে।   লোককাহিনীগুলি লেখক, কবি, শিল্পী, সুরকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মীদের জন্য উপাদান এবং অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠতে থাকে। রাশিয়ান লোককাহিনীর উপর ভিত্তি করে বা প্রভাবিত বিখ্যাত রচনাগুলির কয়েকটি হলো, আলেকজান্ডার পুশকিনের  " দ্য টেল অফ জার সালটান",  পিটার ইয়ারশোভের " দ্য হাম্পব্যাকড হর্স", ইগোর স্ট্রাভিনস্কির" দ্য ফায়ারবার্ড",  নিকোলাই রিমস্কি-কোরসাকভের "দ্য স্নো মেইডেন", ইভান বিলিবিনের " দ্য টেল অফ ইভান সারেভিচ " এবং "গ্রে উলফ", আলেকজান্ডার রাউয়ের "মোরোজকো", আলেকজান্ডার পতুশকোর "ভাসিলিসা দ্য বিউটিফুল"। 

স্লাভিক লোককাহিনীর রহস্যময় চরিত্র বাবা ইয়াগা গল্পের প্রেক্ষাপট এবং সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন প্রতীকী অর্থ ধারণ করে। কারও মতে,  প্রাচীন স্লাভিক দেবতা ভেলেসের স্ত্রী মৃত্যুর দেবী  উসোনশা ভিয়েনাই হলো বাবা ইয়াগা।  নিবিড়   প্রকৃতি এবং বন্য শক্তির সাথে বাবা ইয়াগার সম্পর্ক রয়েছে। লোকালয়ে তাকে বাস করতে দেখা যায় না। ঘন অরণ্য, অন্ধকার,  মুরগীর পায়ের উপর কুটীর এইসকল  বুনো গন্ধ বহন করে। বন্য পরিবেশের আঁধার বা জটিল, রহস্যময়, দুর্ভেদ্য স্থান তার বাসভূমি। বাবা ইয়াগার ক্রমাগত ঘুর্ণায়মান কুটীর জীবন, মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের আবর্তন  চক্রের   প্রতীক।   সে প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার একজন অভিভাবক, মানুষকে জীবনের অস্থায়িত্ব এবং মৃত্যু ও পুনর্জন্মের ক্রমাগত চক্রের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।   আর কুটীরের ভিতরের রহস্য উদঘাটন করতে পারলে হয়তো  মানুষের গহীন মনের সন্ধান পাওয়া যাবে। অবচেতন মনের ভয়, দ্বিধা,  সংশয়, অমীমাংসিত সমস্যাগুলিতে বিজয় অর্জন করতে পারবে মানব সমাজ। বাবা ইয়াগা স্লাভিক লোককাহিনীতে সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং ঐতিহ্যের প্রতীক হিসাবে কাজ করে। ইয়াগা  প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা প্রজ্ঞা, বিশ্বাস এবং ঐতিহ্যের প্রতীক, যা মানুষকে তাদের সাংস্কৃতিক শিকড়ের সাথে সংযুক্ত করে। ইয়াগার  মুখোমুখি হওয়া অনিশ্চয়তা এবং জীবনের রহস্যের মুখোমুখি হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। 

 ইয়াগার চরিত্রে রুশ সমাজের দৃঢ় প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। বাবা ইয়াগা রাশিয়ান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সে  রাশিয়ান লোককাহিনীর সমৃদ্ধি এবং গভীরতার প্রতিনিধিত্ব করে। তার চরিত্রটি স্লাভিক পৌরাণিক কাহিনীর রহস্য এবং জটিলতার প্রতীক। বাবা ইয়াগা রাশিয়ান সাহিত্য এবং শিল্পকলায় একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।  অনেক বিখ্যাত রাশিয়ান লেখক, কবি এবং শিল্পী তাদের রচনায় তার চরিত্রটি অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ইয়াগা আলেকজান্ডার পুশকিন এবং নিকোলাই গোগোলের মতো বিখ্যাত লেখকদের রচনায় উপস্থিত হয়েছে, যা রাশিয়ান সাহিত্য ঐতিহ্যে তার স্থানকে দৃঢ় করেছে। বাবা ইয়াগার গল্পগুলি শিশুদের  নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষাগত প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়।  সাহসিকতা, অপরের  প্রতি শ্রদ্ধার মতো গুণাবলী শেখাতে শিক্ষক, শিক্ষিকা,  বাবা, মা, বাবা ইয়াগার গল্পগুলি ব্যবহার করেন। ইয়াগা রাশিয়ার সমাজের জটিলতা,   সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি প্রতীক।

রুশ দেশের উপকথায় বাবা ইয়াগা অনেকাংশে জুড়ে অবস্থান করছে। পৃথিবীর সকল দেশেই ডাইনী, রাক্ষসী চরিত্রের অভাব নেই। তারা প্রায় সকলেই, " হাউ মাউ খাউ" বলে এগিয়ে এসে গল্পে ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করে। বর্তমান যুগে ডাইনী প্রথা কুসংস্কারের পরিচায়ক৷ অস্বাভাবিক কিছু ঘটলেই ডাইনী অপবাদ দিয়ে সমাজের চোখে ঘৃণ্য করে তোলার প্রয়াস নতুন নয়। বিভূতিভূষণের "পথের পাঁচালী " কিংবা তারাশঙ্করের " ডাইনি" গল্প তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ। তবে রাশিয়ার উপকথায় শিশুমনে বাবা ইয়াগা ভীতি সঞ্চার করলেও সে অভিভাবক, পথ প্রদর্শক, পরোপকারী। সমাজের লোকসমাগম থেকে বহুদূরে থেকেও ইয়াগার উপস্থিতি অস্বীকার করার উপায় নেই। এখানেই তিনি স্বতন্ত্র।